জীবন মানে তুমি পর্ব-৫৬

0
3604

#জীবন মানে তুমি
#লেখিকা:H.B.Rini (Irini Ori)
#পর্ব:৫৬

(১৯৩)

-“ধ্যাত,বিয়ের পর ছাড়া কী ঘুমানো যায় নাকী?অার কারো কথা তো জানিনা বাট্ আমার তো ঘুম আসছেনা।বৌয়ের জায়গায় বালিশ,হুয়াট দ্যা হেল?”

কথাটা বলে বিরক্তি সহকারে বেড থেকে উঠে বসে আবরার,যে যন্ত্রণা আজ ওর হচ্ছে সেটার কোনো শেষ নেই।প্রিয়জনের যন্ত্রণা ওকে প্রতিটা মুহুর্ত কাঁদাচ্ছে,বুকের ভিতর চিনচিন ব্যাথা করছে।চোখ বন্ধ করলে ইয়ারাবীর ঘুমন্ত মুখ ভেসে উঠছে,রাত যত বাড়ছে,অস্থিরতা ততো তাড়া করছে।দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বাম হাতটা বাড়িয়ে টেবিলের থেকে ফোনটা হাতে নিয়ে ইয়ারাবীর ছবিটার দিকে তাকিয়ে থেকে বলে,
-“রাত তো অনেক গভীর হয়েছে,নিশ্চয়ই ঘুমিয়ে পরেছো।যাক কেউ একজন তো নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে।কিন্তু আমার তো চোখে ঘুম নেই,তোমার শূন্যতা যে খুব পুড়াচ্ছে আমাকে।”

তারপর সোফার উপরে রাখা বাস্কেটের সামনে বসে বিড়াল দু’টার গায়ে হাত বুলিয়ে বলে,
-“বুঝলি ইনি-মিনি,তোদের মা একজন চমৎকার মেয়ে।সত্যিই আমাকে অসম্ভব ভালোবাসে,এই কয়েক মাসে প্রচুর বকেছি,ঠিকমত কাজ না করলে ধমক দিয়েছি কিন্তু মেয়েটা জেদী-রাগী হলেও কখনো আমার সাথে তর্ক করতে আসেনি।এবারো তাই, মেরেছি ভুল করে তবুও প্রতিবাদ করেনি বরং ক্ষমা করে দিয়েছে।কিন্তু তোদের মামারা ভিলেনের মতো এসে তোদের মাকে আমার কাছ থেকে নিয়ে চলে গেলো।বদের হাড্ডি বিয়ে করেনি তাই বোঝেনি বৌ ছাড়া কেমন লাগে?ধ্যাত,জানে বলেই তো আলাদা করেছে।আমার হয়েছে জ্বালা,এই কয়মাসের অভ্যাস কীভাবে পাল্টায় বলতো?”

এমন করে ও ঘুমন্ত বিড়াল ছানাদের সাথে বেশ কিছুক্ষণ একা একা কথা বলে।তারপর কিছু একটা ভেবে ফোনটা হাতে নিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে সোজা স্ট্যাডি রুমে চলে যায়।কিছুক্ষণ চেয়ারে বসে ল্যাপটপ,কাগজ-পত্র ঘাটাঘাটি করে তবুও মন বসাতে পারছেনা।বারবার মনে হচ্ছে, “মেয়েটা নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পারছে তো?ভয় পাবেনা তো রাতে?বলেছিলো বুকে ঘুমিয়ে অভ্যাস হয়ে গেছে রাতে,তাহলে ছটফট করছে নাতো?”নানা প্রশ্ন আবরারের মাথায় হানা দিচ্ছে।দেয়ালের বড় ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে দেখে রাত দু’টা বেজে পঁয়ত্রিশ মিনিট,মোবাইলের ডিসপ্লে অন করে কিছু একটা ভেবে মুচকি হাসি দিয়ে রুম থেকে বের হয়ে যায়।

(১৯৪)

সকালে জানালায় ফাঁক দিয়ে সূর্যের আলো এসে ইয়ারাবীর চোখের উপর পরতেই ভ্রু দু’টা কুচকে যায়।ঘুমের ঘোরেই মনে হচ্ছে কেউ খুব যত্ন করে জড়িয়ে ধরে রেখেছে,মুখের উপর হালকা খুচা লাগছে।প্রবল জ্বরের জন্য চোখ দু’টা আবিষ্ট হয়ে আছে,খুলতেই মন চাচ্ছেনা।তবুও কৌতুহল মিটানোর জন্য চোখ দু’টা পিটপিট করে তাকিয়ে বুঝতে পারে ওর মাথা বালিশে নয় বরং কারো বুকে আছে।মুখের উপর কারো গরম নিশ্বাস পরতেই উপরের দিকে তাকিয়ে চমকে যায়,এক ঝটকায় তার কাছে থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে বেডের শেষ প্রান্তে বসে পরে।চোখ দু’টা ভালো করে হাত দ্বারা কচলে আবার সামনের দিকে তাকায়,না সে ভুল দেখছেনা একদম ঠিক।নিজের দিকে তাকিয়ে তাড়াতাড়ি পাশ থেকে স্কার্ফ উঠিয়ে গলায় পেচিয়ে নেয়।

এতক্ষণ ধরে তার সামনের ব্যাক্তিটি বেডের সাথে হেলান দিয়ে আধশোয়া হয়ে বসে বুকে হাত বেঁধে ভ্রু কুচকে ইয়ারাবীর কান্ডগুলো দেখছিলো।তবে এই ব্যাক্তিটির মুখভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে উনি অবাকের থেকে বিরক্ত বেশি হচ্ছে,কেননা সেই ব্যাক্তিটি আর কেউ নয় স্বয়ং আবরার।চুলগুলো উস্কোখুস্কো,চোখগুলো ফোলাফোলা,সবুজ মনির চারপাশ কিছুটা লাল হয়ে গেছে বোঝায় যাচ্ছে রাতে ঘুম হয়নি,গায়ে নীল বক্সার গেন্জি আর কালো ট্রাউজার।আবরার এবার আর চুপ করে না থেকে বলে উঠলো,
-“একদিন বাপের বাড়ি এসেছো ওমনি একশো তিন জ্বর বাঁধিয়ে বসেছো।”
-“এটা বাপের বাড়ি নয়,খালুর বাড়ি।আর জ্বর সেটা আপনি মেরেছিলেন তাই এসেছে।”

আবরার একটা ধমক দিয়ে বলে উঠলো,
-“রাতের মধ্যেই তোমার জ্বর কমিয়েও দিয়েছিলামএসবের কিছুই হতোনা যদি একঘন্টা ধরে লম্বা শাওয়ার না নিতে।”
-“আপনি কী করে জানলেন?তার থেকে বড় কথা আপনি ভিতরে আসলেন কীভাবে আর কখন আসলেন?ভাইয়ারা আপনাকে দেখলে রেগে যাবে।”

আবরার একটা ডোন্ট-কেয়ার ভাব নিয়ে আড়মোড়া ছেড়ে বলে,
-“তোমার ছোট ভাইয়া স্ব-সম্মানে আমাকে ভিতরে এনেছে।বাকী রইলো ওই দু’টার কথা,বেশ ভালো লেখাপড়া করিয়ে ছেড়েছে বদ দু’টা?”

ইয়ারাবী অবাক চোখে ওর দিকে তাকিয়ে বলে,
-“মানে?”

আবরার একটানে ওকে নিজের কাছে নিয়ে বলে,
-“রাতের ঘুম হারাম করে দিয়েছে,না দিনে কাজে মন বসাতে পেরেছি না রাতে।তোমাতেই সবকিছু অাবদ্ধ হয়ে আছি,গ্রাস করে নিয়েছো আমাকে।বশ হয়ে গেছি আমার শ্যামকুমারীর মধ্যে বৌ।”
-“আ…আপনি কী বলছেন এসব?দ…দেখুন আমার খারাপ লাগছে,আমার গা..গায়ের তাপ লাগছে আপনার,প্লিজ দূরে সরে যান।”
-“দূরে যাওয়ার জন্য তো কাছে আসিনি সোনা, বললাম না সব তোমাতেই আবদ্ধ।তুমি দূরে যেতে চাইলেও যেতে পারবেনা।”
-“আ…আবরার আপনার কী হয়েছে?”
-“আমার কী হবে?আই এম্ ফাইন,তবে ঘুমাতে চাই।কাল সারা রাত ঘুমাতে পারিনি জান…”

-“তা পারবি কেন?এসব উল্টো-পাল্টা কাজ করার আগে মনে ছিলোনা।”
ইরাক একটা সাদা গেন্জি আর থ্রী-কোয়াটার প্যান্ট পরে হাতে ফোন ঘাটতে ঘাটতে রুমে ঢুকে কথা বলে।ইয়ারাবী ওর ভাইকে দেখে আবরারের কাছে থেকে দূরে সরে যায়।ইরাক একবার ওদের দিকে তাকিয়ে বলে,
-“দুঃখীত নক করে আসা উচিত ছিলো,আসলে পুরাতন অভ্যাস তো তাই।”
-“ইরাক সেন্টি কথাবার্তা বলবিনা।”
-“দেখ তোর বন্ধু হলেও সম্পর্কে তোর থেকে অনেক বড়।সুতরাং সম্মান দিয়ে কথাটা বলবি।”

ইরাক কিছুটা ভাব নিয়ে কথাটা বললে আবরার বিছানা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে আড়মোড়া ছেড়ে বলে,
-“নির্ঘাত বৌকে পাওয়ার জন্য এই আবরার তোদের সামনে কান ধরে ধরেছে,নয়তো জীবনের এই অষ্টম আশ্চর্য দেখতে পারতিনা।”

-“ক…কান ধরেছে মানে?”
ইয়ারাবী অবাক হয়ে প্রশ্নটা করে উঠলে আবরার বিরক্ত চাহনি দিয়ে ওয়াশরুমে চলে যায়।ইরাক যেয়ে বোনের পাশে বসে ওর কপালে হাত রেখে বলে,
-“জ্বরটা এখনো পরেনি,ফ্রেস হয়ে কিছু খেয়ে আবার শুয়ে পরিস।”
-“ভাইয়া উনি কখন এসেছেন?”
-“তুই জানিসনা,রাতের কথা তোর মনে নেই?”

ইরাক ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে কথাটা বলে।ইয়ারাবী কিছুটা সময় চুপ করে থেকে বলে,
-“কাল রাতে ভয় পেয়েছিলাম,তারপর তুমি আসলে আর ঘুমিয়ে গেলাম।এছাড়া তো আর কিছু মনে নেই।”

ইরাক খানিকটা মৃদু হেসে নেয়।মেয়েটার কাল রাতের কথা মনে থাকার কথা নয় অবশ্য তবে কাল যা হয়েছে তারা ওরা তিন ভাই কোনোদিন ভুলতে পারবেনা।কেননা অষ্টম আশ্চর্যের জিনিসের মতো কিছু দেখেছে যে।
কাল রাতে ইফাজ ঘরে আসার কথা বললেও দুই ভাই কফি নিয়ে ছাদে চলে গেছিলো।ইফাজ ওর মন থেকে কথাগুলো সরাতে পারছেনা,ও চেয়েছিলো এবার তারার সাথে দেখা হলে নিজের মনের কথাগুলো বলবে।কিন্তু তার আগেই সব এলোমেলো হয়ে গেলো।অবশ্য তারাকে দেখার সাথে সাথে এমন খেয়াল মাথার মধ্যে হানা দিচ্ছিলো,কিন্তু ও সেটা পাত্তা দেয়নি।নানা কথা ভাবতে ভাবতে ওর চোখ থেকে নোনাজল বের হচ্ছিলো।ইরাক বুঝতে পারে ভাইয়ের মনের অবস্থা,তাই ওর মাইন্ডটাকে ঘুরানোর জন্য বিভিন্ন কথাবার্তা বলতে থাকে।ঠিক তখনি ইয়ারাবী ঘর থেকে চিৎকারের আওয়াজ আছে,ভাইয়া ভাইয়া বলে অনেক জোরে ডাকতে থাকে।ওরা দু’জনই দ্রুত ছাদ থেকে নেমে ওর ঘরে যেয়ে দেখে বিছানার এক কর্ণারে গুটিশুটি মেরে বসে আছে আর অনাবরত কাঁপছে।ওরা ঘরের লাইটটা জ্বালিয়ে দিয়ে ছুটে যায় বোনের কাছে।ইয়ারাবী ওর বড় ভাইকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলে,
-“ভা…ভাইয়া ও আ…আমাকে নিয়ে যাবে।ভাই…ইয়া ও ছিলো এখানে…ও ও…”
-“শান্ত হ,কেউ নেই এখানে।দেখ আমরা আছি শুধু।”
-“না,ছ..ছিলো এখানে।আমার হাত আজ ও ধ..ধরতে এসেছিলো।”
-“হুজুর না তোকে শরীর বন্ধ দিতে বলেছিলো।”
-“মনে ছ…ছিলোনা।”

ইফাজ ওর রুম থেকে প্রেশার মাপার জন্য স্ফিগমোমনোমিটার নিয়ে আসে,প্রেশার মাপায় পর বুঝতে পারে প্রেসার অনেক হাই হয়ে গেছে।এদিকে গাঁয়ে কাঁপুনি দিয়ে জ্বর চলে এসেছে।ইফাজ ওকে কিছু মেডিসিন খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিতেই হঠাৎ কলিংবেলের আওয়াজ শুনতে পায়।ইরাক ইয়ারাবীর কপালে ভেজা রুমাল রেখে ইফাজের সাথে নিচে নেমে দেখে ইমান দরজা খুলে অবাক চোখে দাঁড়িয়ে আছে।ওরা বিষয়টা বোঝার জন্য কাছে যেয়ে দেখতেই চমকে যায়।কেননা আবরার একটা গেন্জি আর ট্রাউজার পরে হাতে ফোন আর গাড়ির চাবি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।বেচারার মুখ দেখে বোঝায় যাচ্ছে কতটা কষ্টে আছে আর এখানে কেন এসেছে।ইমন অবাক চোখে আবরারের দিকে তাকিয়ে বলে উঠে,
-“ভাইয়া আপনি এখানে?”
-“কেন আসতে পারিনা?”
-“না তা নয়,ভিতরে আসুন।”

আবরার ভিতরে ডুকে ওদের দিকে তাকিয়ে বলে,
-“আমার বৌ কী ঘুমাচ্ছে?”

ইরাক ওর দিকে তাকিয়ে চুলগুলো মুঠো করতে করতে বলে,
-“তোকে না আসতে নিষেধ করেছিলাম?”
-“দেখ আমি বলছি আর কোনোদিন এমন করবোনা।কাজের চাপে মাঝে মাঝে মেজাজ খিটখিটে হয়ে যায়,তবুও রাগটাকে চেপে রাখি।কিন্তু স্বয়ং আমার চোখের সামনে দাঁড়িয়ে মিথ্যা বলার জন্য রাগটা অতিদ্রুত বেড়ে গেছিলো।”
-“দেখ আবরার আমরা জানি,ওকে যেমন আমরা আগলে রাখি তুই তার থেকে বেশি করসি,বেশি ভালোবাসিস।কারণ ও তোর স্ত্রী,তোর অর্ধাঙ্গীনি।কিন্তু তোর এই রাগের বসেই গায়ে হাত তোলার জন্য ওর বড় কোনো ক্ষতি না হয়ে যায় সেই ভয়টা পায় সর্বদা।”

আবরার ওদের তিনজনের সামনে হঠাৎ কান ধরে হাটু ভাঁজ করে বসে পরে।এখানে যে ইমন ওর বয়সে ছোট উপস্থিত আছে সেটা ও পাত্তা দেয়না।ওরা এমন কিছু আশা করেনি,ওর কান ধরা দেখে মনে হয় আকাশ থেকে পরবে এমন অবস্থা।ইমন তো লজ্জায় নিজের ঘরে চলে যায়,আবরার বলে উঠে,
-“দেখ আমি কানে ধরে বলছি কোনোদিন ওর গায়ে হাত তুলবোনা।শুধু যে তোরা এমন করছিস সেটা নয়,আমার পুরো বাড়ির মানুষ উঠতে-বসতে আমাকে বকছে।আব্বু বাসায় নেই বলে রক্ষে, আজ বিকালে বাসায় এসে যদি দেখে…দোস্ত প্লিজ তোরা এমন করিসনা।দেখ শুধু যে আমি কষ্ট পাচ্ছি তা নয় আমার বৌটাও পাচ্ছে।শুধু তোদের ভয়ে কিছু মুখ ফুটে বলছেনা,জানিস সারাদিন খেতে পর্যন্ত পারিনি।”

আবরারের করুন স্বর শুনে ওরা দু’জনে হেসে ফেলে ওকে জড়িয়ে ধরে।ইরাক ওর দিকে তাকিয়ে বলে,
-“তুই যখন প্রস্তাব দিলি জানিস মানা করিনি কেন?কারণ কলেজে তুই যেমনি ছিলিস না কেন মেয়েদের প্রচুর সম্মান করিস,হ্যাঁ তবে তোর যে দোষ নেই…থাক সেটা বলছিনা।তুই সাইক্রেটিস, মানুষকে বুঝতে পারিস,তোর কাছে অভাগা বোনটা থাকলে ভালো থাকবে তাই।”

ইফাজ ওর দিকে তাকিয়ে বলে,
-“ভেবেছিলাম দু’তিন দিন তোকে বৌ ছাড়া রাখবো তবে একদিনে যে হাল করেছিস।ঘরে ঘুমাচ্ছে যা, প্রেশার বেড়েছে আর জ্বরও এসেছি একটু খেয়াল রাখিস।”

ওদের বলতে দেরি হলেও আবরারের যেতে দেরি হয়নি।ঘরে ঢুকেই যেই ইয়ারাবীর ঘুমন্ত মুখটা,ও এতটাই বিভোর যে ঘরের দরজা লক করেনি।আবরার ইয়ারাবীর পাশে বসে ওর মুখে হাত রাখে।তারপর কপাল থেকে রুমাল সরিয়ে ভালোবাসার পরশ একে দেয়।ওর মাথাটা নিজের বুকের সাথে নিয়ে বাম হাত দিয়ে আগলে ধরে ডান হাত দিয়ে রুমালটা পানিতে ভিজিয়ে ওর মুখটা মুছে দিয়ে কপালে রাখে।বাইরে দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে দুই ভাই এসব দেখে মুচকি হেসে ঘরে শুতে যায়।

ইয়ারাবী এতক্ষণ ধরে ভাইয়ের কাছে ঘটনাটা শুনছিলো,ওর মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে সব।এসব যে এরেন্জ্ ম্যারেজে হয় সেটা ওর ধারণাতেই ছিলোনা।আবরার ওয়াশরুম থেকে বেড়িয়ে ইরাকের দিকে তাকিয়ে বলে,
-“ওর জ্বর পরলে তবে যাবো,বাট্ এক্সটা কাপড় দে কারণ আমি কিছুই আনিনি সাথে।”
-“তুই কবে থেকে পারমিশন নিস?”
-“বৌ ফর্মালিটি।”
-“সাথীকে দিয়ে পাঠিয়ে দিচ্ছি,ওকে ফ্রেস করিয়ে দে।”

ইরাক ফোন চালাতে চালাতে বের হয়ে যায়।আবরার ইয়ারাবীর দিকে তাকিয়ে বলে,
-“তোমার মনে হয়না তোমার ভাইয়া…”
-“প্রেম করছে তার জুনিয়ার অফিসারের সাথে।খালামনির বান্ধবীর মেয়ে,নাম রাজিয়া।ভাইয়ার থেকে সারে তিন বছরের ছোট।ভাইয়া শর্ট ফর্ম রোজ বলে ডাকে।”
-“বাহ্হ্,সবটাই জানো দেখছি।”
-“আপনার মনে নেই,লন্ডনে থাকতে একবার কথা বলিয়ে দিয়েছিলো।”
-“হতে পারে,আচ্ছা উঠো তুমি।ফ্রেস করিয়ে দেয়, ড্রেস তো এই বাসাতেই আছে সব।”

ইয়ারাবী হেসে বলে,
-“হেজাবের পিন পর্যন্ত পাবেন এই বাসাতে।”

আবরার আর কথা না বাড়িয়ে ওকে নিয়ে ওয়াশরুমে যায়।

(১৯৫)

বেলা বারোটা বাজে,অনু আজ টিএসসির টোং দোকানের সামনে গাল ফুঁলিয়ে বসে আছে।আজ প্রত্যয়ের জন্য মেরুন কালারের শাড়ি পরেছে, কোকড়ানো চুলগুলো বিনুনি বেঁধেছে,কানে ঝুমকো,গলায় মালা,হাতে কাঁচের চুড়ি,ঠোঁটে লিপিস্টিক সব মিলিয়ে অনন্য সুন্দরী লাগছে।তবে যার জন্য এতে সেজেছে তার আসার কোনো নাম নেই।কেননা টানা এক ঘন্টা ধরে ছয় কাপ চা খেয়েছে মেয়েটা তবুও ছেলের কোনো আসার খোঁজ নেই।চায়ের দোকানের লোকটাও অদ্ভুত ভাবে তাকিয়ে আছে অনুর দিকে,হয়তো ভাবছে এত বড় চা খাদক মেয়ে আজ পর্যন্ত দেখেনি।এবার অনু অনেকটা বিরক্ত নিয়ে দোকানদারকে টাকা দিয়ে রাস্তায় পা দিতে যাবে তখনি একটা কালো বাইক এসে ওর সামনে ব্রেক করে।অনু অনেকটা ভয়ে পেয়ে চোখ খিচে বন্ধ করে চিল্লানি দিতে যাবে তখনি মনে হচ্ছে কেউ ওর মাথায় কিছু পরিয়ে দিচ্ছে।চোখ খুলে তাকিয়ে দেখে ওর সামনে বাইকে প্রত্যয় বসে ওর মাথায় হেলমেট পরিয়ে দিচ্ছে।অনু অনেকটা রেগে বলে,
-“এটা কী ধরনের কাজ প্রত্যয়?”
-“কেন ভয় পেয়েছো?”
-“ভয় কেন পাবো খুশিতে নাচতে ইচ্ছা করছে।”

অনু কথাটা বলে মুখটা রাগ করে ঘুরিয়ে অন্য দিকে তাকায়।প্রত্যয় ওর কাজে হেসে দিয়ে বলে,
-“তোমাকে তো আমার থেকেও সাহসী হতে হবে অনু?কারণ আমাদের জীবনের কোনো নিশ্চয়তা নেই।”
-“তুমি আবার শুরু করেছো?”
-“আচ্ছা বাবা স্যরি।”
-“তোমার ফোন কোথায়?কল করেছি রিসিব করোনি কেন?”
-“আরে বাইকের উপর ছিলাম শুনতে পাইনি।উঠে বসো,তোমাকে নিয়ে একটা জায়গায় যাবো।”

অনু অনেকটা আগ্রহ নিয়ে প্রশ্ন করে,
-“কোথায়?”
-“গেলেই দেখতে পাবে।”

অনুর আর কথা না বাড়িয়ে বাইকে উঠে বসে।ঘন্টা দু’য়েক পর একটা দশ তলা এপার্টমেন্টের সামনে দাঁড়িয়ে প্রত্যয় অনুকে বাইক থেকে নামতে বলে।অনু বাইক থেকে নেমে হেলমেট খুলে বলে,
-“এখানে কেন আমরা?”
-“কারোর সাথে দেখা করাবো তোমাকে।আমার পিছু এসো”

প্রত্যয় এন্টি রেজিষ্টার করে অনুকে নিয়ে লিফ্টে করে সাত তলায় যেয়ে ডান পাশের ফ্ল্যাটের কলিংবেল বাজাতেই একজন বারো-তেরো বছরের বিদেশী মেয়ে এসে দরজা খুলতেই আধো বাংলা ভাষাই বলে উঠলো,
-“পাপ্তো ভাইয়া,তোমার সাথে লেডিটা কে?”

প্রত্যয় ওর মেয়ের সোনালি চুলগুলো টেনে বলে উঠলো,
-“আমি প্রাপ্ত নয় বরং প্রত্যয়,আর এইটা তোর বৌমনি।আর যেয়ে সবাইকে ডেকে আন,অনু ভিতরে এসো।”

মেয়েটা মাথা চুলকাতে চুলকাতে ভিতরে চলে যেতেই প্রত্যয় অনুর দিকে তাকিয়ে হেসে বলে উঠলো,
-“আমার বোন ফিলা।”
-“কিন্তু ওরা তো…..”
-“কাল এসেছে,আমি ইচ্ছা করেই বলিনি।”

প্রত্যয় অনুর সাথে নানান কথা বলছে আর অনু শুধু মাথা নাড়াচ্ছে।আসলে ও ভাবতে পারেনি প্রত্যয় এমন একটা সারপ্রাইজ দিবে।এর মধ্যে প্রত্যয়ের দাদা-দাদী,ওর বাবা-মা আর ফিলা চলে আসে।প্রত্যয় ইশারায় সবার অাশীর্বাদ নিতে বললে,অনু প্রথমে ওর দাদা-দাদী তারপর ওর বাবার পায়ে হাত দিতে গেলে উনি পা সরিয়ে বলেন,
-“এসব ন্যাকামি আমার সাথে করবেনা।”

প্রত্যয় ওর বাবার দিকে তাকিয়ে বলে,
-“এখানে ন্যাকামির কিছুই নেই বাবা,বরং এটা ভালো লক্ষণ।”
-“তোমার বাবা আমি,তুমি আমার বাবা নও।”

প্রত্যয়ের বাবা কথাটা বলে ঘরের ভিতরে চলে যান, অনু এই অাচারনে অপমান আর সাথে কিছুটা লজ্জাও পায় যার কারনে ওর চোখ দু’টো ছলছল করে উঠে।প্রত্যয়ের ছোট মা অর্থাৎ মিসেস কিয়াকো অনুর মুখে হাত রেখে ইংরেজিতে বলেন,
-“হেই হানি,ক্রন্দন করবেনা।আমার স্বামী নারিকেলের মতো উপরে শক্ত ভিতরে নরম।উনিও তোমাকে মেনে নিবেন।বাবা-ছেলের সম্পর্কটা এখানে একটু অন্যরকম।”

ফিলা পাশ থেকে বলে উঠে,
-“ভাইয়া যেন কী বললো?ভৌমনি তাইতো,তুমিও আমার ভৌমনি।”
প্রত্যয় ওর মাথায় চাটি মেরে বলে,
-“ওটা ভৌমনি নয় বৌমনি হবে।আর এখনো হয়নি বিয়ের পরে হবে।”
-“ওয়াও,জীবনে প্রথমবার বেঙ্গলি বিবাহ দেখবো।”
-“হামম অনেক মজা হবে।”

প্রত্যয়ের বাবা ছাড়া সবাই অনুর সাথে ভালো ব্যবহার করে।অনুর ভিতরে ভিতরে চাপা একটা কষ্ট লাগছে,তবুও কিছু বলছেনা।প্রত্যয়ের বাসায় বেশকিছুক্ষণ থেকে খাওয়া-দাওয়া করে বিকাল পাঁচটার দিকে প্রত্যয় ওকে ওর ফ্ল্যাটের সামনে ড্রপ করি দিয়ে বলে,
-“দুঃখীত অনু,আমার বাবার সাথে সম্পর্ক বেশি ভালো নয়।উনি কখনো আমার আর প্রাপ্তর সুখ সহ্য করতে পারেন না।আমি জানতাম উনি অফিসে আছে তাই তোমাকে নিয়ে গেছিলাম।আমি ক্ষমাপ্রার্থী তোমার কাছে।”

অনুর হেসে ফেলে বলে,
-“শুধু তোমার বাবাই তো,তাছাড়া পুরো পরিবার অনেক ভালো।দেখবে সব ঠিক হয়ে যাবে,চলো ভিতরে।”
-“উহু তুমি যাও,এমনি তুমি একা এখানে থাকো।কেউ যদি দেখে ঘনঘন তোমার বাসায় একটা ছেলে যাতায়াত করছে তো মানুষের বদনাম করতে সময় লাগবেনা।”
-“আমি জানি,তবে…”
-“আমার কাছে কোনো ফর্মালিটি নয়,ঘরে যেয়ে ফ্রেস হয়ে ঘুম দিবে।রাতে ফোন করবো বাই।”
-“বাই…”

প্রত্যয় বাইক নিয়ে চলে যেতেই অনু মুচকি হেসে গেটের ভিতরে পা বাড়ায়।

(১৯৬)

দেখতে দেখতে একটা দিন কেটে যায়,ইয়ারাবী তার শ্বশুড়বাড়ি এসেছে।আজ দিনটা শুক্রবার তাই সবাই বাড়িতেই আছে।দুপুরে লান্চের পর ইয়ারাবী ওর শ্বাশুড়ির সাথে বেশ কিছুক্ষণ গল্প করে ইনি-মিনিকে খাইয়ে রুমে ডুকে দেখে চেলসি ম্যাটের উপর ঘুমিয়ে আছে।আর আবরার কালো রঙের চিকন স্লিভস এর গেঞ্জি আর থ্রী-কোয়াটার প্যান্ট পরে বালিশে হেলান দিয়ে শুয়ে ফোন টিপছে আর মুচকি হাসছে।আবরারকে প্রথম এই লুকে দেখছে ইয়ারাবী,অন্য সময় হলে অবশ্য ভালো লাগতো কিন্তু এখন ওর ভালো লাগার থেকে রাগ বেশি হচ্ছে।কেননা ওর ফাঁকা মস্তিষ্ক বারবার জানান দিচ্ছে আবরার নিশ্চয়ই কোনো মেয়ের সাথে কথা বলছে,অবশ্য দু’তিনবার মাথা থেকে বিষয়টা বের করতে চেয়েছে কিন্তু যাচ্ছেনা।আবরার ফোন থেকে চোখ সরিয়ে দরজার দিকে তাকিয়ে দেখে ইয়ারাবী কিছু একটা ভাবছে।আবরার ফোনটা বন্ধ করে ওর দিকে তাকিয়ে বলে,
-“কী ব্যাপার ওখানে দাঁড়িয়ে আছো কেন?”
-“না এমনি,আপনি কিছু করছিলেন।”
-“হ্যাঁ,মানে না…বাদ দাও।এদিকে এসো,কিছুক্ষণ ঘুমিয়ে নাও।”

ইয়ারাবী বিছানায় যেয়ে আবরারের বুকের উপর মাথা রেখে চোখ বন্ধ করে,এদিকে ও ইয়ারাবীর মাথায় বিলি কেঁটে দিতে থাকে।প্রায় অনেকক্ষণ পরে আবরার বাম হাত দিয়ে ওর মাথায় বিলি কাটছে আর ডান হাতে ফোন নিয়ে কারোর সাথে হুয়াটস্অ্যাপে ম্যাসেজ বিনিময় করছে।ইয়ারাবী ঘুমাইনি বরং চোখ পিটপিট করে খুলে বোঝার চেষ্টা করছে অপরপ্রান্তের ব্যাক্তিটা কে।হঠাৎ আবরার জোরে হেসে উঠে বলে,
-“পাগলি,ঘুমের ভান ধরে দেখার কী দরকার জানতে চাইলেই তো বলে দিতাম।”

ইয়ারাবী গাল ফুলিয়ে বলে,
-“আমি ঘুমের ভান করিনি বরং সত্যিই ঘুমাচ্ছি।”
-“আচ্ছা,তুমি ঘুমালে কথা কে বললো?সত্যিই পাগলি একটা।”
-“আমি ঘুমাবো,ফোন রাখুন।”
-“আচ্ছা বাবা রাখছি।”

আবরার ওর গায়ে চাদরটা টেনে দিয়ে বলে,
-“আজ রাতে খেয়ে কাল থেকে রোজা।”
-“জ্বি,আপু বলল ভোর রাতে বলে আম্মু আর আপু রান্না করে।”
-“হুম।”
-“আপনি কিছু চিন্তা করছেন?”
-“হ্যাঁ,তুমি প্রতিবছর রোজা রাখো।”
-“জ্বি,সাত বছর বয়স থেকে চার-পাঁচটা রাখতে রাখতে বারো বছর থেকে সবগুলো থাকার চেষ্টা করতাম তবে সবতো আর হইনা।আল্লাহ্ আমাদের কিছুদিনের জন্য সাময়িক ছুটি দেন তাই।”
-“কিন্তু এবার তুমি রাখতে পারবেনা।”
-“কী বলছেন আপনি এসব?আমি রোযা রাখবোনা কেন?সবাইকে রোজা রাখতে হয় আপনি জানেন না?”

ইয়ারাবী অনেক জোরেই কথাটা বলে উঠে বসলে আবরার ওর মুখে হাত রেখে বলে,
-“আমার কথাটা মন দিয়ে শুনো,তারপর যা বলার বলবে।করুণাময় আল্লাহ তাআলা বলেন: ‘সিয়াম বা রোজা নির্দিষ্ট কয়েক দিন (এক মাস মাত্র)। তবে তোমাদের মধ্যে যারা পীড়িত থাকবে বা ভ্রমণে থাকবে, তারা অন্য সময়ে তা এর সমপরিমাণ সংখ্যায় পূর্ণ করবে। আর যাদের রোজা পালনের সামর্থ্য নেই, তারা এর পরিবর্তে ফিদ্‌ইয়া দেবে একজন মিসকিনের খাবার। অনন্তর যে ব্যক্তি অধিক দান করবে, তবে তা তার জন্য অতি উত্তম। আর যদি তোমরা পুনরায় রোজা পালন করো তবে তা তোমাদের জন্য অধিক উত্তম।’ (আল কোরআন, সুরা-২ [৮৭] আল বাকারা (মাদানি), রুকু: ২৩/৭, আয়াত: ১৮৪, পারা: সাইয়াকুল-২, পৃষ্ঠা: ২৮/৬)।
এ আয়াতের আলোকে বুঝা যায় যে, যদি কোনো প্রাপ্তবয়স্ক জ্ঞানসম্পন্ন মুসলমান অসুস্থতার কারণে রোজা রাখতে একেবারেই অক্ষম হন এবং পুনরায় সুস্থ হয়ে বা সক্ষমতা ফিরে পেয়ে রোজা আদায় করার সম্ভাবনাও না থাকে, ওই ব্যক্তি তার প্রতিটি রোজার জন্য একজন (প্রাপ্তবয়স্ক জ্ঞানবান) মিসকিনকে খাবার দান করবে।
বুঝেছো তুমি কথাগুলো,তোমার কন্ডিশন ঠিক নেই।তিন বেলাই তোমার মেডিসিন নিতে হয়, খাবারের অবহেলা করলেও হবেনা।তাই যেহেতু তুমি রাখার মতো অবস্থায় নেই তাই তোমার গুনাহ্ হবেনা।”
-“আমি পারবো রাখতে,তাছাড়া এর আগেও করেছি।রাতের মেডিসিন নিতাম সমস্যা হতোনা, প্লিজ আপনি জোর করবেন না।”

আবরার বুঝতে পারছে এই ঘাড়ত্যাড়া মেয়েকে এর ভাষাতেই বোঝাতে হবে।তাই অনেকটা গম্ভীর কন্ঠে বলে,
-“ঠিক আছে,আমিও দেখবো তুমি কীভাবে রাখতে পারো।যদি কাল অসুস্থ হয়ে পরো…”
-“রাখবোনা,তবে আমার বিশ্বাস কিছু হবেনা।প্লিজ আপনি রাগ করবেন না।”
-“না করিনি,তুমি থাকো আমার কিছু কাজ আছে।”
-“আপনি রাগ করেছেন।”
-“এখানে আমার রাগের কী আছে?”

আবরার গম্ভীর মুখে কথাটা বললে ইয়ারাবী উঠে করুন চোখে কান ধরে বলে,
-“এই দেখুন কানে ধরছি,প্লিজ রাগ করবেন না।আপনি আমার উপর রেগে থাকলে খুব কষ্ট হয়।আর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘তার কোনো নামাজ কবুল হয় না, কোনো নেক আমল ওপরে উঠানো হয় না; যতক্ষণ স্বামী তার প্রতি সন্তুষ্ট না হবে।’ (ইবনে হিব্বান)”

আবরার ওর মুখ দেখে হেসে ওকে জড়িয়ে ধরতেই ওদের দরজায় নক পরে।ওরা একে অপরকে ছেড়ে দিতেই ইকরা ভিতরে ঢুকে বলে,
-“তোমাদের বিরক্ত করলাম না তো।”
-“আরে ভাবী তুমিও না,কীসের বিরক্ত হবো?তুমি বসো…”
-“না আবরার বসতে আসিনি,ইয়ুকে ডাকতে এসেছে।তোর কী হয়েছে বলতো আমার থেকে সারাদিন পালাই পালাই করিস।”

ইয়ারাবী মাথাটা নিচু করে বলে,
-“কিছু হয়নি আপু,এমনি তোমাকে বিরক্ত করতে চাইনা তাই।”
-“তুই জানিস স্কুল থেকে ছুটি নেওয়ার পর বাসাতেই থাকি,তারপর যদি তুই এভাবে দূরে দূরে থাকিস তো…”
-“এমনি আপু,কিছু বলবেন?”
-“তোর এই এমনি কথার মধ্যেও অনেক কিছুু থাকে।এখন চল তো আমার সাথে…”
-“কেন আপু?”
-“আজকাল না তুই বড্ডো প্রশ্ন করিস।আবীর সবার জন্য দই বড়া এনেছে চল খাবি।”
-“দুই?”
-“আবরার ও খেলে কোনো সমস্যা হবে?”

ইকরা আবরারের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলে ওর মাথা নাড়িয়ে ‘না’ বোঝায়।তারপর ইকরার দিকে তাকিয়ে মজার ছলে বলে,
-“কাল থেকে রোযা থাকবে বলে আজই সব সাবার করবে নাকী?”
-“তুমি কোনোদিন ঠিক হবেনা।আমার এই অবস্থায় থাকা ঠিক হবেনা,তাছাড়া তুমিতো জানোই গর্ভবতী মাসয়ালা : রোজা রাখার কারণে গর্ভবতী মহিলার নিজের কিংবা সন্তানের প্রাণহানি বা মারাত্মক স্বাস্থ্যহানির প্রবল আশঙ্কা হলে তার জন্য রোজা ভঙ্গ করা জায়েজ।পরে এ রোজা কাজা করে নেবে।(-আল মুহিতুল বুরহানি: ৩/৩৫৯)
মাসয়ালা : রোজার কারণে দুগ্ধপোষ্য সন্তানের ক্ষতির পূর্ণ আশংকা বোধ করলে তিনিও রোজা রাখবেন না।(-রদ্দুল মুহতার : ২/৪২২; আল ফাতাওয়াল হিন্দিয়া : ১/২০৭; আলহিদায়া : ১/২২২; আপকা মাসায়েল আওর উনকা হল : ৪/৫৬৭)”

ইয়ারাবী অবাক চোখে তাকিয়ে বলে,
-“আমিতো এটা জানতাম না।”
-“ধীরে ধীরে তুইও জানবি।আমিও জানতাম না এটা,কাল রাতে আবীর আমাকে জানিয়েছে।”

মেঘ,জারবা,মিসেস রায়হান আর ওরা দুই জন দই বড়া খাচ্ছে ঠিক এমন সময় জারবা একটা মুখে পুরে দিয়ে বলে,
-“আম্মাজান আমাদের শ্রদ্ধেয় জানের জান নানীজান কখন আসবেন।”

মিসেস রায়হান চোখ রাঙিয়ে বলে,
-“খবরদার মায়ের নামে উল্টা-পাল্টা কিছু বলবিনা।”
-“আম্মাজান আমিতো পিয়ারছে বললাম।”
-“তোর পিয়ার আমার জানা আছে।কাল সকালে আসবে,ঢাকাতেই তোর খালার বাসায় আজ এসেছে ওখানে,তাই কাল আসবে।মায়ের সামনে বাদরামি করবিনা।আর মেঘ তুইও না,মনে থাকে যেন।”

জারবা,মেঘ ভদ্র বাচ্চাদের মতো মাথা নাড়াই।ইয়ারাবী ওর শ্বাশুড়ির দিকে তাকিয়ে বলে,
-“আপনার আম্মু…”
-“ওহ্হ্ তোকে তো বলা হয়নি।কাল আমার মা আসবে,তোর বিয়েতে আসতে পারেনি তাই চিনিসনা।”

ইকরা মুখের দই বড়াটা শেষ করে বলে,
-“মা বলুন দাদীর সাথে দাদীর বোনেনা তাই আসেনি।”
-“তুই চুপ করবি ইকরা।”
-“সত্যিটাই বললাম,বিয়ের আগে গল্প শুনেছি আর বিয়ের পর এসে দেখেছি স্ব-চোখে।”
-“ওহ্হ্,তোদের নিয়ে আর পারিনা।শোন ইয়ারাবী, আমার মা সেকালে টাইপের তাই একটু খুতখুত করে।একটু মানিয়ে নিস মা…”

ইয়ারাবী শ্বাশুড়ির দিকে তাকিয়ে বলে,
-“সমস্যা নেই আম্মু,আমি চেষ্টা করবো উনার যাতে কোনো অসুবিধা না হয়।”
-“বুঝিস তো সবাই এক মাইন্ডের হয়না,চায়ের মতো হয় এক একটা মানুষ।রং আর স্বাদ দু’টা আলাদা আলাদা।”
-“জ্বি…”

(১৯৭)

ইফাজ এসে তারার চেকআপ করছে ঠিকই কিন্তু মুখে কোনো কথা বলছেনা এই দুই দিন।তারা দুপুরে বাবা-মাকে জোর করে ইয়ামিলাদের বাসায় ফ্রেস হতে পাঠিয়ে দিয়েছে।আর ওর সেই ভাইকেও বাসায় পাঠিয়েছে,ধরতে গেলে তারা এখন একা।ইফাজ এসে ওর স্যালাইনটা চেক করে নার্সকে উদ্দেশ্য করে বলে,
-“শরীরে পানি শূন্যতা বেশি,নার্স স্যালাইন শেষ হলে খাবার খাইয়ে দিবেন।”

ইফাজ কথাটা বলে চলে যেতেই তারা ওর হাত ধরে ফেলে।ইফাজ ঘুরে প্রশ্নসূচক চোখে ওর দিকে তাকাতেই তারা বলে উঠে,
-“জানি আমার ছোঁয়ায় ঘৃনা পাচ্ছেন,আসলে ধর্ষিতাদের সবাই ঘৃনা করে ধর্ষককে নয়।তাই তো মরতে চেয়েছিলাম।”

ইফাজ গম্ভীর কন্ঠে বলে,
-“তোমাকে আমি বলেছি আমি ঘৃনা করি।”
-“কিছু কথা আচারনে প্রকাশ পায়,আপনিও বাকীদের মতো আমাকে ভিতর থেকে ঘৃনা করছেন।”
-“হ্যাঁ,ঘৃনা করি আমি তোমাকে।কেননা একজন এডাল্ট,স্পষ্টভাষী মেয়ে হয়েও চুপচাপ অন্যায়কে প্রশ্রয় দিয়ে মরতে গেছিলে।যে মেয়ে কিনা সবাইকে জ্ঞানদান করে,বাচ্চাদের আলোর পথ দেখায়,শিষ্টাচার বোঝায় সেই মেয়ে অন্ধের মতো কাজ করছে।এখানে ঘৃনা ছাড়া আর কী বা আসে তোমার প্রতি।তুমি চাইলে তিনদিন আগে হওয়া অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে,যদি টাকা আর ক্ষমতার কথা আসে তবে তোমরা সেদিক থেকে অনেকটাই এগিয়ে।তাহলে অন্যায় চুপচাপ সয়ে পঁচিশ বছরের পরিবারের ভালোবাসাকে পায়ে ঠেলে আত্মহত্যা করতে গেছিলে কেন?এসব ভাবলেই তো ঘৃনা হয়।”

তারা ওর চোখের দিকে তাকিয়ে বলে,
-“কতটা সহজ উপায়ে কথাটা বলে দিলেন আপনি কিন্তু ব্যাপারটা ওতোটাও সহজ নয়।আমি করতে চেয়েছিলাম না তাই ভাবছেন?চেয়েছিলাম কিন্তু হয়নি কারণ আমি নিরুপায়।কেননা ওই লোকের কাছে ভিডিও ছিলো।আর হুমকি দিয়েছিলো এমন কিছু করলে ভাইরাল করে দিবে।কী করতাম, বাবা-মায়ের মুখে চুনকালি দিতাম।আমাদের সমাজ ছেলেদের নয় বরং মেয়েদের দোষ খোঁজে।এখনো পর্যন্ত বাবা-মা জানেনা কথাটা,একমাত্র পুতুল জানে।দয়া করে আপনি জানিয়েন না।”

তারা কথাটা বলে দু’হাত দিয়ে মুখ ঢেকে কাঁদতে থাকে।ইফাজের কিছু বলার শক্তি নেই,প্রিয় মানুষের এমন অবস্থা দেখে কেউ ঠিক থাকতে পারেনা।

#চলবে_____

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here