#জীবন মানে তুমি
#লেখিকা:H.B.Rini (Irini Ori)
#পর্ব:৪৮
(১৬৩)
আবরারের কড়া জবাবে ওর মামী কিছুটা দমে যায়।ঘরের মধ্যে চিল্লা-পাল্লার শব্দ শুনে মিসেস রায়হান আর ইকরা এসে দেখে আবরার জোর গলায় ওর মামীর সাথে কথা বলছে।বাড়ির সবাই আবরারের এই রুপের সাথে পরিচিত,সবাই বুঝতে পারছে নিশ্চয়ই কিছু হয়েছে।ইয়ারাবী বারবার আবরারকে শান্ত হতে বলছে কিন্তু কে শোনে কার কথা।আবরারের মাকে দেখে ওর মামী ন্যাকা কান্না জুরে দিয়ে বলে,
-“দেখেন আপা,আপনার ছেলে কীভাবে বৌয়ের গোলাম হয়ে আছে?আর আমি কিছু বললেই দোষ…”
-“তুমি সর্বদা বেশি বেশি করো,বৌমা অসুস্থ তাই দেখাশোনা করছে।এখানে আমাদের কোনো সমস্যা হচ্ছেনা তো তোমার কেন হচ্ছে?”
-“চিন্তা তো হবেই আপা,দেশ-বিদেশে এতো মেয়ে থাকতে বিয়ে করলো এক রোগীকে।কেন?কী আছে এই মেয়ের?না আছে রুপ না আছে…..”
-“ব্যাস,এনাফ।অনেক বলেছেন আর না,যদি আর একটা কথাও শুনি তবে আমি ভুলে যাবো আপনি কে?”
আবরার অনেকটা রেগে চিল্লিয়ে কথাটা বলে উঠে।ওর কথার প্রতিশব্দে আর কেউ একটা শব্দও করতে সাহস পায়না।মিসেস রায়হান একবার ইয়ারাবীর দিকে তাকিয়ে দেখে মেয়েটা মাথা নিচু করে চোখের জল ফেলছে।উনি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবরারের কাঁধে হাত রেখে বলে,
-“শান্ত হ আব্বু,ওর সামনে এভাবে চিল্লাস না।”
-“তো কী করবো মম্?এই মহিলাটা কোনোদিন ঠিক হবেনা।এখন আমার বিয়ে হয়ে গেছে তারপরও নিজের মেয়েকে গছানোর ধান্ধায় আছে।লিসেন মামী,আমি আবীর বা মেঘ নই যে আপনার কথার পিঠে কথার মাধ্যমে শান্ত করবো,আর না আমি ফারহান যে চুপচাপ শুনবে।আমি আবরার,নিশ্চয়ই দ্বিতীয়বারে আপনাকে বলে বোঝাতে হবেনা।আমার ওয়াইফ,আমার লাইফ,এখানে কেউ ইন্টারফেয়ার করুক সেটা আমার পছন্দ নয়।নাও গেট লস্ট…”
শেষের কথাটা অনেকটা জোরে বলে উঠলে ওর মামী ভয় কিছুটা কেঁপে উঠে।এমন রুপের সাথে উনি আগেও একবার পরিচিত,সেই সময় ইয়ারাবী নয় বরং জারবাকে নিয়ে কথা উঠেছিলো।উনি একদিন কথায় কথায় জারবাকে এতিম বলেছিলেন,ব্যাস সেই দিন ওদের তিন ভাইয়ের ভয়ংকর রুপ দেখেছিলো।অবশ্য আবির আর মেঘ কথায় পিঠে কথা বুঝিয়েছিলো কিন্তু আবরার সামনে থাকা টেবিলটা লাথি মেরে ভেঙে ফেলেছিলো,চিল্লিয়ে তার প্রতিবাদ করেছিলো।রাগ যেন ওর শিরায়-শিরায় বহমান।
আবরারের মামা স্ত্রীকে নিয়ে দ্রুত ঘর থেকে বের হয়ে যান।ফাইকা ইয়ারাবীকে উদ্দেশ্য করে বলে,
-“ছোটলোক মেয়ে একটা,বড়লোকদের বশ করতে তো ভালোই জানো।তোমার কোনো যোগ্যতা নেই এই বাড়ির বৌ হওয়ার।তোমার জন্য আজ আমার মামনি অপমানিত হলো,এর শেষ দেখে ছাড়বো আমি।”
ফারহান হাজার চেষ্টা করেই ফাইকাকে চুপ করাতে পারছেনা।আবরার বুকে হাত বেঁধে দাঁড়িয়ে ফাইকাকে দেখে যাচ্ছে।মিসেস রায়হান কিছু বলতে যাবেন তার আগেই ইয়ারাবী চোখ মুছে মাথা উঁচু করে বলে,
-“লিসেন ফাইকা,আপনি বয়সে বড় হলেও সম্পর্কে আমার ছোট।আর ছোটদের ভদ্রতা কীভাবে শিখাতে হয় তা আমার ভালো করেই জানা আছে। আপনি আমাকে ছোট লোক বলছেন আমি জানি আমি ছোটলোক,কিন্তু তাই বলে এই নয় যে আমি আপনার ভাইকে বশ করেছি। আপনার জানানোর জন্য বলছি,বিয়ের প্রস্তাব আমরা নয় বরং আপনার ভাইয়ের পরিবার থেকে গেছিলো এবং তারাই আমাকে পছন্দ করে বিয়ের কথা পাকাপোক্ত করে।এখানে কিন্তু আমি আপনার ভাই অথবা তার পরিবারকে একটুও ব্যাক্তিগতভাবে চিনতাম না।হ্যাঁ আমি মেঘকে চিনতাম তবে তার পরিবারের ব্যাপারে কিছুই জানতাম না।আর একটা কথা কি বললেন?আমার জন্য মামী অপমানিত হয়েছেন।হুমায়ূন আহমেদ একটা কথা বলেছেন-“নিজের সার্টিফিকেট নিজেই দিও না।খেয়াল করে দেখ যে, সবাই তোমাকে কি ভাবে।তাদের কাছেই সার্টিফিকেট নাও।নিজের সমালোচনা করেই দেখ না,শুদ্ধ হওয়া কঠিন কিছু না।”
তিনিও নিজের ভালো সার্টিফিকেট প্রদর্শনী করতে যেয়ে ঠিক-ভুল বিবেচনা না করেই বক্তব্য প্রদান করছিলেন,তাই তিনিও তার প্রাপ্য পেয়েছেন। আবরার কি করলো বা করছে সেটা যদি তার নিজের সম্পূর্ণ ইচ্ছায় হয় তবে সেই ব্যাপারে আমার বিন্দুমাত্র কৌতুহল দেখানোর আগ্রহ নেই।আর হ্যাঁ,স্ত্রীর কাজ করলেই কেউ গোলাম হয়ে যায়না।আপনি মুসলিম,ইমানের ব্যাপারে একটু হলেও জ্ঞান রাখুন,জানুন সঠিক তথ্যগুলো।কথাটা বুঝতে পেরেছেন।”
ইয়ারাবীর শান্ত কন্ঠে কঠিন কথাগুলো ঠিকভাবে ফাইকার হজম হয়নি।মিসেস রায়হান ছেলের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে ঘর থেকে বের হয়ে যান।ফাইকা রাগে গজগজ করছে,পারলে ওকে মারবে এমন অবস্থা।অবস্থা খারাপ দেখে ফারহান ওকে টানতে টানতে ঘর থেকে বের করে নিয়ে যায়।মেয়েটা বড্ডো অবাধ্য হয়েছে আজকাল, কোথায় কী বলতে হয় সব ভুলে খেয়ে বসে আছে।
আবরার ইয়ারাবীর সামনে বসে গ্লাস থেকে পানি নিয়ে হাতটা ধুয়ে নেয়।তারপর মাংস ছিড়ে ভাত মেখে ওর মুখে দিতে গেলে ইয়ারাবী হাত ধরে বলে,
-“আপনাকে আজ কষ্ট করতে হবেনা,আমি এতটাও দুর্বল নই যে নিজের হাতে খেতে পারবোনা।”
-“তোমার মনে হয়না তুমি কিছুটা বাড়াবাড়ি করছো?”
অনেকটা গম্ভীর কন্ঠে আবরার কথাটা বলে উঠে।এই স্বরের মধ্যে একটা রাগ কাজ করছিলো,হতে পারে যে রাগটা ওর মামীর উপর তুলতে পারেনি সেটা।এমন কথা শুনে ইয়ারাবী কিছুটা থতমত খেয়ে বলে উঠে,
-“না মানে আমি সেটা বলতে চাইনি যা আপনি বুঝছেন।আমি আসলে…আপনার হাতে খেয়ে খেয়ে বদ অভ্যাসে পরিনত হয়ে যাবে তখন আর নিজের হাতে খেতে ভালো লাগবেনা।”
-“মিথ্যাটাও ঠিক মত বলতে পারোনা।চুপচাপ খেয়ে নাও,মাথায় রাগ উঠে আছে।আমার কাজে বাঁধা দিবেনা,নয়তো তোমার উপর প্রয়োগ করতে বেশি সময় লাগবেনা।”
ইয়ারাবী ভয়ে একটা ঢোক গিলে বলে,
-“না না,আমি আপনার হাতেই খাবো।”
-“গুড গার্ল,নাও হা করো।”
-“আপনি খাবেন না?”
-“আমি পরে সবার সাথে বসে করে নিবো,তুমি খাও।”
ইয়ারাবী চুপ করে ওর হাতে খাবার খেয়ে নিচ্ছে।আবরার কিছু একটা ভেবে বলে উঠে,
-“তুমি মামীকে কিছু বললেনা কেন?নিজের জন্য কখন প্রতিবাদ করবে?”
-“উনি আপনার মামী আবরার।আমাদের সমাজে একটা প্রথা চলে আসছে,মেয়েরা বাপের বাড়ি যতবড় যুক্তবাদী হোক না কেন বিয়ের পর তাদের যুক্তি দেখালে চলে না,সবকিছু মুখ বুঝে মেনে নিতে হয় নয়তো প্রতিবাদ করলে কথা উঠে মেয়ে খারাপ।”
-“তুমি তো এমন মেয়ে নও।”
-“আমি করতাম না তা নয়,অবশ্যই করতাম যদি আপনি আর আম্মু এখানে উপস্থিত না হতেন। আপনারা দু’জনে যুক্তিবাদী আর সমাজের কুসংস্কার আর প্রথা বিরোধী।তাই আমার যেখানে যুক্তিগত কথা উপস্থাপনের দরকার মনে হয়েছে সেখানেই করেছি।আমি কখনো অন্যায় সহ্য করেনি আর করবোও না,সমাজের জন্য নিজের অবস্থান থেকে চুপ করে থাকবো সেই স্বভাবের মেয়ে আমি নই।তীরে দৃষ্টি হারাতে সাহস না থাকলে মানুষ নতুন মহাসাগর আবিষ্কার করতে পারে না।”
আবরার মুচকি হেসে ওকে সম্পূর্ন খাবার খাইয়ে মেডিসিন দিয়ে আস্তে করে শুয়ে দেয়।সার্ভেন্ট এসে খাবারের প্লেটগুলো নিয়ে যায়।এমন সময় মেঘ ফোন টিপতে টিপতে রুমে ঢুকে বলে,
-“বাহ্ ছোট ভাইয়া,কী দিলে বস?মামীতো মুখ কালো করে বসে আছে।”
-“যে যেমন তার সাথে ঠিক সেই ব্যবহার না করলে তারা কখনোই নিজের অপরাধ বুঝতে পারেনা।কেউ তোমাকে ক্রেডিট দেয় না বলে কখনও দুর্দান্ত কাজ করা বন্ধ করবে না।”
মেঘ একটা লম্বা হামি তুলে সোফায় আরাম করে বসে বলে,
-“মহৎ ব্যক্তিরা সর্বদাই সংকীর্ণ-ব্যক্তিত্বের অধিকারী মানুষদের নিকট থেকে ভয়ানক বাধার সম্মুখীন হয়।”
-“রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উক্তি,বাট্ আমি কোনো মহৎ ব্যক্তি নই।”
মেঘ ওর কথা শুনে হাসে কিন্তু ওকে কিছু বলেনা।ইয়ারাবীর দিকে তাকিয়ে বলে,
-“আজ কেমন আছিস?”
-“আলহামদুলিল্লাহ্,যে মানুষ তোর ভাই।ভালো না থেকে উপায় আছে।”
-“তোর গলা এমন লাগছে কেন?”
-“আরে তেমন কিছু নয়,আসলে অপারেশনের পর থেকে হাত-পাটা প্রায় অবশ হয়ে যাচ্ছে।হতে পারে মেডিসিনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া।”
-“ভাইয়া তুমি জানো এই ব্যাপারে?”
আবরার ফোনটা চার্জে লাগিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়াই।
-“কিছু করোনি?”
-“তোর ভাবী পা ধরতে দিলে তো।একটা কাজ কর,কোনো লেডি সার্ভেন্টকে তেল হালকা গরম করে নিয়ে আসতে বল।”
-“হুমম,দাঁড়াও আমি বলছি।”
-“শোন,তোকে একটা স্যালাইন আনতে বলেছিলাম দুপুরে…”
মেঘ আর বলতে না দিয়ে বলে,
-“নিয়ে এসেছি,রুমে আছে।”
-“নিয়ে আয়,আধাঘন্টা পরে দিবো।”
-“ভাইয়া,ওর মনে হয় এক ইয়ার গ্যাপ যাবে।”
-“আমিও সেটাই ভাবছি।কিন্তু কিছু করার নেই।”
ইয়ারাবী ওদের কথা শুনে ভ্রু কুচকে বলে,
-“এই তোরা কীসের কথা বলছিস?”
-“কেন,তোর স্ট্যাডির।”
-“আমি কিছু গ্যাপ দিবোনা।”
-“তোর অবস্থা ভালোনা।”
মেঘের কথা শুনে ইয়ারাবী কিছুটা উত্তেজিত হয়ে বলে,
-“আরে মানেটা কী?আবরার আমি আপনাকে আগেই বলেছি,আমি পড়ালেখা বন্ধ করতে পারবোনা।আপনি….”
আবরার ওর কথা শুনে একবার মেঘের দিকে তাকিয়ে বলে,
-“তোমার স্টাডি কেউ বন্ধ করছেনা।দেখো এই কয়েকমাসে তুমি অনেক কিছু ফেস করেছে তার উপর আবার এটা।তাছাড়া তুমি পুরোপুরি ঠিক হয়ে গেলে লন্ডনে তোমার ট্রিটমেন্টের জন্য যেতে হবে।”
-“আপনি আপনার কথার খেলাফ করছেন।”
-“এক মিনিট,শান্ত হও তুমি।আমার পুরো কথাটা শুনো,তুমি এই ইয়ারটা গ্যাপ দাও সামনে তোমাকে…”
-“না কখনো না।আমি কিছু গ্যাপ দিবোনা।এই পর্যন্ত আসতে আমার অনেক কিছু করতে হয়েছে।একটা সময় আস্তে আস্তে আমার পুরো লেখাপড়াটা বন্ধ করে দিতে চাইছেন,যদি সেটাই চান তবে বলে দিলেই তো হয়।”
-“কী সব পাগলের মতো কথা বলছো?যদি করতে চাইতাম তবে প্রথমেই করতে পারতাম।তোমার ভালোর জন্য বলছি আর তুমি রোজ রোজ ক্লাস করতেও পারবেনা।উপর থেকে এক্সাম খারাপ হবে….”
-“আমি কিছু জানিনা,আমি পড়ালেখা এক ইয়ারের জন্য হলেও বন্ধ করতে পারবোনা।ওকে আমি রোজ ক্লাস করতে যাবোনা,আর এক্সামও খারাপ হবেনা।তবুও প্লীজ আমার স্ট্যাডিটা বন্ধ করবেন না দয়া করে।”
মেঘ ওর দিকে তাকিয়ে বলে,
-“তোকে বোঝাতে গেলো এক জিনিস আর তুই বুঝছিস আরেক।”
-“আমি কিছুই বুঝতে চাইনা,আমি গ্যাপ দিবোনা শুধু সেটাই জানি।”
-“কী করবি ভাইয়া?”
আবরার ইয়ারাবীর মাথায় হাত রেখে মেঘের দিকে তাকিয়ে বলে,
-“ও যা চাইছে সেটাই হোক।তবে দেখবি মাঝপথে খুব খারাপ হবে।আর ইয়ারাবী এতটা হাইপার না হয়ে শান্ত হও,তুমি যা বলবে তাই হবে।”
-“সত্যি…”
-“হ্যাঁ,এখন শুয়ে পরো।মেঘ রুম থেকে দিয়ে যাবি…”
মেঘ মাথা ঝাকিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে যায়।আবরার ইয়ারাবীর চুলে হাত বুলাচ্ছে।
-“আমার কথাটা শুনলে কী হতো?”
-“আপনার প্রতিটা কথাই শুনি।তবে এবার আপনি আমার রিকুয়েস্টটা রাখুন,আমার কোনো সমস্যা হবেনা।আর রেজাল্ট ভালো করার সম্পূর্ন চেষ্টা করবো,প্লীজ…”
-“এখন বুঝতে পারছোনা,তবে পরে যেয়ে বুঝবে কেন আমি নিষেধ করছিলাম।তুমি যত সহজ মনে করছো এটা কিন্তু ততটা সহজ নয়।”
-“সহজ জীবনের জন্য প্রার্থনা করিনা;একটি শক্ত সহ্য করার জন্য শক্তি প্রার্থনা করি সর্বদা।”
আবরার বেশ ভালো করে জানে ইয়ারাবী প্রচুর ঘাড়ত্যাড়া মেয়ে,অবশ্য ও যেমন ঠিক সেই মতো ওর স্ত্রী।তাই আর বেশি কথা বাড়াই না,ও জানে যা করার ওকেই করতে হবে।আবরার কিছুটা চুপ থেকে আবার বলে উঠে,
-“ও শুনো…”
-“জ্বি,বলুন…”
-“ভালো একটা খবর আছে তোমার জন্য।”
-“আমার জন্য ভালো খবর?কী সেটা?”
-“জীবন একটি আয়না মত। আমরা যদি এটি ভ্রূণত করি তবে তা পিছন দিকে ফিরে আসে। যদি আমরা হাসি, এটি শুভেচ্ছা ফিরে আসে।”
ইয়ারাবী কিছুটা উঁচু হয়ে আবরারের দিকে তাকিয়ে বলে,
-“মানে?”
-“তুমি যা সব সময় চেয়েছো ঠিক সেটাই হয়েছে।মনির সবকিছু স্বীকার করেছে এবং জেলে আছে।আর বাকী দু’জনকেও ধরে ফেলবে।”
-“কী?আপনি সত্যি বলছেন।আচ্ছা বাকী দু’জন কে ছিলো সেই ব্যাপারে কিছু বলেছে?”
আবরার ওকে ঠিক করে শুয়ে দিয়ে বলে,
-“হ্যাঁ,বলেছে।কিন্তু উত্তেজিত হবেনা তুমি,এই সময় এগুলো ভালো নয়।”
-“আপনি বলুন না….”
-“বাকী দু’জন তোমার আপন চাচারা।”
-“ক..কী বলছেন আপনি?”
ইয়ারাবী অনেকটা অবাক হয়ে কথাটা বলে উঠে।আবরার ওকে দু’হাত দ্বারা শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলে,
-“হ্যাঁ,এটাই সত্যি।উনারা কখনো তোমার বোনকে পছন্দ করতেন না।যখন তোমার দাদা তোমার বোনের নামে সম্পত্তি দেন তখন উনারা হিংসায় জ্বলে উঠে।আর এদিকে মনির তোমার বাবার অফিস থেকে টাকা গায়েব করতো সেই ব্যাপারে তোমার বোন অবজ্ঞত হয়ে যায়।দু’পক্ষ এক সাথে হাত করে মেরে দেয় ওকে।”
-“সামান্য টাকার জন্য ওরা আপুকে….আ আচ্ছা ইলা আপুকে কেন…”
আবরার ওকে সম্পূর্ন কথা বলতে না দিয়ে নিজেই বলে,
-“ইলার সাথে ওদের কোনো শত্রুতা ছিলোনা।ওরা চিনতোও না ইলাকে।ওইদিন তোমার আপু যখন সাহায্যের জন্য চিৎকার করছিলো তখন তোমার আপুকে বাঁচানোর জন্য ইলা ওখানে গেছিলো।ইলা বরাবরই সাহসী মেয়ে ছিলো,লেখাপড়া শেষ করে বিমানবাহিনীতে যোগ দিতে চেয়েছিলো।”
আবরারের কথা বলার সময় চোখের কোনা থেকে জল গড়িয়ে পড়ার মতো অবস্থা।হতে পারে খুব গভীর আঘাত পেয়েছে,হতেই পারে ইলা ওর কাছের মানুষ ছিলো।যার জন্য আঘাতটা আরো গভীর।ইয়ারাবী প্রায়ই খেয়াল করেছে,আবরার যখন ইলার ব্যাপারে কথা বলতে যায় তখন খুব গভীর এক টান প্রকাশ পায় ওর প্রতি।আচ্ছা ওকী ইলাকে ভালোবাসতো?যার জন্য এতটা কষ্ট পায়।ইয়ারাবী নানান কথা চিন্তা করছে নিজের মনের মধ্যে।আবরার হেসে ওর কপালে একটা চুমু দিয়ে বলে,
-“পাগলি ইলা আমার বড় বোন ছিলো।তবে ছোটবেলা থেকে নাম ধরে ডাকতাম তাই কখনো আপু বলা হয়নি আর ও নিজেও আপু ডাকা পছন্দ করতোনা।তাই গোয়েন্দা বৌয়ের ক্যারেক্টার থেকে শুধু বৌ হয়ে বেড়িয়ে এসো।”
-“আপনি জানলেন কী করে?”
-“মেয়েদের মনে কী চলে একটু হলেও বোঝা যায় আর সেটা যদি বৌ হয় তবে কথায় নেই।”
-“আপনি এতটা পার্ফেক্ট কেন?”
-“কোনো মানুষ পার্ফেক্ট হয়না,আমার মধ্যেও প্রচুর খুঁত আছে।যা আস্তে আস্তে জানতে পারবে।তোমার মনে একটা প্রশ্ন সব সময় আসে সেটা হলো,আমি কেন তোমার জন্য এই সব করি তাইতো?কেন স্বামী হওয়া সত্ত্বেও বাকী সবার থেকে আলাদা?”
ইয়ারাবী অবাক চোখে ওর দিকে তাকিয়ে বলে,
-“হ্যাঁ,কিন্তু কখনো বলা হয়না।”
-“তাহলে শোনো,আমার বাবারা মোট দু’ভাই তিন বোন ছিলো।লিসা ফুপি সবার ছোট নয় বরং তার ছোট আরো একজন ছিলো,তার নাম হলো স্নেহা।ফুপিরও ঠিক তোমার বয়সে আমার বয়সের একজনের সাথে বিয়ে হয়ে যায়।সাধারন ভাবেই ওনার স্বামী ওনার সাথে বন্ধুর মতো নয় বরং স্বামীর মতো আচারন করতো।ফুপিকে টাকার সময় টাকা,গিফ্টের সময় গিফ্ট এক কথায় যা যখন প্রয়োজন তখন পেতো তবে কমতি ছিলো একটা জিনিসের।আর সেটা হলো ভালোবাসার।উনার স্বামী কখনো বুঝতে চাইতেন না ফুপির মনের অবস্থা,তার হক সে আদায় করে নিতো।একবার ফুপির প্রচুর জ্বর হয়েছিলো,কিন্তু শ্বশুড়বাড়িতে শুয়ে থাকলে তো আর হয়না।সকাল থেকে রাত পর্যন্ত এটা-সেটা করেই যেতো,আর রাতের দিকে উনার স্বামীর স্বীকার।জ্বর যখন প্রবল আকার ধারন করলো তখন উনাকে ডাক্তারের কাছে না নিয়ে যেয়ে সাধারন ঔষুধ খেতে দেয়,সেই ঔষুধেও কাজ না করেনা।অবস্থা বেগতিক দেখে উনারা ফুপিকে হাসপাতালে ভর্তি করে।আমরা এসব কিছুই জানতাম না,ফুপি মারা যাওয়ার সাত ঘন্টা আগে আমাদের কাছে নার্সের নাম্বার দিয়ে লুকিয়ে ফোন করে ফুপি।কেননা উনার শ্বশুড়বাড়ির কেউ চাইতো না ব্যাপারটা জানুক কেউ।কোনোদিন ফুপি ওই লোকদের অন্যায়ের ব্যাপারে বাড়িতে প্রতিবাদ করেনি বরং মুখ বুজে সহ্য করে নিতো।একবার যদি মুখ ফুটে বলতো তবে এই দিন দেখতে হতোনা।”
-“কী হয়েছিলো?”
আবরার একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবার বলতে শুরু করে,
-“ওইদিন হাসপাতালে যাওয়ার পর ফুপি সবাইকে সত্যি কথা জানিয়ে দেয়।প্রতিটা অন্যায়ের কথা বলে,কিন্তু বড্ডো দেরি হয়ে গেছিলো।হয়তো উনি জানতেন উনার সময় শেষ তাই হয়তো সত্যটা প্রকাশ করে যান।দাদু ওদের বিরুদ্ধে কেস করলে ওরা সহপরিবার মিলে এমন ভাবে গায়েব হয়ে যায় যে পাওয়া যায়না।ফুপি খুব ভালো মানুষ ছিলেন,সব চেয়ে বড় কথা কী জানো যখন ফুপি মারা যায় তখন উনার পেটে একমাসের বাচ্চা ছিলো।
ওইদিনের পরে দাদু আমাদের বলেছিলো কখনো, নিজের স্ত্রীর সাথে অন্যায়ের আচারন করবেনা না।কেননা নারীরা মায়ের জাত।তাদের স্থায়ী ঘর হয়না,ছেলেদের থেকে ওদের বেশি কষ্ট।মেয়েরা বিয়ের পর স্বামী নামক শক্ত খুঁটির হাত ধরে অচেনা শ্বশুড়বাড়িতে পা রাখে।যখন পুরো দুনিয়া স্ত্রীর প্রতি অবিচার করে তখন স্বামীর উচিত তার পাশে ঢাল হয়ে দাঁড়ানো।স্ত্রীকে সাথে বিরুপ আচারন করবেনা,কেননা সে তোমার সন্তানের মা।
তাছাড়া ইসলামে স্ত্রীর প্রতি স্বামীর দশটি কর্তব্য আছে,১)স্ত্রীর ভরন-পোষণ করা,২)শারীরিক চাহিদা পূরন,৩)স্ত্রীর কথায় মর্যাদা দেয়া,৪)স্ত্রীর পিতা-মাতাকে সসম্মান করা,৫)স্ত্রীকে আঘাত কিংবা মারধর না করা,৬)ধর্মীয় বিধি-বিধান পালনে উৎসাহ প্রদান,৭)স্ত্রীর গোপন কিছু অন্যের কাছে প্রকাশ না করা,৮)কৃতজ্ঞতা এবং প্রশংসা,৯)স্ত্রীকে নিয়ে ঘুরতে যাওয়া বা সময় ব্যয় করা,১০)হাসি মুখে কথা বলা
এইগুলো হাদিস ভুলে গেছি,অন্য সময় বলবো তোমাকে।তাছাড়া মহানবী(সাঃ) নিজেও বলেছেন,স্ত্রীর সাথে ভালো আচারন করতে।তুমি জানো যারা স্ত্রীদের সাথে বাজে আচারন করে তারা পরকালে কঠিন শাস্তি পাবে।আমি ইহকালে আল্লাহ ব্যতিত কাউকে ভয় পায় তবে পরকালকে ভয় করে।”
-“আপনার ফুপির জন্য খারাপ লাগছে।”
-“যিনি গেছেন উনি তো আর ফিরে আসবেনা।”
-“উনার কোনো ছবি আছে?”
-“ছিলো তবে পুরিয়ে ফেলা হয়েছে।উনি নিজেই বলেছিলেন,উনার মৃত্যুর পর যেন পুড়িয়ে ফেলি।দেখো কথা বলতে বলতে অনেক সময় পার হয়ে গেছো।এখন ঘুমাও,রাতে তো ঘুমাও না।”
ইয়ারাবী অবাক চোখে অাবরারের দিকে তাকিয়ে আছে।এই মানুষটা সম্পূর্ন ব্যাতিক্রম,একটু আগে এতটা কষ্টের মধ্যে ছিলো কিন্তু এখন দেখলে মনে হচ্ছে কিছুই হয়নি।আসলে হাতের পাঁচ আঙ্গুল যেমন সমান হয়না তেমন সব পুরুষেরা এক হয়না।
(১৬৪)
মি.ফুয়াদ চেয়ারে বসে হাত দিয়ে কপাল ঢেকে রেখেছেন।হয়তো তার কথাগুলো বিশ্বাস করতে খুব কষ্ট হচ্ছে।কাছের মানুষের দ্বারা ধোঁকা পেয়েছেন তবে এমন ধোঁকা কখনো পাননি।এই পৃথিবীতে অনেক লোক আছেন যারা আপনার যত্ন করে, আপনার কেবল তাদের খুঁজে বের করা দরকার।কিন্তু মি.ফুয়াদের বেলায় যারা উনাকে ধোঁকা দেয় তাদের শুধু খুঁজে পায়।
মিসেস ইশানি স্বামীর সামনের প্লেটে খাবার বেড়ে দিয়ে পাশে বসে বলে,
-“ইয়ারাবী একটা কথা বলতো-“একটি সময় আসে যখন আপনাকে পৃষ্ঠাটি ঘুরিয়ে দেওয়ার এবং বইটি বন্ধ করার মধ্যে বেছে নিতে হবে।”ওর কথাটা আজ ফলে গেলে।”
-“মেয়েটাকে শুধু অবজ্ঞা করেছি কখনো ভালোবেসে কাছে টানতে পারিনি পাঁচটা বছর।ওর কথাগুলো যদি একটু হলেও বিশ্বাস করতাম তবে আজকে এই দিন দেখতে হতোনা।”
-“পাপী তো আমি,আমিতো ওর মা হওয়ার যোগ্যতা রাখিনা।প্রতিটা মুহুর্তে ওকে ধিক্কার জানিয়েছি।কেউ যদি ওর সাথে খারাপ কিছু করতো তবে আমরা ওকে আদর না করে তাকে সাপোর্ট করতাম।ও বলেছিলো ফাতিনরা সুবিধার নয়,ওর খারাপ কিছু করতে চাই।কথাটা শুনে তুমি উল্টো মেরেছিলে মেয়েটাকে।তারপর থেকে তো তোমাকে ভয় পেত।”
-“আজ ভয়গুলো ঘৃণায় পরিনত হয়েছে।”
মিসেস ইশানি মেয়ের দিকে ভাজির বাটি এগিয়ে দিয়ে স্বামীকে উদ্দেশ্য করে বলেন,
-“ওরা কী বললো?”
-“তৌফিক কল দিয়ে কিছু নীতিকথা শুনাচ্ছিলো।”
-“কী কথা?”
মি.ফুয়াদ স্ত্রীকে সবটা খুলে বলেন।
আসলে সন্ধ্যায় যখন মি.ফুয়াদ ঘরে বসে ছিলেন তখন উনার ফোনে তৌফিক কল দেয়।উনি অবশ্যই কল দেখে আন্দাজ করতে পেরেছিলেন কী বলবে তবুও কলটা রিসিভ করে বলেন,
-“কী বলবি দ্রুত বল তৌফিক?”
-“চাচা,বাবা আর ছোট চাচাকে বাজার থেকে পুলিশে ধরে নিয়ে গেছে ইস্মিতার খুনের জন্য।”
-“তো আমি কী করতে পারি?”
-“আপনি কী করতে পারেন মানে?উনাদের বের করার ব্যবস্থা করুন।এসব ফালতু ঝামেলায় উনাদের জড়াবেন না।”
-“আমি কীভাবে বেড় করবো?তোর বাপেরা খুনির দায়ে ফেঁসেছে,চুরির দায়ে নয় যে চাইলাম আর বের করা গেলো।”
তৌফিক কিছু বলতে যাবে তার আগে ফাতিনের স্ত্রী জমিলা ফোনটা কেড়ে বলেন,
-“ভাইজান,আপনার ভাইদের বের করুন?”
-“দুঃখীত আমার পক্ষে সম্ভব নয়।”
-“ওই আপনি কী বললেন?আপনার পালিত মেয়ের জন্য আমাদের স্বামীরা জেলে থাকবে?”
মি.ফুয়াদ উত্তেজিত হয়ে বলেন,
-“বাজে কথা বলবেনা,সারা জীবন অপরাধ করেছে আর আমি ছাড়িয়েছি বলে হাতির পাঁচ পা দেখেছে।জেলে পঁচে ভুগবে তখন বুঝবে অন্যায়ের শাস্তি কী?”
-“কী সব বলছেন আপনি?ওরা কোনো অন্যায় করেনি।”
-“তোমাদের ছেলেগুলোও তো বাপের মতো হয়েছে।আসলে রক্ত কথা বলে,বাপের আদর্শ বলে কথা।”
-“ফালতু কথা বাদ দেন ভাইজান।দোহায় লাগে উনাদের বের করার ব্যবস্থা করুন।নয়তো গ্রামের মানুষ ছিঃ ছিঃ করবে।”
-“করবেই তো আমার মেয়েকে খুন করেছে তার শাস্তি পাবেনা।খুনের কথা তোমরাও জানতে তবে লুকিয়েছো,উচিত তোমাদেরও পুলিশে দেওয়া।”
জমিলা সুর তুলে ন্যাকা কান্না করতে করতে বলে,
-“ভাইজান,পরের মেয়ের জন্য নিজের আপন ভাইদের শাস্তি দেওয়াটা কেমন হয়ে যায়না।ও কী আপনার নিজের রক্ত ছিলো?ওরা নাই ভুলটা করে ফেলেছে….”
-“ব্যস অনেক বলেছো।সব সম্পর্ক রক্ত দ্বারা বিবেচনা করলে পৃথিবী চলতো না।আর কারা রক্তের সম্পর্ক দেখিয়ে দিয়েছে।আর ভুল?ওরা কী ছোট বাচ্চা যে ভুল করবে?জ্যান্ত মানুষতে সুস্থ মস্তিষ্কে খুন করেছে আর বলছো ভুল, ব্যাপারটা কেমন ঘোলাটে হয়ে গেলো না।দেখো জমিলা,তুমি বাড়ির বৌ,তাই তোমাকে অসম্মান করার ইচ্ছা আমার নেই।তোমার কথা শুনে মুখে তো অনেক কথায় উঠে আসে কিন্তু বলতে চাইনা।এরপরে আমাকে কোনো অন্যায় কাজকে প্রশ্রয় দেওয়ার জন্য ফোন করবেনা।
মিসেস ইশানি স্বামীর দিকে তাকিয়ে বলেন,
-“কী করবে তুমি?”
-“এবার আর ভুল করবোনা।”
-“ফুয়াদ মেয়েটার সাথে একবার কথা বলবো।”
-“মনে হয় তোমার সাথে বলবে?”
-“তুমি আবরারকে কল দাও,ওকে বুঝিয়ে বললে…”
-“কাল একবার সরাসরি নাই মেয়ে দেখবো।”
-“কাল দেখবো কিন্তু আজ একটা ফোন করে ক্ষমাটুকু চেয়ে নিবো।মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসেছে আর তাকে আমি।”
মি.ফুয়াদ ইয়ামিলাকে ঘর থেকে ফোনটা আনতে বললে ইয়ামিলা দৌঁড়ে ফোন নিয়ে আসে।মি.ফুয়াদ জানেন ওনার মেয়ে নাম্বার ব্লক করে রেখেছে তাই জামাইরের নাম্বারের কল করেন।
আবরার কেবল ডিনার শেষ করে রুমে ঢুকেছে তখনি ওর ফোন বেজে উঠে।ও টেবিল থেকে ফোনটা উঠিয়ে দেখে ওর শ্বশুড় ফোন করেছে।ও একবার ইয়ারাবীর ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকিয়ে ফোনটা রিসিভ করে বেলকনিতে যায়।
মি.ফুয়াদ ফোনটা রিসিভ করার সাথে সাথে সালাম দিয়ে বলে উঠে,
-“কেমন আছো বাবা?”
-“জ্বি,আল্লাহর রহমতে ভালোই আছি।”
-“ইস্মা…”
-“জ্বি,সুস্থ আছে কিছুটা।”
-“বলছি তোমার শ্বাশুড়ি ওর সাথে একটু কথা বলবে।আসলে মেয়েটা আমার সাথে কথা বলবেনা,তাই…”
আবরার কিছুটা নিঃশব্দে মৃদু হেসে বলে,
-“আসলে আব্বু,ওকে স্যালাইন দেওয়া হয়েছে ঘুমাচ্ছে এখন।আর আপনি বুঝতেই পারছেন ওকে জাগানো ঠিক হবেনা।তাছাড়া এই অবস্থায় ফোনে কথা বলা সম্ভব নয় ওর পক্ষে,সমস্যা হবে।”
-“হ্যাঁ,সেটা তো জানি।”
-“আপনারা নাই এসে একবার দেখা করে যান।কখনো আসেননি এখানে।”
-“কাল আসবো বাবা মেয়েটাকে একবার দেখতে।”
-“জ্বি অবশ্যই।”
-“তাহলে এখন রাখি,আল্লাহ হাফেজ।”
আবরার অপরপাশ থেকে ফোনটা কেঁটে দিলে মিসেস ইশানি স্বামীর দিকে তাকিয়ে বলেন,
-“মেয়ে বুঝি কথা বলবেনা।”
-“না,ইস্মা মা ঘুমাচ্ছে,আর ফোনে কথা বলা এলাউ না ওর।”
-“ও কী খুব বেশি অসুস্থ?”
-“আবরার বললো ঠিক আছে।”
-“একবার মেঘকে ফোন করবে,ওর কাছ থেকে খবরটা নাও।”
-“মাথা খারাপ তোমার,এতে যদি কিছু মনে করে।”
-“তাও ঠিক।আচ্ছা কাল একবার যেয়ে দেখে আসবো মেয়েকে।”
ইয়ামিলা তো খুব আনন্দ পাচ্ছে যে বোনকে কাল দেখতে যাবে।অপারেশনের পরে আর দেখতে যেতে পারেনি,গল্পও করতে পারেনি।ও দৌঁড়ে ঘরে যেয়ে আলনা থেকে একটা একটা কাপড় বের করছে যে কাল কোনটা পরবে।আসলে কথায় আছেনা,তাদের সাথে থাকুন যারা জেনে থাকে যে তারা যখন আপনার কাছে রয়েছে ঠিক কী আছে পেয়েছে।এমন কেউ নয় যে,যখন তারা আপনাকে হারিয়ে ফেলবে তখন উপলব্ধি করবে যে ঠিক কী হারিয়ে ফেলেছে।আসলে ইয়ামিলার ক্ষেত্রে ঠিক সেটাই হয়েছে।বোনের থেকে দূরে থেকে শূন্যতা অনুভব করছে।
(১৬৫)
সকাল ছাড়ে ছয়টা বাজে,আজ অনেকদিন পর অনু বাসার ছাদে উঠেছে।বলতে গেলে এখানে তেমন একটা আসা হয়না।একটা বিড়ালের বাচ্চাকে কোলে নিয়ে ছাদের কর্নার ধরে হাঁটতে থাকলো।হঠাৎ একটা অপরিচিত মেয়ে কন্ঠ ওর কাধে হাত রেখে বলে উঠলো,
-“তুমি তিন তালার সেই মেয়েটা না?”
-“জ্বি আন্টি তিন তালাতে আমিই থাকি।”
-“একা থাকো বুঝি,কোনো দিন তো তোমার বাবা-মার দেখলাম না।”
-“জ্বি একাই থাকি।মা-বাবা রংপুরে থাকে,আমি হোস্টেলে থাকতে পারিনা তাই এখানে থাকি।”
-“ওহ্হ্,কী নিয়ে পড়াশোনা করো?”
-“আইন বিভাগে,কিন্তু আপনি কে?”
-“আমি তোমাদের উপরের তলায় থাকি।”
মহিলাটি বেশ কিছুক্ষণ অনুর সাথে কথা বলে ছাদে কাপড় নেড়ে চলে যায়।এদিকে অনুর ফোনে একটা আননোন নাম্বার থেকে কল আসে।অনু নাম্বারটার দিকে একবার তাকিয়ে রিসিভ করার সাথে সাথে বলে,
-“কেমন আছো?চিনতে পারছো আমাকে?”
-“কে আপনি?”
-“যাহ্,এর মধ্যে ভুলেও গেলে আমি কে?”
-“দেখুন ফালতু কথা বলার সময় নেই আমার হাতে।”
কথাটা বলে অনু রেগে ফোনটা কেঁটে দেয়।প্রায় এমন কল আসে মানুষের কাছে,বিশেষ করে এসব কলার ব্যাক্তি যদি মেয়ে কন্ঠ পায় তবে তাকে জ্বালাতে থাকে প্রতিনিয়ত।অনু এসব লোকদের একদম সহ্য করতে পারেনা।ও ফোনটা রেলিং এর উপর রাখতেই আরেকটা ফোন আসে।বিরক্তি নিয়ে ফোনটা উঠিয়ে দেখে মেঘ ফোন করেছে।মুখের বিরক্তি ভাবটা কাঁটিয়ে ঠোঁটের কোনে এক চিলতে হাসি নিয়ে বলে,
-“কীরে ঘুমন্ত কুমার,এত সকাল সকাল ফোন করলি যে?”
-“দেখ ঘুমন্ত কুমার বলবিনা।তোর ভাগ্য ভালো যে আমি ফোন করেছি।”
অনু কিছুটা আল্লাদের সুরে বলে,
-“উলে বাবা লে,বাবু লাগ কলেছে।”
-“শাতচুন্নীর বাচ্চা….”
-“চুপ,খবরদার শাতচুন্নী বলবিনা।”
-“বাহ্ রে,তুই বললে কিছুনা আমি বললে দোষ।”
-“ওই থাম,আমিও বলছিনা তুই ও বলবিনা।এখন বল,ইয়ু কেমন আছে?ওর সাথে তো ফোনে কথা হচ্ছেনা।আর কাজের চাপে দেখাও করতে পারছিনা।”
-“ঠিক আছে,তবে মাঝে মাঝে বেশি দুর্বল হয়ে পরছে।ত্যাড়ামি করে নার্সকে তাড়িয়েছে…”
-“কী?আর জিজু ওরে এমনি এমনি ছেড়ে দিলো।”
-“ছোট ভাইয়া কী করবে বল?ওর এই অবস্থায় রাগ করতেও পারছেনা,যা বলছে ভাইয়াকে সেটাই মানতে হচ্ছে।আর ও সেটার ফায়দা লুটছে।”
অনু কথাটা শুনে হাসতে হাসতে বলে,
-“ইয়ারাবী সম্পূর্নরুপে ব্যাক করছে।”
-“মানে?”
-“তুমি তো জানোনা চাদু,ও কেমন মেয়ে?”
-“যাই হোক তাড়াতাড়ি ঠিক হয়ে যায় সেই দোয়াই করি।”
-“হুম,আচ্ছা ফোন কেন করছিলি?”
-“ও হ্যাঁ,শোন আজ ক্লাস আছে আসবি।”
-“হ্যাঁ,যেতে তো হবেই।আর কাজও আছে,সবাইকে আসতে বলছিস।”
-“ইয়ারাবী বাদে সবাই আসবে।”
অনু বেশ কিছুক্ষণ কথা বলে নিজের ঘরের দিকে পা বাড়াই।ঘরে ঢুকে টফিকে কোল থেকে নামিয়ে হাত ধুয়ে কিচেনে যেয়ে ইলিশ মাছ ভাজা আর সাদা ভাত চুলায় চড়িয়ে দেয়।
#চলবে_____