#জীবন মানে তুমি
#লেখিকা:H.B.Rini (Irini Ori)
#পর্ব:৫৮
(২০১)
আল্লাহর রহমতে দেখতে দেখতে ভালো ভাবে পনেরোটা রোযা পার হয়ে গেছে,কিন্তু ভালো নেই মিসেস নিন্দুর পরিবার।রোজ কোনো না কোনো সমস্যা লেগেই থাকে,কিন্তু এবার যে সমস্যাটা হয়েছে তার কাছে বাকী সমস্যাগুলো কিছুই নয়।প্রতি রোযায় শ্বশুড়বাড়ি কাজ করার ভয়ে উনার তিন মেয়ে বাবার বাসায় চলে আসে।আর যত ঝামেলা হয় মিসেস নিন্দুর।ছয় রোযার বিকালে রান্নাঘরে পাটায় ডাল বাঁটছেন আর তার তিন মেয়েকে গালিগালাজ করছেন।এটা প্রতিদিনের রুটিন উনার,উনার তিন মেয়েও কম নয়।কোনো কিছু গায়ে মাখে না,নিজেদের মতো আয়েশ করে ঘুরাঘুরি করছে আর মায়ের কথায় দু’তিনটা উত্তর দিচ্ছে।ইফতারের সময় উনার ছোট মেয়ে ডাইনিংএ বড় একটা শীতল পাটি বিছিয়ে খাবারগুলো রাখছে।আযান দিতে আর মাত্র দুই মিনিট বাকী,সবাই এসে বসলেও জারিকা আসেনি।মিসেস নিন্দু উনার ছোট মেয়ের দিকে তাকিয়ে বলেন,
-“যেয়ে দেখতো ওই হারামজাদি কোনে মরলো?”
উনার ছোট মেয়ে উনার দিকে বিরক্ত নিয়ে তাকিয়ে বলেন,
-“আমি পারবোনা আম্মু,দেখলেনা কত কাজ করলাম?”
-“চুপ কর মুখপুড়ী,সব কয়টা জ্বালিয়ে খাচ্ছে আমাকে।বিয়ের পর শ্বশুড়বাড়ি না থেকে সবটা মরতে আসিস এই জায়গায়।”
উনি রেগে কথাটা বলে হাতের গামলাটা শব্দ করে শানের উপর রাখলেন।উনার স্বামী উনার দিকে তাকিয়ে বলেন,
-“ইফতারির সময়ই কী তোমার এসব করতে হবে?মেয়েগুলোকে তো মানুষ করতে দিলেনা আবার বেশি কথা বলো?”
-“তুই চুপ থাক,তোরে বিয়ে করে আমার জীবন পুরো শেষ।”
-“কিছু বলিনা বলে বেশি সাহস হয়ে গেছে দেখছি দিনদিন।আমি যদি তোমার মতো ডিভোর্সি মেয়েকে বিয়ে না করতাম তবে তোমার বাপ-মার সাধ্য ছিলোনা তোমার কু-কীর্তি লুকিয়ে অন্য জায়গায় বিয়ে দেওয়ার।নির্ঘাত আমার পরিবার ভালো বলে তোমাকে মেনে নিয়েছে।শুভ যেয়ে দেখতো আব্বু তোর আপু কোথায়?”
শুভ উঠতেই যাবে তখনি আযান দিয়ে দেয়।ও শরবতের গ্লাসে চুমুক দিয়েই উঠে জারিকার ঘরে যায়।কিন্তু জারিকার সেখানে ছিলোনা আর না আলনাতে ওর কোনো কাপড় রাখা ছিলো।কাপড় দেখতে না পেয়েই ওর টনক নড়ে উঠে,তবুও ও তিন-চারবার আপু আপু করে ডাকে কিন্তু কোনো সারা পায়না।যখন ও ঘর থেকে দ্রুত বেড়তে যায় তখন দরজার পাশে থাকা টেবিলের সাথে পায়ে গুতো লাগতেই টেবিলটা নড়ে উঠে আর উপর থেকে খাম ধরনের কিছু মেঝেতে পরে যায়।শুভ কৌতুহল নিয়ে মেঝে থেকে খাম নিয়ে খুলে দেখে ভিতরে একটা চিঠি,তাই দেরী না করেই ও চিঠিটা দ্রুত খোলে পড়তে থাকে।কিন্তু যা দেখলো তাতে ওর পায়ের নিচের মাটি সরে গেলো,ও নিজের বোনদের পছন্দ করেনা ঠিকই কিন্তু কারোর ক্ষতি চাইনা।ও আর দেরি না করে নিচে নেমে আসে।ওর বাবা ছেলের দিকে তাকিয়ে বলে,
-“জারিকা কই?তোকে না ডাকতে পাঠালাম, মেয়েটা তো রোযা রেখেছে।”
শুভ অনেক কষ্টে জবাব দেয়,
-“বাবা,আপু আসবেনা।”
-“আসবেনা মানে?ও মায়ের সাথে রাগ করেছে, কোনো ব্যাপার না আমি খাবার নিয়ে উপরে যাচ্ছি।দেখলে নিন্দু তোমার জন্য মেয়েটা না খেয়ে আছে।”
-“দাঁড়াও বাবা,আপু ঘরে নেই।”
মিসেস নিন্দু হকচকিয়ে বলেন,
-“এই ভরসন্ধ্যায় কোথায় গেছে?ওকে তো ছাদে যেতে দেখলাম না।”
-“এটা পড়ো,তাহলে বুঝতে পারবে।”
শুভ একটা চিঠি মিসেস নিন্দুর হাতে ধরিয়ে দেন।উনি ক্লাস নাইন পর্যন্ত পড়েছেন তাই টেনেটুনে বাংলাটা ভালোই পড়তে পারেন।চিঠির মোটা মোটা গোছের হাতের লিখা দেখে বুঝতে পারলেন এই চিঠি জারিকার।উনি চিঠিটা পড়তে শুরু করলেন,
“মা,
কী বলে সম্বোধন করবো বুঝতে পারছিনা?কেননা প্রিয় কথাটা তাদের বলতে হয় যারা শুভাকাঙ্ক্ষী হয়।আচ্ছা মা,তুমি কী সত্যিই অন্য মায়ের মতো আমার শুভাকাঙ্ক্ষী ছিলে?মনে হয়না,যদি হতে তাহলে মেয়েদের উপযুক্ত শিক্ষা দিয়ে মানুষ করতে। কিন্তু করোনি,সারাজীবন নিজে যেমন পরকীয়ার মতো ভয়াবহ জীবনে আসক্ত ছিলে তেমনি আমাকেও জড়িয়েছো।এখন বুঝছি ক্ষণিকের সুখ জীবনের সর্বস্ব কেড়ে নেয়।আমারও সেটাই হয়েছে।
সবাই বলে মা মানে প্রথম শিক্ষক,মা মানে প্রথম বন্ধু,মা মানে প্রথম ভালোবাসা,মা মানে প্রথম আশ্রয়।কিন্তু আমার ক্ষেত্রে সেটা কী আদেও ছিলো।হ্যাঁ,সব শখ-আল্লাদ পুরোন করেছো যখন যা চেয়েছি কিন্তু সঠিক শিক্ষা দিতে পারোনি।প্রথম অন্যায় করার পরে যদি ভালো করে বোঝাতে বা শাস্তি দিতে তাহলে বড় ধরনের অপরাধ কোনোদিন করতে পারতাম না।কিন্তু তুমি ভুল না শুধরে সব সময় বলেছো আমি যা করি তাই ঠিক।একটা কথা মাথায় রেখো মা,পরের খারাপ চাইলে নিজেরও ক্ষতি হয়।
আর বাবা,তোমাকে নানা সময় নানা ভাবে মায়ের দেখাদেখি খারাপ ব্যাবহার করতাম, এমনকী গায়েও হাত তুলতাম।পারলে আমাকে ক্ষমা করে দিয়ো।মেজো,ছোট ভুল যা করেছিস সেই পথ থেকে ফিরে আসার চেষ্টা কর,নয়তো আমার মতো সব হারাবি।আর শুভ তুই সব সময় ঠিক ছিলি,পারলে তুইও ক্ষমা করিস এই খারাপ বোনকে।
আমি চলে যাচ্ছি মা,হয়তো তোমরা যখন এটা পাবে আমি অনেক দূরে।একটা ভুলে স্বামী হারালাম,নাড়ী ছেঁড়া মেয়েকে হারিয়েছি আর সাথে নিজের জীবনে বয়ে এনেছি ক্ষণিকের সুখের হন্য মরণব্যাধি।কী চমকিয়ে গেলে,তাই না?মরণব্যাধি এইজন্য বলছি কারন আমার এইচআইভি এইডস্ হয়েছে।তাই চলে যাচ্ছি অনেক দূরে,উহু ভয় পাবেনা।আত্মহত্যা করে পাঁপ আর বাড়াবোনা।তবে যতদিন বেঁচে আছি দূরে কোথাও থাকবো, কেননা তোমাদের সাথে থাকলে রোজ রোজ অপরাধ বোধ আমাকে কুড়ে কুড়ে খেতো।আমার মেয়েটার কথা মনে পরতো,জানি সামীর কোনোদিন ওকে কষ্ট দিবেনা।কেননা নীরা সামীরের প্রাণ।আমাকে প্লীজ কেউ খুঁজবেনা,আর খুঁজলেও পাবেনা।আচ্ছা মা,এই অপরাধবোধ আমাকে বেঁচে থাকতে যে কষ্ট দিচ্ছে,সেটা মানতেই পারছিনা,তাহলে মৃত্যুর পর আযাব কীভাবে সহ্য করবো বলোতো?কী হতো তোমার মেয়েকে মর্ডান না বানিয়ে আল্লাহর রাস্তায় ঈমানের পথে নিয়ে আসলে।অন্ততপক্ষে পাপ কাজ করতাম না।
যাই হোক একটা কথাই বলবো,পারলে ভালো হয়ে যেয়ো,সময় থাকতে সৎ পথে ফিরে এসো।আর আমার চলে যাওয়ার পিছনে কেউ দায়ী নয়,তাই অহেতুক কাউকে দোষী করবেনা।আর যদি দোষী করতেই চাও তাহলে সেটা তুমি।কেননা আমার গোটা জীবন তুমিই নষ্ট করে দিয়েছো।
ইতি
জারিকা”
চিঠিটা পরে মিসেস নিন্দু ধপ করে পাটিতে বসে পরেন।উনার স্বামী কেঁদে চোখের পানি ভাসাচ্ছে, তিন ভাই-বোনের মুখে কোনো কথা নেই।হঠাৎ করে মিসেস নিন্দু চিৎকার করে কাঁদতে শুরু করেন,হাজার খারাপ হলেও “মা” তো “মা” হয়।আজ মনে হচ্ছে উনি কত বড় ভুল করেছেন।পাশ থেকে হাতরে হাতরে ফোন খুঁজে আত্মীয়-স্বজনের কাছে কল করেন যে মেয়ে উনাদের বাড়িতে আছে নাকী।
সেদিন থেকে আজ পর্যন্ত এমন কোনো পরিচিত জায়গা বাকী নেই যে বাদ রাখেননি জারিকার খোঅজ করতে।তবে কিছু আত্মীয়দের অনেকে স্বভাবসুলভ খোঁজার বদলে দুর্নাম ছড়িয়ে বেড়াচ্ছে,হতে পারে কর্মের প্রাপ্তি যেমনটা মিসেস নিন্দু আর তার মেয়েরা মিলে করতো।সামীর কথাটা জানার পরপরই নিজেও খোঁজা শুরু করে,যদিও আলাদা হয়েছে তবুও ছোট মেয়ের জন্য তার করতে হবে।তাছাড়া ভালোবাসে যে আজও জারিকাকে,ও জানে যে ওর অজান্তে মেয়ের সাথে এসে দেখা করে জারিকা।আর মেয়েও বাবাকে জানায়না মায়ের কথা,ওর ধারনা মায়ের কথা জানালে বাবা আর মাকে আসতে দেবেনা।অবশ্য সবটা জনে সামীর,দূর থেকে ও নিজেও মাঝে মাঝে জারিকাকে সুযোগ করে দিতো মেয়ের সাথে দেখা করার।ও বুঝতে পারছেনা জারিকা হঠাৎ কোথায় চলে গেলো?শুধু একটা সম্পর্ক কাগজে-কলমে সত্যিই কী শেষ হয়ে যায়?
(২০২)
-“যে ভালোবাসে তার শাসন করার অধিকার থাকে,আর আগলে রাখাটা সেটা জীবনের একটা গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব।এখন একটু হাসোতো দেখি।”
-“ধুর কথা বলবেন না আপনি আমার সাথে।আপনি খুব খারাপ।”
ইয়ারাবী কপট রাগ দেখিয়ে মুখটা অন্যদিকে ঘুরিয়ে কথা বললে।আসলে সকালে খাবার না খাওয়ার জন্য আবরার ওকে বকা দিয়েছে,যার জন্য এই পর্যন্ত ওর সাথে কথা বলেনি ইয়ারাবী। আবরার শব্দহীন ভাবে হাসে মাথা নাঁড়িয়ে বলে,
-“অবশ্যই ম্যাডাম,সেটা আমি সব সময় স্বীকার করি।”
-“আপনি আবারও হাসচ্ছেন?”
-“আসলে কী বলতো?তোমার এই মুখটা দেখে সারাদিনের ক্লান্তি দূর হয়ে মুখে এমনিতেই হাসি চলে আসে।”
আবরারের এমন কথা শুনে ইয়ারাবী আড়চোখে ওর দিকে তাকায়।আবরার পিছন থেকে ওর কোমর বন্ধন করে সোফায় বসে নিজের কোলের উপরে বসিয়ে বলে,
-“ওজন এখনও বাড়েনি,সেই চল্লিশে আছো।তোমার থেকে ছোট ছোট বাচ্চারাও কথা শুনে,কিন্তু তুমি?”
-“ভুল বললেন চল্লিশ নয় পয়তাল্লিশ।আর মিথ্যা বলবেন না,আমি সব শুনি।”
কথাটা শুনে আবরার ইয়ারাবীর কাঁধের উপর মাথা রাখতেই ইয়ারাবী চেঁচিয়ে উঠে।আবরার হকচকিয়ে উঠে বলে,
-“ব্যাথা এখনো?”
-“না না ব্যাথা নয়।”
আবরার বাম সাইডের ভ্রু উঁচু করে প্রশ্নসূচক চোখে ওর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে,
-“তাহলে?”
-“শুরশুরি লাগেতো নাকী?”
-“হায়রে আল্লাহ!আমার কপালে যে কত দুঃখ আছে।”
-“আপনার কপালে দুঃখ কেন থাকবে?”
আসলে ইয়ারাবী ওর কথায় অর্থ সঠিকভাবে বুঝতে পারেনি,তার জন্য বোকার মতো প্রশ্ন করে উঠে।আবরার মুচকি হাসছে আর ওর চুলগুলো নিয়ে খেলছে,হঠাৎ করেই বলে উঠে,
-“আজ বিকালে কিন্তু শ্বশুড়বাড়ি যাচ্ছি।”
-“সত্যি!সতেরদিন হয়ে গেলো এখনো ভাইয়াদের সাথে কোনো কথা বলতে পারলাম না।চলুন ভালোই হবে,অনেক মজা করবো।”
-“হায়রে পাগলি,আমি ইরাকদের নয় তোমার বাবার বাসায় কথা বলছি।”
ইয়ারাবীর কথাটা যেন সহ্য হলোনা,ও আবরারের কোল থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বেলকনির শেষ প্রান্তে চলে যায়।আর অানমনে আকাশের মেঘগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকে।আবরার মনে হয় বিষয়টা বুঝতে পারে,তাই ওর পাশে যেয়ে রেলিংএর উপর বসে বলে,
-“দেখ ইয়ারাবীর,হজরত যুবাইর বিন মুতইম (রা.) থেকে বর্ণিত এক হাদিসে হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘আত্মীতার সম্পর্ক ছিন্নকারী জান্নাতে প্রবেশ করবে না। ’ -(বুখারি ও মুসলিম)।অন্যত্র ইরশাদ হচ্ছে, হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘আত্মীতা আল্লাহতায়ালার সামনে দাঁড়িয়ে বলল, আমাকে বিচ্ছিন্ন করা থেকে আপনার কাছে আশ্রয় প্রার্থনার সময় এটা। আল্লাহতায়ালা বলেন, হ্যাঁ, তবে তুমি কি এতে সন্তুষ্ট নও, যে তোমার সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখবে আমি তার সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখব এবং যে তোমাকে ছিন্ন করবে আমি তার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করব? শুনে আত্মীয়তা বলল অবশ্যই। তখন আল্লাহতায়ালা বললেন, তোমার জন্য এরূপই করা হবে। -(বুখারি ও মুসলিম)।হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত আরও একটি হাদিসে জনৈক ব্যক্তি হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.)-কে জিজ্ঞাসা করল, আমার কিছু আত্মীয় এমন আছে, তাদের সঙ্গে সম্পর্ক যতই জুড়ি ততই তারা ছিন্ন করে, যতই সৎ ব্যবহার করি তারা দুর্ব্যবহার করে, সহনশীলতা অবলম্বন করলেও তারা বুঝতে চায় না। তখন হজরত রাসূল (সা.) বলেন, ‘যদি ব্যাপারটি এমনই হয়, যেমন তুমি বললে তাহলে তুমি তাদের অতি কষ্টের মধ্যে নিক্ষেপ করলে, আর তুমি তাদের সঙ্গে যেভাবে ব্যবহার করে চলছ, তা যদি অব্যাহত রাখতে পার তাহলে আল্লাহ সর্বদা তোমার সাহায্যকারী থাকবেন। ’–(মুসলিম)
বুঝতে পেরেছো তুমি,উনারা উনাদের ভুল বুঝতে পেরেছে।আমরা যেখানে বাস করি,সেখানের বেশিরভাগ মানুষগুলো খুব ভয়ংকর।না চাইতেও অনেক কথা আমাদের কানে বিষের মতো লাগে, আর একটা সময় আমরা সেটাতে না চাইতেও বিশ্বাস করি।”
ইয়ারাবী কোনো উত্তর দেয়না,পূর্বের ন্যায় আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে।আবরার নিজেও চাইতো না ইয়ারাবী ওর বাবা-মাকে ক্ষমা করে দিক,কেননা উনারা যা করেছে সেটা ক্ষমার অযোগ্য।কিন্তু কিছু করার নেই,কেননা ইয়ারাবীকে সম্পূর্ন সুস্থ করতে হলে বাবা-মায়ের ভালোবাসা আগে দরকার।এমনিতেও এই কয়দিনে অসুস্থ শরীরে বড্ডো বেশি ধকল গেছে।আবরার ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে দু’টা বিশ মিনিট বাজে,ও রুমে যেয়ে একটা পেইনকিলার আর এক গ্লাস পানি এনে ইয়ারাবীর সামনে ধরে।আর ও নিজেও খেয়ে নেয়।
-“শরীরের ব্যাথা কী এখনো আছে?”
-“একটু একটু,জাযাকাল্লাহু খায়রান।আপনি না থাকলে কী হতো সেটা ভাবলেই ভয় হয়।”
আবরার ওর হাত থেকে গ্লাসটা নিয়ে বলে,
-“স্ত্রী মানে বোঝো?”
-“মানে?”
-“বোঝেছি বোঝার বয়স হয়নি,যখন হবে তখন বুঝতে পারবে।কিন্তু এখন এভাবে দাঁড়িয়ে না থেকে ঘরে চলো।কিছুদিন এভাবে দুপুরে-সন্ধ্যায় হুটহাট করে বেলকনিতে বা ছাদে একা যাবেনা।”
-“জ্বি,কিন্তু এখন তো আপনি আছেন।আরেকটু থাকি।”
-“উহু,ঘরে চলো ঘুম দিবে।”
-“এখন ঘুমাবো না প্লিজ।”
-“উহু,কোনো বাহানা নয়,এসো।”
-“ধুর আপনি মোটেও ভালো মানুষ নন,একটুখানি ভালো আর পুরোটা পঁচা।”
আবরার হেসে মাথা নাঁড়িয়ে সহমত জানায়।তারপর ওকে কোলে তুলে ঘরে নিয়ে এসে ওকে বেডে শুয়িয়ে দিয়ে মাথাটা নিজের বুকে নিয়ে বিলি কাঁটতে থাকে।আর ভাবতে থাকে দশম রোযার কথা।সেদিন দুপুর থেকেই ইয়ারাবীর পিরিয়ড শুরু হয়েছে,বেশ ঝামেলা পোহাতে হচ্ছে ওকে।শাড়ি সামলে রাখতে একে কষ্ট হচ্ছে তার উপর এই ঝামেলা।ইয়ারাবী বেশ বিরক্ত নিয়ে নিচে নেমে দেখলো মা আর ইকরা বসে কথা বলছে।ইকরার দৃষ্টি ওর দিকে যেতেই ও ইয়ারাবীকে কাছে ডাকে।
-“এদিকে তাই ইয়ু,গল্প করি।”
-“আসছি আপু”
ইয়ারাবীও হাসিমুখে কথা বললেও হঠাৎ কিছু একটা মনে হতেই ও কিচেনে রাখা ফ্রিজের কাছে চলে যায়।ওরাও তেমন একটা পাত্তা দেয়না হতে পারে ক্ষুদা লেগেছে তাই।কিন্তু যা দেখে সেটাই ওদের চোখ কোটর থেকে বেরিয়ে আসার উপক্রম।কেননা ইয়ারাবী পাঁচ রকমের মিষ্টির প্যাকেট নিয়ে ডাইনিং টেবিলে বসেছে,শুধু বসলোই না বরং খাওয়া শুরু করেছে।মিসেস হেনা ওর দিকে তাকিয়ে বলেন,
-“আম্মু তোর তো মিষ্টি খেলে পেটে ব্যাথা হয়।তাহলে আজ?আবরার জানলে রাগ করবে কিন্তু।”
মনে হলো ওর শ্বাশুড়ি অনেক বড় অপরাধ করে ফেলেছেন কথাটা বলে কারণ ইয়ারাবী অনেক রাগী চোখে উনার দিকে তাকালো।তারপর দুই হাত দিয়েই মিষ্টি খেতে শুরু করলো।এতে করে মিসেস হেনার কিছুটা সন্দেহ হয়,উনি সার্ভেন্টকে দিয়ে উনার মাকে ডেকে পাঠান।এদিকে ইয়ারাবীর এভাবে উন্মাদের মতো খাওয়া দেখে ইকরার কিছুটা ভয় লাগে।বাতাসি বানু এসেই বুঝতে পারেন কিছু গন্ডোগোল হয়েছে,তার উপর ওর মাথার চুল ছেড়ে দেওয়া।উনি ইয়ারাবীর পাশে বসে কাঁধে হাত রেখে বলেন,
-“নাতবৌ খুব ক্ষুদা লাগছে?”
ইয়ারাবী মাথা ঝাকাতেই উনি বলেন,
-“আরো কিছু খাবি?”
-“মিষ্টি…”
উনি আর ইয়ারাবী কিছু বলেন না।তবে ইয়ারাবীর খাওয়া শেষ হতেই কোনো একটা দোয়া পরে ফুঁ দিতেই ইয়ারাবী চমকে উঠে উনাদের দিকে তাকাতেই দেখে সবাই অনেকটা বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে আছে ওর দিকে।ও নিজের হাতের দিকে তাকিয়ে বলে,
-“মিষ্টি,আর আমার দুই হাতে কেন লেগে আছে?”
-“ক্যান নাতবৌ তুই তো পাঁচ প্যাকেট মিষ্টি খেলি, মনে নেই।”
-“নানী,আমার মিষ্টিতে সমস্যা আছে।তাছাড়া যদিও খায় তবে একটা-দু’টা খায়,কিন্তু দুই হাত দিয়ে।আর….”
মিসেস হেনা মুখে হাসির রেখা টেনে বলেন,
-“এসব না ভেবে ঘরে যেয়ে ঘুমা,হতে পারে চাপে ভুলে গেছিস।ঘুমালে মাইন্ড ফ্রেস হবে।”
-“জ্বি আম্মু…”
ইয়ারাবী বেশি একটা ভাবেনা বিষয়টা,ওর ধারনা এটা মাথার অপারেশনের জন্য হচ্ছে,যার কারনে ও কিছু জিনিস ভুলে যায়।বাতাসি বানু মেয়ের দিকে তাকিয়ে বলে,
-“আবরাররে ডাক,বিষয়টা সুবিধার মনে হচ্ছেনা।হঠাৎ করে এমন হওয়ার তো কথা না।আর ইকু তুই ওর থেকে দূরে দূরে থাকবি কিন্তু।”
-“কেন দাদী?তুমি কুসংস্কারের মতো কথা বলবে নাতো?ও আমার জা হয়,তাছাড়া বোনের মতো, ওর থেকে কীসের ক্ষতি হবে?”
-“চুপ বেয়াদপ তুই কী বুঝিস?এই সময় গর্ভবতী মেয়েরা অনেকটা জ্বীনের আকর্ষনীয় হয়ে থাকে।তোরা শহরের তাই মান্য করিসনা,কত নিয়ম আছে যা তোদের এই সময় মানতে হয়।ওদের কু-নজর পরলে বুঝবি ছ্যামড়ি।যাহ্ যাহ্, যতক্ষণ পর্যন্ত ওর বর না আসছে দূরে দূরে থাকবি।”
মাগরিবের আযানের পর আবরার একজন হুজুরকে সাথে নিয়ে বাসায় আসে।উনি সবটা শুনে ইয়ারাবীকে একটা দোয়া করতে বলেন আর সাবধানে থাকতে বলে চলে যান।ইয়ারাবীও দু’দিন ধরে খুব ভালো আছে।কিন্তু তেরো রোযার সন্ধ্যার কিছুটা আগে আবরার বাসায় এসে রুমে ডুকে দেখে ও খোলা চুলে বেলকনিতে দাঁড়িয়ে আছে।ও হেসে ইয়ারাবীর সামনে দাঁড়িয়ে রোজকার মতো ওর কপালে চুমু দেয়।কিন্তু ইয়ারাবী প্রতিবারের মতো হাসে না বরং রেগে ওকে ধাক্কা দেয়।আবরার কিছু বলার আগেই ও চিৎকার করে অনেক ভারী স্বরে বলে উঠে,
-“তুই আমার কাছে আসবিনা,তোকে আমার সহ্য হয়না।”
এই কথাটা আবরার হজম করতে পারেনা,ও অবাক হয়ে ওর দুই বাহুতে হাত রেখে বলে,
-“কী বলছো তুমি এসব?”
-“একদম গায়ে হাত দিবিনা,সর জায়গা থেকে।”
ওকে কোনো কথার সুযোগ না দিয়েই চুল ছেড়ে ছাদের দিকে নাচতে নাচতে পা বাড়ায়।আবরার কিছুক্ষণ রুমের মধ্যে অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে,ও ভাবতে পারছেনা ইয়ারাবী ওর সাথে এমন করবে।ওর মাথা থেকে জ্বীনের ব্যাপারটা হারিয়ে গেছিলো,হঠাৎ কারো চিৎকারে ওর হুশ আসে।বুঝতে পারে নিচ থেকে ওর নানী চিৎকার করে বলছে,
-“আবরার ওরে ছাদে যাইতে দিসনা,আটকা ওরে।”
আবরারের বুঝতে একটুও অসুবিধা হলোনা আসলে কী হয়েছে।আবরার হাতের ফোনটা বেডে ছুড়ে ফেলে দ্রুত পায়ে ছাদে দিকে যেয়ে দেখে ইয়ারাবী ছাদে যাওয়ার জন্য ছটফট করছে,কিন্তু পারছেনা।কেননা ওকে আবীর আর মেঘ ধরে রেখেছে।আবরারের জানে কিছুটা হলেও পানি আসে।মি.রায়হান উনাদের পরিচিত বড় হুজুরকে কল করে বাড়িতে আসতে বলেন।
ইয়ারাবীকে ঘরের মধ্যে নিয়ে আসা হয়েছে।কিন্তু ওকে বসিয়ে রাখা যাচ্ছেনা।আবরারের শক্তি যেন ওর কাছে নগন্য মনে হচ্ছে।মিসেস হেনা ওকে ধরতে এলে অনেক জোরে আঘাত করে ফেলে দেয়,যার জন্য উনি বাম হাতে কিছুটা চোট পান।ইকরা আর জারবা আলাদা ঘরে বসে আছে, জারবা খুব কান্না করছে।আবরার আর আবীর ওকে ধরে রেখেছে।হুজুর ঘরে ঢুকার সাথে সাথে ও যেন আরো অশান্ত হয়ে পরে।আর বারবার বলে,
-“একে সাথে করে আমি নিয়ে যাবোই,কেউ আটকাতে পারবেনা।”
হুজুর বুঝতে পারেন এ সহজে যাবেনা,কেননা মি.রায়হান উনাকে সবটাই খুলে বলেছেন।তাই উনি ইয়ারাবীর সামনে বসে বলেন,
-“তুমি যে মেয়েটাকে নিয়ে যাবে,ও তোমার কী ক্ষতি করেছে?”
-“ক্ষতি করেনি,ভালো লেগেছে তাই নিয়ে যাবো।”
হুজুরের এবার রাগ হয়ে গেলো,উনি কিছুটা উচ্চস্বরে বললেন,
-“এ একজন বিবাহিতা মেয়ে,ওর স্বামী-পরিবার আছে।তুই চাইলেই তো আর হবেনা।”
-“কেন হবেনা,আজই নিয়ে যেতাম আমি।যদি না এরা আটকাতো।আর ওই বুড়ি হচ্চে বেশি শিয়ানা,বুড়ি যদি না চেঁচাতো তবে নিয়ে যেতাম।এত বছর অপেক্ষা করেছি।”
-“তুই কী বলবি তুই কে?আর কেন আসলি?”
জ্বীনটা কিছুতেই বলতে চাইছেনা,বারবার আবরারের দিকে গরম চোখে তাকাচ্ছে,আঘাত করেছে কিন্তু তবুও আবরার হাত ছাড়ছেনা।আবরারের হাতে অনেক আঁচড়ের জায়গা থেকে রক্ত পড়ছে,এমনকি হাতে কাঁমড়ও দিয়েছে তবুও একটুও সরেনি নিজের জায়গা থেকে।হুজুর কিছুটা দোয়া পরে ইয়ারাবীর মাথায় ফুঁ দেয়,এতে করে কিছুটা নরমাল হয়,কিন্তু ছেড়ে যায়না।হুজুর ইশারা করে আবরারকে সরে দাঁড়াতে বলে।আবরার সরতে না চাইলে উনি বলেন,
-“তোমাকে ওর সহ্য হচ্ছেনা,তুমি ওর থেকে দূরে সরে যাও।তুমি থাকলে ওর ক্ষতি হতে পারে।”
-“কিন্তু?”
-“আবীর তুমিও ছেড়ে দাও ওকে,ওর সাধ্য নেই এখান থেকে উঠার।”
ইয়ারাবী সারা শরীরের দাগ,চোখ ফুলে গেছে, চুলগুলো উস্কো-খুস্কো।পরিবারের সবার খুব খারাপ লাগছে ওকে এভাবে দেখে।হুজুর ওকে বারবার এক প্রশ্ন করছে কিন্তু ওর জবাব একটাই যা হলো,ভালো লেগেছে সাথে নিবো।হুজুর আবার কিছু একটা পড়ে ফুঁ দিতেই ইয়ারাবী চিৎকার করে উঠে বলে,
-“বলছি বলছি,আপনি এসব করবেন না দয়া করে।”
হুজুর মৃদু হাসির রেখা টেনে বলেন,
-“তোর বয়স আমার থেকে বেশি হলেও অভিজ্ঞতায় তোর থেকে আমি এগিয়ে।বল এবার…”
-“আমাকে এর ক্ষতির জন্য পাঠানো হয়েছিলো, চার বছর ধরে চেষ্টায় ছিলাম।কিন্তু কোনো ভাবেই পেরে উঠছিলাম না।কেননা এই মেয়ে নামায,রোযা সব পালন করতো।রাতে যখন শরীর বন্ধ না দিয়েই শুয়ে পরতো সুযোগ খুঁজতাম একে ধরার,ভয় দেখানোর কিন্তু তবুও পারতাম না।”
-“কেন?”
-“কারণ এ ঘুমিয়ে পরলে এর বাবা এসে ওর শরীর বন্ধ করে দিতো।তবুও কীভাবে এই মেয়ে উপস্থিতি টের পেতো আমাদের,আর সেই সুযোগ কাজে লাগাতাম।”
-“তাহলে চার বছর,লম্বা সময় ধরে ক্ষতি করার চেষ্টা করছিস।তবুও পারিসনি?”
-“একটাই কারণ এর ইমান শক্ত।একটা সময় সাথে থাকতে থাকতে একে ভালো লেগে গেলো।কিন্তু…”
ইয়ারাবীর ভিতরে থাকা জ্বীন প্রচুর রেগে আবরারের দিকে তাকায়।হুজুর বুঝতে পেরে বলে,
-“কিন্তু কী?”
-“কিন্তু মাঝে ওর স্বামী এসে আরো কঠিন করে দিলো।প্রতিটা পদে আরো বাঁধা,ভাবলাম এই মেয়ের কাছে পৌঁছাতে হলে আগে ওকে মারতে হবে।কিন্তু এই ছেলের যে কোরআন মুখস্ত সেটা জানতাম না,অনেক কিছু জানে এ আমাদের দুর্বলতা সম্পর্কে।”
-“তোর নাম কী?”
-“আপনি কী করবেন সেটা দিয়ে?আমি এই মেয়েকে ছাড়বোনা।”
-“তুই যদি আবার বাড়াবাড়ি করিস তবে আমি তোকে পুড়াবো বলে রাখলাম।বলবি তুই নাকী?”
জ্বীন কিছু সময় শান্ত থেকে বলে,
-“নগেস।”
-“তুই হিন্দু?”
-“হ্,”
-“তুই কী একা?”
-“আগে ছিলাম,এখন আমরা মোট পাঁচজন।যখন আমি একা কিছু করতে পারতাম না তখন আরো চারজনকে পাঠায়।”
-“কে ক্ষতি করছে বাচ্চা মেয়েটার?তুই বললে তোকে যেতে দিবো?”
-“আমরা জানিনা।নিষেধ আমাদের,বলতে পারবোনা”
হুজুর কিছু একটা ভেবে আবার বলেন,
-“এখন তোরা কয়জন আছিস?”
-“পাঁচজনই আছি,তবে ওরা মুসলমান,আর আমি শুধু হিন্দু।”
মিসেস রায়হান ইয়ারাবীর দিকে তাকিয়ে বলেন,
-“এতদিন ক্ষতি করতে পারলেনা তবে আজ কীভাবে এলে?”
এই কথা শুনে জ্বীনটা হাসতে হাসতে বলে,
-“মেয়েদের এই সময়ে সহজে ওদের শরীরে প্রবেশ করা যায়,কেননা এই সময় ওরা নাপাক থাকে।আর আজ ওর ভুলটা ছিলো বাথরুমে প্রবেশের সময় দোয়া পড়েনি,যা ও সব সময় করতো।কিন্তু ভুলে গেছিলো তাই সুযোগ পেলাম”
-“এর আগেও কী তুমি এসেছিলে?”
-“না,ও একজন মুসলমান ছিলো।ওর এই মেয়েটা পছন্দ বলে ভর করে শুধু মিষ্টি খেয়ে চলে যায়।তবে একমাত্র ওই যে ওকে ঘুমের ঘরে হাত ধরতে পারতো।”
মি.রায়হান হুজুরের দিকে তাকিয়ে বলেন,
-“হুজুর কিছু একটা করুন,মেয়েটার শরীর খুব খারাপ।তার উপর এরা পাঁচজন আরো…”
হুজুর হাত দিয়ে থামার ইশারা করলেন।উনি আবরার আর আবীরকে শক্ত করে ধরতে বলেন।তারপর জ্বীনদের সাথে বিভিন্ন তর্কাতর্কির পর্যায়ে বুঝতে পারেন “রুকিয়া” ব্যাতিত এদের হাত থেকে মুক্তি নেয় মেয়েটার।উনি “রুকিয়া” করা শুরু করলেন,টানা ছয় ঘন্টা ধরে রুকিয়া পর্ব চলতে থাকলো,আর সাথে চলতে থাকে ইয়ারাবীর পাগলামি।ইয়ারাবীর এক একটা চিৎকার, আওয়াজ আবরারের বুকে ঝড় তুলে দিচ্ছিলো।শেষমেষ উনারা সফল হলেন,তবে ইয়ারাবী পুরোটা নেতিয়ে যায়,জ্ঞান একদম নেই ওর।রুকিয়ার সময় জ্বীনেরা হুজুরকে থামানোর জন্য ওকে কম আযাব দেয়নি।
আবরার ওকে বিছানায় শুইয়ে দেয়,তারপর সবাই বাইরে বেড়িয়ে আসে শুধু মা আর নানী ব্যাতিত।মিসেস হেনা একটা বোলে হালকা গরম-পানি এনে ওর শরীর মুছে দেয়,তারপর পোশাক পাল্টিয়ে দেয়,কাঁটা জায়গায় ঔষধ দিয়ে দেয়।এদিকে হুজুর আবরারকে কিছু গুরুত্বপূর্ণ কাজের কথা বলেন।একটা পানি দেন,ওটা তিনবার পান করতে আর বাকীটা দিয়ে গোসলের কথা বলেন,আর ওকে সাবধানে রাখতে বলেন।যেহেতু দীর্ঘ চার বছরে সেহেতু অনেক কষ্ট হয়েছে,আর পরবর্তীতে যাতে আক্রান্ত না হয় তার পদ্ধতিও বলে দেন।রাত বেশি হওয়ায় মেঘ আর আবীর উনাকে পৌঁছে দিতে যান।
আবরার ঘরে ঢুকে দেখে ইয়ারাবীর মুখটা অনেক শুকনো লাগছে,হাতে-পায়ে আচড়ের দাগ।ও এসে ইয়ারাবীর পাশে বসে কপালে হাত রাখে।মিসেস হেনা ফার্স্টএইড বক্স এনে ছেলের হাতের আঘাতের জায়গায় মলম লাগিয়ে দেয়।অনেকটা ভয়ংকর রাত ছিলো এটা ওদের জীবনে।সকালে ঘুম আবরারের আগে ভাঙলেও ব্যাথায় ও উঠতে পারছিলোনা।বেশি ব্যাথা মাথায় আর তলপেটে হয়েছিলো।আবরার আর কখনো চাইনা ওমন রাতের মতো আর রাত আসুক ওদের জীবনে,যার মুল্য ছোট জীবনটাকে চুকাতে হয়।
(২০৩)
বিকালে ইয়ারাবী ঘুম থেকে উঠে দেখতে পায় আবরার আসরের নামায পরছে।পুরো শরীরে একটু একটু করে ব্যাথা এখনো আছে।আস্তে করে উঠে বসে এক ধ্যানে দেখতে থাকে আবরাকে।যতবার দেখে ততবার অদ্ভুত লাগে লোকটাকে।সাদা পান্ঞ্জাবি-পায়জামা,টুপি,সাথে মুখটা বেশ ভালোই মানিয়েছে।ওর বারবার ছুঁতে ইচ্ছা করছে আবরারের দাঁড়িগুলোকে।ওর বাবা যখন বলতো,”আগে দেখবো ছেলের দাঁড়ি আছে নাকী?ছেলের যদি দাঁড়ি থাকে তবেই মেয়েকে বিয়ে দিবো।”তখন ইয়ারাবীর প্রচুর রাগ লাগতো, যে কোনো বুড়ার সাথে বিয়ে দিবে নিশ্চয়ই।কিন্তু এখন ওর কাছে বিশেষ করে আবরারের ক্ষেত্রে সবচেয়ে ভালো লাগাটা ওর দাঁড়িগুলো,ওই ঘটনার আগে যখন আবরারের সাথে ফ্রি ছিলো তখন মাঝে মাঝে দাঁড়ি ধরে টানাটানি করে ওকে ডিস্টার্ব করতো,আবরার বিরক্ত হলেও ওকে কিছু বলতো না।
-“কী ম্যাডাম?বসে বসে আমাকে দেখলেই কী পেট ভরবে?কিছু খেয়ে মেডিসিন যে নিতে হবে।”
ইয়ারাবী কল্পনার জগতে এতটাই বিভোর ছিলো যে বুঝতেই পারেনি যে কখন আবরার ওর সামনে এসে দাঁড়িয়েছে।ইয়ারাবী কিছুটা লজ্জা পেয়ে চোখটা সরিয়ে নিতেই আবরার হেসে দেয়।আবরার ওর চুলের মধ্যে আঙ্গুল চালিয়ে বলে,
-“শাড়ি পরবে নাকী গাউন?”
-“আমি যেতে চাইনা।”
-“ইয়ারাবী,অনেক বড় একটা ঘটনা ঘটে গেছে।কয়েকদিনের জন্য হলেও বাইরে যেয়ে মাইন্ড ফ্রেস করতে হবে।”
-“ভাইয়াদের কাছে যায়।”
-“তোমার ভাইয়েরাও তোমাদের বাসায়,আজ সকালেই গেছে।তাছাড়া তোমার স্টারপুও আছে।আর যেখানে ওরা থাকে সেখানে তুমি যেতে না করবেনা নিশ্চয়ই।”
ইয়ারাবী বুঝতে পারছে যে ওর স্বামী যেয়েই ছাড়বে।এই মানুষটাকে বুঝতে পারেনা ও,এই রোদ তো এই মেঘ।ইয়ারাবী আস্তে করে বিছানা থেকে নেমে দাঁড়িয়ে বলে,
-“আচ্ছা জারবা আর মেঘকে সাথে নিয়ে যায়।”
-“মেঘ প্রথমে যেতে চেয়েছিলো,কিন্তু আব্বুর সাথে সকালে খুলনা যেতে হবে তাই ও না বলেছে।আর দেখো জারবা যায় নাকী।”
ইয়ারাবী ফ্রেস হতেই সার্ভেন্ট খাবার দিয়ে গেলে আবরার ওকে সামনে বসিয়ে পরম-যত্মে খাইয়ে দেয়।জিনিসটা ইয়ারাবীর খুব ভালো লাগে তাই আটকায়না,বলতে গেলে ওর সব স্বভাবেই আবরার ভর করেছে।আবরার উঠে গুছাতে থাকলে,ইয়ারাবী জারবার ঘরে যেয়ে দেখে মেঘ-আবীর-জারবা বসে ক্যারাম খেলছে।যদি এখন বেড়তে না হতো তবে আবরারও এসে যোগ হতো এদের সাথে।আবীরের নজর দরজার দিকে পরতেই বলে উঠে,
-“ইয়ারাবী,ওখানে কেন দাঁড়িয়ে আছো?ভিতরে এসো…”
-“জ্বি ভাইয়া।”
ইয়ারাবী জারবার কাছে যেয়ে বলে,
-“জারবা,আমরা ওই বাসায় যাচ্ছি সেটা তো জানো।”
-“হ্যাঁ।”
-“তুমি যাবে আমাদের সাথে?”
-“সত্যি!”
জারবা খুশি হয়ে লাফিয়ে উঠে কথাটা বলে।আবীর ওর দিকে তাকিয়ে বলে,
-“তোকে না বলেছি লাফাবিনা,এক পা ভাঙার পরেও শিক্ষা হয়নি।”
-“হু,বুঝি বুঝি হিংসা হয় তোমাদের।সবাই আমাকে ভালোবাসে তাই।”
-“ভুলে যাসনা আমি তোর বড়,সবাই তোকে ভালোবাসলেও আমাকে সম্মান করে।”
এদিকে মেঘ একটা লম্বা হাই তুলে বলে,
-“এই বাড়িতে একটারে সম্মান,একটারে ভয় আর একটারে ভালোবাসা আর আমারে তো সবাই নিম পাতার রস খাওয়ায়।জীবনটাই প্যারাময়,আর সব হয়েছে এই পেত্মীর জন্য।”
ইয়ারাবী এতক্ষণ তিন ভাই-বোনকে দেখছিলো।মেঘের কথা শুনে বলে উঠে,
-“ইউ নো মেঘ,নিম পাতা আমাদের শরীরের জন্য কত উপকারি।কাল তোর সমস্যা হয়েছিলো তাই নিম পাতার রস খাইয়েছি,তুই না মানলে যে সত্যিতো আর পাল্টাবেনা যে এটা খেয়েই তুই ঠিক হয়েছিস।তাছাড়া এই নিম গাছের পাতার বিশেষত্ব হলো এটি অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন। এই পাতায় রয়েছে অ্যান্টিফাঙ্গাল এবং অ্যান্টিভাইরাল বৈশিষ্ট্য যা একে আরো শক্তিশালী করে তোলে। নিমপাতায় রয়েছে রোগ প্রতিরোধকারী ক্ষমতা, যার ফলে নানারকম রোগের চিকিৎসায় এটি ব্যবহার করা হয়ে থাকে। গবেষণায় লক্ষ্য করা গেছে, নিম পাতার নির্যাসে এস মিটানস, ই ফ্যাকালিস এবং এস অরিয়াসের মতো উপাদানগুলি রয়েছে, যা কোন ব্যাকটেরিয়াকে ধ্বংস করে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে তুলতে বিশেষ ভূমিকা পালন করে থাকে।
অনেকেই এমন আছেন যাঁরা অত্যধিক রক্তচাপের সমস্যায় ভোগেন। তাঁদের জন্য একটি প্রয়োজনীয় উপাদান হল নিমপাতা। এর নির্যাস শরীরকে ভেতর থেকে পরিষ্কার করতে সহায়তা করে এবং রক্ত বিশুদ্ধ করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। নিয়মিত নিমপাতা খেলে রক্ত চলাচলের পথ প্রশস্ত হয় এবং উচ্চ রক্তচাপের সমস্যা থাকলে তা নিয়ন্ত্রিত হয়। দৈনিক খালি পেটে এক কাপ জলে মধু মিশিয়ে এবং নিমপাতার রস মিশিয়ে খাওয়া গেলে এটি শরীরের রক্ত চলাচলকে ত্বরান্বিত করতে পারে। এছাড়া দৈনিক নিমপাতা গ্রহণ করতে পারলে এটি শরীরে হরমোনের মাত্রাও নিয়ন্ত্রণ করে।
শুধুমাত্র তাই নয়, নিমের মধ্যে হজমে সহায়ককারি কিছু উপাদান রয়েছে যা বদহজমের সমস্যাকে কমাতে এবং খাদ্য হজমে সহায়তা করে। এক্ষেত্রে নিমপাতার রস ব্যবহার করা যেতে পারে। মূলত হজমজনিত অসুস্থতার ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলো নিম। কারণটি হলো নিমপাতায় উপস্থিত ইনফ্লেমেটরি উপাদানগুলি গ্যাস্ট্রিকের এবং হজম সংক্রান্ত সমস্যার সমাধান করে থাকে।
এছাড়াও রক্তের কোলেস্টেরল হ্রাস করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে নিমপাতা। যাঁরা কোলেস্টেরলের সমস্যায় ভুগছেন তাঁদের ক্ষেত্রে রোজ যদি নিমপাতার রস কিংবা জলে ফুটিয়ে নিমপাতার জল গ্রহণ করা সম্ভব হয় সেক্ষেত্রে কোলেস্টেরল মাত্রা শরীরে কমতে লক্ষ্য করা যায়।যে প্রতিদিন এক টেবিল চামচ নিমপাতার রস সকালে খালি পেটে তিন মাস সেবন করলে ডায়াবেটিস ভালো হয়। এছাড়াও এটি খেলে ৩০-৭০% ইনসুলিন নেয়ার প্রবণতা কমে যায়। অপরদিকে ২৫-৩০ ফোঁটা নিমপাতার রস একটু মধুর সাথে মিশিয়ে সকালে খালি পেটে খেলে জন্ডিস রোগ থেকে মুক্তি পাওয়া যায়।বুঝলি নিমের কতগুন,সাধে কী খাইয়েছিলাম তোকে?”
মেঘ নাক কুচকে কপট রাগ দেখিয়ে বলে,
-“ডাক্তারের বৌ চুপ থাকবি।তুই খাস কেমনে এই অখাদ্য,এখনো আমার মুখ তিতা।বুঝছিনা ইফতারিতে কিছু খেতে পারবো নাকী।তুই যাতো বাপের বাড়ী।আর হ্যাঁ,এটারেও নিয়ে যা,বাড়িতে শান্তি থাকবে।”
আবীর মেঘের কান টেনে বলে,
-“বাদর,ও তোর সম্পর্কে ভাবী লাগে।এখনো সেই আগের মত বকবি?”
-“বয়েই গেছে,ওই পেত্মীরে আমি ছোট বোন ডাকি।তাই ভাবী ডাকার প্রশ্নই উঠেনা।”
-“সত্যিই একটা পাগল তুই।”
জারবা ইয়ারাবীর হাত ধরে বলে,
-“ভাবী তাড়াতাড়ি চলো,নয়তো এই পাগলদের মধ্যে থেকে আমরাও পাগল হয়ে যাবো।”
#চলবে_____