#জীবন মানে তুমি
#লেখিকা:H.B.Rini (Irini Ori)
#পর্ব:৪১
(১৩৮)
সকাল ধরে আদিবা একরাশ চিন্তা নিয়ে বসে আছে। বুঝতে পারছে না কি করবে? আদিবার শাশুড়ি ওর রুমের দরজায় এসে নক করে ভিতরে ঢুকে বলে,
-” কি হয়েছে তোমার?সকাল থেকে মন খারাপ করে বসে আছো।কোন সমস্যা,আছে হাসান কিছু বলেছে?”
-” না মা কিছু হয়নি।”
-” ও,আজ হাসানের ফিরতে লেট হবে।তোমার ফোন বন্ধ ছিল তাই আমাকে ফোন করে বলল, অফিস থেকে কোথাও যাবে আর কি।”
-“আজ আসতে লেট হবে। ঠিক আছে আমি ভাতের চাল বসিয়ে দিচ্ছি,আর কী তরকারি রান্না করবো মা? আপনি বলে দেন,আমি করে ফেলি।ওতো মনে হয় বাইরে থেকে খেয়ে আসবে।”
-“হ্যাঁ বৌ,যেদিন ফিরতে দেরি হয় সেদিন খেয়ে আসে।”
-” মা,বলেন কি রান্না করবো?”
-” ছোট মাছ আর পেঁয়াজ দিয়ে ঝোল আর ইলিশ মাছ ভুনা এই হবে।আর তুমি যদি কিছু খেতে চাও করতে পারো।”
-“আমারো এটাই চলবে….”
আদিবা যেয়ে রাতের রান্নাটা চুলায় চাঁপিয়ে দেয়।তারপর ফ্রিজ থেকে মাছ বের করে পানিতে ভিজিয়ে রাখে।হঠাৎ করে ওর শ্বাশুড়ি ওর ঘাড়ে হাত রেখে একটা ছোট কিছু দেখিয়ে বলে,
-“এটা কী?”
আদিবা অনেকটা লজ্জা পায়।লজ্জাতে কিছু বলতে পারছেনা,মনে হচ্ছে মাটি ফাঁকা করে তার মধ্যে ঢুকে গেলে ভালো হয়।মুখে লজ্জাভাব মাথা নিচু করে দু’হাত মুড়ামুড়ি করছে।ওর শ্বাশুড়ি হেসে বলে,
-“এত শুভ খবর আর আমাদের জানালেনা?”
-“মা,আজ সকালেই জেনেছি,আর…”
-“পাগলটা জানে?”
-“উহু,বলেনি এখনো।ভাবছি কীভাবে বললো আর ওই বা কীভাবে নিবে?”
-“এই জন্য সকাল থেকে মুখভার করে বসে ছিলে?পাগলি,তুমি রুমে যাও বাকীটা আমি সামলে নিবো?”
-“কিন্তু মা রান্না…”
-“এ সময় এসব করতে নেই,বরং বেশি বেশি রেস্ট নিতে হয়।”
-“কিন্তু মা…”
-“বলছিনা ঘরে যাও..”
আদিবা ওর শ্বাশুড়ির কথা শুনে ঘরের দিকে পা বাড়ালো।ওর শ্বাশুড়ি মুচকি হেসে নিজের ঘরে যে উনার স্বামীকে কথাটা জানান।উনার স্বামীর আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করে বাজারে যান মিষ্টি আনতে।
রাত আটটার দিকে হাসান বাসায় ফিরতেই আদিবা অবাক হয়ে তাকিয়ে বলে,
-“তোমার না রাতে আসার কথা?”
-“হ্যাঁ,কিন্তু মা ফোন করে ইমার্জেন্সি আসতে বললো।কী হয়েছে আদিবা?সব ঠিক আছে তো?”
-“আমিতো কিছু জানিনা।”
-“মা কোথায়?”
-“মা,এখানে।”
হাসান পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখে ওর মা মিষ্টি হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।হাসান ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বলে,
-“ডায়াবেটিস হয়েছে তার উপর মিষ্টি খাচ্ছো?তোমাদের না ডাক্তার নিষেধ করেছে?”
হাসানের মা হালকা হেসে বলেন,
-“সব সময় তো খাইনা,তবে আজকের মতো শুভ দিনে খেতেই পারি।তাছাড়া পাশের বাড়িগুলোতে মিষ্টি দিতে গেছিলাম।”
-“কেন?”
-“আগে তুই খা,তারপর বলছি।”
বলেই হাসানের মা ওর মুখে বড় একটা মিষ্টি পুরে দেয়।হাসান ওর মায়ের দিকে তাকিয়ে বলে,
-“কে এনেছে?”
-“তোর বাবা,বিসমিল্লাহ্ নামের যে দোকানটা ওখান থেকে।কেন ভালো হয়নি?”
-“হয়েছে বাট্ এসব কিছু বুঝতে পারছিনা।তুমি দ্রুত আসতে বললে,আদিবাও কিছু জানেনা আর এখন মিষ্টি।কী হয়েছে বলবে?আর মিষ্টি কীসের?”
-“নতুন অতিথী আসছে তার খুশিতে।আল্লাহ খুশি হয়ে একজন ছোট মেহমানকে আমাদের ঘরে পাঠাচ্ছে।”
-“মানে?”
হাসান ওর মায়ের কথায় খানিকটা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায়।ওর মা বুঝতে পেরে হেসে বলে,
-“আরে পাগল আমি দাদী হবো আর তুই বাবা হবি।”
-“কী? সত্যি!”
-“হ্যাঁরে হাসান…”
হাসান মুখে হাসির ঝলক নিয়ে আদিবার দিকে তাকাই।আদিবার লজ্জায় নুয়ে পরার মতো অবস্থা।ও আর লজ্জায় দাঁড়িয়ে থাকতে না পেরে রুমে দৌঁড় দেয়।ও শ্বাশুড়ি হাসানের দিকে তাকিয়ে বলে,
-“মেয়েটা লজ্জা পেয়েছে,যা ওর কাছে।আর শোন বাসায় একটা কাজের মেয়ে রাখার ব্যবস্থা করবি।”
-“ঠিক আছে মা,”
হাসান রুমে ঢুকে দেখে আদিবা উল্টো দিকে মুখ করে বসে আছে।হাসান ওর সামনে বসে ওর দু’হাত নিজের মুঠোয় নিয়ে বলে,
-“তুমি বলোনি কেন আমাকে?”
-” আমার লজ্জা লাগছিলো।”
-“মা হওয়া কোনো লজ্জার বিষয় নয়।আলহামদুলিল্লাহ আমি খুব খুশি হয়েছি তবে..”
-“তবে কী?”
-“তোমার পড়াশোনা আর…”
-“শুনো হাসান,আমার যথেষ্ট বয়স হয়েছে বাচ্চা নেওয়ার।তাছাড়া বিভিন্ন সমস্যার কারনে আমি লেখাপড়ায় পিছিয়ে আছি।তাই এতো ভেবোনা…”
-“না ভাবতে তো হবেই,আমাদের পরীর জন্য।”
-“তুমি এত সঠিক কীভাবে বলছো মেয়ে হবে?”
-“দেখো ছেলে-মেয়ে সেটাই হোক না কেন আমি তাতেই খুশি।চলো দু’জন নামায পড়ে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করি।”
-“হ্যাঁ,সেটা চলো।”
হাসানরা ওযূ করে এসে নামাযে দাঁড়াতে যাবে তখন তার শ্বাশুড়ি ঘরের দরজায় টুকা দিয়ে বলে,
-“বৌ একটু আমার ঘরে আসবে?”
-“আসছি মা,হাসান আপনি নামায পড়ুন আমি আসছি মায়ের কাছ থেকে…”
আদিবা একপা,দুইপা করে ওর শ্বাশুড়ির ঘরে সামনে এগিয়ে যায়।ওর শ্বাশুড়ি ওকে দেখে ঘরে আসার জন্য ইশারা দেয়।ওর শ্বশুড় পাশে বসে কোরআন তিলাওয়াত করছে।ওর শ্বাশুড়ি ইশারা করে পাশে বসার জন্য।তারপর একটা বক্স বের করে ওর দিকে তাকিয়ে বলে,
-” এটা আমার শাশুড়ি আমাকে দিয়েছিল হাসান হবে শুনে। আজ আমিও এটা তোমাকে দিলাম, এটার প্রাপ্য অধিকার তোমার।তাছাড়া তোমার গলাতেও মানাবে।”
-” কিন্তু মা,এটা কি দরকার ছিল?আপনাদের দোয়ায় যথেষ্ট আমার এসব লাগবেনা।”
-” শাশুড়ি হিসাবে আমার কর্তব্য আছে।তাই আমি তোমাকে দিলাম।সুতরাং তোমার এটা নিতে হবে।”
-” ঠিক আছে,আমি আর না করছি না।”
-” নামাজ পড়ার জন্য নিশ্চয় দাঁড়াচ্ছিলে।যাও, নামাজটা আদায় করে নাও। ওই পাগলটাও মনে হয় দাঁড়িয়ে আছে।”
আদিবা ওর শ্বাশুড়ির কথা শুনে মুচকি হেসে ঘর থেকে বের হয়ে যায়।ওর শ্বাশুড়ি ওর যাওয়ার দিকে চেয়ে থাকে।
(১৩৯)
জারা রাত নয়টার দিকে ছাদে উঠে ট্যাংকির উপর বসে আছে।এই স্বভাবটা ইয়ারাবীর কাছে থেকে পেয়েছে,কেননা যদি ইয়ারাবীর মন খারাপ হতো তখনি ছাদে যেয়ে বসে থাকতো।সেটা দুপুর হোক বা রাত,ওর কাছে বিষয় না।আজ জারা আব্বু-আম্মু কেউ বাসায় নেই।ও একপাক ইমনের সাথে দেখা করার জন্য ওই বাসায় যেতে চেয়েছিলো কিন্তু পরে ফোন করে শুনে,আজই ওর ভাই ইমনের বন্ধুদের সাথে ওকে নওগাঁ ঘুরতে পাঠিয়েছে।জারা কী করবে বুঝতে পারছেনা,রাগ করবে যে ওকে না জানিয়ে গেছে নাকী খুঁশি হবে এটা ভেবে যে ছেলেটা স্বাভাবিক আছে?আসলে অল্প বয়সে প্রেম করলে যা হয়।
জারা একটা লম্বা নিঃশ্বাস ফেলে ছাদ থেকে নেমে নিজের ফ্লাটে ঢুকে আলো জ্বালিয়ে দেয়।তারপর গ্যাসের চুলা অন করে সেটাতে দু’কাপ পানি গরম করতে দেয়।যদিও ওর মা সব রান্না করে গেছে তবুও ওর মন খারাপ হলে বেশি ঝাল দিয়ে নুডুলস্ রান্না করে খায়।
প্রথমে সবজিগুলো ছুরি দিয়ে কেঁটে শেষে পেঁয়াজ কাঁটতে যেয়ে ওর চোখের পানি নাকের পানি এক হয়ে যায়।ও চুলায় একে একে সবকিছু দিয়ে ঝালের পরিমান বেশি করে দিয়ে রান্না শেষ করে বাটি নিয়ে নিজের রুমে যেয়ে বিছানার উপর বাবু হয় বসে।কোলের উপর একটা বালিশ দিয়ে তার উপর বাটি রেখে টিভি চালু করে।সামনে হিন্দি অ্যাকশন মুভি দেখছে আর ঝাল নুডুলস্ খাচ্ছে।হঠাৎ করে ওর ফোন বেজে উঠে।ফোনের আওয়াজে অনেকটা খুশি হয় কারণ ওর মন বলছে ইমন কল করেছে।কিন্তু ফোনের স্ক্রীনের দিকে তাকিয়ে সব আশা পানি হয়ে যায়।কেননা ইমন ফোন করেনি বরং করেছে ওর কাছের বন্ধু নুসবা।ও একরাশ বিরক্তি নিয়ে ফোনটা কানে ধরে বলে,
-“যা কইবার মাত্র দু’মিনিট কইবি,বান্দরী?”
-“ক্যান?জিজুর সাথে কী ঝগড়া বাঁধছে,সুন্দরী?”
জারা চোখ-মুখ লাল করে নাক ফুঁলিয়ে বলে,
-“ওর কথা কইবিনা,ওই পোলারে আমি ছারুম না।”
-“কী করছে উনি?”
-“আমারে না কইয়া নওগাঁ গেছে?ক্যান একটা বার জানাইলে কী হইতো?”
-“তুই কই থ্যাইকা শুনলি?”
-“ইফাজ ভাইয়া কইলো…”
-“হইতে পারে,পৌঁছায়ে তোরে ফোন দিবার চাই।তাই মনে হয় দেয় নাই।”
জারা গলা খাকিয়ে বলে উঠলো,
-“ও চামচিকার বৌ,তুই আমার বন্ধু না ওর।তোর লগেও কথা নাই।”
-“আরে সাদি আমার কথা শোন…”
-“চল,কমুনা কথা।খবরদার ফোন দিবিনা,মটকা গরম আছে আমার নোয়াখালী।”
জারা ফোনটা কেঁটে দিয়ে বিছানায় টান মেরে যেই ফেলতে যাবে,তখনি আবার ওর ফোন বেজে উঠে।তাকিয়ে দেখে ইমন ফোন করেছে,ফোন ধরবেনা ভেবে রাখতে যেয়েও আবার কী মনে করে ফোনটা রিসিভ করে কানে দিতেই ইমন বলে উঠে,
-“জানি খুব রাগ হচ্ছে,তবে এই মাত্র পৌঁছালাম।ভাইয়াকে কল করলাম এবার তোমাকে।আসলে আমার আসার ইচ্ছা ছিলোনা,তবে ছোট ভাইয়ার উপর কথা বলতে পারিনা তা তুমি জানো।আর আম্মুর কথা মনে পরছিলো তাই অন্য কিছু ভাবতে পারিনি।”
-“আমি রাগ করিনি…”
-“জানি রাগ করছো।ঝাল খাচ্ছো তাইনা…”
-“হ্যাঁ,ভালো লাগছে।”
-“আচ্ছা শোন,রবিনের দাদা অনেক সুন্দর মাটির জিনিস বানায়।তোমার জন্য কিছু নিয়ে আসবো।”
-“যা মন চাই নিয়ে এসো,তবে খাবার বেশি এনো।”
-“ওইটা তুমি না বললেও আনতাম…”
-“জানি,আপিপুর জন্য।তাই চকলেট আর আচার আনবে তাইতো…”
-“হ্যাঁ,তুমি তো জানো।বাইরে গেলে ও শুধু এই দু’টা জিনিস নিয়ে আসার জন্য বায়না করতো।”
-“তোমার কথা হয়েছে আপিপুর সাথে…”
-“না,তোমার..”
-“না,আপুর সাথে কথা বলার সুযোগ হয়ে উঠছেনা।এই জানো?”
-“কী?”
-“আদিবা আপুর বেবী হবে?”
-“আলহামদুলিল্লাহ্,এখন যদি সু-বুদ্ধি উদয় হয় আরকী…”
-“আপু ভালো হয়ে গেছে।”
-“সাদি ভালো হওয়া মুখের কথা নয়।হ্যাঁ,হওয়ার চেষ্টা করছে সেটা বলতে পারো।”
-“তা ঠিক,আচ্ছা ডিনার করছো?”
-“উহু,কেবল পৌঁছালাম।রবিনের আম্মু আয়োজন করছে,ফ্রেস হয়ে তারপর খাবো।”
-“এই তোমরা কারা কারা গেছো?”
-“আমি,শাহরিয়ার,রবিন,ভোর,শুভ্র,রাকিব আর রাসেল।”
-“ওই রবিনের কী বোন আছে?”
ইমন কিছু একটা ভেবে বলে,
-“হ্যাঁ,আছে।হেব্বি কিউট,মনটা সব সময় চাই দু’গাল ধরে টানি।কত গুলুমুলু…”
-“ওই কী কইলি?তোর সাহস তো কম না।”
-“আরে রাগছো কেন?আরে বাবা,রানির বয়স ইয়ামিলার মতো।পিচ্চি মেয়ে,মাদ্রাসায় পড়ে।তাছাড়া তুমি জানো,বোনদের ছাড়া কোনো মেয়ের দিকে প্রয়োজন ছাড়া তাকায়না।”
-“হ্যাঁ,জানি।আচ্ছা ফ্রেস হয়ে নাও,তোমার রেস্টের দরকার…”
-“ঠিক বলছো,রাখি…”
ইমন ফোনটা কেঁটে দিয়ে পকেটে ঢুকিয়ে পুকুড়ের শান বাঁধানো জায়গায় বসে থাকে।এই জায়গাটা রবিনদের পৈতৃক সম্পত্তি।রবিন ইমনের খুব কাছের বন্ধু,নওগাঁ থেকে ঢাকায় ম্যাসে থেকে পড়াশোনা করছে।বাড়ি আসবে তাই ইমনদের কেউ সাথে করে নিয়ে আসলো,যাতে ওর মন ভালো হয়।কথায় আছেনা,”সু সময়ের বন্ধু প্রকৃত বন্ধু।”এরাও ঠিক তাই,সাতজনের ছোট একটা দল।অবশ্য রবিন ভার্সিটিতে এসে ওদের দলে যোগ দিয়েছে।
ইমন অন্ধকারে পাড়ে বসে একটার পর একটা ঢিলা পানিতে ছুড়ে মারছে।হঠাৎ রবিন এসে ওর পাশে বসে বলে,
-“মা ডাকছে,ফ্রেস হয়ে খেতে চল।”
-“যাচ্ছি…”
-“মন খারাপ,তাইনা?”
-“না তেমন কিছুনা।”
রবিন কিছুটা হেসে বলে,
-“মৃত্যুর আগ অব্দি জীবন চলতে থাকবে।একমাত্র মৃত্যুই যা জীবনকে থামিয়ে দেয়।”
-“চল,ক্ষুদা লাগছে।”
ইমন খানিকটা হেসে কথাটা বলে।রবিনও আর কথা বাড়াতে চাইনা।তাই বাড়ির ভিতরে পা বাড়ায়।
(১৪০)
সবাই ডাইনিং টেবিলে বসে আছে শুধুমাত্র ইকরা আর ইয়ারাবী ছাড়া।মেঘ পানির গ্লাস থেকে পানি ঢেলে বলে,
-“মাইয়াগো আইতে এতো টাইম লাগে কে?খেতে আইবো তাও আটা-ময়দা মাখতে হয়।”
আবরার জুস খেতে বলে,
-“আমার বৌ আটা-ময়দা মাখেনা বুঝলি।”
-“হ,টাকা বাইচা গেছে,তার জন্য মোরে শুকরিয়া আদায় করো।”
জারবা প্লেট আঙ্গুল দিয়ে মাপতে মাপতে বলে,
-“বড় ভাবীও করেনা…”
মেঘ জারবার চুল টেনে বলে,
-“দোয়া কর ননির মা,এমন একটা বৌ যেন আমিও পায়।”
মি.রায়হান মেঘের দিকে তাকিয়ে বলে,
-“হয়তো দু’মেয়ে মিলে কথা বলছে তাই দেরি হচ্ছে।মেঘ লেখাপড়া কেমন চলছে?এক্সাম তো দিলে রিজাল্ট তো দেয়নি তাইনা?”
-“হ্যাঁ,বড় আব্বু।খোলার সাথে সাথে রিজাল্ট দিবে।”
-“কেমন হবে তোমার?”
-“মোটামুটি,জানোনা বড় আব্বু।কত হার্ড হার্ড প্রশ্ন এসেছিলো?”
-“এটা তো বরাবরই শুনি,আর সব সময় তো ফার্স্ট ক্লাস পাও।তা ইয়ারাবীর কিছু জানো?”
আবরার ওর বাবার দিকে তাকিয়ে বলে,
-“বেশি হবেনা এটা সিওর।কেননা ওর হেল্থ কন্ডিশন ঠিক ছিলোনা।”
-“হ্যাঁ,পরীক্ষার জন্য মেয়েটা বলেছি,বিয়েটা যাতে দু’মাস পরে হয়।কিন্তু তুমি জলদি করলে?”
-“আব্বু তুমিই তো বলো,আমি কখনো ভুল ডিসিশন…”
-“জানি,ওইতো ওরা আসছে।”
সিড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে,ওরা দু’জন মিলে কিছু কথা বলতে বলতে আসছে।আবরার খুব ভালো করে শুনতে পাচ্ছে কথাগুলো।ইকরা ইয়ারাবীকে বলছে,
-“আরে বাবা কিছু বলবেনা?”
-“না,আমি পারবোনা আপু।”
-“আমি বলছি তুই যাবি।”
ইয়ারাবী দাঁত দিয়ে নখ কাঁটতে কাঁটতে বলে,
-“পারবোনা…”
-“বললাম তো পারবি,আমিও তো যাবো…”
-“আমার অতো সাহস নেই…”
-“ঠিক আছে আমি বলবো।”
-“ডোজ আমার উপর পরবে….”
-“বললাম না…”
কথা বলতে বলতে ওরা ডাইনিং এ এসে বসে।ইয়ারাবী ওর শ্বশুড়কে দেখে সালাম দেয়।ওর শ্বশুড় হেসে উত্তর দিয়ে বলে,
-“তোমার আব্বু তো মনে হয় চট্রগ্রামে।ফোন করে ছয়দিনের ছুটি নিয়েছে।”
-“মনে হয়,এই ব্যাপারে আমার সাথে কোনো কথা হয়নি আব্বু।”
-“হামম,সেটা জানি।তো তোমার শরীর কেমন এখন?”
-“আলহামদুলিল্লাহ্,”
-“ঠিক মতো যত্ন নিবে,আর এখানে কোনো কিছুতে লজ্জা পাবেনা।কেননা এটা তো তোমার নিজের বাড়ি।অনেকের সহজ হতে কিছু সময় লাগে,বাট্ তুমি তোমার মতো এই বাসায় চলবে।”
-“জ্বি…”
আবরার ইয়ারাবীর দিকে ভ্রু উঁচিয়ে বলে,
-“কী নিয়ে তোমরা কথা বলছিলে?আর কীসের সাহস নেই?তুমি তো বাঘিনি থেকে কম নও।”
জারবা হেসে বলে উঠে,
-“ছোট ভাবী বাইরে বাঘিনি কিন্তু তোমার কাছে ভিজা বেড়াল,হি হি।”
-“জার চুপ করে খা…বলো কী নিয়ে কথা বলছিলে?”
ইয়ারাবী মাথা নিচু করে বলে,
-“কিছুনা,এমনি কথা বলছিলাম।”
-“ভাবী তুমি বলো কী হয়েছে?তোমাদের কাজ কর্মে দুই জা নয় বরং দুই বোন মনে হয়।”
ইকরা মাথা ঝাঁকিয়ে বলে,
-“জায়ে জায়ে ঠুকাঠুকি হয় কিন্তু বোনে বোনে হয়না।তাছাড়া ইয়ারাবী অনেক ভালো মেয়ে,ওর সাথে ঝগড়া হওয়ার সম্ভাবনা খুব কম।”
-“তা ঠিক,এখন বলে ফেলো।”
-“আসলে আবরার,কাল আমাদের স্কুলে ছোট একটা ফাংশন আছে।জারবা আর মেঘ তো প্রতিবছর যায়,ইয়ারাবী তো বসেই আছে।তাই ভাবছিলাম…”
-“ঠিক আছে,এতে এতো ভয় পাওয়ার কী আছে বুঝলাম না।”
-“না মানে যেতে যে তুমি অনুমতি দিবে সেটা জানি।কিন্তু বলছিলাম কী যে…”
-“উহু,এই পারমিশন আমি দিতে পারবোনা ভাবী।”
-“আরে আগে তুমি শুনবে তো?”
আবরার মাথা ঝাঁকিয়ে হালকা হেসে বলে,
-“আমি জানি,ভাবী।তুমি ওকে শাড়ি পরে যেতে বলছো।”
-“তুমি জানলে কী করে?”
-“ওর ‘না’ বলা দেখে আমি বুঝতে পেরেছি।”
-“দেখো আবরার একটা দিন,হেজাব তো পরবে।সমস্যা কী?”
-“সমস্যা আছে,তাছাড়া শাড়ি পড়া আমি এলাও করবোনা।ওখানে অনেক প্যারেন্টস্ আসবে তাই, স্যরি ভাবী।”
-“আমিও তো পরবো।তাছাড়া এতক্ষণ তাও আবার গরমে,তুমি জানো ওর হেল্থ খারাপ।”
মিসেস রায়হান আবরারের দিকে তাকিয়ে বলে,
-“যেতে দেনা,সমস্যা কী?গাড়িতেই তো যাবে।”
-“মম,গাড়িতে যাবে সেটা মেইন কথা নই।ওকে বোরখা নয়,কারন আমিও চাইনা ও অসুস্থ হোক।তবে শাড়ি নয় গাউন পরবে।”
-“যাক বরে মানছে….”
-“না মেনে কী করবো মম,যাক একটু অানন্দ করুক।”
ইকরা ইয়ারাবীর দিকে তাকিয়ে কিছু একটা ইশারা করতেই ইয়ারাবী হেসে দেয়।মিসেস রায়হান আর সার্ভেন্টরা খাবার সার্ভ করে দেয়।হঠাৎ ইকরার চোখ যায় জারবার দিকে।মেয়েটা প্লেটে খাবার রেখে আঙ্গুল দিয়ে প্লেট মাপছে।জারবা বয়স আন্দাজে বড় হলেও মানষিক বিকাশ কিছুটা বাচ্চা সুলভ।বুদ্ধি আছে তবে বাচ্চামু করে।আজ দু’পাশে দু’টা ঝুটি বেঁধেছে,গায়ে চেকচেক টি-শার্ট,আর সবুজ কালারের একটা প্লাজু।ইকরা জারবার দিকে তাকিয়ে বলে,
-“কী করছো জারবা?”
-“গবেষনা।”
-“বাবাহ্,তো কী গবেষনা হচ্ছে শুনি?”
জারবা মুখ ফুঁলিয়ে বলে,
-“ওটাইতো বড় ভাবী,গবেষনা করবো কিন্তু কী নিয়ে করবো বুঝতে পারছিনা।”
-“কোনো ব্যাপার না,আগে খাবার খেয়ে নাও।ততোক্ষণে কোনো আইডিয়া পেয়ে যাবে।তাছাড়া পাশে তো গবেষক বসে আছে।”
জারবা একবারের দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বলে,
-“ভাইয়ার সাথে কথা নেই,আমাকে পিকনিকে যেতে দেয়নি।”
মি.রায়হান ওর দিকে তাকিয়ে বলে,
-“একদম ঠিক কাজ করেছে?”
-“না করিনি,আমি পিকনিকে যাবো।সবাই তো একা যায়।”
-“সময় হলে যাবে।তাছাড়া কলেজ থেকে নয়, তোমরা একা যেতে চেয়েছো।যদি টিচাররা সাথে যেতো তবে মানতাম,কিন্তু একা ছাড়ার পক্ষপাতী নই আমি।”
আবরার মুখে একটা ক্যাবেজ রোল ঢুকিয়ে বলে,
-“তুই সিলেট কতবার গিয়েছিস?”
-“তিনবার…”
-“আমি তোকে সাজেক আবার নিয়ে যাবো।তবুও এই পিকনিকের ভুত মাথা থেকে নামা।”
-“বড় ভাইয়া ভালো।ছোট ভাবী এই জল্লাদের সাথে সংসার করো কী করে?”
ইয়ারাবীর ওর কথা শুনে চোখ বেড়িয়ে আসার উপক্রম।কেননা এই বাড়িতে আসার পর আবরারের অনেকগুলো নামের সাথে পরিচিত হয়েছে,যার সবগুলো জারবার দেওয়া।নিজেকে সামলে ওর দিকে তাকিয়ে বলে,
-“ছিঃ জারবা,বড় ভাইয়াকে এসব বলতে হয়না।”
আবরার খেতে খেতে বলে,
-“কয়টা নামের সাথে পরিচিত হয়েছো তুমি,দিনতো আরো পরে আছো।ম্যাডাম যাতে আমাকে দেওয়া নাম ভুলে না যায় তার জন্য নোটবুকও বানিয়েছে।”
-“তুমি আবার আমার নোটবুকে হাত দিয়েছো ভাইয়া।”
-“বোন হোস,ভালো-মন্দ দেখার দায়িত্ব আমার আছে।তোর কলেজের অধিকাংশ ছেলে-মেয়েকে দেখেছিস কেমন গোল্লায় গেছে?ওরাও পিকনিকে যেতো তাই তোকে যেতে দেয়নি।এখন চুপ করে খা।”
-“খাওয়া ছাড়া আর কী বা কপালে আছে?আম্মাজান আমারে একটু খাইয়ে দেন।হাত দিয়ে খেতে ভালো লাগছেনা।”
মিসেস রায়হান হেসে দেন মেয়ের কান্ড দেখে।নিজের চেয়ার ছেড়ে ওর পাশে বসে প্লেটটা নিয়ে খাইয়ে দিতে থাকে।
(১৪১)
আযানের আগেই একটা দুঃস্বপ্ন দেখে ইয়ারাবীর ঘুম ভেঙে যায়,নিজেকে অবিষ্কার করে আবরারের বুকে।চোখের সামনে আবরারকে দেখে ভয় কিছুটা কেঁটে যায়।ঘুমন্ত মুখে আবরারকে অনেক সুন্দর লাগছে,হঠাৎ করে ইয়ারাবীর হাত ওর দাঁড়িতে চলে যায়।ওর কাছে চাপদাঁড়ি,আর সিল্কি চুলগুলো অনেক ভালো লাগে।ও হাত দিয়ে দাঁড়িগুলো ছুঁয়ে দিচ্ছে।হঠাৎ আবরার শক্ত করে ডান দিয়ে ওকে জড়িয়ে বাম হাত দিয়ে ওর হাত ধরে চোখ বন্ধ করে বলে,
-“চুপচাপ ঘুমাই,সাড়ে পাঁচটায় আযান দিবে।কেবল চারটা বাজে।”
-“আপনি ঘুমাননি?”
-“ঘুমিয়েই ছিলাম,তবে তোমার দাঁড়ি ধরে টানাটানিতে উঠে গেলাম।ইউ নো আমার ঘুম পাতলা,সিক সেন্স বেশি কাজ করে।”
ইয়ারাবী চোখটা নিচের দিকে নামিয়ে নিয়ে বলে,
-“স্যরি আমার জন্য ঘুম ভেঙে গেল আপনার।”
-“হাসালে তুমি।এত তাড়াতাড়ি ঘুম ভেঙে গেলো, দুঃস্বপ্ন দেখেছো?”
ইয়ারাবীর মাথা নাঁড়ায়।আবরার ওর মাথায় বিলি কেঁটে দিতে দিতে বলে,
-“ওসব ভুলে একটু ঘুম দাও,আযান দিলে আমি ডেকে দিবো।”
-“স্ত্রীর কর্তব্য স্বামীকে ডেকে দেওয়া আর আপনি আমাকে ডাকেন।”
-“যখন তোমার সময় আসবে তখন ডেকে দিয়ো।”
কথাটা বলেই ইয়ারাবীর কপালে একটা ভালোবাসার পরশ দেয়।ইয়ারাবীও সবকিছু ভুলে ওর বুকে মুখ গুঁজে ঘুমানোর চেষ্টা করে।
দুপুর বারোটার বাজে,স্কুলের অডিটোরিয়ামে বাচ্চাদের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান চলছে।ইয়ারাবী বরাবরই বাচ্চাদের খুব ভালোবাসে।তার থেকে বড় কথা ওরা এখানে একবার ভিজিটও করেছে।তাই বেশির ভাগ বাচ্চারা মেঘ-ইয়ারাবীকে চেনে।ইয়ারাবী আজ হুলুদ-সবুজ মিশ্রণের লং হাতা গাউন পরেছে,আর সাথে সবুজ রংঙের হেজাব, আর জুতা,অতিরিক্ত সাজ করেনি।আসলে ওর সাজা পছন্দ নয়,তার উপর স্বামীর অনুমতি নেই। ইয়ারাবীর ফোনে আবরারের কল আসলে ও অডিটোরিয়াম থেকে বের হয়ে ফোনটা রিসিভ করে সালাম দেয়।আবরার হেসে সালামের উত্তর দিয়ে বলে,
-“কিছু খেয়েছো?”
-“উহু,কেবল তো বারোটা বাজে।আপনি?”
-“না,দু’টায় একবারে করবো।”
-“ও কোথায় আপনি?”
-“হাসপাতালে পেসেন্ট দেখলাম,এখন ল্যাবে যাবো।শোনো ল্যাবে যাবো সুতরাং মোবাইল বন্ধ থাকবে।যদি গুরুতর কিছু হয় তবে ল্যান্ড ফোনে বা জয়িতাকে কল দিয়ো।”
-“জ্বি…”
-“সাবধানের যাওয়ার কথা বলবেনা।”
-“আমি যা বলি,সব তার উল্টো হয়।তাই….”
-“এখন ভাবীর কাছে যাও,নিশ্চয়ই বাইরে আছো।আর কিছু খেয়ে নিবে।”
আবরার ফোনটা কেঁটে দিলে ইয়ারাবী অডিটোরিয়ামের ভিতর চলে যায়।অনুষ্ঠান শেষ হতে তিনটা বাজে।ও গাড়িতে উঠতে যাবে তখনি ইয়ারাবীর ফোনে আননোন নাম্বার থেকে কল আসে।ইয়ারাবী নাম্বারটা দেখে ভ্রু কুঁচকে সালাম দেওয়ার সাথে সাথে ওপর পাশের লোকটা বলে উঠে,
-“ম্যাম,আমি বিহান।ম্যাম প্লীজ আপনি মেডিকেলে চলে আসুন স্যারের অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে।স্যারের অবস্থা খুব….”
বলার আগেই ফোনটা কেঁটে যায়।ইয়ারাবীর মাথা কাজ করা বন্ধ করে দেয়।ও আবার নাম্বারটা ডায়াল করে কিন্তু বন্ধ দেখায়।
#চলবে_____