জীবন মানে তুমি পর্ব-৩৯

0
4010

#জীবন মানে তুমি
#লেখিকা:H.B.Rini (Irini Ori)
#পর্ব:৩৯

(১৩৩)

বসন্ত এসে গেছে,দুপুরের চারিদিকে রোদে পরিবেশটা এক নতুন রুপে ভেসে উঠেছে।সামনের ল্যাম্পপোস্টের উপর দু’টা কাক এসে বসে আপন মনে ডাকছে।হঠাৎ একটি কাক উড়ে যেতেই দ্বিতীয় কাকটি তার পিছু পিছু উড়ে চলেছে।দেখে মনে হচ্ছে প্রথম কাকটি রাগ করেছে আর তার সাথি তার রাগ ভাঙ্গাতে ব্যস্ত হয়ে পরেছে।

হঠাৎ কোমড়ে এক জোড়া হাতের স্পর্শে চমকে যেয়ে পিছনে তাকিয়ে দেখে আবরার দাঁড়িয়ে আছে।ওর তাকানো দেখে কোমড়টা ছেড়ে দিয়ে সোফায় বসতে বসতে বলে,
-“বিয়ের পাঁচ মাস হতে চললো এখনো আমার স্পর্শে ভয় পাও।”

ইয়ারাবী কিছু না বলে বেলকনির রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আবার শূন্যে দৃষ্টি দেয়।ওর এখন কারো সাথে কথা বলতে নূন্যতম ইচ্ছাটুকু করছেনা।ও মনে শুধু একটা প্রশ্ন ঘুরপাক করছে,আচ্ছা মানুষ এমন কেন?শুধুমাত্র নিজের স্বার্থেরর জন্য পরের ক্ষতি করতেও দ্বিধাবোধ করেনা।আসলে ও জন্মেছে এমন এক পরিবারে যেখানে সবাই নিজের স্বার্থ খোঁজে।

-“যা হয়েছে সেটাই তোমার কোনো দোষ নেই।তবে ওযে ওর প্রাপ্ত সাজা পেয়েছো তাও কিন্তু নয়।”

আবরার সোফায় বসে ওর দিকে তাকিয়ে কথাটা বলে।ইয়ারাবী পিছন না ফিরে সামনের দিকেই দৃষ্টি স্থীর রেখে বলে,
-“আমার জীবন মানে যুদ্ধ,যেখানে সব সময় লড়াই-সংগ্রাম করে যেতে হয়।জীবনটা একটা খেলার মাঠে পরিণত হয়েছে যেখানে সবাই নিজেদের ইচ্ছামত খেলতে চায়।জীবনে কষ্ট সবার থাকে কিন্তু আমার মতো কারো আছে নাকী?”
-“অতীতকে ভুলে যাও,সময় কখনো কখনো মোড় ঘুড়িয়ে দেয়।”
-“উইলিয়াম শেক্সপিয়ার একবার একটা কথা বলেছে।সেটা হলো,সাফল্যের ৩টি শর্তঃ
– অন্যের থেকে বেশী জানুন!
– অন্যের থেকে বেশী কাজ করুন!
– অন্যের থেকে কম আশা করুন!
আমিও ঠিক তাই করার চেষ্টা করি,সবাইকে এড়িয়ে চলে সামনে এগনোর চেষ্টা করি।কিন্তু সেই ঝামেলা কখনো আমার পিছু ছাড়েনা,ভেবেছিলাম বিয়ের পর শেষ হয়ে যাবে।কিন্তু আমার ভাবনাটা সব সময় ভুল হয়।”
-“বাদ দাও এসব,চলো দুপুরে একটু ঘুমাবে।”
-“আপনি যান,ঘুম আর চোখে আসবেনা।”
-“এসব বললে হবেনা,একটা কথা সর্বদা মাথায় রাখবে।বর্তমানে আমার থেকে বেশি আপনজন তোমার দ্বিতীয় কেউ নেই।তাই যা বললো সেটা শুনবে।”
-“আপনি সব সময় জেদ করেন কেন?”

আবরার হালকা হেসে মাথা নাড়িয়ে বলে,
-“আমি যে মানুষটাই এমন হানি।”

কথাটা বলে ওকে কোলে তুলে নিয়ে বিছানায় শুয়ে দেয়।ইয়ারাবী এমন কাজে অনেকটা রেগে যায়।কিছুটা বলতে যাবে তার আগেই আবরার ঠোঁটে আঙ্গুল দিয়ে চোখ রাঙ্গিয়ে ঘুমাতে বলে।ওর সবুজ চোখের দিকে তাকিয়ে ইয়ারাবীর আর কথা বলার সাহস হয়না।

সকালবেলা ব্রেকফাস্ট করতে সবাই টেবিলে বসেছে, সাথি এক এক করে খাবার কিচেন থেকে এনে ডাইনিং এ রাখছে।জারিকা অনেকটা মুখভার করে নিরাকে কোলে নিয়ে নিচে নেমে নুসরাতের পাশে বসে।আবরার একবার আড়চোখে ওর দিকে তাকিয়ে গ্লাসে জুস ঢেলে খেতে থাকে।ইয়ারাবী ফ্রিজ থেকে ছানার সন্দেশ বের করে টেবিলে রাখতেই ইমন ওর দিকে ভ্রু কুচকে বলে,
-“মিষ্টি কম কম কেন লাগছে?”
-“দেখ ভাইয়া,আমি কিন্তু খায়নি।”
-“আমি কী তোকে বলেছি তুই খেয়েছিস।এটাতো সেই প্রবাদ বাক্যের মতো হয়ে দাঁড়ালো,’ঠাকুর ঘরে কেরে?আমি তো কলা খায়নি।’

ইমন অনেকটা বাঁকা হেসে কথাটা বলে।ইয়ারাবী মুখ ফুঁলিয়ে বলে,
-“বাজে বকবেনা,তুমি আমাকে বলেছো আমি খেয়েছি কীনা?সরাসরি বলতে পারোনি তাই ঘুরিয়ে বলেছো।”
-“হ্যাঁ,আপনিতো সব বোঝেন।”
-“দেখো খালু,তোমার ছেলে আমাকে কী বলছে?”

মি.রহমান ইমনের দিকে তাকিয়ে বলেন,
-“ইমু,মেয়ের পিছনে লাগবিনা।ওকে না জ্বালালে কী তোর ভালো লাগেনা?যাই হোক মিষ্টিটা কে বানিয়েছে মা?”
-“আমি আর ইমু ভাইয়া…”

ইমন মুখ লটকিয়ে বলে,
-“বানালাম তো আমি তুই তো জাস্ট জিনিসগুলো বের করলি।”
-“তো,তোমার সৌভাগ্য যে আমি তোমাকে সাহায্য করেছি।”
-“ওটা সৌভাগ্য নয় দুর্ভাগ্য।”

আবরার প্লেট থেকে একপিচ উঠিয়ে মুখে দিয়ে বলে,
-“বাহ্,চমৎকার হয়েছে।তবে চিনির পরিমানটা একটু কম হয়েছে।”
-“তোমার বৌ বেশি মিষ্টি খেতে পারেনা ব্রো।”
-“হামম,জানি তো।এই বাচ্চা বাকী বাচ্চাদের থেকে আলাদা।”

ইয়ারাবী গ্লাসে জুস ঢেলে ঠাস করে জগটা রেখে বলে,
-“আই এম্ নট এ্যা কিড্।উনিশে পরবো…”
-“চার-পাঁচ মাস বাকী এখনো…”
-“হুর,কথায় বলবোনা।”

সবাই চুপচাপ করে খাচ্ছে।সকলের খাওয়া প্রায় শেষের দিকে তখন জারিকা মি.রহমানকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠে,
-“জামাই মনে হয়না আপনারা আর মিরপুরের ফ্লাটে যাবেন।”
-“হামম,শিখার কবর এখানে তাই বাচ্চারাও এখানেই থাকতে চাইছে।”
-“তাহলে আমি বলি কী,ফ্লাট বিক্রি বা ভাড়া দেন।এতে আপনাদেরই লাভ হবে।”
-“না জারিকা,ওটাও থাক।যেভাবে আগে ছিলো, ছেলে-মেয়েরা মাঝে মাঝে ওখানে থাকতে যাবে।”
-“এত বড় বাড়িতে থাকবে আবার ওখানে থাকবে এ কেমন কথা?আচ্ছা বাদ দেন, কাল আম্মু একটা কথা বলছিলো।আসলে সাহস পায়নি তাই আপনাকে বলতে পারেনি।এজন্য আমাকে বলতে বলেছে।”
-“কী কথা?আর নিন্দুই বা আমাকে কেন ভয় পাবে?”

জারিকা কিছুটা কাচুমুচু হয়ে বলে,
-“আসলে জামাই আমার বড় খালা আছেনা,যার স্বামী হার্ট অ্যাটাকে মারা গেছে দু’বছর আগে।”
-“আমি ছিলাম না এখানে,অবশ্য শিখা আমাকে ফোনে বলেছিলো।তো কী হয়েছে?”
-“আসলে আম্মু বলছিলো যে, ফুপু মারা গেছে, আর আপনিও একা হয়ে গেছেন।আসলে আপনার একজন সঙ্গীর প্রয়োজন,কেননা একা একা কতদিন থাকতে পারবেন।আর আমার খালাও বিধবা মানুষ তাই….”

জারিকার এমন প্রস্তাবে সবাই খুব রেগে যায়।ইরাক হাতের কাঁটা চামচটা রাগের কারনে হাতের মধ্যে চেঁপে রেখে বেঁকিয়ে ফেলে।ইমনের তো মন চাচ্ছে জারিকাকে ঠাটিয়ে চড় মারতে তবে বড় বলে চুপ করে আছে।ইফাজ কথাটা শুনার সাথে সাথে চিল্লিয়ে উঠে বলে,
-“বিবেক বলতে তোদের কিছু আছে?সাহস কী করে হয় এমন কথা বলার।এমন চিপ মাইন্ডের কথা কীভাবে বলতে পারো?”
-“আপু কথা বলার একটা লিমিট থাকে।”
মি.রহমান শান্তভাবে বসে পুরো নাস্তাটা শেষ করে ইয়ারাবী-ইমনের দিকে তাকিয়ে বলে,
-“বাবা আস্তে কথা বলো,আর মামনি তুমি সিক ভুলে যাবেনা।আমি ব্যাপারটা দেখছি,একদম চুপ করে বসে খাও তোমরা…”

ইফাজ জারিকার দিকে চোখ লাল করে তাকাই।ইয়ারাবী কথাটা শুনে জারিকার দিকে রেগে তাকিয়ে পরোটার টুকরা ছিড়ে আলু-ভাজি দিয়ে মুখে নেয়।ওর চোখ দেখে মনে হচ্ছে পরোটার জায়গায় ওকে চিবাতে পারলে শান্তি পেত।জারিকাও ওদের তাকানো দেখে কিছুটা ভয় পেয়ে যায়।কেননা ওরা প্রচন্ড রেগে গেলে আউট অফ কন্ট্রোল হয়ে যায়,সামনে কে আছে সেটা ওদের কাছে ম্যাটার করেনা তখন।মি.রহমান জারিকার দিকে তাকিয়ে বলে,
-“দেখো জারিকা,তুমি যা বলেছো সেটা শুনে আমার খুব খারাপ লেগেছে।কেননা শিখার জায়গায় অন্য কাউকে চিন্তা করার কথা তোমার পরিবার কী করে ভাবতে পারে বুঝতে পারছিনা?আর বাকী রইলো একা থাকা,সেটাতো আগেও থাকতাম।আমরা নৌবাহিনীর অফিসাররা ছুটি বেশি পায়না।বিশেষ কারন ছাড়া আমাদের আসা হয়না।তাই এসব ফালতু কথা আর কেউ যেন না বলে।”

জারিকা ওর ফুপার তালে তাল মিলিয়ে বলে,
-“জামাই আমিও তাই বলেছি আম্মুকে,রাগ করেছিলাম এটা নিয়ে।তারপরও কাল রাত থেকে ফোন করে পাগল করে দিচ্ছিলো,তাই জানালাম।আমিও চাইনা রশ্মি ফুপুর জায়গায় অন্য কেউ আসুক।”
-“তোমার কবে থেকে সুবুদ্ধি উদয় হলো?”
ইয়ারাবী আড়চোখে তাকিয়ে কথাটা বলে।জারিকা ওর দিকে তাকিয়ে বলে,
-“মানে?কী বলতে চাস তুই?তোর মতো নই আমি, আমাকে সংসারের চিন্তা করতে হয়।তুই তো সব সময় বাইরে বাইরে ঘুরিস,শ্বশুড়বাড়ি বলে যে একটা জায়গা আছে সেটা তো মনে হয় জানিসও না।”
-“কী বলছো এসব?”
-“কেন সত্য বুুঝি গায়ে লাগলো?বিয়ের পর কয়দিন শ্বশুড়বাড়ি ছিলি তুই,আল্লাহ জানে বাইরে বাইরে কী করে বেড়াস?পড়ালেখা তো অনেকে করে তবে তোর মতো সারাদিন বাইরে বাইরে কাটায়না।আর এতই যদি ভদ্র হোস তবে বিয়ের পরে দেবরের সাথে এতো ঢলাঢলি কীসের?”

ইয়ারাবী চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বলে,
-“মুখের ভাষা ঠিক রেখে কথা বলো…”
-“কেন কেন?সত্যিটা ফাঁস হয়ে গেল।মনে করেছিস আমি কিছু বুঝিনা।সেদিন টিএসসির মোড়ে দাঁড়িয়ে দেবরের সাথে যে ফুসকা খাচ্ছিলো সেটা ঠিকই আমি দেখেছিলাম।”
-“ব্যাস,অনেক বলেছো,মেঘ আমার দেবর হওয়ার আগে আমার ভালো বন্ধু।ওকে সব সময় ভাইয়ের নজরে দেখেছি,আর তুমি।তাছাড়া তো আমি একা ছিলাম না,আমাদের পুরো ফ্রেন্ড সার্কেল ওখানে ছিলো।”
-“হু,শাক দিয়ে মাছ ঢাকার চেষ্টা করবিনা।তুই তোর বরকে যা বুঝাস ও তাই বোঝে,তাই বলে আমাকে পার্ট পড়াতে আসবিনা।তোকে পড়াচ্ছে বলে সারাদিন যা খুশি তাই করে বেড়াস, আর কেউ কিছু টের পাবেনা ভাবলি কী করে?আর আবরার তুমি চুপচাপ বসে জুস গিলছো কী করে?তুমি যদি এখন একে শাষন না করো তবে পরে দেখবে কেলেঙ্কারি বাঁধিয়ে তোমার মুখে চুনকালি মাখাবে…”

আবরার জুসের গ্লাসটা টেবিলে রেখে মৃদু হেসে ইয়ারাবীর দিকে তাকিয়ে ওর হাতটা নিজের মুঠোয় নিয়ে বলে,
-“তুমি ভাবলে কী করে আমি এসবের কিছু জানিনা?ইউ্ নো,ছোটবেলা থেকে সবাই বলতো আমার নজর নাকী বাজপাখির মতো।যার উপর পরে তাকে সহজে ছাড়েনা।তোমার বোন সকাল থেকে রাত পর্যন্ত কোথায় কী করছে,কোথায় যাচ্ছে সবকিছু আমার নখদর্পণে থাকে।তুমি তো জাস্ট ফুসকার কথা বলছো,ওরা তো একসাথে ঘুরতে পর্যন্ত গেছে।তবে সেটা আমার থেকে অনুমতি নিয়ে, আমি যদি কোনো কিছুতে না করি,তবে তোমার বোনের সাহস নেই সেই জিনিসটা করবার।এর মানে এটা নয় ও আমাকে ভয় পায়?আসলে ও আমাকে শ্রদ্ধা করে তাই…”
-“কী আপু?মুখ বন্ধ কেন হয়ে গেল তোমার?এতক্ষণে তো খই ফুটছিলো,আসলে কী জানোতো যে যেমন তার ভাবনা চিন্তাও তেমন।তুমি সুকরিয়া আদায় করো যে এখনো আমি বলিনি কাল রাতে কী কাহিনি করেছিলে?”

জারিকা কিছু চমকে বলে,
-“দ্ দেখ বেশি বুঝবিনা,ওটা ভুলে…”

এর মাঝে ইরাক বলে উঠে,
-“কাল রাতে কী হয়েছিলো রে পিচ্চি?”
-“আম্মু বল কী হয়েছিল,কাল মাঝরাতে তোর রুম থেকে চেঁচামেচির আওয়াজ শুনছিলাম,তবে তোর প্রায় পেইন এ্যাটাক হয় আর আবরার ছিলো বলে আর বিরক্ত করিনি।তখন কী কিছু হয়েছিলো?”

জারিকা দ্রুত বলে উঠে,
-“না না জামাই কিছু হয়নি…”

ইয়ারাবী তাসছিল্যের হাসি দিয়ে বলে,
-“আসলে তোমার একটা নয় অনেকগুলোর প্রয়োজন হয়,তাইনা আপু?”
-“ইয়ারাবী মুখ সামলে কথা বলিস?”
-“কেন?সামীর ভাইয়ার পরে সায়ন ভাইয়া,আর কাল সন্ধ্যার পর তোমার সো-কল্ড খালাতো ভাই আশিষের সাথে রুম ডেট করে মন ভরে ছিলোনা।তার জন্য কাল রাতে জঘন্য কাজ করতে গেছিলে..”

ইয়ারাবীর কথায় উপস্থিত তিনজন মানুষ ব্যতিত চমকে উঠে।জারিকা প্রচুর অবাক হয়ে যায় কেননা এই কথাগুলো তো ইয়ারাবীর জানার কথা নয়।কাল রাতের থাপ্পড়ের বদলা নেওয়ার জন্য সারা রাত জেগে মনে মনে ছক কেটেছে যে কীভাবে ইয়ারাবীকে শায়েস্তা করা যায়।আর করতেও গেছিলো নিজের প্লান অনুযায়ী,তবে মাঝপথে যে এভাবে হাটে হাড়ি ভেঙে যাবে তা বুঝতে পারেনি।

মি.রহমান জারিকার দিকে তাকিয়ে বলে,
-“এসব কী শুনছি জারিকা আমি তোমার নামে?আমি তোমাকে ভালো ভাবতাম আর তুমি,ছিঃ..”
-“জামাই বিশ্বাস করেন,আপনার মেয়ে মিথ্যা বলছে…”
-“ইয়ারাবী কাউকে ফাঁসানোর জন্য কোনোদিনও মিথ্যা বলেনা,সেই শিক্ষা ওর খালা ওকে দেয়নি।”
-“জামাই তুমি কিছুু জানোনা…”

ইয়ারাবী ওর দিকে তাকিয়ে বলে,
-“আচ্ছা আপু,তোমার সাথে তো আমার কোনো শত্রুতা নেই তবে এমন কেন করো?”

মিসেস দোলন ইয়ারাবীর দিকে তাকিয়ে বলে,
-“কী হয়েছে তুই বল শুধু….”

আবরার একটা নিঃশ্বাসে ফেলে সবার দিকে তাকিয়ে বলে,
-“আমি বলছি ব্যাপারটা,জানি ইয়ারাবীর বলতে সংকোচে বাঁধছে তাছাড়া আমার নিজের বলতেও লজ্জা করছে।বয়সে ছোট হলেও সম্পর্কে উনি আমার বড়।ইয়ারাবীকে নিজের মেয়ে মানেন বলে কথাটা বলছি,নয়তো ভবিষ্যতে এর থেকেও ভয়াবহ কিছু হতে পারে।”
-“কী হয়েছে আবরার?”
কথাটা ইরাক কিছুটা গম্ভীর কন্ঠে বলে উঠে।আবরার চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বলে,
-“কাল মাঝরাতের দিকে ইয়ারাবীর পানির পিপাসায় ঘুম ভেঙে গেলে রুমে দেখে পানি নেই।তাই আমাকে না ডেকে ও নিচে পানি আনতে চলে যায়।অবশ্যই এটাকে ও নিজের বাড়ি মনে করে তাই রুমের দরজা বন্ধ না করেই চলে যায়।আমার আবার ঘুমটা খুব পাতলা,হঠাৎ আমার মনে হয় কেউ আমার মুখের উপর ঝুঁকে আছে।ঘুমের ঘোরে ইয়ারাবীকে মনে করে হাত ধরে নিজের দিকে টান দিতেই হঠাৎ কাচের চুড়ির আওয়াজ শুনি।আমার ব্রেনে এটা খুব ভালো করে সেটাপ হয়ে আছে, ইয়ারাবী চুড়ি পরেনা,তাই এই শব্দ আসার কোনো প্রশ্ন উঠেনা।ততক্ষণে ঘুম আমার ছুটে গেছে,উঠে দেখি মিসেস জারিকাকে।
কাহিনি এখানেই শেষ নয়,ইয়ারাবী রুমে এসে যখন নিজের বোনকে দেখতে পায় তখন প্রশ্ন করে এই রুমে কী করছে?তখন এনার উত্তর ছিলো,ভুল করে রুমে চলে এসেছে।মাঝরাতে যদি কেউ এমন করে আর উত্তরটা হাস্যকর হয় তবে রাগ উঠা স্বাভাবিক।কথা কাঁটাকাঁটির এক পর্যায়ে ইয়ারাবী উনাকে একটা থাপ্পড় দেয়।”

মি.রহমান কথাটা শুনার সাথে সাথে জারিকাকে জোড়ে একটা চড় মেরে দেয়।একজন নৌবাহিনীর হাতের শক্তি কখনো সামান্য হতে পারেনা।চড়টা অনেক জোড়ে লাগে যার জন্য জারিকার ঠোঁট কেঁটে যায়।কেউ ভাবতে পারেনি মি.রহমান এমন কোনো কাজ করতে পারেন।উনি অনেকটা হুংকার দিয়ে বলেন,
-“আল্লাহ আমার ঘরে কোনো মেয়ে দেয়নি,তাই ইয়ারাবীকে সব সময় নিজের মেয়ে ভেবে এসেছি।তার মানে এই নয় যে বাকীদের আমি কম ভালোবাসি।মেয়েদেরকে আমি শ্রদ্ধা করি,সে যেমনি হোক তার খারাপ কাজের জন্য আমি কখনো গায়ে হাত তুলিনা।কিন্তু তুমি তুলতে বাধ্য করলে।ইরাক ওর বাড়িতে ফোন করো এখনি,ওর স্বামীকে আসতে বলো।”

ইরাক ফোনটা বের করতে গেলে ইয়ারাবী ওর হাত ধরে বলে,
-“ভাইয়া,দোহায় লাগে এমন করিস না।নিরাকে দেখ বাচ্চাটা ভয় পেয়ে কান্না করছে।সামীর ভাইয়া যদি জানতে পারে তো আপুকে ডিভোর্স দিবে।তাহলে মেয়েটার কী হবে?”
-“এই নিরার জন্যই হলেও আজ করতে হবে,নয়তো মেয়েটা ওর মায়ের স্বভাব পাবে।সামনে থেকে সর,আবরার তোমার বৌকে সরাও….”
-“ভাইয়া দেখ এমন করিস না…..”

জারিকা ইয়ারাবীকে ধাক্কা মেরে মেঝেতে ফেলে দেয়,টেবিলের কর্নারে অনেকটা আঘাত পায়।কেউ কিছু বলার আগেই আবরার জারিকাকে একটা থাপ্পড় মেরে ইয়ারাবীকে উঠায়।জারিকা গালে হাত দিয়ে বলে,
-“নাটক মারাচ্ছিস তুই?ডাক আমিও দেখবো কে কী করতে পারে?আর আবরার এই বাজা মেয়ের জন্য তুমি আমাকে মারলে?”

কথাটা বলে জারিকা নিরাকে নিয়ে রুমে চলে যায়।সবাই অবাক হয়ে যায় জারিকার তেজ দেখে।যেখানে জারিকার অনুতপ্ত হওয়া উচিত সেখানে ও তেজ দেখিয়ে চলে গেলে।আসলে মানুষের অধঃপতন হলে যা হয় আরকী।

(১৩৪)

বিকালের দিকে জারিকা একটা সোফায় চুপচাপ বসে আছে।সামীর এসে নিরাকে কোলে নিয়ে আর ওর কাছে দেয়নি।মিসেস নিন্দু সোফায় বসে পাকোড়া একটার পর একটা মুখে পুরছেন।শুভ একবার নিজের বাবার দিকে তাকিয়ে তারপর ফুপার দিকে তাকিয়ে বলে,
-“জামাই কিছু বলার জন্য ডেকেছিলেন,তাহলে বলুন?”

সামীর মেয়েকে পানি খাইয়ে দিয়ে ফুপা শ্বশুড়ের দিকে তাকিয়ে বলেন,
-“ফুপা যদি আমি ভুল না করি তবে জারিকা নিশ্চয়ই কিছু করেছে।”
-“হ্যাঁ,তবে ইয়ারাবী আর আবরারকে আসতে দাও।নুসরাত ওদের ডেকেছিলে তো?”
-“মামা ইয়ারাবী ঘুমাচ্ছিলো তখন,আবরার বললো ফ্রেস হয়ে আসবে।”

নুসরাত কথাটা বলতে বলতে দেখে ওরা নিচে নামছে।সমীর ইয়ারাবীর দিকে তাকিয়ে বলে,
-“তোমার মুখ এমন লাগছে কেন?ঠিক আছো তুমি…”
-“আলহামদুলিল্লাহ্‌ ভাইয়া,ঠিক আছি।”
-“তোমার আপু কী করেছে?”
-“মানে?”
-“দেখ,এখানে ডাকা হয়েছে মানে নিশ্চয়ই জারিকা কিছু করেছে।তুমি শুধু বলো কী হয়েছে?কেননা ওর নামে অনেক ব্যাড রিপোর্ট আমার কাছে আগেও এসেছে সেটা আমি কাউকে জানায়নি তবে…”
-“ভাইয়া আমি কখনো চাইবোনা এমন কিছু হোক।আপনি আগে কথা দেন আপুকে সুযোগ দিবেন।”

মিসেস নিন্দু গলা খাকিয়ে বলে উঠে,
-“আমার মেয়ে এমন কী করেছে যার সুযোগ দিতে হবে।”
মি.তৌহিদ কথাটা শুনে স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বলে,
-“চুপ করবে তুমি,আগে দেখি কী হয়েছে?”
-“দেখ তোমাকে আগেই বলছি,তোমার বোনের মেয়ের জন্য যদি আমার মেয়ের কিছু হয়েছে তো আমি ছাড়বোনা।”
-“চুপ একদম চুপ…”

মি.রহমান ওদেরকে জারিকার কৃতকর্মের কথা সব বলেন।সামীরের প্রচুর রাগ উঠে যায়,জারিকা চিৎকার করে বলে,
-“মিথ্যা কথা,এসব ভুল।এই বেয়াদপ মেয়েটা সবকিছু বানিয়ে বলছে…”

সামীর উঠে দাঁড়িয়ে জারিকার মুখে চড় মেরে দিয়ে বলে,
-“তুমি এমন ধোঁয়া তুলসি পাতাও নয়,যে মেয়েটার জন্য আমি দিন-রাত খেটে মরি আর সে ছিঃ ছিঃ… তুমি ভাবলে কী করে তোমার কথা বিশ্বাস করবো।”

মিসেস নিন্দু উঠে দাঁড়িয়ে বলেন,
-“দেখো বাবা,এখানে শুধু আমার মেয়ের ভুল তা কিন্তু নয়।তাছাড়া বাচ্চা মেয়ে এমনটা হয়ে যায়।”

ইয়ারাবী ওর মামীর কথা শুনে না হেসে থাকতে পারেনা।ওর মামীকে বলে,
-“কিন্তু মামী আজ আপনার বাচ্চা মেয়ের জন্য পল্লবী আপুর সংসার প্রায় ভাঙ্গতে বসেছে।সায়ন ভাইয়াকে নাকে দঁড়ি দিয়ে ঘুরিয়েছে আপনার এই বাচ্চা মেয়ে।তাও জানেন কবে থেকে?যেদিন পরীর জন্ম হয় সেদিন।”
-“তাই বলে তোমাদের বরদের কোনো দোষ নেই তা কিন্তু নই।তারাই বা কেন আসে আমার মেয়ের কাছে?”
-“দুঃখীত কথাটা না বলে থাকতে পারলাম না, চোরের মায়ের বড় গলা।”
-“ইয়ারাবী?তোর মা ঠিকই বলে,তুই সত্যি একটা অপয়া।তোর নজর যায় উপর পরে সে সতিই ধ্বংস হয়ে যায়।”

ইয়ারাবী কিছু বলতে যাবে তার আগে আবরার মামীর দিকে তাকিয়ে বলে,
-“মামী মাথা ঠান্ডা করে আমার কথাগুলো শুনবেন প্লীজ।আমি এখন যেগুলো বললো সেগুলো ভালো করে ভেবে আপনি রায় দিবেন।পরুষ-মহিলা সবাইকে চরিত্র সংরক্ষণের নির্দেশ দিয়েছে ইসলাম। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘তোমরা ব্যভিচারের নিকটবর্তী হয়ো না। এটা অশ্লীল কাজ এবং নিকৃষ্ট আচরণ।’ (সুরা বনি ইসরাইল, ৩২)
ব্যভিচারের শাস্তি হিসেবে আল্লাহ বলেন, ‘ব্যভিচারী ও ব্যভিচারিণী উভয়কে এক’শ ঘা করে বেত্রাঘাত কর।’ (সুরা নুর, ২)
হাদিস শরিফে ব্যভিচারের ভয়ানক শাস্তির কথা বর্ণিত হয়েছে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘হে মুসলমানগণ! তোমরা ব্যভিচার পরিত্যাগ কর। কেননা এর ছয়টি শাস্তি রয়েছে। এর মধ্যে তিনটি দুনিয়াতে ও তিনটি আখেরাতে প্রকাশ পাবে। যে তিনটি শাস্তি দুনিয়াতে হয় তা হচ্ছে, তার চেহারার ঔজ্জ্বল্য বিনষ্ট হয়ে যাবে, তার আয়ুষ্কাল সংকীর্ণ হয়ে যাবে এবং তার দারিদ্রতা চিরস্থায়ী হবে। আর যে তিনটি শাস্তি আখেরাতে প্রকাশ পাবে তা হচ্ছে, সে আল্লাহর অসন্তোষ, কঠিন হিসাব ও জাহান্নামের শাস্তি ভোগ করবে।’ (বায়হাকি, হা নং ৫৬৪)
হজরত সাহল ইবনে সাদ (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি মুখ ও লজ্জাস্থানের হেফাজতের জামিনদার হবে আমি তার বেহেশতের জামিনদার হবো।’ (বুখারিঃ ৭৬৫৮)
কখনো দেখা যায় দেবরের সাথে জমে ওঠে পরকীয়া। ইসলাম দেবরের সাথে দেখা-সাক্ষাৎ করার লাগামকেও টেনে ধরেছে। হজরত উকবা ইবনে আমের (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘সাবধান! তোমরা নির্জনে নারীদের কাছেও যেও না।’ এক আনসার সাহাবি বললেন, ইয়া রাসুলাল্লাহ! দেবর সম্পর্কে আপনার নির্দেশ কী? নবীজি (সা.) বললেন, ‘দেবর তো মৃত্যুর সমতুল্য।’ (মুসলিম, ২৪৪৫)
হাদিসের ব্যাখ্যায় হাফেজ ইবনে হাজার আসকালানি রহ. ফতহুল বারিতে লিখেছেন, ‘এখানে মৃত্যুর সমতুল্যর অর্থ হলো হারাম।’ আর ইসলামে এসবের শাস্তি ভয়াবহ। এসবের শাস্তি হিসেবে রজম ও দোররার নির্দেশ এসেছে হাদিসে। যাতে কোনো নারী ও পুরুষ যেন এধরনের ভয়াবহ কর্মে লিপ্ত না হয়।
মামী আমি যতদূর জানি আপনার দু’ভাই আলেম তাহলে আপনার এসব জানা উচিত।”
-“দেখো বাবা,আমি তোমার সাথে কোনো কথা বলতে চাইছিনা।আমি ইয়ারাবীর সাথে বলছি….”
-“স্যরি মামী,আপনি যাকে গালমন্দ করছেন সে আমার স্ত্রী।”

সবাই মিসেস নিন্দুকে নানা কথা বলে,বুঝায় মেয়ের কাজগুলো।মি.তৌহিদ স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বলে,
-“সব তোমার জন্য,নিজে যেমন করে বেড়াও তেমন মেয়েগুলোও হয়েছে।কিছু বলতাম না,কিন্তু আজ আর চুপ করে থাকবোনা।”

মি.রহমান সামীরের দিকে তাকিয়ে বলে,
-“সামীর যা বলার তুমি বলো…”
-“এখানে বলাবলির কিছু নেই,মেয়েকে আমার কাছে রেখে ওকে ডিভোর্স দিবো।”

জারিকা সামীরের পায়ে ধরে বলে,
-“প্লীজ তুমি এমন করোনা,একটা সুযোগ দাও।আমি আর কখনো এমন করবোনা।”
-“পা ছাড়ো জারিকা….”
-“না তুমি এমন করোনা…”

ইয়ারাবী সামীরের দিকে তাকিয়ে বলে,
-“ভাইয়া প্লীজ এমন করবেন না।আপনার মেয়ের কথাটা একবার ভাবুন।ভাইয়া আমি রিকুয়েস্ট করছি এমন করবেন না।মাথা ঠান্ডা করে চিন্তা করুন,না ভেবে কোনো কাজ করা বোকামি।”
-“আসলে কী জানো ইস্মা?তোমার বোন কোনোদিন শুধরাবার নই,তবুও ভাব্বো আমি।কিছু মনে না করলে আমাকে এখনো বেড় হতে হবে কিছু কাজ আছে।নিরাকে আমি নিয়ে যাচ্ছি…”
-“ভাইয়া…”
-“চিন্তা করোনা,এমন কিছু করবোনা।চলুন,আম্মাজান আমরা যায়…”

সামীর মেয়েকে কোলে তুলে নিয়ে বেরিয়ে যায়।জারিকা উঠে ইয়ারাবীর দিকে তাকিয়ে বলে,
-“তোর জন্য আমার সংসার ভাঙ্গতে বসেছে।তোকে কোনোদিন ক্ষমা করবোনা।নিজেকে কী ভাবিস, আজ আমার দুর্দিন তাই এমন করছিস।আমারও সময় আসবে,তখন আমিও বলবো।আর সেই সময়টা দেখবো তোর বাহাদুরি কোথায় যায়।খোদার কসম, তোর তখন শুধু মরে যেতে মন চাইবে।”

কথাটা বলার সাথে সাথে কেউ জারিকার মুখে জোড়ে থাপ্পড় দেয়।সামনে তাকিয়ে সবাই অবাক হয়ে যায়।

#চলবে_____

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here