#জ্বালাতে_রং_মশাল 🖤
#ইফা_আমহৃদ
||পর্ব: ০৯||
দাঁতের গোড়া থেকে রক্ত ঝরছে। দাঁত নড়ে গেছে। ব্যথা লাগছে ভিশন। আয়নাতে রক্ত দেখে ঘাবড়ে গেলাম আমি। নির্ঘাত সমুচাতে পাথর ছিল। আগে এমন হয়নি কখনো। এই অপূর্ব ভাই আমার জন্য অশুভ। তার সাথে দুইদিন খেতে এসেছি দুইদিনই এই ঝামেলা। দাঁত হাত দিতেই নড়ে গেল। যখন তখন পড়ে যাওয়ার আশঙ্কা। মনে মনে দৃঢ় প্রতিজ্ঞা করলাম, ‘অপূর্ব ভাইয়ের সাথে কখনো খেতে বের হবো না।’
অপূর্ব ভাই ততক্ষণে পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে। উল্টো ঘুরে দাঁড়ানোর ফলস্রুতিস্বরুপ আমার মুখ তার না-দেখা। আয়নাতে দেখলাম একবার। তিনি বলেন, “আরু, কোনো সমস্যা হয়েছে? এবারে ছুটে এলি যে।”
“না, এমনি ছুটল ইচ্ছে করল, অনেকদিন ছোটা হয়না। আপনাকেও সাথে ছোটালাম।”
খেয়াল করলাম কথার বলার সময় দাঁত নড়তে। সামনের দাঁতটা পড়ে গেলে সবাই আমাকে ব্যঙ্গ করবে। ভাঙা আয়নার সাথে ভাঙা দাঁত যুক্ত হবে। কাঁদতে ইচ্ছে করল প্রচুর। ভ্যাঁ করে কেঁদে দিলাম। বিস্মিত হল অপূর্ব ভাই। আয়না দিয়ে আমার দিকে তাকালেন। আঁতকে উঠলেন। ওষ্ঠের ফাঁক দিয়ে রক্ত গড়িয়ে নিচে পড়ছে। দ্রুত তার দিকে ফিরিয়ে নিলেন। তড়িগড়ি করে বললেন, “কী করে হল।”
আমি হাতের সহায়তায় উপরের ওষ্ঠ উপরে তুলে নিলাম। ধীরে কণ্ঠে বললাম, “তমুতায় তাথর।”
“কী? কিছু বুঝতে পারছিনা। ভালোভাবে বল।”
বেশ কয়েকবার চেষ্টা করলাম। কিন্তু ফলাফল শূন্য। উল্টো যাচ্ছে কথা। ওষ্ঠ ছেড়ে দিলে আবার দাঁতে ব্যথা পাই। আমি কোনো কথা বললাম না। চুপ করে রইলাম।
ডানহাতে ওষ্ঠ উঁচু করে বসে আছি। ডাক্তার মেডিসিন দিয়েছেন। সকালে দুই গ্লাস ফলের রস খেয়েছি। মা বাবা, মামা মামনি এখনো আসেনি বাড়িতে। অপূর্ব ভাই বললেন, তারা গ্ৰামে গেছেন। দাদাজান খুব অসুস্থ। আজকে আসতে পারবেন না। তুর আমার পাশে বসে আছে বই নিয়ে। দু’জনে বিজ্ঞানের ছাত্রী হওয়ার সুবাদে একই বই দিয়ে পড়ছি। আমি মনে মনে পড়ছি। অপূর্ব ভাই রান্না করছেন। মাথা ঘুরল হঠাৎ। তিঁতকুটে ঢেকুল উঠল। আমি মুখ চেপে ধরলাম। ছুটে গেলাম ওয়াশরুমের দিকে। বেসিনের উপর মুখ রাখার পূর্বেই বমি করে ভাসিয়ে দিলাম। মাথাটা ঘুরছে। খালি পেটে ফলের রস খাওয়ার দরুন এমন অবস্থা হয়েছে। আমারই দোষ! অপূর্ব ভাই খেতে বারণ করেছিলেন। আমি কর্ণপাত করিনি। ক্ষুধায় তখন কিছু মাথায় আসেনি। ট্যাপ ছেড়ে পরিষ্কার করলাম। মুখে পানি দিয়ে কুলকুচি করলাম।
তুর আমার কাছে ছুটে এসে বলে, “তখন বারবার ভাইয়া রস খেতে বারণ করল শুনলি না।”
অসহায় দৃষ্টিতে অবলোকন করলাম। ট্যাপের নিচে মাথা দিয়ে বসে রইলাম কিয়ৎক্ষণ জন্য। দৃষ্টি নিবদ্ধ হল গতকাল রাতে বালতিতে ভিজিয়ে রাখা জামা কাপড়ের দিকে। শুকাতে দিতে হবে। একটু পর বিশ্রী গন্ধ আসতে পারে। আমি অতিদ্রুত জামা কামড় নিগড়ে বেরিয়ে এলাম। নিগড়ে নেওয়ার মত শক্তিটুকু নেই শরীরে। বারান্দায় দাঁড়ালাম। আমার বারান্দায় লাগানো গাছগুলো ঝিমিয়ে পড়েছে। গতকাল সকালে পানি দিয়েছিলাম। গ্ৰিল বিহীন বারান্দা থেকে টানা দিয়ে অন্য গাছের টপে পানি দিলাম। দেয়াল ধরে রেলিংয়ের ওপর উঠে গেলাম। অবিলম্বে বিস্মৃতি হল একটু আগে ঘটে যাওয়া ঘটনার কথা। নিজের বারান্দায় পা রাখতেই ধরে ফেলল কেউ। টেনে নামিয়ে দিল কেউ। আমি অপূর্ব ভাই-কে দেখতে পেলাম। অগ্নিরুদ্ধ দৃষ্টি তার। আমি সৌজন্য হাসলাম। তিনি ক্ষেপে বললেন, “তুর আমাকে ডেকে নিয়ে এলো, তুই না-কি অসুস্থ। বমি করি ভাসিয়ে দিয়েছিস। এই তার নমুনা। ইচ্ছে করছে ছাদ থেকে ফেলে দিতে। দেশে ফেরার পর থেকে তোর জন্য একটার পর একটা ঝামেলা আমাকে পোহাতে হচ্ছে। একবার বাবা মা বাড়িতে ফিরুক। আমি বাড়ি ছাড়ব। দূরে কোথাও গিয়ে একা থাকব। সত্যি আর নিতে পারছি না। জাস্ট পারছি না।”
নত কণ্ঠে বললাম, “আমি বাড়িতে যাবো।”
“মানা করেছে কে? যা! ফাঁকা বাড়িতে ভুতে গিলে খাবে। বিরক্তকর!”
চুপটি ঘরে গিয়ে বসে থাকলাম। জানলে তৎক্ষণাৎ চলে যেতাম। আমার একাকিত্ব বাড়িয়ে দিয়ে তুর চলে গেল তার মামা বাড়িতে। এক কথায়, অপূর্ব ভাইয়ের ধমক থেকে বাঁচতে। বিকেলে তার মামা এসে নিয়ে গেল। রাতে একটা ভয়ংকর কাজ করল অপূর্ব ভাই। তার নতুন বন্ধুদের নিয়ে এলেন বাড়িতে। বাইরে থেকে খাবারের আনার ব্যবস্থা করল। ফোন কানে নিয়ে বলছে, “বাড়ি ফাঁকা আছে, সোজা উপরে ছাদে চলে যা। সব ব্যবস্থা করা আছে।”
আমি বই থেকে চোখ সরিয়ে শুধালাম, “অপূর্ব ভাই কারা আসবে?”
ফোন রেখে বললেন, “নতুন কয়েকজন বন্ধু আসবে। তুই কি ঘরে থাকবি? না-কি উপরে যাবি? না গেলে পড়া শেষ করে খেয়ে সোজা ঘুমিয়ে পড়বি।”
মুখ ছোটো করে বললাম, “খাওয়া বলতে আপনার বানানো ঐ স্যুপ। কার স্যুপ খেতে ভালো লাগে?”
“তুই তো স্যুপ ছাড়া কিছু খেতে পারিস না। তাহলে?”
বলেই ধপাধপ পায়ে হেঁটে বেরিয়ে গেলেন। আমি শূন্য চিন্তা নিয়ে পড়ার দিকে চেয়ে রইলাম। বাইরে আলো দেখা যাচ্ছে। জানালা দিয়ে উঁকি দিলাম। কয়েকজন ছেলে-মেয়েদের দেখা যাচ্ছে। আঙুল দিয়ে গুনে দেখলাম সাতজন। এই ক’দিনে অপূর্ব ভাই মেয়ে ফ্রেন্ডও জুটিয়ে ফেলেছেন। আমার মাত্র একজন ফ্রেন্ড ছিল – ‘তন্বি’ এখন দুজন। তন্বি ও তুর। সিঁড়ি দিয়ে ওঠার শব্দ পেলাম। তাঁরা ভেতরে আসবে না। ছাদেই ব্যবস্থা হয়েছে। রঙিন আলো জ্বালানো হয়েছে।
বইখাতা পাশে রেখে ফোন নিয়ে বসেছি। একটু শুয়েছিলাম ছাদে যে আওয়াজে গান বাজছে ‘নিশ্চিতে আমার ঘুম ব্যানিস।’ ভয় ভয় করছে। তাই ফোন নিয়ে বসেছি। অ্যাঞ্জেলা গেমস খেলছি। অ্যাঞ্জেলার গলায় আমার ভয় বিদায় নিয়েছে। অচেনা আইডি থেকে মেসেজ এসেছে। আমি সিন করলাম। “আসসালামু আলাইকুম।”
বিনীত ভাবে সালাম নিলাম, “ওয়া আলাইকুমুস সালাম।”
ওপাশ থেকে রিপ্লাই আসল, “সেদিন আপনি পাত্র পোস্ট দিয়েছিলেন, আমারও বউ চাই।
তা কোন ক্লাসে পড়েন আপনি?”
“ক্লাস নাইন, সাইন্স।” লিখে সাথে ভাব নেওয়া ইমুজি দিয়ে দিলাম।”
অপূর্ব ভাই ঘরে এলেন। গলা খাঁকারি দিলেন। আমি ফোনটা দ্রুত লুকিয়ে ফেললাম। সৌজন্য হেসে বললাম, “কী বললেন ভাই?”
“কিছু না, উপরে চল। সবাই তোকে দেখতে চাইছে।”
আমি ছোটো ছোটো চোখে তাকিয়ে বললাম, “না, অপূর্ব ভাই। আপনার বন্ধুদের মাঝে আমার যেতে ইচ্ছে করছে না। তাছাড়া আমি গিয়েই বা কী করব?”
“বান্ধুবীরাও আছে, চারজন মেয়ে। আমরা যা করব তুইও তাই করবি। এবার চল..
আমি মুখ ফিরিয়ে বসে রইলাম। হঠাৎ অনুভব করলাম, আমার লজ্জা লাগছে। অজানা কারণে এই লজ্জা। কিছুতেই যাবোনা। অপূর্ব ভাই আমাকে তুচ্ছ করে কোলে তুলে নিলেন। একদম ছাদে গিয়ে দাঁড় করালেন। সবাই আমাদের দিকে ‘হা’ করে তাকিয়ে আছে। কেউ তো সিটিও দিচ্ছে। গানের কারণে শোনা যাচ্ছেনা। একটা ছেলে বলে ফেলল, “বাহ্, তলে তলে এতদূর। এতদিন বলতি, তুই না-কি প্রেম করিস না।”
“কই প্রেম করি?”
“ঐযে কোলে!”
“ও আরশি। ফুফাতো বোন হয় সম্পর্কে। তুর-কে মামা নিয়ে গেছে। ও একা আছে বাড়িতে। ভয় পাবে, তাই নিয়ে এলাম।”
“দোস, আজকাল ফুফাতো ভাই-মামাতো বোনের প্রেম কাহিনী বেশি শোনা যায়।”
অপূর্ব ভাই আমাকে নামিয়ে দিলেন এক ধমক। আমি দৌড়ে চলে গেলাম মেয়েদের কাছে। ছোট বলে ওরা আমাকে আদর করল।
ছেলেগুলো গানের তালে নাচতে শুরু করেছে। মেয়েগুলোও নাচছে। আমি একপাশে দাঁড়িয়ে আছি। আচ্ছা এই মেয়েরা এখানে এসেছে নাচতে, তাঁদের বাবা মা কিছু বলেনা। আমার মা হলে মে’রে হাড়গোড় ভেঙে ফেলত।
খাওয়ার সময় সবাই আয়েশ করে খাচ্ছে। বিরিয়ানি এনেছে আট প্যাকেট। আমি খাবো কী? অপূর্ব ভাই নিজের প্যাকেট থেকে কিছু বিরিয়ানি আলাদা থালায় রাখলেন। মাংস গুলোকে ছোটো ছোটো কোষ করে এগিয়ে দিয়ে খেতে বললেন। সর্বপ্রথম বিরিয়ানি এলার্জি আর পাথর খুঁজলাম। দাঁত একটা হারিয়েছি আর হারাতে ইচ্ছুক নই। আমি বড় করে হা করে অল্প করে খাচ্ছি।
খাওয়া শেষে অন্যরকম দেখতে কোকের বোতল নিয়ে এলো। সবাই নিজেদের মতো নিয়ে খাচ্ছে, শুধু আমাকে আধ গ্লাস দিলেন অপূর্ব ভাই। মুখে ছোঁয়াতে কেমন যেন লাগল। মাথা চুলকে সবাইকে দেখলাম, তারা কত আয়েস করে খাচ্ছে। মনে হয়ে অমৃত খাচ্ছে। আমি হাই তুলে পুরোটা শেষ করলাম। গ্লাস বাড়িয়ে বললাম, “আরেকটু খাবো।”
“তোকে দিয়েছি এই বেশি। আর দেওয়া যাবেনা। পানি দিয়ে ধুয়ে খা।”
[চলবে.. ইন শা আল্লাহ]