#জৈষ্ঠ্যের_প্রেম (পর্ব-১৮ ও শেষ)
লেখনীতে– ইনশিয়াহ্ ইসলাম।
৩৭.
সারাদিন কাজ করে ঘেমে নেয়ে একাকার হয়ে যায় মৌসন্ধ্যা। রুমে গিয়ে কিছুক্ষণ বসে। একটু পর শাওয়ার নিবে। গ্রীষ্ম বাড়িতে নেই। সারাদিন মৌসন্ধ্যা যেমন ঘরের কাজে ব্যস্ত ছিল গ্রীষ্মও বাহিরে নানান কাজে ব্যস্ত ছিল। সেই দুপুরে খেয়ে বের হয়েছে। এরপর থেকে আর দেখা নেই তার।
মৌসন্ধ্যা একটু চোখ বুজে বিছানায় হেলান দিয়ে বসা ছিল। সেসময় রুমে নাইলা হাসান প্রবেশ করে। মৌসন্ধ্যা শব্দ শুনে চোখ মেলে তাকে দেখে সোজা হয়ে দাঁড়ালো বলল,
-‘কিছু লাগবে মা?’
-‘না। কথা ছিল তোমার সাথে। বসো। উঠতে হবে না।’
মৌসন্ধ্যা বসে, পাশে নাইলা হাসানও বসে। তারপর কিছুক্ষণ মৌন থেকে বলল,
-‘আর কতদিন এসব চালিয়ে যাবে?’
-‘কীসের কথা বলছেন!’
-‘তুমি বুঝতে পারছ না? নাকি চাইছ না?’
-‘আপনার কথাটা আমি সত্যিই বুঝতে পারছি না।’
-‘গ্রীষ্ম তোমার কি ক্ষ’তি করেছে? তার সাথে এমন করছ কেন! দ্যাখো, আমি কি বলছি তুমি তা ভালোই বুঝতে পারছ। তারপরেও না বোঝার ভান করো না। আমার ছেলেটা ভালোবেসে তোমাকে বিয়ে করেছে। যথেষ্ট সম্মানও করে তোমাকে। তারপরেও কেন তাকে স্বামীর যথাযথ অধিকার, সম্মান দিচ্ছ না? তুমি কি ভেবেছ আমি কিছুর আঁচ পাইনি? আমার ছেলেটার একটা বাজে স্বভাব রয়েছে। সে চাপা স্বভাবের। কখনো মুখ ফুঁটে তার ভেতরকার কথা প্রকাশ করে না। এতে অনেকেই তার সাথে অ’ন্যায় করার সা’হস পায়। যেমনটা আমি নিজেই করেছি। শোনো, তুমি তার উপর অযৌক্তিক ভাবে রে’গে আছো। তার সাথে বৈবাহিক সম্পর্ক তিক্ত করছ কেবল আমার কথাগুলো ধরে। অথচ সেগুলো আমার ছেলের কথা নয়, তার মনভাব নয়। সে যে ভুল করেনি সেই ভুলের শা’স্তি পাওয়াটা কি তার প্রাপ্য? এই যে এখন হয়তো তুমি বলবে আমার ছেলেই আমার কাছে এসে কিছু বলেছে। কিন্তু সে কখনোই আমাকে কিছু বলেনি। সবচেয়ে সুখী মানুষের অভিনয় করে চলেছে সে। আমি টের পেয়েছি কারণ আমি মা। তোমার তাকে করা অবজ্ঞা গুলো আমি দেখেছি। তাছাড়া আমি যতদূর বুঝতে পেরেছি তোমাদের মধ্যে স্বামী-স্ত্রীর কোনো সম্পর্কই নেই। যা আসলেই অনুচিত। বিয়ে যখন হয়েছে তাকে তোমার মেনে নেওয়া উচিত। আর আমি শতভাগ নিশ্চিত তুমি তাকে কেবল আমার জন্যই মেনে নিতে পারছ না। আমি এখন তোমার কাছে মাফ চেয়ে হাতে পায়ে ধরে ছেলের সাথে ভালো হতে বলব না। আমি তোমার বিবেকের কাছে প্রশ্ন রাখছি, আমার ভুলের মাশুল কি আমার ছেলের দেওয়া উচিত! তুমি শিক্ষিতা মেয়ে। আশা করছি বুঝতে পারবে আমার কথা।’
নাইলা হাসান চলে গেলেন। মৌসন্ধ্যা চুপচাপ বসে রইল। যে মানুষটাকে নিয়েই এত সমস্যা ছিল সে নিজেই এসে সমাধান দিয়ে গেছে। মৌসন্ধ্যা একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে কাবার্ড থেকে লাল রঙের সিল্কে শাড়িটা বের করল। শাওয়ার নেওয়ার পর, বেশ কিছুক্ষণ সময় নিয়ে নিজেকে সাজায়। আর অজানা অনুভূতিতে বারবার শি’উ’রে ওঠে
গ্রীষ্ম এলো বারোটার দিকে। আশ্বিন, শ্রাবণদের সাথে বাহিরেই খেয়ে এসেছে। এত রাতে এসে সবাইকে খাওয়ার জন্য বি’র’ক্ত করার তো কোনো মানে হয় না! মৌসন্ধ্যা তার আগমণ টের পেয়ে বারান্দায় লুকায়। তার কেমন কেমন লাগছে। ভীষণ রকমের ল’জ্জা হচ্ছে। গ্রীষ্ম রুমে এসে দেখে মৌসন্ধ্যা নেই। অবশ্য সে অবাক হয়না। গতরাতে হয়তো মৌসন্ধ্যা পরিস্থিতির চাপে তার সাথে থেকেছে। আজ তো তেমন কোনো চাপ নেই। উল্টো গ্রীষ্ম নিজেই তার জন্য এক বড় চাপ। এখন নিশ্চয়ই বর্ষার সাথে গিয়ে ঘুমিয়ে আছে। সবাইকে হয়তো বলেছে দুই দিন পর বর্ষার বিয়ে হয়ে যাবে, একসাথে থাকা হবে না হয়তো আর। তাই একটু এই কয়দিন তার সাথেই শুবে। মেয়েটার তো অজুহাতের অভাব নেই। ক্লান্ত ছিল, সারাদিন এখানে ওখানে, মাছের বাজারে গিয়ে একেবারে ময়লা হয়ে গেছে। তাই শাওয়ার নিতে চলে গেল। শাওয়ার থেকে বের হতেই দেখে রুম অন্ধকার। অথচ একটু আগেই সে লাইট জ্বালিয়ে গিয়েছিল। তার ভুল হওয়ার সম্ভাবনা নেই কারণ তার স্মৃতিশক্তি এতটাও দুর্বল নয়। তবে কি রুমে কেউ এসেছিল? অদ্ভুত!
লাইট জ্বালাতেই সে চমকে উঠল। বারান্দার দরজায় মৌসন্ধ্যা দাঁড়িয়ে আছে। তাকে এই বেশে দেখে গ্রীষ্ম খুব বেশিই চমকায়। বলল,
-‘তুমি এখানে?’
-‘আর কোথায় থাকব? তাছাড়া এত অবাক হচ্ছেন কেন? আশ্চর্য!’
গ্রীষ্ম কি বলবে খুঁজে পেল না। টাওয়াল টা বারান্দায় মেলে দিয়ে এসে বিছানায় বসে বলল,
-‘হঠাৎ এত সেজেছ কেন?’
-‘সাজলে আপনার সমস্যা আছে?’
-‘না। ভালো লাগছে তোমাকে।’
মৌসন্ধ্যা ল’জ্জা পায়। মুখ নামিয়ে ফেলে নিচে। গ্রীষ্ম বলল,
-‘লাইট টা নিভিয়ে দাও। আমি ঘুমাবো। ভীষণ টায়ার্ড ফিল হচ্ছে।’
গ্রীষ্ম শুয়ে পড়ল। মৌসন্ধ্যা হতভম্ব হয়ে গেল। গ্রীষ্ম কি ভাব নিচ্ছে এখন! থাক সমস্যা নেই। তারই ভালো। লাইট অফ করে সে ভাবল সাজ মুছে ফেলবে, শাড়িও বদলাবে। কিন্তু পরমুহূর্তেই ভাবে এতে গ্রীষ্ম বুঝে যাবে সে কেন কার জন্য সেজেছিল। না না! তার কাছে এই ব্যাপারটা প্রকাশ হতে দেওয়া যাবেই না। মৌসন্ধ্যা ধপ করে শুয়ে পড়তেই গ্রীষ্ম বলল,
-‘তুমি এভাবেই ঘুমাবে?’
-‘হ্যাঁ ঘুমাবো।’
-‘সমস্যা হবে না!’
-‘আজব! সমস্যা হবে কেন?’
-‘শুধু শুধু সেজেছ কেন?’
-‘আমার ইচ্ছে হয়েছে আমি সেজেছি। আপনার এত কথা বলতে হবে না।’
-‘আচ্ছা বলব না।’
মৌসন্ধ্যা ঘুমাতে পারছে না। গ্রীষ্ম তাকে এভোয়েড করছে নাকি! কিন্তু কেন? ওহ! নিশ্চয়ই রিপ্লেসমেন্ট পেয়ে গেছে। তাই! মৌসন্ধ্যার ইচ্ছে করছে কাঁদতে। কেন? সে নিজেই জানেনা।
কিছুক্ষণ পর গ্রীষ্ম বলল,
-‘জৈষ্ঠ্য?’
মৌসন্ধ্যা ভেবেছিল জবাব দিবে না। ঘুমের ভান ধরে পড়ে থাকবে। কিন্তু বে’হা’য়া মন কি তা মানে? সে জবাব দিল,
-‘হু?’
-‘আমার ঘুম আসছেনা। অথচ তুমি ঘুমাচ্ছ!’
-‘আপনার ঘুম না আসলে আমার কি!’
-‘তোমার কি মানে? তোমার জন্যই তো ঘুমাতে পারছি না।’
মৌসন্ধ্যার বুকে ধক করে উঠল। গ্রীষ্ম কি বলতে চাইছে? সে একটু সরে এলো এপাশে। একটু আগেও সে গ্রীষ্মের সান্নিধ্য না পেয়ে অভিমন করেছে। এখন তার বুকে ভ’য় দানা বাঁধছে। অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে।
গ্রীষ্ম আচানক মৌসন্ধ্যাকে টেনে নিজের বুকে ফেলে বলল,
-‘আমি তোমাকে একটু আদর করি?’
মৌসন্ধ্যার হাত পা ঠান্ডা হয়ে যায়। না বলতে পারেনা। গ্রীষ্ম তাকে বিছানায় ফেলে নিজের ভর তার উপর ছেড়ে দিয়ে বলল,
-‘তোমার এই অ’স্বস্তিটা আমাকে যে কি পরিমাণ স্বস্তি দেয় তুমি জানো?’
মৌসন্ধ্যা কিছু বলতে যাবে তার আগেই গ্রীষ্ম পরম ভালোবাসায় তার ঠোঁটে ঠোঁট ছোঁয়ায়। তারপর সরে গেল। মৌসন্ধ্যা বুঝে উঠতে পারল না কি হচ্ছে। গ্রীষ্ম সরে গেল কেন?
-‘স্যরি জৈষ্ঠ্য। আমার একটু আদর করতে ইচ্ছা করছিল। এই আদরেই থেমে যেতে হলো। তোমার সম্মতি নেই যখন তখন আমি কিছুই করব না। আগেই বলেছি।’
মৌসন্ধ্যার চোখ ভিজে এলো। লোকটা কি সত্যিই বুঝতে পারছে না! গ্রীষ্ম তার উপর থেকে সরে যাওয়ার আগেই সে গ্রীষ্মের টি-শার্ট টেনে ধরে। কিছু বলতে পারে না। তার যে বড্ড ল’জ্জা করছে। বলবে কি? গ্রীষ্ম হয়তো বুঝল। পরপর কয়েকবার মৌসন্ধ্যার ঠোঁটে চুমু খেয়ে বেশ গাঢ় গলায় বলল,
-‘এই শাড়ি আমার জন্য পড়েছ?’
মৌসন্ধ্যা কোনোরকম ভাবে জবাব দেয়,
-‘হুম।’
-‘তাহলে এখন আমি শাড়িটা খুলে ফেললে তুমি কি রা’গ করবে?’
মৌসন্ধ্যা জবাব দেয় না। কেননা জবাবের অপেক্ষা গ্রীষ্ম করেওনি। এরপর?
এরপর মৌসন্ধ্যা গ্রীষ্মের প্রতিটি স্পর্শে শি’হ’রি’ত হয়ে ওঠে। সব ভুল বোঝাবোঝি, হী’নমন্যতা, মান অভিমান ভুলে দুটো মানুষের মনের মিলন থেকে দেহের মিলন ঘটে।
সমাপ্ত।