জীবন মানে তুমি পর্ব-৫৩

0
3812

#জীবন মানে তুমি
#লেখিকা:H.B.Rini (Irini Ori)
#পর্ব:৫৩

(১৮০)

আবরার ইয়ারাবীর মাথা প্রতিরাতের মতো নিজের বুকের উপর নিয়ে শুয়ে আছে।তবে আজ ইয়ারাবীরর ভয় যেন চারপাশ থেকে গ্রাস করেছে।যদিও প্রথম মনে হয়েছিলো এমন কিছু হতে পারে পরে ওর সাথে,তবে পরিবার গুরুত্ব না দেওয়ায় ও নিজেও তেমন মাথা ঘামায়নি।যদি তখন একটু হলেও ওর বাবা-মা খেয়াল করতো তবে আজ এই পরিস্থিতির স্বীকার হতোনা।নানা চিন্তায় ইয়ারাবী মগ্ন তখনি বাড়ির কারেন্ট চলে যায়।হ্যাঁ,গ্রামের এই একটা সমস্যা,হুটহাট করে অসময়ে কারেন্ট চলে যাওয়া।একে তো গরম কাল,তার উপর কারেন্ট নেই রাতে শুতে অস্বস্তি হয় প্রচুর।ইয়ারাবী প্রচুর গরমের মধ্যেও থাকতে পারে কেননা ওর অভ্যাস আছে।কিন্তু আবরারের পক্ষে সম্ভব নয়।আজ জ্যোৎস্না রাত ছিলো তাই জানালা ভেদ করে ভিতরে আলো এসে পরেছে বিধায় টর্চ জ্বালানো লাগেনি।

হঠাৎ করে আবরারের বুকের অংশ ভেজাভেজা লাগে,ওর বুঝতে দেরী হয়না ইয়ারাবী নিঃশব্দে কাঁদছে।কেননা মাঝে মাঝে কেঁপে কেঁপে উঠছে।আবরার ডান হাত দিয়ে সাবধানে ওর মাথায় রেখে বলে,
-“কাঁদছো কেন?”

ইয়ারাবী তাড়াতাড়ি স্বাভাবিক হয়ে বলে,
-“কাঁদছিনা তো।”
-“ইয়ারাবী মিথ্যা বলা পাপ।কিছুদিন ধরে দেখছি তুমি মিথ্যার আশ্রয় নেওয়া শুরু করেছো যা কীনা আল্লাহ্ পছন্দ করেন না।”
-“জানি,কিন্তু কী করবো?নিজের কথা কারোর সাথে ভাগ করতেও ইচ্ছা হয়না।”
-“আমার সাথেও নয়?”
-“দ্বিধা কাজ করে।মনে হয় আপনিও দূরে চলে যাবেন।”
-“আমি তোমাকে ছেড়ে কোথাও যাবোনা পাগলি।”
-“ভয় করছে….”
-“ভেবোনা ওসব,কালেমার শক্তি সবচেয়ে বড়।কোনো প্রকার অনিষ্ট তোমাকে ছুঁতে পারবেনা।”
-“আচ্ছা,আবরার আমার সাথেই এসব কেন হয়?আমি তো জ্ঞান হওয়ার পর থেকে যতদূর জানি কারো ক্ষতি করিনি।তবে মানুষ কেন আমার ক্ষতি করতে চায়।”

আবরার একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,
-“সমাজে দুই প্রকারের মানুষ আছে।এক.যারা তোমার সাফল্য দেখে খুশি হবে এবং আগে বাড়তে উৎসহ দেবে।আর দুই.যারা সাফল্যের পথে পা বাড়ানোটা বিনা কারনে সহ্য করতে পারবেনা।
তোমার ভাগ্য খারাপ তাই দ্বিতীয় শ্রেনীর মানুষের আনাগোনা বেশি।আচ্ছা একটু উঠবে?”

ইয়ারাবী দ্রুত ওর বুক থেকে মাথা উঠিয়ে বামপাশটা আস্তে করে ধরে আফসা আলোতে ওর দিকে তাকিয়ে নিচু স্বরে বলে,
-“আপনার বুকে ব্যাথা করছে?”

আবরার বিছানা ছেড়ে উঠে গায়ের কালো গেন্জি খুলতে খুলতে বলে,
-“পাগলী সেটা নয়,আসলে প্রচুর গরম লাগছে।পাখা নেই রুমে।”
-“সন্ধ্যায় দেখেছিলাম ঘরের মধ্যে টেবিল ফ্যান কিন্তু আম্মুনি…মানে উনি পরিষ্কারের জন্য নিয়ে গেছিলো।হয়তো কাজের চাপে পরে ভুলে গেছে।”
-“হাত পাখা নেই?”
-“আছে মনে হয়,কাবার্ডের কোনো ড্রয়ারে হবে, দাঁড়ান আমি বের করে দিচ্ছি।”
-“না তুমি শুয়ে থাকো আমি বের করছি,দুর্বল শরীরে এসব ঠিক নয়।”

আবরার ফোনের ফ্লাশ অন করে অনেক্ষণ ধরে কাবার্ডের ড্রয়ার খুঁজে খুঁজে পাখা বের করে খাটে এসে শুয়ে পরলো।ইয়ারাবী ওর দিকে তাকিয়ে বলে,
-“আপনার চোখগুলো না পুরো বিড়ালের মতো।”
-“হঠাৎ আমার চোখের পিছনে পরলে কেন?”
-“ভালো লাগে তাই….”

কিছুক্ষণ থেমে আবরার বলতে শুরু করে,
-“তোমার খালাদের কথা যদি সত্যি হয়ে যায়।”
-“মানে?”
-“ওই যে যদি আমি তোমাকে ছেড়ে দিয়ে আবার বিয়ে করি?”
-“খুন করে ফেলবো আপনাকে…”

অনেকটা রাগী কন্ঠে কথাটা বলে উঠে ইয়ারাবী, এতে আবরার অনেকটা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায়।কখনো ভাবতে পারেনি এমন কোনো রিয়্যাক্ট করতে পারে ও।ও কিছুটা মজার সুরে বলে,
-“নিজের হাতে নিজে বিধবা হতে চাও?”
-“হ্যাঁ,হবো তবুও দ্বিতীয় বিয়ের কথা বললে জানে মেরে ফেলবো।”

আবরার ঠিক বুঝতে পারছে যে মেয়েটা প্রচুর রেগে গেছে।তাই আর মজা না করে ওর উপর ঝুঁকে স্বাভাবিক কন্ঠে বলে,
-“সিরিয়াসলি কেন নিচ্ছো?আমি তো জাস্ট মজা করছিলাম।”

ইয়ারাবী দু’হাত দ্বারা ওর বুকে ধাক্কা দিয়ে রাগে ফোসফোস করে উঠে বসে বলে,
-“তোর মজার গুষ্টি কিলায়।”
-“আহ্,ব্যাথা লাগে তো।এই রাতে কোনো আত্না ভর করলো নাকী তোমার উপরে?এই কয়েকমাসে এমন রুপ তো কোনোদিন দেখিনি।ডাইরেক্ট আপনি থেকে তুই…বাবাহ্ আমার বৌয়ের তো ভালোয় উন্নতি হয়েছে।”
-“আরো অনেক করতে পারি দেখাবো?”
-“না থাক,ওসব দেখতে গেলে আবার বি… এই না মানে তুমি আমার ভুল বুঝবে তাই ঘুমিয়ে পরো।”
-“একটা কথা মনে রাখবেন আবরার,আমি আমার সব জিনিস মানুষের সাথে ভাগ করলেও আপনাকে করবোনা।আর আমি বেঁচে থাকতে দ্বিতীয় বিয়ের কথা চিন্তাও করবেন না।যদি কোনোদিন মা হতে নাও পরি তবে ওই টিপিক্যাল মানুষের মতো স্বামীর আবার বিয়ে করাটা সহ্য করবো।”
-“ওকে ওকে,কুল।বাপরে সব বৌরা দেখি এক হয়।”

ইয়ারাবী শুতে যাচ্ছিলো তখনি এই কথাটা শুনে উঠে বসে বলে,
-“ওই আপনি কয়টা বিয়ে করেছেন যে বৌরা এক হয় বলছেন?”
-“তুমি এভাবে ক্ষ্যাপছো কেন সোনা?দেখো তোমার মাথায় চাপ…”
-“ডাক্তারি জ্ঞান পরে ঝাড়বেন আগে প্রশ্নের উত্তর দেন।”

আবরার ওর ভ্রু যুগল কুচকে কিছুটা উঁচু করে ওর দিকে ঝুঁকে বলে,
-“তুমি কী আমার সাথে ঝগড়া করছো?”
-“হাসবেন্ডের সাথে ঝগড়া করা আমার পছন্দ নয়।কিন্তু আপনি যা বলেছেন জানেন একজন স্ত্রীর কাছে কতটা কষ্টের লাগে।”
-“আরে আমিতো মজা করেছি,তুমি তো দেখছি কেঁদে ফেলছো।দেখি তাকাও এই দিকে….”

ইয়ারাবীর চোখে থেকে বৃষ্টির ধারার মতো পানি পরছে,আসলে ওদের কথা শুনে যতটা কষ্ট লাগেনি তার চেয়ে বেশি কষ্ট লেগেছে ওর কথা শুনে।আবরার ওকে নিজের বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে বলে,
-“তুমি কী জানোনা আমি তোমাকে ভালোবাসি?আমি সবটা জুড়ে তুমি আছে,জীবনের প্রতিটা মানে তুমি হয়ে আছো।যাকে এক কথায় বলে জীবন মানে তুমি।”
-“মুখের কথায় বিশ্বাস হয়না।”
-“তাহলে করে দেখায়?”
-“ওই মিয়া যখন আমি বলতাম খুব উপদেশ দিতেন এখন আপনি প্যান প্যান করবেন না।”

আবরার অবাক হয়ে যাচ্ছে ওর প্রতিটা কথা শুনে।তবুও নিজেকে সামলে বলে,
-“শেষমেশ বৌ বুঝি পাগল হয়ে গেলো।”
-“বাজে কথা বলবেন না।”
-“তাই,আচ্ছা বলছিনা।আচ্ছা ইয়ারাবী?”
-“হুম বলুন শুনছি…”
-“আমাকে বাকীদের মতো তুমি করে বলা যায়না।”
-“আমার ভালো লাগে তাই মি.বর।”
-“কিন্তু আমার যে মিসেস বৌয়ের মুখ থেকে তুমি ডাক শুনতে চায়।”
-“যেদিন ভালোবাসবেন সেদিন থেকে বললো।”
-“দেখি হয় নাকী?”
-“মানে?”
-“এই আজ তোমার কী হয়েছে বলতো?আমার ছোট ছোট কথার মানে ধরছো,আসো ঘুমাবে….”

কথাটা বলে আবরার ওকে বুকে টেনে নেয় তবে ওর ঘুম আসছেনা,আসলে যা হয়েছে ঘুম সেহেতু আসবেনা।কিন্তু আবরার এদিকে ঘুমিয়ে গেছে,জ্যোৎস্নার আলো মুখে পরায় ঘুমন্ত মুখটা অনেক সুন্দর লাগছে।ইয়ারাবী ওর দাঁড়িতে বাম হাত দিয়ে নাড়াচাড়া করছে।

(১৮১)

আজ সকালে মেহেদী আর সন্ধ্যায় বিয়ের অনুষ্ঠান।অবশ্য য়ুহারের বাবা বলেছিলো পরেরদিন বিয়ের আয়োজন করতে কিন্তু য়ুহার সেটায় দ্বিমত পোষন করে।ওর মতে বাড়তি টাকা খরচ করার কোনো মানে হয়না।একটু পরে মেহেদী অনুষ্ঠানের তোড়জোড় শুরু হবে,তাই সবাই ব্যস্ত।সকাল নয়টা বাজে,ইয়ারাবী ঘর থেকে বের হয়ে নিচে যেয়ে দেখে ডাইনিংএ এখনো ব্রেকফাস্ট দেওয়া হয়নি।আশেপাশে তাকিয়ে দেখে ওর মা আর ওর কিছু খালারা মিলে খাবার নিয়ে ডাইনিং এ আসছে।ইয়ারাবী ইয়ামিলাকে ইশারা করে ডাক দিতেই ও দৌঁড়ে এসে বলে,
-“কিছু বলবি আপু?”
-“হামম বলার জন্যই ডেকেছি,তোর আম্মুকে যেয়ে বল ব্রেকফাস্ট দিতে।এতো বেলা এখনো কেউ খায়নি।”

ও নিচু স্বরে কথাটা বললেও মিসেস ইশানি ঠিকই শুনতে পান।উনি সব ব্যবস্থা করে ইয়ারাবীর সামনে যেয়ে বলে আবরার,জারবা,মেঘকে ডাক।ইরাক একটা আপেল খেতে খেতে এসে বলে,
-“কাউকে ডাকতে হবেনা সবাই চলে এসেছে।”

সবাই খাওয়ার জন্য বসেছে, এমন সময় ফ্রেস হয়ে জারবা এসে ইয়ারাবীকে জড়িয়ে ধরে বলে,
-“গুড মর্নিং ছোট ভাবী…”
-“গুড মর্নিং,ঘুম ভালো হয়েছে?”
-“হ্যাঁ,অনেক ভালো হয়েছে,আমি কোথায় বসবো?”
-“মেঘের পাশে বসো,”
-“তুমি বসবেনা?খাবেনা তুমি?”

আবরার গ্লাসে পানি ঢালতে ঢালতে বলে,
-“খাবে,তুই বস।আর ইয়ারাবী তুমিও এসে বসে পরো।”
-“আমি….”
-“কোনো পরে নয়,আগে খাবে তারপর বাকী সব।”

বারোটা থেকে মেহেদী শুরু,সবাই খুব মজা করছে।আর ইয়ারাবী একটা চেয়ারে বসে বসে দাঁত দিয়ে নক কাটছে।এছাড়া আর কী বা করার আছে?অনু এসেছে তবে মেঘের সাথে ঘুরে ঘুরে সেলফি তুলছে,আর এসে ওকে দেখাচ্ছে।হঠাৎ ও পিছন থেকে কানে কিছু বাজে আওয়াজ শুনতে পায়।পিছনে একটু ভালো করে ঝুঁকে বুঝতে পারে এটা মিসেস নিন্দু আর মিসেস জামানের কন্ঠ।মিসেস নিন্দু আফসোসের কন্ঠে বলে উঠে,
-“আরে আপা কথায় আছেনা ধর্মের কল বাতাসে নড়ে।যদি কারো ক্ষতি করতে যাও তবে নিজের ক্ষতি হবে।”
-“হ্,তুই একদম ঠিক বলছিস রে নিন্দু।”
-“ওই শয়তান মেয়ে ইয়ারাবী আমার মেয়ের সংসারটা ভাঙলো,আমার মেয়ের কাছ থেকে নিরাকে কেড়ে নিলো তার জন্য আল্লাহ ওর শাস্তি দিয়েছে সারাজীবনের মতো।কোনোদিন মা হতে পারবেনা,আল্লাহ অন্যায় সয় না আপা।”

মিসেস জামান পানের পিক ফেলে বলে উঠেন,
-“দেখিস ওর ও সংসার টিকবেনা।আজ বর ঠিকই বলছে পাশে আছি কাল ছেড়ে দিবে।ওর বরের কী কোনো স্বার্থ আছে যে ওকে ধরে রাখবে।আমার মতে ছেড়ে দেওয়ায় ভালো।কত সুন্দর ছেলে, অনেক নাম ডাকও আছে।ওর এতো দায় পরেছে নাকী ওর মতো বাজা মেয়েকে ধরে রাখবে।আমার যদি আদিবা ছাড়া অন্য কোনো মেয়ে থাকতো তবে আবরারের সাথে বিয়ে দিতাম।”

-“বাহ্ বাহ্ খালা-মামী বাহ্।কত চমৎকার আপনাদের চিন্তা-ধারা?”
উনারা দু’জন কথার আওয়াজে চমকে যেয়ে সামনে তাকিয়ে দেখে গোল্ডেন-সবুজ মিশ্রন কালারের একটা লং হাতা গাউন পরা,মাথায় খুব সুন্দর করে ওড়না দিয়ে ইয়ারাবী দাঁড়িয়ে আছে। আজ চেহারা দেখতে অনেকটা জ্বলজ্বল করছে, মুখে একপ্রকার মাধুর্য কাজ করছে।ইয়ারাবী কিছুটা হেসে ওর মামীর দিকে তাকিয়ে বলে,
-“মামী আমি আপনার মেয়ের সংসার নষ্ট করিনি,সে নিজেই করেছে।আমি বরং তাকে বাঁচাতে চেয়েছিলাম।ওর কোল থেকে আমি নিরাকে সরায়নি বরং ও নিজের দোষে হারিয়েছে।আল্লাহ আমার কোল খালি কেন রেখেছেন সেটা তিনিই ভালো জানেন।কেননা দেওয়া-নেওয়ার মালিক একমাত্র আল্লাহ।আর খালা আপনার কথাতো বাদই দিলাম,লজ্জা করেনা আপনার কথাটা বলতে।আসলে কাদের কী বলছি?আমাকে নিয়ে সমালোচনা করবেন ভালো কথা কিন্তু এভাবে বাইরে করলে মানুষ আমাকে নই বরং আপনাদের খারাপ বলবে।আমার স্বামী আমাকে রাখবে কীনা সেটা উনি ভালো জানেন,তাই আপনাদের চিন্তা করতে হবেনা।”

ইয়ারাবী কথাটা বলে দ্রুত ওখান থেকে সরে আসে।আজকাল উনাদের দেখলে ওর শ্বাস নিতে পর্যন্ত কষ্ট হয়,এই মানুষগুলোর জন্য কখনো আদর-ভালোবাসা পায়নি।যখন কোথাও বাচ্চাকে তাদের বাবা-মার সাথে দেখতে পাঢ়য নিজের ভিতর কষ্ট অনুভব হয়।ওরও মন চাই নিজের বাবা-মার কাছ থেকে আদর নিতে।নানা কথা চিন্তা করতে করতে কারো বুকের সাথে ধাক্কা খেয়ে ভাবনা থেকে বেড়িয়ে সামনে তাকিয়ে দেখে আবরার দাঁড়িয়ে আছে,পরনে সবুজ কালারের পান্জাবি আর ব্লাক জিন্স।আবরার ওর দিকে তাকিয়ে বলে,
-“মন কোথায় থাকে তোমার?আর জায়গা থেকে উঠেছো কেন?”
-“এমনি ভালো লাগছেনা।”
-“অসুস্থবোধ করছো?”

ইয়ারাবী খানিকটা হাসির রেখা টেনে বলে,
-“না,”
-“বুঝেছি,আবার সমালোচনা।কেন কথায় কান দিচ্ছো বলতো?আমি বা আমার পরিবার কখনো কিছু বলেনি তোমাকে। ”
-“এমনটা নয় আবরার,আমি ওসব ভাবছিনা।”

আবরার সন্দেহ নজরে ভ্রুটা খানিক উঁচু করে বলে,
-“তাহলে?”
-“কিছু নয়,ওহ্ আমি না আপনাকে বলতে ভুলে গেছি।কাল যে ফোনটা আমাকে দিয়েছিলেন আজ সকালে কেউ ফোন করেছিলো।আমি রিসিভ করিনি,বাইরের দেশের নাম্বার ছিলো।”

আবরার ফোনটা ওর কাছ থেকে হাতে নিয়ে দেখে বলে,
-“এটাতো মিকের নাম্বার,এটাই কেন ফোন করেছে!”
-“মিক আপনার সেই বন্ধু?”
-“হ্যাঁ,তোমার ট্রিটমেন্টটা ও নিজেই করবে।আচ্ছা তুমি য়ুহারের কাছে যাও,আমি কথা বলে আসছি।”

আবরার ফোনটা ওকে ফেরত দিয়ে নিজের ব্যবহৃত ফোন থেকে মিককে কল করতে করতে জায়গা থেকে চলে যায়।ইয়ারাবী কিছুক্ষণ ওর দিকে তাকিয়ে সামনের দিকে এগুতে থাকে।হঠাৎ ওর চোখ যায় ইরাক-ইফাজের উপর,দুই ভাই বাড়িতে উপস্থিত থাকলে সব সময় একসাথেই থাকবে।তবে ইমনটা হয়েছে তার ব্যাতিক্রম,ও নিজেই জানেনা কখন কোথায় থাকে?এখন বোধ হয় শাহরিয়ারদের সাথে আড্ডা দিতে ব্যাস্ত, ইয়ারাবী সেদিকে নজর দিয়ে ওর ভাইদের কাছে এগিয়ে যায়।
-“ভাইয়া কী করো তোমরা?”

ইফাজ হেসে কোকের বোতল থেকে এক ঢোক গিলে বলে,
-“এইতো ভাইয়া ক্যাম্পের গল্প বলছে আর আমি শুনছি।”
-“ক্যাম্পের গল্প নাকী গোলাপের গল্প?”

কথাটা শুনার সাথে সাথে ইরাক আড়চোখে তাকায় ওর দিকে।ইফাজ কৌতুহল নিয়ে ওর দিকে প্রশ্ন ছুড়ে বলে,
-“গোলাপের গল্প মানে?”
-“আরে ওই যে ভাইয়ার…..”

ইরাক ওর মুখের মধ্যে একটা লাড্ডু ঢুকিয়ে চোখ রাঙিয়ে বলে,
-“খা এইটা।”
-“ভাইয়া ওর সাথে এমন করছো কেন?এই পিচ্চি বলতো কী হয়েছে?”
-“ইফাজ কিছুই হয়নি।”
-“এই তুই বল….”

ইয়ারাবী মুখের খাবারটুকু শেষ করে বলে,
-“এমনিতে অর্ধমৃত আছি,বলে একেবারে মরার ইচ্ছা নেই বাপু।”
-“তুই না বললে আমি তোকে মারবো…”
-“এ্যা!তোমরা এমন করো কেন বলোতো?আমি গেলাম এখান থেকে…”
-“পিচ্চি উঠবিনা একদম,আগে বল ভাইয়ার কাহিনি।”

ইরাক মিষ্টি খাচ্ছে আর হাসতে হাসতে বলছে,
-“তো পিচ্চি বাঘিনী,সাহস থাকলে বলে দেখা।কী হলো মেজো ভাইয়া শুনছে বলো?”
-“তুমি এমন করো কেন?”
-“শুরু তো তুই করলি….”
-“আমি আপুর কাছে যাচ্ছি।”

ইয়ারাবী কথাটা বলে দ্রুত স্থান থেকে চলে যেয়ে বড় দু’টা শ্বাস নেয়।সামনের দিকে তাকিয়ে দেখে জারবা একটা লোকের সাথে রাগী গলায় কথা বলছে,দেখেই বোঝা যাচ্ছে কোনো সমস্যা হয়েছে।কিন্তু লোকটা উল্টোপিঠে থাকায় বুঝতে পারছেনা কার সাথে,ইয়ারাবী দ্রুত পায়ে জারবার নিকট যেয়ে প্রশ্ন করে,
-“কী হয়েছে জারবা?”
-“দেখোনা ছোট ভাবী,এই লোকটা কেমন বাজে ভাবে আমাকে স্পর্শ করছিলো।এখন হাতটাও ছাড়ছেনা,অসভ্য লোক একটা।”

ইয়ারাবী সামনের দিকে তাকিয়ে চমকে যায়, কেননা এই লোকটি য়ুহারের ছোট মামা মি.সুজন, বয়স অানুমানিক পঁয়তাল্লিশ বছর হবে।যার স্বাভাব-চরিত্র বলতে একটুও ভালোনা,এই পর্যন্ত তিনটা বিয়ে করেছে একটাও টিকেনি।দুইবার জেলও খেটেছে,তার জন্য য়ুহাররা কেউ পছন্দ করেনা সুজনকে।ইয়ারাবী এক ঝটকায় উনার হাত থেকে হাতটা সরিয়ে নিয়ে বলে,
-“মামা অতিথির মতো আচারন করলেই খুশি হবো।”

মি.সুজন কিছুটা ভরকে গিয়ে মিনমিন গলায় বলেন,
-“তুই য়ুহারের ফুফাতো বোন,সেই বিয়েতে দেখেছি।কতটা সুন্দর হয়ে উঠেছিস যেন চোখ ফিরানো যায়না।”

ইয়ারাবী উনার কথায় পাত্তা না দিয়ে জারবাকে নিয়ে চলে আসতে গেলে উনি ইয়ারাবীর ওড়না টেনে ধরেন যার জন্য মাথা থেকে খুলে পরে যায়।তখনি ইয়ারাবী ঘুরে উনার মুখে একটা চড় কষিয়ে দেয়।আশেপাশে অনেক মানুষজন কিন্তু কেউ তেমন খেয়াল করেনি।এমন ঘটনায় জারবা কিছুটা ভয় পেয়ে চমকে উঠে।ইয়ারাবী ওড়নাটা ঠিক করে মাথায় পেঁচিয়ে বলে,
-“বয়স হয়েছে কিন্তু এখনো চরিত্র ঠিক হয়নি।তখন হাতটা না ছাড়িয়ে আপনার পুরো হাতটা আমার ভেঙ্গে দেওয়া উচিত ছিলো।”
-“মুখ সামলে কথা বলবি,ভুলে যাসনা উনি তোর বড়।”

ইয়ারাবী পাশে তাকিয়ে দেখে কথাটা য়ুহারের বড় খালা মিসেস আমেনা বলছে।ইয়ারাবী খানিকটা হেসে বলে,
-“যা সত্য সেটাই বলেছি আমি,তাছাড়া আপনার ভাই একটু আগে যা করেছে সুকরিয়া আদায় করেন এখনো উনি দাঁড়িয়ে আছে।”

কথাটা শুনে য়ুহারের খালা কিছু না বলে বোনকে ডেকে ন্যাকা কান্না জুরে দিয়ে বলেন,
-“অচু এই দিন দেখার জন্য আমাদের এখানে ডেকেছিলি।তোদের বাড়ির মেয়ে আমাকে আর ভাইকে যাচ্ছে তাই বলছে।”

মিসেস অচলা উনার কথার গুরুত্ব না দিয়ে ইয়ারাবীর দিকে তাকিয়ে বলেন,
-“কী হয়েছেরে মা বলতো?”
-“তুই ওকে কেন জিজ্ঞেস করছিস?”
-“কারণ আমি জানি তোদের স্বাভাব-চরিত্র ভালো না।পরের ভাতে বেগুন পুরাতে খুব ভালো পারিস।”
-“অচলা ভুলে যাসনা আমি তোর বড়।”
-“সেটা ভুলিওনি আমি….”

-“আহ্হ্,মামী থামোতো।তাছাড়া এখানে সেটাই হয়েছে যেটা তোমার ভাই সব সময় করে।”
-“মা এরা কেমন সেটা তুই জানিস তাই কোনো ঝামেলা করিস না দোহায় লাগে।তুই জানিস য়ুহার কেমন,তার উপর তোর স্বামী-ভাইয়েরা…”
-“মামী আমিও চাই আপুর বিয়েটা ভালো করে হোক।সুতরাং চেষ্টা করবো কোনো ঝামেলা না করা।”

কথাটা বলে ইয়ারাবী ওখান থেকে চলে যেতেই মিসেস আমেনা তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠে বোনকে বলেন,
-“তুই কিছু বললি না কেন তোর ননদের মেয়েকে?”
-“কী বলবো?তুমি জানো অন্যায় তোমার ভাই করেছে আর সেটা আমিও দেখেছি।ভাবছি এখন যদি জামাই জানে তার বোনের হাত ধরে এই অসভ্যটা টানছিলো তবে প্রলয় আসতে বেশি দেরি হবেনা।”

কথাটা শুনার সাথে সাথে দু’ভাই-বোন রাগে গজগজ করছে,শুধু বিয়ে বাড়ি বলে ঝগড়া করতে চাইছেনা।তাছাড়া আরো একটা কারন আছে আর সেটা হলো,বোনের কাছ থেকে স্বামীর দুর্দিনের কথা বলে একটা মোটা অঙ্কের টাকা হাতানো।
ইয়ারাবী চারপাশে চোখ বুলিয়ে শুধু জারবাকে খুঁজছে,মেয়েটাকে তাড়াতাড়ি না পেলে সর্বনাশ হয়ে যাবে।কেননা জারবা যদি মেঘ-আবরারকে কথাটা জানিয়ে দেয় তবে একটা বিচ্ছিরি ব্যাপার ঘটবে।আর ও চাইনা বিয়ের সময় এমন কিছু হোক,তবে এই জারবাকে নিয়ে হয়েছে ঝামেলা।কেননা ওর স্বভাব হলো ভালো-খারাপ যাই হোক না কেন পুরো দিনের কথা তার ভাইদের কাছে বলা।মায়ের সাথেও এতটা ফ্রি নয় যতটা ভাইদের সাথে ফ্রি।শেষমেষ খুঁজতে খুঁজতে পেয়েও যায় তবে যে ভয় করছিলো সেটাই।কেননা জারবা আবরারের সাথে বসে আছে।আর আবরারের মুখ দেখে মনে হচ্ছে কোনো কিছু নিয়ে চিন্তা করছে।ইয়ারাবী দ্রুতপায়ে ওদের নিকট যেয়ে জারবাকে প্রশ্ন করে বলে,
-“জারবা তুমি এখানে আর আমি পুরো বাড়ি খুঁজছি।”
-“ছোট ভাবী তুমি তো কথা বলছিলে তাই চলে আসলাম ভাইয়ার কাছে তবে কিছু বলিনি।”

আবরার কথাটা শুনে প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে ওদের দিকে তাকিয়ে বলে,
-“কী বলিসনি?কিছু হয়েছে নাকী জারু?”
-“আসলে ভাইয়া….”

ইয়ারাবী জারবা হাত চেপে ধরে বলে,
-“তেমন কিছুনা,তুমি মেহেদী লাগাবে বলে?”
-“তুমি দিয়ে দিবে,সবাই বলে তুমি ভালো দিতে পারো।”

ইয়ারাবী হাসার চেষ্টা করে বলে,
-“ঠিক আছে ননদিনী,জারার কাছে যেয়ে বলো দু’টা মেহেদী দিতে।”
-“আচ্ছা…”

জারবা কথা বলে দৌঁড়ে চলে যেতেই আবরার ইয়ারাবীর হাত টেনে ধরে সামনের চেয়ারে বসিয়ে বলে,
-“অনেকক্ষন ধরে দেখছি ছোটাছুটি করছো,পরে কী হবে ভেবে দেখেছো?”
-“কই নাতো…”

কিছুক্ষণ চুপ থেকে ইয়ারাবী আবার বলে উঠে,
-“আপনি কোনো কিছু নিয়ে চিন্তা করছেন?”
-“হামম,”
-“আমাকে বলা যাবে?না মানে ব্যাক্তিগত হলে থাক…”
-“তেমনটা নয়,মিকের সাথে কথা হলো।বললো, তোমার ট্রিটমেন্টের জন্য যেতে।আমি বলেছি ঈদের পরে যাবো।কী বলো তুমি?”
-“আপনি যে সিদ্ধান্ত নিবেন সেটাই মেনে নিবো, তবে পড়ার..”
-“পাগলি,তুমি ওখানে পড়াগুলো কম্পিলিট করতে থাকবে,মেঘ-অনুর থেকে লেকচার গুলো জেনে নিবে।কী পারবেনা তুমি?আর না পারলেও করার কিছু নেই, কেননা দ্রুত ট্রিটমেন্ট না করলে পরে…”

ইয়ারাবী মনটা খারাপ করে বলে,
-“আমি পারবো।আচ্ছা আপনি বসেন আমি তালেব নানুর…”

আবরার ওর দিকে তাকিয়ে হেসে বলে,
-“দেখা করবে তাইতো?”
-“হ্যাঁ,বিষয়টার জন্য।”
-“উনি তো সকালে খাওয়ার পর চলে গেছেন তবে কিছু আমল করতে বলেছেন তোমাকে আর ভয়ের কিছু নেই এইগুলো করলে ঠিক হয়ে যাবে।সমস্যা বলে চলে যেতে হলো নয়তো উনি সবটা করে যেতেই চেয়েছিলেন।”
-“ওহ্হ্….”

সারাদিন অনেক আনন্দের মধ্যে দিনটা কেঁটে সেই মুহুর্ত উপস্থিত হয়,যেটা একটা মেয়ের জীবনে কতটা আনন্দময় স্বপ্নে ঘেরা থাকে।একদিকে জীবনের নতুন ধাপ আরেকদিকে বাবা-মা,নিজের চিরচেনা পরিবেশ থেকে অচেনা পথে পাড়ি জমানো।বিয়ের সময় জারা-টিকলিরা আনন্দ করলেও ইয়ারাবী করতে পারেনি।অসম্ভব মাথা ব্যাথা নিয়ে বিছানায় থাকতে হয়েছিলো,আবরার বাসায় শাষালেও এখানে এসে তেমন রাগ করেনি।কেননা ওর জানা ছিলো এমনটা এমনিতেই হতো,কারণ ও বাকীদের থেকে শারীরিকভাবে অনেকটা দুর্বল।

যাওয়ার সময় য়ুহার প্রচুর কান্না করছিলো,তবুও যেতে হবে তাকে এটাই যে নিয়ম।এই সময় প্রত্যেক বাবা-মা মেয়েকে কিছু উপদেশমুলক কথা বলে কিন্তু এখানে য়ুহার ওর বাবা-মাকে অনেক কথা গুছিয়ে বলে গেলো।কারণ ও জানে ওর মায়ের মনটা নরম তাই যে কোনো মানুষের কথায় গলে যায় আর ওর বাবা বোকা মানুষ।বাড়ির সকলের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ইয়ারাবীর ঘরে যেয়ে দেখে ও শুয়ে আছে।ওদের দেখার সাথে সাথে ইয়ারাবী শত কষ্ট হলেও উঠে বসে মুখে হাসি ফুঁটিয়ে বলে,
-“কী ব্যাপার আপু এখনো বিদায় হওনি?”
-“ফাজলামি করছিস তুই…”

কথাটা বলেই ওকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দেয় য়ুহার।ইয়ারাবী কানে কানে বলে উঠে,
-“এমন করে কাঁদলে তো মামার টাকাগুলো জলে যাবে আর সেই সাথে তোমার বিখ্যাত ডাইনি মার্কা চেহারা বাইরে চলে আসবে।আর সেটা হলে তো দোলাভাই বাসর ঘরে ঢুকেই ভয় পেয়ে যাবে আর বলবে বৌকে রেখে আমরা ডাইনি পাঠিয়েছি।তাইনা দোলাভাই।”
-“লাগুক ডাইনি….”
-“এভাবে মরা কান্নার কী আছে?কেউ কী মারা গেছে।তোমার তো আরো আমাকে ধনেপাতা দেওয়া উচিত যে তুমি আমার বিয়েতে অস্ট্রেলিয়া গেলেও আমি এসেছি ঠিকই।কিন্তু তোমার সাথে তোমার শ্বশুড়বাড়ি যেতে পারলাম না,আর না বজ্জাতগুলো আমাকে টাকার ভাগ দিলো।”

শৈল ওর কথা শুনে হেসে দেয়,য়ুহার ওকে ছেড়ে দিয়ে মাথায় একটা চুমু দিয়ে বলে,
-“জানিস কষ্ট হলেও একটা জিনিস ভেবে ভালো লাগছে আমার বাচ্চাটা সেই ছোট বেলার মতো চঞ্চল হয়ে উঠছে।আচ্ছা আবরার কোথায়?”

আবরার ওয়াশরুম থেকে টাওয়াল দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে বেড় হয়ে বলে,
-“এইতো আমি…”
-“ওহ্হ্ ভালোই হলো তোমাকে পেয়ে গেলাম।”
-“কেন কিছু বলবে?”

য়ুহার ইয়ারাবীর মাথায় হাত রেখে বলে,
-“হামম,বলছি সোনাটার খেয়াল রেখো।আগে তো সমস্যা হলে যেতে পারতাম কিন্তু বিয়ের পর অতোটা পারবো কীনা জানিনা।আপনজন বলতে তুমিই ওর সব,দোষ করলে বকবে,বোঝাবে কিন্তু কখনো মারবেনা বাচ্চাটাকে।ওর জীবনের সবটাই তুমি জানো।”

আবরার কিছুটা মুচকি হেসে বলে,
-“ডু ইউ রিমেম্বার য়ুহার?যখন তোমার সাথে প্রথম দেখা হয়েছিলো তখনো তুমি এই কথাটাই বলেছিলে।আমি জানি তুমি,তারা,ইরাকদের জন্য ও কতটা ইমপর্টেন্ট পার্সন।আর ছোট থেকে শুধু তোমাদের কাছেই বাবা-মা,পরিবার বলো সেই আদরটাই পেয়েছে।চিন্তা করোনা,আমি সব সময় চেষ্টা করবো নিজের রাগকে কন্ট্রোলে রাখার।”
-“আমি জানি তবুও ভয় হয়,জানি ও সহজে ভুল করেনা।তবুও যদি করে ফেলে অন্তত গায়ে হাত তুলবেনা।আর ও তেমন মেয়ে নয় যে স্বামীর উপর চটে যাবে।”

আবরার খানিকটা হেসে বলে,
-“তোমাদের জন্য অপেক্ষা করছে সবাই।আর স্যরি কাল তোমার বৌ-ভাতে যেতে পারবোনা।”
-“জানি আমি,তোমার ভোরে রওনা দিবে।আর স্যরি আমার বাচ্চাটা,আমার বিয়েতে এসে আরো অসুস্থ হয়ে পরলি।”

ইয়ারাবী ওকে জড়িয়ে ধরে বলে,
-“প্লীজ আপু এসব বলবেনা,তুমি জানো তুমি আমার কাছে কেমন?দেখো সবাই তাড়া দিচ্ছে যাওয়ার জন্য যাও,আর হ্যাঁ শ্বশুড়বাড়ি মানিয়ে চলবে আর ভাইয়া কিছু উল্টো-পাল্টা বললে ঘুষি দিবে।”

শৈল অবাক হয়ে তাকিয়ে বলে,
-“ঘুষি দিবে,সিরিয়াসলি?”
-“হ্যাঁ,কারণ আপু তো সব সময় বলে।”

য়ুহার বাকীদের সাথে কিছুটা কথা বলে নতুন জীবনে পাড়ি জমায়,ওর সাথে নিলয়,জারা আর ওর খালাতো ভাই সজীব সাথে যায়।

(১৮২)

দেখতে দেখতে অনেকগুলো দিন পার হয়ে যায়,দু’দিন পর থেকে রোজা শুরু।দুপুরে ডাইনিং এ বসে মিসেস রায়হান ইকরাকে নিয়ে কিছু লিস্ট করছেন,এমন সময় আবরার অনেকটা রেগে বাসায় ফিরে জোরে জোরে ইয়ারাবীকে ডাকতে থাকে।ওর ডাক শুনে ঘর থেকে মেঘ আর জারবা দ্রুত নিচে নেমে আসে।মিসেস রায়হান ছেলের দিকে তাকিয়ে বলেন,
-“কী হয়েছে আব্বু তোর?আর ইয়ারাবীকে কেন ডাকছিস?”
-“মম্ সেটা তোমার বৌমা আসলেই বুঝতে পারবে।কোথায় ও?”
-“ওতো ফেরেনি এখনো….”
-“কী?মেঘ তাহলে তুই….”

মেঘ ওর রাগ দেখে ভয়ে কথা সম্পন্ন হওয়ার আগেই বলে উঠে,
-“ভাইয়া আমিও জানিনা ও কোথায় গেছে, প্রাইভেট থেকে বের হয়ে বললো তুই যা আমি আসছি একটু পরে।আমি বরাবরের মতোই ওকে বললাম,তোকে সাথে নিয়েই বাসায় যেতে হবে নয়তো ভাইয়া রাগ করবে।কিন্তু ও বললো তোমাকে জানিয়েছে যে দেরি হবে তাই আর মাথা ঘামায়নি।”
-“সাথে অনু ছিলো?”
-“নাতো ভাইয়া,অনুকেও সাথে নেয়নি।কী হয়েছে?”

আবরার কিছু বলবে তার আগেই ইকরা দরজার দিকে তাকিয়ে বলে উঠে,
-“ওইতো ইয়ারাবী…”

কেউ কিছু বোঝার আগেই আবরার যেয়ে ঠাস করে ওর মুখে একটা জোরে থাপ্পড় মেরে দেয়।এতে করে সবাই অনেক অবাক হয়ে যায়,মিসেস হেনা চিৎকার করে উঠে বলে,
-“আবরার তোর এই দিন দেখার জন্য বড় করেছি।কাপুরুষের মতো মেয়ের গায়ে হাত কেন তুললি?”

ইয়ারাবী মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে ওর সামনে, মুখ বাধা চোখটা ছলছল করছে।আবরার ওরদিকে তাকিয়ে অনেকটা রাগী কন্ঠে মায়ের উদ্দেশ্যে বলে,
-“প্লীজ মম্ আজ কেউ কোনো কথা বলবেনা।”

ওর হুংকারে সবাই চুপ করে যায়,এমন কী ওর মা নিজেও।আবরার ইয়ারাবী ঘাড় ধরে অরেকটা থাপ্পড় দিয়ে বলে,
-“এই দিন দেখার জন্য আমি তোকে স্বাধীনতা দিয়েছি।যা চেয়েছিস তাই দিয়েছে বিনিময়ে তুই কী করলি?”

কথা বলে আরেকটা থাপ্পড় লাগায় ইয়ারাবীকে, আর এই থাপ্পড়ে কাউচের সামনে রাখা কাচের টেবিলের সাথে ওর মাথাটা লাগে।ইকরা দ্রুত যেয়ে ইয়ারাবীকে ধরে।মিসেস রায়হান অবস্থা খারাপ দেখে আরবারকে আটকিয়ে বলে,
-“পাগল হয়ে গেছিস তুই,মেয়েটা অসুস্থ আর তুই তাকে এভাবে মারছিস।আমার ভাবতেও অবাক লাগছে তুই আমার ছেলে।কী করেছে ও যার জন্য এই জঘন্য ব্যবহার করছিস,দেরি করে আসা তো দোষের কিছু নয়।”

আবরার পাশে রাখা ছোট কাউচে লাথি মেরে চেঁচিয়ে বলে,
-“আমি এতটা খারাপ নই যে দেরি করে আসার জন্য ওকে মারবো।শোনো তোমার বৌমা কী করেছে?যে লোকটা ওকে ছোট থেকে মলেস্ট করার চেষ্টা করছে আজ তার সাথে একা দেখা করতে গেছিলো।”

উনি কিছুটা অবাক হয়ে বলেন,
-“কী?
-“হ্যাঁ,যে রেস্টুরেন্টে ও গেছিলো সেখানে বিহানও ছিলো।ও প্রথমে আমাকে বলে ম্যাডাম একটা ছেলের সাথে রেস্টুরেন্টে এসেছে।তখন আমি ওকে ছবি পাঠালে বলি।আমি ওকে পইপই করে বলেছি কখনো মিথ্যা বলবেনা আমাকে,কিন্তু বারবার রাগিয়ে দেয়।আরে যখন যাবি তখন মেঘ বা অনুকে কেন নিসনি?আর ওকে পর্দা করতে বলছি কিন্তু ওর পিয়াসকে নিজের চেহারা দেখিয়ে এসেছে।”
-“আহ্হ্,আবরার হতে পারে ছেলেটা…”
-“হ্যাঁ,মম্ ক্ষমার জন্য।কিন্তু মিথ্যা কেন বলবে? তোর বাবা ঠিকই বলে ভদ্রভাবে কথা শোনার মেয়ে তুই না।তোকে তো আমি…।”

-“আবরার রাগ পরে করবে,ইয়ারাবী সেন্সলেস হয়ে গেছে।”
ইকরা উত্তেজিত কন্ঠে কথাটা বললে মেঘ-জারবা ইয়ারাবীকে ধরে কাউচের উপর শুইয়ে দিতেই আবরার এসে দেখে ওর কপালের বাম পাশ থেকে রক্ত পরছে।ও দ্রুত ওর নেকাব খুলে দিয়ে দেখে মুখের দু’পাশের পাঁচ আঙ্গুলের ছাপ পরে গেছে।মিসেস রায়হান আবরারের দিকে তাকিয়ে বলে,
-“এবার খুশিতো,নিজে একজন ডাক্তার হয়ে পশুর মতো কাজ কীভাবে করতে পারলি?মেঘ তোর জাফর আঙ্কেলকে ফোন দিয়ে আসতে বল….”
-“মম্ আমিও কিন্তু ডাক্তার।বেশি কিছু হয়নি,দুর্বলতা আর ভয়ে জ্ঞান হারিয়েছে।আমি ওকে রুমে নিয়ে যাচ্ছি।”

কথাটা বলে আবরার ওকে কোলে তুলে নিতেই মিসেস রায়হান বলেন,
-“ঘরে নিয়ে আরো মারবি তাইতো?”
-“মম্ আমি এতটাও খারাপ নই।তুমি সার্ভেন্টদের দিয়ে খাবার পাঠিয়ে দেও।”
কাউকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে আবরার ওকে রুমে নিয়ে এসে বেডে শুয়ে দিয়ে ওর বোরখা আর হিজাব খুলে দেয়।গালের দাগগুলো লাল হয়ে বসে গেছে।আবরার ওর গালের উপর নিজের হাতটা বুলিয়ে দিয়ে কপালে একটা চুমু দিয়ে বলে,
-“দুঃখীত আমি,তুমি জানো আমার কথা কেউ না শুনলে মাথা ঠিক থাকেনা।আর আমি জানি তুমি কোনো অন্যায় করোনি,তবে পিয়াসের সাথে দেখে আমার মাথা ঠিক ছিলোনা।তুমি ওর কথায় গলে ওকে ক্ষমা করার জন্য দেখা করতে গেলে,যদি তোমার কোনো ক্ষতি করে দিতো।একজন সাইক্রেটিস হয়ে বুঝতে পারছি ওর চোখে একটু হলেও সেই কামনা ছিলো তোমার প্রতি।”

কথাটা বলে আবরার ওর গায়ে চাদরটা টেনে দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে নিজে ফ্রেস হতে চলে যায়।সার্ভেন্ট এসে খাবার দিয়ে গেছে,আবরার বের হয়ে কাবার্ড থেকে মেডিসিনের একটা বক্স এনে ওর কপালে মলম লাগিয়ে ব্যান্ডেজ করে দেয়,মুখের দাগের উপরে জেল লাগিয়ে ওকে ইনজেকশন পুশ করে দিতেই তিন-চার মিনিট পর ওর জ্ঞান ফেরে।ইয়ারাবীর মাথায় ভয়ংকর যন্ত্রনা হচ্ছে,মুখে, কপালে খুব ব্যাথা করছে,চোখগুলো পিটপিট করে খুলে বুঝতে পারে নিজের ঘরে শুয়ে আছে আছে।পিপাসায় গলা শুকিয়ে কাঠ,হঠাৎ সামনে তাকিয়ে ভয়ে দ্রুত উঠে গুটিগুটি হয়ে বসে।কেননা সামনে আবরাকে দেখে,একটু আগের কথা ভাবতেই ওর গাঁয়ে কাঁটা দিয়ে উঠে।আবরারের হাতের চড় ওর মা-বাবার থেকেও অনেক জোরে।আবরার বুঝতে পারছে ইয়ারাবী ওকে ভয় পাচ্ছে,কেননা ও যা করেছে তাতে ভয় পাওয়া স্বাভাবিক।ও ইয়ারাবীকে ধরতে গেলে ও ভয়তে সরে যেয়ে কান্না করতে করতে বলে,
-“আ…আমি জানি আমি ভুল ক..রেছি,দয়া করে আমাকে আর মা…মারবেন না।আপ..নি যা বলবেন সেটাই করবো আজ থেকে,প্লীজ তবুও আমাকে মারবেন না।আম্মুনি-আব্বু মারলেও সেটা স…সহ্য করতে পারতাম কিন্তু আপনারটা পারিনা।আমি আপনার পায়ে পরেছি প্লীজ এমনটা করবেন না।”

ও শান্ত কন্ঠে ডেকে উঠে,
-“ইয়ারাবী….”
-“না আপনি মারবেন আমাকে।”
-“আমি তোমার কাছে হাত জোর করে বলছি তুমি কান্নাটা থামাও,এমনিতে মাথায় প্রচুর চাপ পরেছে এমন করলে….”
-“আপনি কেন হাত জোর করছেন?ভুল আমি করেছি,পিয়াস আমাকে ফোন দিতো যাতে দেখা করে আমি ওকে ক্ষমা করি।আ…পনাকে জানালে রাগ করবেন তাই আমি কাউকে বলি নাই কথাটা।আর আমি নেকাব ইচ্ছা করে খুলিনি, জা…জানেনতো মাশরুমে এলার্জি আছে তাছাড়া গন্ধটাও সহ্য হয়না।এজন্য ওয়াশরুমে যেয়ে মুখে পানি দিতে যেয়ে নেকাব ভি…জে গেছিলো।তাই শুঁকানোর জন্য আর পরা হয়নি।আ..আমি কিছু ইচ্ছাকৃতভাবে করিনি।তবুও আপনার মি…থ্যা মনে হলে বকুন আমাকে।আপনার আ..আঘাত সহ্য করতে পারিনা।”

আবরারের এখন নিজের উপরে রাগ হচ্ছে আর ওর অবস্থা দেখে কষ্টও লাগছে।ইয়ারাবীর আঘাতের জায়গা ফুলে গেছে,দু’চোখ থেকে পানি পরছে।আবরার আর কিছু না ভেবে একটান দিয়ে ওকে নিজের বুকের সাথে জড়িয়ে নেয়।

#চলবে_____

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here