#জৈষ্ঠ্যের_প্রেম (পর্ব-৬)
লেখনীতে– ইনশিয়াহ্ ইসলাম।
১২.
মৌসন্ধ্যা এসেছে থেকেই এমন এদিক ওদিক ঘুরছিল। বর্ষা তার কাছে একবারের জন্যও আসেনি তাই তার মনটাও ভীষণ খা’রা’প। এদিকে একটু খালি জায়গা পেয়ে বসতেই একটা মহিলা তাকে আটকে ধরলেন। তার নাম, বয়স, বাড়ি কোথায়, বাবা কী করে হেনতেন নানান কথা জিজ্ঞেস করতে থাকে। মৌসন্ধ্যা একটু হলেও ধারণা করছিল মহিলার তার ব্যাপারে এত কিছু জানার আগ্রহের কারণটা। তবুও ভদ্রতার খাতিরেই সে জবাব দিচ্ছে। মহিলা যখন জিজ্ঞেস করলেন,
-‘তা তোমার বিয়ে হয়েছে?’
তখনিই সেখানে গ্রীষ্মের আগমন। সে এসেই মহিলার দিকে বিরক্তির দৃষ্টিতে তাকালো। তারপর মৌসন্ধ্যার দিকে ক্রু’দ্ধ নয়নে চেয়ে থেকে ধ’ম’কের সুরে বলল,
-‘তুমি এইখানে কী করছ? সবার খাওয়া দাওয়া শেষ আর তুমি বসে গল্প করছ!’
মৌসন্ধ্যা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। গ্রীষ্ম এখানে কেন আসতে গেলো! আবার এসেছে যখন তাকে এমন ধ’ম’কাচ্ছেই বা কেন? মৌসন্ধ্যা কিছু বলবে তার আগেই গ্রীষ্ম মহিলাটির উদ্দেশ্যে নমনীয় হয়েই বলল,
-‘আন্টি যদি কিছু মনে না করেন আমি ও’কে নিয়ে যেতে পারি? আসলে ও এখনও খাবার খায়নি। আমি বুঝতে পারছি, আপনারা হয়তো কিছু জরুরী কথা বলছিলেন ও না হয় পরে এসে বাকি কথা বলবে। আগে খেয়ে আসুক!’
মহিলাটি বললেন,
-‘কি বলছ বাবা! ও এতক্ষণ যাবৎ না খেয়েই বসে আছে? এই মেয়ে তুমি আসলে কী! যাও খেয়ে আসো। পরে কথা হবে।’
মৌসন্ধ্যা কী বলবে বুঝতে পারছেনা। গ্রীষ্মর তো জানার কথা নয় সে খেয়েছে কীনা! বর্ষা আর তার মা যেখানে খোঁজ করল না সেখানে গ্রীষ্মের নিজে থেকে এসে ডেকে নিয়ে যাওয়াটা একটু ভাবনার বিষয় বটে। গ্রীষ্ম মৌসন্ধ্যাকে বলল,
-‘বসে আছো কেন? আসো!’
মৌসন্ধ্যা উঠে দাঁড়ায়। মহিলাটির দিকে তাকিয়ে একবার ভদ্রতার খাতিরে হাসে। মহিলাটিও হেসে বলে,
-‘যাও মা, খেয়ে নাও।’
গ্রীষ্মর পাশাপাশিই মৌসন্ধ্যা হাঁটছে। গ্রীষ্মের মুখে কেন যেন কাঠিন্য প্রকাশ পাচ্ছে। এমনকি তার কোনো টু শব্দও নেই। মৌসন্ধ্যার মনে হলো কোনো জড় বস্তুর সহিত সে হাঁটছে। নিচে সিঁড়ি বেয়ে নামতেই গ্রীষ্ম বলল,
-‘এই সব অপরিচিত মহিলাদের থেকে যতটা সম্ভব দূরে থাকবে।’
আচানক গ্রীষ্মের মুখে এমন কথা শুনে মৌসন্ধ্যা খানিক চমকালো। তারপর ভাবল গ্রীষ্ম তাকে এমন মানা করছে কেন? সে কী ছোট বাচ্চা! মহিলা কী তাকে চকোলেট খাইয়ে গা’য়ে’ব করে দিবে? সে ছোট্ট করেই শুধায়,
-‘কেন?’
গ্রীষ্ম সরাসরি তার চোখের দিকে তাকায়। মেয়েটা কী অবুঝ নাকি! বুঝতে পারছেনা? সে যখন তাদের মধ্যে উপস্থিত হলো তখনই তো শুনতে পেল মহিলাটি তাকে বিবাহিতা কীনা জিজ্ঞেস করছে। একটা মেয়ের তো এত অবুঝ হওয়ার কথা নয়! মহিলাটি ধা’ন্দা কিছুটা হলেও তো আন্দাজ করবে নাকি! গ্রীষ্ম কাঠ কাঠ গলায় জবাব দিল,
-‘ভালোর জন্যই বলছি। তোমারই কাজে আসবে।’
মৌসন্ধ্যা নিজেও মহিলাটির সাথে কথা বলতে আর আগ্রহী নয়। তবে মহিলাটি কথা বলতে আসলে সে তো না বলতে পারেনা। কেমন আদর করেই কথা বলছিলেন। সে মহিলার উদ্দেশ্য তার শেষ কথাতে বুঝে গিয়েছে। তবে গ্রীষ্ম কেন বারণ করছে! তার তো বারণ করার যুক্তিসংগত কোনো কারণ সে দেখছেনা। তাই সেও নিজের কথা রাখে।
-‘দেখুন, ভদ্রমহিলা কথা বলতে আসলে আমি তাকে এড়িয়ে যেতে পারিনা। এটা অভদ্রতা হয়ে যায়।’
-‘সবসময় সবকিছুতে ভদ্রতা অভদ্রতা নিয়ে ভেবে পড়ে থাকলে লাভের লাভ কিছুই হবেনা, ক্ষ’তি ছাড়া!’
মৌসন্ধ্যা ভ্রু কুচকে তাকালো গ্রীষ্মের দিকে। তাকাতেই দেখল গ্রীষ্মও তাকিয়ে আছে তার মুখপানে। সে চোখ সরায়। যতবার সে লোকটির দিকে সরাসরি তাকাতে চায় ততবারই খেয়াল করে সেও তাকিয়েই আছে। আর এইজন্য তাকেই চোখ সরাতে হয় প্রতিবার। লোকটা পারেনা অন্যদিকে তাকাতে? সে একটু মন ভরে তাকাতে পারে তাতে। তা নয়, সেও ফ্যালফ্যাল করে বে’হা’য়া চোখ দুটো দিয়ে দিকেই তাকিয়ে থাকে। অস’হ্য!
মৌসন্ধ্যার মনে হলো সে অযথা রা’গ করছে গ্রীষ্মের উপর। রা’গ করার কোনো যথাযথ কারণ নেই। হয়তো আষাঢ়ের কিংবা বর্ষার উপরে থাকা রা’গটা তার উপর ঝারছে। আর সে শুধু শুধু একটু আগেই লোকটাকে বে’হা’য়া’র খেতাব দিয়ে দিয়েছে। যদিও লোকটি কোনো বে’হা’য়া’পনা করেনি। গ্রীষ্ম মৌসন্ধ্যাকে ভাবনায় মশগুল থাকতে দেখে বলল,
-‘কী ভাবছ এত?’
-‘কিছু না।’
গ্রীষ্ম মৌসন্ধ্যাকে নিয়ে যখন খাবার খাওয়ার জায়গায় গেল তখন দেখে আহরারের খাওয়া শেষ। গ্রীষ্মের রা’গ উঠল। ব্যাটা এত দ্রুত খায় কীভাবে! পরক্ষণেই ভাবে ভালো হয়েছে। মৌসন্ধ্যা হয়তো আহরারের সাথে বসতে আনইজি ফিল করতে পারে। আহরার কোক খাচ্ছিল। গ্রীষ্মদের আসতে দেখেই সে সামনে এগিয়ে গেল। গ্রীষ্মকে বলল,
-‘ওহ! তুই মৌসন্ধ্যাকে আনতে গিয়েছিলি! আগে বলবি তো, তাহলে অপেক্ষা করতাম। এখন তো আমার খাওয়া শেষ!’
-‘সমস্যা নেই। তুই ওইদিকটা দ্যাখ। আমরা খেয়ে আসছি।’
আহরার মৌসন্ধ্যার দিকে একবার আড়চোখে তাকায়। মেয়েটাকে ভীষণ সুন্দর লাগছে। একটু ভালো করে দেখতে পারলে সে খুশি হতো। কিন্তু সম্ভব নয়। মেয়েটি তাকে যদি ম’ন্দলোক ভেবে বসে? সে গ্রীষ্মের দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে সেখান থেকে চলে এলো। গ্রীষ্ম মৌসন্ধ্যাকে নিয়ে গিয়ে একটা টেবিলে বসল। এরপর ওয়েটার এসে খাবার সার্ভ করতে থাকে।
১৩.
বর্ষা তার মা আর ফুপিদের ভীড়ে গিয়ে একটু বসলো। মূলত তার চোখ মৌসন্ধ্যাকে খুঁজছে। কিন্তু কোথাও তো দেখা যাচ্ছেনা! সে কোথায়? বর্ষাকে দেখে মৌসন্ধ্যার মা বসা থেকে ওঠে এসে তার সামনে দাঁড়িয়ে বলল,
-‘এই বর্ষা! মৌ’কে দেখেছিস?’
বর্ষা বিরস মুখে বলে,
-‘আমি দেখব কি করে? ও তো এসেছে থেকেই লাপাত্তা।’
-‘কী বলছিস! ও তোর সাথে ছিল না।’
বর্ষা এবার একটু নড়ে চড়ে বসল।
-‘না তো। ও তো আমার সাথে ছিল না। আমি তো জানি তোমার সাথে আছে সে।’
-‘না, আমার কাছেও তো ছিল না। ওই যে তখন আসছে এসে একবার দেখা দিয়ে গেছে। তারপর তো আর দেখলাম না। কোথায় গেল মেয়েটা! ও তোদের সাথে খেতে বসেনাই?’
বর্ষা উঠে দাঁড়ালো। ফুপির কাছেও এতক্ষণ ছিল না। তাহলে মৌসন্ধ্যা কোথায়? এখনও খাবার খায়নি! সে বলল,
-‘দাঁড়াও ফুপু আমি দেখি ও কোথায়।’
বর্ষা বের হয়ে পুনরায় মৌসন্ধ্যাকে খুঁজতে থাকে। এদিকে মৌসন্ধ্যার মা চিন্তায় অস্থির। মেয়ে কোথায় গেল? মেয়েটা ইন্ট্রোভার্ট! তাছাড়া এরকম জন সমাগোম তার অপছন্দ। একা একা সে এতক্ষণ কী করছে! তিনি মাহতিমকে কল করলেন। মাহতিম কল ধরতেই প্রথমে কয়েকটা কড়া কথা শুনিয়ে দিলেন। মৌসন্ধ্যাকে দেখে শুনে রাখবেনা সে! বড় ভাইয়ের ছোট বোনের প্রতি কি দায়িত্ব নেই? মায়ের ঝারি খেয়ে মাহতিম বলল,
-‘আচ্ছা আমি দেখছি। তুমিও কী! মেয়ে কোথায়, কী করছে খোঁজ রাখবেনা? বাপের বাড়ির কাউকে পেলেই হলো! গল্পে গল্পে বাচ্চাদের ভুলে যাও।’
মাহতিমের কথা শুনে তিনি এবার প্রচন্ড রে’গে গেলেন। ছেলে মেয়ে দুইটাকে হাতের কাছে পেলে তিনি চড়িয়ে সোজা করবেন। তার ভাষ্যমতে সবকয়টা বে’য়া’দব। বাপের মতো পুরো। তিনি মনে করেন তার স্বামী ইচ্ছে করেই আসেননি। কারণ শ্বশুড় বাড়ির লোকদের তিনি বিশেষ পছন্দ করেননা।
বর্ষা এদিক ওদিক খুঁজতে খুঁজতে হয়রান। সে এখন দোতলায় যাচ্ছিল তাকে দেখে আহরার বলল,
-‘এই মেয়ে? কিছু খুঁজছ!’
-‘হ্যাঁ ভাইয়া। মৌ’কে খুঁজছি।’
-‘ওহ! ও তো খেতে বসেছে গ্রীষ্মের সাথে।’
বর্ষা অবাক হলো। গ্রীষ্মের সাথে খেতে বসেছে? যাক! তবুও ভালো। এখন যদি মেয়েটা না খেয়েই থাকত সে তো ম’র’মে ম’রেই যেত। ধুর! তারই ভুল। শ্রাবণের কথা শোনা একদমই উচিত হয়নি। সে আহরারকে ধন্যবাদ জানিয়ে রওনা হলো। উদ্দেশ্য মৌসন্ধ্যার কাছে যাওয়া।
গ্রীষ্ম খুব যত্ন করে মৌসন্ধ্যার প্লেটে পোলাও তুলে দিলো। তারপর রোস্ট, চিংড়ী এগিয়ে দিতেই মৌসন্ধ্যা বলল,
-‘চিংড়ী খাইনা আমি।’
-‘অ্যালার্জি আছে?’
-‘হু।’
-‘আচ্ছা সমস্যা নেই। ফিশ্ ফ্রাইটা নাও। এটা বোধহয় রুই মাছের।’
-‘আচ্ছা নিব পরে। এখন না।’
গ্রীষ্ম মৃদু হাসে। মৌসন্ধ্যা তার পাশে রাখা গরুর কালাভুনাটা গ্রীষ্মের দিকে এগিয়ে দিলো। গ্রীষ্ম মৌসন্ধ্যার দিকে একবার তাকায়। মৌসন্ধ্যার ল’জ্জা লাগছে। সে বুঝে উঠতে পারেনা এমনিতেও তার একটু অ’স্ব’স্তি হয় দূরের মানুষের সাথে। কিন্তু সেই অস্ব’স্তি আর ল’জ্জার পরিমাণ বেড়ে বেশি হয়ে যখন সে গ্রীষ্মের পাশে থাকে। গ্রীষ্ম সালাদ, আচার সব মৌসন্ধ্যার হাতে কাছে রাখল। মৌসন্ধ্যা হাত বাড়িয়ে আচারটা নিল। দুজনে খাওয়া শুরু করতেই সেখানে বর্ষা হাজির। এসেই পেছন থেকে মৌসন্ধ্যাকে জড়িয়ে ধরে বলল,
-‘আই অ্যাম স্যরি জান। ভেরি স্যরি। মা’ফ করে দে।’
গ্রীষ্ম খাওয়া থামিয়ে অবাক চোখে দুজনের দিকে চেয়ে আছে। সে দেখল মৌসন্ধ্যার চোখের কোণে অশ্রুকোণা চিকচিক করছে। বর্ষা মৌসন্ধ্যাকে ছেড়ে এবার পাশে এসে বসে। তারপর বলল,
-‘তুই এত অভিমান কেন করিস? আচ্ছা যা, আর কখনো আমি হাসব না। বড় ভাইয়া আর কিছু বললে আমি উল্টো তাকে বকে দিব। সত্যি!’
মৌসন্ধ্যা তাকালো গ্রীষ্মের দিকে। সে চাইছেনা এসব কথা তার সামনে বলতে। সে বর্ষাকে বলল,
-‘আমি কিছু মনে করিনি।’
-‘তোকে আমি চিনি মৌ। আমি জানি তুই রে’গে আছিস।’
মৌসন্ধ্যা চুপ করে রইল। এতই যখন সে তাকে জানে, চেনে তখন কেন সে চুপ ছিল! আর একটু খোঁজ পর্যন্ত নিলো না।
গ্রীষ্ম বর্ষাকে বলল,
-‘কি হয়েছে বর্ষা?’
বর্ষা কিছু বলতে যাবে তার আগেই মৌসন্ধ্যা তাকে চোখের ইশারায় মানে করল। ব্যাপারটা গ্রীষ্মের চোখ এড়ায়নি। বর্ষা বলল,
-‘কিছু না ভাইয়া। ওই আমাদের একটু কথা কা’টা’কা’টি হয়েছে।’
বড় ভাইয়া বলাতে গ্রীষ্ম বুঝতে পেরেছে আষাঢ় জড়িত আছে ব্যাপারটায়। আর মৌসন্ধ্যা চাইছেনা গ্রীষ্মের সাথে এই ব্যাপারে কথা বলতে। তাই গ্রীষ্ম আর কিছু জিজ্ঞেস করল না। সে নিজের খাওয়া মনযোগ দিলো। তার হাতে সময় নেই। বিয়ে পড়ানোর কাজ শুরু হয়ে গেছে হয়তো। সেখানেই যেতে হবে দ্রুত। বর্ষা পাশে বসে নানান কথা বলতে থাকল। মৌসন্ধ্যা শুনছে আর খাচ্ছে। মাঝে গ্রীষ্মের দিকে তাকায়। দেখে গ্রীষ্ম কোনো মতে এক কি দুই আইটেম দিয়ে খেয়ে উঠে পড়ল। মৌসন্ধ্যার কেন যেন গ্রীষ্মের এমন অল্প খাওয়াতে ভালো লাগল না। সে ফট করেই বলে উঠল,
-‘আপনি কোথায় যাচ্ছেন? ঠিক মতো তো খেলেন না!’
গ্রীষ্ম বলল,
-‘আমার আসলে এখন ওত তৃপ্তি করে খাওয়ার সময় নেই জৈষ্ঠ্য। আমার কাজ আছে অনেক। এই বর্ষা, ওর খাওয়া শেষ না হওয়া পর্যন্ত এখানেই থাকবি। আর যা লাগবে এগিয়ে দিবি। আমি আসছি।’
-‘আচ্ছা ভাই।’
গ্রীষ্ম চলে যেতেই বর্ষা লাফিয়ে উঠল। তারপর বেশ আগ্রহের সহিত জানতেই চাইল,
-‘এই মৌ! তুই গ্রীষ্ম ভাইয়ার সাথে খেতে বসলি যে! এতক্ষণ তার সাথেই ছিলি নাকি!’
মৌসন্ধ্যা কথাটা শুনে বিরক্ত হলো বেশ! গ্রীষ্মের সাথে সে কেন থাকতে যাবে?
-‘না। আমি একাই ছিলাম। উনি পরে খাওয়ার জন্য ডেকে এনেছেন।’
বর্ষা চোখ মুখ কুচকে ফেলল। তার কেন যেন এখানে অন্য একটা রহস্যের গন্ধ নাকে লাগছে। সে কৌতুকের সহিত দুই ভ্রু উচু করে বলল,
-‘ডেকে এনেছে? বাহ! সামথিং সামথিং।’
বর্ষার এমন কথা শুনে মৌসন্ধ্যা চমকে উঠল। সে ফটাফট জবাব দেয়,
-‘নাথিং নাথিং।’
১৪.
জুনের বিয়েটা বেশ সুন্দর করেই সম্পন্ন হলো। বিদায়বেলা মৌসন্ধ্যা সেই ক’ঠো’র জুনকে কাঁদতে দেখল। বাবা-মা, ভাইকে জড়িয়ে তার কি যে কান্না! এপ্রিল গেল জুনের সাথে। চৈত্র যেতে চেয়েছিল কিন্তু তার মা যেতে দিলো না। এপ্রিলকেও দিতো না কিন্তু জুনের বেশ আদরের সে। তাই সে যেতে দিয়েছে। চৈত্রকে না যেতে দেওয়ার বড় কারণ হলো সে কোথাও যাওয়ার সময় বেশ উৎসাহ নিয়ে যায়। পরবর্তীতে কিছুসময় যেতে না যেতেই কল করে কেঁ’দেকু’টে একাকার অবস্থা করে। মোট কথা সে তার মা ছাড়া কোথাও গিয়ে থাকতে পারেনা। অবশ্য নিজেদের মধ্যে কোথাও বেড়াতে গেলে পারে। কিন্তু অপরিচিত জায়গাতেই তার যত সমস্যা!
জুন চলে যাওয়ার পর সবারই মন খা’রা’প থাকে। গ্রীষ্ম সবাইকে একে একে গাড়িতে উঠিয়ে দিলো। সবাই চলে গেলেও বাকি থাকল শুধু বর্ষা, মৌসন্ধ্যা, শরৎ। গ্রীষ্ম তাদের দিকে তাকিয়ে বলল,
-‘তোদের ব্যাপারটাই বুঝলাম না। সবার শেষে এসেছিস। এখন আবারও সবার শেষে ফিরছি।’
শরৎ বলল,
-‘ওই যে দেরিতে এসেছি তাই এখন দেরিতে গিয়ে সেই সময়টা পূরণ করে নিলাম।’
গ্রীষ্ম আলতো হাসে। তার গাড়িটা নিয়ে আসতেই শরৎ পেছনের সিটে বসে পড়ল। মৌসন্ধ্যা বলল,
-‘শরৎ ভাই তুমি সামনে বসো! আমি আর বর্ষা পেছনে বসব।’
শরৎ যেন কথাটা শুনে বেশ চটে গেল। সে বলল,
-‘দ্যাখ, আমি এমনিতেও বেশ টায়ার্ড! এখন আর তোদের সাথে কথা বলে আরো বেশি টায়ার্ড হতে চাইছিনা। আমি আমার বসা বসে পড়েছি। একট হাত পা ছড়িয়ে বসব। শরীরটা ভালো না আমার। একদম আমার শান্তি ন’ষ্ট করবিনা। নইলে!’
বর্ষা বলল,
-‘আচ্ছা আমরা তিনজন না হয় পেছনে বসি।’
শরৎ বর্ষাকে চোখ রাঙানি দিয়ে পুনরায় বলল,
-‘মাথা গরম করিস না বর্ষা! হাত পা ছড়িয়ে আরাম করে বসব বলেই পেছনে বসেছি। এখন তিনজন বসলে সেই একই ব্যাপার ঘটবে। যে লাউ সে-ই কদু।’
বর্ষা তড়িগড়ি করে পেছনের সিটে বসে পড়ল। তারপর মৌসন্ধ্যার দিকে তাকিয়ে বলল,
-‘তুই তো জানিস আমার সামনের সিটে বসতে ভালো লাগেনা। তুই আজকে সামনে বসতে পারিস। তোর তো ভালো লাগে।’
বর্ষার কথা শুনে মৌসন্ধ্যার এত রা’গ হচ্ছিল! ঠিক আছে বর্ষা সবসময় পেছনে বসে। তার মানে এই নয় সে সামনে বসতে পারেনা। আর মৌসন্ধ্যার সামনে বসতে ভালো লাগে মানে কী! লাগলেও সে কী ভাবে বসবে! সে চাইছেনা গ্রীষ্মের আশেপাশে থাকতে। সত্যি বলতে তার কেমন অদ্ভুত অনুভূতি হয় গ্রীষ্ম আশেপাশে থাকলে।
অগত্যা উপায়ন্তর না পেয়ে মৌসন্ধ্যা সামনেই বসল। সন্ধ্যা হয়ে গেছে। চারিদিকে অন্ধকার হতে শুরু করেছে। গ্রীষ্ম ড্রাইভ শুরু করতেই শরৎ বলল,
-‘ভাইয়া, লাইট টা অফ করো তো! মাথা ধরেছে ভীষণ।’
গ্রীষ্ম লাইট নিভিয়ে দিলো। মৌসন্ধ্যার এই অন্ধকারটা বেশ মনে ধরলো।
-‘সিট বেল্টটা লাগিয়ে নাও জৈষ্ঠ্য!’
মৌসন্ধ্যা গ্রীষ্মের কথা শুনে তাড়াতাড়ি সিট বেল্টটা লাগিয়ে নিলো। সে আসলে ভুলেই গিয়েছিল এটার কথা। এদিকে পেছনে শরৎ অবাক হয়ে তাদের দিকেই চেয়ে আছে। হঠাৎ করেই সে বলে উঠল,
-‘এই মৌ! তোকে গ্রীষ্ম ভাই জৈষ্ঠ্য বলে ডেকেছে।’
মৌসন্ধ্যা পেছন ফিরে শরৎের মুখটা দেখার চেষ্টা করল। স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছেনা। সে আবার সামনে তাকায়। গ্রীষ্ম বলল,
-‘কেন? জৈষ্ঠ্য বললে সমস্যা কোথায়!’
-‘না মানে, মৌ নিজেই তো বলেছে জৈষ্ঠ্য বলে ডাকলে চুন টেনে ছিড়ে দিবে। আর এখন এত শান্ত!’
গ্রীষ্ম হেসে ফেলল।
-‘আমি তো তাকে সেই প্রথম থেকেই এই নামে ডাকছি।’
-‘তাই নাকি!’
বর্ষাও বলল,
-‘হ্যাঁ, আমিও খেয়াল করেছি ব্যাপারটা।’
শরৎ বলল,
-‘কিরে মৌ! ব্যাপার কী?’
মৌসন্ধ্যা কিছু বলল না। বর্ষা-ই বলল,
-‘ও হয়তো গ্রীষ্ম ভাইকে এক্সট্রা সম্মান করে। তাই কিছু বলছেনা।’
কথাটা বলেই বর্ষা ঠোঁট চেপে হাসে। শরৎ তো অবাক হয়ে তাকিয়েই আছে মৌসন্ধ্যার দিকে। তারপর বেশ অবিশ্বাসের সাথে বলে ওঠে,
-‘বাহ মৌ! তুই সম্মান করতেও জানিস।’
মৌসন্ধ্যার ইচ্ছে করছে সবকয়টাকে লা’থি মেরে গাড়ি থেকে বের করে দিতে নয়তো চাইছে নিজে লা’ফ দিয়ে নেমে যেতে। এরা এত জ্বা’লা’য় কেন?
এদিকে গ্রীষ্মের মন পুলকিত হয়ে উঠছে। আসলেও সে তো তখন দেখেছে জৈষ্ঠ্য বলাতে শ্রাবণকে কী ভাবে রা’গ দেখিয়েছিল সে। আর তার বেলায় সে কিছু বলেনি। হয়তো মৌসন্ধ্যা তাকে শ্রাবণের মতো করে বলতে পারেনা কারণ তাদের সেই রকম ক্লোজ সম্পর্ক নেই। কাজিন গ্রুপের বাকি সবাইকে তুমি করে বললেও সে তো গ্রীষ্মকে আপনি করে বলে। গ্রীষ্মের যেমন একদিকে ভালো লাগছিল আবার অন্যদিকে কেমন খা’রা’প লাগল। তবে কী মৌসন্ধ্যা তাকে আপন ভাবেনা? সে মৌসন্ধ্যার দিকে তাকালো। রাস্তার ধারের ল্যামপোস্টের আলো তার মুখে পড়ছে। তাতেই স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে তার অ’স্ব’স্তিগুলো। গ্রীষ্ম ড্রাইভিং এ মনযোগ দিলো। কেউ আর কোনো কথা বলল না। কয়েক মিনিট পর তারা জ্যামে আটকা পড়ল। বেশ কিছুক্ষণ পর জ্যাম কাটতেই গাড়ি আবারও চলতে থাকে। পেছন থেকে কারো সাড়া শব্দ না পেয়ে মৌসন্ধ্যা সেদিকে তাকালো। বর্ষা আর শরৎ ঘুমিয়ে পড়েছে। ইশ! তারা কী সুন্দর শান্তিতে ঘুমোচ্ছে। আর এদিকে তার বুকের ভেতরটা সেই কখন থেকে ধকধক করছে। গ্রীষ্মর কাছে যাওয়া মানেই হা’র্ট অ্যা’টা’কের ঝুঁ’কি নেওয়া। সে ঠিক করল আর গ্রীষ্মের সামনে পড়া যাবেনা। অথচ সে কি আজ এইখানে বসে জানত যে, এই গ্রীষ্মই একদিন তার সাথে সবচেয়ে বড় বাঁধনে বাঁধা পড়বে!
#চলবে।
(রি-চেইক দেইনি। ভুল ত্রুটি ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন এবং ধরিয়ে দিবেন। আমি শুধরে নিব।)