#জীবন মানে তুমি
#লেখিকা:H.B.Rini (Irini Ori)
#পর্ব:৫৫
(১৮৮)
দুই ঘন্টা ধরে ইরাক সোফায় আরাম করে বসে তার প্রিয় ব্লাক কফি খাচ্ছে আর টিভিতে ফুটবল ম্যাচ দেখছে।ওর মুখ দেখে মনে হচ্ছেনা বড় কোনো ঘটনা ঘটেছে,মাঝে মাঝে খেলোয়াড়দের কিছু কাহিনি দেখে উচ্চশব্দে হাসছে।
এদিকে ইয়ারাবী লম্বা শাওয়ার নিয়ে একটা প্লাজু আর গেন্জি পরে আয়নায় সামনে দাঁড়িয়ে বিরক্তি নিয়ে চুল আচড়িয়ে লম্বা পা ফেলে নিচে নেমে ভাইয়ের কাহিনি দেখে আরো রেগে যায়।কিছু বলার জন্য দ্রুত পায়ে ভাইয়ের পাশে যেয়ে শব্দ করে বসে।ইরাক ওর দিকে একবার ভ্রু কুচকে তাকিয়ে আবার নিজের কাজে মনোযোগ দেয়।ইয়ারাবী কিছু বলতে যেয়েও বলতে পারছেনা, কেননা গাড়িতে একটা বড় আকারের ধমক খেয়েছে ইরাকের কাছ থেকে।এদিকে ইমনও বাসায় আসার পর পুরো ঘটনা শুনে ভাইকে সাপোর্ট করে চলেছে।
কিন্তু ওর চুপ করে থাকলে তো হবেনা,তাই ইয়ারাবী খুকখুক করে কেশে হাত দু’টা বারবার মুচরা-মুচরি করছে বারবার।ইরাক টিভির দিকে তাকিয়ে বলে উঠে,
-“শেষমেশ যক্ষ্মারোগী হওয়ার ইচ্ছা হয়েছে নাকী তোর?”
-“ভাইয়া পরশু থেকে রোজা…”
-“তো?”
-“না মানে বলছিলাম কী…”
ইরাক শব্দ করে কফির মগটা টেবিলে রেখে বলে উঠে,
-“নাক টিপলে একটু দুধ বের হবে,সেদিন হাঁটলে শিখলো সেই মেয়ে কীনা বর বর করে পাগল হয়ে যাচ্ছে?আর একবার যদি বর বর করেছিস তবে একটা থাপ্পড় খাবি?”
-“আমি তো বর বর করছিনা?আমি তো মাত্র তিনবার আবরারের নাম নিয়েছি।ও ভাইয়া, উনিতো তোমাদের বেস্ট ফ্রেন্ড,কত ভালো বন্ডিং তোমাদের।এমনটা কীভাবে করতে পারলে বলতো?কতটা কষ্ট পেয়েছে উনি?”
ইফাজ থ্যাথিস্টকোপ আর গায়ের এপ্রোনটা বাম হাতে ঝুলিয়ে বাসায় প্রবেশ করতে করতে বলে,
-“আর ওযে আমাদের কলিজায় হাতড়দ দিলো সেই বেলায়….”
-“তোমরাই তো কলিজাকে উনার সাথে বিয়ে দিলে।”
-“বেটা কয়দিন বৌ ছাড়া থাক,তবে বুঝবে রাগ করার ফল।”
-“ও ভাইয়া আমি….”
-“একটা কথাও নয়,কান ধরে স্যরি আর বিড়াল ছানা দিলো তাই সব রাগ শেষ।”
ইয়ারাবী অবাক চোখে ইফাজের দিকে তাকায় তো একবার ইরাকের দিকে।কারণ কাল সন্ধ্যায় কী ঘটেছে এদের কারোর জানার কথা নয়,তবে জানলো কীভাবে?ইফাজ সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠছে তখনি ইয়ারাবী পিছন থেকে বলে উঠে,
-“মেজো ভাইয়া দাঁড়াও,তোমরা কীভাবে জানলে কাল সন্ধ্যায় কী ঘটেছিলো?”
ইরাক সোফা থেকে উঠে আড়মোড়া ছেড়ে বলে উঠে,
-“কীভাবে জেনেছি সেটা তোর না বুঝলেও হবে?ছোট ছোটর মতো থাকবি,বেশি বুঝতে আসবি না।আর আবরারকেও নিজের রাগ কন্ট্রোল করতে হবে।কোনোদিন আমাদের কথা কানেও তোলেনি, আজ বুঝবে কত ধানে কত চাল।”
ইয়ারাবী দাঁত দিয়ে নখ কাটতে কাটতে মাথাটা নিচু করে বলে,
-“দেখ,তোমরা আমাকে নিয়ে আজ পর্যন্ত যে সিদ্ধান্ত নিয়েছো সেটা কখনো ভুল হয়নি যা কীনা আমার পরিবারও পারেনি।অবশ্য পরিবার থেকে এক্সেপ্ট করাও ভুল,তারা কখনো মেয়ে হিসাবেই মানেনি।তবে এভাবে চলে আসা ঠিকনা ভাইয়া, উনারা জয়েন্ট ফ্যামিলি,আব্বু-আম্মু,আপু, ভাইয়া সবাই খারাপ ভাব্বে আর মনেও কষ্ট পাবে।তাছাড়া পরশু থেকে রোজা শুরু,কীভাবে….”
ইফাজ আর কিছু বলতে না দিয়ে হাসতে হাসতে সিঁড়ির রেলিংএর সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে বলে উঠে,
-“ভাইয়া দেখেছো,আমাদের পিচ্চি কত বড় হয়ে গেছে।নিজের থেকে আগে শ্বশুড়বাড়ির চিন্তা মাথায় থাকে।”
ইয়ারাবী কথাটা শুনে কিছুটা লজ্জা পায়,ইরাক মুচকি হেসে ওকে একহাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে বলে,
-“তাইতো দেখছি,তবে কী জানিস?তোর শ্বাশুড়ি নিজেই বলেছে তার ছেলেকে উচিত শিক্ষা দিতে।”
ইয়ারাবী অবাক হয়ে বলে,
-“কী?”
-“হ্যাঁ,সকালে কথা হয়েছিলো।বিশ্বাস না হলে আন্টিকে ফোন করে শোন।এই নে মোবাইল,আমি ফ্রেস হয়ে আসছি।”
ইফাজের থেকে মোবাইলটা নিয়ে ইরাকের দিকে একবার তাকিয়ে ওর শ্বাশুড়িকে কল করে অপরপাশ থেকে রিসিভ হতেই ও সালাম দিয়ে বলে,
-“হ্যালো আম্মু…”
-“হ্যাঁ,বল আম্মু,কিছু বলবি?”
-“জ্বি,আম্মু আসলে আমি এখন….”
-“তুই এখন বাড়িতে তাইতো,আমি তোর ভাইকেই বলেছি কয়েকদিন ওখানে তোকে রাখতে।”
-“কিন্তু আম্মু…”
-“চুপ কর,কয়েকদিন তোকে ছাড়া থাকলে আবরার ঠিকই বুঝতে পারবে কী ভুল করেছে।এতো যে ঘাড়ত্যাড়া কীভাবে জন্মালো আল্লাহ জানে।দেখ মা ‘রাগ’ ধ্বংস করে দিতে পারে জীবন, সম্পদ, সম্মান এবং পারিবারিক ও সামাজিক সম্পর্ক নষ্ট করে দেয়।এ কারণেই নবীজি (সা.) এটাকে বলেছেন, ‘আদম সন্তানের অন্তর একটি উত্তপ্ত কয়লা’ (তিরমিজি)।কোরআনে বলা হয়েছে, ‘তোমরা তোমাদের পালনকর্তার ক্ষমা এবং জান্নাতের দিকে ছুটে যাও, যার সীমানা হচ্ছে আসমান ও জমিন, যা তৈরি করা হয়েছে পরহেজগারদের জন্য। যারা সচ্ছলতায় ও অভাবের সময় ব্যয় করে, যারা নিজেদের রাগকে সংবরণ করে আর মানুষকে ক্ষমা করে, বস্তুত আল্লাহ সৎকর্মশীলদিগকেই ভালোবাসেন।’ (সুরা আলে ইমরান, আয়াত: ১৩৪)।
ও জানে এই আয়াত আর হাদিস সম্পর্কে তবুও অতিরিক্ত রাগের জন্য ভুল করে ফেলে।কয়দিন তুই থাক ভাইদের সাথে,পাগলটা দেখিস কী করে।”
-“আম্মু আপনি এত ভালো কেন?”
মিসেস রায়হান ফোনের ওপাশে শব্দ করে হেসে উঠে,এতে ও কিছুটা লজ্জা পায়।ওর মনে হচ্ছে প্রশ্নটা করা উচিত হয়নি।উনি ইয়ারাবীর চুপ থাকাকে বুঝতে পেরে বলে উঠে,
-“আমি অতোটা ভালোও নয়,ভালোর সময় ভালো শাষনের সময় শাষন জানিস তো তুই।আচ্ছা খেয়েছিস কিছু?”
-“না আম্মু,এইতো খেতে বসবো।”
-“আপনারা খেয়েছেন আর উনি?”
-“আমরা খেয়েছি তবে তোর উনি না খেয়েই হাসপাতালে চলে গেছে।এখনো খায়নি মনে হয়, একটা ফোন করে দিস আর বেশি ভাব না জমিয়ে শুধু খেয়ে নিতে বলবি।”
ইয়ারাবী নিঃশব্দে হেসে বলে,
-“আম্মু সবাই কী করছে?”
-“আর বলিসনা,তোর ইনি-মিনি আর চেলসিকে নিয়ে তিনটাই ছাদে আছে আর আবীর কাজে চলে গেছে।আমি ঘরে বসে কোরআন পড়ছিলাম,তুই নিজের খেয়াল রাখবি।”
-“জ্বি,আম্মু।আপনারাও সাবধানে থাকবেন, নিজের খেয়াল রাখবেন,আল্লাহ হাফেজ।”
ইয়ারাবী কথা বলে ফোনটা কেঁটে দিয়ে সামনে তাকাতেই ইরাক ওর দিকে তাকিয়ে হেসে ইফাজের ফোনটা নিয়ে নেয়।ও বলে উঠে,
-“ভাইয়া খাবেনা?আমার খুব ক্ষুদা লেগেছে,দশটা বেজে গেছে।”
-“এইতো ওরা দু’জন আসুক।এই সাথী,টেবিলে খাবার দে।”
সাথী চেয়ার মুছতে মুছতে বলে,
-“দেতাছি ভাইজান।”
ইয়ারাবী ভাইয়ের পাশে দাঁড়িয়ে স্কার্ফের একপাশ হাতের আঙ্গুলে পেচাচ্ছে আর খুলছে।ইরাক আড়চোখে ওর দিকে তাকিয়ে বলে,
-“কিছু বলতে চাইলে বলে ফেল,বেচারা স্কার্ফকে কেন ছিড়ছিস?”
-“না মানে বলছিলাম কী,আমার ফোনটা একটু দিবে?”
-“কেন?”
-“না মানে উনাকে ফোন করবো,আসলে আম্মু বলছিলো….”
-“এখনো গিলেনি..না মানে খায়নি তাইতো।দিচ্ছি বেশি প্রেম আলাপ করবিনা কিন্তু,যদি করেছিস তো মার খাবি।”
ইরাক পকেট থেকে ওর হাতে দিয়ে বলে,
-“যা বলার এখানে বসে বলবি।”
-“এ….এখানে?
ইরাকের চোখ রাঙানিতে নিরুপায় হয়ে সামনের সোফায় বসে আবরারের ফোনে কল করে।ফোন দেওয়ার সাথে সাথে রিসিব হয়।অন্যান্য দিন অবশ্য বন্ধ থাকে নয়তো তিন-চারবার রিং হওয়ার পর রিসিব করে, তবে আজ এমনটা হওয়ায় বোঝা যাচ্ছে হয়তো ও চাতকপাখির মতো চেয়েছিলো কখন ইয়ারাবীর কল আসে।আবরার প্রথমে সালাম দিয়েই উত্তেজিত কণ্ঠে বলে উঠে,
-“ঠিক আছো তুমি?খেয়েছো কিছু,মেডিসিন নিয়েছো।”
-“ওয়ালাইকুমুসসালাম,একটু ধীরে ধীরে প্রশ্ন করলে তবেই না উত্তর দিবো।আমি ঠিক আছি,আর একটু পরে খেয়ে নিবো।আপনি সকালে ব্রেকফাস্ট করেননি কেন?”
-“তুমিও তো খাওনি।কী করছিলে এতক্ষণ যে দেরি হলো?”
-“গরম লাগছিলো তাই শাওয়ার নিয়েছি এই জন্য।”
আবরার একটা ধমক দিয়ে বলে,
-“কাল সন্ধ্যা থেকে জ্বরে ভুগছিলে আর এখন শাওয়ার নিয়েছো।কোথায় তোমার ভাইয়েরা?”
-“আপনি এমন করছেন কেন?এখন জ্বর নেই, আগে আপনি খেয়ে নেন পরে কথা বলবো।”
-“আমি একবারে লান্চ করে নিবো,জানো কাজের খুব চাপ।”
-“তারপরও এখনি হাসপাতাল থেকে বের হয়ে খেয়ে নিবেন।”
-“আচ্ছা বাবা খাবো,তোমার ভাইয়াকে ফোনটা দাও তো।”
ইয়ারাবী একবার আড়চোখে ইরাকের দিকে তাকিয়ে বলে,
-“কোন ভাইয়া?”
-“যে মহাশয় তোমার সামনে বসে আছে,আমি জানি সুতরাং ফালতু প্রশ্ন না করে যে আছে তাকে দাও।”
ইয়ারাবী ফোনটা ইরাকের দিকে বাড়িয়ে দিতেই ও ভ্রু কুচকে তাকিয়ে ফোনটা নিয়ে আবরারকে বলে,
-“কী বলবি?”
-“দেখ ইরাক,আমার ভুল হয়ে গেছে।আমি মানছি, ক্ষমাও চেয়েছি প্লিজ তোরা এমনটা করিসনা।”
ইরাক কিছু আলিস্যি কাটানোর জন্য ঘাড়টা একটু ডান-বাম সাইডে বাকিয়ে বাম হাতের আঙ্গুল দেখতে দেখতে বলে,
-“কিছু বলবি তুই,ঠিক করে আসলে শুনতে পায়নি।”
-“তুই কী আমার সাথে ফাজলামি করছিস?”
-“ওমাগো,ফাজালামি কাকে বলে সেটাতো এই ভদ্রছেলে আজ পর্যন্ত জানতেই পারেনি।”
-“ইরাক আমার কিন্তু রাগ হচ্ছে,দেখ তোর বোন কিন্তু খুব দুর্বল,তাছাড়া মেডিসিন গ্যাপ দেওয়া যাবেনা।তুইতো বোনকে ভালোবাসিস।”
-“ভালোবাসি বলে নিয়ে এসেছি নিজের কাছে, খালা-খালুর কোনো কালেই মেয়েকে নিয়ে মাথা ব্যাথা নেই।দেখ আমি জানি,ঘটনাটা রাগের বসে তুই ঘটিয়েছিস তবে তোকে নিজের রাগ কন্ট্রোল করতে হবে।নয়তো তুই ওকে সুস্থ করতে যেভাবে চেষ্টা করছিস,ঠিক তেমনি রাগের বসে ভুল করে তোর হাত দ্বারাই কোনো ক্ষতি না হয়ে যায়।”
-“আমি বুঝতে পারছি সবটা,তোকে কথা দিচ্ছি এমনটা ভুল করে আর করবোনা।”
-“উহু শুধু তোকে না আরো কাউকে শিক্ষা দেওয়ার জন্য কাজটা করেছি।সে যাই হোক,তোর বৌকে এতো সহজে দিচ্ছিনা,মায়ের পেটের এক রক্তের না হলেও ওকে নিজের বোন ভাবি আর সেই নিজের কলিজার টুকরার মতো যত্ন করি।”
-“তুই কথাটা শোন….”
-“অনেক দেরি হয়ে গেছে ব্রেকফাস্ট করতে হবে, আল্লাহ হাফেজ।”
-“আরে কথাটা….”
আবরারের কথা না শুনেই ইরাক ফোনটা কেটে দিয়ে ইয়ারাবীকে বলে,
-“তুই টেবিলে বসে শুরু কর,আমি তোর ফোনটা চার্জে দিয়ে আসি।আর ওই দুইটাকেও ডেকে আনি।”
ইয়ারাবী রাগ করার বদলে ভাইদের কাহিনি দেখে আনমনেই হেসে দেয়।ওর প্রায়ই আফসোস হয়, যদি সত্যিই এদের বোন হয়ে জন্মাতো তবে অন্ধকার জীবনটা দেখতে হতোনা।ইরাক প্যান্টের পকেটে হাত ঢুকিয়ে শিষ বাজাতে বাজাতে সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে যায়।ইরাক যে আরেকজনের কথা উল্লেখ করেছে তারা হলো ইয়ারাবীর বাবা-মা।ইরাক যখন ওকে হাসপাতাল থেকে নিয়ে আসে তখন ওর ফুপি ভাইয়ের কাছে কল করে সব ঘটনা খুলে বললে উনি ইরাককে কল করে বলেন,
-“আব্বু,তোমরা এমন কেন করছো?”
-“কী করছিস খালু?”
-“এই যে ইস্মা মাকে ওর বরের কাছ থেকে নিয়ে আসলে,এটা কী ঠিক হলো?স্বামী-স্ত্রীর মনোমালিন্য হয়েছে আবার ঠিকও হয়ে গেছে তার ভিতরে যাওয়াটা কী ঠিক?আর এখানে কিন্তু ইস্মা মায়েরই দোষ,মিথ্যা বলেছে তাই জামাই ওকে মেরেছে।দেখ তোমাদের এমন কিছুর জন্য যদি ওর বিবাহিত জীবনে কিছু হয়,একটা ছোট পদক্ষেপ থেকে অনেক কিছুই হতে পারে,আল্লাহ না করুক যদি ওর শ্বশুড়বাড়ি আর জামাই রাগের বসে….”
-“খালু বিয়েটা আমরা দিয়েছি,আর এতগুলো বছর মেয়েকে তো কখনো ছুয়েও দেখেছেন কীনা সন্দেহ?আর রইলো ওর শ্বাশুড়বাড়ি,তারা আমার-আপনাদের মতো নিচু মানষিকতা সম্পূর্ন মানুষ নই,তারা এই বিষয়ে সবটা জানে।আর আবরার ওকে আমি চিনি,আপনার এসবে মাথা না ঘামালেও চলবে।”
মিসেস ইশানি ফোনটা স্বামীর কাছ থেকে নিয়ে বলেন,
-“দেখ এসব কিন্তু বাড়াবাড়ি করছিস,তোদের এসবে মাথা না ঘামালেও হবে।মনে রাখিস ওর বাবা-মা এখনো মরে যায়নি।”
ইরাক হেসে তাসছিল্যের সুরে বলে উঠে,
-“মরে যায়নি বলেই তো হাত বাড়িয়ে বাড়াবাড়ি করছি।এটা মনে করবেন না আম্মু মারা যাওয়ায় ইয়ারাবীকে আপনাদের মতো অবহেলা করতে শুরু করবো।আমরা বিয়ে দিয়েছি সুতরাং আমরা ঠিক করবো কোনটা ঠিক কোনটা ভুল।”
-“তোদের যা ভালো মনে চাই কর,আমরা কিছুই বলবোনা।”
এসব কথোপকথনের কোনটাই ইয়ারাবী জানেনা, ইরাক নিজেও ওকে জানায়নি।খাবার টেবিলে সবাই বসে খাওয়া শুরু করেছে,এদিকে ইয়ারাবী প্লেটে খাবার নাড়াচাড়া করছে।ইমন ওর দিকে তাকিয়ে বলে,
-“ফড়িং!না খেয়ে বসে আছিস কেন?”
-“এইতো খাচ্ছিস…”
ইফাজ খাবার খেতে খেতে বলে উঠে,
-“বিকালে আমার ডিউটি আছে,তুই কী যাবি আজ?”
-“হামম,স্টারপুর সাথে ঠিক করে কথাই বলতে পারিনি যা শুরু করেছিলে তোমরা।”
-“যা করেছি বেশ করিছি,ওই বিষয় নিয়ে কোনো ঘ্যানঘ্যান করবিনা।শোন তারার কাছে জানতে চাইবি এসব কেন করলো?প্রথমে নাও বলতে পারে তবে জোর করে শুনবি।”
-“স্টারপু বলবেনা।স্টারপু যেটা না করে সেটাই হ্যাঁ করানো মুশকিল।”
ইরাক ওর ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বলে,
-“যেটা বলছি দেখিস সেটাই হবে,ওর হাত-পা দেখেছিস বিশেষ করে….”
ইরাক কিছু বলতে যেয়েও বোনের দিকে তাকিয়ে থেমে যায়।ইয়ারাবী ওদের দিকে তাকিয়ে বলে,
-“কী ভাইয়া?কী ভাবছো তোমরা?”
-“সঠিক নয় তবে অনুমান করেছি,তাই তোকে বলতে পারবোনা।মেডিসিন নিয়ে একটু ঘুমাবি, আযান দিলে ডেকে দিবো।”
-“জ্বি,বলছি তুমি কয়দিন আছো?”
-“পাগলি ঈদের পরে যাবো এবার।”
ইয়ারাবী জোরে হেসে খুশি মনে বলে উঠে,
-“সত্যিই,ইয়াহু আমরা মজা করবো।”
-“হ্যাঁ,অবশ্যই মজা করবো আগে তো খেয়েনে।”
(১৮৯)
য়ুহার শৈলের সাথে তার শ্বশুড়বাড়িতে এসেছে, এসেই সবার সাথে কুশল বিনিময় করে প্রাণোর সাথে গল্পে মজে গেছে।এদিকে শৈল ঘরের মধ্যে এদিকে থেকে ওদিক পায়চারি করছে বৌয়ের জন্য।দু’তিনবার অবশ্যই একপাক ঘুরে গেছে ড্রয়িংরুম থেকে,নাম ধরে ডাকলেও য়ুহার যায়নি।ওর অবশ্য ভালো লাগছে শৈলকে জ্বালাতে।ওর শ্বাশুড়ি ছেলের এমন ছটফটানি দেখে এককাপ চা নিয়ে য়ুহারের সামনে এসে কিছুটা রাগী সুরে বলেন,
-“বৌ,যেয়ে আমার ছেলেকে চা দিয়ে আয়।এখানে ননদের সাথে বসে থাকলে কিছু হবেনা,বরং ছেলের কাছে যা।”
য়ুহার কিছু বলার আগেই প্রাণো বলে উঠে,
-“ওই এমন করো কেন?কতদিন পর দেখা হলো, দুইজন দুইপ্রান্তে চাকরি করি,দেখা বলতে গেলে হইনা।”
-“তোর ভাই যে বৌ বৌ করে পাগল হয়ে যাচ্ছে সেদিকে খেয়াল আছে।আর বৌ এখনি যা ছেলের কাছে।”
য়ুহার মুচকি হেসে চায়ের কাপটা নিয়ে বলে,
-“যাচ্ছি আম্মা।”
য়ুহার পা টিপে টিপে ঘরের মধ্যে ঢুকে দেখে শৈল বিরক্তিমুখে পায়চারি করছে।য়ুহারের খুব হাসি পাচ্ছে ওর মুখটা দেখে,কিন্তু হাসলেই বিপদ।শৈলের চোখ য়ুহারের দিকে যেতেই ওর দিকে এগিয়ে যেয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বলে,
-“আসার কী দরকার ছিলো,ননদের সাথেই থাকতে পারতে?বরের কী দরকার ননদ থাকতে?”
-“নাউজুবিল্লাহ্,এসব কী কথা বলো তুমি?”
শৈল চোখ ছোট ছোট করে ওর দিকে প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে,
-“নাউজুবিল্লাহ্ কেন বললে?ওই তুমি কী ভাবছো বলতো,তোমার চিন্তা-ধারা এমন কবে থেকে হলো?”
য়ুহার খানিকটা শব্দ করে হেসে বলে,
-“তোমার রিয়্যাকশন দেখার জন্য বলেছি পাগল। চা খেয়ে নাও,পরে ঠান্ডা হয়ে যাবে।”
শৈল চা নিয়ে বেতের চেয়ারে আরাম করে বসে পান করতে থাকে।এদিকে য়ুহার খাটের উপর বসে মুখে হাত দিয়ে শৈলকে এক ধ্যানে দেখে যাচ্ছে।ও চাচ্ছে যাতে এই মুহুর্ত শেষ না হয়,এমন করে যেন চলতেই থাকে।শৈল চা শেষ করে য়ুহারের দিকে তাকিয়ে বলে,
-“দারুন।”
-“আম্মার হাতের সবকিছুই দারুন লাগে সন্তানের কাছে।”
-“আমি চা নয় তোমার কথা বলছি।সাদা পাড় নীল শাড়ি,লম্বা চুলটা বেনুনি,কপালে কালো টিপ আর তিলটা মিলিয়ে জোরা টিপ লাগছে,চোখে কাজল, হাতে কালো রেশমি চুড়ি আর কানে ঝুমকো সবটা মিলিয়ে কবির সৃষ্ট উপন্যাসের কোনো চরিত্র মনে হচ্ছে।মনে হচ্ছে পরন্ত বিকালের কাশবনের মাঝে একটুকরো….”
-“ব্যাস অনেক হয়েছে,এবার কিন্তু বেশি বলছো প্রফেসার?”
-“তুমি কেমন বলতো?সবাই প্রশংসা শুনতে চায়, আর তুমি….যাইহোক আজ সত্যিই তোমার রুপ সাহিত্যকে হার মানবে।একটাবার আয়নাতে দেখো, তখন একটা গানই মনে পড়বে,
আয়নাতে ওই মুখ দেখবে যখন
কপোলের কালো তিল পরবে চোখে
ফুটবে যখন ফুল গোপন শাখে
ভ্রমর যে এসেছিলো যানবে লোকে।
মনটি তোমার কেন দুরুদুরু কাঁপছে?
মনের মানুষ কীগো চেনা চেনা লাগছে?
তুমি কী তারে কাছে ডাকবে?
হৃদয়ের কাছে সে রই অলোকে
হঠাৎ যখন তুমি দেখবে তাকে
স্মরনে-নয়নে কীগো রাখবে ডেকে?”
য়ুহার কিছুটা লজ্জা পেয়ে বলে উঠে,
-“আশি দশকের গান আর গাইতে হবেনা প্রফেসর।ভুলে যেয়োনা তুমি ল’নিয়ে পড়াও সংস্কৃতি নয়।”
শৈল উঠে ওকে দুই বাহুতে আবদ্ধ করে বলে,
-“আমার মুখ আমি গাইবো,তুমি কেন লজ্জা পাচ্ছো।”
-“জানিনা…”
-“উকিল ম্যাডাম এই প্রথম কিছুর উত্তর জানিনা বললো,সেটা ভাবা যায়?”
-“দেখি ছাড়ো আমাকে,আম্মাকে যেয়ে সাহায্য করতে হবে।”
-“লজ্জাবতি লতিকা,তো ঔষুধ নেওয়া হয়েছে।এখানে আসার খুশিতে বাদ না পরে যেন।”
-“কপাল গুনে আমি আর আমার বাচ্চা দু’টা বর পেয়েছি,এমন স্বামী যদি সবার ঘরে ঘরে হতো তো মেয়েরা হাজার বছর বাঁচতে চাইতো।”
-“কে চাই,কী চাই আমি জানিনা।তবে তোমাকে নিয়ে জীবনের শেষ মুহুর্ত পর্যন্ত বাঁচতে চাই।”
য়ুহার শৈলের বুক থেকে মাথাটা উঠিয়ে করুন সুরে বলে উঠে,
-“আমি বাঁচতে চাই শৈল,এই সুখ ছেড়ে যেতে চাইনা।”
-“তোমার কিছু হবেনা।”
-“সইবে তো কপালে?”
প্রাণো হঠাৎ দরজায় দাঁড়িয়ে বলে উঠে,
-“কী সইবে কপালে?”
ওরা তাড়াতাড়ি একে অপরকে ছেড়ে বলে,
-“আরে একটা ক…কেসের ব্যাপারে বলছিলাম।”
-“কী কেসরে য়ুহার?”
-“আর বলিস না?এখানে আসার আগে একটা কেস হাতে পেয়েছি,সেটার ব্যাপারে আরকী?”
প্রাণো বামকান থেকে হেডফোনটা খুলে হাতে গুছিয়ে বলে,
-“আমাকেও বল,আফটারঅল আমিও একজন উকিল।আর ভাইয়া তোমাকে মা ডাকছে যাও।”
শৈল ঘর থেকে বের হতেই য়ুহার বলে উঠে,
-“আর বলিসনা প্রাণো,একটা মেয়ে যে কীনা যৌতুকের জন্য স্বামী-শ্বশুড়বাড়ি নির্যাতিত হতো।একটা সময় ওরা মারতে মারতে মেয়েটার গায়ে আগুন লাগিয়ে দিয়েছিলো কিন্তু ভাগ্য ভালো ওর শ্বাশুড় আর কাজের মেয়েটা বাঁচিয়ে ছিলো।মুখটার অনেকখানিক পুরে গেছে সাথে বাম হাতটাও।”
-“কী বলছিস?বুঝিনা এদের পরিবার না দেখে এমন জায়গায় বিয়ে কেন দেয়?”
-“শুধু এই নয় মেয়েটা গত পাঁচ বছর যাবত নির্যাতিত হচ্ছে তবুও মুখ বুজে ছিলো তিনটা বাচ্চার দিকে তাকিয়ে।আরো আল্প বয়সে মেয়েটার বিয়ে হয়েছে,তাহলে বোঝ।”
-“হায় আল্লাহ!আমি এমন কেস সচারচর পায়না তবে খবরের কাগজে প্রায়ই দেখি।”
য়ুহার প্রাণোর হাত দু’টা ধরে বলে,
-“এসব বাদ দে,দেখতে দেখতে অবভস্ত হয়ে গেছি।তোর উনির কী খবর সেটা বল আগে?”
-“আর উনি?মনে হয় ব্রেকআপ চাই।”
-“মানে?”
-“ওর ফ্যামিলির আমাকে পছন্দ নয়,বিশেষ করে আমার গায়ের রঙের জন্য।উনাদের শ্যামলা মেয়ে পছন্দ নয়,বলে ফর্সা ছেলের সাথে শ্যামলা মেয়ে মানাবেনা।তাছাড়া আমি উকিল এটা নিয়েও উনাদের সমস্যা।বলেছে উকিলদের সংসারে শুধু অশান্তি,তাদের ঘর টেকেনা।”
-“তোকে কে বললো?”
-“সূর্য নিজেই বলেছে কথাগুলো?”
-“তাহলে এতদিন ধরে কী নাটক করলো?”
-“আমার কিছু করার নেই রে।”
-“শোন ফর্সা-শ্যামলা কিছু নয়,আমার বাচ্চাটা তো তোর থেকেও শ্যামলা ওর কী বিয়ে হয়নি ভালো জায়গায়।কুয়াশা,মিম এরা তো কালো তবুও দেখ বিয়ে হয়েছে।আমিও তো উকিল,তোর ভাইয়ের সাথে আমার বিয়ে হয়নি?আমি আগেই বলেছিলাম সূর্য প্লে-বয়।বাকীদের মতো তোর সাথেও গেম খেলছে,আর এখন ফালতু বাহানা দিচ্ছে।”
-“বাদ দে তো,সবাই তো আর সবকিছু চাইলেই পায়না।
প্রাণো একটা হতাশাজনক নিঃশ্বাস ফেলে, প্রতিত্তুরে য়ুহারও আর কিছু বলেনা।শুধু চেয়ে থাকে মেয়েটার দিকে।
(১৯০)
রাতের নিস্তব্দ অন্ধকারে বেলকনির রেলিং ঘেষে দাঁড়িয়ে আছে ইয়ারাবী।বামপাশে খালার কবরের দিকে দৃষ্টি রেখে বারবার তারার কথাগুলো আওড়াচ্ছে।বুঝতে পারছেনা ইফাজকে কীভাবে বলবে কথাটা?হঠাৎ কাঁধের উপর কারো হাত পরতেই কেঁপে উঠে ইয়ারাবী,ঘুরে তাকিয়ে দেখে ব্লু ট্রাউজার আর সাদা গেন্জি,পায়ে স্লিপার পরে হাত কফির মগে পাশে দাঁড়িয়ে চুমুক দিচ্ছে ইফাজ।ওর দিকে তাকিয়ে ভ্রুটা সন্দেহ যুক্ত ভাবে নাচিয়ে বলে উঠে,
-“এভাবে ভয় পেয়ে উঠলি কেন?”
-“না হঠাৎ করে তো,মাঝে মাঝে হয়।তুমি কফি খাচ্ছো আমারটা কই?”
-“বিকালে খেয়েছিস আর না,দিনে একবার খাবি।এখানে এসে অনিয়ম করবি সেটা হবেনা।”
ইয়ারাবী একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে খালার কবরের দিকে দৃষ্টি রেখে বলে,
-“তোমরা এতো ভালোবাসো কেন আমাকে?আজ যদি তোমরা না থাকতে তো অনেক আগেই মাটির সাথে মিলিয়ে যেতাম।”
-“ফালতু কথা না বললে ভালো লাগেনা তোর?কী হয়েছে মন খারাপ আবরারের জন্য?”
-“উহু….”
-“তাহলে?”
-“আমি ঠিক আছে।আচ্ছা ভাইয়া খালামনির কবরে আলো কেন জ্বলছেনা?”
-“আজ সকালে লাইনটা নষ্ট হয়ে গেছে। ইলেক্ট্রিশিয়ানকে আসতে বলছি,কাল এসে ঠিক করে দিয়ে যাবে।”
-“ও আচ্ছা।”
-“ভিতরে চল,রাতে বাইরে থাকার দরকার নেই।”
-“আমার ভালো লাগছে,এসির জন্য শীত করছে আর বন্ধ করলেও গরম।তাই বাইরে এসে দাঁড়িয়েছি।”
-“জ্বর আসছে নাকী আবার?”
ইফাজ হাত দিয়ে ওর কপাল চেক করে দেখে সত্যিই জ্বর এসেছে।ও জোর করে ইয়ারাবীকে ঘরে নিয়ে এসে বলে,
-“তুই বস,আমি সাথীকে গরম দুধ আনতে বলছি মেডিসিন নিতে হবে।”
ইয়ারাবী বাচ্চাদের মতো জেদ ধরে নাক কুচকে বলে,
-“দুধ খাবোনা,চিকেন সুপ বা সুপ নুডুলস্ এনে দাও।”
-“আচ্ছা তুই বোস আমি সাথীকে বলে আসি।”
-“হামম যাও….”
(১৯১)
এদিকে আবরার একবার বিছানায় বসছে তো একবার সোফায় যাচ্ছে,ছটফট করছে অনেকটা।ঘরটা খালি খালি লাগছে,চেম্বার থেকে ফিরে এসে ইয়ারাবীর মৃদু হাসি,ওর উচ্চশব্দে পড়া,মি.বর বলে ভালোবেসে ডাকা,ওকে নিজের হাতে খাইয়ে দিয়া সবকিছুর শূন্যতা অনুভব করছে।ইকরা অনেক্ষণ ধরে দরজার আড়াল থেকে দেখে হাসছে আর পেটে উপর হাত বুলিয়ে বলে,
-“দেখছিস তোর চাচার কান্ড,তোর চাচীআম্মুকে ছাড়া একদমই চলছেনা।তবে তোর চাচা বুঝবে রাগের বসে কত বড় ভুল করেছে,বেচারা তো জানেনা এর মধ্যে তোর দাদীরও হাত আছে।চল তোর চাচাকে আরেকটু জ্বালিয়ে আসি।”
ইকরা মুখে গম্ভীরতা টেনে দরজা দিয়ে ঢুকে হালকা কেশে বলে
-“শূন্যতা মানুষকে পুড়াই,প্রিয়জনকে উপলব্ধি করাই।”
-“ভাবী তুমি তো বোঝো,প্লিজ ডু সামথিং।”
ইকরা বাম হাতে থাকা আচারের বাটিটা ওর দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে,
-“খাবে নাকী?খালামনি বানিয়ে পাঠিয়েছে, ইয়ারাবীর বলে আচার খুব পছন্দের।ওর জন্যও রেখে দিয়েছি,তোমার জন্য বলে বেশি টকও খেতে পারেনা মেয়েটা।আহারে বাচ্চা মেয়েটা,তোমার শাষনের জন্য পছন্দের কিছু খেতেও পারেনা।ইয়ারাবী…”
আবরার ওকে থামিয়ে দিয়ে বলে,
-“আমার এমন কেন মনে হচ্ছে তুমি কাঁটা ঘায়ে নুনের ছিটা মারতে এসেছো।”
-“শুনছিস বাবু তোর চাচা আমাকে কী বললো?”
-“থাক,তোমার ড্রাম ভরা ড্রামা করতে হবেনা।”
-“হু….”
ইকরা একটা ভেংচি কাটে,আবরার কিছু একটা ভেবে ইকরার সামনে দাঁড়িয়ে আবার বলে,
-“আচ্চা ভাবী ও তোমাকে ভাবী বলে কেন ডাকেনা?”
ইকরা আমের বড় টুকরাটা মুখে পুরে অনেকটা তৃপ্তি সহকারে খেয়ে বলে,
-“কারন আমি বলেছি তাই,ওর থেকে আমি ইলা ইলা গন্ধ পায়।ওর দু’চোখের কর্ণারে ইলার মতো দু’টা তিল আছে।একটা তো স্পষ্ট বোঝা যায় আরেকটা কিছুটা সময় লাগে।কেন বলতো?”
-“ও ভাবী,দেখোনা আমি কিন্তু তোমার দেবর বাদে ফুপাতো ভাইও হই।”
-“তো আপনার জন্য কী করিতে পারি?”
আবরার ফ্লোরে হাটু ভাঁজ করে বসে বলে,
-“ভাবী তুমি না ভালো,একটাবার বোঝাও না ওদের যাতে ইয়ারাবীকে আসতে দেয়।”
-“তুমি ক্যান যাচ্ছোনা?”
-“ওরা আমার ফ্রেন্ড,শিরায় শিরায় চিনি বজ্জাত দু’টাকে।ডিপ্রেশন,ট্রমা থেকে বের হওয়ার জন্য রোজ রাতে মেডিসিন দিতে হয়,তুমি তো সব জানো।”
আবীর ঘরে ঢুকে আবরারের কানটা টেনে দিয়ে বলে,
-“গায়ে হাত তোলার আগে মনে ছিলোনা তোর,যে মেয়েটা অসুস্থ।মেয়েটার ছোট থেকে ঘৃণা-অত্যাচার-অবহেলায় জীবন কেঁটেছে,আর তোর কাছে যে ভালোবাসা পেয়েছিলো সেটা একদিনে শেষ করলি।ও বলছে তোকে ক্ষমা করেছে তোর প্রতি কোনো রাগ নেই কিন্তু দেখিস আগের মতো আবার গুটিয়ে যাবে তোর থেকে।চৌধুরি বংশে বৌয়ের গায়ে হাত তোলেনি কেউ,এই প্রথম তুই কাজটা করলি।মানলাম ও মিথ্যা বলেছে তুই জানিসও,তাহলে ঘরে এসে ওকে বুঝাতে পারতি,শাষন করতে পারতি।ছোটদের সামনে গায়ে হাত কেন তুলবি?এমনভাবে মেরেছিলি যে মেয়েটা বেহুশ হয়ে গেছিলো।ও ভালোবাসার কাঙ্গাল সেটা তুই নিজেই বলিস,আর তোর কাছ থেকে সেই ভালোবাসা পায় বলে হাজার ধমক-শাষণ করার পরও তোর উপর অভিমান করেনা।”
আবরার এবার না পেরে কেঁদে দেয়,কথায় আছে ছেলেরা অধিক কষ্ট না পেলে কাঁদেনা।ইয়ারাবীর অপারেশনের সময় কাঁদতে দেখা গেছিলো আর আজ আবার সেই চোখের পানি বের হচ্ছে।আবীর ওর পিঠে হালকা চাপড় না দিয়ে বলে,
-“কষ্ট হচ্ছে তাইনা,জানিস আজ পর্যন্ত তুই যা সিদ্ধান্ত নিয়েছিস সবাই সেটাই মেনে নিয়েছে।কেননা তুই ভুলটা খুব কম করিস,তবে যে ভুলটা করেছিস সেটা শুধু ভুল নয় জঘন্য অপরাধ।”
-“ভাইয়া…”
-“আমি জানি তুই বুঝতে পেরেছিস।কাল সকালে যেয়ে নিয়ে আসবি।”
-“ও ভাইয়া…..আজ রাতে তাহলে কীভাবে ঘুমাবো?”
-“বেটা বিয়ের আগে যেমনে ঘুমাতি সেভাবে ঘুমা।আমাদের তো আরেকটা বৌ আছে সেটার আন।”
ইকরা আচার খাচ্ছিলো,ওর কথা শুনে চোখ বড়বড় করে তাকিয়ে বলে,
-“আরেকটা বৌ মানে?”
-“ইয়ে মানে তুমি যা ভাবছো তা নই, কো..কোলবালিশের কথা বলছিলাম।মানে অবিবাহিতদের বৌ যাকে বলে,তুমি তো বিয়ের পরেই স্টোর রুমে রেখে দিয়েছো।”
-“কী বললে রুমে চলো তোমার হচ্ছে?দাঁড়াও মায়ের কাছে বিচার দিচ্ছি।”
ইকরা নাক টেনে ঘর থেকে বের হয়ে যেতেই আবীর ফ্লোরে বসে বলে,
-“মেয়ে মানুষ আসলেই হিংসুক,শেষ পর্যন্ত কোলবালিশকেও ছাড় দেয়না।আর ইকরা,এ কী বাচ্চার জন্ম দিবে যেখানে নিজেই বাচ্চা হয়ে গেছে।”
-“ভাইয়া প্রেগন্যান্সির সময় এমনটা হয়,কিন্তু কথা হলো বালিশকে তো আর বুকে জড়িয়ে ধরা যায়না।আর তার থেকেও বড় কথা আমার বেড এখন ইনি-মিনি,চেলসির দখলে চলে গেছে।”
আবীর বিছানার দিকে তাকিয়ে দেখে সত্যিই, তিনটাই বিছানার উপর ঘুমাচ্ছে।চেলসি অবশ্য এমন করেনা,ও নিজের ঘরেই ঘুমাই।হয়তো বিড়ালদের দেখাদেখি করছে।আবীর চেলসিকে জাগিয়ে নিজের ঘরে নিয়ে যাওয়ার সময় বলে,
-“বিড়ালগুলোকে বাস্কেটে রাখ।অাচ্ছা তোর বৌ কী আমারটার মতো….”
-“না,আমার বৌটা বাচ্চা হলেও বালিশকে সতিনভাবে না।কষ্ট করে আজকের রাত কাটাতে হবে।”
(১৯২)
-“আর একটু …..”
-“আর না,তিতা লাগছে।”
-“দেখ তুই বললি স্যুপ খাবি তাই এনেছি,এমন করলে কীভাবে হবে সোনা?হাই পাওয়ায়ের মেডিসিন অর্ধেক খাবারটুকু খা।”
-“ভাইয়া সত্যি আমি আর খেতে পারছিনা।”
ইমন ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বলে,
-“একটা বিষয়ে আমি আবরার ভাইয়াকে পুরো সাপোর্ট করি।উনি তোকে ধমক দিয়ে হলেও সম্পূর্ন খাবার খাওয়ান।যার জন্য পাটকাটি থেকে একটু মোটা হয়েছিস।”
-“ভাইয়া দেখ কী বলে?”
-“ইমু জ্বালাবিনা ওকে,জ্বর এসেছে।”
-“তোমার দেখে তো হাফ আঙ্গুলও ভয় পায়না এই ছুড়ি,বড়টারে ডাকি।হেতিই ওরে খাওয়াতে পারবে।”
-“এই ভাইয়াকে ডাকিস না ইমু,শুয়ে পরেছে দেখলাম।”
-“হ্যাঁ,হাসপাতালে তো তোমার সাথেই ছিলো।ভালো কথা ফড়িং,আপু কেন এমন করলো রে?”
ইয়ারাবী ওর কথা শুনে আমতা আমতা করতে থাকে।কেননা তারা বিকালে যা বলেছে সেটা ইফাজকে বলতে পারবেনা,ইফাজ মুখে না বললেও জানে তারাকে ও ভালোবাসে।ইফাজ ওর মুখে আরেক চামচ স্যুপ দিয়ে বলে,
-“কী হলো বল?”
-“ইয়ে ভাইয়া…আসলে…”
-“কথা টেনে না বলে ভালো করে বল।”
-“স্টারপু সুইসাইড করতে গেছিলো কারণ….”
-“কারণ…”
-“ভাইয়া,স্টারপু খারাপ নয়,উনি খুব ভালো,এতে উনার কোনো দোষ নেই।”
-“এবার কিন্তু সত্যিই আমার রাগ লাগছে।তুই কী বলবি?”
ইফাজ ধমকে কথাটা বলে উঠতেই ইয়ারাবী বলে উঠে,
-“স্টারপু দু’টা বাচ্চাকে পড়ায় সেটা তো জানো।”
-“হ্যাঁ…”
-“আসলে স্টারপুর টিউশনি নেওয়ার কোনো দরকার ছিলোনা।তবুও ওই বাচ্চার মায়ের জন্য পড়াতে রাজি হয়।তিনদিন আগে তিনটার দিকে ওদের বাসায় যেয়ে দেখে বাসায় ওই মহিলার স্বামী ব্যাতিত কেউ নেই।তাই স্টারপু চলে আসতে চাইলে ওই লোকটা বলে উনারা কিছুক্ষণের মধ্যেই চলে আসবে।বেশি গরম পরায় স্টারপু এক গ্লাস পানি চাইলে ওই লোকটা আপুকে পানির বদলে জুস দেয়।প্রথমে খেতে না চাইলে উনার জোরাজুরিতে খায়,কেননা লোকটি অনেক বয়স্ক ছিলো।আসলে উনাদের বিয়ের বারো বছর পর সন্তান হয়,তাই বাবার বয়সি লোকের কথা ফেলতে পারেনি।স্টারপুও জুসটা খেয়ে নেয়,তবে জুস খাওয়ায় পরের তিন-চার মিনিটের মধ্যেই স্টারপুর কী হয় জানেনা।ঘন্টাখানিক পরে….”
এরপর ইয়ারাবী আর বলতে পারেনা,ওর গলায় কথাগুলো জড়িয়ে যাচ্ছে,চোখ থেকে পানি পরতে শুরু হয়েছে।ইফাজ-ইমনও বুঝতে পারে কী হয়েছে?ইমন ঘর থেকে বেড়িয়ে নিজের রুমে চলে যায়।ইফাজ শক্ত গলায় বলে উঠে,
-“না কেঁদে শুয়ে পর।”
-“ভাইয়া….”
-“একটা কথা নয়,ঘুমিয়ে পর।রাতে সমস্যা হলে পাশের ঘরে ভাইয়া আছে,মাঝের দরজা খোলা ডাক দিস।আমি আসছি,ফোনটা হাতের কাছেই রাখ।”
কথাগুলো বলে ইফাজ ওর গায়ে চাদরটা টেনে দিয়ে বেলকনির দরজা ভালো করে বন্ধ করে, শ্যাডো লাইট জ্বালিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে যায়।ইয়ারাবীর খুব কষ্ট লাগছে,একদিকে বোনের জন্য অন্যদিকে ভাইয়ের জন্য।তারার সাথে যা হয়েছে সেটা কোনো ভাবেই মেনে নিতে পারছেনা।ইয়ারাবী নিজেও এর স্বীকার হয়েছে তবে প্রতি মুহুর্তে আল্লাহর উছিলায় ভাইয়ের জন্য বেঁচে গেছে, ফেরেশতার মতো ওর ভাইয়া কোনোভাবে সেই মুহুর্তে পৌঁছে বোনকে রক্ষা করেছে তবে আফসোস তারার বেলায় এমন কেউ ছিলোনা।
ইফাজ ওর মায়ের কবরের পাশে বসে শূন্য আকাশে দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে আছে।ওতো চাইনি এমনটা হোক হাসি-খুসি মেয়েটার জীবনে, চেয়েছিলো মায়ের ইচ্ছা পূরন করতে।হ্যাঁ,মিসেস রহমানের তারাকে ইফাজের বৌ করার খুব শখ ছিলো।উনার ইচ্ছা ছিলো চার ছেলেমেয়ের বিয়েটা দেখার।তবে শুধু মেয়েটার বিয়ে দেখে যেতে পেরেছেন।হঠাৎ সামনে কারোর ছায়া পরায় তাকিয়ে দেখে ইরাক দাঁড়িয়ে আছে।
-“ভাইয়া তুমি,ঘুমাওনি এখনো?”
-“তোর ছোটবেলার কথা মনে আছে ইফাজ।আগে মা ইমনকে ঘুম পারাতো তারপর তোকে তারপর আমাকে।কারণ আমি বড় বলে বেশি গল্প শুনতে চাইতাম,কতটা পাগলামি করতাম সেই সময়।”
-“দেখনা ভাইয়া আজ মা ঘুমিয়ে আছে আর আমরা জেগে আছি।”
-“তুই এখানে বসে চোখের পানি ফেলছিস,মায়ের কষ্ট হচ্ছেনা বুঝি।আর তারার সাথে যা হয়েছে অন্যায়।আল্লাহর শুকরিয়া কর যে মেয়েটার কিছু হয়নি।”
ইফাজ চোখটা বামহাতের আঙ্গুল দ্বারা মুছে উঠে দাঁড়িয়ে বলে,
-“পিচ্চি ঘুমিয়েছে?”
-“উহু,ফুঁপিয়ে কান্না করছে।প্রথমে মা এখন তারা, বুঝতে পারছিস।ও বুঝতে পারছে তারার কষ্ট, কেননা ওর সাথেও ঘটতে গেছিলো।”
-“সকালে হাসপাতালে যেতে হবে চলো ভিতরে।”
-“হ্যাঁ,চল….”
#চলবে_____