#জীবন মানে তুমি
#লেখিকা:H.B.Rini (Irini Ori)
#পর্ব:৩৭
(১২৭)
হঠাৎ কোনো লোকের পায়ে পারা লেগে যাওয়ায় ওনাকে স্যরি বলে চলে আসতে যেয়ে আবার কী মনে করে ওনার মুখের দিকে তাকায়।আর যা দেখে,সেটাই ইয়ারাবীর শরীর কেঁপে উঠে। কোনোদিন ভাবতেও পারেনি এটা হবে।কেননা এই চেহারার মানুষকে ভুলা কখনো সম্ভব না,এই চেহারার মানুষটা ওর জীবনে এক অভিসাপের মতো হয়ে আছে।
ইয়ারাবী সামনে তাকিয়ে দেখে একজন চল্লিশ-পয়তাল্লিশ বছরের আধা কাঁচা-পাঁকা চুলের ব্যাক্তি পরনে সাদা শার্ট,কালো প্যান্ট,উপরে কালো কোর্ট,পায়ে কালো জুতা পরে দাঁড়িয়ে আছে।লোকটা ওকে তাকিয়ে থাকতে দেখে বলে,
-“কিছু বলবে তুমি?এভাবে তাকিয়ে আছো কেন?”
ইয়ারাবী কী বলবে বুঝতে পারছেনা?মুখের ভাষা হারিয়ে ফেলেছে।তবুও নিজেকে সংযত রেখে কিছু বলতে যাবে ঠিক তখনি মি.ফুয়াদ এসে লোকটার কাঁধে হাত রেখে বলে,
-“কীরে এখানে কী করিস?আর তোকে আরেকটু আগে আসতে বলেছিলাম না?”
-“আসলে নামায পড়তে যেয়ে দেরি হয়ে গেছে,যতই গুরুত্বপূর্ণ হোক না কেন নামায কাজা দেওয়া যাবেনা।আমরা তো আল্লাহর গোলাম,তার ইবাদতের জন্যই পৃথিবীতে এসেছি।”
-“তা একদম ঠিক বলেছিস…”
লোকটা ইয়ারাবী দিকে তাকিয়ে মি.ফুয়াদকে জিজ্ঞেস করেন,
-“এই বাচ্চা মেয়েটা কে রে?”
-“ও,এই মেয়ে…ইস্মা,আমার মেয়ে।”
মি.ফুয়াদ ইয়ারাবীর দিকে তাকিয়ে বলে,
-“ইস্মা,আমার বন্ধু মুনির হোসেন।আঙ্কেলকে সালাম দাও…”
ইয়ারাবী কিছু না বলে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে,এতে ওর বাবা কিছুটা বিরক্তবোধ করে।তবে লোকজনের মধ্যে তাই কিছুটা মৃদ্যু হাসি দিয়ে বলে,
-“স্যার তো দেশের বাইরে গেছে,তোমার শ্বাশুড়িরা কখন আসবে?চলে তো আসার কথা তাদের…”
-“আসার সময় হলে চলে আসবে।”
মুনির হোসেন বন্ধুর দিকে তাকিয়ে বলে,
-“তোর মেয়ের বয়স কত?এতটুকু বাচ্চাকে বিয়ে দিয়ে দিয়েছিস?তোরা তো ব্যাকডেটেড না তাহলে..”
-“এইতো আঠারো হবে,চারমাস হলো বিয়ে হয়েছে, আসলে আমার বস খুব ধরলো নিজের ছেলের জন্য।মেয়েও কোনো আপত্তি করেনি,তাছাড়া বিয়ের পরে পড়াশোনা করছে।ধরতে গেলে ওটা শ্বশুড়বাড়ি বলে ওর মনে হয়না।”
-“তাই বলে এতটুকু বাচ্চাকে বিয়ে দিলি?তোমার হাসবেন্ড কী করে?”
ইয়ারাবী নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে বলে,
-“ড্..ডাক্তার।”
-“ওহ্হ্,আলহামদুলিল্লাহ্,খবু ভালো।নাম কী তোমার হাসবেন্ডের আর কীসের ডাক্তার?”
-“আবররার চৌধুরী ফুয়াদ,পেশার একজন সাইক্রেটিস আর নিজস্ব একটা ল্যাব আছে।”
-“ও তার মানে সাইন্টিস্ট,তা এসেছে এখানে?আমি নামটা খুব শুনেছি কিন্তু দেখা হয়ে উঠেনি…”
-“এখনো আসেনি,একটু কাজে আটকে গেছে চলে আসবে কিছুক্ষণের মধ্যে…”
মি.ফুয়াদ বন্ধুর কাঁধে হাত দিয়ে বলেন,
-“তোর কথা শেষ হলে চল ওই দিকে যায়,”
-“হ্যাঁ,চল।পরে কথা হবে ইস্মা…”
মুনির হোসেন কথা বলে ওর বাবার সাথে অন্যদিকে চলে যেতেই ইয়ারাবী একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস নেই।তবে ওর মাথা ঘুরে উঠছে,এত বছর পরে যে সেই ব্যক্তিকে দেখতে পাবে সেটা ও কল্পনাতেও ভাবেনি।হঠাৎ ওর কাঁধে কারো হাত পরতেই ও কিছুটা চমকে উঠে,পিছন ঘুরে দেখে আবরার দাঁড়িয়ে আছে।ব্লু কালারের টি-শার্ট তার উপর কালো কোটি,কালো জিন্সের প্যান্ট,ডান হাতে কোট,পায়ে কালো জুতা,সিল্কি চুলগুলো অনেক সুন্দর লাগছে,মুখে চাপ দাঁড়ি আর সবুজ চোখ সব মিলিয়ে কোনো ছেলে এত সুন্দর হতে পারে জানা ছিলোনা ওর।আবরার ডান হাতে কোটটা ধরে বাম হাতটা পকেটে ঢুকিয়ে ওর দিকে হালকা ঝুঁকে মৃদ্যু হেসে ফিসফিস করে বলে,
-“আমি বরটা তোমারই,আমাকে দেখার অফুরন্ত সময় পাবে।বললে এখনি তোমার সামনে বসে থাকবো।”
ইয়ারাবী তাড়াতাড়ি চোখ নামিয়ে নেয়।আবরার ওর কাঁধে হাত রেখে বলে,
-“ভয় পেয়ে আছো কেন?”
-“ম্ মানে?আমি কেন ভয় পাবো?”
-“আমাকে মিথ্যা বলোনা।জানো সাইক্রেটিস হওয়ার একটা সুবিধা আছে,ওরা সহজে মিথ্যা ধরে ফেলতে পারে।”
-“ক্ কিছুনা…”
আবরার চারপাশে চোখ বুলিয়ে বলে,
-“এখানে নিশ্চয়ই এমন কিছু দেখেছো যার জন্য ভয় পাচ্ছো।বলো কী হয়েছে?”
-“পরে বলি,আমি য়ুহার আপুর সাথে দেখা করে আসি।আপনি রুমে যেয়ে বসুন আমি সাথি আপুকে নাস্তা দিতে বলছি…”
-“ব্যস্ত হতে হবেনা,তুমি খেয়েছো?”
-“হ্যাঁ,আপনি বসুন।আচ্ছা আম্মুরা আসবেনা?”
-“আসবে,উনারা বের হয়েছে।ফোন কী হয়েছিল তোমার?রাত থেকে একভাবে কল করছি ধরার নাম নেই,জানো কত টেনশনে ছিলাম?ল্যাবে কাজ করার সময় এমনি মাথা ঠিক থাকেনা তার উপর তোমার চিন্তা….”
-“স্যরি,এমন আর হবেনা।রাতে মেডিসিন নিয়ে ঘুমায় তাই টের পায়নি,চাপ লেগে ফোন সাইলেন্ট হয়ে গেছিলো।এবার থেকে খেয়াল রাখবো…”
-“তোমার ভাইয়াও তাই বলেছিলো….”
ইয়ারাবী এদিক-ওদিক তাকিয়ে দেখে সাথি ডাইনিং এ কাজ করছে।ইয়ারাবী আবরারের হাত থেকে কোটটা নিয়ে সাথিকে উদ্দেশ্য করে বলে,
-“সাথি আপু,এনার জন্য কিছু নাস্তা পাঠাও তো।”
-“আপু আমি এখনি দিচ্ছি…”
-“আবরার আপনি এখানে বসবেন নাকী রুমে যাবেন?”
-“এখানেই থাকি,তোমার আব্বু-আম্মু এসেছে?”
-“জ্বি এসেছে…”
ইয়ারাবী আবরারকে একটু বসতে বলে য়ুহারকে খুঁজার জন্য উপরে যাবে ঠিক তখনি ওর খালু মি.রহমান ওকে ডাক দেয়।ও পিছনে তাকিয়ে দেখে মি.রহমান ওর তিন-চার জন বন্ধুর সাথে দাঁড়িয়ে আছে।ইয়ারাবী সিঁড়ি থেকে নেমে ওর খালুর দিকে এগিয়ে যায়।মি.রহমান ইয়ারাবীর মাথায় হাত রেখে বলে,
-“তোমাদের বলতাম না আমার একটা মেয়ে আছে এটাই সেই মেয়ে ইয়ারাবী।শুধু মেয়ে নয় আমার আরেক মা।”
ইয়ারাবীর মি.রহমানের সাথে কিছুক্ষণ কথা বলে এসে রুমে যেয়ে মুখে পানি নেই।তারপর অনেকক্ষণ য়ুহারকে খুঁজেও না পাওয়ার পর ফোন করে জানতে পারে একটা আর্জেন্ট কেসের জন্য বের হতে হয়েছে।তাই ইয়ারাবীও ফোনে আর কিছু বলেনা,চুপচাপ বেডের এককোনে বসে থাকে।ইমন ফোনে কথা বলতে বলতে ওর রুমে ঢুকে বলে,
-“তুই এখানে,আর আমি সারা বাড়ি খুঁজে মরছি।”
-“কিছু বলবে ভাইয়া?”
-“ভা মানে আবরারকে নিচে বসিয়ে রেখে এখানে কী করছিস?আর কাঁদছিলি কেন?”
-“কই কাঁদছিলাম না তো,এমনি খালামনির কথা মনে পরেছিলো তাই….”
-“মায়ের কথা মনে পরলে তুই এভাবে কাঁদিস?”
-“আমি কী এখন কাঁদতেও পারবোনা?”
-“তুই দুপুর অব্দি একদম ঠিক ছিলি,হঠাৎ কী হলো তোর?”
-“ভাইয়া,আমি না…থাক বাদ দাও।য়ুহার আপু আসলে বলবো।”
-“কেন আমি কী দোষ করলাম?কী হয়েছে বলতো?”
ইয়ারাবী চোখে-মুখে ভয় স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে,ও বারবার দরজার দিকে তাকাচ্ছে।ইমন ওর কাঁধে হাত রেখে বলে,
-“কী হয়েছে খুলে বলতো?”
-“ভ্ ভাইয়া আমি না ওই লোকটাকে দেখেছি…”
-“কাকে দেখেছিস?”
-“ওই লোকটা,ওই যে আপুকে মেরেছিলো…”
কথাটা বলেই ইয়ারাবী কেঁদে দেয়।ইমনের মনে হচ্ছে ও এক ঘোরের মধ্যে চলে গেছে।আজকের দিনে এমন কিছু শুনবে বলে আশা করেনি।তাও আবার এই বাড়িতে কীভাবে সম্ভব?খুনি এই বাড়িতে কেন আসতে যাবে?ইমন ওর দিকে তাকিয়ে দেখে মেয়েটা প্রচুর কাঁদছে।ইমন ওর সামনে বসে বলে,
-“কান্না থামা,তুই তো এমন স্বভাবের ছিলিনা।আগে বল কোথায় দেখেছিস?”
ইয়ারাবী চোখ মুছে বলে,
-“এখানে দেখেছি…”
-“তুই নিশ্চিত যে ওই সেই লোক?”
-“আমি ওই চেহারা কখনো ভুলতে পারবোনা।”
-“খালা-খালুকে জানিয়েছিস?”
-“পাগল তুমি?এমন কথা বললে আমাকে মেরে ফেলবে,কেননা লোকটা মি.ফুয়াদের বন্ধু।আর তুমি জানো ওরা কখনো আমাকে বিশ্বাস করেনা।”
-“আচ্ছা,তুই কাঁদিস না।আমি দেখছি,এখন নিচে চল…”
ইয়ারাবী মুখে পানি দিয়ে স্বাভাবিকভাবে নিচে যায়।ওর শ্বাশুড়ি,ইকরা-আবীর,মেঘ আর জারবা এসেছে।ইকরার ছয় সপ্তাহ চলছে তারপরও আবীরের অনেক কেয়ার।ইয়ারাবী ওর শ্বাশুড়ির সাথে বলছে আর আবরার পাশে বসে ফোন টিপছে।ইয়ারাবী ইকরার দিকে তাকিয়ে বলে,
-“আপু তোমার সমস্যা হলে আমার রুমে চলো,”
-“লাগবেনা আমি ঠিক আছি,তুমি তো জানো তোমার ভাইয়া বরাবরই পাগল।”
জারবাএই কথা শুনে বলে,
-“বড় ভাবী শুধু বড় ভাইয়ার কেন পাগল হতে যাবে।বলো আমাদের বাড়ির সব ছেলেগুলো বৌ পাগলা।”
মেঘ জারবার মাথায় একটা চাটি মেরে বলে,
-“তুই যে এত দ্রুত পাগল হয়ে যাবে তা ভাবতেই খারাপ লাগছে,তুই নিশ্চয়ই ভুলে গেছিস এখনো আমার বিয়ে হয়নি।তাই ওই বাড়ির সব ছেলে পাগল না।”
-“তুমি তো গার্লফ্রেন্ড পাগল,রাত ভরে যে গল্প করো সেটা আমি জানিনা।আমি সব শুনে।”
-“দেখ রাজহাঁসের মতো প্যাক প্যাক করবিনা।আমি গুড পোলা,ওসবের ভিতর আমি নাই।তুই শুধু আমাকে ফাঁদে ফেলানোর ধান্দায় থাকিস।”
মিসেস রায়হান দুই ছেলে মেয়ের উদ্দেশ্যে বলে,
-“তোরা থামবি,দু’জন এক জায়গায় হলে শুরু হয়ে যায়।চুপচাপ বসে থাকবি….”
-“ছোট ভাবী আমি তোমার ঘরে যাবো…”
ইয়ারাবী হেসে বলে,
-“যাও,আর মেঘ তুইও যা।আসরের পরে দোয়ার করার কথা ছিলো কিন্তু সেটা মাগরিবের পরে হবে।আসলে ইমাম সাহেবের আসতে দেরি হবে…”
-“কোনো ব্যাপার না,বড় ভাবী তুমিও চলো।ফ্রেস হয়ে নিবে…”
মিসেস রায়হান ইয়ারাবী দিকে তাকিয়ে বলে,
-“আমি তোমার মায়ের সাথে দেখা করে আসি,কোথায় উনি?”
-“নিচের বামপাশের রুমে আছে,আসলে নানু এসেছে তো তাই ওনার সাথে কথা বলছে আপনি যান।”
সোফায় শুধু ইয়ারাবী আর আবরার বসে আছে।আশে পাশে অনেকে আছে তবে নিজেদের কাজে ব্যস্ত।ভিতরের রুম থেকে কিছুটা আওয়াজ আসছে, বুঝা যাচ্ছে ওর খালা-মামারা থেমে থেমে কান্না করছে।আবরার জুসের গ্লাসে চুমুক দিয়ে বলে,
-“তোমাকে আপসেট লাগছে,অন্য কোনো ব্যাপার আছে নিশ্চয়ই …”
-“তেমন কিছুনা,খালামনির শূন্যতা অনুভব করছি।”
-“ওনার জন্য সব সময় দোয়া করবর,উনি যেন বেহেশতে নসীব হন।”
-“করছি সব সময়।আচ্ছা,কাল পুরো রাত কী ল্যাবে ছিলেন?বাসায় যাননি?”
আবরার মাথাটা হালকা হেলিয়ে বলে,
-“না,এখান থেকে সোজা ল্যাবে তারপর হাসপাতালে,আর ওখান থেকে সোজা তোমার কাছে।”
-“খেয়েছিলেন কিছু?”
-“হামম,তুমি তো জানো আমি টাইম টু টাইম সব করি।আজ তোমাকে অনেক সুন্দর লাগছে এই পোশাকে।কবে কিনলে গাউনটা?”
-“এটা আমি কিনিনি,বড় ভাইয়া এনে দিয়েছে।এমনিতেও এই বাসায় আমার জামা থেকে শুরু করে মাথার ক্লীপ পর্যন্ত সব থাকে।”
-“বরাবরই কালোতে তোমার মানায়,হবে হেজাব পরেছে এটাই ভালো লাগছে।কেননা আমি চাইনা আমার বৌয়ের সৌন্দর্য আমি ব্যাতিত অন্য কেউ দেখুন।”
ইয়ারাবীর হাজার কষ্টের মধ্যেও ওর কথা শুনে হাসি পায়।তবে হাসেনা,চুপ করে বসে আছে।ও কুৎসিত হলেও লোকটার চোখে সব সময় সুন্দর দেখায়।আবরার ওর দিকে তাকিয়ে বলে,
-“ভার্সিটি খুললে পনের দিনের ছুটি নিয়ো..”
-“কেন?”
-“লন্ডন যেতে হবে তাই…”
-“কিন্তু হঠাৎ লন্ডন কেন?”
-“দেখো তোমার ফ্রেস হাওয়ার দরকার তাছাড়া আমার কাজ আছে,আমি তোমাকে রেখে যেতে চাইছিনা।”
-“আমি ছোট বাচ্চা নই আবরার,”
-“এসব পরে দেখা যাবে।”
ওরা কথা বলছে এমন সময় পঞ্চাশ ছুঁই ছুঁই কাঁচা-পাঁকা চুলগুলো খোপা করা,পরনে হালকা সবুজ রঙের তাতের শাড়ি মুখে পান চিবাতে চিবাতে একটা মহিলা ইয়ারাবীর সামনে এসে বসে বলে,
-“যার জন্য দোয়া করা হবে সে তোমার কে হয়?”
-“জ্বি,খালামনি”
-“আপন?”
-“হ্যাঁ,আপন খালামনি.”
-“ও,ছেলেগুলো এতিম হয়ে গেলো।আসলে যার মা নেই তার পুরো দুনিয়া অন্ধকার।আমার নাম সোহাগী বানু,তোমার নিন্দু মামীর বড় ভাবী।মামীই তো হবে তোমার?”
-“ওহ্হ্,তার মানে আপনিও মামী?”
-“হ্যাঁ,তা তোমার নাম কী?”
-“ইয়ারাবী”
-“এখন কী করো?”
-“পড়াশোনা করি…”
-“কী পড়ো?”
-“আইন নিয়ে পড়ি…”
-“ওহ্হ্,তা বাড়ির কাজকর্ম কিছু পারো?”
ইয়ারাবীর খুব রাগ উঠে সোহাগী বানুর উপর।একের পর এক প্রশ্ন করেই যাচ্ছে।ও মানুষের মধ্যে কোনো খারাপ আচারন করতে চাইনা।তাছাড়া পাশে ওর স্বামী বসে আছে এই জন্য ভদ্র মেয়ের মতো কথা বলছে।সোহাগী বানু আবার বলে,
-“ও মেয়ে চুপ করে আছো কেন,বলো বাড়ির কাজকর্ম মানে রান্না-বান্না পারো?”
-“না মামী,এসব পারিনা….”
-“ওহ্ ব্যাপার না,বয়স কত তোমার?”
-“উনিশে পড়বে কিছু মাস পরে।”
-“চশমা পরো কেন?চোখে সমস্যা নাকী?”
-“জ্বি…”
সোহাগী বানু আর কিছু বলতে যাবে তার আগে মিসেস রায়হান এসে ইয়ারাবীর কাধে হাত রেখে বলে,
-“আম্মু আমাকে মিষ্টি কিছু দিতে পারবে,মনে হচ্ছে সুগার লো করেছে।”
-“আপনি বসুন আমি এখনি নিয়ে আসছি।”
মিসেস রায়হানকে সোফায় বসিয়ে ইয়ারাবী উঠতে যাবে তখন সোহাগী বানু বলে,
-“ইনি তোমার কে হয়?”
-“আম্মু,আপনারা কথা বলুন আমি আসছি।”
ইয়ারাবী কিচেনে চলে যায় মিষ্টি জাতীয় খাবার আনতে।সোহাগী বানু মিসেস রায়হানের দিকে তাকিয়ে বলে,
-“আপনার মেয়ে শ্যামলা হলেও দেখতে শুনতে মাশাল্লাহ্।”
-“ও একজন চমৎকার মেয়ে আমি ওর মা হতে পেরে নিজেকে সৌভাগ্যবতী মনে করি।”
-“আপা একটা কথা বলতাম আপনি যদি কিছু মনে না করেন?”
মিসেস রায়হান সম্ভবত বুঝতে পেরেছেন সোহাগী বানু কী বলবেন? তাই উনি আবরারের দিকে তাকিয়ে একটু মুচকি হাসি দেন।আবরার হাসিটা দেখে খানিকটা ভ্রু কুচকে ওর মায়ের দিকে তাকায়।তারপর মিসেস রায়হান সোহাগী বানুকে উদ্দেশ্য করে বলে,
-“তো আপা কী বলবেন বলুন?”
-“আসলে বলছিলাম কী?আমার ভাইয়ের একটা ছেলে আছে,দেখতে শুনতে মাশাল্লাহ্।দু’মাস হলো একটা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে জয়েন করেছে।বয়সটা একটু বেশি,তবে সোনার আংটি বাঁকা হলেও ভালো।”
-“তো আমি কী করতে পারি?”
-“আসলে আমরা ওর বিয়ের জন্য একটা মেয়ে খুঁজছিলাম।”
এর মধ্যে ইয়ারাবী পিরিচে করে কিছু মিষ্টি এনে মিসেস রায়হানের হাতে দেয়।মিসেস রায়হান মিষ্টি মুখে দিয়ে ওকে ইশারা করে পাশে বসতে।সোহাগী বানু ইয়ারাবীর দিকে একবার তাকিয়ে বলে,
-“আসলে আমরা বলতে গেলে কম বয়সি ছোট মেয়ে খুঁজছি,এরা আবার গুরুজনদের খুব সম্মান করে।আর বিয়ের পরে গ্রামে থাকতে হবে,যদি ছেলে চাই তবে পড়ালেখা করতে পারে।”
-“তো?”
-“আসলে আপনার মেয়েটাকে আমার খুব মনে ধরেছে।”
ইয়ারাবীতো অবাক চোখে সোহাগী বানুর দিকে তাকায়।কেননা ওর মতে জারবাকে ওর রুমে দিয়ে এসেছে তাহলে সোহাগী বানু তাকে দেখলো কীভাবে?আর আবরার কেমন রিয়্যাক্ট করবে কথাটা শুনে।ও আরবারের দিকে তাকিয়ে দেখে ওর সবুজ চোখগুলো ও ভয়ানক লাগছে,হাতের শিরাগুলো ফুলে উঠেছে,নিচের ঠোঁট কামড়ে রাগকে কন্ট্রোল করার চেষ্টা করছে।ইয়ারাবী আবরারের দিকে তাকিয়ে ভয়ে একটা ঢোক গিলে সোহাগী বানুকে বলে,
-“আপনি জারবাকে কখন দেখলেন?আর আপনার এমন কেন মনে হলো আমরা অতোটুকু মেয়েকে বিয়ে দিবো?তাও আবার এমন বলছেন বিয়ের পর গ্রামে থাকবে,পড়াবেন না।”
সোহাগী বানু খানিকটা অবাক হয়ে বলে,
-“জারবা কে?আমি তো তাকে চিনিও না,আমিতো তোমারা মায়ের সাথে তোমার বিয়ের কথা বলছিলাম।”
-“আমার মায়ের সাথে মানে….”
ইয়ারাবী মিসেস রায়হানের দিকে তাকিয়ে দেখেন উনি মুচকি মুচকি হাসছেন।এবার ও বুঝতে পারে যে আবরার এমন রিয়্যাক্ট কেন করছে?আসলে কোনো স্বামীর সামনে যদি তার স্ত্রীর বিয়ের কথা বলে তাহলে সেই স্বামীর রাগ উঠা খুব স্বাভাবিক।ইয়ারাবী উনার দিকে তাকিয়ে বলে,
-“দেখুন আপনার কোথাও ভুল হচ্ছে?”
-“কেন,ভুল হবে কেন?”
-“কারন বিয়ে করা আমার পক্ষে সম্ভাব না।”
-“কেন সম্ভাব না,মেয়েদের এমন বয়সে বিয়ে করতে হয়।”
-“কারণ আমি বিবাহিতা,”
সোহাগী বানু খানিকটা জোড়ে বলে উঠে,
-“কী তোমার বিয়ে হয়ে গেছে?তুমি যে বললে তুমি পড়ালেখা করো,কাজকর্ম পারোনা আর নাকে নোজপিনও তো দেখছিনা।আর এসব কিছুতো অবিবাহিত মেয়েদের লক্ষন,তার মানে তুমি মিথ্যা বলেছো।”
-“আমি তো মিথ্যা কিছু বলিনি মামী,যা সত্যি আমি তাই বলেছি।আর নোজপিন আমার পরার ইচ্ছা নেই তাই পরিনি,তাছাড়া আমার স্বামীরও পছন্দ না।”
-“তোমার মা যে কিছু বললোনা।”
-“বলবে কী?আপনি কী তাকে কিছু বলতে দিয়েছেন,আর তাছাড়া ইনি আমার শ্বাশুড়ি আর এই যে ইনি হলো আমার হাসবেন্ড..”
সোহাগী বানু অবাক চোখে তাকিয়ে বলে,
-“তুমি সত্য বলছো,এই ছেলেটা তোমার স্বামী আর এই আপা তোমার শ্বাশুড়ি।তবে এনাকে আম্মু কেন বললে,আর ইনিও তো তোমাকে মেয়ে বললো?”
-“কারন উনি আমাকে নিজের মেয়ে মনে করেন আর আমি মা,বুঝেছেন এইবার….”
সোহাগী বানু কোনো কথা না বলে ওখান থেকে উঠে চলে যান।মিসেস রায়হান আবরারের দিকে তাকিয়ে হেসে দেয়।আবরার উনার দিকে তাকিয়ে বলে,
-“মম্,উনি তোমার সামনে এমন একটা কথা বললো আর তুমি।ইয়ারাবী তোমাকে তো আমি রাতে দেখছি।”
আবরার চলে যেতেই ইয়ারাবী ভয়ে ওর শ্বাশুড়ির দিকে তাকিয়ে বলে,
-“আম্মু,উনি তো খুব রেগে গেলেন।কিন্তু আমার কী দোষ?আমি যদি ওই মহিলার সাথে রাগারাগি করতাম তো সেটা খারাপ দেখাতো,তাই ঠান্ডা মাথায় ব্যাপারটা সামলেছি।”
-“আরে পাগলের কথা বাদ দে তো,কিছু বলবেনা তোকে।শুধু শুধু ভয় দেখিয়েছে…”
-“আম্মু আপনি জানেন না উনি বকা দেয়..”
-“কিছু বললে আমাকে বলবি,আর শোন বেশি মানুষের ভিতর যাওয়ার দরকার নেই।নইতো আমার মেয়েকে আবার কেউ ভাগ নিতে আসবে।”
-“আপনি পারেনও বটে,আপনি গেস্টরুমে যেয়ে একটু রেস্ট নিন।আমি যেয়ে দেখি…”
(১২৮)
মাগরিবের নামাযের পর মিসেস রহমানের জন্য দোয়া করা হয়।ইরাকদের বুক ফেঁটে গেলেও চুপ করে আছে।ইয়ারাবী চুপচাপ এক কর্ণারে বসে আছে,মি.রহমান নিজের কষ্ট কাউকে দেখাতে চান না বলে সবার খাওয়া-দাওয়ার ব্যাবস্থা করতে ব্যস্ত হয়ে পরেন।তবে আবরার এসবের ভিতর একটা জিনিস খেয়াল করছে সেটা হলো মুনির হোসেন যখন ইয়ারাবীর আশেপাশে আসছে তখন ও নিজেকে গুটিয়ে নিচ্ছে।আবরার ইরাককে ব্যাপারটা জানায়।দোয়া মহফিল শেষে সবার খাবারের ব্যবস্থা করা হয়।সবার খাওয়া হয়ে গেলে মিসেস রায়হান ইয়ারাবীর সামনে এসে বলে,
-“মা তুই কী আজ আমাদের সাথে যাবি নাকী আরো কিছুদিন থাকবি?”
-“আম্মু আর কয়েকটা দিন,খালু আর বড় ভাইয়া চলে গেলে আমি বাসায় আসবো।”
-“জোড় নেই তোর উপর,তাছাড়া তুই এখানে তার মানে বাদরটাও এখানে থাকবে।তবে সাবধানে থাকবি আর কান্নাকাটি একদম করবিনা।”
-“করবোনা আম্মু,কাঁদলে খালামনি কষ্ট পাবে।”
-“এইতো ভালো মেয়ের মতো কথা,তাহলে আজ আসি।”
মিসেস রায়হান ওর খালু আর বাবা-মায়ের সাথে দেখা করে চলে যান।একটু পর আস্তে আস্তে সবাই চলে যায়।প্রতিবারের মতো ইয়ারাবীর বাবা-মা ওর সাথে কথা না বলে চলে যায়।তবে সবাইকে অবাক করে দিয়ে জারিকা এখানে থেকে যায়।ইয়ারাবী য়ুহারকে কথাটা বলে উঠার সময় পাচ্ছেনা।য়ুহার দোয়ার পর পরই বেড়িয়ে গেছে আর বলেছে ফোনে সব কিছু জানাতে।কিন্তু এসব বিষয় যে ফোনে বলা যায়না।
রাতে মিসেস দোলন ওনার মেয়ের সাথে এই বাসায় আছেন।মহিলাটা ইয়ারাবীকেও প্রচন্ড ভালোবাসেন ঠিক যেমন ইরাকদের ভালোবাসেন।কেননা উনার চোখে এটাও মিসেস রহমানের মেয়ে।আর ইয়ারাবীও ওনাকে ফুপু নয় বরং মনি বলে ডাকে।রাতের দিকেন ইয়ারাবী আস্তে আস্তে নিচে নেমে দেখে মিসেস দোলন সাথীর সাথে রাতের রান্নার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে।উনি ইয়ারাবীর দিকে তাকিয়ে বলে,
-“কিছু বলবি মা?”
-“না মনি,আসলে কফি নিতে এসেছিলাম।”
-“তুই একটু বোস আমি করে দিচ্ছি,”
-“আচ্ছা,নুসরাত আপু কোথায়?”
-“ওই যে তোর এতটা বোন আছেনা জারিকা ওর রুমে।তুই তো জানিস ওর বাচ্চাদের কতো ভালোবাসে তাই নিরার সাথে খেলছে।”
ইয়ারাবী গলার স্কার্ফটা ঠিক করে নিয়ে বললো,
-“মনি,রাতে একটু কষ্ট করে কষানো গরুর মাংস করবে।”
-“তোর তো গরু খাওয়া বারন..”
-“আমার জন্য না খালুর জন্য,গরম সাদা ভাত আর কষানো গরুর মাংস খালু খুব ভালোবাসে রাতে খেতে।”
-“তোর তো সব দিকে খেয়াল আছে,সত্যিই ভাইয়া তোকে মা ডেকে ভুল করেনা..”
-“একজন মা তার সন্তানের জন্য সব খেয়াল রাখতে পারে।”
-“এখন বল জামাই কী খাবে?”
-“তুমি চিন্তা করোনা,উনার জন্য আলাদা কোনো জামাই আদর করতে হবেনা।তোমার এই জামাই সব জামাই থেকে আলাদা।শুধু আমার জন্য কোনো কিছু ভাজি করে দিলে হবে।”
-“তোর কী এখনো ঠিক হয়নি…”
-“ট্রিটমেন্ট করছিতো,জানিনা ঠিক হবে কীনা?”
-“আরে এমন সমস্যা অনেকের আছে,মন খারাপ করিস না।”
মিসেস দোলন কথা বলতে বলতে ওর হাতে পাঁচ কাপ কফি আর এক কাপ চা ধরিয়ে দিলে,ও ট্রেটা নিয়ে প্রথমে ওর খালুর রুমের দিকে যায়।দরজায় নক করে ভিতরে ঢুকে দেখে মি.রহমান ওনার স্ত্রীর ছবির সামনে দাঁড়িয়ে আছেন।
-“খালু আসবো?”
মি.রহমান চোখটা মুছে ওর দিকে তাকিয়ে বলেন,
-“আয় মা,ঘরে ঢুকতে পারমিশন কেন নিস?এই বাড়িটা তোরই তো,আলাদা কেন ভাবিস বলতো?”
-“তেমন কিছুনা খালু,মানুষ অভ্যাসের দাস।তাই স্বভাব অনুযায়ী হয়ে যায়।তুমি আবার কাঁদছিলে?”
-“না,কাঁদছিলাম না।তোর খালার হাসিটা খুব সুন্দর ছিলো তাই নারে?”
-“খালার প্রতিটা জিনিস খুব সুন্দর ছিলো।আলবার্ট আইনস্টাইন কী বলেছে জানো?উনি বলেছেন- “একজন সুন্দর, আকর্ষণীয় রমণীর পাশে ২ ঘণ্টা বসে থাকুন, দেখবেন সময় উড়ে চলে গেছে!! এবার গ্রীষ্মের গরমের মাঝে রাস্তায় ২ মিনিট হাঁটুন, মনে হবে আপনি অনন্তকাল ধরে হাঁটছেন!!”
মি.রহমান হেসে বলেন,
-“ভুলে যাচ্ছিস আমি তোর খালু?”
ইয়ারাবী মাথাটা নাড়িয়ে বলে,
-“খালু নও তুমি হলে আমার ছেলে।মা বলো তো সব সময়।”
-“ঠিকই বলেছিস।”
-“এই যা তোমার চা দিতে এসে ভুলে যাচ্ছিলাম।নাও ধরো এটা…”
-“তুই কেন কষ্ট করতে গেলি?সাথি বা দোলন কিছুক্ষণ পরে দিয়ে যেতো…”
-“সবাই রান্নার কাজ করছে,তুমি নাও।আর যতদিন আমি আছি,সব কিছুর খেয়াল আমিই রাখবো।”
-“ঠিক আছে,তুই একদম তোর খালার মতো কথা বলিস…”
-“আজ সারাদিন ধরে কান্নাটা কন্ট্রোল করে রেখেছি,আমার কান্না করলে খুব সমস্যা হচ্ছে তাই প্লীজ এমন কিছু বলোনা যাতে নিজেকে কন্ট্রোল করতে না পারি।”
-“আমি জানিতো মেয়েটা ওর খালামনিকে খুব ভালোবাসে।মনে হয় তুই কফিগুলো ওদের জন্য নিয়ে যাচ্ছিলি।তাড়াতাড়ি ছাদে যা নয়তো হট কফি কোল্ড হয়ে যাবে।”
-“ওহ্হ্,মনে ছিলোনা।আমি দিয়ে আসি ওনাদের, এসে তোমার সাথে গল্প করবো।”
ইয়ারাবী রুম থেকে বেড়িয়ে যায়।
(১২৯)
শাহরিয়ার ছাদ থেকে নামছে আর নুসরাত নিরাকে কোলে নিয়ে ছাদে উঠছে।এমন শাহরিয়া ওর দিকে তাকিয়ে বলে,
-“তুমি ইমনের বোন নুসরাত তাইনা?”
-“জ্বি”
-“আমি শাহরিয়া ওর ফ্রেন্ড।”
-“তো আমি কী করতে পারি?”
-“না এমনি ভাবলাম একটু কথা বলি…”
-“কিন্তু আমি আগ্রহী নই,”
-“আরে আমিতো জাস্ট কথা বলতে এসেছি…”
-“ভাইয়া এখানে কী করো?”
শাহরিয়ার নুসরাতের পিছনে তাকিয়ে দেখে ইয়ারাবী কফির ট্রে হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।এই সুযোগে নুসরাত নিরাকে নিয়ে ছাদে চলে যায়।শাহরিয়ার আফসোস করে বলে,
-“বাসায় যাবো,আম্মু ফোন দিয়েছিলো..”
-“খেয়ে যাও,”
-“নারে,এমনিতে অনেক দেরি হয়ে গেছে”
-“তাহলে কফিটা খেয়ে যাও।”
শাহরিয়ার ওর চুলগুলো নেড়ে সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামতে নামতে বলে,
-“আমারটা তুই খেয়ে নিস।কাল দেখা হবে..”
ইয়ারাবী ওর দিকে তাকিয়ে থেকে ছাদের দিকে যেয়ে দেখে চারজন ছাদের যে কর্নারে রেলিং দেওয়া নেই সেদিকটাই চেয়ার নিয়ে বসে কথা বলছে।ইয়রাবী খানিকটা এগিয়ে যেয়ে ইমনকে ডেকে বলে,
-“ইমু ভাইয়া তোমাদের কফি নিয়ে যাও…”
-“তোর আসলে কী হচ্ছে?”
-“মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাচ্ছে…”
-“ফাজালামি না করে এদিকে আয়…”
-“তোমার কোন এঙ্গেল থেকে মনে হচ্ছে আমি ফাজলামি করছি।ফাজলামি তো তোমরা করছো, এত জায়গা থাকতে ওখানে কেন বসতে হয়েছে?”
ইমন বাঁকা হেসে বলে,
-“ওরে আমার সাহসী মাইয়া,ক ডরাইতেছিস।”
-“মারবো কিন্তু,আমি বলছিনা এভাবে কথা বলবেনা।”
ইফাজ ইমনের পিঠে একটা থাপ্পড় মেরে বলে,
-“সব সময় ওর পিছনে ক্যান লাগিস,তুই আয়তো”
-“অকালে শহীদ হওয়ার ইচ্ছা আমার নেই,তাছাড়া ছাদ প্রায় পিচলা হয়ে গেছে।আল্লাহ জানে সাথি আপুর জিন্দেগীতে বুদ্ধি হবে নাকী,রাতের দিকে উনি ছাদে পানি ঢালছে।”
-“তুই আয়,বোস এখানে।কিছু হবেনা,”
-“বসমু,তার আগে ইমু ভাইয়ারে সরতে বলো।ওই পোলার উপর ভরসা নেই,শুধু শুধু ভয় দেখায়…”
ইরাক ইমনের দিকে তাকিয়ে বলে,
-“তুই আবরারের পাশের চেয়ারে এসে বোস,ওঠ ওখান থেকে…”
-“দেখছো ভাইয়া আমারে শুদ্ধ ভাষায় কথা বলতে বলে উনি অশুদ্ধ ভাষায় কথা বলছে।বুঝতেছিনা এই মাইয়ারে জিন-পরীতে ধরছে নাকী?”
-“আবার ওর পিছনে লাগছিস,পিচ্চি আমার পাশে এসে বোস।আমরা আমরাই তো,ভয়ের কিছু নেই।”
আবরার ইফাজের পাশে ছিলো,ওর পিছনের জায়গাটা পুরোটা খোলা,কর্নারের থেকে এক ফুট দূরত্বে বসে আছে।ইফাজের দিকে তাকিয়ে বলে,
-“ওর তো উচ্চতায় ভয় নেই,তাহলে এখন কেন ভয় পাচ্ছে।”
-“ও উঁচু খোলা জায়গায় থাকতে ভয় পায়।ছোট থাকতে একবার ওর চাচতো ভাই বিপ্লব খেলার সময় ওকে একতালার ছাদ থেকে ধাক্কা দিয়ে নিচে ফেলেছিলো।ভাগ্য ভালো মিস্ত্রিরা বাড়ির কাজ করছিলো তাই তাদের যে বেডগুলো ছিলো সেগুলো নিচেই রাখা ছিলো।আসলে একটা কথা কী জানিস ওর সব ভয়গুলো হলো ছোট বেলার ভয়,যা এক প্রকার ব্রেনের ভিতর চেপে বসে আছে।”
ইয়ারাবী আস্তে করে এসে ইরাকের পাশে বসে।ইরাক নুসরাতকে ডাক দেয় তবে ও বসবেনা বলেছে,নিরাকে নিয়ে নিচে চলে যায়।আসলে ও কান্না করছিলো খাওয়ার জন্য।সবাই কফি খাচ্ছে এমন সময় ইরাক অনেকটা গম্ভীর কন্ঠে বলে উঠে,
-“আজ কী হয়েছিলো রে পিচ্চি?”
-“অনেক কিছুই হয়েছে,জানো তোমাদের বোনের একমাত্র জামাইয়ের সামনে তার মায়ের কাছে তার ছেলের বৌয়ের বিয়ের কথা চলছিলো।”
সবাই অনেকটা অবাক হয়ে ইয়ারাবীর দিকে তাকায়।তবে আবরার নিজের মতো কফি পান করছে আর ফোন স্ক্রোল করছে।ইরাক ওর দিকে তাকিয়ে বলে,
-“আমাদের বোন মানে তো তুই,তোর বিয়ে মানে?”
-“আরে ভাইয়া সোহাগী বানু আছেনা?”
-“কোন সোহাগী বানু?”
ইয়ারাবী অনেকটা বিরক্তি নিয়ে বলে,
-“তৌফিক মামার বৌয়ের বড় ভাবী সোহাগী বানু, তার ভাইয়ের ছেলের জন্য আমাকে পছন্দ করতে এসেছিলো।আম্মুর কাছে বলছিল,আমি প্রথমে ভাবছি জারবার কথা বলছে।পরে শুনি উনি আমার বিয়ের পরিকল্পনা করছে।এমনিতে আজকাল মুডের বারোটা বেজে থাকে তার উপর এমন কথা।অনেক কষ্টে মেজাজটা ঠিক রেখেছিলাম।”
ইমন আবরারের দিকে তাকিয়ে খানিকটা পিন্চ করে বলে,
-“বিষয়টা মন্দ ছিলোনা,একটা বিয়ে খেতে পারতাম।”
আবরার ফোনের দিকে চোখ রেখেই বলে,
-“তোমার বোনের সাহসে কুলালে করে দেখাতে বলো।”
-“ওর এত সাহস নেই,সেটা খুব ভালো করেই জানি।”
-“হ্যাঁ,ম্যাডাম বাইরে রণচণ্ডী আর পরিবারের মধ্যে ভিজা বেড়াল।”
ইরাক ইয়ারাবীর কাঁধে হাত রেখে বলে,
-“দোষ ওর না আবরার,আসলে পরিবারের কেউ এমনিতে ওকে সহ্য করতে পারেনা।তার উপর যদি এমন করে তাহলে ওরা খুন করতে দ্বিধাবোধ করবেনা।”
খুনের কথাটা শুনতেই ইয়ারাবী কিছুটা কেঁপে উঠে।হঠাৎ ওর মাথায় দুপুরের কথা ভেসে উঠে,আসলে ব্যাস্ততায় আর খালামনির জন্য সবকিছু মাথা থেকে বেড়িয়ে গেছিলো।ইরাক ওর তাকিয়ে বলে,
-“কী হয়েছে?হঠাৎ কেঁপে উঠলি কেন?জ্বর আসেনি তো আবার?”
আবরার ইয়ারাবীর দিকে খানিকটা রাগী চেহারা নিয়ে বলে,
-“নিজের একটুও খেয়াল রাখতে পারোনা।নিশ্চয়ই অনেকক্ষণ পানিতে ভিজেছো।”
-“আশ্চর্য,আপনারা নিজেদের মতো চিন্তা-ভাবনা করে আমাকে কেন বকা দিচ্ছেন?আমার কোনো জ্বর আসেনি।আর আমি নিজের খেয়াল খুব ভালো রাখতে পারি।”
ইফাজ ইয়ারাবীরকে একটা ধমক মেরে বলে,
-“এভাবে কথা কেন বলছিস?তুই তো এভাবে কথা বলিস না।কী হয়েছে তোর বলতো?”
-“কিছুই হয়নি,দেখি সরো নিচে যাবো।”
-“কোথাও যাবিনা,চুপচাপ এখানে বসবি।আবরার তুমি কোনো কথা বলছোনা কেন?”
-“তোমরা ভাই-বোন কথা বলছো এর মধ্যে আমাকে ঢুকা মানায় না।তাছাড়া আমি জানি ওর মুড সুইং হচ্ছে তাই এভাবে রেগে কথা বলছে।”
আবরার কথা বলে ইয়ারাবীর দিকে তাকাই।মেয়েটা মাথা নিচু করে কফি হাতে নিয়ে বসে আছে।আবরার অবশ্য ভুল বলেনি,ওর অভিজ্ঞ চোখ বিষয়টা বুঝতে পেরেছে।ইমন গলাটা ছেড়ে সবাইকে উদ্দেশ্য করে দুপুরের কথাটা বলে।সবার তো কথাটা শুনে চোখ বেড়িয়ে আসার উপক্রম।ইয়ারাবী কান্না করছে,আবরার মৃদ্যু একটা হাসি দেয়।ইরাক ওর দিকে তাকিয়ে বলে,
-“আমাদের বলিসনি কেন?”
-“কী বলতাম?আর বললে কী হতো জানো?এমনিতে তোমার খালু আমাকে সহ্য করতে পারেনা।তার উপর যদি আমি এমন কথা বলতাম তাহলে কী হতো বুঝতে পারছো?”
আবরার খানিকটা আরমোরা ছেড়ে বলে,
-“ইরাক ভাইয়া,ও যা করেছে ঠিক করেছে।এমনিতে সবাই মন-মানসিকতা ঠিক নেই,তারপর এমন কিছু করলে ওকে সবাই অবিশ্বাস করতো।কেননা তখন ওর বয়স মাত্র আট বছর।হ্যাঁ,এমন অনেক অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা যা আমাদের অনেক ছোট বয়সে ঘটে যেটা সহজে স্মৃতি থেকে মুছা যায়না।ওর সাথেও ঠিক তাই হয়েছে,ও খুনির চেহারা ভুলতে পারেনি।তবে প্রশ্ন হচ্ছে,খুনি আব্বুর বন্ধু হয় তবে উনার মেয়েকে কেন মারলো?আর সাথের দু’জন কে ছিলো?আর কেউ ওর কথায় বিশ্বাস করবেনা।তাছাড়া প্রমান ছাড়া কিছু করাও যাবেনা।”
-“তুই মানে তুমি বলছো এমন কথা?”
ইফাজ অনেকটা সূক্ষ দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে কথাটা বলে।আবরার খানিকটা মুচকি হেসে বলে,
-“চলো রাতের ডিনার করতে হবে,খালুও এখনো খায়নি।আর ইয়ারাবী কান্না বন্ধ করো,তুমি কেন কাঁদছো?তোমার কোনো দোষ নেই,চলো খাবে…”
-“সবাই তো দোষী আমাকে ভাবে…”
-“কেউ ভাব্বেনা,তোমরা একমাত্র আপনজন বলতে যারা তোমাকে অনেক ভালোবাসে।শুধু তাদের কথা ভাব্বে,অন্য কারোর কথা না।”
ওরা সবাই নিচে নেমে দেখে জারিকা নিরাকে কোলে নিয়ে চেয়ারে বসে আছে।জারিকা একটা আকাশি রঙের পাতলা জর্জেটের শাড়ি পরে লম্বা চুলগুলো খুলে রেখেছে।তবে ইয়ারাবী বরই সিম্পিল কেননা একটা সিলভার রঙের হাফহাতা গেন্জি আর কালো প্লাজু গলায় স্কার্ফ ,চোখে চশমা চুলগুলো হাতখোপা করা।আবরার একবার জারিকার দিকে তাকিয়ে আবার ইয়ারাবীর দিকে তাকালো।মেয়েটাকে সাধারনভাবে অনেক সুন্দর লাগছে।মিসেস দোলন সাথির সাথে কিচেন থেকে এটা-ওটা নিয়ে আসছে।ইয়ারাবী ওনার দিকে তাকিয়ে বলে,
-“মনি আমি সাহায্য করি।”
-“তুই চুপ করে বোস,আমি খাবার আনছি…”
-“খালু কই?”
বলতে যেয়ে দেখে মি.রহমান সিঁড়ি থেকে নামছেন। উনি চেয়ারে বসে জারিকার দিকে তাকিয়ে বলে,
-“সামীর চলে গেল,আটকালে না কেন?”
-“জামাই ওর অনেক কাজ,তাই আর থাকলোনা।”
-“ওহ্হ্,মা তুই দাঁড়িয়ে আছিস কেন বোস আর নুসরাত তুইও বোস।”
সবাই খাবার খাচ্ছে এমন সময় জারিকা আবরারের পায়ে টেবিলের নিচ থেকে খোঁচা মারে।তবে আবরার স্বাভাবিকভাবে খেয়ে যাচ্ছে।জারিকা এবার অনেক জোরে ওর পায়ে মারে যার জন্য নিজেও ব্যাথা পায় তবে আবরারের কিছু হয়না।আবরার মিসেস দোলনের দিকে তাকিয়ে বলে,
-“আন্টি,খাওয়ার পরে রুমে একগ্লাস গরম দুধ পাঠিয়ে দিবেন কষ্ট করে।”
-“কষ্ট কেন বলছো?আমি পাঠিয়ে দিবো,সাথি ফ্রিজ থেকে দুধটা বের করে রাখো।”
জারিকা আবারও আবরারের পায়ে মারে,এবার আবরার অনেকটা বিরক্ত নিয়ে ওর দিকে তাকায়।জারিকা ওর দিকে শয়তানি হাসি দিয়ে চোখ টিপ মেরে ইয়ারাবীকে উদ্দেশ্য করে বলে,
-“ইস্মা শোবার আগে একবার আমার সাথে দেখা করবি কিছু বলার আছে তোর।”
আবার ওর কথা শুনে খানিকটা সন্দেহজনক চোখে ওর দিকে তাকাই।ইয়ারাবী বিরক্ত হয়ে বলে,
-“যা বলার এখানে বলো আমার অতো সময় নেই।”
-“মাত্র পাঁচ-দশ মিনিট।”
-“পারবোনা,খাওয়ার পর রুমে যাবো মাথা ব্যাথা করছে।”
-“তোর তো কিছুনা কিছু লেগেই থাকে।”
-“আমার মতো জীবনতো পাওনি তাই বুঝবেনা।যদি আমার জায়গায় হতে তবে একদিনেই শেষ হয়ে যেতে।”
-“ইয়ারাবী,উনি তোমার বড় বোন।এভাবে কথা বলেনা,খাওয়া শেষ…তোমার রুমে যাও আমি আসছি।”
আবরারের কথা শুনে ও টেবিল থেকে উঠে হাত ধুয়ে রুমে চলে যায়।মি.রহমান ওর যাওয়ার দিকে তাকিয়ে আবরারকে বলে,
-“কী হয়েছে মার?”
-“আসলে খালু এসবের মধ্যে ওর দু’দিনের মেডিসিন গ্যাপ গেছে,তাই এমনটা হচ্ছে।আপনি চিন্তা করবেন না,ঠিক হয়ে যাবো।”
-“সব সময় দোয়া করি মেয়েটা যেন ঠিক হয়ে যায়।”
জারিকা নিরাকে কোলে নিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলে,
-“কই মাছের প্রাণ,এতো সহজে মরবেনা।”
#চলবে_____