#টুয়েন্টি_মিনিটস (চ্যাপ্টার-০১)
পর্ব-০৭
লেখা: ShoheL Rana শামী
রাত নেমেছে। জ্যোৎস্না রাত। চাঁদের আলোতে সুফিয়াদের বাড়ির উঠোনে চলতে লাগলো খেলা। হাডুডু খেলা। এবার শুধু বাচ্চারা না। কিশোর, যুবতী এমনকি এ বাড়ি ও বাড়ির বউরাও এসে হাজির খেলতে। চলছে পুরোদস্তুর খেলা। জাফর মাস্টারের সাথে বাইরে চেয়ার নিয়ে বসে খেলা দেখছে রিহান। সবাই খুব মনোযোগী আজ খেলায়। হয়তো নতুন এই অতিথিকে দেখানোর জন্যই সবার মনে খেলায় ভালো পারফরম্যান্স করার একটা তাগাদা চলছে। নতুন অতিথির চোখে ভালো খেলোয়াড় হতে হবে তো! খেলার সময় সুফিয়া একেবারে বাচ্চা হয়ে যায়। এত দৌড়াতে পারে মেয়েটা। জাফর মাস্টার এবার শুরু করলেন খেলাধুলার উপকারিতা নিয়ে বেশকিছু কথা। মাস্টার মানুষ, লেকচার দেয়াটাই স্বাভাবিক।
‘বুঝছো রিহান মিয়া, এই যে বাচ্চারা খেলে, এতে অনেক উপকার হয়। খেলাধুলা বাচ্চাদের পাশাপাশি বড়োদেরও প্রয়োজন। এতে শরীরের পাশাপাশি মনও ভালো থাকে। এই যে এরা দৌড়াদৌড়ি করছে, ওদের শরীর থেকে ঘাম ঝরছে। এতে কি শুধু শরীরের ময়লা বের হচ্ছে? না, এতে মনের ময়লাও বের হয়। মন পরিষ্কার হয়। খেলাধুলার পর পড়ালেখা করলে, পড়া খুব মনে থাকে।’
রিহান চুপচাপ শুনছিল। কিন্তু, কোনো প্রত্যুত্তর না করলে হয়তো খারাপ দেখায় ব্যাপারটা। তাই বললো, ‘জি আংকেল। খেলাধুলার উপকারিতা আসলে শেষ করা যাবে না। খেলাধুলা মানুষকে রোগ-বালাই থেকে রক্ষা করে।’
‘আমার বয়স কত জানো এখন?’
‘কত?’
‘ষাট। আমাকে কি ষাটের বয়সী মনে হয়?’
‘না, এখনও শক্ত সামর্থ্য তরুণ মনে হয়।’
‘এগুলো খেলাধুলার ফল। খেলাধুলা মানুষের বার্ধক্য দেরিতে আনে।’
‘যদি এসব খেলাধুলা একসময় হারিয়ে যায় আংকেল?’
জাফর মাস্টার দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। খানিক দম নিয়ে বললেন, ‘তখন আর কী হবে, মানুষের শরীরের সাথে সাথে মস্তিষ্কের বিকাশটা পিছিয়ে পড়বে, স্মরণ-শক্তি কমে যাবে, রোগ-বালাই বাড়বে। আর অল্প বয়সে বার্ধক্য নেমে আসবে জীবনে।’
জাফর মাস্টারের কথা শুনতে শুনতে রিহান নিজের যুগ আর এই যুগের পার্থক্যগুলো অনুধাবন করতে লাগলো। অতীতের এই যুগটাতে মানুষের মধ্যে কত মিল ছিল, একতা ছিল। এই মিল-মহব্বত ধীরে ধীরে লোপ পাবে একটা সময়ে এসে। মানুষ একা থাকতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করবে। মোবাইল নামক যন্ত্রটার সাথে বানিয়ে নেবে নিজস্ব এক জগত।
বাড়ির ভেতর হঠাৎ ‘খুট খুট’ শব্দ হলো। মাস্টার সাহেব উঠে ভেতরে গেলেন। রিহানও পিছুপিছু গেল ভেতরে। ঘরের লাইট জ্বালানো ছিল। তাই স্পষ্ট দেখা গেল, এক লোক ঘরের ভেতর ঢুকে চাল চুরি করছে। মাস্টার সাহেবকে দেখে লোকটা থতমত খেয়ে ভয় পেয়ে গেল। ত্বরান্বিত হয়ে চালগুলো পুনরায় রেখে মাস্টার সাহেবের পাশে লুটিয়ে পড়লো লোকটা। তারপর কান্নায় ভেঙে পড়লো, ‘মাস্টার সাব, মাস্টার সাব, মাফ কইরা দ্যান। ঘরে খাওনের কিছু ছিল না, তাই চুরি করবার আইছি।।’
জাফর মাস্টার লোকটাকে ধমকালেন না। উল্টো আশ্বস্ত করে বললেন, ‘ভয় পেয়ো না। আর চিৎকার করো না। লোকজন এসে পড়বে।’
লোকটা এবার কান্না কিছুটা থামিয়ে বললো, ‘বাচ্চা দুইডা গতকাইল থেইকা না খাইয়া রইছে মাস্টার সাব। হাতেও কোনো কাম কাজ নাই। কী করবো কন।
‘ঠিক আছে, ঠিক আছে। তোমার যত খুশি চাল নাও ওখান থেকে। কোনো দরকার হলে আমার কাছে চাইবে। চুরি করো না, কেমন?’
‘ঠিক আছে মাস্টার সাব।’ বলেই এক থলে চাল নিলো লোকটা। চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই দেখলো দরজায় দাঁড়িয়ে আছে ঘর্মাক্ত সুফিয়া। আবারও ভয় পেয়ে দাঁড়িয়ে গেল লোকটা। জাফর মাস্টার মেয়ের উদ্দেশ্যে নরম স্বরে প্রশ্ন করলো, ‘ঠিক করিনি মা?’
সুফিয়া হাসলো। মাথা কাত করে বাবার সাথে সম্মত হলো। এমন বাবার মেয়ে কি আর অমত হতে পারে?
‘আপনার মেয়ে আপনার মতোই দয়ালু হয়েছে আংকেল।’ বলে ওঠলো রিহান। লোকটা চলে গেল সুফিয়াকে পাশ কাটিয়ে। সুফিয়ার দিকে তাকালো রিহান। প্রশংসা গায়ে মাখলো না সে। এতক্ষণ খেলে হাঁপিয়ে ওঠেছে। ঘনঘন বুক উঠানামা করছে। কপাল বেয়ে ঘাম ঝরে নীল ব্লাউজটা ভিজিয়ে তুলছে। কপালের ঘাম মুছে এগিয়ে গেল সে অন্য একটা কক্ষে। তারপর বাবার একটা লুঙ্গি আর গেঞ্জি এনে রিহানের দিকে বাড়িয়ে বললো, ‘নিন, পরে নিন এগুলো।’
‘আংকেলের কাপড়? আপনি আজ আমাকে রেখে দিবেন জানলে আমার ব্যাগসহ আনতাম। ওখানে আমার কাপড় আছে। লুঙ্গিও আছে।’
‘আপনারগুলো না এনে ভালোই করেছেন। এখানে যতদিন আছেন, বাবারগুলোই পরুন।’
‘ঠিক আছে।’ কাপড়গুলো হাতে নিলো রিহান। ‘আপনি তো ঘেমে একেবারে গোসল হয়ে গেছেন?’
‘আপনিও খেলবেন না-কি মেয়েদের সাথে?’
‘না, না, আপনারাই খেলুন।’
‘ঠিক আছে, এগুলো পরে বাইরে আসুন। আর শুনুন, কোনো মেয়ের দিকে নজর দিয়ে লাভ নাই। ওখানে বেশিরভাগ এ বাড়ি ও বাড়ির বউ।’ বাবাকে বের হয়ে যেতে দেখে শেষের কথাটা গলা নিচু করে বললো সুফিয়া। তারপর হেসে বের হয়ে গেল।
ভোর হতেই কোলাহল নেমে এলো গ্রামে। রিহান ইতোমধ্যে গ্রামের পরিবেশের সাথে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিয়েছে। ভোর বেলায় ঘুম ভাঙে তার। ঘুম থেকে উঠে বাইরে বের হতেই চোখে পড়ে বাচ্চারা দলবেঁধে মক্তবে যাচ্ছে। সুফিয়াকে কোথাও দেখা গেল না। জাফর মাস্টার বাইরে চেয়ার নিয়ে বসে কুরআন পড়ছেন। রিহানকে দেখে বললেন, ‘রিহান মিয়ার ঘুম ভাঙছে না-কি? যাও, ওখান থেকে নিমগাছের একটা ডাল ভেঙে দাঁত মেজে নাও। তারপর পুকুরঘাটে গিয়ে মুখ ধুয়ে আসো।’
বাধ্য ছেলের মতো রিহান শুনলো জাফর মাস্টারের কথা। রাতে ঘুমটা ভালোই হয়েছে আজ। দুহাত প্রসারিত করে আড়ষ্ট ভাবটা কাটালো।তারপর নিমগাছ থেকে একটা ডাল ভেঙে দাঁত মাজতে মাজতে পুকুরে গেল। বড়ো একটা পুকুর। ওখানে সুফিয়াকে পাওয়া গেল। ঘাটে বসে সে চাল ধুচ্ছিল। রিহানকে ওদিকে আসতে দেখে সে বললো,
‘নবাব সাহেবের ঘুম ভাঙলো তবে?’
‘আমি তো তাড়াতাড়িই ওঠলাম ঘুম থেকে।’
‘এটাকে তাড়াতাড়ি ওঠা বলে? আরও ভোরে ওঠবেন, যখন একটু একটু করে আলো ফুটবে। তখনকার হাওয়া গায়ে লাগাবেন। স্বাস্থ্য ভালো থাকবে।’
‘আমার কি স্বাস্থ্য খারাপ?’
‘শুধু শরীরটা থাকলেই কি স্বাস্থ্য ভালো থাকে? ভেতরের রোগ কি আর দেখা যায়? ঠিক আছে, মুখ ধুয়ে আসুন আপনি।’ বলেই সুফিয়া চাল ধোয়া শেষ করে চলে যেতে লাগলো। রিহান ঘাটে বসে কুলি করতে লাগলো।
কিছুক্ষণ পর সুফিয়া আবার এলো পুকুরঘাটে। চুলোয় চাউল বসিয়ে এসেছে সে। বাবা বাজারে যাওয়ার জন্য বাজারের ব্যাগটা খুঁজলে, সুফিয়া বাবাকে একটু বসতে বলে এদিকে চলে এসেছে। রিহানের উদ্দেশ্যে বললো, ‘এই যে স্বাস্থ্যবান, হয়নি আপনার এখনও? বসে বসে ঝিমোচ্ছেন কেন?’
‘ঝিমোচ্ছি না তো। মুখ ধুচ্ছি দেখেন না?’
‘তাড়াতাড়ি আসুন। বাবার সাথে বাজারে যাবেন।’
‘কে? আমি?’
‘তো আর কে আছে এখানে?’
‘আমি কখনও বাজার করিনি।’
‘আপনি না ঐ বাসায় বাজার করে দেন? মিথ্যা বলবেন না। তাড়াতাড়ি করুন। দেরি হয়ে গেলে পঁচা মাছ নিয়ে ফিরতে হবে।’
‘ঠিক আছে। আপনি যান। আসছি আমি।’
সুফিয়া চলে এলো। রিহান হাত-পা ধুয়ে আরও কিছুক্ষণ পর এলে একটা তোয়ালে এগিয়ে দিলো সুফিয়া তার দিকে, ‘নিন, হাত-মুখ মুছুন।’
রিহান তোয়ালেটা হাতে নিলো। এটা গতকালের সেই তোয়ালেটা, যেটা সুফিয়া তার চুলে প্যাঁচিয়েছিল। তোয়ালেটা দিয়ে রিহান হাত মুছলো। মুখ মুছতে গিয়ে অনেকক্ষণ চেপে ধরলো মুখে তোয়ালেটা। সুফিয়ার যেন গন্ধ লেগে আছে এটাতে। মিষ্টি একটা গন্ধ। রিহান তোয়ালেটা মুখ থেকে সরাচ্ছে না দেখে সুফিয়া টান দিয়ে নিয়ে নিলো। তারপর বাবার উদ্দেশ্যে বললো, ‘বাবা, বাজারের ব্যাগটা উনার হাতেই দিয়ো। খুব স্বাস্থ্যবান উনি।’
জাফর মাস্টার হাসলেন। বললেন, ‘বেচারা ছেলেটাকে আর জ্বালাস না। চলো রিহান, বাজার থেকে ঘুরে আসি।’
‘চলুন।’ বেরিয়ে গেল দুজন বাজারের উদ্দেশ্য। বেশি দূরে না বাজারটা। হেঁটেই যাওয়া যায়। মাস্টার সাহেবের পোশাক পরে হাঁটতে কিছুটা অস্বস্তি লাগছে রিহানের। নিজের যুগে এই পোশাকে হাঁটলে লোকজন হা করে চেয়ে থাকতো। পাগল বলে টিটকারি করতো। যেমনটা এখন এই যুগের লোকেরা করছে রিহানের পোশাক নিয়ে। সময়ের সাথে সাথে মানুষের পোশাকেও পরিবর্তন আসে।
রিহান ভেবেছিল সে আজ অনেক ভোরে ঘুম থেকে ওঠেছে। কিন্তু বাজারে এসে তার ধারণা পালটে গেল। ইতোমধ্যে মানুষের অর্ধেক কাজ শেষ হয়ে গেছে। জাফর মাস্টার রিহানকে নিয়ে বাজারে ঘুরে ঘুরে মাছ কিনলো, সবজি কিনলো। তিন আঁটি শাকও কিনলো, লাল শাক। ফেরার সময় দেখলো একটা ছোট্ট মেয়ে গাঁদা ফুলের মালা বিক্রি করছে। রিহান দাম জিজ্ঞেস করলে জানালো মালা প্রতি এক পয়সা। রিহান জাফর মাস্টারের দিকে চেয়ে ইতস্তত করে বললো, ‘আংকেল, এক পয়সা পাবো আপনার কাছে?’
‘কেন?’
‘মালা কিনবো। সুফিয়ার খোপায় মানাবে মালাটা।’
জাফর মাস্টার হেসে রিহানের হাতে দশ পয়সা দিয়ে বললেন, ‘বাকিগুলো তুমি রেখো। খরচ করবা।’
রিহানও হাসলো। পকেটে যখন চাহিদার অতিরিক্ত পয়সা এসে গেল, তখন খরচ করতে মানা নাই। দুই পয়সা দিয়ে সে দুইটা মালা কিনে নিলো। তারপর ফিরতে ফিরতে ভাবতে লাগলো সুফিয়ার চুলের খোপায় কেমন দেখাবে এই মালা।
বাড়িতে যখন ফিরলো, রিহান অবাক হয়ে গেল সুফিয়ার কাণ্ড দেখে। রিহান রাতে তার শরীর থেকে যে শার্ট-প্যান্ট খুলে রেখেছিল, ওগুলো সুফিয়া যত্ন করে ধুয়ে রোদে শুকোতে দিচ্ছে। রিহান বাজারের ব্যাগ নিয়ে দ্রুত এগিয়ে গিয়ে বলে, ‘এ কী করলেন আপনি? আমি ধুতে পারতাম তো এসে।’
‘এখন সমস্যাটা কী হলো?’ গম্ভীর মুখে কথাটি বলে রিহানের হাত থেকে বাজারের ব্যাগটা হাতে নিলো সুফিয়া। ভেতরে কী কী আছে দেখতে দেখতে বললো, ‘দুজন মিলে বাজারে গেছেন, পঁচা মাছ সবজি আনলে আজ দুজনের খবর আছে।’
‘সব ঠিক আছে। দেখেশুনে নিছি আমরা।’ বলেই রিহান জাফর মাস্টারের দিকে নজর দিলেন। মাস্টার সাহেব এরই মধ্যে কিছুটা দূরে একটা লিচু গাছের চারায় পানি দিতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। রিহান নিচু স্বরে সুফিয়াকে বললো, ‘আপনার জন্য দুইটা মালা আনছি। গাঁদা ফুলের মালা।’
সুফিয়া বাজারের ব্যাগ নিয়ে চলে যাচ্ছিল। রিহানের কথা শুনে থমকে দাঁড়ালো। তার দিকে ঘুরে মৃদু হাসলো সে। কিছুটা অবাক হয়ে প্রশ্ন করলো, ‘মালা আনছেন?’
‘হুমম… এই যে।’ সুফিয়ার হাতে মালা দুটো দিলো রিহান। খুব খুশি দেখালো তাকে। নেড়েচেড়ে মালাজোড়া দেখতে দেখতে বললো, ‘পয়সা কোথায় পাইছেন?’
‘আংকেল থেকে নিছি।’
‘বাবা থেকে নিছেন?’ চাপা স্বরে হাসলো সুফিয়া। কী মিষ্টি লাগছে এই মুহূর্তে তাকে। এই খুশি চেহারাটাতে সুফিয়াকে কয়েকগুণ সুন্দর লাগলো। হঠাৎ হাসি থামিয়ে, সুফিয়া মালা জোড়া রিহানকে ফিরিয়ে দিয়ে বললো, ‘নিজ হাতে খোপায় পরিয়ে দিতে পারবেন? তবেই নিবো।’
[[চলবে…]]