জীবন মানে তুমি পর্ব-৪৫

0
3933

#জীবন মানে তুমি
#লেখিকা:H.B.Rini (Irini Ori)
#পর্ব:৪৫

(১৫২)

অনুর চিৎকারে সামনে তাকিয়ে দেখে ইয়ারাবী হাত থেকে ক্যানেল খোলার চেষ্টা করছে।আবরার দ্রুত ওর কাছে যেয়ে ওকে ঝাপটে ধরে শান্ত করার চেষ্টা করছে কিন্তু কোনো কাজ হচ্ছেনা।আজ ইয়ারাবী কারো কোনো কথা শুনছেনা,মাথার মধ্যে শুধু একটা কথায় ঘুরঘুর করছে-ওর বেঁচে থেকে লাভ কী?যদি মা হওয়ার সুখ না পায়,আর আবরার ওকে ব্যবহার করার জন্য বিয়ে করেছে।ইফাজ জারিকার চুলের মুঠি ধরে বলে,
-“তোর লজ্জা কী জীবনেও হবেনা?নিজের মায়ের স্বভাব পেয়েছিস।ইচ্ছা করছে তোকে মেরে এখানে পুতে ফেলি।”
মিলিস্তা ইফাজের হাত ছাড়াতে ছাড়াতে বলে,
-“ছাড়ুন আপুকে ভাইয়া,আপুতো ভুল কিছু বলেনি।”
-“মিলিস্তা!নিজের জায়গা মেপে কথা বল।নিজের বোনের মতো অবস্থা না করতে চাইলে চুপচাপ থাক।”

অনু ইয়ারাবীর হাত ধরে বলে,
-“তুই কেন এদের কথা শুনে পাগলামি করছিস?তুই তো জানিস এরা শুধু তোর ক্ষতি করতে চায়।এমনটা করিসনা ইয়ু,তোর নিজের ক্ষতি হবে।প্লীজ শান্ত হয়ে বস,এরা সম্পূর্ন মিথ্যা কথা বলছে।”
-“কোনো মিথ্যা বলছেনা এরা,যা সত্য তাই বলছে।ঠিকই বলেছে আমার মতো মেয়েকে মরে যাওয়া উচিত,চাইনা বাঁচতে আমি।”

আবরার ইয়ারাবীর দুই শক্ত করে ধরে বলে,
-“একদম পাগলের মতো কথা বলবেনা।কেন মরবে তুমি?তোমাকে দেখিয়ে দিতে হবে তুমিও পারো।বুঝিয়ে দিবে যে-শকুনের দোয়ায় গরু মরেনা। এমন করেনা সোনা,দেখ রক্ত পরছে।”

ইয়ারাবী হাত ছাড়ানোর বৃথা চেষ্টা চালাতে থাকে।আবরারের মতো একজন শক্তিশালী মানুষের নিকট ওর মতো পিঁপড়ার শক্তি কিছুইনা।ও চিৎকার করে বলে উঠে,
-“আপনিও সুবিধাবাদী,ভেবেছিলাম আপনি ভালো হবেন।কিন্তু না আপনিও ওদের মতো নিজের স্বার্থ খোঁজেন।যখন জানলেন আমি মা হতে পারবোনা তখন শরীর ব্যবহার করার জন্য বিয়ে করলেন।”

আবরার এতক্ষণ নিজের রাগকে শান্ত করে রেখেছিলো,কিন্তু ওর কথা শুনে সেটা আর সম্ভাব হলোনা।প্রচন্ড আক্রোশে জোরে থাপ্পড় মেরে দেয় ইয়ারাবীকে।চড়ের মাত্রা খুব গভীর ছিলো।ইয়ারাবী শান্ত হয়ে ছলছল চোখে মুখে হাত দিয়ে ওর দিকে তাকায়।আবরারের রাগ কিছুতেই কন্ট্রোল হচ্ছেনা,ওর যেন বুদ্ধি লোপ পেয়েছে।ইফাজ জারিকাদের সিকিউরিটির হাত তুলে আটকে রাখতে বলে।কেন আটকে রাখতে বলে সেটা ওই ভালো জানে।ওরা চলে গেলে ইফাজ আবরারকে ধাক্কা দিয়ে বলে,
-“কী করলি তুই এটা?সব বুদ্ধি লোপ পেয়েছে তোর?একজন ডাক্তার হয়ে এই কাজ কীভাবে করতে পারলি?মুখের বাম পাশে পাঁচ আঙ্গুলের দাগ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে।”
-“তো কী করবো?ভালো ভাবে কথা শোনার মেয়ে তোর বোন?দেখ ক্যানেলে টান মেরে হাতের কী অবস্থা করেছে?কাল অপারেশন কেমন পাগলামি করছে,আরে ও ভাবলো কী করে আমি এমন ছেলে?”

ইয়ারাবী আবরারের সামনে দাঁড়িয়ে কান্না জড়ানো কন্ঠে বলে,
-“তো কী ভাব্বো?তাহলে আপনিই বলুন,যে মেয়ে কোনো দিন মা হতে পারবেনা তাকে কেন বিয়ে করেছেন?যদি বলেন ভালোবাসা,তাহলে আমার কাছে সেটা নাটক ছাড়া কিছুই নয়।”
-“যদি আমি তোমার শরীরই চাইতাম তবে পাঁচ মাস আগেই সেটা করতাম।মা হতে পারবেনা সেটা কী তোমার দোষ?আরে আল্লাহ চাননি তাই দেয়নি,এখানে তোমার দোষটা কোথায়?এমনটা নয় যে তুমি মা হতেই পারবেনা।ডাক্তার বলেছে চান্স আছে….”

আবরার দু’হাত ওর মুখ ধরে শান্ত কন্ঠে কথাটা বলে।ইয়ারাবীর সব কিছুতে রাগ লাগছে,মনে হচ্ছে পুরোটা নাটক,সহ্য করা কঠিন হয়ে যাচ্ছে ওর জন্য।রাগে,ক্ষোভে ওকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে বলে,
-“আবার মিথ্যা,আবার অভিনয়।কী পেয়েছেন আপনারা?আমিও মানুষ,এসব অভিনয় দেখতে দেখতে হাঁফিয়ে উঠেছি।”
-“পিচ্চি,ও মিথ্যা বলছেনা।যা বলছে সবটা সত্যি।তুই বেডে চলে,এমন করে চিল্লাস না তোর ক্ষতি হবে।”
-“ওহ্হ্,সত্যিই তোমাদের কথা শুনে আশ্চর্য না হয়ে পারছিনা।এর থেকে বড় ক্ষতি আর কী হতে পারে।মিসেস ইশানির দোয়া যেন সত্যিই ফলে,যেন খুব তাড়াতাড়ি মরে যেতে পারি।আমার এই অপয়া মুখটা যেন কাউকে দেখতে না হয়।”
-“ইয়ারাবী!বড্ডো বেড়েছিস তুই,তোর সাহস কী করে হয় মরার কথা বলার।আবরার ওকে ধর…”
-“না কেউ আমার গায়ে হাত দেবে না।”

আবরার ওর দুই বাহু শক্ত করে ধরে,জোর করে বেডে বসিয়ে দেয়।ইয়ারাবী ওর কাছ থেকে ছাড়া পাওয়ার জন্য মুচড়া-মুচড়ি করছে,বাম হাতের থেকে রক্ত পরছে,সাদা চাদরেও অনেকটা লেগেছে।আবরার ওকে জোর করে বেডে শুয়িয়ে দিয়ে মুখের সামনে ঝুকে বলে,
-“রেইলি সুইটহার্ট,তোমার মনে হয় তুমি আমার সাথে পারবে?নিজের দিকে তাকিয়ে দেখো আর আমাকে দেখো।”
-“ছা…ছাড়ুন আমাকে…”
-“উহু,ইফাজ দেরি কেন করছিস।পুশ করে দে…”
-“বললাম তো আমি কিছু নিবোনা।ভাইয়া এমন করলে কিন্তু কোনোদিন তোমার সাথে কথা বলবোনা।”
-“এখানে তোমার হাতে কিছুই নেই,ইফাজ বোনের হুমকিতে ভয় পাচ্ছিস নাকী?ডাক্তার হিসাবে যা করার তাই কর…”

ইফাজ ওর মাথায় হাত দিয়ে বলে,
-“পাগলামী কেন করছিস পিচ্চি?আমরা যা করছি তোর ভালোর জন্য করছি।”
-“ভালোর জন্য যদি কিছু করতেই চাও তবে মেরে ফেলো আমাকে।”

ইফাজ আর কিছু না বলে একটা হাই পাওয়ায়ের ইনজেকশন ওর হাতে পুশ করে দেয়।ইয়ারাবী আবরারের সাথে ধ্বস্তাধস্তির এক পর্যায়ে ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পরে।আবরার ওকে ঠিকভাবে শুইয়ে দিয়ে গায়ে চাদরটা টেনে দেয়।ইফাজ আর নার্স মিলে ওর বাম হাতটা ক্লিন করে ব্যান্ডেজ করে দেয়।তারপর ডান হাতে স্যালাইন লাগিয়ে দেয়।অনু দেওয়ালের সাথে হেলান দিয়ে অশ্রুসিক্ত চোখে চুপচাপ দাঁড়িয়ে দেখছে।

আবরার ওর দিকে তাকালেই অনু বলে উঠে,
-“এভাবে না মারলেও তো পারতেন?কোনো মানুষ পার্ফেক্ট হয়না।”
আবরার মুচকি হেসে বলে,
-“আমরা নিখুঁত ব্যক্তি খুঁজে না পেয়ে একজন অসম্পূর্ণ ব্যক্তিকে পুরোপুরি দেখতে শেখার মাধ্যমে প্রেমে আসি।তুমি যেমন ওর ভালোটা চাও,তেমন আমিও চায়।সুতরাং এমন করে না কেঁদে চুপ করে ওর পাশে বসো।”
-“আপনার মারাটা ঠিক হয়নি,কষ্ট পেয়েছে ও।”
-“ওর কাছে বসো….”

ইফাজ ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে।আবরারের দিকে তাকিয়ে বলে,
-“রাতের মধ্যে ওকে শান্ত করার চেষ্টা করবি।”
-“তোর বোন তো কোনো কথা শুনছেনা।”
-“মারবিনা ওকে…”

-“কে কাকে মারবে?”
পিছন ঘুরে তাকিয়ে দেখে মিসেস রায়হান,ইকরা আর জারবা দাঁড়িয়ে আছে।ইকরা ইয়ারাবীর মাথার কাছে বসে বলে,
-“ঘুমাচ্ছে,হাতে কী হয়েছে ওর?”
-“না ভাবী,ঘুম পারানো হয়েছে।”
-“মানে?”

আবরার সবটা খুলে বলে।মিসেস রায়হান অবাকের কন্ঠে বলে উঠে,
-“জেনে গেছে সবটা।কোনো না কোনো সময় ঠিক জানতো তবে এই মুহুর্তে….”
-“মম্,আমার ইচ্ছা করছে ওই মেয়েটা খুন করি।কী পেয়েছে সবাই?ও কী কারো হাতের পুতুল?কাল ওর বাবা-মা যা নয় তাই বলেছে আর আজ ওই জারিকা।সবাই মিলে বাচ্চা মেয়েকে মারতে বসেছে।ওকে পুলিশে দিবো নয়তো….”
-“শান্ত হ্,রাগের বসে কোনো কাজ করা ঠিক নয়।”
-“কীভাবে শান্ত হবো?কতোটা উত্তেজিত হয়ে গেছিলো।যে মায়ের কাছে এই মুহুর্তে বেশি সাপোর্ট দরকার সে নিজে বলে মেয়েকে মরে যেতে।আর ওই মেয়ে…”
ইফাজ আবরারের কাঁধে হাত রেখে বলে,
-“এটেম্পট টু মার্ডারের কেসে ফেঁসে যাবে।”
-“ইফাজ তুমি কী পাগল হয়ে গেছে?ও নিজেও তোমার বোন হয়।”
-“না আন্টি,ও যা করতে এসেছিলো তার মধ্যেই পরে।আর বোন হওয়ার যোগ্য নয় ওরা।”
-“তোমাদের যা ভালো মনে তাই করো।”

হঠাৎ ইফাজের ফোনে মোহিব নামে কারোর কল আসলে ও আবরারকে সাথে করে বেড়িয়ে নিজের কেবিনে নিয়ে যায়।ওখানে জারিকা আর মিলিস্তাকে সিকিউরিটি গার্ডরা আটকে রেখেছে।অফিসার মোহিব দু’জন মহিলা কনস্টেবলকে নিয়ে রুমে ঢুকতেই ইফাজ বলে,
-“এই দু’টা মেয়েকে নিয়ে যা।এটেম্পট টু মার্ডারের কেসে যাবে…”
-“কী করেছে এরা?আবরার তুই এখানে?”
-“মোহিব এরা ইয়ারাবীকে মারার চেষ্টা করেছে।”
-“এই ইয়ারাবীটা আবার কে?সেই পিচ্চিটা নাকী?কীভাবে মারতে চেয়েছে?”
-“তোকে যা করতে বলছি তুই করবি?তোরা পুলিশরা আসলেই হলি ঘাড়ত্যারা মানুষ।হাসপাতালে এসে মারার চেষ্টা করেছে।এখনি নিয়ে যা ওকে,ওর বিষাক্ত নিঃশ্বাসগুলো সবার জন্য ক্ষতির।”

জারিকা চিৎকার করে বলে,
-“তুমি এটা মোটেও ঠিক করছোনা,আমি কখন ওকে মারতে গেলাম।”
আবরার ওকে জোড়ে একটা চড় মেরে বলে,
-“লিসেন্ তোর মতো চরিত্রহীন বাজে মেয়ের জন্য আমার ইয়ারাবীর কিছু হয়,খোদার কসম তোকে আমি জ্যান্ত কবর দিবো।”
-“তোমার সাহস কী করে হয় আমাকে মারার?”
-“আমার কী সাহস আছে সেটা তোর না জানলেও হবে।তুই কোনোদিন কল্পনাও করতে পারবিনা তোর সাথে ঠিক কী হবে।মোহিব তোকে কী ইনভাইট করতে হবে একে নিয়ে যাওয়ার ।”
-“রেগে যাচ্ছিস কেন?আর তোমরা দাঁড়িয়ে আছো কেন?এরেস্ট করো এদের।”

-“তুমি কিন্তু কাজটা ঠিক করলেনা।এর ফল কিন্তু ভালো হবেনা বলে দিলাম।”
-“দেখ আপু,তোর জন্য আমিও ফেঁসে গেলাম।”
-“চুপ করবি তুই,তোমাদের সবাইকে এর জন্য মাশুল পেতে হবে।”
মোহিব আর কোনো কথা না বাড়িয়ে ওদেরকে নিয়ে যায়,তবে আবরারকে কেস ফাইল করার জন্য একবার থানায় যেতে বলে।আবরারও মাথা নাঁড়িয়ে হ্যাঁ জানায়।

আসলে মানুষ নিজের তৃপ্তি মেটানোর জন্য এতটাই মরিয়া হয়ে উঠে যার ফলে সে তার সঠিক জ্ঞান হারিয়ে ফেলে।একটাবারও ভাবেনা তার জন্য কী অপেক্ষা করবে এই কাজের জন্য?কারোর ক্ষতি করতে গেলে নিজের ক্ষতি হয়।আর আজ সেটা জারিকার সাথে হলো।ও নিজের প্রতিশোধের নেশায় এতটা মেতে উঠেছিলো,যে একটা বারও ভাবেনি কাকে আহত করতে যাচ্ছে।আর তার এই ভুলের মাসুলগুলো এখন দিতে হচ্ছে।ওর জানা নেয় ভবিষ্যতে ওর জন্য কী অপেক্ষা করছে।আসলে ওর একুলও গেছে অকুলও গেছে,যা হাতে ছিলো এখন সেটাও নেয়।ও চাইলে পারতো শুধরাতে কিন্তু তা করেনি।বেছে নিয়েছে সর্বদা অন্যায়ের রাস্তা।

(১৫৩)

স্মৃতির মাঝে ডুব দিলে কষ্টগুলো উকি দেয় মাঝে মাঝে ,যা ভাবতেই বুক কেঁপে উঠে,না চাইতেও চিন্তা হয় যদি শক্ত না হওয়া যেতো তবে সব হারাতে হতো।দুপুরের তিক্ত রোদে ছাদে শুকনো কুমড়ার বড়া,ছোলা আর জিড়াগুলো নেড়ে দিয়ে সিড়ির কাছে এসে দাঁড়াতেই দেখে পরী আর সায়ন বল নিয়ে খেলা করছে।কত সুন্দর বাবা-মেয়ের একটা মুহুর্ত,যা সব সময় চাইতো পল্লবী।মেয়েটা হেসে হেসে হাতে তালি মেরে বল বাবার দিকে ছুড়ে মারছে।আর সায়ন সেটা হাসি মুখে ধরে ফেলছে।

অথচ কিছুদিন আগেও এই মানুষটা পরকীয়ায় আসক্ত ছিলো তাও নিজের শালীর মতো এমন কারোর সাথে।মেয়েকেও পর্যন্ত সহ্য করতে পারতোনা।সেদিন যদি প্রতিবাদ না করতো তবে সব হারাতে হতো।

জারিকাকে যখন মিসেস নিন্দু বাড়িতে নিয়ে আসেন তখন কোনো ভাবে পল্লবী জানতে পারে সায়ন অন্য কেউ নয় বরং জারিকার সাথে পরকীয়ায় অাসক্ত।তখনি আর এক মুহুর্ত দেরী না করে স্বামী,শ্বশুড়-শ্বাশুড়িকে নিয়ে জারিকার বাসায় যায়।ওরা যখন জারিকার বাসায় যেয়ে জারিকাকে নানাভাবে প্রশ্ন করে তখন মিসেস নিন্দু তার ননদ অর্থাৎ পল্লবীর মা রায়ীনাকে আসতে বলে।উনি তখন ওনার স্বামীকে নিয়ে বাসায় উপস্থিত হয়।পল্লবী নানা ভাবে জারিকাকে প্রশ্ন করতে থাকে।মিসেস নিন্দু পল্লবীকে নানাভাবে অকথ্য ভাষায় গালাগালি করে।তবে আজ পল্লবী চুপ থাকেনা প্রতিটা কথার প্রতিবাদ করে।

মিসেস রায়ীনা এই কাজের জন্য নিজের মেয়েকে দোষারোপ করেন।তার প্রতিটা কথার মধ্যে সবচেয়ে জঘন্য কথাটা বলে উঠে নিজের মেয়েকে,
-“বরকে ধরে রাখতে পারিস না,কেমন মেয়ে তুই?সমাজের ভয় কর,বাড়ির ভিতরের ঝামেলা বাইরে কেন আসবে?তোর দোষ তুই সায়নকে বেঁধে রাখতে পারিসনা।নিজের রুপ দিয়ে কী করিস যে বর অন্যের পিছন ঘোরে..”
-“ছিঃ ছিঃ তুমি মা নামের কলঙ্ক।নিজের কাছেই ঘৃনা হচ্ছে তোমার মেয়ে হয়ে জন্মানোর জন্য।তবে আজ থেকে ভুলে যেয়ো তোমার কোনো মেয়ে আছে।কেননা আমার কাছে আমার পরিবার মৃত।সব সম্পর্ক এখানেও শেষ।”
-“হ্যাঁ,যা যা তোর মতো মেয়েও দরকার নেই।”
-“আর জারিকা তোদের সাথেও নূন্যতম সম্পর্ক রাখার ইচ্ছা নেই।ভুলেই আমার পরিবারের আশেপাশে তোকে না দেখি।”

জারিকা হাসতে হাসতে বলে,
-“সত্য খুব গায়ে লাগলো তাইনা আপু,নিজের বরকে প্রশ্ন করে দেখ সেকী আদেও তোকে আর তোর মেয়েকে চায়?”

সায়নের মুখে কোনো কথা নেই,মাথা নিচু করে আছে।চোখে মুখে এক অনুতপ্তে ভরা,সায়নের বাবা ওর দিকে তাকিয়ে বলে,
-“তুই আজ পর্যন্ত যা খুশি তাই করেছিস কিন্তু কিছুই বলেনি।কিন্তু আজ সব কিছু পার করে দিয়েছিস।তোকে তো কোনোদিন আরবির লাইনে নিতে পারিনি শিখবী কী করে মুর্খ।মেয়েকে তুই অকর্মা ভাবিস।আরে মুর্খ কান খুলে শোনে রাখ,
আল্লাহ তাআলা পবিত্র কোরআনে ইরশাদ করেন, ‘যখন তাদের কাউকে কন্যা সন্তানের সুসংবাদ দেওয়া হয়, তখন তার মুখ অন্ধকার হয়ে যায় এবং অসহ্য মনস্তাপে ক্লিষ্ট হতে থাকে।

তাকে শোনানো সুসংবাদের দুঃখে সে লোকদের কাছ থেকে মুখ লুকিয়ে থাকে। সে ভাবে, অপমান সহ্য করে তাকে থাকতে দেবে নাকি তাকে মাটির নিচে পুতে ফেলবে। শুনে রাখো, তাদের ফয়সালা খুবই নিকৃষ্ট। ’ (সুরা আন-নাহল, আয়াত : ৫৮-৫৯)

রাস‍ুল (সা.) মেয়েদের অনেক বেশি ভালোবাসতেন। মেয়েরা ছিল তার আদরের দুলালী। আজীবন তিনি কন্যাদের ভালোবেসেছেন এবং কন্যা সন্তান প্রতিপালনে অন্যদের উদ্বুদ্ধ করেছেন। কন্যা সন্তান লালন-পালনে অনেক উৎসাহ দিয়েছেন।

আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে নবী (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি দু’টি কন্যাকে তারা সাবালিকা হওয়া পর্যন্ত লালন-পালন করবে, কিয়ামতের দিন আমি এবং সে এ দু’টি আঙ্গুলের মতো পাশাপাশি আসবো (অতঃপর তিনি তার আঙ্গুলগুলি মিলিত করে দেখালেন)’। (মুসলিম, হাদিস নং: ২৬৩১, তিরমিজি, হাদিস নং: ১৯১৪, মুসনাদ আহমদ, হাদিস নং: ১২০৮৯, ইবনু আবি শাইবা, হাদিস নং: ২৫৯৪৮)

হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলনে, রাসুল (সা.) ইরশাদ করনে, ‘যার ঘরে কন্যা সন্তান জন্মগ্রহণ করলো, অতঃপর সে ওই কন্যাকে কষ্ট দেয়নি, মেয়ের ওউপর অসন্তুষ্টও হয়নি এবং পুত্র সন্তানকে তার ওপর প্রধান্য দেয়নি, তাহলে ওই কন্যার কারণে আল্লাহ তাআলা তাকে জান্নাতে প্রবশে করাবেন। ’ (মুসনাদ আহমদ, হাদিস নং: ১/২২৩)

হযরত আবদুল্লাহ উমর (রা.) বর্ণনা করেন, রাসুল (সা.) ইরশাদ করেন, ‘ওই নারী বরকতময়ী ও সৌভাগ্যবান, যার প্রথম সন্তান মেয়ে হয়। কেননা, (সন্তানদানের নেয়ামত বর্ণনা করার ক্ষেত্রে) আল্লাহ তায়ালা মেয়েকে আগে উল্লেখ করে বলেন, তিনি যাকে ইচ্ছা কন্যা সন্তান দান করেন, আর যাকে ইচ্ছা পুত্র সন্তান দান করেন। ’ (কানযুল উম্মাল ১৬:৬১১)
এসবের মর্ম তুমি কীভাবে বুঝবে?আশ্চর্য ব্যাপার যে এতদিন ধরে এত কিছু চলছে আর আমি কিছুই জানিনা।”
-“আব্বা আমি….”
-“চুপ কর বেয়াদপ,পরকীয়া করিস আবার বড় কথা বলিস।জানিসনা পরকীয়াকারী জাহান্নামের আগুনে পুড়বে।কান খুলে শুনে রাখ যদি মানুষ হতে পারিস,এসব পাপের জায়গা থেকে ফিরে আল্লাহর রাস্তায় আসতে পারিস তবে তোকে মাফ করবো।নয়তো তোকে ত্যাজ্যপুত্র করবো…”

কথাটা বলে কাসেম মন্ডল ছেলেকে পায়ের জুতা খুলে মারতে যান,কিন্তু পল্লবী সামনে দাঁড়িয়ে বাঁধা সৃষ্টি করে।আর শ্বশুড়কে কথা দেয় পরবর্তীতে সায়ন এমন জঘন্য কোনো কাজ করবেনা।সেদিনের পর থেকে সায়ন নিজেকে শুধরে নেওয়ার চেষ্টা করছে।প্রতিদিন নামায পড়ার চেষ্টা করে,কোরআন পড়তে পারেনা সেটা ধীরে ধীরে পল্লবী শিখাচ্ছে।
হঠাৎ পরীর আওয়াজে ওর ধ্যান ভাঙে।পরী ওর আধো আধো বুলিতে ডেকে বলছে,
-“মাম্মাম,আতো থেলবো একতাথে।”
-“আসছি আম্মুজান।”

পল্লবী মেয়েকে কোলে নিয়ে বলে,
-“আম্মুজান,আপনি যোহরের নামায পড়েছেন?”
-“তুমি তিলেনা,তাই পলা হয়নি।”
-“কেন আপনার আব্বুতো ছিলো?”
-“আব্বু,দাদুর তাথে নামাযে গেতিলো।”
-“ঠিক আছে,এরপরে আপনি আমার সাথে পড়বেন।”
-“পলবো পলবো তলো থেলি।”
পল্লবী সায়নের দিকে তাকিয়ে বলে,
-“ইয়ারাবী হাসপাতালে,দেখতে যাবে ওকে?”
-“তুমি যেতে চাও?”
-“অবশ্যই,ও আমাদের পরিবারের মত নিকৃষ্ট নয়।চমৎকার বুদ্ধিমান এক মেয়ে,অাফসোস হয় যদি ও নিজের বোন হতো।”
-“মানুষের সব চাওয়া পূর্ন হয়না।”
-“যেমন তোমার…”
-“পল্লবী আর কত ছোট করবে?প্লীজ আর এভাবে বলোনা।আমি অনুতপ্ত আমার কর্ম দ্বারা।”

বিনিময়ে পল্লবী কিছু না বলে মেয়ের সাথে খেলতে থাকে।মেয়েটা সত্যিই রুপকথার পরীর মতো মিষ্টি,সুন্দর।দু’পাশে দু’টো ছোট ঝুটি করা,হাসলে গালে টোল পরে,চেহারায় একটা মায়াবীভাব, দেখলে বোঝা যায় পল্লবীর মতো উঁচু,লম্বা হবে।এমন মেয়েকে কী ভাবে কেউ ঘৃনা করতে পারে?ওর আধোআধো বুলিতে সবার মন কেড়ে যায়, আর সেখানে নিজের বাবা একটা সময় ওকে ঘৃনা করতো।

(১৫৪)

ঘুম ভাঙার পর থেকে ইয়ারাবী দু’হাত দিয়ে মুখ ঢেকে কেঁদে চলেছে।কেউ ওকে আটকাতে পারছেনা।অনুর বাসায় ওর মাসি এসেছে,ডাক্তার দেখাবে তাই ওকে যেতে হয়েছে।আবরার কালকের অপারেশনের জন্য ডাক্তারের সাথে কথা বলছে, ইফাজ ওটিতে।মিসেস রায়হান আর ইকরা কিছুতেই ওকে আটকাতে পারছেনা।ওর এক খালা মিসেস দিপ্তী ওনার স্বামী আর মেয়ের সাথে এসেছেন।জারা বুঝতে পারছেনা ইয়ারাবীর কাঁদছে কেন?জারা ওর পাশে বসে বলছে,
-“আপিপু কাঁদছো কেন তুমি?কী হয়েছে বলতো আর খালা কোথায়?”

মিসেস দিপ্তী জারাকে উদ্দেশ্য করে বলেন,
-“সাদি,তোমার আপিপু সিক আছে।প্লীজ কোনো প্রশ্ন করোনা।”
-“আম্মু আমি ছোট বাচ্চা নই,নিশ্চয়ই কিছু হয়েছে যার জন্য আপিপু কাঁদছে।”
-“পাগলী,ইস্মার কাল অপারেশন,ভয় পাচ্ছে বলে কান্না করছে।ইস্মা মা প্লীজ কান্না করিস না।তুই জানিস,এভাবে কান্না করলে তোর ব্রেনে চাপ পরবে যাতে করে বেশি সমস্যা হতে পারে।”

মিসেস দিপ্তীর সাথে ইয়ারাবীর তেমন একটা সম্পর্ক নেই।তবে মহিলাটি বেশ ভালোই,মানুষের ভালো করার চেষ্টা করে।ওনার স্বামী মি.ইয়াকুব সব সময় গম্ভীর থাকতে ভালোবাসেন,প্রয়োজন ব্যতিত কোনো কথা বলেন না।বলেন না বললে ভুল হবে আসলে বলতে চান না।কেননা ওনার গলার স্বর প্রচুর মোটা,যদি মানুষ দূর থেকে শুনে তবে মনে হয় কাউকে ধমকাচ্ছেন,আসলে ওনার চেহারাটা রাগী রাগী ধরনের কিন্তু মানুষটা বেশ ভালো।

মি.ইয়াকুব এতক্ষণ ধরে সবার কথা শুনছিলেন হঠাৎ উনি বলে উঠেন,
-“তুমি কান্না করছো কেন?আমার দেখা সাহসী মেয়ে তুমি।সামান্য কাঁটা-ছেড়াতে ভয় পাচ্ছো।তুমি তো এমন ছিলেনা।”
-“আব্বু আপিপুর অন্য কিছু হয়েছে।কিন্তু বলতে চাইছেনা কিছু।”

মিসেস রায়হান ইয়ারাবীকে নিজের বুকে আগলে ধরে বলেন,
-“তেমন কিছুনা জারা,ভয় পাচ্ছে তাই কান্না করছে।”
-“ভাইয়া কোথায়?”
-“ডাক্তারের সাথে কথা বলছে।আম্মু কান্না বন্ধ কর,আমাকে যদি মা ভাবিস তবে কান্না থামা।”
-“আপনাকে মা মনে করি বলেই তো ডাকি।”
-“তাহলে চুপ কর…”

এর মধ্যে আবরার কিছু রিপোর্ট হাতে করে কেবিনে ঢুকে দেখে ইয়ারাবী ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্না করছে।এমনিতে কিছু খেতে পারছেনা তার উপর কান্না,শরীরের রক্তও বেশি নেই এসব ভেবে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মিসেস দিপ্তীদের সাথে কুশল বিনিময় করে।ওর মায়ের দিকে তাকিয়ে বলে,
-“মম্ তোমরা বাসায় চলে যাও,অনেকক্ষণ তো এসেছো।”
-“আর কিছুক্ষণ থাকি,তুই তো এদিক-ওদিক দৌঁড়াচ্ছিস মেয়েটা যে একা থাকছে।”
-“আর যাবোনা,নার্স আছে।তুমি ভাবী আর জারুকে নিয়ে বাসায় যাও।ড্রাইভার গাড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, শোনো ভাইয়া অথবা মেঘকে রাতে আসতে বলবে কাজ আছে।”
-“ঠিক আছে মেয়েটার খেয়াল রাখিস।কাল তো খেতে পারবেনা আজ একটু খাইয়ে দিস।”

আবরার মৃদু হেসে মাথা নাড়ায়।মিসেস রায়হান ইয়ারাবীর মাথায় চুমু দিয়ে কিছু কথা বলে চলে যান।ওর খালারাও ওনাদের সাথে বেড়িয়ে পরে, জারা অবশ্য থাকতে চেয়েছিলো কিন্তু কোচিংএ পরীক্ষা বলে চলে যেতে হয়।ওরা চলে যেতেই আবরার নার্সকে ইশারা করে বাইরে বের হতে বলে।নার্সও বাইরে চলে যাওয়ার সময় দরজাটা লাগিয়ে দেয়।আবরার দু’পকেটে হাত ঢুকিয়ে ইয়ারাবীর সামনে আস্তে আস্তে হেঁটে আসে,ওতো ভয়ে ওর দিকে তাকাচ্ছেনা।মাথা নিচু করে ফুঁপিয়ে যাচ্ছে।আবরার গলাটা একটু ঝেড়ে বলতে শুরু করে,
-“আমি ঠগ জীবন পছন্দ করিনা,আর ঠগ ভাবে চলাও আমার পছন্দ হয়না তবে ঠগ জীবন আমাকে বেঁচে নিয়েছিলো।”

ইয়ারাবী অবাক হয়ে ওর দিকে তাকায়।আবরার মুচকি হেসে ওর সামনে হাঁটতে হাঁটতে বলে,
-“সফল হওয়ার জন্য,তোমাকে অবশ্যই ঠিক করতে হবে যে তুমি কী অর্জন করতে চাও, তারপরে এটি পাওয়ার জন্য মূল্য দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে হবে।আমি জানি তুমি কিছুই বুঝতে পারছোনা।হ্যাঁ,আমি বিয়ের আগেই জানতাম কারন তোমার খালা আমাকে সবটা বলেছিলো।বিয়ের পরেও তোমাকে যখন চেক-আপ করতে নিয়ে যায় তখনও জানতে পারি তুমি মা হতে পারবে তবে চান্স অনেকটা কম।ট্রিটমেন্টের মাধ্যমে সম্ভব,তাই রোজ রাতে যে মেডিসিনগুলো আমি তোমাকে দিতাম এগুলো সে জন্যই।
ইয়ারাবী আল্লাহর উর্ধ্বে কারোর কিছু করার থাকেনা।উনি যেভাবে চান সেভাবেই সবটা হয়।উনার হুমুক ছাড়া একটা গাছের পাতাও নড়েনা।জারিকা বললো,তুমি বাজা মেয়ে।তুমি মা হতে পারবেনা।আচ্ছা বলতো আদেও কী তোমার বা আমার হাত আছে উনি যদি না চান?
আর ঠগ কেন বললাম?কারন আমি তোমাকে প্রতি মুহুর্তে এটা নিয়ে ঠকিয়েছি।তোমার মেন্টাল কন্ডিশন মোটেও ঠিক নেই,তোমাকে এসব বলতাম তো সহ্য করতে পারতেনা।আচ্ছা,কারোর জীবন বাঁচানোর জন্য যদি মিথ্যা বলা হয় তাহলে কী পাপ?আমিও তাই করেছি,তবে তুমি আমাকে বললে সুবিধাবাদী।তোমার শরীর চাই বলে আমি বিয়ে করেছি।আচ্ছা,ইয়ারাবী সত্যিই যদি তাই হতো তবে সেটাতো অনেক আগেই করতাম।তারপরও তোমার এমনটা মনে হলো জারিকার কথা শুনে।”

ইয়ারাবী বুঝতে পারছে ও আবেগে-রাগের বসে কত বড় কথা বলে ফেলেছে?সত্যিই আবরার এমন হতো তবে অনেক আগেই করতো।কিন্তু ও তো সেটা করেনি।বরং ওকে জানতে না দিয়ে প্রতিটা মুহুর্ত ওকে সাহায্য করেছে,ওকে ট্রিটমেন্ট করছে যাতে ঠিক হতে পারে।ইয়ারাবী এতক্ষণ ধরে ফুঁপালেও নিজেকে আর ধরে রাখতে পারেনা।আবরার ওর সামনে পকেটে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলো।ও আর এক মুহুর্ত দেরি না করে আবরারকে ঝাপটে ধরে কান্না করতে থাকে আর বলে,
-“স..স্যরি,আমি জানিনা আমি কী বলেছি আপনাকে?প্লীজ আমাকে ক্ষমা করে দিন।আপনি যদি আপনার পা ধরে ক্ষমা চাইতে বলেন তাও করবো তবুও ক্ষমা করে দিন।”

আবরার ওর মাথায় হাত রেখে বলে,
-“উহু,পায়ে ধরে চাইতে বললোনা।তবে এত সহজে ক্ষমা করবো সেটাও ভেবোনা।আমি যা বলবো সেটা যদি করো তবেই তোমাকে ক্ষমা করবো।”
-“আপ..আপনি যা বলবেন তাই করবো।”
-“তাহলে কান্না বন্ধ করে লক্ষ্মী মেয়ের মতো বসো, এটাই করতে হবে।”

ইয়ারাবী ওর বুক থেকে মুখ তুলে ওর দিকে তাকালে আবরার হেসে ওর চোখের পানি মুছে দেয়।তারপর ওকে বসিয়ে ওর সামনে বসে বলে,
-“ভয় পেয়েছিলে?”
-“হুম….আপনি চলে যাবেন নাতো আমাকে ছেড়ে।”
-“কেন যাবো?”
-“যদি মা হতে না পারি।”
-“সেটাই কিছু যায় আসেনা।”
-“যদি আমার প্রতি তিক্ত হয়ে যান।”
-“কোনো প্রশ্নই আসেনা।”
-“যদি বোরিং হয়ে যায়,আপনি কী তবুও আমাকে এভাবে ভালোবাসবেন?সবাই যখন আঙ্গুল তুলে বলবে তখন কী করবেন?”
-“তুমিতো মানুষের কথা গায়ে মাখোনা।”
-“কিন্তু শুনতে শুনতে আপনার খারাপ লাগবে তখন আর আমাকেও ভালো লাগবেনা।বিরক্ত এসে যাবে আমার প্রতি…”
-“জীবনে প্রথম আর শেষ ভালোবাসা তুমি।একটা কথা কী জানো,আমার প্রতিটা পাতায় জীবন মানে শুধুই তুমি।”

ইয়ারাবী ওর কথা শুনে ওর দিকে তাকিয়ে থাকে অবাক চোখে।একটা ছেলে কতটা ভালোবাসতে পারে,আজকাল এমন ভালোবাসা কয়জনে পায়।এখন ইয়ারাবীর সত্যিই গর্ব হচ্ছে নিজেকে নিয়ে, ওর ভাগ্য এতটাও খারাপ নয়।হঠাৎ করে ও আবরারের গলা জড়িয়ে ধরে বলে,
-“ভালোবাসি…”

আবরারের বুঝতে একটু সময় লাগে,যখন বোঝে ও আসলে কী বলেছে তখন খুব অবাক হয়ে যায়।কেননা ইয়ারাবীর চোখে ভালোবাসা,গভীর শ্রদ্ধা দেখা গেলেও মুখে কখনো বলতোনা।ও মুচকি হেসে ওর পিঠে হাত রেখে বলে,
-“তো ম্যাডাম বিয়ের পাঁচ মাস পরে সত্যটা স্বীকার করলেন।”

ইয়ারাবী কিছুটা লজ্জা পেয়ে ওকে ছেড়ে দিতেই হঠাৎ করে ডান হাতে টান লাগতেই ব্যাথাই কুকরে উঠে।আবরার ওর হাতে ফুঁ দিয়ে বলে,
-“আস্তে আস্তে সব করবে।দেখলে কেমন ব্যাথা পেলে।”
-“আপনি তো বলেছিলেন আর লাগবেনা তবে এখন কেন চলছে।”
-“তোমার শরীর দুর্বল হয়ে পরেছিলো।দুপুরে খাওনি এখন খেতে হবে,আমি নার্সকে খাবার আনতে বলছি।”
-“আপনি খেয়েছেন?”
-“আমি,হুমম খেয়েছি।”
-“মিথ্যা,কিছু খাননি আমি জানি।”
-“বাচ্চা বড় হচ্ছে।”
-“সব সময় এমন কেন করেন?আবরার..”
-“বলো?”
-“অনুকে দেখছিনা।কোথায় ও,আমার উপর রাগ করে চলে গেছে?”
-“না পাগলী,ওর মাসী ডাক্তার দেখাতে ঢাকায় এসেছে।তাই বাসায় গেছে।”
-“ওহ্হ্…”
-“মন খারাপ করবেনা,বিপি আপ-ডাউন করলে সমস্যা।কাল সকালে আরেকবার টেস্ট করতে হবে, যদি আল্লাহর রহমতে সব ঠিক থাকে তবে কালই অপারেশন।তুমি যা করেছে আল্লাহ জানে কী অবস্থা।”
-“আমার ভয় করছে।”
-“আমি আছিনা,কোনো ভয় পাবেনা।”
-“মাথাটা ভার ভার লাগছে…”
-“কিছু খাওনি,কাঁদছো এই জন্য।দেখি বালিশে একটু শোও,আমি নার্সকে…”
-“বালিশে নয়…”
-“তাহলে?”
-“বুকে,অভ্যাস হয়ে গেছে।এজন্য কালও ঘুমাতে পারিনি…”
-“হাতে তো স্যালাইন চলছে,আর বাম হাতেও তো ব্যাথা।”
-“উহু আমি বুকে মাথা রাখবো।বিয়ে করা বৌ আমি…”
-“পাগলি,আচ্ছা আমি আসছি তুমি বসো।”

(১৫৫)

রাত আটটা বাজে,মিসেস ফাতেমা ওকে খাইয়ে দিচ্ছে।খেতে চাইনি কেননা বিকালে অনেক খাবার আবরার জোর করে খাইয়েছে।এখন আবরার চোখ রাঙানির ভয়ে খেতে হচ্ছে,এক গাল করে খাবার নিচ্ছে আর আবরারের দিকে তাকাচ্ছে।তারা ওর গাল টেনে বলে,
-“যাক,একটু ভয়ে ভয়ে হলেও তো খাচ্ছিস।”
-“বিয়ে করো বুঝবে তুমি।”
-“য়ুহার শুনেছিস পুতুলের কথা।”

য়ুহার ফোন থেকে চোখ সরিয়ে বলে,
-“সবাই কী ওর মতো ভিতু নাকী?”
-“কপাল,সবটাই কপাল বুঝলে আপু।আমার হলো পুড়া কপাল,যে বাঘের সাথে বিয়ে হয়েছে।”

শেষের লাইনটা বিরবির করে বলে।য়ুহার কিছুটা ভ্রু কুচকে বলে,
-“কী বলছিস?”
-“নিশ্চয়ই তোমার বোন আমাকে নিয়ে কিছু বলছে যার জন্য বিরবির করছে।”
-“তা যা বলেছো।আচ্ছা ব্লাডের জন্য কন্টাক করেছো?”
-“চিন্তা নেই,ওর নেগেটিভ।আমার ভাইয়ারও নেগেটিভ,তাছাড়া ভাইয়ার এই পর্যন্ত কোনো অসুখ হয়নি যার জন্য বড় কোনো মেডিসিনও প্রয়োজন হয়নি।আর দ্বিতীয় জন হলো আমার এক ফ্রেন্ড,ও প্রায়ই ব্লাড দেয়।”
-“আমাদের ফ্যামিলির মধ্যে একমাত্র ইয়ারাবীরই নেগেটিভ।”
-“এটা সহজে মেলেনা।”

তারা ইয়ারাবী বাম পাশে বসে আছে।ও মাথা সোজা করে বসতে পারছেনা,তাই তারার সাথে কিছুটা হেলান দিয়ে বসে খাচ্ছে।হঠাৎ করে মি.ফুয়াদ আর মিসেস ইশানি কেবিনে ঢোকে।আজ আবরারের খুব রাগ হচ্ছে এদের দেখে।মি.ফুয়াদ মেয়ের সামনে দাঁড়িয়ে বলে,
-“কাজটা তুমি একদম ঠিক করোনি।জারিকা-মিলিস্তাকে জেল থেকে বের করো।”

ইয়ারাবী নরমাল ভাবেই বলে উঠে,
-“দুঃখীত,এই ব্যাপারে আমি কিছু জানিনা।”
মিসেস ইশানি মেয়ের সামনে যেয়ে বলেন,
-“দেখ পরিবারের মধ্যে এমন ঝামেলা বাঁধানোর কী আছে?তোর তো আপু হয়।আজ যদি য়ুহার বা তারা থাকতো তবে কাজটা করতে পারতি।”
-“য়ুহার বা স্টারপু কখনো আমার খারাপ চাইনা।আর রইলো ওদের বের করার কথা,এই বিষয়ে আমার কিছু করার নেই।আমার স্বামী,ভাইয়ার কাছে যেটা সঠিক লেগেছে সেটাই করেছে।আর উনাদের উপরে কথা বলার বা কাজকে উপেক্ষা করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।আপনারা চাইলে উনাদের বলতে পারেন।”

ওর বাবা-মা ছাড়া ইয়ারাবীর কথা শুনে সবাই মুচকি মুচকি হাসে।তবে উনারা খুব অবাক হয়, কেননা এই মেয়ে কখনো শান্ত কন্ঠে দৃঢ় জবাব দেয়নি। উনারা নিজেদের মুখ চাওয়া-চাইয়ি করেন আর বুঝতে পারেন ওনাদের জামাই বা ইফাজকে বলে কোনো লাভ নেই।উনাদের জামাই যদিও বা হতো তবে ইফাজের জন্য সম্ভাব নয়।উনারা মুখ কালো করে বের হয়ে যান কেবিন থেকে।মিসেস ফাতেমা ওকে পানি খাইয়ে দিয়ে বলেন,
-“হঠাৎ এভাবে কথা বললি যে?আগে তো কখনো শুনিনি।”
-“সময়ের সাথে সব পরিবর্তন করতে হয় মনি,শুধু তাদের জন্য ভাবতে হবে যারা আমার ভালো চায়।প্রতিবার শত্রুকে ক্ষমা করে দিলে তারা শুধরাবার বদলে বারবার আঘাত করবে,তাই সব সময় দুর্বলতা দেখাতে নেয়।আমার আপজন সেটাই শিখিয়েছে।”
কথাটা বলে আবরারের দিকে তাকিয়ে দেখে ও মুচকি হাসছে।ইয়ারাবীও ওকে দেখে হাসি দেয়।

#চলবে_____

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here