টুয়েন্টি মিনিটস (চ্যাপ্টার-০১) পর্ব ১৪

0
264

#টুয়েন্টি_মিনিটস (চ্যাপ্টার-০১)
পর্ব-১৪
লেখা: ShoheL Rana শামী

গলাটা বেশ পরিচিত মনে হলো সুফিয়ার। আবারও জিজ্ঞেস করলো সে, ‘কে আপনি?’

‘আমি রিহান।’

নামটা শুনেই চমকে ওঠলো সুফিয়া। অন্ধকারে রিহানের হাতটা শক্ত করে ধরলো, যেন বহুদিন পর একটা ভরসার হাত খুঁজে পেয়েছে। হাতটা ধরেই কান্নায় ভেঙে পড়লো সে। রিহান তাকে শান্ত হতে বলে জিজ্ঞেস করলো, ‘আপনার এ অবস্থা কেন? আপনার তো এখানে থাকার কথা না।’

কয়েক মুহূর্ত লাগলো সুফিয়ার নিজেকে সামলাতে। তারপর কী কারণে সে বন্দী হলো খুলে বললো। শুনে রিহান বললো, ‘সাহসীদের কখনও দমে যেতে নেই। আপনি যে বখাটে লোকটার কাছে হার মানেননি এটাই আপনার বড়ো পরিচয়।’ সব মেয়ে এই সাহসিকতা দেখাতে পারে না।’

‘কিন্তু আপনি কেন এখানে?’ জিজ্ঞেস করলো সুফিয়া।

‘সেদিন আপনাদের বাড়ি থেকে বের হয়ে এলে আমাকে কয়েকজন ব্রিটিশ সেনা আটক করে। আমাকে ওরা যুদ্ধের প্রশিক্ষণ দিতে ক্যাম্পে নিয়ে আসে। কয়েকদিন প্রশিক্ষণও দেয়। কিন্তু ব্রিটিশদের উপর আমার আগে থেকেই ঘৃণা জন্মে আছে। একদিন এক ব্রিটিশ সেনাকে খুন করে পালিয়ে যেতে চেয়েছিলাম। পালাতে পারিনি। পালানোর সময় আমাকে পুনরায় আটক করে এই কারাগারে বন্দী করে।’

‘নিয়তি হয়তো এটাই চেয়েছিল। দুজনকে আবার এভাবে মিলিয়ে দিলো। কিন্তু, অন্ধকারে আপনি আমায় চিনলেন কী করে? আমার কণ্ঠও তো শুনেননি।’ বিস্ময় প্রকাশ করে সুফিয়া।

‘আপনার গায়ের গন্ধটা আমার খুব চেনা। আপনাদের ওখানে কাটানো দিনগুলোতে আমি কেবল আপনাকে নিয়েই ভেবেছি। গায়ের গন্ধটাও চিনতে পারি।’

‘তবে বিয়ের কথা বলায় ওভাবে পালিয়ে এলেন যে?’

‘পালিয়ে আসিনি। বরং আপনার কষ্টটা আমার সহ্য হবে না তাই…’

‘আমার কীসের কষ্ট?’

‘বাদ দিন। আজ কত তারিখ বলতে পারেন? এখানে এই অন্ধকারে রাত-দিনের হিসাব করতে পারি না।’

‘বাইরে বের করে না কোনো সময়?

‘খাবারের টাইমে বের করে। আর প্রাকৃতিক কাজে। এই বন্দী-জীবনে তারিখের হিসাব করে কী হবে?

‘আজ আগস্টের ছাব্বিশ তারিখ।’

‘আহ! আংকেলকে আমি কথা দিয়েছিলাম, একমাস পর উনার সাথে দেখা করবো। মানে আগের মাসের দশ তারিখে আপনাদের বাসায় যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু আফসোস! পারলাম না। আমি তখনও বন্দী ছিলাম। কেমন আছে আংকেল?’

জবাব দিলো না সুফিয়া। হঠাৎ যেন স্তব্ধ হয়ে গেল সে বাবার কথা শুনে। রিহান ডাক দিলো, ‘কথা বলছেন না যে?’

‘বাবা আর বেঁচে নেই।’ খুব অসহায় শুনালো সুফিয়ার কণ্ঠ। ‘আগের মাসের দশ তারিখেই বাবা মারা যান।’

‘কী বলছেন? আংকেল মারা গেছে?’ চমকে ওঠে রিহান।

‘হ্যাঁ, সেদিন পত্রিকা পড়ে আমাকে ডাক দিয়ে কী যেন বলতে চেয়েছিল। বলতে পারেনি। আমি যেতে যেতেই তার শরীরটা নিস্তেজ হয়ে যায়।’

রিহানের মুখ দিয়ে আর কথা বের হলো না। আংকেলের সাথে আর শেষ দেখা হলো না তার। লোকটা বড্ড ঋণী করে গেল তাকে। তবে সে জানে, আংকেল নিশ্চয়ই বিশ্বাস করেছে তার কথা। রিহান যে ভবিষ্যতের লোক সেটা জেনে তারপর মারা গেছেন তিনি। ঐদিন হয়তো উনি সুফিয়াকে ডেকে এই কথাটা-ই বলতে চেয়েছিলেন, বলতে পারেননি।

রিহানের গায়ে জলের একটা ফোঁটা পড়লে সে হাতড়ে সুফিয়ার চোখ মুছে বললো, ‘সাহসীরা কাঁদে না। আচ্ছা, আপনি আমাকে বলতে পারেন, সেদিন পত্রিকায় কি কাজী নজরুলের কোনো খারাপ সংবাদ ছাপিয়েছিল?’

‘হ্যাঁ। কেন?’

‘ওটা বলতেই ঐদিন আংকেল আপনাকে ডেকেছিল।’

‘সত্যি তো?’

‘হ্যাঁ।’

‘কিন্তু, পত্রিকার সংবাদটা আপনি কী করে জানেন?’

রিহান চুপ করে থাকে। সুফিয়া পুনরায় বলে, ‘আপনি বারবার বলেন না, আপনি ভবিষ্যত থেকে এসেছেন? আপনি ভবিষ্যতের হোন বা না হোন, আপনাকে খুব বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হয় এখন। আমার মাথায় হাত রাখারও কেউ রইলো না আর।’

‘আপনি জানেন, এই কারাগারের ছোটো ছোটো কক্ষগুলোতে কাদের রাখা হয়?’ জিজ্ঞেস করলো রিহান।

‘না।’ অস্ফুটে জবাব দিলো সুফিয়া।

‘যাদেরকে ওরা ফাঁসি দিয়ে মৃত্যুদণ্ড দেবে, তাদেরকে এখানে রেখেছে ওরা।’

‘আপনি কী করে জানেন?’

‘কারণ, অনেক মৃত্যু দেখেছি এখানে। আমি যে বাড়িতে থাকতাম, জাকারিয়া সাহেবদের, ঐ বাড়িতে কমল নামে এক লোককে ব্রিটিশরা খোঁজ করেছিল মনে আছে? বলেছিলাম।’

‘হ্যাঁ, মনে আছে।’

‘কমলকে ওরা আটক করে এখানে এনেছিল। তিনদিন আগে ওর ফাঁসি হয়েছে। আমি নিজ চোখে ওর ফাঁসি দেখেছি।’

‘আমাদেরও ফাঁসি হবে?’

‘হুমম, তবে আপনার ফাঁসি হতে দেরি হবে। আমার হয়তো খুব তাড়াতাড়ি হবে ফাঁসি। ক্যাম্পে ব্রিটিশদের একটা আদালত আছে। ওখানে ফাঁসির রায় দেয়া হয়।’

সুফিয়া হালকা কেঁপে উঠলো কথাটা শুনে। নিজের ফাঁসি হোক, আপত্তি নেই। কিন্তু রিহানের ফাঁসি হবে শুনে ভেতরটা তার ‘হু হু’ করে ওঠলো। নিজেকে সামলিয়ে সে জিজ্ঞেস করলো, ‘অনেকেই তো নির্দোষ। তাদেরও ফাঁসি হবে?’

‘হ্যাঁ হবে। তাদের একটাই দোষ, তারা ব্রিটিশদের মতের বিপক্ষে। এখানে আদালতটা কেবল নামেই। ন্যায়-বিচার এখানে হয় না।’

সুফিয়া আর কিছু বললো না। তবে সেই থেকে রিহানের হাতটা শক্ত করে ধরে আছে, ছাড়ার নাম নেই। ছাড়লেই যেন রিহান আবার হারিয়ে যাবে বহুদূরে।

রাতের খাবার দিতে এলো দুজন গার্ড। একজনের হাতে একটা মশাল, অন্যজনের হাতে খাবার। রাতের খাবারটাই কেবল ওরা কক্ষে এসে দিয়ে যায়। সকালে আর দুপুরে বন্দীদের বাইরে নিয়ে যাওয়া হয় খেতে। খাবার রেখে একজন বেরিয়ে গেল, অন্যজন মশাল ধরে পাহারা দিচ্ছিল। মশালের আলোতে রিহান এবং সুফিয়া পরস্পরকে দেখলো। তবে গার্ডকে বুঝতে দিলো না ওরা পরস্পরের পরিচিত। সুফিয়া ভালো করে দেখে নিলো রিহানকে। বন্দী থাকতে থাকতে মুখভর্তি দাড়ি হয়েছে তার। চোখগুলো অনেকটা ভেতরে ঢুকে গেছে। আর অনেকটা শুকিয়ে গেছে সে। তার এমন অবস্থা দেখে খুব কষ্ট হলো সুফিয়ার। তবে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালো না। খাবারটা টেনে নিলো দুজনে। তারপর শেকল বাঁধা অবস্থায় খেতে লাগলো। ধীরে ধীরে খেতে লাগলো দুজন। যেন মশালের আলোতে পরস্পরকে আরেকটু বেশি সময় নিয়ে দেখতে পারে। খাওয়া শেষ হয়ে গেলেই তো আবার বদ্ধঘরে অন্ধকার নেমে আসবে। আবার পরস্পরকে দেখতে পারবে সেই সকালে ব্রেকফাস্টের সময়। খেতে দেরি হচ্ছে দেখে গার্ড তাগাদা দিলো, ‘দ্রুত খাও।’

তারপরও আরও অনেকক্ষণ লাগলো ওদের খাবারটা শেষ করতে।

বদ্ধ কক্ষে আবারও অন্ধকার নেমে এলে সুফিয়া পুনরায় রিহানের হাতটা শক্ত করে ধরে থাকলো। সারারাত এভাবেই কাটালো দু’জন।

সকালে দুজনকে শেকল পরা অবস্থায় কক্ষ থেকে বের করা হলো ব্রেকফাস্টের জন্য। তখন সুফিয়া দেখলো এখানকার আসল চিত্র। শত-শত বন্দী এখানে অসহায়ভাবে জীবন কাটাচ্ছে। প্রত্যেকের হাতে-পায়ে শেকল পরা। এদের প্রত্যেককে হয়তো ফাঁসিতে ঝুলানো হবে। সামনে একটা বড়ো মাঠ। মাঠের মাঝখানে একটা ফাঁসির মঞ্চ সাজানো। কে জানে এই পর্যন্ত ঐ ফাঁসির মঞ্চটা কতজন নিরীহ মানুষের প্রাণ নিয়েছে। এই যে শেকল পরা লোকগুলো এখন খেতে এসেছে। কার ভাগ্য কখন কাকে ওখানে নিয়ে যায় কে বলতে পারে?

বন্দীরা এখানে কখনও তৃপ্তিভরে খেতে পারে না। সকালে তো চলে নামেমাত্র খাবার। হালকা নাস্তা। একটা রুটি দুজনকে ভাগ করে খেতে হয়। ব্রিটিশরা হয়তো খাবার দেয়ার সময় চিন্তা করে, ‘যারা মরবে, তাদেরকে এত খাবার দিয়ে লাভ কী?’

রিহান এবং সুফিয়াকে একটা রুটি দিলো। রিহান অল্প একটু ছিঁড়ে নিয়ে প্রায় পুরোটা সুফিয়াকে দিয়ে বললো, ‘এখানে না খেয়ে থাকতে থাকতে আমার অভ্যাস হয়ে গেছে, আপনি খান এটা।’

‘কিন্তু, আপনি না খেলে আমার কষ্ট হবে। শরীরের খুব খারাপ অবস্থা হয়ে গেছে আপনার।’ বললো সুফিয়া।

কৃত্রিম হেসে রিহান বললো, ‘এখানে আর আমার সৌন্দর্য কে দেখবে বলুন? ঐ ফাঁসির মঞ্চে যে কোনো সময় ডাক পড়তে পারে আমার।’

রিহানের কথাটা শেষ হওয়ার আগেই সুফিয়ার চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়লো। শেকলসহ দুহাত তুলে চোখ মুছে বললো, ‘ওভাবে বলবেন না। অনেকদিন পর আপনাকে পেয়েছি, এত তাড়াতাড়ি হারাতে চাই না।’

‘নিজেকে সংযত করুন। ব্রিটিশরা আশেপাশে ঘুরছে। আমরা পরস্পরের পরিচিত জানলে অন্য কক্ষে নিয়ে যাবে আপনাকে।’ সাবধান করলো রিহান।

সুফিয়া তখন মাথা নিচু করে খেতে লাগলো ধীরে ধীরে। একজন ব্রিটিশ অফিসার হাতে একটা লিস্ট নিয়ে এলেন কিছুক্ষণ পর। এই লিস্টটা বন্দীদের জন্য কোনো কাগজের লিস্ট নয়, এটা যেন মৃত্যুদূত। আর অফিসারটা আসা মানে কারও না কারও মৃত্যু কার্যকর হবে। অফিসারটা কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে লিস্টে চোখ বুলালেন। সবার বুক দুরুদুরু করে কাঁপতে লাগলো। আজ উনি কার নাম ধরে ডাকবেন? কাকে তুলে নেবেন ফাঁসির মঞ্চে? খাবার আর মুখ দিয়ে গেল না কারও। অফিসারটা ইংরেজিতে ডাক দিলেন, ‘কয়েদি নং ৯৭’

নিজের নাম্বারটা শুনে একজন শেকল পরা বন্দী কান্নায় ভেঙে পড়লো ওখানে। তাকে ধরে কয়েকজন ব্রিটিশ সেনা টানতে টানতে নিয়ে গেল ফাঁসির মঞ্চে। তাঁর চিৎকার কারও হৃদয় স্পর্শ করলো না। একটু পর তার শেকলটা খুলে ফাঁসির জন্য প্রস্তুত করা হলো। সুফিয়া বাকিটা আর দেখতে পারলো না। ওদিক থেকে চোখ সরিয়ে কক্ষের দিকে হাঁটতে লাগলো। শেকল পরায় দ্রুত পা চালাতে পারলো না। তাকে অনুসরণ করলো রিহান। একটু পর জোরে একটা আর্তনাদ এলো ফাঁসির মঞ্চ থেকে। সুফিয়ার সারা শরীর কেঁপে ওঠলো।

একজন গার্ড ওদের দুজনকে আবার তাদের কক্ষে ঢুকিয়ে বাহির থেকে বন্ধ করে দিলো। ভেতরে ঢুকে কান্নায় ভেঙে পড়লো সুফিয়া। রিহান তাকে আলতো করে ধরে সান্ত্বনা দিতে লাগলো। অন্ধকারে সুফিয়া রিহানের কাঁধে মাথা রেখে কাঁদতে কাঁদতে বললো, ‘এসব আমি আর দেখতে পারবো না। আপনি আমাকে এখান থেকে নিয়ে চলুন।’

রিহান কী জবাব দেবে ভেবে পেল না। সুফিয়াকে এভাবে ভেঙে পড়তে দেখে নিজেকে সে শক্ত রাখলো। বললো, ‘ধৈর্য ধরুন। শক্ত হোন। আপনি এখন থেকে মনোবল হারালে, আমিও দুর্বল হয়ে পড়বো আরও।’

সুফিয়া আরও কিছুক্ষণ কেঁদে চললো। একটু পর কক্ষের দরজা খোলার শব্দ হলে চোখ মুখ মুছে পুরোপুরি শান্ত হলো সে। একটা মশাল হাতে ভেতরে ঢুকলো একজন গার্ড। গার্ডটা বাঙালি। তবে ব্রিটিশদের চাটুকার। সে এসে রিহানের উদ্দেশ্যে বললো, ‘রিহান সাহেব, আপনি প্রস্তুত থাকুন। দুপুরের খাবারের পর আপনাকে আদালতে নিয়ে যাওয়া হবে। আজ আপনার রায় হবে ওখানে।’

গার্ড পুনরায় চলে গেল কথাটি বলে। থমকে বসে পড়লো রিহান। কী রায় হবে সে জানে। সবারই তো একই রায় হয়। সুফিয়াও থমকে গেল। রিহানের হাত শক্ত করে ধরে জিজ্ঞেস করলো, ‘কী বলে গেল এই লোকটা? কী বলে গেল?’ চিৎকার করে ওঠলো সুফিয়া। বদ্ধ ঘরে প্রতিধ্বনি হলো সেই চিৎকারের।

[[চলবে…]]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here