জীবন মানে তুমি পর্ব-৪০

0
4038

#জীবন মানে তুমি
#লেখিকা:H.B.Rini (Irini Ori)
#পর্ব:৪০

(১৩৫)

চট্রগ্রামের সাতকানিয়া উপজেলার একটা গ্রামে মি.ফুয়াদের পৈতিক বাড়ি অবস্থিত।টানা পাঁচ ঘন্টা জার্নির পর উনারা রাত একটার দিকে পৌঁছালেন সেখানে।শুধু ওনারা একা এসেছেন তা নয়,বরং মিসেস ইশানির দু’একজন ভাই-বোনেরাও এসেছেন।তবে কোনো অনুষ্ঠান উপলক্ষ্যে কেউ আসেনি,এসেছে শেষবারের মতো বাপ্পী আর বিপ্লবের মৃত দেহ দেখতে।তাই ইচ্ছা না থাকা সত্ত্বেও ইয়ারাবীকে ওর স্বামীর সাথে আসতে হয়েছে শুধুমাত্র নিয়ম রক্ষার্থে।

বিকালের দিকে রাগ করে সামীর চলে যাওয়ার পর জারিকা ইয়ারাবীকে কৃতজ্ঞতা না জানিয়ে নানা ভাবে অপমান করে।এক পর্যায়ে একটা বাজে শব্দ উচ্চারন করার সাথে সাথে কেউ একজন খুব জোরে জারিকাকে থাপ্পড় মারে।মাত্রাটা এত বেশি ছিলো যে জারিকা নিজের স্থান থেকে পরে যায়।এমন আকর্ষিক ঘটনার জন্য কেউ প্রস্তুত ছিলোনা।তাই কৌতুহল নিয়ে সামনে তাকিয়ে ব্যক্তিকে দেখে অবাক হয়ে যায় সবাই,কেননা যিনি জারিকাকে মেরেছেন,সে মারা তো দূর আদর করে খাইয়ে দিতে পারলে বাঁচে।ব্যাক্তিটা আর কেউ নয় বরং মিসেস ইশানি।

ইয়ারাবী ওর মাকে দেখে অনেকটা অবাক হয়ে যায়, ইরাক তো বড় সরো বিষম খায়।মি.রহমান কিছুই বলতে পারছেন না।উপস্থিত সকলের মুখে বিস্ময় জুড়ে আছে।ইফাজ কোনো মতে নিজেকে সামলে মিসেস ইশানির দিকে তাকিয়ে বলে,
-“খালা,তুমি?”
-“হ্যাঁ,আমি।আজ যদি না আসতাম তবে জারিকার আসল চেহারা কোনো দিন দেখতে পারতাম না।”

মি.রহমান শ্যালিকার দিকে তাকিয়ে বলেন,
-“তোমাকে তো কেউ জানায়নি ব্যাপারটা?”
-“হ্যাঁ,আর আমাকে জানানোর কথাও নয়।ধরতে গেলে ওর বাবা-মা তো আপনারাই।তবে আমি এসেছিলাম অন্যকাজে।বাইরে সামীরকে দেখলাম, জিজ্ঞেস করলাম কী হয়েছে?তখন এই মেয়ের সুন্দর বর্ণনা আমাকে দিলো।বাহ্ ভাই বাহ্,যার জন্য চুরি করলো সেই বলে চোর।জারিকার তোর উচিত আমার মেয়ের পায়ে ধরে ক্ষমা চাওয়া,তার কৃতজ্ঞতা আদায় করা।আর সেগুলো না করে তুই নিজের সাফায় দিচ্ছিস।আজ আমার বলতেই হয়,তুই ইয়ারাবীর পায়ের নখের যোগ্যও না।”

মিসেস নিন্দু সোফা থেকে ঝাপ মেরে উঠে ননদের সামনে দাঁড়িয়ে গলা খাকিয়ে বলতে শুরু করলেন,
-“আপা আপনার তো সাহস-মন্দ নয় আমার মেয়েকে মারলেন।ভুল করেছে তাই বলে আপনারা মারবেন?”

মিসেস ইশানি মনে হয় এতটাই রেগে ছিলেন যে ধরতে গেলে একটা বড়সরো চড় বসিয়ে দেন নিন্দুর মুখে।যার ফলে তার মুখে পাঁচ আঙ্গুলের গভীর ছাপ পরে যায়।উপস্থিত সকলের কাছে মিসেস ইশানির এই রুপটা হজম হচ্ছেনা।তবে ইয়ারাবী বুঝতে পারছে ওর মা কিছু একটা নিয়ে খুব রেগে আছে যার জন্য অন্য কারোর উপর তার ঝাল মিটাচ্ছে।কেননা এমন মার ইয়ারাবী অনেক খেয়েছে।ও একটা ঘোরের মধ্যে চলে যাচ্ছে,ও শক্ত করে আবরারের হাত চেঁপে ধরে।আবরার ওর দিকে তাকিয়ে বাম হাত ওর কাঁধে রাখে।

নিন্দু অবাক হয়ে মিসেস ইশানির দিকে তাকিয়ে বলেন,
-“আপা আপনি আমার মারলেন?”
-“হ্যাঁ,মেরেছি।এই মারগুলো যদি তোকে আগে দেওয়া হতো তবে এতটা অধঃপতন হতো না।সামনে একটা পাথর পড়লে যে লোক ঘুরে না গিয়ে সেটা ডিঙ্গিয়ে পথ সংক্ষেপ করতে চায় – বিলম্ব তারই অদৃষ্টে আছে।এমন অবস্থা হয়েছে তোর।নিজে কুকর্ম করে বেড়াস আর মেয়েকেও সেটা শিখাস, তোর মেয়ের থেকে আমার মেয়ে হাজারগুন ভালো।কেননা ও তোদের মতো চরিত্রহীন নয়।”
-“দেখেন ভালো হবেনা কিন্তু,জারিকার আব্বু তুমি কিছু বলছোনা কেন?”
-“ও কী বলবে?ওতো জানেই এইটা তোর প্রাপ্য,তুই এখনি তোর মেয়েকে সাথে নিয়ে বের হবি বাড়ি থেকে..”
-“এটা আপনার বাড়ি না।”

মি.রহমান নিন্দুর দিকে তাকিয়ে বলেন,
-“মেয়েকে নিয়ে স্ব-সম্মানের সাথে বাড়ি থেকে বেড় হয়ে যাও।আমি এইটা নিয়ে আর কোনো ঝামেলা চাইনা।”
-“আমিও নিন্দু,আপনার বাড়িতে আর কোনো দিন পা রাখবো না।এই চলো জারিকার আব্বু…”

মি.তৌহিদও স্ত্রী ছেলে-মেয়েকে নিয়ে বাসা থেকে বেড়িয়ে যান।কারন ওনার জানা আছে,জোঁকের স্বভাব হলো কামড়ানো।আর সেটা হলেন ওনার স্ত্রী।ওনারা চলে গেলে মি.রহমান মিসেস ইশানির দিকে তাকিয়ে বলেন,
-“হঠাৎ তুমি,তাও এই সময়ে…”
-“আসলে বাচ্চাদের জন্য খারাব রান্না করেছিলাম তাই সেটা দিতে এলাম।সাথী খাবারগুলো নিয়ে যাও..”

সাথী এসে মিসেস ইশানির কাছ থেকে খাবার নিয়ে কিচেনের দিকে পা বাড়ায়।মিসেস ইশানি পুরো হল রুমে চোখ বুলিয়ে বলে,
-“ইমন কোথায়?”
-” ইমন একটু বাইরে গেছে,আসলে ওর বন্ধুরা ফোন করেছিল। তাই আমিও ভাবলাম যাক কিছুক্ষণ বাইরে থেকে ঘুরে আসবে এদের মনটাও ভালো থাকবে।তবে এসব আনার কোনো দরকার ছিলোনা।”
-” কি যে বলেন না দুলাভাই?অবশ্যই দরকার ছিল, আসলে সকালে ব্যস্ততার কারণে এদিকে আসতে পারিনি।তাই ভাবলাম রাতের খাবারটা রান্না করে নিয়ে যায়।আর তাছাড়া…আচ্ছা বাদ দেন। তা বাবা আবরার কেমন আছো তুমি?আশা করি তোমার এখানে কোন সমস্যা হচ্ছে না।”

অনেকটা অবাক হয়,কেননা যে মেয়ের জন্য আজ প্রতিবাদ করলো অথচ তার কাছে একটা বারও জানতে চাইলোনা সে কেমন আছে।তবুও প্রশ্নটা শুনে আবরার সৌজন্যমূলক হাসি দিয়ে বলে,
-” জি আম্মু আলহামদুলিল্লাহ আমরা ভালোই আছি।”

উনারা সোফায় বসে বেশ কিছুক্ষণ গল্প করেন। হঠাৎ করে মিসেস ইশানির ফোনে ওনার স্বামীর কল আসে।উনি কলটা রিসিব কলে কিছু বলতে যাবেন তার আগেই ওনার স্বামী বলে উঠে,
-“ইশা,দ্রুত বাসায় এসো।আমাদের এখনি চট্রগ্রামে যেতে হবে।”
-“কেন?”
-“ফাতিন ফোন করে বললো,বাপ্পি আর বিপ্লবকে মারামারির সময় কারা যেন রামদা দিয়ে কুপিয়ে মেরে ফেলেছে।”

মিসেস ইশানি কথাটা শুনে একটুও অবাক হলেন না।কেননা এটা হওয়ার কথা,গ্রামের মারামারিতে এসব প্রায় দেখা যায়।তবে বংশের দু’টা বাতি চলে গেল এটাই খুব কষ্টের,যত খারাপ হোক..ছিলো তো ছেলে।মিসেস ইশানির ছেলেদের ক্ষেত্রে একটা কথা সব সময় বলেন,”সোনার আংটি বাঁকা হলেও ভালো।”আফসোস উনি মর্ডান হলেও কিছুটা কুসংস্কার এখনো বিশ্বাস করেন।উনি ইয়ামিলাকে গুছিয়ে রাখতে বলে কলটা কেটে দেন।এদিকে সবাই কে ঘটনাটা বলেন,মি.রহমান ওনার ছোট ছেলেকে ফোন দিয়ে বাসায় দ্রুত আসতে বলেন।কেননা উনারাও যাবেন,তবে সবকিছুর মধ্যে বেঁকে বসে ইয়ারাবী।ও কিছুতেই যেতে রাজী নয়,কেননা ওখানে গেলে কিছু কুৎসিত মানুষদের মুখোমুখি হতে হবে।ইয়ারাবীর কথা শুনে মিসেস ইশানি আজ কিছু বলেন না,অন্যদিন হলে অবশ্যই রেগে যেতেন কিন্তু আজ তার ব্যাতিক্রম।ইরাক ওর দিকে তাকিয়ে বলে,
-“দেখ কম-বেশি তোর সো-কল্ড চাচা-চাচিকে আমি খুব ভালো চিনি।তাছাড়া কিছু গ্রামের মানুষ আছে এটা নিয়ে কথা উঠাবে,কেননা তুই বাড়ির বড় মেয়ে।আর আমরা চাইনা আমাদের বোনকে নিয়ে কেউ কথা তুলুক।শোন ওখানে তো থাকতে যাচ্ছিনা, জাস্ট যাবো জানাযা পড়ে মাটি দিয়ে চলে আসবো।”
-“তো আমি যেয়ে কী করবো?”
-“হায় আল্লাহ্,এতক্ষণ ধরে আমি কাকে কী বুঝালাম।বোইন শোন,তুই যেয়ে রুমের মধ্যে বসে থাকবি তুবও চল।আবরার ওই বাড়ির একমাত্র জামাই না গেলে একটা খারাপ দেয়।আর ওদেরকে তো চিনিস…”
-“সব সময় আমাকে কেন কম্প্রোমাইজ করতে হবে?”

-“কারণ তুই বড়ো,”
মিসেস ইশানি দাম্ভিক কন্ঠে কথাটা বলে উঠেন।ইয়ারাবী ওর খালুর দিকে তাকিয়ে বলে,
-“খালু ওনাকে বলে দাও,আমি তার সাথে কোনো কথা বলতে ইচ্ছুক নই।”
আবরার ইয়ারাবীর দিকে তাকিয়ে কিছুটা রাগী কন্ঠে বলে,
-“আহ্ ইয়ারাবী,মায়ের সাথে কেউ এভাবে কথা বলে।রুমে যেয়ে গুছিয়ে নাও,আমরা যাচ্ছি।”

এর উপরে আর কী বললে ইয়ারাবী?যেখানে আবরার হ্যাঁ বলে,সেখানে ওর না করার কোনো সাহস নেই।তাছাড়া মৃত ব্যাক্তির উপর রেগে থাকাটা মানায়না।কেননা হাদিসের নির্দেশনা অনুযায়ী সবার উচিত, মৃত ব্যক্তির ভালো কাজগুলো আলোচনা করা। আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে রাসুল (সা.) ইরশাদ করেন, ‘তোমরা তোমাদের মৃতদের ভালো কাজগুলোর আলোচনা করো এবং মন্দ কাজের আলোচনা থেকে বিরত থাকো।’ (সুনানে আবু দাউদ, হাদিস : ৪৯০০)।ইফাজ সোফা থেকে উঠে আড়মোড়া হেসে খানিকটা হেসে বলে,
-“নে এবার বল যাবিনা,বরে বলেছে যেতে তো হবেই।ঠ্যালায় পরলে সব হয়…”

ইয়ারাবী কোনো কথা না বলে ওর ভাইয়ের দিকে আড়চোখে তাকিয়ে সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে যায়।আর আড়চোখের বাণী ইফাজের জন্য সতর্ক বার্তা, যেটা ছিলো-তোমাকে আমি দেখে নিবো।ঘন্টাখানিকের মধ্যে ওরা রওনা দেয় চট্রগ্রামের উদ্দেশ্যে,সন্ধ্যার ঠান্ডা বাতাস আর জানালা খুলে রাখার কারনে ইয়ারাবীর সমস্যা হয়না।

(১৩৬)

বাড়িতে কান্নার শোলগোল পরে গেছে,কেউ থেমে কাঁদছে তো কেউ সুর তুলে কাঁদছে।তবে এখানে অনেকেই লোক দেখানো কান্না করছে।টানা চার-পাঁচ ঘন্টা ধরে এমন শোরগোল চলছে,আর এটা ইয়ারাবীর ব্রেনে একদম সহ্য হচ্ছেনা।এখানে মি.ফুয়াদের নিজস্ব তিন কামরা বিশিষ্ট একতালা বাড়ি আছি।ইয়ারাবী ওর হাসবেন্ডের সাথে রুমেই বসে আছে।ইরাক,ইফাজ ও রুমের মধ্যে আছে আর বাকীরা বাইরে।মিসেস ইশানি মেয়ের হাত ধরে রুমে ঢুকতেই ইফাজ বলে উঠলো,
-“খালা জানাযা কখন হবে?”
-“নয়টার দিকে করা হবে।”
-“ওহ্হ্,অাব্বু আর ইমনকে অনেক্ষণ দেখছিনা।তুমি জানো কোথায় ওরা?”
-“আরে ফুয়াদের সাথে আছে,ইয়ামিলা এখানে বসো।আমি তোমার খাবার দিয়ে যাচ্ছি।আর ইয়ারাবী তুই বাড়ির বড় মেয়ে,সবাই তোকে খুঁজছে।বাইরে বের হ,মানুষ চাচা-চাচীদের কাছে যেয়ে বসে,এদের নাস্তার ব্যাবস্থা করে।আর তুই….”

আবরার ফোন থেকে চোখ সরিয়ে ওর শ্বাশুড়ির দিকে তাকিয়ে বলে,
-“আম্মু,খালামনির ধাক্কা এখনো কাঁটিয়ে উঠতে পারেনি।তার উপর লং জার্নি করে এসেছে…”
-“তারপরও সবাই বাড়ির মেয়েকে খুঁজছে।টানা ছয়-সাত বছর পর এসেছে।আচ্ছা ঠিক আছে তবে সবার সাথে ভালো ব্যবহার করিস জেনো….”

মিসেস ইশানি চলে যেতেই ও ইফাজের দিকে রাগী চোখে তাকায়।কেননা ইরাক বা আবরারকে কিছু বলার সাহস ওর নেই।ওর তাকানো দেখে ইফাজ ভ্রু কুচকে বলে,
-“আমি তোকে কিছু বলেছি নাকী?”
-“শুধু বাসায় চলো তারপর তোমাকে দেখছি….”
-“ও ওই বাসায় যেয়ে কী করবি তুই?আমি কী তোকে দেখে ভয় পায়।”
-“আল্লাহ,আমি কখন বললাম তুমি ভয় পাও।তুমি তো সাহসী বীরপুরুষ…”

শেষের কথাটা ইয়ারাবী কিছুটা ভেংচি কেটে বলে।আবরার আর ইরাক দু’জনের কথা শুনে ভালোই মজা নিচ্ছে,এমনকি এরা সারা রাস্তা দিয়ে ঝগড়া করতে করতে এসেছে।ইয়ামিলা ইয়ারাবীর দিকে হা করে তাকিয়ে আছে।ইয়ারাবী ভ্রু কুচকে বলে,
-“আমার কী ডানা গজিয়েছে নাকী?এভাবে তাকিয়ে আছিস কেন?”
-“না না ডানা কেন আসবে?আচ্ছা আপু,একসেরে মানে কী?”

ইয়ারাবী হাতের ফোনটা পাশে রেখে ওর দিকে ঝুঁকে বলে,
-“তোকে কেউ বলেছে নাকী?”
-“উহু,আমাকে বলেনি।বলোনা এটার মানে কী?”
-“গ্রামের অনেক মানুষ এই শব্দ ব্যবহার করে।আমার মতে কোথায় এমন শব্দ নেই।তবে যার ক্ষেত্রে এটা ব্যবহার করা হয় তাকে স্বার্থপর বা আল্টা হিসাবে উপস্থাপনের জন্য।এখন বল তুই কোথার থেকে শুনলি?”
-“আবার কোথার থেকে?কোন একটা মহিলা ছোট চাচীকে বলছিলো,বাড়ির বড় মেয়ে এসেছে নাকী?তাই ছোট চাচী ওনাকে বললো,এসেছে তবে একসেরে মেয়ে তাই দেমাগের জন্য বাইরে বের হচ্ছেনা।”
-“এই ছোটটা তো আমার জাত শত্রু।শুধুমাত্র ভদ্রতার খাতিরে বেশি কিছু বলিনা এদেরকে।”
কথাগুলো বিরবির করে বললেও পাশে বসা আবরার সবটা শুনে ফেলে।ইয়ামিলা ওর দিকে তাকিয়ে বলে,
-“কী বলছো?কিছুই শুনতে পাচ্ছিনা।”
-“কিছুনা…”
-“তোমার রাগ হয়নি?”
-“না….”
-“ঝগড়া করবানা…”
-“না”
-“এমনি ছেড়ে দিবে?”
-“ওদের কথা তো কিছু জানিনা,কিন্তু তুই যদি এক মিনিটের মধ্যে আমার সামনে থেকে না যাস তবে আজ তোর খবর খারাপ করে ফেলবো।”

ইয়ামিলা কথাটা শুনার সাথে সাথে বিছানা থেকে নেমে বাইরে দোর মারে।কেননা ও জানে,ওর বোনের রাগ মাথায় উঠে গেলে মেরে দিতে পারে।
নয়টার দিকে জানাযার জন্য বিপ্লব আর বাপ্পীর লাশ নিয়ে যাওয়া হয়।ওর মৃত্যুর আসল কারন হলো,পাশ্ববর্তী গ্রামের এক দলের সাথে মেয়ে নিয়ে ঝামেলা।রোজ বাপ্পীরা চার ভাই ওই গ্রামে যেয়ে মেয়েটাকে আসতে যেতে ব্যাক সাউন্ড দিতো।তার জন্য দুই গ্রামের দলের প্রচুর মারামারি হয় আর সেখানে এরা দুই জন মারা যায়।ইয়ারাবীর কথাটা শুনার সাথে সাথে গা গুলিয়ে উঠে।এখানেও মেয়ে,আসলে যারা খারাপ তারা মৃত্যুর আগে অব্দি খারাপের সঙ্গ ছাড়তে পারেনা।

বাড়ির ছেলেরা সবাই জানাযার নামায পড়তে গেছে,এখন শুধু বাড়িতে কিছু বাচ্চা আর মহিলার উপস্থিত আছে।ইয়ারাবীর বিছানায় শুয়ে আছে, মাথার কাছের জানালাটা খোলা,দরজাটা হালকা চাপানো।ইয়ারাবীর পরনে হালকা পিত্তি কালারের গাউন,হাতে,কানে,গলায় সেই জুয়েলারিগুলো, ওড়নাটা পাশে রাখা।হুট করে কেউ রুমে ডুকতেই ও আড়চোখে তাকিয়ে দেখে ওর মা হাতে একটা ট্রে নিয়ে এসেছে।তাই না উঠে ওভাবে শুয়ে থাকে।ও মা বিছানার সামনে একটা ছোট টেবিল টেনে খাবারের ট্রে রেখে বলে,
-“খাবারটা খেয়েনে,আবার তো ঔষধ নিতে হবে।”
-“এই বাড়ির পানিও খাওয়ার নূন্যতম ইচ্ছা আমার নেই।তাছাড়া আমাকে নিয়ে কারোর ভাবতে হবেনা।”
-“তোর ছোট দাদার বাড়ি থেকে তোর জন্য খাবার পাঠিয়েছে।এই বাড়ির কিছু নই,তোর মনি ব্যস্ত তাই আমি নিয়ে এলাম।”
-“জানেন আপনার কথা বিন্দুমাত্র বিশ্বাস করার মন আমার নেই।”
-“বিশ্বাস কর বা না কর,তোর মনি জানে তুই এই বাড়ির কিছু খাবিনা।এখন কথা না বারিয়ে খেয়েনে।”

ইয়ারাবী বিছানা থেকে উঠে ট্রের দিকে তাকিয়ে দেখে সাদা ভাত,মুরগির মাংস,ডাল আর ভর্তা।
-“আবরার-ভাইয়ারা আসুক তারপর খাবো, উনারা না খেয়ে আছে।”
মিসেস ইশানি হেসে বলেন,
-“ওরা আসলে খাবে,কিন্তু তোর দেরি হলে সমস্যা হবে।”

এখন ওর মায়ের সাথে বিন্দুমাত্র কথা কাঁটাকাঁটি করার মুড নেই। ইয়ারাবী হাফ প্লেট ভাত নিয়ে সাথে হালকা ভর্তা আর দু’পিচ মাংস নিয়ে খেতে থাকে।আসলে ওর ক্ষুদাও লেগেছিলো প্রচুর।কেননা কাল রাত ধরে না খেয়ে আছে,তার উপর এক গ্লাস পানিও পান করেনি।অবশ্য পানি পান করলে এমন ক্ষুদা লাগতো না ওর।ইয়ারাবী দু’লোকমা ভাত গালে দিয়েছে তখনি পরনে সুঁতির শাড়ি পরা তিন-চার জন মাঝারি বয়সের মহিলারা ঘরে ঢোকে।দেখেই বুঝা যাচ্ছে এরা গ্রামের মহিলা।ইয়ারাবী কারোর সামনে খেতে পারেনা,তাই প্লেটটা রাখতে গেলে ওর মা বলে উঠে,
-“তুই খেয়েনে…”

ইয়ারাবীও চুপচাপ খেতে থাকে।মিসেস ইশানি ইয়ারাবীর প্লেটে ডাল দিয়ে দেন,বেশকিছুক্ষণ পর ওর খাওয়া শেষ হয়।একজন মহিলা ওর মায়ের দিকে তাকিয়ে বলে,
-“এ কী আপনার মাইয়া ভাবী?”
-“হ্যাঁ…”
আরেকজন মহিলা ইয়ারাবীর দিকে তাকিয়ে বলেন,
-“তুমি কী ফুয়াদের মাইয়া?”
-“একটু আগে তো ইনি বললেন যে আমি উনার মেয়ে।আর উনিতো ফুয়াদের স্ত্রী তাহলে আমি ফুয়াদের মেয়েই হবো।”
-“বাহ্,তোমার মাইয়া তো দেহি ভালো চাটাং চাটাং কথা কয়।আদব কায়দা তো কিছুই নাই দেহি…”

ইয়ারাবীর কথাটা শুনে প্রচুর রাগ হয়,কেননা এই মহিলারা জানে ও কার মেয়ে।তবুও খোঁচা দিয়ে কথা বলবেই।ইয়ারাবী খাট থেকে নেমে সোফার উপর রাখা ব্যাগ থেকে মেডিসিন বের করে খেয়ে নেই।একজন মহিলা এটা লক্ষ্য করে ইশানিকে বলেন,
-“মাইয়ার কী অসুখ নাকী?”
-“ওই একটু আরকী,”
-“ও মাইয়া এহানে আইসা বসো।দু’টো কথা কয়,তুমি তো এদিকে আহোই না…”

ইয়ারাবী বিছানায় বসে মাথায় কাপড়টা ভালো করে দিয়ে নেই।একজন আধা কাঁচা-পাঁকা চুলের মহিলা ওর মুখে হাত দিয়ে বলে,
-“চেহারা ভালো তয় মাইয়া তো শ্যামলা।”
-“চাচী শ্যামলা হলেও আমার মেয়ে মাশাল্লাহ্।”
-“তুমি এহন বুঝবানা বৌ,যহন মাইয়া বিয়া দিতে যাইবা তখন বুঝবা।”

মিসেস ইশানি কথাটা শুনে হেসে ফেলে বলেন,
-“চাচী আপনার কোথাও ভুল হচ্ছে,কেননা আমার মেয়ের তো চারমাস হলো বিয়ে হয়েছে।আর আলহামদুলিল্লাহ গায়ের রং নিয়ে কোনো প্রশ্ন উঠেনি।”
আরেকজন মহিলা পাশ থেকে বলেন,
-“তা নাকফুল তো দেখতাছিনা?”
-“হাদিসের কোনো শরীয়তে নাই তাই পরেও না।তাছাড়া ওর স্বামীর এমন শিরক কাজ পছন্দ নয়।”
-“আমরা তো জীবন ধইরা পরলাম,কহনো শুনলাম না এসব পরা যাইবোনা।”

মহিলাটা থামতে থামতে আরেকজন মহিলা বলে উঠেন,
-“ভালো করছো মাইয়ারে ছোড বয়সে বিয়া দিয়া, মাইয়াগোর কাম হলো সংসার করা।অতো লেহাপড়া করা কী হইবো।আমিও আমার তিন মাইয়ারে বিয়া দিয়া দিছি।”
-“কী বলেন আপনি?আপনার মেজো আর ছোট মেয়ে ইয়ারাবীরও ছোট,এত কম বয়সে বিয়ে দিলেন কেন?”
-“ছোড তো কী হইছে,মাইয়াগো হায়েজ হওয়ার পর বিয়া দিতে হয়,হেইডা নিয়ম।আমারও তো ছোড বয়সে বিয়া হইছে।”

ইয়ারাবী অনেকক্ষণ ধরে এদের মূর্খের মতো কথাগুলো শুনছিলো।এবার ও বলে উঠে,
-“নিশ্চয়ই লুকিয়ে..”
-“হ পুলিশের জন্য ওই আরকী?”
-“বাচ্চা হওয়ার সময় যদি আপনার মেয়ের কিছু হয় তখন বুঝবেন পুলিশ কেন বিয়ে আটকায়।”
-“তুমি বেশি বোঝো কেন?তুমিও তো বিয়া করছো, আমার ঝুমুরের থ্যাইকা দুই বছরের বড়ো হইবা।”
-“কথা আছে,অল্প বিদ্যা ভয়ংকারী।সেই সমস্যা হলো আপনাদের।”
-“ওই কী কইলা তুমি?”

একজন মহিলার ওনার হাত চেপে ধরে বলে,
-“ওই বানু চুপ কর,তা মাইয়া আমাগোর তো চিনোনা তুমি?আমি ওর ওই সাদা শাড়ি পরা হচ্ছি তোমার দাদী লাগি,আর এরা হইলো চাচী বুঝলা।তা তোমার বর আহেনাই…”
-“জ্বি এসেছে…”
-“কী করে তোমার বর?”
-“উনি পেশায় একজন ডাক্তার”
-“যাক ভালা,বাইরে একখান সুন্দর পোলারে দেখলাম।বাগুনি রঙের শাট পরা আর উপরে কালো কোটি ওইডা নাহি?”
-“জ্বি,উনিই….”
-“বাহ্ জামাই তো চান্দের লাহান,তবে কিছু মনে কইরো না একখান কথা জিগায়?”

ইয়ারাবীর বিরক্ত লাগছে এসব প্রশ্ন শুনে।ওর কাছে মনে হচ্ছে ও কোনো রিমান্ডের আসামি যাকে একটার পর একটা প্রশ্ন করা হচ্ছে।তবুও নিজের মুখে সৌজন্যমূলক হাসি রেখে বলে,
-“না,আপনি করুন।”
-“তোমার বরের কী চোখে সমস্যা?না মানে চোখটা কেমন সবুজ সবুজ লাগলো..”
-“না দাদী,ওনার চোখে কোনো সমস্যা নয়।এটা একটা আইরিশে মেলানিনের পরিমাণ, প্রোটিনের ঘনত্ব এবং আইরিশে স্ট্রোমার অস্বচ্ছ অংশে আলো কতটা বিচ্ছুরিত হচ্ছে ইত্যাদির ওপর ভিত্তি করে চোখের রং নির্ধারিত হয়।বংশগতভাবে চোখের রং নির্ধারণে ১৬টি জিন কাজ করে। বংশগতভাবে চক্ষুর রং নির্ধারণে সবচেয়ে প্রভাবশালী জিন হলো ওসিএ২ এবং এইচইআরসি২। এদের অবস্থান ক্রোমোজোম ১৫-এ। সাধারণত নীল চোখের জন্যে এইচইআরসি২ জিনকে দায়ী করা যায়। আর ওসিএ২ সাধারণত চোখের নীল এবং সবুজ রং সৃষ্টিতে কাজ করে।সহজ কথায় যদি আপনাকে বলি সেটা হলো বংশগত ভাবে ওর এমন।ওর দাদার চোখের মনিও সবুজ,তবে এটা কোনো রোগ নয়।।”
-“তুমি যে কইলা কিছু বুঝিনাই,তবে এইডা বুঝবি জামাইয়ের চোখে কোনো সমস্যা নাই।তা তোমরা কী আলাদা থাকো নাকী এক লগে?”
-“আমি ঠিক বুঝিনি আপনার কথা?”
-“না মানে কইছিলাম শ্বশুড়বাড়ির লগে থাহো?”
-“জ্বি…”
-“ওহ্হ্…”

একজন মহিলা সম্পর্কে চাচী হয় উনি বলে উঠেন,
-“তা তোমার মায়ে কইলো চার মাস হইয়া গেছে বিয়ার তা বাচ্চা-কাচ্চা নাও নাই?বয়স বেশি হইলে বাচ্চা হয়না,এই বয়স ঠিক বাচ্চার লাইগা…”
-“জ্বি না,উনি সব সময় বলেন আগে আমার স্ট্যাডি কম্পিলিট হবে একটা জব করবো দ্যান বাচ্চা প্লানিং।তাছাড়া আমার বয়স কম,তাই শ্বশুড়বাড়ির থেকে কড়াভাবে বলে দিয়েছে।তাছাড়া আপনি সেটা বললেন সেটা সম্পূর্ন ভুল ধারনা।”
-“তুমি এহোনো লেহাপড়া করো,সোয়ামী পড়াই তোমারে..”
-“জ্বি…”
-“তা জামাইরা কয় ভাই-বোন?”
-“তিন ভাই এক বোন..”
-“তুমি কয় নাম্বার?”
-“জ্বি আমি মেজো..”
-“ও বাকীরা কী করে?তোমার জাও কী পড়ালেহা করে?”

ইয়ারাবী হাসি পায় উনার মুখের ভঙ্গি দেখে।কথা বলার সময় ওনার ভ্রু গুলো কুঁচকে যাচ্ছে আর ওর কথার সময় প্রসারিত হচ্ছে।প্রায় অনেক্ষণ হলো ওর মা বাইরে চলে গেছে।তাই ওকেই কথা বলতে হচ্ছে।ইয়ারাবী বিছানায় পা উঠিয়ে ভালো করে বসে বলে,
-“না,আপু মানে ভাবী আরকী উনি জব করেন।আমার ভাসুর উনি পেশায় ইন্জিনিয়ার,আর দেবর ও আমার সাথে পরে।বাকী রইলো ননদ ও বর্তমানে কলেজে পড়ে..”
-“শ্বশুড়বাড়ির সবাই ভালা?আচ্ছা বিয়াতে কী কী চাইছিলো না মানে তুমি কী লইয়া গেছো?”
-“আলহামদুলিল্লাহ,সবাই অনেক ভালো।আর আপনার মতে যৌতুক,সেটা কোনোদিন আমি বা আমার পরিবার সামর্থন করিনা।”
-“যাক সব ভালা হইলে ভালা,তা বাইরে যাবানা?”
-“যাবো,”
-“থাকতাছো তো আজ…”
-“না চাচী,থাকা হবেনা…”

আর কিছু বলতে যাবে তার আগেই সবাই ফিরে আসে।ওদের দেখে সবাই ঘর থেকে বাইরে বের হয়ে যায়।ইয়ারাবী ইরাকের দিকে তাকিয়ে বলে,
-“ভাইয়া ওদের কবর কোথায় দেওয়া হলো?”
-“তোদের পারিবারিক কবরস্থানে,খেয়েছিস কিছু?যাওয়ার আগে মনিকে বলে গেছিলাম”
-“হ্যাঁ,খেয়েছি….”

তখন তারা আর ওর মা হাতে খাবার নিয়ে ঘরে ঢোকে।ওদেরকে বিছানায় বসতে বলে সামনে দস্তারখানা বিছিয়ে দিয়ে বলে,
-“মরা বাড়ি বুঝতেই তো পারছো,তার কষ্ট করে এখানে বসে খেতে হবে।আর আবরার একটু মানিয়ে নেও বাবা আর দোলাভাই আপনিও…”
-“সমস্যা নেই আন্টি,চিন্তা করবেন না।আমাদের আবার এখনি বেড়তে হবে…”
-“সেকী এখনি বের হবে?আজ থেকে গেলে হয়না।”

ইরাক মিসেস ফাতেমার দিকে তাকিয়ে বলে,
-“পরশু আমাকে আর আব্বুকে ব্যাক করতে হবে, ইফাজকেও মুভ করতে হবে কাজে।আর রইলো পিচ্চি,ওর ব্যাপারে তো জানেন।”
-“ভাইয়ারা কী থাকবে?”
-“মনে হয়,কেননা তার ভাইয়ের ছেলে মারা গেছে।তবে একটা জিনিস বুঝছিনা।”
-“কী আব্বু?”
-“দুই চাচাকেই দেখলাম বারবার বলছে,“যে পাপ করেছি তার সাজা পেয়েছি।অন্যের বুক খালি করেছি সেই পাপের জন্য আজ নিজের বুক খালি হলো।”ব্যাপারটা বুঝিনি।”
-“সেটা তো আমিও জানিনা।আবরার ডাল নাও…”
-“আমার লাগলে নিবো…”

ওরা সবার সাথে সৌজন্যতার খাতিরে কিছুক্ষণ কথা বলে বারোটার দিকে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা হয়।থাকার মধ্যে মিসেস ইশানি ওনার স্বামী,মিসেস জামান আর মিসেস নিকি থাকেন।ছয়টার দিকে মি.রহমানের বাসায় ফিরে।ইয়ারাবীর অবস্থা খারাপ সেই সাথে এই প্রথম ইমনেরও হলো।ইয়ারাবী রুমে ঢুকে সোফায় বোরখা-নেকাব খুলে রেখে বিছানায় ঠাস করে শুয়ে পরে।আবরার ওয়াশরুম থেকে ফ্রেস হয়ে এসে দেখে এই অবস্থা।ও ভ্রু কুচকে ওর দিকে তাকিয়ে বলে,
-“এটা কী ইয়ারাবী?ফ্রেস হয়ে তারপর ঘুমাবে।”
-“মাথা ব্যাথায় ছিড়ে যাচ্ছে।তাই আপনার বকবক বন্ধ করে চুপ করে ঘুমান।”
-“ওই তোমার মাথা কী খারাপ হয়েছে,সন্ধ্যায় কেউ ঘুমাই।”
-“হ্যাঁ,ইয়ারাবী ঘুমাই।তাই এখন ইয়ারাবী ঘুমাবে।”

আবরার ভালোই বুঝতে পারছে ও ঘুমের ঘোরে এসব বলছে।ও একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ইয়ারাবীকে উঠিয়ে ফ্রেস হতে পাঠায়।

(১৩৭)

ছাদের এক প্রান্তে রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আছে ইয়ারাবী।কাল মি.রহমান আর ইরাককে বিদায় দিয়ে আজ সকালেই এই বাড়িতে ফিরেছে,তবে এমন একটা কথা শুনবে তার প্রত্যাশা করেনি।বিকালের বসন্তের হালকা বাতাসে ওর মাথা থেকে ওড়না পরে যেয়ে চুলগুলো উড়ছে,চোখটা বারবার ভিজে যাচ্ছে পানিতে।আবরার ছাদে এসে ওকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে প্যান্টের পকেটে ডান হাত ঢুকিয়ে বাম হাত দিয়ে চুলগুলো মুঠো করতে করতে ওর পিছনে এসে দাঁড়ায়।ইয়ারাবী এতটাই চিন্তায় মগ্ন ছিলো যে ওর উপস্থিতি বুঝতে পারেনি।বিষয়টা বুঝে আবরার শব্দ করে গলা ঝাড়া দেয়।তবুও ইয়ারাবী ওর দিকে তাকায় না, নিজের মতো শূন্য আকাশে দৃষ্টি মেলে আছে।

আবরার মুচকি হেসে দু’হাত পকেটে ঢুকিয়ে রেলিং এ পিঠ ঠেকিয়ে ওর পাশে দাঁড়ায়।
-“তুমি কেন কষ্ট পাচ্ছো সেটা বুঝলাম না?এখানে তো তোমার কোনো দোষ নেই…”
-“কিন্তু সবটা তো আমার জন্যই হলো।রবি ঠাকুর একটা কথা বলেছেন–“চন্দ্রের যা কলঙ্ক সেটা কেবল মুখের উপরে, তার জ্যোৎস্নায় কোনো দাগ পড়ে না।”কিন্তু চাঁদকে তবুও কলঙ্ক বলা হয়।”
-“নিজেকে দোষ দেওয়া বন্ধ করো।খনার বচনে আছে জানো — বুধের ঘাড়ে দিয়ে পা, যথা ইচ্ছা তথা যা।”
-“মানে বুঝলাম না…”
-“চিন্তা করোনা আমি তো আছি,সবটা ঠিক করে দিবো।”
-“তাহলে কী আপনি এটার কথাই বলেছিলেন ওই বাসায় থাকতে?”
-“হ্যাঁ, এখন নয় আরো কিছুদিন পরে বলতে চেয়েছিলাম।তবে তুমি যে এভাবে বিষয়টা শুনে নিবে সেটা ভাবতে পারিনি।”

আসলে আজ সকালে ও আবরারের সাথে এই বাড়িতে আসে।বাড়িতে ঢুকতেই দেখে সোফায় মিসেস রায়হান,ইকরা,জারবা আর মেঘ বসে গল্প করছে।মিসেস রায়হান ওদের দেখে জড়িয়ে ধরেন।ওরা মিসেস রায়হানের সাথে বিভিন্ন কথা বলে।ইয়ারাবী ইকরার দিকে তাকিয়ে বলে,
-“তুমি আজ স্কুলে যাওনি আপু?”
-“না,কাল ফাংশন আছে তাই আজ বন্ধ।তোমাকে খুব মিস করছিলাম সোনা।”
-“আমিও তোমাদের সবাইকে খুব মিস করেছি।তো পুচকো কেমন আছে?”
-“পেটের ভিতর আরামে আছে।”
-“মা হওয়ার অনুভুতিটা সত্যিই খুব আনন্দের,তাই না।”
-“তুমিও বুঝবে যখন তুমি নিজে হবে।”

জারবা সোফার উল্টোদিকে খুব ফুঁলিয়ে তাকিয়ে বলে,
-“হ শ্বশুড়-শ্বাশুড়ি,জা,দেবর এমনকি যিনি পৃথিবীতে আসেননি তার খবর নেওয়া হচ্ছে, সবাইকে মিস করছে শুধু মাসুম ননদকে মিস করোনি।আর ভাইয়া তুমিতো আগে বাইরে গেলে টুট টুট করে কল করতে এবার শুধু দিনে একবার করে করেছো,তুমিও ভুলে গেছো।”

ইয়ারাবী হেসে ওকে জড়িয়ে ধরে বলে,
-“কে বললো তোমাকে মিস করিনি?সবচেয়ে বেশি মিস আমার গুলুমুলু ননদকে করেছি।”
-“সত্যি?এক মিনিট আমাকে খুশি করার জন্য বলছো না তো!”
-“আরে না,আমি মিথ্যা বলিনা সেটা তুমি জানো।আর তোমার ভাইয়া ব্যস্ত ছিলো তাই কল করেনি মনে হয়।”

আবরার ওর মাথায় একটা চাটি মেরে বলে,
-“গাধী তোকে ফোন করি কিন্তু তুই ধরিস না।এটা কী আমার দোষ?তবে ঘুম ছেড়ে এবার পড়তে বসবি, কথাটা যেন মনে থাকে।অনেক ফাঁকিবাজ হয়েছিস তুই আর মেঘ।”
-“তোমার বউ রে পড়তে কও,আমরা পড়ি তো।উঠতে-বসতে পড়ি,খেতে-শুতে পড়ি..”
-“হামম,ম্যাডামকেও পড়তে হবে।প্রচুর কামাই গেছে, তা ভাইয়া এখনো এবরোড থেকে ব্যাক করেনি।”
-“নারে আবরার,কালকের ফ্লাইটে আসবে,তোরা রুমে যেয়ে ফ্রেস হয়েনে।”

ওরা রুমে যেয়ে ফ্রেস হয়ে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেই।দুপুরের খাবারের পর আবরার ল্যাবে যায়,ইয়ারাবী মেঘের থেকে কিছু নোট নিতে যেয়ে দেখে ইকরা ওর মা আর মেঘ বসে কথা বলছে।মেঘ মিসেস রায়হানের দিকে তাকিয়ে বলে,
-“বড় আম্মু ওকে বলে দিলে হয়না।”
-“না মেঘ,আবরার বলছে টাইম হলে বলবে।”
-“তবে কেসটা শুরু হলে তো ও বুঝে যাবে,তখন জানলে আরো বেশি খারাপ লাগবে ওর।”

ইকরা মেঘের দিকে তাকিয়ে বলে,
-“ইলা আমার বোন ছিলো,খুব কষ্ট লাগে ওর জন্য।এভাবে মারা যাবে ভাবতেও পারিনি।”
-“ইলা আপুকে আমিও মিস করি।”
-“ইস্মিতার সাথে ইলাকেও মেরে দিলো।তোমার ভাইয়ার ধারনা ওরা ইস্মিতাকে মারতে এসেছিলো সেখানে ইলাকে….”
-“এত সিউর হলে কীভাবে?”
-“জানিনা,কেননা ইলার সাথে কারো কোনো শত্রুতা নেই।তার মানে যা ধারন করা হয়েছে আর…”
-“যে মেয়েটা মারা গেছে সে তোমার বোন আপু?”

কথার আওয়াজে সবাই পিছনে তাকিয়ে দেখে ইয়ারাবী দাঁড়িয়ে আছে।মেঘ অবাক হয়ে বলে,
-“ই ইয়ু,তুই ঘুমাসনি।”
-“ঘুমালে তো আর এখানে আসতে পারতাম না।”

মিসেস রায়হান ইয়ারাবীর দিকে তাকিয়ে বলেন,
-“মা শোন,”
-“আম্মু তার মানে আপনারা আগে থেকে আমাকে চিনতেন?”
-“না শোনা,আমরা তো ইস্মিতার ছবি দেখে চিনেছি।”
-“আমাকে বলেননি কেন?আর আপু তুমিও বলোনি, তার মানে তোমরাও এটা ভাবতে না তো সবার মতো যে আমি…”
-“খবরদার এসব মুখেও আনবিনা।আসল খুনি শাস্তি পাবে,আমরা বলিনি কারন তুই ভেঙে পরবি তাই।তুই কম কষ্ট পাসনি জীবনে….”

ইয়ারাবী আর কোনো কথা না শুনে চুপচাপ রুম থেকে বের হয়ে যায়।

#চলবে_____

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here