জীবন মানে তুমি পর্ব-৪৭

0
3870

#জীবন মানে তুমি
#লেখিকা:H.B.Rini (Irini Ori)
#পর্ব:৪৭

(১৬০)

-“বাস্তবা বড় কঠিন,কারোর পক্ষে বাস্তবকে মেনে নেওয়া সহজ হয়না যদি সেটা তোমার ক্ষতির কারন হয়ে দাঁড়ায়।উচ্চাকাঙ্ক্ষা মানুষগুলো তৃষ্ণার্ত কাকের মতো বিলাসিতার পিছু পিছু ছোটে।কিন্তু কী জানিস?তাদের এই লোভ তাদের কাল হয়ে দাঁড়ায়।একটা প্রবাদ বাক্য আছে-“লো‌ভে পাপ,পা‌পে মৃত্যু”।মানে লোভী‌দের সেটাই অদৃষ্ট।”

য়ুহার কথাগুলো বলে টি-টেবিলের উপর থেকে চায়ের কাপটা হাতে তুলে নিয়ে চুমুক দেয়।আদা দেওয়া চা য়ুহারের বরাবরই খুব পছন্দের।অনেকটা তৃপ্তি সহকারে চা পান করে সামনে বসা জারিকার দিকে তাকায়।আগের থেকেও অনেকটা করুন অবস্থা হয়েছে জারিকার।আজ তিন দিন হলো জারিকা জেল থেকে ছাড়া পেয়েছে।ছাড়া পেয়েছে বললে ভুল হবে,তাকে বের করে আনা হয়েছে।অবশ্য সেটা ইয়ারাবীর কথায়,নয়তো কখনই ও বাইরে বের হতে পারতোনা।কেননা যে কেসে আবরার ওকে ফাঁসিয়ে ছিলো তাতে তার উপযুক্ত শাস্তি হতো।

অপারেশনের একদিন পরে সমীর ইয়ারাবীর কাছে ছুটে গেছিলো জারিকাকে জেল থেকে বের করার জন্য।প্রথমে মানতে নারাজ,পরে ছোট বাচ্চা নিরার জন্য আবরার আর ইফাজকে মানিয়ে দেয়।কিন্তু ও কীভাবে জানতো ওর জন্য এত বড় সারপ্রাইজ অপেক্ষা করছে।অবশ্য সারপ্রাইজটার জন্য জারিকা যতটা অবাক হয়নি তার থেকে বেশি ইয়ারাবী হয়েছে।সমীরের কথা শুনে ওরা কেসটা তুলে নেওয়ার পরপরই সমীর জারিকাকে ডিভোর্স দেয় এবং মেয়ে কেও নিজের কাছে রাখে।অবশ্য, মেয়েটা মায়ের থেকে বাবা বলতে পাগল বেশি।সবাই যখন অনুরোধ করে ডিভোর্স না দিতে তখন সমীর শুধু একটা কথাই বলে,
-“আপনার মেয়েকে আমাকে দিয়ে হয়না,তাহলে আমাকে কেন রাখতে চাইছেন।যার কাছে গেলে ভালো থাকবে তার কাছেই থাকুক।তাছাড়া আমি চাইনা আমার মেয়েটাও ওর মতো নোংরা মনের মানুষ হোক।ওর চিন্তা-চেতনা সবটা জুড়েই শুধু নোংরামি,ওর সেই কালো নোংরা ছায়ার মাঝে আমি আমার মেয়েকে বড় করতে পারবোনা।
আর জারিকা,আজ যেটাকে অবজ্ঞা করে পায়ে ঠেলে দিয়েছো সেটার জন্যই সারা জনম ধরে কাঁদবে।কাউকে কাঁদিয়ে সুখে থাকা যায়না,তুমিও কাঁদবে আর আমি সেই দিনটার অপেক্ষা করবো।”

জারিকা কথাগুলো ভাবছিলো,য়ুহান চায়ে দ্বিতীয় চুমুক দিয়ে বলে উঠে,
-“এখন ভেবে লাভ হবে কী?যা গেছে সেটা পাওয়া সম্ভব নয়।নিজেকে বদলে ফেল….”
-“তুমি আজ ওই বাসায় যাবে।”

জারিকা অনেকটা উৎসুক হয়ে কথাটা বলে উঠে।য়ুহার চায়ের কাপটা রেখে দুই ভ্রু সংযুক্ত করে বলে,
-“কোন বাসা?”
-“না মানে ইয়ারাবীকে দেখতে যাবে।ওকে তো বাসায় নিয়ে আসা হয়েছে।”
-“হ্যাঁ,যাবো।শৈলও যেতে চেয়েছে,ওর জন্য অপেক্ষা।”
-“বাবার বাড়ি নাকী শ্বশুড়বাড়ি?”
-“শ্বশুড়বাড়ি,আবরার ওকে কোথাও রাখেনি।তুই এতো জানতে চাইছিস কেন?”

জারিকা অনেকটা অপরাধীর মতো মুখ করে বলে,
-“ক্ষমা চাইবো।”

য়ুহার কিছুটা বিদ্রুপ করে বলে,
-“ক্ষমা আর তুই?বিশ্বাস করাটা খুব কষ্টের। কোনো প্রশ্নই উঠেনা তোকে সাথে নিয়ে যাওয়ার।”
-“জানি ক্ষমা চাওয়ার মুখ নেই,তবে এই কয়দিন ধরে ভেবেছি,আসলে যা করেছি সব ভুল।”
-“মৃত্যু ঘনিয়ে আসলে সবাই ভুলটা বুঝতে পারে।”
-“আমি আসি আপু,নিরার স্কুল ছুটি দিবে।”

যুহার ওর কথা শুনে কিছুটা প্রশ্নসুচক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে,
-“নিরা তো সমীরের সাথে থাকে।আর তোকে তো…”
-“দূর থেকে দেখি।হাজার হলেও মা তো…”
-“অন্যায় করার আগে মনে ছিলোনা।সবটাই ঠিক হয়ে যাচ্ছিলো,তাহলে মাঝে কেন আবার সুঁচ হয়ে ঢুকতে গেলি।ওটা ওদের পারিবারিক বিষয়, তোকে কেউ তো বলেনি তুই ওকে জানা বিষয়টা।আর তোর সাথে সাথে সবাই সত্যিটা জেনে গেল।”
-“মাফ করে দাও আপু…”
-“জানিস একটা মেয়ের কাছে মা হওয়া কতটা সুখের।তোর থেকে কেবল পাঁচটা দিন নিরা দূরে তাই তোর মনটা পুরছে ওর জন্য।আর ওতো মা হতে পারবেনা তার বেলা।তুই এমন এমন জঘন্য কাজ করিস যার দ্বারা তোর সাথে কথা বলতে পর্যন্ত ইচ্ছা করছেনা।সত্যি কথা এটাই তোকে আমার এখনো সহ্য হচ্ছেনা,তবে কী করবো বল?হাজার হলেও রক্তের সম্পর্ক,যার বাঁধন ছিন্ন করা খুব কঠিন।”
-“জানি,সবাই ঘৃনা করে।তবুও….”

য়ুহার কিছুটা বিরক্তির সহিত বলে উঠলো,
-“তোকে যদি ইয়ারাবীর সাথে দেখা করাই তবে আমিও কোনোদিন ওই বাড়িতে পা রাখতে পারবোনা।তোকে এখন যারা একটু কটু কথা শুনাচ্ছে দু’দিন পরে তারা মাথায় উঠাবে।কিন্তু ওই মেয়ের স্বামী শ্বশুড়বাড়ি ছাড়া এইদিকে হাতেগুনা কয়েকজন আছে।যদি এটাও বন্ধ হয়ে যায় তবে….”
-“না থাক আপু তোমার দরকার নেই।মৃত্যুর আগে কোনো এক সময় চেয়ে নিবো ক্ষমা।আমি আসি আজ….”

জারিকা য়ুহারের সামনে থেকে উঠে কালো বোরখাটা পরে নিয়ে সাদা একটা ওড়না দিয়ে মুখটা ঢেকে নেয়।তারপর রং চটা একটা স্বল্প মুল্যের হ্যান্ডব্যাগ নিয়ে মিসেস অচলাকে বিদায় জানিয়ে বেড়িয়ে পরে।য়ুহার ওর যাওয়ার দিকে তাকিয়ে হাসতে থাকে।কী ছিলো একটা সময় আর কী হয়ে গেল?কখনো দামী কাপড় ছাড়া বাসা থেকে বের হতো না সেই মেয়ে আজ কমদামী বোরখা,পুরানো ওড়না গায়ে জড়িয়েছে।মিসেস অচলা মেয়ের সামনে থেকে চায়ের কাপগুলো নিতে নিতে বলেন,
-“আম্মু এভাবে কথা না বললে কী হতোনা?”

য়ুহার হেসে ওর মায়ের দিকে তাকিয়ে বলে,
-“যে যেমন তার সাথে ঠিক সেটাই হওয়া উচিত।”
-“তবুও মানুষের মনে কষ্ট দিতে নেই।”
-“আর ও যা করেছে সেটা কম কীসে?শুধু এমন না ও শুধু ইয়ারাবীর ক্ষতি করার চেষ্টা করেছে।ওর কারো সুখ কোনোদিন সহ্য হতো না।”
-“মেয়েটার কাছে একবার নিয়ে যেতে ক্ষমা চেয়ে আসতো।”
-“মা তুমিও না খুব বোকা।ওকে কখনো ইয়ারাবীর সামনে নিয়ে যাওয়া যাবেনা।আবরারের কড়া মানা আছে।তুমি জানো যদি ও যায় পরিস্থিতি কেমন হবে?”

মিসেস অচলা ওর মেয়ের দিকে তাকিয়ে বলে,
-“আমি চাইনা কারো ক্ষতি হোক।সবাই সুখে থাকুক সেটাই চায়।আচ্ছা শৈল কখন আসবে?”
-“সময় হলে চলে আসবে।তুমি যাবে?”
-“আজ যাবোনা কাল একবার দেখে আসবো মেয়েটাকে।তুমি বসো,আমি পাকোড়া নিয়ে আসি।”

মিসেস অচলা চলে যাবে এমন সময় কী মনে করে আবার বলে উঠলেন,
-“আচ্ছা আম্মু তোমার ঘরে কিছু ঔষুধের পাতা পেলাম।আমিতো বেশি লেখাপড়া যানিনা তাই বুঝিনি কীসের ঔষুধ?তোমার কী কিছু হয়েছে?”

য়ুহার ওর মায়ের কথা শুনে কিছুটা ইতস্ততভাবে বলে,
-“আসলে মা,ওইগুলো এমনি রেখেছি।অনেক সময় কত জিনিস কত কাজে লাগে।তুমি যাওতো পাকোড়া নিয়ে আসো।নিলয়কে আলুর চপ খেতে দেখছিলাম,ওইটাও আনবে।”
-“কিন্তু ওইগুলো তো নিলয়ের আম্মু,আমি তোমার গরম গরম বানিয়ে দেয়।”
-“উহু,ওই বাদরেরগুলো খাবো।তুমি ওইগুলো আনবে।”
-“আনছি,কিন্তু একটু পর যেনো ইদুর-বিড়াল যুদ্ধ না চলে।”

য়ুহার ওর মায়ের কথা শুনে কিছু না বলে হাসতে হাসতে রুমের দিকে পা বাড়ায়।আজকাল য়ুহারের মনটা খুব ভালোই ফুরফুরে লাগছে,কেন সেটা তার জানা নেই।তবে শৈলের সাথে সময় কাটাতে তার বেশ ভালোই লাগে,হতে পারে স্বামী সেই জন্য ।

অনেক্ষণ ধরে বইয়ের তাকের সামনে দাঁড়িয়ে পড়ার উপযুক্ত একটা বই খুঁজে চলেছে।অবশ্য সব বই পড়ার মতো তবে সবচেয়ে মনকাড়া বইটা খুঁজে চলেছে।হঠাৎ করে চোখ যায় তাকের কর্নারের দিকে।হাসি মুখে বইটা হাত বাড়িয়ে নেয়।
কাজী নজরুল ইসলামের শ্রেষ্ট সৃষ্টির মধ্যে পাঠকদের মন ছুঁয়ে যাওয়া একটি উপন্যাস ‘কুহেলিকা’। কুহেলিকা’র মূল চরিত্র “জাহাঙ্গির”কে নিয়ে,পার্শ্ব চরিত্র আরো থাকলেও য়ুহারের মন ছুঁয়ে যায় এই চরিত্রটায়।ওকে সবচেয়ে ভাবায়, জাহাঙ্গিরের জন্ম সংক্রান্ত বিদ্রোহের বর্ণনা,আর ভালোও লাগে প্রচুর। বন্ধু হারুণের সাথে হারুণের বাড়ীর দিকে যাত্রা। হারুণের পাগলী মায়ের অদ্ভুত আচরণের তো তুলনা নেই। তাঁর অন্ধ পিতা, খোন্দকার সাহেব সহ তাঁর দুই বোনের চরিত্র, সাথে উপন্যাসের সংলাপ গুলো গভীর মনস্তাত্বি ভাব বহন করে।প্রতিটা চরিত্র,সংলাপ য়ুহারের মুখস্ত তবুও এই বইটার প্রতি বেশি আকর্ষন।

য়ুহার বইটা নিয়ে বিছানার উপর বসে পড়তে শুরু করে।প্রায় আধাঘন্টা পরে ওর রুমের দরজায় ‘খট’ করে একটা আওয়াজ হয়।অর্থাৎ কেউ ঘরে প্রবেশ করেছে।য়ুহার ওর মাকে মনে করে বলে উঠে,
-“মা এতক্ষণ লাগে খাবার আনতে।তোমার বাদর ছেলেকে মোবাইল রেখে পড়তে বসতে বলো।আর দেখো তোমাদের গুনধর জামাইয়ের,স্যারের এখনো আসার নাম নেই।হয়েছে একটা অলস,অকর্মার ঢেকি।নিজে লেট লতিফ তাহলে শিক্ষার্থীদের কী শিখায় আল্লাহ ভালো জানে।”

-“ওহ্ তো জামাই লেট লতিফ,অকর্মা,অলস।”

য়ুহার মায়ের পরিবর্তে পুরুষালী আওয়াজ শুনে সামনে তাকিয়ে দেখে শৈল একটা সবুজ রঙের টি-শার্ট আর নীল রঙের জিন্স পরনে বুকে হাত বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে,দেখতে বরাবরই ভালো লাগে য়ুহারের।শৈল আবার ভ্রু কুঁচকে বললো,
-“তুমি আমাকে কী বলছিলে?”

য়ুহার বইটা রেখে গলা ঝেড়ে বলে,
-“যাহা সত্য তাহাই বলিয়াছি।ইহার মধ্যে এক বিন্দুও মিছা নহে।”
-“তুমি পারোও বটে।তৈরি আছো,চলো তাহলে বের হওয়া যাক।”
-“আগে কিছু খেয়ে নাও তারপর….”
-“শ্বশুড়বাড়িতে খাওয়ার জন্য অফুরন্ত সময় আছে।”

য়ুহার ক্লীপ দিয়ে চুল ঠিক করতে করতে মেকি হেসে বলে,
-“যদি সেই সময় না হয়।”

শৈল দু’হাত দিয়ে পিছন থেকে ওর কোমড় বন্ধন করে নিজের কাছে নিয়ে বলে,
-“এসব কথা বলবেনা তুমি,তুমিহীন পাগল আমি।”
-“আগে এলে যে আরো কিছুটা সুখের মুহুর্ত একসাথে কাঁটাতে পারতাম।তোমরা যাই বলোনা কেন,আমি জানি আমি বাঁচবোনা।”
-“য়ুহার,আল্লাহর দোহায় লাগে এসব বলোনা।ভালোবাসি বড্ডো ভালোবাসি তোমায়।”
-“জানি প্রফেসার সাহেব কিন্তু এখন ভালোবাসলে তো আর হবেনা আমাদের বেরতে হবে।”
-“তোমাকে জলপাই রঙের শাড়িতে বেশ ভালো মানিয়েছে।”
-“আমি যাই করি সেটাই তোমার ভালো লাগে।”

য়ুহার আর কথা না বাড়িয়ে শৈলকে নিয়ে মাকে বিদায় জানিয়ে বেড়িয়ে পরে।য়ুহারের গাড়িটা কিছুদিন ধরে গ্যারেজে আছে,তাই একটা সিএনজি ঠিক করে উঠে পরে।

(১৬১)

মি.মনিরের স্ত্রী আর ছেলে এসেছে মি.ফুয়াদের বাসায়।মি.ফুয়াদ অফিসে ছিলেন,উনার স্ত্রী ফোন করার সাথে সাথে ছুটি নিয়ে বাসায় চলে আসেন।মনিরের স্ত্রী শিফালি উনাকে দেখার সাথে সাথে বলেন,
-“ভাইজান আজ নিয়ে চারদিন হয়ে গেলো আর আপনি কিছুই করতে পারছেন না।”
-“আমিতো চেষ্টা করছি ভাবী।কিন্তু যারা কেস রি-অপেন করেছে তারাই তো তুলতে চাইছেনা।”

মিসেস শিফালি আচলে চোখ মুছে বলেন,
-“আপনার মেয়েই তো করেছে।ভাইজান ওর সাথে তো মনিরের কোনো শত্রুতা নেই তাহলে কেন মিথ্যা কেসে ফাঁসালো।আপনার মেয়েকে কে না কে মারলো আর ফাঁসলো আমার স্বামী?এটা অন্যায়, যখন আপনার বড় মেয়ে মারা গেলে,ও তখন আট বছরের শিশু।তাহলে কীভাবে মনে থাকার কথা?”

মি.ফুয়াদ কপাল চুলকিয়ে বলে উঠেন,
-“প্রথম কথা ভাবী কেসটা আমার মেয়ে রি-অপেন করেনি।বরং ইস্মিতার সাথে যে মেয়েটা মারা গেছিলো তার পরিবার করেছে।আর ওই মেয়েটার বড় বোন হলো আমার মেয়ের জা,এসব তো আমি সেদিন জেনেছি।”
-“তো আমার স্বামী কী দোষ করলো?বিপদে সময় আমরা আপনার পাশে ছিলাম এখন আপনি কিছু করুন।”
-“আমি আমার সব চেষ্টা চালাচ্ছি,আপনি একটু ধৈর্য ধরুন।”

এর মধ্যেই থানা থেকে মি.ফুয়াদের কাছে ফোন আছে।উনি ফোনটা রিসিভ করলে অফিসার উনাকে থানাতে আসতে বলেন।উনিও দ্রুত সবাইকে নিয়ে থানাতে যাওয়ার জন্য বের হন।প্রায় এক ঘন্টা মতো সময় লেগেছিলো তাদের পৌঁছাতে।ভাগ্য ভালো যে জ্যামে পরতে হয়নি।উনারা থানায় পৌঁছালে অফিসার মি.ফুয়াদকে বলে উঠে,
-“খুনি নিজের মুখে স্বীকার করেছে সত্য।”
-“মানে?”
-“মনির সাহেব উনি নিজে আমাদের বলেছেন যে আপনার মেয়েকে ছুরির আঘাতে খুন করেছেন।”
-“আমি দেখা করতে চাই।”

পুলিশ অফিসার কথাটা শুনে উনাদের নিয়ে একটা সেলের সামনে যায়।উনারা দেখেন মি.মনির ফ্লোরে বসে দেওয়ালের সাথে হেলান দিয়ে আছে,চোখ মুখ ফোলা,দেখেই বোঝা যাচ্ছে মেরে কথা আদায় করা হয়ে।মিসেস শিফালি উনার দিকে তাকিয়ে কেঁদে দেন।মনির চোখ খুলে শান্ত ভাবে মাথা নিচু করে উনাদের সামনে এসে দাঁড়ায়।মি.ফুয়াদ উনার দিকে তাকিয়ে কাঁপাকাঁপা গলায় বলে উঠেন,
-“অফিসার যা বলছে সেটা কী সত্য?”

মনির কোনো কথা বলেনা,মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে।শিফালি চোখ মুছে চিল্লিয়ে অফিসারকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠে,
-“দেখছেন আমার স্বামী খুন করেনি।নিশ্চয় আপনার টাকা খেয়েছেন যার জন্য ওকে ফাঁসাচ্ছেন।আপনারা মেরেছেন,তাই মারের ভয়ে মিথ্যা বলেছে।আপনারা সবাই ঘুষখোর।”

অফিসার উনার দিকে তাকিয়ে গম্ভীর কন্ঠে বলে উঠে,
-“দেখুন ম্যাডাম ভদ্রভাবে কথা বলবেন।স্বামীর শোকে পাগল হয়ে গেছেন।”
-“ও খুন করেনি,যদি করতো তবে দশ বছর আগে কেন ধরেননি।”

মিসেস শিফালি অনেক চিৎকার করতে থাকে পুলিশের সাথে।কিন্তু অফিসার বেশি কথা বলেনা, কেননা তারা এসব জিনিসের সম্মুখীন অহরহ হন।তাই এতে করে তারা অভ্যস্ত।হঠাৎ করে মনির বলে উঠে,
-“উনি ঠিক বলছে শিফালি।”
-“মানে?”
-“খুনটা আমরা করেছি।”

শিফালি কান্না বন্ধ করে শান্ত চোখে স্বামীর দিকে তাকিয়ে থাকে।হয়তো বিশ্বাস হচ্ছেনা এতো বছর একজন খুনির সাথে সংসার করেছে।মিসেস ইসানি স্বামীর দিকে তাকালে মি.ফুয়াদ অনেকটা অবিশ্বাসের কন্ঠে ওকে উদ্দেশ্য করে বলে,
-“ত..তুই আমার মেয়েকে মেরেছিস?”
-“হ্যাঁ,আমি মেরেছি তোর মেয়েকে।”
-“কেন?কীসের জন্য মেরেছিস ওকে?কোন স্বার্থর জন্য মেরেছিস?তুই না আমার কাছের বন্ধু, বন্ধু হয়ে এতো বড় সর্বনাস করতে তোর বাঁধলোনা।”

মনির শক্ত কন্ঠে বল উঠে,
-“না বাঁধেনি।তুই জানিস তোকে রাস্তায় তো আমিই নামিয়েছিলাম।যার জন্য তোর মেয়েকে খুন হতে হয়।”
-“কী বলছিস তুই এসব?”
-“সত্যিই তো বলছি,আমার বড়লোক হওয়ার স্বপ্ন ছিলো।তোদের থেকে আমাদের অবস্থা ভালো থাকলেও তোর মতো সাফল্য অর্জন করতে পারিনি।তাই তুই যখন ব্যবসা শুরু করলি আমি তখন সেটাই যোগ দিলাম।ধীরে ধীরে তোর টাকা বাড়তে লাগলো আর আমি সেখান থেকে সরিয়ে ফেলতাম।তোর মনে হতো ম্যানেজার এসব করছে।আমি যা বলতাম তুই তাই বিশ্বাস করতিস,কতটা বোকা তুই।”

মি.ফুয়াদের মুখে কোনো কথা নেই।আসলে উনি জানেন উনি বোকা।সহজে সবাইকে বিশ্বাস করে নেন,যার জন্য পস্তাতে হয় সব সময়।মনির আবার বলতে শুরু করে,
-“ইস্মিতা ছিলো বেশ চঞ্চল,ও যখন তখন তোর কাছে আসতো দেখা করতে।এভাবে ও একদিন ম্যানেজারের সাথে কথা বলতে দেখে নেয়।সেদিন তোরা পিকনিকে যাবি ওইদিন।বড্ডো চঞ্চল মেয়েটা আমার কোনো কথাই শুনলোনা।বললো তোকে বলে দেবে।তাই রাস্তা থেকে সরিয়ে দিলাম।”
-“তা…তাহলে ইস্মা সব ঠিক বলতো,বিশ্বাস করতাম না ওকে।বন্ধু হয়ে জানোয়ারের মতো বিশ্বাসঘাতকতা করলি।তোকে তো….”

মি.ফুয়াদ চিৎকার করে কথাটা বলে উঠেন।মনির আবার শান্তভাবে বলে,
-“তুই আমাকে জানোয়ার বললি,তাহলে তোর ভাইয়েরা।তারা তো পশুর কাতারেই পরেনা।জানিস কেন?কারন তোর দুই ভাইও ছিলো আমার সাথে।ওরা সম্পত্তির জন্য ইস্মিতাকে মারতে চেয়েছিলো।কেননা তোর বাবা পরের মেয়ে হলেও ওর নামে সম্পত্তি লিখে দেয় সেই কারনে।সেদিন কী হয়েছিলো জানিস?”

মি.ফুয়াদ ক্রুদ্ধচোখে ওনার দিকে তাকায়।মিসেস ইশানি কপালে হাত রেখে বেঞ্চে বসে কাঁদতে থাকেন।কেননা উনি সারা জীবন নিজের মেয়েকে দোষী ভেবেছেন।যার জন্য মেয়েটা একটা বছর পাগল পর্যন্ত হয়ে ছিলো।উনার বোন বলতো তবুও উনি শুনতেন না।এই লোকটার জন্য মৃত্যুমুখী মেয়েকে যা নয় তাই বলেছেন হাসপাতালে।

মি.মনির উনাদের দিকে তাকিয়ে আবার বলতে শুরু করেন,
-“তোর ভাইয়েরা এক একটা স্বার্থপর।স্বার্থের জন্য নিজেদের তোকেও মারতে পারে।আমি জানতাম ওরা আমাকে সাহায্য করবে।ব্যাস কথা বললাম এক পায়ে রাজী হয়ে গেলো।প্রথমদিন কিছু করতে পেরেছিলাম না,তবে দ্বিতীয় দিন সেই সুযোগ পেলাম।তোর দুই মেয়ে বাইরে খেলতে গেছিলো, সুযোগটা কাজে লাগালাম।আসেপাশে কেউ ছিলোনা তাই।তবে ধারনা আমাদের ভুল ছিলো ওকে মারার সময় আরো একটা মেয়ে আমাদের দেখে ফেলে।বোকা মেয়েটা নিজের প্রান না বাঁচিয়ে তোর মেয়েকে বাঁচাতে এসে অকালে প্রাণ হাঁরায়।তবে জানতাম না,ওই ছোটটা আমাদের দেখে নিয়েছিলো।নয়তো ওকেও উপরে পাঠিয়ে দিতাম।ভাগ্য ভালো যে বেঁচে গেলো।”

মি.ফুয়াদ সবটা শুনে স্তব্ধ হয়ে যান,মুখের ভাষা হাঁরিয়ে ফেলেন।যাকে সারা জীবন বন্ধু ভাবলো সেই পিছনে ছুরি মারলো।আর মেয়েটা তাকে যে অবজ্ঞা করেছে,মাফ করবে তো সে?মিসেস ইসানি চেঁচিয়ে বলে উঠে,
-“জানোয়ার,তোর সাহস কী করে হয়,আমার মেয়েকে মেরেছিস?তোকে আমি খুন করবো,আর ওই দু’টো কুকুড় কেউ,কাউকে ছাড়বোনা।”

মিসেস ইশানি রাগের মাথায় কী বলছেন সেটা উনি নিজেও জানেন না।ইয়ামিলা খুব ভয় পাচ্ছে এসব দেখে।ও আসলে বুঝে উঠতে পারছেনা আসল কাহিনি কী?মি.ফুয়াদ অফিসারকে কিছু বলতে যাবে তার আগেই উনি বলে উঠেন,
-“চট্রগ্রামের থানার সাথে কথা হয়েছে।খুনিরা ধরা পরবে।”
-“কঠিন শাস্তি যেন পায়….”
-“অন্যায় করলে মাফ নেই।সে যেই হোক না কেন?জানি অনেকে আছে যারা পুলিশকে সহ্য করতে পারেনা,তবে চিন্তা করবেন না,দশ বছর আগে যেটা হয়নি সেটা দশ বছর পরে হবে।”

মি.ফুয়াদ আর কিছুনা বলে স্ত্রী মেয়েকে নিয়ে থানা থেকে বাইরে আসেন।উনার স্ত্রীর চোখে অশ্রুধারা বইছে।উনার নিজেরও কিছু ভালো লাগছেনা।একটা ক্যাব ঠিক করে বাসায় দিকে রওনা দেন।রাস্তায় কেউ কারোর সাথে কথা বলেনি।ক্যাব চলছে নিজের আপন গতিতে,আর উনাদের দৃষ্টি শূন্যে।আসলে উনারা ভাবতেও পারেননি এমন কিছু হবে।হঠাৎ করে অপ্রত্যাশিত জিনিস যদি সামনে চলে আসে তবে অনুভুতিটা কেমন হয়,সেটা তারাই বলতে পারে যারা এই সম্মুখীন হয়েছে।কতটা বিশ্বাস করতো বন্ধুকে কিন্তু সেই বন্ধু তার মর্যাদা রাখলোনা।

(১৬২)

দুপুর তিনটা বাজে,ইয়ারাবী বিছানার সাথে কিছুটা হেলান দিয়ে শুয়ে আছে।তিনদিন হলো ওকে বাসায় নিয়ে আসা হয়েছে,আসলে একপ্রকার ওর জেদের কাছে হার মেনে ওকে নিয়ে এসেছে।আজকাল বড্ডো জেদি হয়ে যাচ্ছে মেয়েটা।বাসায় নার্স রাখা হয়েছিলো কিন্তু আবরারকে একপ্রকার বিরক্ত করে ওকে আসতে নিষেধ করিয়েছে ইয়ারাবী।কেননা সারাক্ষণ রোগীর মতো শুয়ে বসে থাকতে ওর ভালো লাগছেনা।আর না থেকেই বা কী করবে?মাথা উঁচু করে বেশিক্ষণ বসতেও পারছেনা।

জারবা সার্ভেন্টের সাথে একগ্লাস জুস নিয়ে রুমে আসে।ইয়ারাবী ওকে দেখে বসতে গেলে জারবা এসে সাহায্য করে বলে,
-“তুমি সব সময় এমন তাড়াহুড়া করো কেন ছোট ভাবী?তুমি জানোনা,তোমাকে প্রচুর বিশ্রাম নিতে হবে।এখন জুসটা খেয়ে নাও তো,মামীরা আসবে তাই মম্ সার্ভেন্টকে কাজ বুঝিয়ে দিচ্ছি।নয়তো এসে খাইয়ে দিতো।”

ইয়ারাবী কিছুটা হেসে মৃদ্যু স্বরে বলে,
-“তোমাকে কিছু ব্যাখা দিতে বলেনি।তাছাড়া তোমার সাথে সময় কাঁটাতে ভালোলাগে।কিন্তু বাসায় আসার পর থেকে তুমিতো আমার কাছে আসছো না।আমাকে দেখতে কী খারাপ লাগছে নাকী ভালোলাগেনা?”
-“ছিঃ,এমন কিছু নয় ভাবী,আসলে তোমার হার্ড অপারেশন হয়েছে।তোমার প্রচুর রেস্টের দরকার, আর আমি বাচাল,বকবক করতেই থাকি।”
-“উহু,তুমি বাচাল নও,কিউট একটা মেয়ে।তিনটা বাজে তোমার ভাইয়া কখন আসবে?”
-“কেন তোমার কিছু প্রয়োজন?নার্সকেও বাদ দিয়ে দিয়েছো।”
-“তেমন কিছু নয়,আসলে তোমার ভাইয়ার কাছে আমার ফোনটা আছে।অপারেশনের পর থেকে আর দেয়নি।একটু ড্রয়ারগুলো খুঁজে দেখবে।”

ইকরা রুমে ঢুকতে ঢুকতে বলে,
-“কোনো ফোন ব্যবহার করতে পারবেনা।আগে সুস্থ হও তারপর।”
-“কিন্তু আপু….”
-“ফোনের কথা বাদ দাও,দেখো কারা এসেছে?”

ইকরার পিছনে তাকিয়ে দেখে য়ুহার আর শৈল রুমে ঢুকছে।ইয়ারাবী হেসে বলে,
-“দোলাভাই,আপু তোমরা।যাক শেষ পর্যন্ত আমার শ্বশুড় বাড়িতে পা দিলে।”
-“আসতে তো হবেই,বাচ্চাটা যে এখানে আছে।”
-“বসো তোমরা।আমি নাস্তা পাঠিয়ে দিচ্ছি।”

ইকরা কথা বলে মিষ্টি একটা হাসি দিয়ে রুম থেকে বেড়িয়ে যায়।য়ুহার ইয়ারাবী হাতের উপর হাত রেখে বলে,
-“কেমন আছিস এখন?”
-“আলহামদুলিল্লাহ,তোমরা?”
-“আমরাও খুব ভালো।জারবা তুমি কেমন আছো?”

জারবা বেড থেকে দাঁড়িয়ে বলে,
-“আমিও খুব ভালো,ছোট ভাবী জুসটা খেয়ে নিয়ো কেমন?আমি আসি,কাল পরীক্ষা আছে।”

ইয়ারাবী হেসে বলে,
-“আচ্ছা যেয়ে পড়তে বসো,নয়তো বকা খাবে।”

জারবা মাথা দুলাতে দুলাতে ঘর থেকে বেড় হয়ে যায়।য়ুহার ইয়ারাবীর দিকে চিন্তিত মুখে তাকিয়ে বলে,
-“আবরার তোর সাথে জারিকার ব্যাপার নিয়ে রাগারাগি করেছে নাকী?”
-“সত্যি বলতে আপু,এ্যাটিটিউড দেখে মনে হচ্ছে রেগে আছে।খাওয়ার সময় খাইয়ে দিচ্ছি,যে কোনো প্রয়োজনে পাশে থাকছে তবে প্রয়োজন ছাড়া কথা বলছেনা।ভালো লাগছেনা আমার…”
-“কোথায় ও?ল্যাবে নাকী?”
-“না,হাসপাতালে।একজন ইমার্জেন্সি পেসেন্ট আছে তাই।আর ল্যাবে আপাতত যাচ্ছেনা।”
-“কখন বেড়িয়েছে?”
-“সকালে খাইয়ে দিয়ে বেড়িয়েছে,বললো তো দুপুরের আগে আসবে এখনো আসেনি।”

য়ুহার মুচকি হেসে বলে,
-“চিন্তা করিসনা,একটু রেগে আছে।দেখিস সব ঠিক হয়ে যাবে।”
-“কী জানি?রাগ ঝাড়তে পারছেনা তাই এমন করছে।সুস্থ থাকলে এই কাজের জন্য নির্ঘাত ধমক খেতে হতো।”
-“তুই একটু বেশিই ভাবিস।”

ইয়ারাবী শৈলের দিকে তাকিয়ে বলে,
-“দোলাভাই,আপুকে কবে নিবেন?”
-“তুমি আগে সুস্থ হয়ে নাও,তারপর তোমার আপুকে উঠিয়ে নিয়ে যাবে।”

-“কেমন আছো তোমরা?”
আবরার কোর্ট খুলে রুমে ঢুকতে ঢুকতে কথাটা বলে উঠে।য়ুহার মিষ্টি হেসে বলে,
-“আলহামদুলিল্লাহ,তুমি কেমন আছো?”
-“আল্লাহ যেমন রেখেছে।”

হঠাৎ আবরারের চোখ যায় টেবিলে রাখা জুসের গ্লাসের উপর।আবরার ইয়ারাবীর দিকে তাকিয়ে গম্ভীর কন্ঠে বলে,
-“এক ঘন্টা আগে তোমাকে জুস দিতে বলেছি, আর তুমি এখনো খাওনি কেন?”
-“ভালো লাগছেনা,তাই?”
-“তা লাগবে কেন?এমন এটা ধকল যাওয়ার পরে কীভাবে মানুষ বোকার মতো জেদ ধরে সেটা তোমার থেকে শিখতে হবে।”

য়ুহার আবরারের দিকে তাকিয়ে বলে,
-“আহ্হ্,আমার বোনকে বকবেনা একদম।”
-“না,ওকে বকবো কেন?উনি যা করেন সেটাই সঠিক,বাকী সবাই ভুল।”
-“আবরার,এই বিষয় নিয়ে ওকে কিছু বলোনা আর…”
-“দেখো য়ুহার,আমি ওই টপিকে কথা বলছিনা।তুমি জানো কাল কী করেছে?”
-“কী করেছে?”
-“রাতে ঘুম ভেঙেছে,ওয়াশরুমে যাবে আমাকে ডাকবে তো।কিন্তু তিনি তা করেননি,ম্যাডাম একা একা ওয়াশরুমে যেয়ে আসার সময় মাথা ঘুরে পরে গেছেন।আমি যদি না দেখতাম তবে কী হতো ভাবতে পারছো?”

য়ুহার কথাটা শুনে রাগী চোখে ইয়ারাবীর দিকে তাকায়।ইয়ারাবী মুখটা কালো করে মাথা নিচু করে দাঁত দিয়ে নখ কাঁটতে থাকে।য়ুহার ইয়ারাবীর দিকে তাকিয়ে আবরারকে বলে,
-“যা করছো একদম ঠিক করছো।এর সাথে কথা বলার সময় মনে রাখবে তুমি যুক্তির প্রাণীদের সাথে নয়, তবে আবেগের প্রাণীদের সাথে কাজ করছো।”

ইয়ারাবী য়ুহারের দিকে তাকিয়ে বলে,
-“আপু…”
-“চুপ ফাজিল মেয়ে,খুব বুঝা শিখেছো।যদি রাতে কিছু হয়ে যেত।”
-“উনি সারাদিন ব্যস্ত থাকেন আমাকে নিয়ে।তাই ভাবলাম…”

আবরার আড়চোখে তাকিয়ে বলে উঠে,
-“ভেবে আমাকে উদ্ধার করেছেন ম্যাডাম।এবার জুসটা খেয়েও করেন,তাহলে এই অধম খুশি হতো।”
-“আপনি এমন করছেন কেন?”
-“তোমাকে…তোমার কপাল ভালো যে তুমি অসুস্থ।নয়তো কী করতাম সেটা আমি নিজেও জানিনা।”

শৈল হাসতে হাসত আবরারের কাঁধে হাত রেখে বলে,
-“তুমি পারোও বটে।বাদ দাও,একটু বোঝালে তো হয়।”
-“আপনার শ্যালিকা প্রচুর ঘাড়ত্যাড়া।বোঝালে বোঝেনা।”

শৈল কিছু বলতে যাবে তার আগে ওর বাসা থেকে ফোন আছে।কলটা রিসিভ করার সাথে সাথে জানতে পারে ওর দুরসম্পর্কের ফুপু মারা গেছে, এখনি যেতে হবে।তাই ওরা আবরারদের বিদায় জানিয়ে দ্রুত বেড়িয়ে পরে।অবশ্য মিসেস রায়হান আটকাতে চেয়েছিলো তবে মৃত্যু সংবাদ পেয়ে আর জোর করলেন না।ওরা চলে যেতেই আবরার ওয়াশরুম থেকে ফ্রেস হয়ে একটা ট্রাউজার আর একটা গেন্জি পরে মাথা মুছতে মুছতে বের হয়।আবরার আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের কাজ করতে করতে বলে,
-“জুসটা শেষ করো দ্রুত।”
-“বমি আসবে।”
-“হবেনা খেয়ে নাও।আর আজ রাতে কিছু খেতে পারবেনা স্যালাইন চলবে।”
-“আবার?”
-“নিজে বেশি বুঝলে এমনটাই হয়।”

ইয়ারাবী জুসের গ্লাসটা হাতে নিয়ে আবরারের দিকে তাকিয়ে তিন নিঃশ্বাসে শেষ করে দেয়।আবরার মুচকি হেসে ওর হাত থেকে গ্লাস নিয়ে বলে,
-“গুড,আগে খেলে আর বকা খেতে হতোনা।”
-“আজ বলে মামারা আসবেন, তাই।”
-“হুম।”
-“উনাদের তো অনেক আগে ব্যাক করার কথা ছিলো।তাহলে?”
-“জানিনা,আর জানতেও চাইনা।তুমি এখন ঘুমাও।”
-“মাথা খারাপ একটু আগে ঘুম থেকে উঠছি।”

আবরার আর কিছু না বলে সোফায় বসে ল্যাপটপে কাজ করতে থাকে।আসলে কিছুক্ষণ ওকে ওর মতো সময় কাঁটাতে দেয়।ইয়ারাবী বিছানায় হেলান দিয়ে আবরারের দিকে তাকিয়ে আছে।
-“আবরার?”

ল্যাপটপের দিকে চোখ রেখেই বলে,
-“বলো…”
-“সেলাই কবে কাঁটবে?”
-“দেরি আছে।কেন?”
-“শাওয়ার নিতে পারছিনা তো।”

আবরার আড়চোখে তাকিয়ে বলে,
-“সকালেই তো করিয়ে দিলাম।”
-“মাথাতো ভিজাতে পারিনি।আর ওটাতে গোসল বলেনা,পানির ছিটা দেওয়া বলে।”
-“কমপক্ষে একমাস তো ভিজাতে পারবেনা।তার উপর চুল সব কাঁটতে দাওনি।”
-“আমার ফোনটা কী দেওয়া যাবে?”
-“উহু,কোনো প্রশ্নই উঠেনা।”
-“চেলসি কোথায়?”
-“মেঘের রুমে,যতদিন তুমি ঠিক না হচ্ছো ও আসবেনা।যদিও ভ্যাক্সিনেশন করা আছে তবুও ইনফেকশন হতে কতক্ষণ।”
-“তাহলে টিভিটা চালিয়ে দিন,খুব বিরক্ত লাগছে।”
-“উহু,চোখে প্রেশার পরবে।চশমা তো ব্যবহার করতে পারছোনা।”
-“তাহলে আমার সাথে কথা বলুন,কাজ পরে করবেন।”
-“তোমাকে ঘুমাতে বলেছি,বেশি কথা বললে সমস্যা হবে।”
-“আপনি…আবরার?”

ল্যাপটপটা বন্ধ করে ইয়ারাবীর দিকে বিরক্তের দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে বলে,
-“আবার কী?”
-“আপনি কী বিরক্ত হচ্ছেন?”
-“না বলো তুমি কী বলবে?”
-“দুঃখীত,আমার জন্য আপনার সময় নষ্ট হচ্ছে।আসলে কালকের পর থেকে উঠে দাঁড়াতে সাহস পাচ্ছিনা।একটু ওয়াশরুমে নিয়ে যাবেন খুব বমি আসছে।”

আবরার তাড়াতাড়ি ল্যাপটপটা পাশে রাখে দ্রুত উঠে ইয়ারাবীর কাছে এসে ওকে ধরার সাথে নিজেকে কন্ট্রোল করতে না পেরে ওর উপর করে দেয়।আবরার ওর দিকে তাকাতেই ইয়ারাবী ভয়ে বলে উঠে,
-“আ..আমি আসলে ব..বুঝতে পারিনি…”

আবরার ওকে অবাক করে দিয়ে হেসে বলে উঠে,
-“পাগলি,ভয় পাচ্ছো কেন?জানি তুমি ইচ্ছা করে করোনি।এমনিতে এগুলো চেপে রাখতে হয়না, নয়তো সমস্যা হয়।আর করবে?”
-“না…”
-“চলো তোমাকে ফ্রেস করিয়ে দেয়।অনেকটা দুর্বল হয়ে পরেছো।”

আবরার ইয়ারাবীকে ওয়াশরুম নিয়ে ওকে ফ্রেস করিয়ে দিয়ে নিজে ফ্রেস হয়ে বাইরে আসে।সার্ভেন্ট এসে সবকিছু পরিষ্কার করে দিয়ে গেলে আবরার ওর মাথায় সাবধানে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলে,
-“এখন ঘুমাও।”
-“আপনি সত্যি রাগ করেননি তো?”
-“তুমি কী পাগল?এই বিষয়ে কেউ রাগ করে।”
-“করে তো?ছোট বেলায় রায়ীনা খালাকে দেখেছিলাম খালুর উপর বমি করে দিয়েছিলো।তাই উনি খুব বকেছিলো খালাকে….”
-“সবাইকে এক পাল্লায় মাপা ঠিক না।তোমার কষ্ট হচ্ছে,ঘুমিয়ে পড়ো।আমি পরে ডেকে দিবো।”
-“ব্যাথা করছে…”
-“ঘুমালে ঠিক হয়ে যাবে।”

দুপুর গড়িয়ে রাত হতে চললো।আবরারের মামা সহপরিবারে বাড়িতে আসলেন।ফারহান,আবীর আর মেঘকে হাগ করে আবরারের কথা জানতে চাইলো।মেঘ বললো ও নিজের রুমে।ফারহান কিছু বলার আগেই ফাইকা দৌঁড়ে আবরারের রুমে যেয়ে ওকে জড়িয়ে ধরলো।ইয়ারাবীকে কেবল খাওয়াতে বসবে এমন সময় এই কাজ করলো ফাইকা।আবরার প্রচন্ড রাগে ওকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে ফেললে ইয়ারাবী আড়চোখে আবরারের দিকে তাকিয়ে আস্তে আস্তে বলে,
-“পুরানো পাগলে ভাত পায়না,নতুন পাগলের আমদানি।”

ফাইকা বিদেশে থাকার কারনে অনেক বাংলা প্রবাদ বাক্যের মানে বোঝেনা।ও ইয়ারাবীর দিকে ভ্রু-কুচকে তাঁকালে আবরার হো হো করে হেসে দেয়।ফাইকা ওর দিকে তাকিয়ে বলে,
-“তুমি হাসছো কেন?আর তোমার বৌ আমাকে কী পাগল বলে সম্বোধন করলো?”
-“তোমার কী মনে হয়?”
-“তার মানে?”

আবরার কিছু বলতে যাবে তার আগে ওর মামা-মামী আর ভাই রুমে ঢোকে।ও মামা এসে ইয়ারাবীর সাথে হালকা পাতলা কথা বলে।ওর মামী খাবারের দিকে তাকিয়ে আবরারকে উদ্দেশ্য করে বলে,
-“দেখো আব্বু,বৌয়ের সেবা করতে করতে অভ্যাসে পরিনত না হয়ে যাও।আজকালকের যা যামানা চলছে।বৌতো লাট সাহেব,আর স্বামীদের দিয়ে সব কাজ করায়।মানুষ দেখলে কী ভাববে বলোতো?তুমি শিক্ষিত ছেলে হয়ে বৌয়ের কাজ করছো।আর এই মেয়ে তুমি,তোমার কী কান্ড-জ্ঞান বলতে কিছু নেই?কোথায় অল্প একটু মাথা কেঁটেছে তাতে মনে হচ্ছে কীনা না কী হয়েছে?”

ওর মামা বারবার স্ত্রীকে চুপ করতে বলছেন,কিন্তু উনার থামার নাম নেই।একে ইয়ারাবীর শরীর খারাপ,তার উপর এসব কথা শুনে চোখে পানি চলে এসেছে।ওর পরিবারের লোক হলে কিছু বলতে পারতো কিন্তু উনি আবরারের পরিবারের।তাই চুপ করে হজম করছে।আবরারের সহ্যের বাঁধ ভেঙে যায়।ও নিজের মামীর উদ্দেশ্যে চিৎকার করে বলে,
-“কমনসেন্স ওর আছে,তবে আপনার নেই।কোথায় কী বলতে হয় সেই বুদ্ধি লোপ পেয়েছে।যেটাকে আপনি সামান্য কাঁটা বলছে,শুধু ওই জানে এর কতটা মুল্য চুকাতে হচ্ছে।প্রতিটা রাত শুধু ব্যাথায় ছটফট করে মেয়েটা,আর হাসপাতালে কেমন ছিলো সেটা আমরা জানি।আর কী বললেন?স্ত্রীর কাজ করলে লোকে কী বলবে?
আমাদের নবীজি বহুলাংশেই স্বাবলম্বী ছিলেন। নিজের প্রয়োজনে কারও ওপর নির্ভরশীল হতেন না। নিজ হাতে জুতা মেরামত করতেন, কাপড় সেলাই করতেন, দুধ দোহন করতেন। সেবকদের কাজে সহায়তা করে আটা পিষতেন। নিজ হাতে রুটি তৈরি করে পরিবার-পরিজনকে নিয়ে খেতেন। নিজে হাটবাজার থেকে সওদা করে নিয়ে আসতেন। পরিবারের কেউ কোনো কাজের সহায়তা কামনা করলে তখনই সাহায্যের জন্য সাড়া দিতেন।
তাঁর পারিবারিক কার্যকলাপ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে হজরত আয়েশা (রা.) বলেন, ‘রাসুলুল্লাহ (সা.) বাড়িতে অবস্থানকালে পরিবারের কল্যাণমূলক কাজে নিয়োজিত থাকতেন। যখন নামাজের সময় হতো তখন তিনি নামাজের জন্য উঠে যেতেন।’ হজরত আনাস (রা.) বলেছেন, ‘পরিবারের প্রতি অধিক স্নেহপ্রবণ হিসেবে নবী করিম (সা.) থেকে বেশি অগ্রগামী আমি আর কাউকে দেখিনি। তিনি দিবারাত্রির সময়টুকু তিন ভাগে ভাগ করে নিতেন। এক ভাগ ইবাদত-বন্দেগি করতেন। অন্য ভাগ পরিবার-পরিজনের গৃহকর্মের যাবতীয় কাজ সম্পন্ন করতেন। আর এক ভাগ সময় তিনি নিঃস্ব-দুস্থজনদের জনসেবায় ব্যয় করতেন। কোনো জরুরি অবস্থা দেখা না দিলে সাধারণত এ নিয়মের ব্যত্যয় ঘটত না।
উনি নবী হয়ে পরিবারের কাজ করতে পারেন তবে আমরা তার উম্মত হয়ে কেন পারবোনা।কোনো কাজই কখনো ছোট নয়।স্ত্রীর যেমন কর্তব্য স্বামীর সেবা করা তেমন স্বামীরও কর্তব্য আছে স্ত্রীর সেবা করার।আশাকরি দ্বিতীয়বারে কিছু বলার আগে অন্ততপক্ষে ভেবে বলবেন।”

#চলবে_____

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here