#জীবন মানে তুমি
#লেখিকা:H.B.Rini (Irini Ori)
#পর্ব:৪৩
(১৪৫)
ব্রেকফাস্ট করে শ্বাশুড়ির সাথে বেশ কিছুক্ষণ গল্প করে রুমে ফিরতেই দেখে আবরার আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে হাতে ঘড়ি পরছে।ইয়ারাবী ভ্রু দু’টো কুঁচকে প্রশ্নসূচক চোখে ওর দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে,
-“আপনি কী কোথাও যাচ্ছেন?”
আবরার কোটির বোতাম লাগাতে লাগাতে বলে,
-“রোজই তো যায়,প্রথমে হাসপাতাল তারপর ল্যাব।”
-“রোজ যাওয়া আর আজকের যাওয়ার মধ্যে পার্থক্য আছে।আপনি ভুলে যাবেন না আপনি অসুস্থ।আল্লাহর রহমতে অনেক বড় অ্যাক্সিডেন্টের হাত থেকে বেঁচে গেছেন।”
আবরার মুখ দিয়ে ‘চ’ জাতীয় শব্দের মতো উচ্চারন করে বলে,
-“ইয়ারাবী,নাও আই্ এ্যাম্ ফাইন।তাছাড়া আজ যেতে হবে,দরকারি খুব।”
-“না আপনি আজ কোথাও যাবেন না।”
-“দেখ,জেদ করেনা।আচ্ছা,আমি না হয় সকাল সকাল বাসায় আসার চেষ্টা করবো।”
-“আপনার মিষ্টি কথায় আমি গলছিনা।”
আবরার ওর দিকে এক ভ্রু উঁচু করে অবাকের চোখে তাকিয়ে বলে,
-“তোমার কী মনে হয়,আমি তোমাকে মাখন লাগাচ্ছি?”
ইয়ারাবী মাথা দু’পাশে হালকা দুলিয়ে বলে,
-“উহু,ভূগোল পড়াচ্ছেন।দেখুন আপনি যদি সোজা কথায় না মানেন তবে আমি বাঁকা রাস্তায় মানাতে পারি।”
-“সেটা কীভাবে?”
-“আম্মুকে ডাকবো…”
-“ব্ল্যাকমিল ভালোই পারো দেখছি।যাক পাঁচ মাস পরে যেয়ে কোনো গুন তো দেখছি।তবে স্যরি হানি, আমাকে যেতেই হবে।”
-“দেখুন আমার মন সাই দিচ্ছেনা,প্লীজ একটা দিনই তো।”
আবরার ওর কথার কোনো উত্তর না দিয়ে আয়নার দিকে আবার ঘুরে কোর্ট পরতে থাকে।ইয়ারাবী বুঝতে পেরেছে ওর কথায় কাজ হবেনা।তাই ও মন খারাপ করে ঘর থেকে বের হয়ে যায়।আবরার ওর দিকে তাকিয়ে একটা মুচকি হাসি দিয়ে নিজের কাজে মন দেয়।কয়েক মিনিট পরে যেয়ে দেখে ওর মা কিছুটা রাগী মুখ নিয়ে ঘরে ঢুকছে আর পিছনে ইয়ারাবী।আবরার সোফায় বসে পায়ে মোজা দিতে দিতে বলে,
-“ওহ্হ্ মম,এবার তুমি আর আটকিয়োনা,আমার যাওয়াটা খুব দরকার।”
মিসেস রায়হান ইয়ারাবী দিকে একবার তাকিয়ে আবরারকে রাগী কন্ঠে বলে,
-“দেখ বড় হয়ে মায়ের হাতে মার খেতে চাসনা।তোর আব্বুও বলেছে আজ বাসায় থাকতে।হাসপাতাল আর ল্যাবে ফোন করে বল,তুই আজ আসবিনা।”
-“মম্!”
-“মেয়েটা মুখ ফুঁটে তোকে মানা করছে,স্বামীর কর্তব্যের মধ্যে পরে স্ত্রীর কথা শোনা।”
আবরার হঠাৎ করে মুখ ফুসকে বলে ফেলে,
-“বেচারা আব্বুর কেমন লাগে এবার বুঝতে পারছি।”
-“কী বললি তুই?”
-“আব্ না মানে,ঠিক আছে।কোথাও যাচ্ছিনা,আর তুমি মমের পিছন না ঘুরে বই নিয়ে বসো।”
-“তোর সাহস তো মন্দ না,তুই মেয়েটাকে ধমক দিচ্ছিস।”
-“ধমক,এটাকে ধমক বলে…..”
মিসেস রায়হান ছেলের দিকে আড়চোখে তাকিয়ে বলে,
-“হ্যাঁ,এটাকে ধমক বলে।আমাকে শিখাতে আসবি না।জানিনা বাবা,কার উপর গিয়েছিস।শোন আম্মু, আবরার কিছু বললে আমাকে জানাবি।”
শ্বাশুড়ির কথায় ইয়ারাবী মাথা নাড়াতেই উনি রুম থেকে বের হয়ে যায়।আবরার ভ্রু কুচকে কিছুটা রাগ নিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে আছে।ইয়ারাবীর ভয়ে শুকনা একটা ঢোক গিলে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে।আবরার কোর্ট খুলতে খুলতে বলে,
-“শেষ মমকে এনেই আটকালে।পুরো দিন বাসায় আছি,তোমার কপালে দুঃখ আছে।”
-“আ আমি কী করেছি?”
-“কী করোনি সেটা বলো?কাল দুপুর থেকে হাসপাতাল এখন বাসা…”
-“আমি তো আপনার ভালোর জন্য বললাম…”
-“এখন এক কাপ কফি নিয়ে এসো জাস্ট পাঁচ মিনিট সময়।আমি চেন্জ করে আসি।”
আবরার ড্রেস নিয়ে ওয়াসরুমে যেতেই ইয়ারাবী যেন হাফ ছেড়ে বাঁচলো।ও বুঝতে পারেনা এই ছেলেটার আসল সমস্যা কী?সব সময় ভয় দেখিয়ে কথা না বললে পেটের ভাত মনে হয় হজম হয়না।পুরো পরিবারের খেয়াল রাখতে পারে কিন্তু নিজের কেয়ার করেনা।আর কেউ বললে খেতে হয় তার ধমক।নানা চিন্তা-ভাবনা করতে করতে যেই রুম থেকে বের হচ্ছিলো তখনি ওর ফোনে শুভোর নাম্বার থেকে কল আসে।ইয়ারাবীর দরজার কাছে দাঁড়িয়ে ফোনটা রিসিভ করে সালাম দিয়ে বলে,
-“কেমন আছিস শুভ..”
কিন্তু ওপাশ থেকে শুভর পরিবর্তে কোনো মেয়ে কন্ঠ বলে উঠলো,
-“আমি শুভ নই,জারিকা আপু বলছি।তুই তো আমার নাম্বার সোজা ব্লকলিস্টটে ফেলেছিস মনে হয়।”
-“ফোন কেন দিয়েছে?”
-“বাবাহ্,টোন তো দেখছি অনেক পরিবর্তন হয়েছে।”
-“আমি রাখছি…”
-“এক মিনিট ফোন রাখবিনা।”
-“আমি তোমার সাথে কথা বলতে নূন্যতম ইচ্ছুক নই।”
-“বলতে হবেনা,তবে আমি কিছু কথা তোকে জানাতে চায়,যেটা তুই জানিস না।বিশেষ করে তোর বর,আর তোর সো-কল্ড ভাইয়েরা তোকে কিছুই জানায়নি।পুরো ধোঁয়াশার মধ্যে রেখেছে।”
-“নিশ্চয়ই কোনো কারন আছে যার জন্য জানায়নি।প্রয়োজন হলে ঠিকই জানাবে।”
জারিকা ওর কথা শুনে হেসে বলে,
-“তুই প্রচুর বোকা,চল আমি তোকে বলে দিবো।আমি চাইনা আমার বোন কোনো ধোঁকার মধ্যে থাকুক।”
-” হঠাৎ এতো দরদ উথলিয়ে পরলো কেন আমার জন্য?তাছাড়া আমার জন্য তোমার এত বড় একটা ক্ষতি হয়ে গেল…”
-“ক্ষতি নয় তুই করলি,বাট্ আমি সত্যটা তোকে জানাতে চায়।প্লীজ একটা বার আমার সাথে দেখা কর।আর আবরার যেন না জানে।”
-“সরি,আমার ক্লাস বন্ধ তাই বেড় হইনা।”
-“তুই তো কাজ করিস?”
-“মেঘ থাকে আমার সাথে,তাছাড়া উনি টোটালি তোমার সাথে মিশতে মানা করেছে..”
-“প্লীজ বোন আমার একটা বার দেখা করতে আয় আমার সাথে।আজ বিকালে যেভাবে হোক,প্লীজ।”
জারিকা এমনভাবে রিকুয়েস্ট করছে যে ও না করতে পারলোনা।অনেক ভেবে বললো,
-“ঠিক আছে,দেখি চেষ্টা করে।তবে যেখানে আসতে বলবো সেখানেই আসতে হবে।আর আজ নয় দেখা কাল করবো,উনি বাসায় আছেন।”
-“ঠিক আছে,কাল আসিস।রাখি,আজকের দিনটা তোর যেন খুব সুন্দর যায়।কালের কথা তো কেউ জানেনা।”
ওর এমন কথা ইয়ারাবীর ভ্রু দু’টো কুচকে যায়।অনেকটা সন্দেহযুক্ত কন্ঠে বলে,
-“মানে?কী বুঝাতে চাইছো তুমি?”
-“আরে না না,কী বুঝাতে চাইবো।আসলে ভবিষ্যতের কথা তো কেউ জানেনা।তাই তোকে গুড উইশ করলাম।আচ্ছা রাখি…”
ইয়ারাবী ফোনটা কেটে টেবিলের উপর রেখে নিচে নেমে যায়। কিচেনে যেয়ে দেখে মেঘ আর জারবা পরম যত্নে অভেনে পিৎজা দিয়ে কফির বানাচ্ছে।জারবা ওকে দেখে বলে উঠে,
-“ছোট ভাবী কিছু লাগবে?”
-“হামম,কফি বানাতে এলাম।এক মিনিট তুমি আজ কলেজ যাওনি কেন?”
-“উহ্ বাবা কী পেট ব্যাথা জানো?তাই মম বললো রেস্ট নিতে।”
ইয়ারাবী প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে বলে,
-“পেট ব্যাথা হলে কী মানুষ পিৎজা আর কফি খায়।”
-“মানে আগে হচ্ছিলো হি হি হি..”
-“পাগলি,মেঘু কী করছিস ভাইয়া?”
মেঘ ওর কথা শুনে সন্দেহ নিয়ে তাকিয়ে পা থেকে মাথা পর্যন্ত স্ক্যান করে বলে,
-“বাবাহ্,এতো সুন্দর ডাক।ডাল মে কুচ কালা হে…”
-“রাখ তোর হিন্দি,বাঙালি বাংলা ভাষার বলবি।”
-“ভনিতা না করে বলো কী লাগবে?”
-“দেখ আমি তোর কত ভালো ফ্রেন্ড তাইনা।”
-“শুধু ফ্রেন্ড কেন?সম্পর্কে আমার বড় ভাবী, আমার উচিতো তোর কথা শুনা তাইতো।এবার ঝেড়ে কাশো তো ভাবী।”
-“কফিটা দেনা…”
-“জানতাম,কিছু নিয়ার জন্য করছিস।নিজে করে খা,সকাল ধরে কফি পায়নি।সোনালিও আজ আসেনি,”
-“এমন করিস কেন?আমি না তোর ভাইয়া খাবে, বলেছে পাঁচ মিনিটের মধ্যে কফি না নিয়ে গেলে কপালে দুঃখ আছে।একটু আগে একটা ঝাড়ি খেয়েছে আর খেতে চায়না।প্লীজ দেনা ভাই,”
মেঘ কিছুক্ষণ ভেবে ওর দিকে তাকিয়ে মগটা এগিয়ে দিয়ে বলে,
-“নে ধর,ভাইয়া বলে দিচ্ছি তুই হলে দিতাম না।তাছাড়া আমি উদার মনের মানুষ।মানুষের জন্য কাজ করি পেত্নির জন্য নয়।”
কথাটা শুনে ইয়ারাবী রাগী চোখে ওর দিকে তাকায়।জারবা মুখে বাদাম পুরে মেঘের দিকে তাকিয়ে বলে,
-“ভাইয়া,তুমি ছোট ভাবীর সাথে এমন করো কেন?”
-“কেন করি?সেটা একদিন এর সাথে বের হলে বুঝবি।জানিস,টিমের সবাই ফুসকা খেয়ে আমাকে ফকির বানায়।”
-“ইয়াম্মি,টেস্টি টেস্টি।চলোনা আজ বিকালে খেতে যায়।”
মেঘ মুখে ভেংচি দিয়ে বলে,
-“শিয়ালের কাছে মুরগি বর্গা দিলাম।”
-“তোমরা ঝগড়া করো আমি যায়।আর জারবা যদি বের হও তবে আপু আর আমার জন্যও এনে কিন্তু,টাকা মেঘ দিয়ে দিবে।”
কথাটা বলে ইয়ারাবী হাসতে হাসতে রুমে দিকে হেঁটে যায়।মেঘ মুখ ফুঁলিয়ে আবার কফি বানাতে শুরু করে।
-“কফিটা মেঘ বানিয়েছে নাকী?”
আবরার বিছানায় বসে কফিতে চুমুক দিয়ে বলে।ইয়ারাবী মাথা নাড়ায়।আবরার ওর দিকে তাকিয়ে বলে,
-“শাওয়ার নিয়েছো চুলতো সম্পূর্ন ভেজা,ওড়না ফেলে দাও।আর শোনো হেয়ার ড্রায়ার দিয়ে চুল শুকাবেনা,নয়তো সমস্যা হবে।”
-“আপনি কীসের সমস্যা বলেন বুঝিনা।গত দু’বছর ধরে করি।”
-“সময় হলে বুঝবে।বই নিয়ে পড়তে বসো,গ্যাপ কভার করতে হবে।”
-“আচ্ছা একটা কথা বলুন তো,প্রায় স্বামীরা চাই তাদের বৌ সংসার করুক,শ্বাশুড়ি চাই তাদের সেবা যত্ন করুন।কিন্তু আপনারা উল্টো কেন?আপনারা তো প্রচুর বড়লোক।আমাদের মতো মিডিল ক্লাস ফ্যামিলিকে তিন-চারবার কেনার ক্ষমতা রাখেন, সেখানে আপনার বাবা তার অফিসের কর্মচারীর মেয়েকে নিজের ছেলের বউ করে আনলো।আমি তো আহামরি সুন্দরি নই,ভাবতেই অবাক লাগে।”
আবরার হেসে বলে,
-“যদি বলি চিনতাম তোমাকে…”
-“সেটা কী স্বাভাবিক নয়?”
-“মানে?”
-“আপনি ভাইয়াদের বন্ধু,তাছাড়া মেঘের ভাই।ফোন থেকে আমার ছবি দেখেছেন আর প্রশংসা শুনে আমাকে ভালো লেগে গেছে।তবে ভাইয়ারা আমাকে নিয়ে একটু বারিয়ে বলে।”
কথাটা বলে ইয়ারাবী হেসে টেবিলের কাছে চলে যায়।আবরার বড় করে বিষম খেয়ে যায়।কেননা হঠাৎ খেতে খেতে কোনো অপ্রকাশিত সত্য যদি আচমকা প্রকাশিত হয় তবে সেটা সহজে হজমের নয়।আবরার অবাক চোখে ওর দিকে তাকিয়ে বলে,
-“তুমি এসব কী বলো?”
-“প্লীজ,দয়া করে আর অভিনয় করবেন না।আমি সত্যটা জানি।”
-“ইয়ারাবী আমি…”
-“লন্ডনে যাওয়ার অনেক আগেই জেনেছি,তবে কখনো বলিনি।এখন বলেন,এটা দয়া নাকী করুনা নাকী বন্ধুত্বের ভালোবাসা,কোনটা?”
-“কী বলছো তুমি এসব?”
-“আমার সব কিছু জেনেই আপনি সম্পর্ক এগিয়েছেন।”
-“ইয়ারাবী?”
আবরার অনেক জোরে ধমক দিয়ে উঠে।রাগে ওর শরীরের মধ্যে আগুন জ্বলছে।নিজের রাগটাকে কন্ট্রোল করার ট্রাই করছে।ও রেগে গেলে হীতাহিত জ্ঞান কিছু থাকেনা,আর ও চাইনা অসুস্থ মেয়েটার উপর রাগ উঠাতে।আবরার ঘাড়ে হাত দিয়ে ঢলতে ঢলতে মাথাটা ডান-বাম পাশে ঘুরিয়ে কিছুটা শান্ত হয়ে বলে,
-“বসো কথা আছে…”
ইয়ারাবী নিজের জায়গা থেকে একচুল পরিমান নড়ে না।একভাবে ফ্লোরের কার্পেটের দিকে তাকিয়ে জুতার মাথা দিয়ে আঁকিবুঁকি করছে।আসলে আবরার এমন ধমক দিয়েছে যা সচারচর ও কখনো করেনা।আফসোস কান্না পাচ্ছে কিন্তু সাহস পাচ্ছেনা কাঁদার।আবরারের ভয়ের জন্য নয়,সপ্তাহখানিক হলো কাঁদলে ওর ভয়ংকর ভাবে মাথাব্যাথা বেড়ে যায়।যা সহ্য করা ওর জন্য কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে।আবরার ওর দিকে তাকিয়ে শান্ত কন্ঠে আবারও বলে,
-“কী হলো বসো?”
ইয়ারাবী চুপচাপ বিছানায় বসে দাঁত দিয়ে হাতের নখ কাঁটছে।আবরার খানিকক্ষণ ওকে পর্যবেক্ষণ করে ওর সামনে বসে বলে,
-“তোমার সাথে বিয়ে হওয়ার ছয় মাস আগে আমি বিডিতে ব্যাক করি।প্রথমে ইরাকদের সাথে দেখা করার জন্য বাসায় গেলে জাস্ট একটা মেয়ের কথায় আওয়াজ শুনি।পরে জানতে পারি ওইটা তুমি যাকে ওরা নিজের বোন ভাবে।তার কিছুদিন পর ইফাজ জোর করে ওর বাসায় নিয়ে গেলে ডাইনিংএ প্রথম তোমাকে দেখে চমকে যায়।চমকায় কেন জানো?কারন তোমাকে আগে থেকে চিনতাম,ইলার মৃত্যুর সাথে তুমি জড়িত ছিলে।তোমার চেহারার একটুও পরিবর্তন হয়নি।ভাবছিলাম তুমি এখানে কেন?হতে পারে আমার মনের ভুল।পরে যখন তুমি নাস্তা দিতে গেলে কাছ থেকে খুব ভালো করে দেখলাম,তবে তুমি আমাকে দেখনি সেটা আমাকে খুব অবাক করলো।তারপর ইফাজের ল্যাপটপে কিছু ছবি দেখি,তোমার ব্যাপারে সবটা জানি।যেহেতু আমি সাইক্রেটিস তো ইফাজের মনে হলো হেল্প হতে পারে।তোমার ব্যাপারে জেনে ইন্টারেস্ট লাগলো,বলতে গেলে ভালো লেগে গেল।বাসায় জানালাম,মেঘ তোমাকে চেনে।পরে জানলাম তোমার বাবাও আমাদের অফিসে চাকরি করে।”
ইয়ারাবী অবাক চোখে আবরারের দিকে তাকায়।এমন গল্প সিনেমা-নাটক-উপন্যাসে অনেক পড়েছে,তবু বাস্তবে প্রথম দেখলো।আবরার আবার বলতে শুরু করলো,
-“দেখ,মানুষের কখন কীসে আকর্ষন হয় সেটা সে নিজেও জানেনা।আর ভালোবাসা সেটা মনের অজান্তে।তবে হ্যাঁ,আমি এতটাও উদার নই যে তোমাকে করুনা করবো।”
-“আমি আসলে…”
-“তোমাকে কোনো কিছু ব্যাখ্যা করতে হবেনা।সুতরাং এসব উল্টো-পাল্টা না ভেবে তুমিই আমার উপর করুনা করো প্লীজ।”
ইয়ারাবী বুঝতে পারছে আবরার প্রচুর রেগে আছে।ও যে রাগটা দেখাতে চাইছেনা তাও বুঝতে পারছে।ইয়ারাবী না পেরে কেঁদে ওর পায়ে পরে যায়।আবরার তাড়াতাড়ি ওকে টান দিয়ে সরিয়ে ফেলে বলে,
-“কী করছো তুমি?তুমি জানোনা কারোর পায়ে ধরতে নেই?”
-“আমাকে মাফ করে দিন।আমি এভাবে বলতে চাইনি।আসলে আমার জীবনটা এমন যে সব সময় মনে হয় কেউ আমাকে করুনা করছে।”
-“তোমার মনে হয় আমি তোমাকে করুনা করি?তুমি ভাবলে কী করে?”
-“আ…আমি সেটা বলিনি…আমি আমি”
-“ইয়ারাবী!রিল্যাক্স,একদম কাঁদবেনা তুমি।আমি জানি তুমি বলতে চাওনি বাদ দাও এসব।”
-“আপনি এত ভালো কেন?”
-“আমি অতটাও ভালো নই যেটা তুমি ভাবছো।”
ইয়ারাবী ওর কোলের উপর মাথা রেখে শুয়ে আছে, আবরার ওর আঙ্গুলগুলো দিয়ে চুলে বিলি কাঁটছে।ঘরে বেশ নিরবতা,কিছুক্ষণ পরে হঠাৎ ইয়ারাবী বলে উঠে,
-“খালামনিরাও আপনাকে চিনতো?”
-“ঘুমাওনি তুমি?”
-“চোখ বন্ধ করে আছি,বলেন…”
-“হামম,কেননা আমরা ছোটবেলার বন্ধু।”
-“জানেন প্রথমে আমার অবাক লাগছিলো।কেননা আপনার শ্বাশুড়ি যখন আমার বিয়ের কথা বলতো খালামনিরা খুব ক্ষেপে যেত।কিন্তু এবার উনি,খালু, ভাইয়ারা সবাই রাজি ছিলো।খুব অদ্ভুত লাগলেও ভাবতাম হয়তো আমার এতেই মঙ্গল লুকিয়ে আছে তাই।জানেন খালামনি কী বলতো?”
-“কী?”
-“বলতো তোকে এমন যায়গায় বিয়ে দিচ্ছে,যেখান থাকলে আমাদের আর চিন্তা করতো হবেনা।প্রথমে না বুঝলেও এখন বুঝছি।আর এখন এটাও বুঝছি ইমু অার শাহরিয়ার ভাইয়া আপনাকে নাম ধরে ডাকতে এতটা লজ্জা পায় কেন?”
আবরার ওর কথা শুনে হাসতে থাকে।আসলেই যাকে সারা জীবন ধরে বড় ভাইয়া বলে সম্মান করে এসেছে তাকে নাম ধরে ডাকতে গেলে লজ্জা তো পাবেই।ওদেরও সেই অবস্থা হতো,ইয়ারাবীর সামনে নাম ধরে ডাকতে গেলে কতটা অস্বস্তি হতো সেটা ওরা জানে।আবরার হাসি থামিয়ে বলে,
-“তুমি তো অলওয়েজ ওই বাসায় যেতে,থাকতে তুমি কী কখনো আমাকে দেখনি?”
-“উহু,ভাইয়াদের বন্ধুরা আসলে আমি যেতাম না।ওই বাসায় আমি যতদিন থাকতাম নিজের লাইফটা খুশিতে ভরে যেত।তবে টর্চারও খুব করতো খাওয়া নিয়ে।”
-“বয়স হিসাবে ওজন অনেক কম।”
-“তো,আমি খেয়ে খেয়ে মটু হতে পারবোনা।”
-“ওহ্ বাবা,কী রোমান্টিক সিন?”
দু’জনে দরজায় দিকে তাকিয়ে দেখে জারবা মুখে হাসি নিয়ে হেলেদুলে ঘরে ঢুকছে।ওকে দেখে ইয়ারাবী তাড়াতাড়ি উঠে চশমা পরে।আবরার ওর দিকে তাকিয়ে বলে,
-“কিছু লাগবে..”
-“হামম পিৎজা খাবো আর আড্ডা দিবো।বড় ভাবী,মম্ আর ভাইয়া বসে আছে,চলো…”
-“না তোরা যা,”
-“চলো,ভাইয়া।কিউট বোনের কথা রাখতে হয়..”
-“ফাজিল একটা,আচ্ছা চল….”
(১৪৬)
বিকেল ৫টায় টিএসসির মোড়ে একটা টং দোকানে বসে আছে অনু।পরনে সাদা সুতির থ্রী-পিচ, কোকড়ানো চুলগুলো একপাশে বিনুনি করা,ঠোঁটে হালকা লিপিস্টিক,কানে পাথরের সাদা রিং।অনেকটা সুন্দর লাগছে ওকে,তবে বড় বড় চোখের সাথে কপালে একটা টিপ পরলে অনেকটা ভালো লাগতো ওকে।তবে আজ কেন পরেনি সেটা ও নিজেও জানেনা,হয়তো মন ভালো নেই তাই।
দশমিনিট ধরে অপেক্ষা করছে প্রত্যয়ের জন্য। সকালে ম্যাসেজ করে জানিয়ে দিয়েছিল বিকেলে আসার কথা। অনু একটু আগেই এসেছে,কেউ ওর জন্য অপেক্ষা করুক সেটা ও চায় না। ২মিনিটের ভিতরে প্রত্যয় সেখানে আসল। অনুর পাশটাতেই বসল।,ও না বসলে হয়ত অন্য কেউ বসত। কিন্তু প্রত্যয় সেটা মানতে পারবে না। তাই অনু কিছু মনে করবে কি না সেটা ভাবার প্রয়োজন মনে করল না। প্রত্যয়ের বসা দেখে অনু বলল,
-” আপনার কি এখানে অসুবিধা হচ্ছে? অসুবিধা হলে আমরা অন্য কোথাও বসতে পারি। আসলে টং দোকানের চা আমার খুব পছন্দের। তাই আর কি…….”
অনুর কথা শুনে প্রত্যয় মুচকি হেসে বলল,
-“জানো অনু, ইউনিভার্সিটিতে পড়ার সময় এমন কোনো দিন ছিল না যে আমরা সব বন্ধুরা মিলে এই টং দোকানের চা খাইনি। ভাত খাওয়া রুটিনের মতো এটাও ছিল আমাদের একটা রুটিন। সবাই বিকেলে চা খেতে খেতে আড্ডা দিতাম। এখন সবাই কাজের চাপে ব্যাস্ত হয়ে পড়েছি। তাই আসা হয় না। খুব মিস্ করি জানো দিনগুলো। মনে হয় আবার যদি ফিরে পেতাম সেই সোনালি দিনগুলোকে।”
-“চলে যাওয়া সময় আর দিন কোনোটাই ফিরে আসে না। আচ্ছা চা খাওয়া যাক?”
-“হুম,অবশ্যই। আমি বলে আসি বসো তুমি।”
প্রত্যয় চা অর্ডার করে আসার ২ মিনিটের ভেতরেই দুধ চা চলে আসে। চা খেতে খেতে প্রত্যয় বলে,
-“তুমি কালকে কিছু বলতে চেয়েছিলে।”
-“হুম। কি বিষয়ে বলতে চেয়েছিলাম জানেন?”
-“কি?”
-“আমার অতীত। যা এখনো আমি বয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছি।”
-“অনু আমি তোমার অতীত ঘাটতে চাই না। এসব জেনে কি লাভ যেটা তোমার কষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।”
-“তবুও আমি চাই আপনি সবটা জানুন। তারপরে না হয়…..”
-“আচ্ছা বলো।”
-“চা তো প্রায় শেষ। কোনো খোলামেলা জায়গায় যাওয়া যাক?”
-” হুম চলো।”
-“জিজ্ঞেস করলেননা কোথায় যবো?”
অনুর এই প্রশ্নে প্রত্যয় কোনো জবাব দিল না। বিনময়ে দিল শুধু একটা হাসি।
প্রত্যয় একটা নদীর পাড়ে গাড়ি থামালো। অনু গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়িয়ে অবাক চোখে তাকিয়ে আছে। অনু চারপাশের প্রকৃতি দেখছে। প্রত্যয় যে ওর পাশে দাঁড়িয়েছে সেটা ওর খেয়ালই নেই। প্রত্যয় অনুকে বলল,
-” জায়গাটা সুন্দর তাই না?”
-“শুধু সুন্দর না। খুব সুন্দর। কিন্তু আপনি কি করে জানলেন নদী আমার ভালো লাগে?”
-” আরো অনেক কিছুই জানি ম্যাডাম। ক্রমশ প্রকাশ্য।”
-” আবার হেয়ালি। আচ্ছা চলুন ওখানটায় বসি।”
প্রত্যয় আর অনু নদীর কিনারায় পাশাপাশি বসল। কিছুক্ষণ চুপ থাকার ওর অনু বলল,
-“নদীতে ভেসে যাওয়া ওই কচুরীপানাগুলোর দিকে তাকান। একবার যে কচুরীপানা নিজের জায়গা থেকে সরে যায় তো পূর্ববর্তী স্থানে আর ফিরে আসেনা। আমাদের সম্মানটাও ঠিক তেমনই তাই না? একবার চলে গেলে আর ফেরত পাওয়া যায় না।”
-” হঠাৎ এই কথা?”
-” আমার গল্পটা ঠিক এমনই।”
-” মানে?”
অনু কিছু না বলে মুচকি হাসি দিয়ে নদীর দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।বাতাসের তালে তালে ওড়নার কোনাগুলো দুলছে।হঠাৎ করে নদীর পারের নরম ঘাসের উপর বসে বলা শুরু করল ওর অতীত।
২বছর আগে,,,,
“অনু তখন ইন্টার ফার্স্ট ইয়ারের স্টুডেন্ড,তাই নতুন ফোন কিনে দিয়েছিল ওকে ওর বাবা-মা। নতুন ফেসবুক এ্যাকাউন্ট খুলেছিল ও। সেখান থেকেই ওর পরিচয় হয় দীগন্ত নামের এক ছেলের সাথে।পরিচিত হয়ে জানতে পারলো ওরা একই বর্ষের শিক্ষার্থী, প্রথম প্রথম বন্ধুর মতোই কথা চলতো। কিছুদিন যাওয়ার পর দীগন্তই প্রথমে প্রপোজ করে অনুকে। অনু দেখতো ওর সব বান্ধবীদেরই বয়ফ্রেন্ড আছে,শুধু ওর নেই। তাই কিছু না ভেবেই দীগন্তের প্রপোজাল গ্রহণ করে নেয়। প্রথম দুই মাস সম্পর্কটা বেশ ভালোই চলছিল।অনু দীগন্তকে আস্তে আস্তে প্রচন্ডভাবে ভালোবাসতে শুরু করে। দিনে ঠিক কতবার কথা বলত তার ইয়ত্তা নেই। প্রতিদিন দেখা করা, কথা বলা যেন একটা রুটিনে পরিণত হয়েছিল।যার জন্য মাঝে মাঝে ক্লাস ফাঁকিও দিতো।কিন্তু কিছুদিন পর থেকেই দীগন্তের মাঝে পরিবর্ত লক্ষ্য করে অনু। অনুর এক্সট্রা কেয়ার যেন দীগন্তের ভালো লাগছিল না। তাই একটু কিছু হলেই অনুকে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করতে শুরু করে দীগন্ত। প্রতিদিন চোখের জল ফেলা অনুর জন্য ফরজ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। রাতের পর রাত জেগে থাকতো শুধু দীগন্তের সাথে কথা বলবে বলে। কিন্তু দীগন্তের কোনো ফোন আসত না। অনু ফোন দিলে ওয়েটিং দেখাত। অনু আস্তে আস্তে বুঝতে পারে দীগন্ত অন্য সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছে। কিন্তু অনু দীগন্তকে এতটা ভালোবেসেছিল যে ঠিক ভুল বিচারের ক্ষমতা পর্যন্ত হারিয়ে ফেলেছিল। সবকিছু জানার পরেও শুধু চেয়লেছিল দীগন্তের ভালোবাসা। এভাবে ছয়মাস চলার পর এমন একটা শর্ত দীগন্ত অনুকে দেয় যার জন্য মেয়েটা একদম প্রস্তুত ছিল না। একদিন দীগন্ত অনুকে ফোন করে বলে,
-“অনু আমি ব্রেকআপ করতে চাই।আমি আর নিতে পারছিনা তোমাকে।”
-“দীগন্ত প্লিজ এরকম করো না। আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি। তোমাকে ছাড়া থাকতে পারব না।”
-“তোমার এক্সটা কেয়ার আমার অসহ্য লাগে।তোমার মতো নেকামি আর কেউ করেনা।”
-“দীগন্ত এমনটা বলোনা।ওকে ফাইন আমার ফোন দেওয়াতে বিরক্ত হও,আজ থেকে করবোনা।তোমাকে রোজ দেখা করার জন্যও বলবোনা।সপ্তাহে একবার দেখা করবো,জাস্ট একঘন্টা একসাথে কাটাবো।প্লীজ তবুও আমাকে ছেড়ে যেওয়া।”
অনু কথাগুলো বলছে আর ও দু’চোখ দিয়ে নোনা জলের ধারা বইছে।ওপাশে দীগন্ত কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে আবার বলে উঠে,
-” ওকে থাকব। কিন্তু আমার একটা শর্ত আছে।যদি তুমি শর্ত মানো তবে আমি থাকবো তোমার সাথে।”
অনুর মুখে হাসি ফুঁটে উঠলো,ওড়না দিয়ে চোখ মুছলো।এক মুহুর্তের জন্য কোনো কিছু চিন্তা না করে বললো,
-” কি শর্ত বলো। আমি তোমার সব শর্ত মানতে রাজি।”
-“তুমি তোমার কিছু হট পিক আমাকে দিতে হবে।”
-“মানে? দীগন্ত তুমি এগুলো কি বলছো? আমি কখনই পারব না।”
-“তাহলে তুমি আমাকে ভুলে যাও।”
-“প্লিজ বোঝার চেষ্টা করো।”
-“তুমি দেবে? হ্যাঁ নাকি না?”
কথায় বলেনা,ভালোবাসা এমন এক জিনিস যা পাওয়ার জন্য মানুষ মরিয়া হয়ে ওঠে,হিতাহীত জ্ঞান হারিয়ে ফেলে।অনুরও ঠিক তাই হয়েছিলো, দীগন্তকে পাওয়াটায় ওর প্রধান লক্ষ্য ছিলো।যার জন্য ও সমস্ত বাঁধা পেরতে পারে।আচ্ছা এটা কী আদেও ভালোবাসা?ভালোবাসাকে আটকে রাখার জন্য তার অশ্লীল শর্ত পূরন করতে হবে?ঠিকবে তো এই ভালোবাসা?নাকী দীগন্তের দেওয়া কোনো ধোঁকা হবে সেটা?
সেদিন অনু নিজের সাথে যুদ্ধ করে দীগন্তের কথা মতো কিছু ছবি পাঠায়। তারপর দুমাস আর কোনো সমস্যা হয়নি। দুজনে বেশ ভালোই ছিল। তবুও দীগন্ত অনুকে লুকিয়ে অন্য রিলেশন করত। অনু জানলেও কিছু বলত না,বড্ডো ভালবাসত যে। কিন্তু সমস্যাটা হয় তখন,যখন অনুর বাসায় ব্যাপারটা জেনে যায়। অনুর মা দীগন্তকে অনেক বকাবকি করে সাথে অনুকেও। কেউই চাইছিলো না ওরা একসাথে থাকুক। সবার সাথে লড়াই করে অনু চেয়েছিল সম্পর্ক যাতে শেষ না হয়। কিন্তু দীগন্ত শেষ পর্যন্ত ওকে ছেড়ে চলে যায়। অনু তখন পাগল প্রায়। ফোন কেড়ে নেওয়া হয়েছিল ওর থেকে। কোনোভাবেই যোগাযোগ করতে পারছিল না দীগন্তের সাথে,হয়তো দীগন্তও চাইছিল না যোগাযোগ রাখতে। অনুর পাগলামি দিন দিন বাড়ছিল। সুইসাইড করতে চেয়েছিল কিন্তু পারেনি। একপর্যায়ে ওকে ঢাকায় নিয়ে এসে সাইক্র্যাটিস্ট দেখানো হয়। কাউন্সিলিং এর পর ও কিছুটা স্বাভাবিক হয়। এভাবে তিন মাস যাওয়ার পর অনু পুরোপুরি ভালো হলে অনুর মা-বাবা ওকে ওর ফোন ফেরত দেয়। কিন্তু অনু কল্পনাও করেনি যে ওর জন্য ঠিক কি অপেক্ষা করছে।
অনু ওর এক বন্ধুর মাধ্যমে জানতে পারে ওর কিছু ছবি ভাইরাল হয়েছে। ইনবক্সে সবাই ওর ছবি দিয়ে বিভিন্ন বাজে বাজে কথা বলতে থাকে।অনু ছবিগুলো দেখে চমকে যায়। কারণ এই সেই ছবি যা অনু দীগন্তকে দিয়েছিল।দীগন্ত তাহলে অনুর সর্বনাশটা করেই দিয়েছিল।ভালোবাসার নামে ধোঁকাটা লিখে দিলো।মরে যেতে চেয়েছিল,ওর মা বন্ধুর মতো তখন ওকে আগলে রেখেছিল। তাই এখনো বেঁচে আছে।তবে সমাজ আর সম্মানের ভয়ে কোনো প্রশাসনের সাহায্য নেয়নি ওর পরিবার।তবে একটা ভাবে অনু প্রতিবাদ করতে চেয়েছিলো কিন্তু দীগন্ত তার কুট-বুদ্ধি দিয়ে নিজেকে বাঁচিয়ে নেয় আর এটাই ওই বোকা মেয়েটাকে বলে,কেউ ওর অ্যাকাউন্ট হ্যাক করে কাজটা করেছি।অনু প্রথমে বিশ্বাস করলেও এখন আর করেনা।ও যখন বুঝতে পারলো তখন একজনের সাহায্য নেয় দীগন্তের বিরুদ্ধে প্রমানের জন্য।কেননা সমাজ প্রমানে বিশ্বাসী।তবে দীগন্ত সেই দাবার গুটি পাল্টে দিয়ে নিজেকে নিরাপদে রেখে ওর আশার আলোকে আবার নিভিয়ে।”
পুরো গল্পটা শেষ করে অনু প্রত্যয়ের দিকে তাকাল। প্রত্যয় সামনের দিকে তাকিয়ে আছে। ওর চোখগুলো লাল হয়ে আছে।অনু মুচকি হেসে বললো,
-” আমি এখন ভাইরাল। এমন মেয়েকে কেউ তার জীবনসঙ্গী করতে চাইবেনা। আমি জানি আপনিও চাইবেননা। আর আমি কাউকে নিজের স্বার্থের জন্য ঠকাতে চাই না।ভালো থাকবেন,আর ভালো একটা মেয়েকে নিজের জীবনসঙ্গী করে সুখী থাকবেন,চলি।”
প্রত্যয় কিছু বললনা। অনু ফিরে চলল নিজের গন্তব্যে। চোখে নোনা জল। টুপ টুপ করে ঝরে পড়ছে। অনু জানে এই জল মুছিয়ে দেওয়ার কেউ নেই।ওকে একাই চলতে হবে। একদম একা….এক নিঃসঙ্গ পাখি যার সঙ্গ দেওয়ার কেউ নেই।ডানা তো আছে তবে মুক্ত বিহঙ্গে উড়ে চলার ক্ষমতা নেই।যে কিনা দিন-রাত,ঝড়-ঝাপটার ভিতর নিজের নীড়ে একাই বসে থাকে…
আচ্ছা দোষটা এখানে কার?হ্যাঁ,অনুর দোষ আছে।সে না হয় ভালোবাসায় পুরোটা অন্ধ ছিলো।তবে দীগন্ত যেটা করেছে সেটা কী ঠিক করেছে?শুধু দীগন্ত নয় এমন অনেক ছেলে আছে যারা উড়তি বয়সের মেয়েদের নিজেদের জালের শিকার বানায়।তবে সমাজে বারবার অনুর দিকে চোখ তুলেছিলো,কেউ বলেনি দোষটা ছেলেটারও আছে।আসলে আমাদের সমাজটাই এমন,যেখানে ঠিক-ভুল বিবেচনা না করে সম্পূর্ন দোষ একটা মেয়েকেই দেওয়া হয়।
(১৪৭)
সময় নদীর স্রোতের মতো বয়ে যায়,যাকে হাত দিয়ে ধরে রাখা যায়না।কাল আবরারের মুখ থেকে সব শোনার পরও মন কিছুতেই বসছেনা,বই খোলা কিন্তু পড়তে পারছেনা।কিছু একটা মনে করে ও অনুর নাম্বারে কল দেয়।তিনবার রিং বাজার পর চার বারের বার অনু ফোনটা উঠিয়ে রিসিভ করার সাথে সাথে ইয়ারাবী সালাম দিয়ে বলে,
-“ফোন দিসনি কেন?”
-“ব্যাল্যান্স ছিলোনা,অনলাইনে ঢু মার,দেখ কত ম্যাসেজ পাঠায়েছি।”
-“ওহ্হ্,আজকাল অনলাইনে খুব কম যাওয়া হয়।”
অনু কথাটা শুনে হেসে হেসে বলে,
-“হ্,তা তো হবেই।বর তো তোমারে ছাড়েনা তা আইবা ক্যামনে?”
-“বেশি বুঝবিনা,”
-“আচ্ছা বাবা স্যরি,রাগ করিসনা।এখন বল কেন আসতে পারিসনি।আমার জানা মতে তোর তো সারাদিন লেখাপড়া করেই দিন কাঁটে, আউটডোরের কাজও ছিলোনা এবার।”
-“হ্যাঁ,তুই ঠিকই বলেছিস।পড়াশোনা,আড্ডা আর চেলসির সাথেই সময় পার হয় দিনে।আসলে এই কয়টা দিন ফোন ব্যাবহার করতে পারছিনা,বেশি ব্যবহার করে মাথা যন্ত্রনা…”
-“তোর এটা আমার নরমাল লাগছেনা কিন্তু…”
-“হ্,এইবার বলে দে,এই সব তোর দাদা-দাদির ও হইছিলো আর তারা পটল তুলছে…”
-“বাজে বকবিনা,ডাক্তার দেখা।জিজুকে বলছিস…”
-“উহু,একে মোটা মোটা ইনজেকশন আর তিনবেলা মেডিসিন।আর এখন যদি এসব বলি আমাকে হাসপাতালে এডমিট করবে।”
-“দোস্ত একটা সত্যি কথা বলি…”
-“বল,তোরে কেউ আটকে রাখছে?”
-“মাফ করে দে বোইন,কয়তাছি শোন।আমার দূরসম্পর্কের এক কাকী ছিলো।তারও প্রায় মাথাব্যাথা করতো,অবহেলা করতো পরে জানা গেল মাথায় যেখানে আঘাত পেয়েছিলো,ধীরে ধীরে সেখানে রক্ত জমে টিউমারে পরিনত হয়েছিলো।”
-“মুরুব্বি বাইচা আছে নাকী পটল তুলছে…”
অনু খুব অবাক হচ্ছে ইয়ারাবীর আচারনে।এমনভাবে কথা বলবে ও সেটা ভাবতে পারছেনা।ইয়ারাবী যে আমার ফিরে আসছে এটা ওর কথার দ্বারা বোঝা যাচ্ছে।অনু হেসে বলে,
-“খুব ভালো লাগছে…”
-“কার?”
-“তোকে…”
-“অডিওতে কথা বলছি,ভিডিও নয় বুঝলি।”
-“আরে গাধী তোর কথাগুলো,জানিস কত মিস করি এইগুলোকে।”
-“বাদ দে এসব,কাল কেমন কাঁটলো?”
-“ভালো…”
-“কী হয়েছে বল?”
অনু একবার বলতে চাইলো তবে ওর প্রেশার পরবে বলে বলিনি।ইয়ারাবী অনুর ব্যাপারে সব জানে শুধু ভাইরাল হওয়া বাদে।ও চাইনা ইয়ারাবী কিছু জানুক।তাই নিজেকে সামলে বললো,
-“হ,দোস্ত হেব্বি মজা হইছে।”
-“পিক দে দেখমু,তোর উপর বিশ্বাস নাই।”
-“পিক তুলি নাই…”
-“তার মানে ডালের ভিতর কালো কিছুমিছু তাইতো…”
-“ডালের ভিতর কালো নেই দোস্ত,একদম হাছা কথা।”
-“সত্যি!”
-“হ্,সত্যি।”
-“আচ্ছা শোন আমার সাথে নীলক্ষেতের ওইদিকে যেতে পারবি?”
-“কেন?”
-“কারোর সাথে দেখা করবো,বাট্ তোর জিজুকে জানানো যাবেনা।”
-“নিশ্চয়ই এমন কোনো ব্যাক্তি যে কালনাগিনী মতো তাইনা।এবার বলেই দে কে সে?সাসপেন্স রাখলে ভাত হজম হইবোনা।”
-“আসলে জারিকা আপু,ওর কিছু কথা আছে তাই।”
-“ইয়ারাবী আর ইউ ম্যাড?”
-“তুই যাবি আমি জানি।রেডি হয়ে থাক মুই আইতাছি।”
-“নীলক্ষেত কেন?তুই কথা এড়িয়ে যাচ্ছিস কেন?”
-“উহু,নীলক্ষেত পরিচিত কারোর থাকার চান্স নেই।আসলে আমার ভাগ্য খারাপ,কাউকে লুকিয়ে কিছু করতে গেলে ধরা খেয়ে যায়।তাই এই ব্যবস্থা।”
-“ঠিক আছি,তুই রাখ আমি ভাত খামু…”
ইয়ারাবী কলটা কেঁটে রেডি হয়ে শ্বাশুড়ির রুমে যেয়ে ওনাকে বলে বাইরে বেড়িয়ে ট্যাক্সি নেয়।মিসেস রায়হান গাড়ি নিয়ে যেতে বলেছিলেন তবে ও নেয়নি।কেননা ড্রাইভারকে সাথে নেওয়া মানে আবরারের জেনে যাওয়ার নিশ্চয়তা।ও প্রথমে অনুর বাসায় যেয়ে ওকে সাথে নিয়ে নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছাতে দু’ঘন্টা লাগে।ওর বলা কফি হাউসে ঢুকে কর্নারের টেবিলের দিকে তাকিয়ে জারিকাকে দেখতে পায়।আজ জারিকা খুব সিম্পিল ভাবে বের হয়েছে,না আছে মুখে সেই লাবন্য না আছে পরনে সেই দামী শাড়ি।খুবই সামন্য একটা ফিরোজা রঙের সুঁতির শাড়ি,আর চুলগুলো বিনুনি করা।আসলে যার যেমন তার সেটা নিয়ে সন্তুষ্ট থাকা উচিত,নয়তো বেশি লোভ করলে একুলও যায় ওকুলও যায়।
যখন জারিকার ব্যাপার জানাজানি হলো তখন সায়নের সত্যিটাও সামনে আসলো।সায়নের বাবা অর্থাৎ পল্লবীর শ্বশুড় ওনার ছেলেকে বলে দিলেন, হয়তো শুধরাবে নয়তো ত্যাজ্যপুত্র করবে।আর যা সামন্য আছে সবকিছু পরীর নামে করে দেবে।
পল্লবী শুধু জানতো সায়ন পরকীয়া করে তার জন্য ওকে হাদিস-কালামের মাধ্যমে সঠিক জ্ঞান দিয়ে সঠিক পথে আনছিলো।ব্যাপারটা ওর শ্বাশুড়ি ছাড়া কেউ জানতোনা।সায়নও ভুল বুঝতে পেরেছিলো,তবে মাঝে যেয়ে সত্যটা সবাই জেনে গেল।পল্লবী জারিকার পরিবারের সাথে সম্পর্ক ভেঙে দেয়।মিসেস নিন্দু পল্লবীকে কথা শুনালে পল্লবী প্রতিবাদ করে।যার ফলে ওর মা ওকে ক্ষমা চাইতে বলে মামীর কাছে।তবে পল্লবী সেটা করেনা।ওর মা একটা কথা বলে,
-“বরকে ধরে রাখতে পারিস না,কেমন মেয়ে তুই?সমাজের ভয় কর,বাড়ির ভিতরের ঝামেলা বাইরে কেন আসবে?তোর দোষ তুই সায়নকে বেঁধে রাখতে পারিসনা।নিজের রুপ দিয়ে কী করিস যে বর অন্যের পিছন ঘোরে..”
আরো অনেক কথা বলে যা ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়।কিন্তু পল্লবী এবার ভেঙে পরেনা,ও নিজের মায়ের জন্য তার সাথেও সব সম্পর্ক ভেঙে দেয়।আর বাকী রইলো,জারিকার সেই খালাতো ভাই।সবাই সব কিছু জানার পর সেই ভাইও পলাতক হয়ে যায়।আসলে সত্য বলতে,জারিকার সব আশা জলে ধুয়ে গেল।লোভ আজ ওর এই পরিনতি করেছে,কী জানে নতুন আবার কোনো চাল চালার জন্য ইয়ারাবীর জীবনে ঢুকতে চাচ্ছে নাকী?
ইয়ারাবী একাই আসতে চেয়েছিলো তবে জারিকার প্রতি বিশ্বাস নেই।মেঘকে নিয়ে যা রটানোর চেষ্টা করলো,এবার কোনো ফাঁদ ফাতলো সেটা ওই জানে।তাছাড়া যেহেতু কাউকে জানাতে নিষেধ করেছে তাই ও সাথে অনুকে নিয়ে এসেছে।
#চলবে_____