#জীবন মানে তুমি
#লেখিকা:H.B.Rini (Irini Ori)
#পর্ব:৪৪
(১৪৮)
-“তুমি এখানে কী করছো?”
কথাটা শোনার সাথে সাথে ইয়ারাবী আর অনুর পা যেন থেমে যায়।লক্ষ্য স্থীর সামনের টেবিলে বসা জারিকার দিকে,কিন্তু মস্তিষ্ক তার পেছনের ব্যক্তির কন্ঠস্বরে।বারবার জানান দিচ্ছে,,”নিজের পায়ে নিজে কুড়াল মেরেছো।অদ্ভুত ভাবে তার এখানে উপস্থিত থাকার কোনো কথা নয়।তার থেকে বড় কথা চিনলো কীভাবে?”নানা কথার বানী নিজের মস্তিষ্কে আওড়াতে লাগলো।বিস্মিত হয়েছে তার সাথে ভয়ও পাচ্ছে।কেননা জীবনে প্রথমবার মিথ্যা বলেছে তার কাছে।নানা চিন্তা-ভাবনার মধ্যে আবার সেই চিরচেনা কন্ঠ বলে উঠলো,
-“হুয়াট হ্যাপেন্ড?কিছু আকস্ করছি তোমাকে?”
অনু পাশ থেকে ইয়ারাবীকে গুতা দিয়ে বলে,
-“তুই বললি,জিজু যাতে না জানে সেই জন্য এখানে আসা।বাট্ জিজু তাহলে এখানে কী করছে?”
-“আমি কীভাবে বলবো,তোর জিজু এখানে কেন?কিন্তু অনু উনি জানলে আমার অবস্থা খারাপ করে ফেলবে?আমি বুঝছিনা উনি চিনলো কীভাবে?”
-“বৌকে চিনবে নাতো পাশের বাসার বৌদিকে চিনবে বিয়াদপ মেয়ে?তাছাড়া হতে পারে আমাকে দেখে।এসব পরে ভাবিস,আগে সামলা।”
ইয়ারাবী নিজেকে সামলে পিছনে ঘুরে দেখে আবরার ওর থেকে চার কদম দূরত্বে পকেটে হাত ঢুকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।গায়ে নীল রঙের টি-শার্ট তার উপর ব্লাক কোটি,মাশাল্লাহ্ ইয়ারাবী বারবার নতুন করে প্রেমে পরে যায়।ওকে তাকিয়ে থাকতে দেখে পাশ থেকে অনু হালকা ধাক্কা দেয়।ইয়ারাবী আবরারের দিকে তাকিয়ে বলে,
-“এখানে আপনি?”
-“আমার কথা ছাড়ো তুমি এখানে কেন?”
-“আ..মি আসলে….”
আবরার ভ্রু যুগল কুচকে ওর দিকে সন্দেহের চোখে তাকিয়ে বলে,
-“তুমিতো বলেছিলে,য়ুহারের সাথে দেখা করতে যাবে।আমার মতে ওর বাসা তো এই স্থানে নয়।”
-“আমি দেখা করতে যাবোই তো,কিন্তু…এই অনু বললো ওর কাজ আছে এখানে।তাই আসা, তারপর আবার খাদকের মতো কফির বায়না।”
-“হুম,এবার বুঝলাম,মেঘ কেন তোমাদের জোড়া কবুতর বলে।যায় হোক,কিন্তু আমার এমন কেন মনে হচ্ছে তুমি কিছু লুকাচ্ছো?”
ইয়ারাবী কি বলবে বুঝতে পারছেনা।অনু ব্যাপারটা স্বাভাবিক করার জন্য ওর তালে তাল মিলিয়ে বলে,
-“না জিজু,ও কী লুকাবে?যা বলছে একদম সত্যি।কিন্তু বুঝছিনা আপনি কোথার থেকে টপকা না মানে এখানে কী করছেন?”
-“হ্যাঁ,মানে আপনি এখানে কেন?আপনিতো এদিকে আসেন না।”
আবরারের ওদের কথার ধরন শুনে বুঝতে একটুও দেরি হয়না যে ওরা কিছু লুকাচ্ছে।ও বিষয়টাকে বেশি উপস্থাপন না করে মুচকি হেসে বলে,
-“একটা পেসেন্টের মায়ের সাথে দেখা করতে এসেছিলাম।বের হতে যেয়ে দেখি তোমরা ঢুকছো।”
-“জিজু আপনি বুঝলেন কী করে এটা ইয়ারাবী?”
-“হাতের ব্রাসলেট তার উপর তুমি তো আছোই।তাছাড়া নিজের অস্তিত্বকে চিনা এতটা কঠিন নয় বুঝলে শ্যালিকা।”
-“ওরে বাবাহ্,যাক আপনি পারেন ও বটে।কিন্তু আপনি এতবড় অ্যাক্সিডেন্ট করে অন্ততপক্ষে দু’দিন রেস্ট নিতে পারতেন।”
-“আরে তেমন কিছু নয়,তাছাড়া ডাক্তার যদি আরাম করে তবে পেসেন্ট দেখবে কে?আচ্ছা,কফি খাবে জন্য এসেছিলে,তাহলে আজ আমি ট্রিট দেয়।”
ইয়ারাবী চমকে দ্রুত বলে উঠে,
-“না না,আপনার দেরি হয়ে যাবে।আপনি যান, আমরা…”
-“লিসেন্ হানি,আমার আর কোনো কাজ নেই।তাছাড়া ছয়টা বাজতে চললো,আজতো আর আপুর সাথে দেখা করতে পারবেনা।সো তোমাকে সাথে নিয়েই বাসায় ফিরবো।”
ইয়ারাবী অনুর দিকে তাকায়।অনুর বা এখানে করার কী আছে?তবে ইয়ারাবী ফেসে গেছে এটা ঠিক বুঝতে পারছে।তার থেকে বড় কথা,আবরার যদি একবারের জন্য জারিকাকে দেখে তবে খুব বাজে একটা ব্যাপার ঘটবে।অনু হেসে আবরারের দিকে তাকিয়ে বলে,
-“হুম জিজু,যখন আপনি কফির অফার করলেন তখন সেটা না বলি কীভাবে?তবে আমার এখন মন ফুসকা ফুসকা করছে।সামনে একটা ফুসকার স্টল আছে।চলুন ফুসকা খাওয়াবেন।”
-“শ্যালিকা,তোমার বান্ধুবীর সমস্যা না হয় তবে চলো।”
ইয়ারাবী ওর দিকে তাকিয়ে বলে,
-“কোনো সমস্যা হবেনা,চলুন যায়।তাছাড়া অনেক দিন হলো খাইনা।”
-“ঠিক আছে চলো যায়।”
আবরার ওদেরকে সাথে নিয়ে কফি হাউসের বাইরে বের হওয়ারা সাথে সাথে ওরা যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো।ইয়ারাবী পার্স থেকে ফোন বের করে জারিকাকে দ্রুত টেক্সট করে দিলো যে ওরা এই মুহুর্তে দেখা করতে পারবেনা,পরে সময় হলে করবে।হঠাৎ করে আবরার ওর দিকে তাকিয়ে বলে উঠে,
-“ফোনে কী করছো?”
-“ক্ কিছুনা,মনে হলো কল এসেছে তাই চেক করলাম।”
-“আচ্ছা তোমরা অর্ডার করো তাহলে।তা অনু তুমি কী কাজে এখানে এসেছিলে?”
অনু পানির বোতল খুলে কেবল মুখে দিয়েছিল,ওর কথা শুনে চোখ বড়বড় করে ইয়ারাবীর দিকে তাকায়,কিন্তু ইয়ারাবী এমন ভান করে যেন সে কিছু শোনেনি।ও কনুই দিয়ে ইয়ারাবীকে গুতা দিচ্ছে কিন্তু ওর কোনো হেলদোল নেই।নিজের মতো ফোন টিপছে,তবে আবরার ওদের কাহিনি দেখে মুচকি মুচকি হাসছে।ইয়ারাবী বিরক্ত হয়ে অনুর দিকে তাকিয়ে বলে,
-“কী হলো বল কেন এসেছিস?”
-“আমি বলবো?”
-“তাছাড়া কে বলবে?”
অনু কিছুটা বিরক্ত নিয়ে ইয়ারাবীর দিকে তাকায়।পরক্ষণে অনু কিছুটা একটা ভেবে বলে,
-” আসলে জিজু,ব..বই কিনতে এসেছিলাম।”
আবরার বাম চোখের ভ্রুটা কিছুটা উঁচু করে সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,
-“তা বই কোথায়?দেখছিনা তো,তার থেকে বড় কথা বই কিনতে এত দূরে এসেছো?”
-“আসলে যা খ্ খুঁজতে এসে…..”
হঠাৎ একটা তীক্ষ্ণ আর্তনাদের শব্দে আবরার-অনু দু’জনেই চমকে ইয়ারাবীর দিকে তাকিয়ে দেখে,ও নিজের হাত দ্বারা মাথা চেপে আছে।মুখে নেকাব দেওয়া,তবে চোখ দেখে বোঝা যাচ্চে খুব কষ্ট পাচ্ছে।আবরার দ্রুত চেয়ার থেকে উঠে ইয়ারাবীর পাশে দাঁড়িয়ে দু’হাত দ্বারা ওর বাহু ধরে উত্তেজিত কন্ঠে বলে উঠে,
-“ইয়ারাবী কী হচ্ছে?খারাপ লাগছে তোমার?”
কথাটা বলার সাথে সাথে ইয়ারাবী জ্ঞান হারিয়ে আবরারের গায়ে ঢলে পরলো।এতে করে অনু প্রচুর ভয় পেলেও আবরার প্রথমে এটা নরমাল ভাবে।কেননা ইয়ারাবী প্রায়ই এমন করে,তাই আবরার ওর নেকাব খুলে মুখে পানি দেয়।কিন্তু এবারে ওর জ্ঞান ফেরেনা।আবরার মনে প্রাণে দোয়া করছে যা ভাবছে সেটা যেন না হয়,কেননা ওর পক্ষে সহ্য করা সম্ভব নয়।ও অন্য কিছু চিন্তা না করে অনুকে সাথে নিয়ে হাসপাতালের উদ্দেশ্যে বেড়িয়ে পরে।পথে ফোন করে ইফাজকে সবটা জানিয়ে দেয়।জ্যাম থাকার কারনে দু’ঘন্টা মতো সময় লাগে হাসপাতালে পৌঁছাতে।
আবরারের মতো ইফাজও কিছুটা ধারনা করে,যার জন্য প্রথমে কিছু টেস্ট করিয়ে নেয়।ইয়ারাবীকে কেবিনে রাখা হয়েছে,হাতে স্যালাইন চলছে,গায়ে হাসপাতালের পোশাক।মুখটা শুকিয়ে গেছে,মাত্র কয়েক ঘন্টার ব্যাবধানে কী হয়ে গেলে?আবরার ডা.রুপকের সাথে কথা বলছে,বাকী সবটাই সামলাচ্ছে।এখনো কাউকে ফোন করে জানায়নি ঘটনাটা।অনু ইয়ারাবীর পাশে বসে কিছু চিন্তা করছে।হঠাৎ আবরার কেবিনে আসে,তবে মুখ দেখে বোঝা যাচ্ছে কিছু হয়েছে।আবরারকে দেখে নার্স বাইরে চলে যায়।অনু ওর দিকে তাকিয়ে বলে,
-“রিপোর্টে কী এসেছে?”
আবরার ইয়ারাবীর পাশে বসে বাম হাত ওর মাথায় রাখে আর ওর ডান হাতটা নিজের মুঠোর ভিতর নিয়ে বলে,
-“ওর যেখানে রক্ত জমে ছিলো সেখানে টিউমারের আকার ধারন করেছে।টিউমার নয় তবে পরবর্তীতে হতে কতক্ষণ,রিপোর্ট বেশি ভালো আসেনি।”
-“কী?কীভাবে সম্ভব?ও তো মেডিসিন নিতো, তাহলে?”
-“মেডিসিন নিলে এমনটা হওয়ার কথা নয়।নিশ্চয়ই কিছু হয়েছে সেটা আমার অগোচরে।আমার মতে মাত্র দু’দিন ওর মেডিসিন গ্যাপ পরেছে…”
-“জিজু,আমি ইয়ারাবীকে খুব ভালো করে চিনি।ওর একটা বদ অভ্যাস আছে,যখন খুব বেশি অসুস্থবোধ করে ঠিক তখন মেডিসিন নেয় তার আগে নয়।”
-“কিন্তু অনু,আমি তো বাসায় ফিরে মেডিসিনের প্রতিটা পাতা চেক করতাম।তখন তো এমন কিছু দেখিনি।”
-“হতে পারে ফেলে দিয়েছে।ও আপনাকে ভয় পায়,আপনি বকবেন এই জন্য মনে হয় এমন কোনো কাজ করেছে।”
আবরার অবাক হয়ে অনুর দিকে তাকিয়ে বলে,
-“তুমি এতটা নিশ্চিত কীভাবে?”
-“আগে এসব দেখেছি তাই জানি।এই জন্য ও যখন অসুস্থ হতো খালা ওর বাসায় থাকতো নয়তো নিজের কাছে রাখতো ওকে।কেননা আন্টি-আঙ্কেল ততোটা কেয়ার করতো না।একবার তো রাতের বেলা জ্বরের ঘোরে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলো কিন্তু আন্টি বা আঙ্কেল কেউ ওর ঘরে পর্যন্ত যায়নি।ওদের বাসায় যে মেয়েটা কাজ করে সে সকালবেলা গোপনে ওর খালাকে ফোন করে।মিনা এই বাসার সব খবর ওর খালাকে দিতো যার জন্য ইয়ারাবী আজও মরতে মরতে বেঁচে আছে।”
-“তুমি এসব কীভাবে জানো?”
-“বোকার মতো প্রশ্ন করলেন জিজু?ওর খালার পরে যদি কারো কাছে মন খুলে কিছু বলতো সে হলাম আমি।বাসায় কাউকে জানিয়েছেন?”
-“না,এখনো জানায়নি।দেখি স্যার কী বলে? দেখো,সাড়ে আটটা মতো বাজতে চললো,তুমি বরং বাসায় যাও।আমি তোমাকে ফোন করে সবটা জানাবো।”
-“ইয়ারাবী শুধু বান্ধবী নয় আমার বোনও বটে।তাছাড়া বাসায় আমি একাই থাকি,ওর এই অবস্থায় বাসায় যেয়ে শান্তি পাবোনা।তার থেকে বরং এখানে থাকি।”
-“কিন্তু…”
-“প্লীজ..”
-“ঠিক আছে,তবে কিছু খেয়ে এসো।মানা করবেনা,যদি রাতে থাকতে হয়।সামনে একটা হোটেল আছে,অল্প হলেও খেয়ে আসো।”
-“আপনিও কিছু খাননি মনে হয়?”
আবরার হালকা হেসে বলে,
-“তুমি এলে আমি না হয় যাবো।ওর জ্ঞান ফেরেনি, তাছাড়া ওর ভাইয়া দৌঁড়া-দৌঁড়ি করছে কাজে।তুমি যাও….”
-“আচ্ছা।”
অনু কথাটা বলে পাশের থেকে ব্যাগটা উঠিয়ে কেবিন থেকে বেড় হয়ে গেলে।ওর যেতে মন চাইছেনা,তবে আবরার যা বলেছে তা ঠিক…রাতে যদি থাকতে হয়।ওর গ্যাসের সমস্যা আছে,না খেয়ে থাকতে পারেনা আবার,তার মনের সাথে যুদ্ধ করে হাসপাতাল থেকে বের হয়ে যায়।আবরার ইয়ারাবীর মুখের দিকে তাকিয়ে বলে,
-“তোমার এই অবস্থায় আমার গলা দিয়ে যে খাবার নামবেনা।এত করে বলি নিজের কেয়ার করো,কিন্তু তুমি শুনবেনা কথা?নিজের ক্ষতি নিজেই করলে,কোনো আন্দাজা আছে তোমার কী হয়েছে?আমিও না কী ভাবছি?তোমার কিছু হতে পারেনা,তুমি আমার প্রতিটা নিঃশ্বাসে থাকবে।আমার অস্বস্তিই তো তুমি,আমি না থাকলেও তুমি থাকবে।আমির প্রতিটা নিঃশ্বাস,আমার উপস্থিতি, আমার অস্বস্তিকে টিকিয়ে তো তোমাকেই রাখতে হবে।কেন বোঝনা কথাগুলো,আমার জীবনের প্রতিটা মানে যে তুমি হয়ে আছো।এই কয়েকমাসে তোমাকে ছাড়া নিজেকে ভাবা খুব কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে।”
-“আসলে সম্পূর্ন দোষ ওর না,ওর বাবা-মায়ের।কথায় কথায় এতটা বাজে ভাবে মেরেছে যার জন্য আজ এই অবস্থা।”
আবরার তাকিয়ে দেখে ইফাজ এসে ওর পাশে দাঁড়িয়ে আছে।ইফাজ স্যালাইনটা চেক করে বলে,
-“অপারেশনটা করতে হবে,ডাক্তার রিস্ক নিতে চাইচ্ছেনা।তাছাড়া ও ঔষধ ঠিকমত খায়নি, যার জন্য এমন হয়ে গেছে।”
-“আরে নিজের ভালো তো পাগলেও বোঝে।”
-“জীবনের প্রতি মায়া না থাকলে যা হয় আরকী।আচ্ছা শোন বাসায় ফোন করে জানিয়ে দে।”
-“হামম সেটাতো করতে হবে।”
-“তুই কাঁদছিস?তোকে কান্না মানায়না আবরার।দুর্বলতা আর ইমোশন্ তোর সাথে যায়না।”
-“তুই ওতো কেঁদেছিস।আমি শুধু ভাবছিস ব্যাথা সহ্য করবে কীভাবে?সামান্য মাথা যখন ব্যাথা করে কতটা ছটফট করে সেটা আমি দেখেছি।”
-“তোকে শক্ত থাকতে হবে।”
ইফাজের কথার পিঠে আবরার কোনো কথা বলেনা।হ্যাঁ,এটা ঠিক আবরারকে দুর্বলতা বা ইমোশন কোনো কিছু গ্রাস করতে পারেনা।ও প্রচুর শক্ত মনের মানুষ,যে কোনো পরিস্থিতিতে ওর মুখে সর্বদা এক টুকরো হাসি থাকবে।তবে আজ ওর ভিতরের সেই শক্ত মজবুদ জায়গাটা ভেঙে গেছে।তবে ওকে মানিয়ে নিতে হবে।এটাই সবার জন্য ভালো হবে।
(১৪৯)
জারিকা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে পরখ করছে।গায়ে সেই সুঁতির শাড়িটা জড়ানো আছে, মাত্র কয়েকদিনের ব্যাবধানে মুখের নানা জায়গায় ডার্ক সার্কেল আর ব্রোনের আনাগোনা শুরু হয়েছে।যেই মেয়েটা দামী শাড়ির আর গয়নার কথা ভেবে সর্বদা কাটিয়ে দিতো আজ তার কী অবস্থা।এই করুন অবস্থার সম্মুখীন হয়েও কী শিক্ষা হয়েছে ওর?যদি হতো তবে মনের মধ্যে কুট-বুদ্ধির বাসা আর বাঁধতোনা।নিজের যে রুপের বড়াই করতো আজ তা ত্রিশ বছরের উপরের মহিলাদের মতো লাগছে।মুখে কিছুটা ফাউন্ডেশন লাগিয়ে ঘর থেকে বাইরে বেড়িয়ে দেখে মিলিস্তা মেঝেতে পাটি বিছিয়ে বসে আলুর চপ খাচ্ছে।
-“কী মিলিস্তা,কখন আসলি তুই?তোকে তো দেখায় যায়না।”
মিলিস্তা মুখে “চ” জাতীয় শব্দ করে বলে,
-“আর বলিশ না আপু,ফুপু মারা যাওয়ার দু’দিন আগে শাওনকে পুলিশ এরেস্ট করেছিলো।তখন জানতে পারিনি বিষয়টা কী?ওর ভাই নানা জায়গায় দৌড়াদৌড়ি করে শুনতে পেলো,ও নাকী কোনো মেয়েকে অশ্লীল ম্যাসেজ,ভিডিও,ছবি পাঠিয়ে বিরক্ত করতো।”
-“কোন মেয়ে?খবর নে,দেখ।যদি জানিস সেই মেয়েকে বল কেসটা তুলে নিতে।কম বয়সি ছেলে-মেয়েরা একটু এসব করে।”
-“জানতে পারিনি রে আপু মেয়েটা কে?তার থেকে বড় কথা সেই মেয়ের স্বামী কেস করেছে।যতটুকু জানলাম সাজা হবেই।ওকে প্রশ্ন করলে ওই কিছু বলছেনা।আমার শ্বাশুড়ি পুরো বাড়ি মাথায় তুলেছে।”
-“চিন্তা করিস না,ঠিক হয়ে যাবে।”
-“এই আপু জানিস,ইয়ারাবী হাসপাতালে।”
মিলিস্তার কথাটা অনেকটা উৎফুল্ল কন্ঠে শোনা গেলে।জারিকা অনেকটা আগ্রহ নিয়ে বলে,
-“কেমনে কী?ওর সাথে সন্ধ্যায় যে কথা হলো।”
-“সন্ধ্যার পরে খবর আসলো।আসলে শুভর কাছে নিলয়ের ফোন আসছিলো তাই।যাবি নাকী দেখতে?”
জারিকা অনেকটা আগ্রহের কণ্ঠে বললো,
-“যেতে তো হবেই,যা করতে পারিনি সেটা কাল সকালে করবো।”
-“কী করবি তুই?আমাকে তো একটু বলতে পারিস?তাছাড়া ওর বর আর ভাইয়া যদি জানে তো জানে মেরে ফেলবে।”
-“উহু,মানুষের ভিতর কিছু বলবেনা।তাছাড়া তুই যাবি,রাস্তা পরিষ্কার।”
-“আপুরে নাটক তুই ভালোই জানিস।”
-“তা না হলে, এমনভাবে চলতে পারতাম।আমার স্বামীর যে মুরদ,তুই যতদিন আসবিনা আমিও যাবোনা।”
-“কী জানি?তবে আমি ওর সাথে মিটমাট করে নিয়েছি।আমাদের ওইদিকে প্রতি শুক্রবারে তালিম দেয়।অনেক কিছু শিখি হাদিসের,তাই ভয় করে।”
-“বাদ দে তো….”
দুই বোন মনের সুখে গল্প করতে থাকে,আর পরিবারের নানা কথা আলোচনা করে।জারিকা মনে মনে খুব খুশি হয় ইয়ারাবীর এমন পরিস্থিতির কথা শুনে।
(১৫০)
রাত বাজে প্রায় এগারোটা,আবরার কেবিনের বাইরে দাঁড়িয়ে সবার সাথে কথা বলছে।আবরারের বাবা-মা,আবীর,ইয়ারাবীর বাবা-মাও এসেছে, ইয়ামিলা মি.ফুয়াদের গলা জড়িয়ে ধরে কোলে চুপ করে আছে।এতটুকু বুঝতে পেরেছে নিশ্চয়ই ওর বোনের কিছু হয়েছে।বারবার কেবিনের দিকে তাকিয়ে বেডে ঘুমিয়ে থাকা বোনকে দেখছে।আবরারে কথা বলার সময় ওর চোখের পানি চিকচিক করছে,মনে হচ্ছে এখনি বাঁধ ভাঙবে।ছেলেরা কাঁদেনা সহজে, খুব গভীর আঘাত পেলে তারা কাঁদে।তবে আবরার খুব কষ্টে নিজের মনকে শক্ত করে রেখেছে।মি.ফুয়াদের আবরারের দিকে তাকিয়ে বলে,
-“অপারেশনটা না করলে হয়না?প্রচুর টাকা লাগবে কিন্তু?”
-“না আব্বু,ওর অবস্থা খুব খারাপ।আঘাতে ওখানে রক্ত জমে গেছিলো,আস্তে আস্তে সেটা টিউমারের আকার ধারন করছে।ও প্রথম থেকে মেডিসিনে অবহেলা করতো।আমাদের টাকা আছে তাই এসব চিন্তার কোনো প্রশ্ন উঠেনা।মেঘ অনুকে পৌঁছে দিয়েছিস তো?”
-“হামম,বাসায় জোর করে দিয়ে এসেছি।”
ইয়ামিলা ওর বাবার দিকে তাকিয়ে বলে,
-“আপুর কী হয়েছে আব্বু?”
-“কিছুনা সোনা…”
-“তাহলে ভাইয়ারা কাঁদছে কেন?”
আবরার ইয়ামিলাকে কোলে নিয়ে বলে,
-“তেমন কিছুনা,তোমার আপু একদম ঠিক আছে।”
-“আপনি কী আপুকে মেরেছেন?”
-“আমি কেন মারবো তোমার আপুকে?”
আবরার অনেকটা অবাক হয়ে কথাটা বলে।ইয়ামিলা মনটা খারাপ করে আবার বলে,
-“আগের বার আব্বু যখন আপুকে মারছিলো, আপুর অপারেশন করতে হয়েছিলো।আম্মুও তো বলছে আপুর অপারেশন করবে।এবার তো আব্বু মারেনি তাই ভাবলাম আপনি মেরেছেন হয়তো।”
ইয়ামিলার কথা শুনে উপস্থিত সবাই অবাক।আসলে এতটুকু বাচ্চা যা বুঝেছে তাই বলছে।আবরার ওর গাল টেনে বলে,
-“তোমার আপুকে তো মারার কথা ভাবতেই পারিনা সোনা।তোমার আপুতো গুডগার্ল,আসলে একটু অসুস্থ তাই এখানে আনতে হয়েছে।”
-“আপু ঘুম থেকে উঠবেনা?”
আবরার মাথা নাঁড়িয়ে বলে,
-“হামম,উঠবে।যখন উঠবে তখন কথা বলে নিয়ো।আপুকে খুব ভালোবাসো?”
-“আমিতো বাসি কিন্তু আপু বাসেনা।আপু আমাকে সহ্যই করতে পারেনা।”
মিসেস ইশানি মেয়ের দিকে তাকিয়ে বলেন,
-“ইয়ামিলা আম্মু,ভাইয়াকে জ্বালিয়োনা।আসো আমার কাছে…”
-“থাক আম্মু,বাচ্চা মানুষ কতটুকু বা বোঝে।”
-“ওকে তো হাসপাতালে রাখতে হবে?একজন মেয়ে থাকলে ভালো হতো?”
-“হ্যাঁ,রাখতে হবে।আর রাতে মেয়ে থাকার কোনো দরকার নেই,আমি থাকছি।তাছাড়া ইফাজও থাকবে,নার্স আছে,চিন্তার কোনো কারন নেই।”
মি.রায়হান আবরারের দিকে তাকিয়ে বলে,
-“যদি রাতে কোনো সমস্যা হয় ফোন করবে।ওর জ্ঞান ফিরলে তারপর যাবো।”
আজ মিসেস ইশানি বা মি.ফুয়াদ বেশি কথা বলছেন না।হয়তো অনুতপ্ত হওয়ার কারনে নয়তো নিজেদের কৃতকর্মের লজ্জায়।হঠাৎ নার্স কেবিন থেকে বের হয়ে এসে ওদেরকে জানায় ইয়ারাবী জ্ঞান ফিরে,আর ডাক্তার ডাকতে চলে যায়।কথাটা শোনার সাথে সাথে ওরা সবাই কেবিনে ঢোকে।
ইয়ারাবী ওদের সবাইকে দেখে আশেপাশে পাশে তাকিয়ে আর গায়ের পোষাক দেখে ভালো করে বোঝতে পারে ও এই মুহুর্তে হাসপাতালে।শরীরটা প্রচুর দুর্বল লাগছে,মাথাটা ব্যাথায় ছিড়ে যাচ্ছে, অন্যদিকে তৃষ্ণায় গলাটা শুকিয়ে কাঠ।উঠে বসায় চেষ্টা করতে যেয়ে বাম হাতের শিরায় টান পরায় তাকিয়ে দেখে হাতে স্যালাইন দেওয়া।আবরার ওর ছটফটানি দেখে দ্রুত ওর সামনে এসে বসে ওকে আস্তে করে ধরে উঠিয়ে বসায়।
-“পানি খাবো…”
আবরার পাশ থেকে একটা গ্লাসে পানি ঢেলে ওকে খাওয়ায়।ইয়ারাবী সবার দিকে তাকিয়ে আবরারকে প্রশ্ন করে,
-“আমাকে কেন এনেছেন এখানে?”
-“আগে বলো,তোমার কেমন লাগছে?এখন ভালো অনুভব করছো?”
-“যন্ত্রনা করছে মাথার ভিতর,দুর্বলও লাগছে।কী হয়েছে?”
-“তেমন কিছুনা,মেঘ একটু খাবার নিয়ে আসবি।ওকে কিছু খাওয়াতে হবে।”
-“আমি কিছু খাবোনা…”
-“কোনো কথা নয়,স্যুপ নিয়ে আসবি।”
মেঘ কথাটা শুনে বাইরে চলে যায়।ইয়ারাবী কিছু বলতে যাবে তার আগে ডা.রুপক আর ইফাজ কেবিনে আসে।ডা.রুপক ওকে একবার চেক আপ করে বলে,
-“পেশার অনেক লো হয়ে গেছে,আবরার একে কিছু খাইয়ে দাও।”
-“খাবার আনতে পাঠিয়েছি।”
-“তোমাকে নতুন করে কিছু বলতে হবেনা,কেননা তুমি নিজেও একজন ডাক্তার।”
-“টাইমটা কী একদম ফাইনাল?”
-“হ্যাঁ,ডা.ইব্রাহীম নিজে এসে অপারেশনটা করবে।বাট্ ব্লাডটা ম্যানেজ করে রেখো,মামনির ব্লাডটা সহজে পাওয়া কঠিন,কেননা নেগেটিভ ব্লাড বেশি পাওয়া যায়না।”
ইয়ারাবী অপারেশনের কথা শুনে কিছুটা আতকে উঠে।চোখগুলো ছোট ছোট করে ডা.রুপকের দিকে তাকিয়ে বলে,
-“কার অপারেশন আর কীসের অপারেশন?”
-“তেমন কিছুনা মামনি,তোমার আঘাতের জায়গায় ব্লাড জমে গেছে।সেটাই ছোট একটা অপারেশনের মাধ্যমে বের করতে হবে।”
-“ম্ মানে?আমি কোনো অপারেশন করবোনা।”
ইফাজ ওর মাথায় হাত রেখে বলে,
-“পিচ্চি,এতো ভয় কেন পাচ্ছিস?কিছু হবেনা তোর।”
-“না,ভাইয়া আমি করবোনা অপারেশন।কেন বোঝছোনা তোমরা।”
-“আচ্ছা এতো হাইপার হোসনা,করবোনা এবার খুশি।”
ইয়ারাবী চোখ কুচকে ওর ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে রাগী কন্ঠে বলে,
-“আমাকে বাচ্চা পেয়েছো,হাতে লজেন্স ধরিয়ে বলবে এটা চিকেন,আর আমি সেটা মানবো।”
-“তোর হাতে লজেন্স কখন দিলাম আমি।খাবি তুই নিয়ে আসবো নাকী?”
-“ধুর…বলি এক তোমরা করো আরেক।”
ইয়ারাবী রাগী মুখ নিয়ে অন্যদিকে তাকালে ইফাজ মুচকি হেসে দেয়।ধীরে ধীরে ওর আগেই সেই পাগলামিগুলো ফিরে আসছে।তবে যদি এমন পরিস্থিতি না হতো তবে মন খুলে খুশি হতে পারতো।ডা.রুপক আবরারের সাথে কথা বলতে বলতে বাইরে চলে যায়। ইয়ারাবী বাকীদের সাথে টুকটাক কথা বলে জানতে পারে পরশু বিকালে ওর অপারেশন।ও জানে এটা ওর বাবার কারণে হয়েছে,ওর বাবা-মা ওর সাথে কথা বলতে এলে ও মুখ ঘুরিয়ে নেয়।মিসেস ইশানি ওর দিকে তাকিয়ে বলে,
-“মরতে বসেছিস অথচ তেজ কমেনি তোর?”
সবাই অবাক হয়ে মিসেস ইশানির দিকে তাকায়,ইফাজও বুঝতে পারছেনা এই ব্যবহারের কারন।কেননা যে মা কিছুদিন আগে মেয়ের হয়ে এতবড় প্রতিবাদ করলো আজ সে অন্যভাবে কথা বলছে।আগের সেই রুপ,সেই ব্যবহার…গিরগিটির মতো রং বদলাবার কারন কী?মিসেস রায়হান ওনার দিকে তাকিয়ে বলে,
-“ভাবী,আপনি মা হয়ে এমন কথা বলতে পারলেন?কোথায় মেয়েকে রিল্যাক্স হতে বলবেন তা নয় ওকে উল্টো বাজে কথা শুনাচ্ছেন।আজ আমার সত্যিই বলতে হচ্ছে,আপনি কী মানুষ?”
-“ভাবী আমি মানুষ বলেই একে সহ্য করেছি।আর হ্যাঁ,বেশি লাই দিয়েন না একে,নয়তো পরবর্তীতে আপনাদের মান-সম্মান ডুবিয়ে ছাড়বে।”
ইফাজ ওর খালার দিকে তাকিয়ে বলে,
-“ভেবেছিলাম আপনার হয়তো বদলে গেছেন কিন্তু না।আসলে গিরগিটি কখনো বদলায় না,শুধু ক্ষনিকের জন্য ছলনা করে।নিজের মেয়ের ব্যাপারে এমন কথা বলতে আপনার বাঁধলোনা।”
-“আমার তো মেয়েনা এ,অনেক আগেই তো তোর মা একে নিজের মেয়ে করে নিয়েছে।চিন্তা করলে তোরা কর আমি কেন করবো।দোয়া করি ইয়ারাবী, তোর এই অপয়া মুখ যেন দুইবার আমাকে আর দেখতে না হয়।চলো ফুয়াদ,ইয়ামিলার কাল পরীক্ষা আছে।”
মি.ফুয়াদ ওদের নিয়ে চলে যান কেবিন থেকে।কারোর কাছে বোধগম্য হচ্ছেনা হঠাৎ এনাদের কী হলো?মি.রায়হান ইয়ারাবীর দিকে তাকিয়ে দেখে, মেয়েটা অন্যদিকে মুখ করে চোখের পানি আটকানোর বৃথা চেষ্টা করছে।উনি নিজের স্ত্রীকে ইশারা করতেই উনি ইয়ারাবী সামনে বসে বলে,
-“জানিস বিয়ের পর শ্বশুড়বাড়ির মানুষই আপন হয়,আর বাবার বাড়ি পর।আর তুই কান্না করছিস কেন বলতো?যারা তোকে ভালোবাসে তারা সবাই এখানে আছে,তাছাড়া তোর মা-বাবা মনে হয় কোনো কিছুটা আপসেট তাই এমন করেছে।”
-“পিচ্চি,আন্টি ঠিক বলেছে।কাঁদিস না…”
-“কাঁদতে না চাইলেও কান্না চলে আসে অপমানে।আচ্ছা আমি কী করেছি যে আমাকে সব সময় অপমানিত হতে হয়?”
মি.রায়হান ওর দিকে তাকিয়ে বলে,
-“আমার প্রথম থেকে কেমন একটা খটকা লেগেছিলো যে তোমাদের বাবা-মেয়ের কিছু একটা ঠিক নেই।তবে মি.ফুয়াদ কেন তোমাকে সহ্য করতে পারেনা সেটা বুঝিনা।ওসব ভেবোনা, আমরাও তো তোমার বাবা-মায়ের মতো।আর এমন কাঁদেনা,নয়তো আমার পাগল ছেলেটা ভয় পেয়ে যাবে।”
-“কী হয়েছে আব্বু?ও কাঁদছে কেন?”
আবরারের হাতে কিছু মেডিসিন,কেবিনে ঢুকতে ঢুকতে প্রশ্নটা করে।ইয়ারাবী চোখ মুছে বলে,
-“কিছুনা,মাথা ব্যাথা করছে।আচ্ছা আমার চশমা কোথায়?”
-“ওটাতো গাড়িতে আছে।আব্বু,মেঘ আসলে তোমরা বাসায় চলে যেও।আমি থাকছি এর কাছে,ইফাজও মনে হয় থাকবে।”
-“রাতে ডিউটি নিয়েছি,আপনারা বাসায় যান।কাল না হয় আবার আসবেন।”
মেঘ খাবার নিয়ে কেবিনে ঢুকে টেবিলে রাখে।ইয়ারাবীর চুলে হাত রেখে বলে,
-“দেখ পেত্নী,কেঁদে কী অবস্থা করেছিস?আজ মনে হচ্ছে আমার দেওয়া নামটা স্বার্থক হয়েছে।তুই যে এতো ভিতু সেটা এখন বুঝলাম।”
-“সর গাধা,তুই কথা বলবিনা।”
-“উরে বাবা,ভাবী দেখি রেগে গেছে?”
-“ভাবী?”
-“ভুলে ডেকে ফেলছি,বয়ে গেছে তোর মতো পিচ্চিকে ভাবী ডাকতে।নিজের খেয়াল রাখিস, ভাইয়া আছে তাই কোনো সমস্যা নাই।এসব নিয়ে চিন্তা করিস না,নয়তো তোর সমস্যা হবে,আল্লাহ ভরসা।”
ইয়ারাবী কিছু না বলে চুপ করে থাকে।মিসেস রায়হান দোয়া পড়ে ওকে ফুঁ দিয়ে আবরারকে কিছু উপদেশ দিয়ে চলে যায়।আবরার স্যুপটা নিয়ে ইয়ারাবীর সামনে বসে ওকে খাওয়াতে গেলে বলে,
-“আল্লাহ আমাকে দু’টা সুস্থ হাত দিয়েছে।”
-“মেজাজ গরম না করে আমার হাতে খেয়ে নাও।”
-“আপনি কী আমাকে ভয় দেখাচ্ছেন?”
-“ও,সত্যিই কী তুমি আমাকে ভয় পাও?যদি ভয়ই পেতে তবে এমন স্টুপিডের মতো কাজ করতে না।”
-“আমি কী করেছি?ভাইয়া দেখো…একি তুমি আমার দিকে রেগে তাকিয়ে আছো কেন?”
ইফাজ স্টেথেস্কোপটা ভালো করে হাতে নিয়ে বলে,
-“যদি হাসপাতালে না হতি তবে ঠাটিয়ে চড় খেতি।তুই সাহস কী করে পেলি ঔষধ না খেয়ে থাকার।”
-“আ আমিতো খেতাম,আব..আবরার আপনিতো রোজ চেক করতেন…”
-“আঠারো বছর ধরে তোকে আমরা চিনি, ফাজলামির একটা লিমিট থাকে।মরার খুব শখ না তোর।”
-“আর হবেনা…”
আবরার ইফাজের দিকে তাকিয়ে বলে,
-“অনেক বকেছিস আর না,ওর ব্রেন চাপ পরবে।”
-“আমি কেবিনে যাচ্ছি,একটু পরে আবার আসবো।”
ইফাজ তো রেগে চলো গেলো নিজের কেবিনে।আবরার একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ওকে খাইয়ে দিলো।ইয়ারাবী ভয়তে কোনো কথা বলছেনা।আবরার ওকে মেডিসিন খাইয়ে শুয়ে দিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলে,
-“ভয় পেতে হবেনা,মানুষের ভুল হয়।লক্ষী মেয়ের মতো ঘুমিয়ে পরো।”
-“আর আপনি?”
-“আমিও ঘুমাবো।”
-“রেগে আছেন তাইনা…”
-“না,চিন্তা করবেনা এসব।তুমি আমার অস্তিত্ব,আর নিজের অস্তিত্বের উপর রেগে থাকা যায়না।”
-“আচ্ছা,অপারেশন করলে কী চুল কেঁটে ফেলতে হবে।”
-“হ্যাঁ,”
-“আমি দেখতে এমনিতে বাজে,আরো বাজে লাগবে।”
-“কে বললো তুমি বাজে?আল্লাহ কাউকে বাজে ভাবে সৃষ্টি করেনা,সবারই আলাদা আলাদা সৌন্দর্য আছে।তেমন তোমার সৌন্দর্য আছে তোমার চোখে,চুল কাঁটলে চুল আবার হবে।এতে মন খারাপ করতে হয়।”
-“আমার ভয় করছে।”
-“পাগলি,তোমার ভাইয়াতো থাকবে সাথে।অনেক কথা বলেছো এবার ঘুম।”
জীবনের প্রতিটা মুহুর্তে আমাদের জন্য কতকিছু অপেক্ষা করে,সেটা ভালো হোক বা খারাপ।আসলে ভবিষ্যতে কী হবে সেটা কেউ জানেনা।তাই ক্ষনিকের সুখের জন্য ভবিষ্যতের কথা না ভেবে বোকামি করা ভুল।প্রতিটা পদক্ষেপে ভাবতে হয়,যেটা করছি সেটা ভবিষ্যতে কতটা গুরুত্বপূর্ণ।
(১৫১)
ইয়ারাবী আবরারের বুকে মাথা দিয়ে নিজেকে গুটিয়ে শুয়ে আছে।একটু আগে ওর মনি,তারা, য়ুহার,খালু আর ইরাকের সাথে ভিডিও কলে কথা হয়েছে।ইরাক ওর ভিতু চেহারা দেখে প্রচুর হেসেছিলো।য়ুহার একটা কেসের জন্য মক্কেলের বাড়ি বরিশালে গেছে তাই আসতে পারেনি।তারার স্কুলে আন্ডা-বাচ্চাদের পরীক্ষা চলছে,তবে ছুটি নিয়ে চলে আসবে বলেছে।
ইয়ারাবী আবরারের হাতের আঙ্গুলে নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে আর ছাড়ছে।যেটা ও প্রায় ছোটবেলায় করতো,একটা জিনিস ও কাল বুঝতে পেরেছে ওর বাবা-মায়ের মনে একটু হলেও ওর জায়গা নেই।তাই তাদের ভয়ে বা লোক লজ্জায় আর চুপ থাকবেনা।আসলে ওর চুপ থাকাতে ওর দুর্বলতা ভেবে ওর বাবা-মা যা খুশি তাই করেছে এতোদিন।ইয়ারাবী আবরারের দিকে তাকিয়ে বলে,
-“এটা করলে কিছু হবেনা তো?”
-“একদম না,তোমাকে না নিষেধ করেছি।”
-“মন মানছেনা,ভয় করছে খুব।একটা কথা বলবো আপনাকে?”
-“বলো…”
-“আপনিও তো ডাক্তার,অপারেশনের সময় আপনি কী থাকতে পারবেন না?”
আবরার ওর কথাটা শুনে মুচকি হেসে বলে,
-“আমি চেষ্টা করবো,ওটির সময় পাশে থাকার।যদি পারমিশন পায় তবে একা ছাড়বোনা।”
-“বাসায় কথা হয়েছে।”
-“হ্যাঁ,মম্ আর ভাবী একটু পরেই আসবে আর তোমার বন্ধুও।”
-“আমার ফোন কী আপনার কাছে?”
-“হ্যাঁ,তবে দেওয়া যাবেনা।”
-“এভাবে থাকতে কার ভালো লাগে।হাত পুরো ব্যাথা হয়ে আছে।”
-“একটু কষ্ট করো।এটা শেষ হলো সারাদিনে আর নেই,তবে রাতে দেওয়া হবে।তোমার শরীরে ব্লাড আর পানি দু’টার স্বল্পতা আছে।”
-“কেমন ডাক্তার আপনি?বৌকে ঠিকমত খাওয়াতে পারেন না।”
-“কী করবো বলো?বৌটা তো কথা শুনেনা….”
-“মোটেও না,আমি আপনার সব কথা শুনি।
-“আচ্ছা,সোনা যোহরের আযান দিয়েছে,আমি নামায পরে আসি।নার্স আছে,সমস্যা হলে বলবে।”
-“আমি পড়তে পারছিনা।মাথা উঁচু করতেই কষ্ট হচ্ছে।”
-“সুস্থ হওয়ার পরে না হয় কাজা পড়ে দিয়ো।দেখি…”
আবরার ওকে বালিশে শুয়ে দিয়ে কপালে একটা একটা ভালোবাসার পরশ একে দিয়ে নার্সকে খেয়াল রাখতে বলে চলে গেলো।নার্স মুচকি হেসে ওর দিকে তাকিয়ে বলে,
-“ম্যাম,স্যার আপনাকে খুব ভালোবাসে তাইনা।”
ইয়ারাবী খুব লজ্জায় পরে যায়,আবরারের কিছু কাজের দ্বারা।এখনো সেটাই হলো।তাই ওর কিছুনা বলে একটু মুচকি হাসি দিলো। এমন সময় অনু আসে।অনু এসে বসতেও পারেনি, মিলিস্তা আর জারিকা ঢোকে কেবিনে।অনু ওদের পাশ কাঁটিয়ে যেয়ে বলে,
-“তুই একা কেন?”
-“একা কই,উনিতো আছে।”
-“ও স্যরি আমি খেয়াল করিনি।আচ্ছা ভাইয়া, জিজু….”
-“নামায পড়তে গেছে।”
জারিকা পাশ থেকে আদুরে কন্ঠে জোরে বলে উঠে,
-“এখন তো বেশি বেশি করে নামায পড়া উচিত, বলা তো আর যায়না।”
নার্স পাশ থেকে বলে উঠে,
-“স্যরি টু সে আপু,একটু আস্তে কথা বলুন।উনার ব্রেনে চাপ পড়বে।”
-“জানি জানি আমি,এসব আমাকে বোঝাতে হবেনা।আপনি দেখছেন না ফ্যামিলির লোক এসেছে তাহলে আপনি বাইরে যাচ্ছেন না কেন?”
-“স্যরি আপু,স্যাররা আমাকে অর্ডার দিয়েছে এখান থেকে যাতে না যায়।”
জারিকা ভ্রুটা কুচকে বলে,
-“কোন স্যাররা?”
-“ডা.ইফাজ আর ডা.আবরার স্যারেরা।আমি যদি উনাদের কথা না শুনি তবে চাকরি চলে যাবে,আর আমি আপনার জন্য চাকরি হারাতে পারবোনা।”
জারিকা এমন কথায় রাগে ফোঁসফোঁস করতে থাকে।অনু মুচকি মুচকি হেসে ইয়ারাবীকে বলে,
-“এখন কেমন আছিস তুই?”
-“ভালো তবে বসলে মাথাটা ছিড়ে যাওয়ার অনুভুতি হচ্ছে।”
-“ঠিক হয়ে যাবে।”
জারিকা ইয়ারাবীর সামনে চেয়ারে বসে বলে,
-“শোন,জানি আমাকে খারাপ ভাব্বি।তবে আজ যা বলবো সেটা সম্পূর্ন সত্য।”
-“কী কথা?”
-“জানিনা সহ্য করতে পারবি কীনা?”
-“বলার ইচ্ছা হলে বলবে না হলে চলে যাও।আমার স্বামী বা ভাইয়া কেউ তোমাকে পছন্দ করেনা।আশা করি তোমাকে বোঝাতে হবেনা কথাটা।”
-“জানি,তুই জানিস বাজা মানে কী?”
অনু ওর কথা শুনে দ্রুত বলে উঠে,
-“জারিকা আপু,এসব কথা না বললে নয় নাকী?”
-“তুমি বাইরের মানুষ হয়ে কথা কেন বলছো?”
অনুর কথাটা শুনে গায়ে লাগে,অনেক কষ্টও পায়।কেননা এটা সত্য যে ওরা বোনেরা কথা বলছে তার ভিতর ওর ঢোকা ঠিক নয়।ইয়ারাবী বেডে উঠে বসে বলে,
-“বেড়িয়ে যাও এখান থেকে।তোমার সাহস কী করে হয় অনুকে এসব বলার।শুধু রক্তের সম্পর্ক হলেই বোন হওয়া যায়না,এসবের উর্ধ্বেও কিছু সম্পর্ক আছে।যা তোমার মতো নিচু মনের মানুষ বুঝবেনা।”
-“আহ্হ্,ইয়ু চুপ কর।উনিতো খারাপ কিছু বলনি।”
-“অনু থাপ্পড় খেতে না চাইলে চুপ করে বস এখানে।”
জারিকা মুখ বাকিয়ে বলে উঠে,
-“ঢং,বাজা মেয়ের এতো তেজ ভালো নয়।তুই জানিস তোকে কেন বাজা মেয়ে বলি,কেননা তোর কোনোদিন মা হওয়ার মুরদ নেই বুজলি।”
ইয়ারাবী অবাক হয়ে বলে,
-“কী?”
-“হ্যাঁ,তাই।আবরার বিয়ের আগে থেকে জানতো, তোর সো-কল্ড খালারাও জানতো,তোর বাবা-মা জানে শুধু তোকে জানায়নি।”
-“আব..আবরার জানতো?”
-“হ্যাঁ,ও নিজেও কোনো ধোঁয়া তুলসি পাতা নয়।ও তোর শরীর চায় বলে তোকে বিয়ে করেছে।তুই আসলে অপয়া জানিস।আরে যে মেয়ে মা হতে পারেনা তার বেঁচে থেকে লাভ কী?তোর তো মরে যাওয়া উচিত।”
ইয়ারাবীর মাথার মধ্যে ভয়ংকর ব্যাথা শুরু হয়েছে।ও কখনো ভাবতেও পারেনি এমন কিছু শুনবে।হঠাৎ কোনো শব্দে ও চমকে যায়,সামনে তাকিয়ে দেখে ইফাজ একের পর এক চড় মারছে ওকে।ইফাজ নার্সের দিকে তাকিয়ে বলে,
-“সিকিউরিটিকে ডেকে এদেরকে ঘাড়ে ধাক্কা দিয়ে বের করে দাও।”
আবরারের চোখগুলো ভয়ংকর হয়ে আছে।ও ভাবতেও পারেনি,ওর অনুপস্থিতে এমন কিছু ঘটবে।নিজের রাগকে কন্ট্রোল করতে পারছেনা।অনু চিৎকারে সামনে তাকিয়ে দেখে ইয়ারাবী হাত থেকে ক্যানেল খোলার চেষ্টা করছে।আবরার দ্রুত ওর কাছে যেয়ে ওকে ঝাপটে ধরে শান্ত করার চেষ্টা করছে কিন্তু কোনো কাজ হচ্ছেনা।
#চলবে_____