#জীবন মানে তুমি
#লেখিকা:H.B.Rini (Irini Ori)
#পর্ব:৩৮
(১৩০)
ইয়ারাবী সমরেশ মজুমদারের ‘সাতকাহন’ বইটা নিয়ে বিছানায় কেবল বসেছিলো।আসলে ওর খালামনি মারা যাওয়ার পর থেকে ওর মাইন্ড কিছুটা ডিস্টার্ব হয়ে আছে,যার জন্য রুমে ঢুকার আগে ইমনের কাছ থেকে বইটা চেয়ে এনেছে।বইটা ওর কাছে অনেক ভালো লাগে তবে কখনো পড়ে উঠতে পারেনি।বইয়ের পাতা খুলতে যাবে তখনি নুসরাত এক গ্লাস দুধ নিয়ে রুমে ঢোকে।
-“এই নাও,দুধটা শেষ করে গ্লাসটা দাও…”
ইয়ারাবী বইটা একপাশে রেখে নুসরাতের হাত ধরে সামনে বসিয়ে দেয়।নুসরাত হেসে ওর দিকে তাকিয়ে বলে,
-“কিছু বলবে?”
-“তুমি কী নিয়ে পড়ছো?”
-“যুক্তিবিদ্যা,কেন?”
-“এমনি,আসার পর থেকে তোমার সাথে কথা বলতে পারিনি।আসলে পরিস্থিতি এমন ছিলো যে..”
-“মামীকে মিস করছো?”
-“জানো আপু,কখনো ভাবতে পারিনি এমনটা হবে।যখন খবরটা শুনলাম তখন অনেক কষ্টে নিজেকে এই বলে শান্তনা দিচ্ছিলাম যে,আর কিছুক্ষণ।কয়েক ঘন্টা পরে খালামনির কাছেই থাকবো,কিছু হবেনা ঠিক হয়ে যাবে।কিন্তু যে আশা নিয়ে এসেছিলাম সেটা পুরোপুরি মিথ্যা ছিলো।কখনো ভাবিনি এসে খালামনির মৃত শরীরটা দেখবো।”
চোখের কর্নারে জমে থাকা জল চিকচিক করে উঠে, যে কোনো সময় বাঁধ ভাঙবে।নুসরাত ওর কাঁধে হাত রেখে বলে,
-“কেঁদোনা,কাঁদলে আত্মা কষ্ট পায়।তুমি ভেঙে পরলে খালুদের সামলাবে কে।আচ্ছা এসব বাদ দিয়ে গরম দুধটা খেয়ে নাও।”
-“পরে খাবো আপু।”
-“পরে ঠান্ডা হয়ে যাবে,তখন দুধ খেতে পারবেনা।”
-“সেটা নয়,আসলে উনি আমাকে দুধের সাথে কোনো মেডিসিন দেন।”
-“কীসের মেডিসিন?”
-“জানিনা,আমাকে কীসের ট্রিটমেন্ট করছে আর কীসের মেডিসিন দেয় কিছুই জানা নেই।”
-“ওমা,তোমার সম্পর্কে আর তুমি জানোনা।এটা কেমন কথা?”
-“শুধু একটুকু জানি,একদিন গ্যাপ গেলে আমার অবস্থা খারাপ হয়ে যায়।সবাই কী ঘুমিয়ে পরেছে?”
-“না,খালুরা কথা বলছে রুমে।আম্মু প্রায় শুয়ে পরেছে আর আমি এখানে…”
-“তাহলে যেয়ে ঘুমিয়ে পরো,এমনিতে সারাদিন প্রচুর ঝামেলার মধ্যে ছিলে।”
-“হ্যাঁ,শুতে যাবে।”সাতকাহন”পড়ছো তুমি,বইটা অনেক ভালো।”
-“শুনেছি ভালো,তবে কোনোদিন পড়তে পারিনা।কেননা যেদিন পড়তে যাবো কোনো না কোনো ঝামেলা হবেই সেদিন।”
-“এই বইটা একটা নেশার মতো,বারবার পড়লেও তৃপ্তি মিলবেনা।একটা নেশার মতো কাজ করে,দীপাবলি চরিত্রকে ঘিরেই উপন্যাসটা।হার না মানা এক নারী,আচ্ছা তুমি পড়ো আমি যায়।”
-“জ্বি আপু,শুভ রাত্রি।”
-“শুভ রাত্রি সোনা।”
নুসরাত চলে যেতেই ইয়ারাবী ফোনটা উঠিয়ে দেখে ফোনে অনেকগুলো কল আর ম্যাসেজ,সবগুলো এসেছে অনু,হিয়া,চৈতিদের নাম্বার থেকে।ইয়ারাবী জানে এরা কল আর ম্যাসেজ কেন করেছে?কেননা নিশ্চয়ই মেঘ সবাইকে কথাটা জানিয়েছে।আজ তিনটা দিন ধরে ওর ফোনটা আবরারের কাছে ছিলো,কাল রাতে যাওয়ার আগে ওকে দিয়ে গেছে।তারপর থেকে ফোনটা তেমনভাবে ধরা হয়নি।কিন্তু ইয়ারাবীর এখন মোটেও ইচ্ছা করছেনা ওদের সাথে কথা বলার,ও কথা বলতে গেলেই অনেকটা ইমোশোনাল হয়ে পড়বে।কিন্তু ও আর কাঁদতে চাইনা।তাই পুরো ফোকাসটা বইয়ের উপর অনার চেষ্টা করছে।বইটার একটা পৃষ্টা পড়ে অনেকটা কৌতুহল জাগে ওর মনে,যেই দ্বিতীয় পৃষ্ঠা পড়তে যাবে কেউ একজন বইটা ওর হাত থেকে টান দেয়,সাথে কিছু কাঁচের চুরির শব্দ হয়।বিরক্তি নিয়ে ও সামনের ব্যাক্তির দিকে তাকিয়ে দেখে একটা লাল রঙের কোটি দেওয়া গাউন টাইপের নাইটি পরে জারিকা দাঁড়িয়ে আছে।ইয়ারাবী খানিকটা বিরক্ত নিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে বলে,
-“এটা কী ধরনের ভদ্রতা আপু?”
জারিকা মুখ ভ্যাটকানো হাসি দিয়ে বিছানায় পায়ের উপর পা তুলে বসে।ওর দিকে তাকিয়ে বলে,
-“আমি কিন্তু কয়েক বছরের বড় তোর…”
-“তো?”
-“বড় বোন হই,আর জানিস বড় বোনের সব কথা শুনতে হয়,সম্মান করতে হয়।”
-“তুমি নিশ্চয়ই ভুলে গেছো আমি মানুষের চরিত্র আর কাজ দেখে তাদের সম্মান করি।আর তুমি তো সম্মান পাওয়ার মতো এমন কোনো কাজ করোনি যাতে করে তোমার পা ধরে বসে থাকতে হবে।”
-“বড় ফুপু ঠিকই বলে তুই একটা অতি মাত্রার বেয়াদব মেয়ে।দেখিস এই দেমাগ নিয়ে না স্বামীর ঘর করতে পারবি না বেশিদিন শ্বশুড়বাড়ি টিকতে পারবি।শুধু রশ্মি ফুপু তোকে নিয়ে নাচতো…”
-“শিখা খালামনির কথা তোমার মুখে মানায় না।আর আমি জানি আমি বেয়াদব,আমাকে নিয়ে তোমার আর তোমার ফুপুদের না ভাবলেও চলবে।আর ঘর করতে পারবো কী পারবো না,সেটা না হয় আমার স্বামীকে বুঝতে দাও।”
জারিকা রেগে ওর দিকে তাকিয়ে বলে,
-“অভদ্র মেয়ে একটা,ভদ্রতার নামানে নেই…”
-“আমি যদি অভদ্র হই তবে তুমি কী?কারোর রুমে আসার জন্য পারমিশন লাগে সেটাও তুমি জানোনা।”
-“আমি তোর সাথে ভালো ভাবে কথা বলতে এলাম আর তুই,আচ্ছা বাদ বোন।নিজেদের ভিতর ঝগড়া কীসের?আমরা তো বোনই,আর আমার দিক থেকে দেখতে গেলে তুই হলি আপন বোনের মতো।”
কথাটা খুব শান্তভাবে বলে জারিকা।তবে ইয়ারাবীর এই কথা শুনে প্রচুর হাসি পায় তবে জোড়ে না হাসলেও হালকা একটা মুচকি হাসি দেয়।ও ভালো করেই বুঝতে পারছে জারিকা নিশ্চয়ই কোনো ফন্দি আটছে যার জন্য এত নমনীয়তা দেখাচ্ছে।ইয়ারাবী চোখ থেকে চশমা খুলে পাশে টেবিলে রেখে বলে,
-“কিছু বলার থাকলে বলো…”
-“তেমন কিছুনা এই কথা বলতে এলাম।এখন কেমন আছিস তুই?”
-“আলহামদুলিল্লাহ্,আল্লাহর রহমতে তোমার সামনে এখন বসে আছি।”
-“কথা ঘুরিয়ে না বললে তোর ভালো লাগেনা।”
-“কী করবো বলো আপু?আমি মেয়েটাই এমন,”
-“অনেক সুন্দর তো তোর নাইট ড্রেসটা,”
-“সুন্দর কোথায় দেখলে,একটা শার্ট আর পাজামা।”
-“তবুও,কোন জায়গা থেকে কিনেছিস এইটা?”
-“জানিনা,আবরার এনে দেয়।”
-“যে বোরখা আর ড্রেসগুলো পরিস ওগুলোও আবরার কিনে দেয়?”
-“হ্যাঁ,যদি শপিংমলের দিকে যান তবে কিছু না কিছু নিয়ে আসেন।”
ইয়ারাবী মৃদু হেসে কথাটা বলে।তবে জারিকার যে কথাটা একদম পছন্দ হয়নি সেটা ওর মুখে ভালো ভাবেই প্রকাশ পাচ্ছে।তাই কিছুটা মুখ লটকিয়ে বলে,
-“ও এনে দেয় মানে তোর নিজের কোনো পছন্দ নেই নাকী?বিয়ের পরের থেকে দেখছি পুরো প্যাকেট হয়ে বাইরে বেড় হোস।”
-“আপু,আমার পছন্দ নেই তা নয় কিন্তু।তবে কী জানো উনি আমার পছন্দ সম্পর্কে সব জানেন তাই অভিযোগ করার কোনো সুযোগ নেই।তাছাড়া উনি খুশি মনে যা দেন আলহামদুলিল্লাহ্ আমার কাছে সেটাই অনেক কিছু।আর রইলো পর্দার ব্যাপার সেটাতো বিয়ের আগেও বোরখা পরতাম।”
-“বোরখা পরতি তবে হুজুরদের বৌয়ের মতো তো আর চলতি না।”
-“আসলে কী জানো আপু,তোমাদের মতো দেহ প্রদর্শন করে চলাচল করা আমার একদম পছন্দ নয়।তাছাড়া আমি কীভাবে চলবো কী চলবো না সেটা আমার ব্যাক্তিগত ব্যাপার,আশাকরি এসবে তুমি এসবে হস্তক্ষেপ করতে আসবেনা।”
-“বাহ্,ভালোই কথা শিখেছিস।কই এসব কথা তো তখন শুনিনা যখন ভাইয়া-আপুরা তোর ব্যাপারে নাক গলায়।”
-“কারন তাদের অধিকার আছে তাই,কিন্তু সেই অধিকার আমি তোমাকে কোনো দিনও দেয়নি।আশা করি কথাটা বুঝতে পরেছো।”
জারিকার কথাটা শুনে মাথায় রাগ উঠে যায়,তবে এখন ওর রাগলে চলবেনা।কেননা ও যেই কাজ করতে এসেছে সেটা করার মোক্ষম সময় এইটা।তাই ও নিজের রাগটাকে মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে বলে,
-“আবরারকে খুব ভরসা আর বিশ্বাস করিস তাইনা?”
-“অবশ্যই আমার স্বামী হন উনি,ওনাকে বিশ্বাস করা ছাড়া আর কাকে করব।তাছাড়া বিয়ের পর একটা মেয়ের সবচেয়ে ভরসা আর বিশ্বাসের জায়গাটা হয় স্বামী।”
-“ওহ্হ্,কিন্তু কী জানিস,তোর এই বিশ্বাস…”
-“স্লিপিং টাইম!”
কথাটা শুনে দরজার দিকে তাকিয়ে দেখে আররার ট্রাউজারের পকেটে বাম হাত ঢুকিয়ে ডান হাত দিয়ে ফোন টিপতে টিপতে রুমে ঢুকে ইয়ারাবীর পাশে দাঁড়িয়ে বাম হাত দিয়ে ওর বের হয়ে থাকা চুলগুলো কানের পাশে গুজে জারিকার দিকে তাকিয়ে বলে,
-“স্যরি আপু,বাট্ এখন ঘুমাতে হবে।কাল না হয় আপনি আপনার বোনের সাথে মন ভরে গল্প করবেন।”
-“আরে কিন্তু…”
-“কোনো কিন্তু নয় আ…পু,ওর ঘুমের প্রয়োজন তাছাড়া আমিও প্রচুর টায়ার্ড।প্লীজ আপনি গেলে খুব খুশি হবো।সুইট ড্রিম…”
জারিকা রাগে গজগজ করতে করতে রুম থেকে বেরিয়ে যেতেই আবরার মাথার চুলগুলো ঝাঁকিয়ে রুমের দরজাটা আটকিয়ে দেয়।ইয়ারাবী ওর দিকে তাকিয়ে আবার চশমাটা পড়ে বইটা পড়তে থাকে।আবরার ব্যাগ থেকে একটা ছোট মেডিসিনের বোতল বের করে দু’টা পিলস্ নিয়ে দুধের মধ্যে দিয়ে চামশ দিয়ে নাড়তে নাড়তে বলে,
-“দুধটা ঠান্ডা হয়ে গেছে..”
-“আমার কাছে গরম-ঠান্ডা একই।”
-“এত অবহেলা করো কেন?জানো দুধ শরীরের জন্য কত উপকারী?”
ইয়ারাবী আবরারের দিকে আড়চোখে তাকিয়ে বলে,
-“ক্লাস ওয়ান থেকে পড়ে আসছি,মুখস্ত করে ভেজে খাওয়া হয়ে গেছে…”
-“তাহলে এমন করো কেন?”
-“পড়া আর খাওয়া এক জিনিস নয়…”
-“নাও,পুরোটা শেষ করো।”
ইয়ারাবী গ্লাসটা হাতে নিয়ে ওর দিকে প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে,
-“আচ্ছা,এই মেডিসিনটা কীসের জন্য?”
-“অতো জানতে হবেনা তোমার?”
-“আমিতো জানতামই না,ভাগ্যিস লন্ডনে থাকতে দেখেছি…”
-“আইন নিয়ে পড়ছো ভালো পজিশনে যেতে পারবে।”
ইয়ারাবী চোখবন্ধ করে পুরো দুধটা শেষ করলে আবরার ওর হাত থেকে বইটা নিয়ে বলে,
-“শুয়ে পড়ো…”
-“একটু পরে ঘুমাই,বইটা পুরো শেষ করি।”
-“সকাল হয়ে যাবে শেষ করতে করতে।তাছাড়া ইনজেকশন দিবো অর্থাৎ ঘুমিয়ে পরতে হবে।”
-“আমি আপনার জন্য খুবই দুঃখীত স্যার,কেননা ওইটা তো বাড়িতে আছে,এখানে নেই।সুতরাং আপনার ডাক্তারি এখানেই সমাপ্ত…”
আবরার ওর কথা শুনে হাসতে হাসতে ওর মাথার হালকা চুল টেনে দেয়।ইয়ারাবী ওর হাসির দিকে তাকিয়ে মুখভার করে বলে,
-“নিয়ে এসেছেন তাইতো…”
-“ইয়েস হানি…”
আবরার ব্যাগ থেকে সিরিন্জ আর মেডিসিন বের করে ওর পাশে বসে ওর দিকে তাকিয়ে দেখে, ইয়ারাবী মুখ-চোখ ভার করে বসে আছে।আবরার হেসে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে ওর বাম হাতটা ক্লিন করে পুশ করে দেয়।হাতে ব্যাথা লাগে কিন্তু ইয়ারাবী দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করে নেই।আবরার শুয়ে ওকে নিজের বুকে নিয়ে বলে,
-“তোমার আপু কী বলতে চাইছিলো তোমাকে?”
-“জানিনা,বলার আগেই আপনি চলে আসলেন।”
-“ওর থেকে দূরে দূরে থাকবা…”
-“আমি দূরেই থাকি,আপনাকে একটা কথা বলার ছিলো…”
-“বলো?”
-“কাল রাতে আমার হ্যালুসিনেশন হচ্ছিলো।”
-“কী?”
-“হ্যাঁ,আগেও হয়েছে তাই বিষয়টা বুঝি আমি।পরে স্টার আপুর সাথে অনেক কষ্টে ঘুমিয়েছিলাম।”
-“ঘুমিয়ে পরো,জাগলে আবার হবে।”
ইয়ারাবী ঘুমিয়ে পরতেই আবরার মনে মনে জারিকার বিষয়টা ভাবতে থাকে।আবরারের জারিকার উপর ওর কথা আর কাজে কেমন একটা সন্দেহ লাগছে।পরে বিষয়টা ভাব্বে তাই আর বেশি চিন্তা না করে দোয়া পরে ঘুমিয়ে যায়।
(১৩১)
-“ওই ভাইয়া ওঠো,আর কত ঘুমাবা।দেখো এবার কিন্তু পানি মারবো…”
ইমন বিরক্ত নিয়ে হালকা চোখ খুলে ওর দিকে তাকিয়ে আবার মুড়ি দিয়ে শুয়ে পরে।
-“তুমি কী উঠবা?ওঠোনা আর কত ঘুমাবে..”
-“দেখ ফড়িং ঘুমের বারোটা বাজাবিনা,আর এত সকালে তুই আমার রুমে কেন?”
-“এত সকাল কোথায়?আমি নামায পড়ে, কোরআন শরীফ তিলাওয়াত করে,খালামনির কবর জিয়ারত করে এসে দেখি তুমি আবার ঘুম।তোমাকে না বললাম,ঘুমাবেনা।”
ইমন ঘুমুঘুমু চোখে উঠে ঢলতে ঢলতে ওর দিকে তাকিয়ে বলে,
-“কী বল?”
-“ছানার সন্দেশ মিষ্টি খাবো…”
-“এনে দিবো,এবার যা।নয়তো তোর বর আবার খুঁজবে..”
কথাটা বলে ও আবার চাদর মুড়ি দিয়ে শুতে গেলে ইয়ারাবী টেনে ওকে বসিয়ে দিয়ে বলে,
-“আমার বর ভাইয়াদের সাথে রানে বের হয়েছে, আর আমি বাইরের মিষ্টি নয় বাসার বানানো খাবো।চলোনা দু’জন মিলে বানিয়ে ফেলি।মিষ্টির মধ্যে তো শুধু এই একটাই খায়…”
-“শখ কত?রান্নাঘরে ঢুকবে উনি,ফুপুকে বলবো বানিয়ে দিতে,এখন সর ঘুমাবো।”
-“না,তুমি বানিয়ে দিবে।চলো চলো নয়তো খালুকে বলে দিবো তোমার আর জারার বুঝতে পারছো?”
ইমন ওর দিকে একটা রাগী চেহারা বানিয়ে বলে,
-“তুই বস আমি ফ্রেস হয়ে আসি,খবরদার একা কিচেনে যাবিনা।”
ইমন ওয়াশরুমে যেতেই ইয়ারাবী বিরবির করে বলে,
-“আমি যতদিন আছি মন খারাপ হতে দিবোনা।আমি জানি,তুমি কবর জিয়ারত করে এসে ঘুমাচ্ছিলে না।খালামনির জন্য তো মন পুড়ছে,তবে আমি থাকাকালীন কাঁদতে দিবোনা।”
-“কী বিরবির করিস?”
-“কিছুনা,চলো যায়…”
-“নুসরাতকে ডাকি…”
ইয়ারাবী ভ্রু কুচকে বলে,
-“নুসরাত আপু জারিকার সাথে ঘুমিয়েছে।এখন আপুকে ডাকতে গেলে উনিও উঠবেন।আর সকালের মজাটা মাটি করে দিবে।”
-“আচ্ছা,চল…”
-“জানো তোমার বৌয়ের জন্য না টাকা খরচ করা লাগবেনা।”
-“কেন?”
-“কেননা তোমার বৌয়েরও শুধু ছানা মিষ্টি পছন্দ যা তুমি বাড়িতেই বানাতে পারো…”
ইমন ইয়ারাবীর কান টেনে বলে,
-“প্রচুর ফাজিল হয়ে যাচ্ছিস।আল্লাহ জানে ওই বাড়ির মানুষ তোকে সামলায় কী করে?”
-“আমি ভদ্র মেয়ে ভাইয়া।তবে তোমাকে জ্বালাতে আমার খুব মজা লাগে…”
-“একটা জিনিস কী জানিস?তুই আগের মতো হয়ে যাচ্ছিস,যাকে আমরা সবাই মিস করতাম..”
ইয়ারাবী হাসি থামিয়ে চুপ করে ওর ভাইয়ের সাথে কিচেনে যায়।প্রথমে ওরা ফ্রিজ থেকে দুধ ১ লিটার বের করে,বোয়েম থেকে চিনি আধা কাপের একটু কম,এলাচগুঁড়া ১ চিমটি বাটিতে রাখতে ইমন ওর দিকে তাকিয়ে হেসে বলে,
-“গাধী,এক চিমটি তাও আবার বাটিতে রাখছিস।”
ইয়ারাবী ভ্রু কুচকে বলে,
-“সবকিছু পরিমান মতো করতে হয়।”
-“ওহ্হ্,তাইতো আমি তো জানতাম না, যদি আপনি না বলতেন।”
-“ভাইয়া…”
-“স্যরি,লেবুর রস ১ টেবিল-চামচ, পেস্তাবাদাম সাজানোর জন্য বের করতো।”
-“করছি,তুমি চুলার কাজটা করে নাও।”
এর মধ্যে সাথি এসে বলে,
-“আপু,ছোট ভাইজান আপনারা কিচেনে কেন?যা লাগবে আমি করে দিবো,আপনারা যান।”
-“না সাথি তুমি বাকী কাজ করো,আমি আর ফড়িং সব সামলে নেব।”
-“কিন্তু আপুর তো আগুনে…”
-“আমি আছি তুমি যাও।”
ইয়ারাবী সাথির দিকে তাকিয়ে বলে,
-“আপু,মনির মাথা ব্যাথা করছে তাই মনিকে আজ রান্না করতে দিবেনা।তুমি এক কাজ করো,রাতের মাংসটা গরম করো,পরোটা,আলু-ভাজি,ফ্রিজে ইলিশ মাছ আছে ওইটা বের করে ভুনা করবে আর হাঁসের মাংস।”
-“আর আপনার জন্য?”
-“আমি এগুলো দিয়ে চালিয়ে নিবো।তুমি এখন এক গ্লাস নাসপাতির জুস বানাও চিনি বাদে,”
-“বুঝছি ভাইজানের জন্য তাই তো,আর খালুর রুমে কী চা দিবো এখন…”
-“হ্যাঁ,দিয়ে এসো।”
সাথি চলে যেতেই ইমন ওর মাথায় টুকা মেরে বলে,
-“পাক্কা গিন্নি হয়ে গেলি দেখি….”
-“তোমার কাজ করো।”
ইমন প্রথমে হাঁড়িতে দুধ নিয়ে জ্বাল দিতে থাকে।আর সেটা ফুটে উঠলে তাতে লেবুর রস দিয়ে আস্তে আস্তে নেড়ে ছানা ও পানি আলাদা হয়ে গেলে ছেঁকে নেয়।ছানা থেকে চেপে চেপে পানি বের করে নিয়ে, এরপর ছানা আধা-একঘণ্টা খোলা বাতাসে রেখে দেয়।ছানা হাত দিয়ে ভালো করে মথে সঙ্গে চিনি এবং এলাচগুঁড়া মিশিয়ে একটি ননস্টিক প্যানে জ্বাল দিয়ে ঘনঘন নাড়তে থাকে।ইয়ারাবী ওর পাশে দাঁড়িয়ে কাজগুলো দেখছে।চিনি গলে একটু আঠাআঠা হয়ে গেলে এতে ২/৩ টেবিল-চামচ কনডেন্সড মিল্ক এবং জাফরান রং দেয়। নামিয়ে দ্রুত ট্রেতে বিছিয়ে আধা,এক ইঞ্চি পুরু চারকোণা,গোলাকার করে ছড়িয়ে দেয়।তারপর উপরে পেস্তা বাদামকুচি ছড়িয়ে দিয়ে ইয়ারাবীর হাতে দেয়।ও একটু নিতে গেলে ইমন ওর হাতে একটা বারি মেরে কিছুক্ষণের জন্য ফ্রিজে রেখে দেয়।ইয়ারাবীকে নিতে না দেওয়ায় মুখ ফুলিয়ে বসে আছে।ইমন দেওয়ালে হেলান দিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে মুচকি মুচকি হাসছে।ও ইমনের দিকে খানিকটা রেগে তাকিয়ে বলে,
-“হাসবানা একদম,একটু নিলে কী হতো?”
-“কাঁচা ছিলো তাই…”
-“এখন বুঝি পাকা হয়ে যাবে?”
ইমন ওর কথা শুনে কিচেন থেকে বেরিয়ে যেতেই আবার পিছন ঘুরে বলে,
-“খবরদার,না হওয়া পর্যন্ত খাবিনা।”
ইয়ারাবী ওর দিকে তাকিয়ে একটা ভেংচি মারে।
(১৩২)
ইয়ারাবী সোফায় বসে আছে তখন একটা বল নিয়ে দৌঁড়ে নীরা ওর সামনে এসে বলে,
-“খালামনি,চলো আমরা ফুটবল খেলি…”
-“স্যরি আম্মু,কিন্তু খালামনি তোমার সাথে দৌঁড়ে খেলা করতে পারবেনা।”
-“কেন কেন?”
-“কারন খালামনি অসুস্থ…”
নিরা বলটা রেখে ইয়ারাবী হাত ডাক্তারদের মতো ধরে দেখে বলে,
-“কিন্তু ডাক্তাল নিরা তো কিছু বুঝছেনা…”
ইয়ারাবী ওর কথা শুনে হেসে দিয়ে ওকে কোলে তুলে নিয়ে বলে,
-“কেননা ডাক্তার নিরা এখন খুব ছোট,যখন বড় হয়ে যাবে তখন বুঝতে পারবে।”
-“তাহলে কার সাথে নিরা খেলবে?”
-“হুমম,তাও ঠিক কার সাথে নিরা খেলবে।একটা কাজ করো,তোমার নুসরাত খালামনি আছে তার সাথে যেয়ে খেলা করো।তোমার নুসরাত খালামনি অনেক ভালো খেলতে পারে…”
নিরা বল দিয়ে দৌঁড়ে নুসরাতের কাছে চলে যায়।ইরাক বাইরে থেকে এসে ওর মাথায় একটা চুমু দিয়ে বলে,
-“গুড মর্নিং পিচ্চি…”
-“গুড মর্নিং…”
আবরার সোফায় বসে ওর দিকে তাকিয়ে বলে,
-“উঠলে কখন?”
-“ঘুমায়নি আর,”
-“ওহ্”
-“তোমরা ফ্রেস হয়ে আসো,জুস কফি দিবো নাকী সোজা নাস্তায় যাবে…”
ইফাজ ওর দিকে তাকিয়ে বলে,
-“কফি লাগবেনা,তুই আবরারকে জুস দে।আমরা ফ্রেস হয়ে আসছি।”
-“হামম হামম,তোমরা যাও..”
সাথি এসে আবরারকে জুস দিলে ও তিন নিঃশ্বাসে জুসটা শেষ করে ইয়ারাবীর দিকে তাকিয়ে বলে,
-“একটু রুমে আসো, কথা আছে..”
-“চলুন”
ওরা রুমে যেতেই ইয়ারাবী কার্বাড থেকে আবরারের ড্রেসটা বের করে দেয়।
-“আপনি কী আজ হাসপাতালে যাবেন?”
-“না,আজ এখানে থাকবো।”
-“ওহ্হ্,”
-“ইয়ারাবী?”
-“জ্বি বলুন?”
-“তুমি কী একদম নিশ্চিত ওই সেই লোক যে তোমার আপুকে মেরে ছিলো?”
ইয়ারাবী অবাক হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে বলে,
-“আপনি এমন কথা কেন বলছেন?”
-“কথায় আছে,কোঁচো খুঁড়তে সাপ বেরিয়ে যায়।ধরো এমন কিছু হলো যা তোমার পরিবারের বিরুদ্ধে সাক্ষী দিতে হবে তখন কী পারবে?”
-“আপনি কী বলছেন আমি সত্যি কিছু বুঝছিনা।আমার এখনো স্পষ্ট মনে আছে,ওই লোকটার হাতে চাকু ছিলো যা দিয়ে আমার সামনে আপুকে মেরেছিলো।আপনি স্বপ্নেও জিনিসটা ভুলতে পারিনা,সবাইকে বললে ওনারা বলতেন আমি নাটক সাজিয়েছি।ওনাদের ধারনা আপি আপুকে দেখতে পারতাম না,যদি আজ খালামনি-খালু, ফুপা না থাকতো তবে আমাকে সেই অন্ধকার সেলে কাঁটাতে হতো।কিন্তু আপনি এসব কেন বলছেন?”
-“এমনি,কেননা তুমি বাইরে থেকে শক্ত দেখালে ভিতর থেকে অনেক উইক।কিছু কথা আছে যা তুমি জানোনা,তবে সেটা বাসায় যেয়ে বলি।আর শোনো এসব ভেবে মাথায় চাপ দিবেনা।”
-“কেননা আমি একজন রোগী সেটা খুব ভালো করো জানি।”
-“ফালতু কথা একদম বলবেনা।”
আবরার ওর হাত থেকে ড্রেসটা নিয়ে ওয়াশরুমে চলে যায় তবে ইয়ারাবীর মনে রেখে যায় অনেক প্রশ্ন।ও কোনোকিছু মিলাতে পারছেনা,আবরারের কথাগুলো ওর মাথার মধ্যে বেজে চলেছে।তবে ওর এখন আবরারকে প্রশ্ন করলে কোনো লাভ হবেনা।কেননা আবরার ওকে বাসাই যেয়ে সব প্রশ্নের উত্তর দিতে চেয়েছে।ইয়ারাবী মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলার চেষ্টা করে করে।কেননা ও কাল এমন মানুষদের সাথে কথাটা বলেছে যারা এর মোড় পর্যন্ত পৌঁছিয়ে ছাড়বে।ও সবটা ভেবে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে নিচে চলে যায়।
#চলবে_____