জীবন মানে তুমি পর্ব-৩৫

0
3671

#জীবন মানে তুমি
#লেখিকা:H.B.Rini (Irini Ori)
#পর্ব:৩৫

(১২১)

মেয়েটা কত শান্তিতে ওকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে ঘুমাচ্ছে।ঘুমের মাঝে মাঝে হেসে উঠছে,নিশ্চয়ই কোনো সুন্দর স্বপ্ন দেখছে।আচ্ছা ঘুমন্ত মানুষকে এতো সুন্দর কেন লাগে?আসলে ভালোবাসায় মানুষটি যতো কুৎসিত হোক না কেন,নিজের চোখে পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর লাগে।ইয়ারাবী বালিশ ছেড়ে আবরারের হাতের উপর মাথা রেখে বুকের ভিতর গুটিশুটি মেরে ঘুমাচ্ছে।আর আবরার বাম হাত দিয়ে ওর কানের পাশের চুলগুলো নিয়ে খেলা করছে।প্রায় ভোর পাঁচটা মতো বাজে,উঠে নামায পড়তে হবে।কিন্তু ইয়ারাবী না নিজে উঠছে আর না ওকে উঠতে দিচ্ছে।যতবার ও ডাকছে ততবার শক্ত করে জড়িয়ে ধরে ঘুমাচ্ছে মেয়েটা।আবরার ওর মাথার নিচ থেকে হাত সরিয়ে ওকে ডাকতে থাকে,
-“ইয়ারাবী ফজরের নামায পড়বেনা?”

ইয়ারাবী ওর বুকের ভিতর মাথা ঢুকিয়ে ঘুমঘুম কন্ঠে বলে,
-“আরেকটু পরে উঠি..”
-“নামাযের সময় থাকবেনা,নামায পড়ে না হয় আবার ঘুমাবে।”
-“হাতে আর পেটে ব্যাথা করছে,মাথাও ভারী লাগছে আরেকটু ঘুমিয়ে নেই।নয়তো নামায পড়তে গেলে ভুল হয়ে যাবে…”

আবরার ওর চুলে হাত বুলিয়ে ওর মাথায় একটা চুমু দিয়ে বলে,
-“বাম কাত হয়ে ঘুমাও এইজন্য,এখন উঠো…”

ইয়ারাবী বিরক্তি নিয়ে আধোআধো চোখ খুলে ওর দিকে তাকিয়ে বলে,
-“আপনি খুব খারাপ…”
-“মেনে নিলাম..”

আবরারের হাসি দেখে ইয়ারাবীর মেজাজ গরম হয়ে যায়।ও আবরারের বুকে একটা ধাক্কা দিয়ে বলে,
-“হাসবেন না একদম,আমি যা বলি বা করি সেটাতে আপনার হাসি পায়।আমি কী জোকার নাকী?”
-“তুমি জোকার হবে কেন?তুমি তো আমার একমাত্র বৌ,যে এখনো পিচ্চি আছে…”
-“একদম বাজে কথা বলবেন না…”
-“আচ্ছা বলবোনা,এবার উঠো…পরে আবার ঘুমিয়ো।”

ইয়ারাবী উঠে ফ্রেস হয়ে ওযূ করে বেরিয়ে দেখে আবরার জায়নামাজ বিছিয়ে বসে আছে।ওকে ইশারা করে পাশে দাঁড়িয়ে নামায আদায় করতে বলে।দু’জন একসাথে খুব সুন্দর করে নামায আদায় করে নেয়।ইয়ারাবী মাথার হিজাব খুলে আবরারের দিকে তাকিয়ে বলে,
-“কাল বাসায় কখন ফিরেছি আমরা?”
-“এইতো আটটা সাড়ে আটটার দিকে।চিন্তা করার কোনো দরকার নেই,যদিও আমি তোমার স্বামী তারপরও কাল রাতে এমা এসে তোমার পোশাক বদলে দিয়েছে।”

ইয়ারাবী ওর বাম ভ্রুটা উঁচু করে ওর দিকে তাকিয়ে বলে,
-“আমি আপনার কাছে জানতে চেয়েছি?”

আবরার হালকা হেসে বলে,
-“জানতে চাইছিলে কিন্তু মুখে বলতে পারছিলেনা।”

আসলেই তাই,ইয়ারাবী ঘুম থেকে উঠে কিছু অবাক হয়ে যায়।ওর কিছুটা ধারনা হয়েছিলো যে ওর পোশাক হতে পারে এমা বদলে দিয়েছে,কেননা আবরার ওর অনুমতি ছাড়া এমন কাজ করবেনা।তাই কথাটা বলতে সংকোচ বোধ জাগছিলো।আবরার ক্লজেট থেকে জগিং স্যুট বের করে ওর দিকে তাকিয়ে বলে,
-“খুব ঘুম পাচ্ছে বলে,ঘুমিয়ে নাও।আমি রানে যাচ্ছি…”
-“ঘুম আসবেনা,বলছি আজ না গেলে হয়না।”
-“কেন?”
-“না এমনি…”

আবরার হালকা হেসে ক্লজেটে কাপড়টা রেখে বিছানায় ব্লাঙ্কেটে পা ঢুকিয়ে হেলান দিয়ে বসে।ইয়ারাবী চুলটা হাত খোঁপা করে ওর পাশে যেয়ে বলে,
-“আপনার জন্য কফি করে আসবো?”
-“প্রয়োজনবোধ করছিনা…”

ইয়ারাবী আবরারের বুকে মাথা রেখে বলে,
-“আপনি লন্ডনে কত বছর আছেন?”
-“সত্যি বলতে আমার বয়স যখন ছয় বছর তখন ভাইয়া আর আমাকে লন্ডনে পাঠানো লেখাপড়া করার জন্য।কিন্তু ছয় বছর পরেই দেশে ব্যাক করি,কেননা মমকে ছাড়া আমার পক্ষে থাকা সম্ভব ছিলোনা।এজন্য বাবা নিয়ে যায়।কিন্তু আঠারো বছর বয়সে আবার ব্যাক করি।”
-“ওহ্হ্,মায়ের জন্য সব সন্তানের মন পোড়ে।সে খারাপ হোক বা ভালো,মা তো মা হয়।”

আবরার ওকে শক্ত করে নিজে বাহুতে আবদ্ধ করে বলে,
-“মায়ের কথা মনে পরছে,মিস করছো তাইনা।একটা ফোন করে কথা বলে নাও।হতে পারে সেও তোমাকে ছাড়া শূন্যতা অনুভব করছে।”

ইয়ারাবী শক্ত গলায় বলে,
-“না করছেনা,তিনি কোনো দিনও আমাকে মেয়ে বলে মনে করেনি।তার শুধু একটাই মেয়ে আর সে হলো ইয়ামিলা।তাহলে কোন অধিকারে আমি কথা বলবো।”
-“শূন্যতা মানুষকে পুড়াই,এটা এমন একটা আগুন যা সবকিছু ছাড়খাড় করে দেয়।আর সেই আগুনে ভিতর থেকে তুমিও দ্বগ্ধ হচ্ছো।মনের ভীতরের অভিমানকে বাইরে বের করে আনো,তুমি তার সন্তান।সেই অধিকারে কথা বলবে,”
-“অপমান কেন করাতে চান?নাকী আপনিও শান্তি পাবেন এটা দেখে?”
-“তুমি আমার স্ত্রী,আর একজন স্ত্রীর ভালো রাখার দায়িত্ব তার স্বামীর।হতে পারে আম্মু যেগুলো করতো সেগুলো না বুঝে করতো।”

ইয়ারাবী আবরারের বুক থেকে মাথা উঠিয়ে বলে,
-“কী না বুঝে করতো বলতে পারবেন?কখনো গলায় পারা দেওয়া,বুকে লাথি মারা,রড দিয়ে আঘাত করা,গরম পানিতে হাত চেপে ধরা,বটি দিয়ে জবাই করতে চাওয়া,ইলেকট্রিক আয়রন মারা,মানুষের মাঝে বিনা করানে তৃপ্তি সহকারে অপমান করা,আর নিজের বড় বোনের খুনির পরিচয় দেওয়া,আরো আছে সেগুলো নাই বা বললাম।এবার বলুন কোনো মা না বুঝে তার মেয়েকে এমন আঘাত কেন করবে?কী হলো বলুন?”

ইয়ারাবীর কথাগুলো বলার সময় চোখের পানি টলমল করছিলো।নিজেকে আটকানোর বৃথা চেষ্টা করেও পারলোনা শেষ পর্যন্ত।হাটুতে মুখ গুজে কান্না শুরু করল।আর কাঁদবে নাই বা কেন?আবরার যে আগুনের ছোঁয়ায় দ্বগ্ধ হওয়ার কথা বলছে সেটাতে তো ছোট থেকেই পুড়ছে,জীবেনর সব কিছু ছাড়খাড় হয়ে গেছে।জীবন্ত লাশ হয়ে বেঁচে আছে,আর সেই লাশে আশার আলো হয়ে ভালোবাসার ছোঁয়া দিয়ে নতুন করে প্রাণ সঞ্চার করছে আবরার।মাত্র আঠারো বছরের জীবনে কত কী না সহ্য করেছে ইয়ারাবী।যে বয়সে নিজে হাতে খেতে পারতো না,একা ঘুমাতে পারতোনা,বাবা-মার ভালোবাসার প্রয়োজন ছিলো সেই সময় ভালোবাসার বদলে পেয়েছে শুধু অবহেলা।ঠিক করে যে মেয়েটা খেলতে পারতো না তাকে অপরাধী বানিয়ে অন্ধকার জগতে ঠেলতে চাইছিলো তার আপন বাবা-মা।যেখানে তাদের সব চেয়ে বেশি প্রয়োজন ছিলো তারা তাকে ছুড়ে ফেলে দিলো।আসলেই কী বাবা-মা নিজের স্বার্থে এতটা নিষ্ঠুর হতে পারে?যে সন্তানকে দশমাস দশদিন গর্ভে ধারন করে তারই মৃত্যু কামনা করে প্রতি ওয়াক্তে।মায়ের ভালোবাসা বলে বদলায় না,তাহলে ওর কেন বদলে গেল?

আবরার ইয়ারাবীকে কিছু বলতে যাবে তার আগেই মি.ফুয়াদের কল আসে ওর ফোনে।এত ভোরে ফোন পেয়ে কিছুটা চমকালেও পরক্ষণে মনে পরে ওরা লন্ডনে আছে।ও ইয়ারাবীর চোখের পানি মুছে দিয়ে একটা পানির গ্লাস দিয়ে ইশারা করে পানি খেতে।তারপর মি.ফুয়াদের ফোনটা ধরে সালাম দেওয়ার আগেই উনি বলেন,
-“বাবা আমি জানি তোমরা কিছুদিনের জন্য বাইরে গেছো।কিন্তু যত দ্রুত সম্ভব ইস্মাকে নিয়ে বাংলাদেশে এসো।”

আবরারের মি.ফুয়াদের গলার স্বর আর কথাগুলো শুনে কেমন একটা খটকা লাগে।তাই সে বেলকনির দরজা খুলে বাইরে যেয়ে বলে,
-“আব্বু কী হয়েছে?অস্বাভাবিক কোনো পরিস্থিতি হয়েছে নাকী?”
-“ইস্মা কী তোমার আশেপাশে আছে?”
-“না,ও রুমে আছে।আপনি বলেন সমস্যা নেই….”
-“মেজো আপা মানে ইরাকের আম্মুর অবস্থা ভালোনা।সিঁড়ি থেকে পরে গেছে,আইসিইউতে রাখা হয়েছে।তুমি মেয়েটাকে যত দ্রুত সম্ভব এখানে নিয়ে এসো….”

আবরার কী বলবে বুঝতে পারছেনা।হঠাৎ করে এমন খবর শুনবে তার আশাও করেনি।মি.ফুয়াদের কথা শুনে মনে হচ্ছে অবস্থা খুব গুরুতর,নয়তো ইয়ারাবীকে সামান্য কারণে নিয়ে যেতে বলতেন না। কথা বলে ফোনটা কেঁটে ওর এক পরিচিত ব্যাক্তিকে ফোন দিয়ে প্লেনের টিকেট কেটে নেয়।রুমে এসে দেখে ইয়ারাবী ফোন নিয়ে ঘাটাঘাটি করছে।
-“কী করছো তুমি?”
-“দেখুন না,পল্লবী আপু ফোন করেছিলো।রিসিব করলাম তো বললো কারো কিছু হয়েছে,ঠিক বুঝিনি তার আগে ফোনটা কেঁটে গেল।কিন্তু এতটুকু বুঝতে পারছি আপু খুব কান্না করছিলো।”
-“ফোনটা চার্জে দিয়ে গুছিয়ে নাও,”
-“কেন?”

আবরার কিছু বলতে যাবে তার আগে ওর ফোনে একটা ম্যাসেজ আসে।ম্যাসেজটা চেক করে ওর কপালে ভাঁজ পরে যায়।ও ইয়ারাবীর পাশে বসে বলে,
-“আমরা বাংলাদেশে ব্যাক করছি,”

ইয়ারাবী ওর দিকে বিস্মিত চোখে প্রশ্ন করে বলে,
-“হঠাৎ বাংলাদেশে কেন?কিছু হয়েছে?”
-“তেমন কিছু নয়,আর্জেন্ট একটু কাজ আছে।তুমি গুছিয়ে নাও,আমি টিকেট কনফার্ম করছি।”

ইয়ারাবীর কেমন একটা সন্দেহ হচ্ছে আবরারের কথা শুনে।কেননা ও জানে একটু আগে ওর বাবা ফোন করেছিলো।তারপরও কাপড় নিয়ে ওয়াশরুমে যেয়ে চেন্জ হয়ে এসে দেখে এমা রুমে খাবার দিয়ে গেছে।আবরার ওকে হাতের ইশারায় ডেকে সামনে বসিয়ে ওর মুখে খাবার তুলে দেয়।
-“আপনার মাথা খারাপ,এত সকালে আমি খেতে পারিনা।”
-“খেতে হবে কমপক্ষে বারো ঘন্টার জার্নি।খাবারটা শেষ করে সকালের মেডিসিন নিয়ে নিবে।এবার হা করো,তোমাকে খাইয়ে আমাকে রেডি হতে হবে।”
-“আপনার ভয়েস এমন লাগছে কেন?সত্যি করে বলেন কিছু হয়েছে নাকী?”

আবরার খানিকটা হাসির রেখা টেনে বলে,
-“নাথিং,এমনি এমনটা হচ্ছে।”

আবরার ইয়ারাবীকে যত্ন সহকারে খাইয়ে দেয়।আবরার সবকিছু নরমাল বললেও ইয়ারাবীর মনে কু ডাকছে।বুক ফেঁটে কান্না আসছে,কিন্তু কেন?তাহলে খুব কাছের কেউ কী চলে যাচ্ছে।এমন কেই যাকে ওর ভীষণ প্রয়োজন,হৃদয়ে একটা আহাকারের সুর বাজছে।সত্যিই কী তাই?আবরার ওকে খাইয়ে দিয়ে নিজে রেডি হয়ে নেই।ইয়ারাবী কোনো কথা বলছেনা শুধু নিবরে চেয়ে আছে আবরারের দিকে।ইয়ারাবী একটা সাদা রঙের সুতির গাউন পরেছে তার ওপর একটা চাদর।ওরা সাড়ে সাতটার দিকে বাসা থেকে বের হয়ে এ্যায়ারপোর্টে পৌঁছালে ব্রুজ ওর হাতে দু’টা টিকিট ধরিয়ে দিয়ে বিদায় জানায়।ওরা যথা সময়ে অর্থাৎ আটটায় প্লেনে উঠে,ডিপার্চারের আগের মুহুর্তে আবরার ওর সিলবেল্ট বেঁধে দেওয়ার পর ইয়ারাবী ফোন বন্ধ করতে যেয়ে দেখে ওর ফোনে কিছু কল আর ম্যাসেজ উঠে আছে,পল্লবীর নাম্বার থেকে।কৌতুহল বসত ও ম্যাসেজ ওপেন করে যে লেখাটা দেখে তাতে ওর হাত থেকে মোবাইল পড়ে যায়।আবরার ওর দিকে তাকিয়ে মোবাইল হাতে নিয়ে দেখে লিখা আছে,
“ইয়ারাবী,মেজো খালা গুরুতর অসুস্থ।সিড়ি থেকে পড়ে যেয়ে মাথায় আঘাত লেগেছে,বাঁচার চান্স খুব কম।”

ম্যাসেজটা পড়ে আবরার একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ছেড়ে ইয়ারাবীর দিকে তাকিয়ে দেখে ওর চোখে পানি টলমল করছে।আবরার কিছু বলতে যাবে তার আগেই ইয়ারাবী বলে উঠে,
-“খালামনির কথা আপনি জানেন?এই কারনে আমাকে মিথ্যা বলেছেন?”
-“দেখ ইয়ারাবী উনি ঠিক হয়ে যাবে..”
-“সত্যি খা…লামনির কিছু হবেনা তো,উনি খালামনি না উনি…উনি আমার মা।উনার কিছু হলে আমি বাঁচতে পারবোনা।জানেন আমি ভেবে রেখেছিলাম এখান থেকে যেয়ে কিছুদিন খালামনির কাছে থাকবো।উনি বলতো সব সময় কিন্তু বিয়ের পরে আর যেয়ে থাকা হয়নি।”
-“দেখ ইয়ারাবী,শান্ত হও।উনি যেন ভালো থাকেন সেই দোয়া করো।তুমি তো জানো ওনার জন্য দোয়া করতে থাকো।”
-“ক্ করবো।”

ইয়ারাবী চোখের পানি মুছে মনে মনে দোয়া করতে থাকে।প্রথম চারঘন্টা ভালো গেলেও পরবর্তীতে ওর প্রচন্ড অসুস্থ হয়ে পরে।ভয়ংকর মাথা যন্ত্রনা, জ্বর সাথে সারা শরীর ব্যাথা করতে শুরু করে।দু’বার ভোমিট হয় ওর।ইয়ারাবী কান্না করতে থাকে ওর খালামনির জন্য,আবরার ডাক্তার হওয়ার সুবিধায় এবং পাশে একজন ইন্ডিয়ান নিউরোলজিস্ট থাকায় কোনো অসুবিধা হয়নি।তবে সারাটা পথে ওকে জোর করে একটু খাবার খাওয়াতে পারেনি।জোর করে একটু জুস খাইয়ে দুপুরের মেডিসিন আর জ্বরের জন্য একটা ট্যাবলেট দেয়।অনেক কষ্টে ইয়ারাবীকে ঘুম পারিয়ে দেয়।ঘুমের ঘোরে জ্বরের জন্য মৃদ্যু মৃদ্যু কেঁপে উঠছে।ফ্লাইটে বেশি কিছু হয়না,ওরা রাত একটার দিকে বাংলাদেশে পৌঁছায়।বাসায় আগে ফোন করেছিলো বলে মেঘ গাড়ি নিয়ে আসে।আবরার মেঘকে দেখে বলে,
-“তুই আসলি,ড্রাইভার কোথায়?”
-“রাজু আজ আসেনি,তার মহিনকে সাথে নিয়ে গেছে বড় আম্মুরা ওদের বাসায়।ওর কী হয়েছে?”
-“অনেক অসুস্থ হয়ে পরেছে।”
-“ভাইয়া ওখানে নিয়ে যাওয়া কী এখন ঠিক হবে?”
আবরার একবার ইয়ারাবীর দিকে তাকিয়ে বলে,
-“যেতে তো হবেই,সবাই তো ওর জন্য অপেক্ষা করছে।”
ইয়ারাবী কথাটা শুনার সাথে সাথে আবরারের দিকে তাকিয়ে বলে,
-“সবাই অপেক্ষা ক..করছে মানে?খালা..খালামনি ঠিক আছে তো?”
কান্নার জন্য ওর কথাগুলো গলায় দলা পাকিয়ে আটকে যাচ্ছে।ও স্বপ্নেও ভাবতে চাইনা,ওর খালামনির খারাপ কিছু হোক।মেঘ ইয়ারাবীর মাথায় হাত রেখে বলে,
-“সব ঠিক হয়ে যাবে,আন্টিকে দেখবিনা?তাহলে দেরি করছিস কেন?”
-“খালামনি কোথায় এখন?”
-“আব…বাসায়”
ইয়ারাবীর কথাটা শুনে কিছুটা সন্দেহ হয়।ওর সন্দেহের দৃষ্টিতে মেঘের দিকে চেয়ে বলে,
-“বাসায় কেন?খালামনি না অসুস্থ,হাসপাতালে থাকায় কথা।আপু যে বললো আইসিইউতে আছে..”
আবরার আর মেঘের মুখে কোনো কথা নেই।কী বলবে মেয়েটাকে?মেঘ আবরারের দিকে তাকিয়ে বলে,
-“তুই কী ভুলে গেছিস,ইফাজ ভাইয়া একজন ডাক্তার।এইজন্য বাসায় শিফট্ করে নিয়েছে।”

ইয়ারাবী কোনো কথা না বারিয়ে ওদের সাথে গাড়িতে উঠে।পুরো রাস্তা কেউ কোনো কথা বলেনা।এখানে তেমন একটা শীত নেই,বসন্তের আগমন ঘটেছে,ফেব্রুয়ারির শেষ প্রান্তে।স্ট্রীট ল্যাম্পের আলোয় ফুটপাতে কিছু কুকুড় আর ঘুমন্ত মানুষ ছাড়া দু-তিনটা গাড়ি চলতে দেখা যাচ্ছে।আজ প্রকৃতিটা কেমন গম্ভীর হয়ে আছে, এতটা নিরব মুহুর্ত কোনোদিন হয়েছে বলে মনে হয়না।প্রায় দুই ঘন্টা পরে ওরা বারিধারার একটা দু’তালা ডুপ্লেক্স বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ায়।বাইরে থেকে শোরগোলের আওয়াজ শুনা যাচ্ছে।এই আওয়াজটার সাথে ইয়ারাবী পূর্বপরিচিত বিধায় চিনতে একটুও ভুল হয়নি।ও গাড়ি থেকে নেমে আবরারের দিকে তাকায়।ও কিছু শুনায় প্রত্যাশা করেনা,কেননা যা বোঝার বুঝে গেছে।ও দৌঁড়ে বাড়ির দারজা দিয়ে ভিতরে প্রবেশ করে দেখে সাদা চাদরে আবৃত করে কাউকে শুয়িয়ে রাখা হয়েছে।তার মাথায় কাছে ইরাক,ইফাজ বসে কোরআন তেলাওয়াত করছে।ইমন পায়ের কাছে বসে চুপ করে আছে।ওর মায়েরা প্রচুর কান্নাকাটি করছে,ওর খালুকে ওর বাবারা সামলাচ্ছে।য়ুহার ইমনের পাশে বসে ওকে বোঝাচ্ছে।এসব দেখে কিছুক্ষণের জন্য ওর পুরো পৃথিবী থমকে যায়,মাথা কাজ করা বন্ধ হয়ে যায়,সবকিছু একটা বাজে স্বপ্নের মতো মনে হচ্ছে। ইয়ারাবী দৌঁড়ে এসে ওর খালাকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পরে আর বলতে থাকে,
-“খালামনি তুমি শুয়ে আছো কেন?উঠো দেখো আমি এসেছি।খালামনি কথা বলোনা।উঠোনা,তুমি জানোনা তুমি ছাড়া আমার কেউ নেই।তোমাকে চাদর দিয়ে ঢেকে কেন রেখেছে?তোমার নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছেনা।আর তোমরা চিৎকার করছো কেন? জানোনা খালামনি নয়েজ পছন্দ করেনা।”

য়ুহার ইয়ারাবীকে উঠানোর চেষ্টা করে বলে,
-“সোনা,ফুপু আর নেই।তুই এই ভাবে কাঁদিসনা।”
-“তুমি মিথ্যা বলছো,আমি কাল সকালেও খালামনির সাথে কথা বলেছি।খালামনি বলেছিলো,আমি আসলে আমার সাথে থাকবে।আর তুমি প্রমিজ করেছিলেনা,তুমি আমাকে ছেড়ে যাবেনা।তুমি বলেছিলে তুমি আমার মা হও…খালামনি প্লীজ উঠো।দেখো সবাই বলছে তুমি মারা গেছো।”
ইয়ারাবীকে হাজার কষ্ট করেও কেউ উঠাতে পারছেনা।ইমনও এইদিক থেকে মায়ের পায়ের উপর পরে কান্না শুরু করে দিয়েছে।
-“আম্মু তুমি কই গেলে,এখন দুষ্টুমি করলে তুমি আর বকা দেবেনা।বাসায় দেরিতে ফিরলে শাষন করবেনা,আমার আবদার শুনার মতো আর কেই থাকলোনা…”
ইরাক-ইফাজ অনেক কষ্টে বুকের উপর পাথর চাঁপা দিয়ে আছে,কেননা ওরা যদি ভেঙে পরে বাকীদের সামলাবে কী করে।ওরা কুরঅান শরীফটা একপাশে রেখে ওদের কাছে যায়।ইয়ারাবী ওর খালার মুখটা ধরে বলে,
-“ও খালামনি,তুমি কেন চলে গেলে?মায়ের আদর ভালোবাসা সব তো তোমার কাছ থেকে পেয়েছিলাম।ভেবেছিলাম ফিরে এসে তোমার কাছে কিছুদিন থাকবো কিন্তু আর থাকা…হলোনা…।”
এদিকে ইয়ারাবী ওই দিকে ইমন,এদের হৃদয় ফাটানো চিৎকারে পরিবেশ আরো ভারি হয়ে উঠে।আবরারের মা,জারবা ইয়ারাবীকে সরানোর চেষ্টা করছে কিন্তু হচ্ছেনা।ইমনের শক্তির সাথেও আজ আর কেউ পারছেনা,হাসান,আবরারের মতো মানুষকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছে।মি.রহমান ছেলে মেয়েদের এমন অবস্থা দেখে নিজেকে শক্ত রেখে বলেন,
-“শিখার বডি অনেক্ষণ ধরে এভাবে রাখা আছে, গোসল করে জানাযার নামায পড়াতে হবে তার ব্যবস্থা করো।ওর কষ্ট হচ্ছে…”

ইয়ারাবী চিৎকার করে বলে,
-“না খালামনি কোথাও যাবেনা।আমি কোথাও যেতে দিবোনা…”
ইমনও ওর বাবার দিকে তাকিয়ে বলে,
-“আব্বু আম্মু চলে গেলে আমরা কোথায় থাকবো?”

মিসেস রহমানের ভাই-বোনেরা চিৎকার করে কাঁদছে।পল্লবী,আদিবারাও কান্না করলে জারিকা ওর ছোট বোনের সাথে বলছে,
-“দেখছিস কত ডং করছে,একজনের মা মেরেছে আর বাকীরা নাটক করছে।”
-“আরে আপু দেখ বেশি নাটক তো ইয়ারাবী করছে।আদিকক্ষ্যাতা,আর বাঁচিনা এসব দেখে…”
য়ুহার ওদের সামনে যেয়ে বলে,
-“আজকের দিনেও তোরা এমন করছিস,লজ্জা হয় তোদেরকে বোন বলতে।আজ যদি খালা মারা না যেতো তবে তোদের ঠাটিয়ে থাপ্পড় মারতাম।”

-“ইয়ারাবী…”
আবরারের মায়ের চিৎকারে য়ুহার তাকিয়ে দেখে ইয়ারাবী জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে।আবরার দ্রুত ইয়ারাবীর কাছে আসে।গাঁয়ে জ্বরে একদম পুরে যাচ্ছে।ইরাক ওর কাঁধে হাত রেখে বলে,
-“উপরের বড় ঘরটা ওর,নিয়ে যা ওখানে।মেয়েটার নয়তো সমস্যা হবে।”
আবরার ওকে নিয়ে উপরে যেতে ইরাক ওর ফুপির মেয়ে নুসরাতকে তেল নিয়ে উপরে যাওয়ার জন্য বলে।

(১২২)

ইরাকদের বাসার এরিয়াটা অনেক বড়ো।মিসেস রহমানকে বাসার পিছনে গোসলের ব্যাবস্থা করিয়ে শেষ গোসল করানো হলো।ইমন হাত-পা ছরিয়ে ছিটিয়ে কান্না করছে।জারার মা দিপ্তির সাথে ছিলো ওনার বোনের গভীর সখ্যতা।কিন্তু বোনের মৃত্যুতে উনিও খুব ভেঙ্গে পরেছেন।রাত সাড়ে চারটা বাজে,সকাল দশটায় ওনার জানাযা করে কবর দেওয়া হবে।মি.রহমান ছেলেকে শান্তনা দিচ্ছেন।ওনার একটা মাত্র বোন আর ওনার বাবা-মা অনেক আগে মারা গেছেন।অনেক আত্মীয়-স্বজন,শিক্ষার্থীরা এসেছে শেষ দেখা দেখতে।য়ুহার,আদিবা,টিকলি,শুভ খালার পাশে বসে কোরআন পরছে।ইয়ারাবীকে নাইট্রোজিপাম দিয়ে ঘুম পারিয়ে রেখেছে।আবরার ওকে ঠিক করে দিয়ে নুসরাত আর ইয়ামিলাকে ওর কাছে বসিয়ে রেখে বাইরে বেড়িয়ে প্রাণপ্রিয় বন্ধুর কাছে গেলো।ইরাক-ইফাজ এতক্ষণ পর্যন্ত শক্ত থাকলেও এক বুক ফেঁটে কান্না আসছে।আর আসবে নাই বা কেন?মা শব্দে যেমন একটা জাদু থাকে তেমন এই ব্যাক্তিও একজন জাদুকারী।মায়ের কোলে মাথা রেখে শুলে পৃথিবীর সমস্ত কষ্ট দূর হয়ে যায়,তার হাতের ছোঁয়া যেন এক পরশ পাথর।আর সেই মা আজ তাদের মাঝে নেই।হঠাৎ করেই ইফাজ ইরাককে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে কেঁদে দেয়।মিসেস ইশানি নিজের মনকে শান্ত করে ছেলে দু’টোকে সামালাচ্ছে।আবরার এসে ইফাজকে বলে উঠে,
-“দেখ তোরা এভাবে কাঁদলে,বাকীদেরকে সামলাবে?ইরাক-ইফাজ তোরা যথেষ্ট বড়, নিজেদের সামলা।ইমনকে দেখ এভাবে কাঁদলে হাসপাতালে ভর্তি হতে বেশি সময় লাগবেনা।”

ইরাক নিজের পানি মুছে বলে,
-“সকালে মায়ের সাথে ফোনে কথা হয়েছিলো,কত মজা করলাম।কখনো ভাবিনি এভাবে মা চলে যাবে।যখনি শুনেছি মা সিঁড়ি থেকে পরে গেছে তখনি জুরুরি ভিত্তিতে ছুটি নিয়ে চলে এসেছি।মাত্র একঘন্টা পর মা আমাদের ছেড়ে চলে গেলো।তবে মৃত্যুর আগে একবার পিচ্চিকে দেখতে চেয়েছিলো, কেননা মা সব সময় ওকে আপন মেয়ে ভেবে এসেছে।কিন্তু পারিনি দেখাতে…”
-“দেখ ভালো মানুষ পৃথিবীতে বেশিদিন বাঁচেনা, দোয়া কর ওনার জন্য।”

মিসেস ইশানি ইরাকের মাথায় হাত বুলিয়ে বলতে থাকে,
-“দেখ আব্বু,তুই সবার বড়।শক্ত হ,তোরা মা হারিয়েছিস আর আমরা বোন।তোদের কষ্ট হয়তো অনুভব করতে পারবোনা,তবে এতটুকু বলবো ইমনের কথা ভেবে শক্ত হ।ছেলেটা তখন থেকে কেঁদেই চলেছে…”
-“ও খালা,ক্যাম্পে গেলে মা রোজ নিয়ম করে খাওয়ার আগে ফোন করতো,যখনি কোনো গন্ডোগোল হতো মা সবার আগে আমাকে ফোন করে খবর নিতো ঠিক আছি কীনা,নামাযের পাটিতে বসে দোয়া করতো।ফোন করে বলতো,আব্বু তুই ভালো আছিস,আব্বু তুই খেয়েছিস,আব্বু কোনো সমস্যা নেই তো,আব্বু তুই কবে আসবি,তোর ছুটির জন্য অপেক্ষা করি।এসব কথা যে আর কেউ ফোন করে বলবেনা যে খালা…..”
ইফাজ কান্নার জন্য কথা বলতে পারছেনা।সকালের দিকে যে বাড়িতে হাসির কলোরব ছিলো সেই বাড়ি এখন শোকে ঢেকে আছে।ইরাক আবরারের দিকে তাকিয়ে বলে,
-“পিচ্চি কী একা আছে?”
-“না,তোর ফুফাতো বোন আর ইয়ামিলা আছে।ঘুমাচ্ছে,চিন্তা করিসনা।”
-“না চিন্তা করে কী করবো,ওর মেন্টালি কন্ডিশন ঠিক নেই।তাছাড়া ও নিজের বোন হয় বলেই চিন্তা করি,চোখে চোখে রাখিস…”

ভোর ছয়টার দিকে ইয়ারাবীর ঘুম ভাঙলে নিজেকে রুমে আবিষ্কার করে।ওর পাশে জারবা আর ইকরা বসে আছে।হঠাৎ ওর সবকিছু মনে পড়তেই ও উঠে বসে।ইকরা ওর কপালে হাত দিয়ে দেখে এখনো গায়ে জ্বর আছে,জারবা বলে,
-“ভাবী উঠেনা প্লীজ..”
-“খা খালামনি কোথায়?আমি যাবো ওখানে,একটু নিয়ে যাবে..”
-“কিন্তু…”
ইকরা ওর মাথায় হাত দিয়ে বলে,
-“পরে যাও,তোমার হেলথ কন্ডিশন ঠিক নেই, তাছাড়া জানাযা দশটার দিকে।”
-“আমি এখনি যাবো…”
জারবা ইয়ারাবীকে নিয়ে বাইরে বেরিয়ে দেখে লোহার খাটিয়ায় সাদা কাফনের কাপড় দিয়ে মুড়িয়ে রাখা হয়েছে।জারবাকে সরিয়ে দিয়ে ও খালার খাটিয়ায় কাছে যেয়ে জোরে জোরে কান্না করতে থাকে।কে কাকে থামাবে?শক্ত একটা খুঁটি যে হারিয়ে গেলো।সবার মধ্যে ইনি একমাত্র ব্যাক্তি ছিলেন যিনি বুঝে শুনে কাজ করতেন।কারোর প্রতি অন্যায় হতে দিতেন না।ইয়ারাবীকে কেউ সরাতে পারছেন।ওর কান্নায় গলা ভেঙে গেছে, ইমনও পাগলামি শুরু করেছে।ওর বন্ধু শাহরিয়ার ওকে সামলাচ্ছে কোনো মতে।আবরার ইয়ারাবীর কাছে যেয়ে ওকে তুলার চেষ্টা করে বলে,
-“ইয়ারাবী,খালার কষ্ট হবে এভাবে কাঁদলে।মৃত্যু মানুষের জন্য দোয়ার প্রয়োজন,কান্না করলে ওদের আত্না কষ্ট পায়।”

ইয়ারাবী আবরারকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে চিৎকার করে বলে,
-“আপনি কাকে মৃত বলছেন?আপনার তো সাহস মন্দ না।আর খালামনিকে এভাবে পেঁচিয়ে রেখেছে কেন?এমন করলে মানুষ কষ্ট পায় জানেন না।খালামনি এখনি উঠে বসবে।আমাকে মা বলে ডাকবে,আর আপনি তাকে মৃত বলছেন।”
-“কী বলছো তুমি এসব?তোমার খালা মারা গেছে সোনা,বুঝার চেষ্টা করো।”
-“না খালামনি ঘুমাচ্ছে।আর আপনারা ওনাকে মেরে ফেলছেন?”

আবরার ইয়ারাবীকে দুই বাহু ধরে ঝাঁকিয়ে বলে,
-“হুশে আসো ইয়ারাবী,উনি ঘুমাচ্ছেনা মারা গেছে।এমন কেন করছো তুমি?”

ইরাক এসে ইয়ারাবীর মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,
-“অবুঝের মতো কথা বলিশ না পিচ্চি,মা আর নেই।ফাঁকি দিয়ে চলে গেছে,”
-“ভাইয়া তুমিও,তাহলে আমাকে কেউ মা বলে ডাকবেনা।সমস্যা হলে,মায়ের ভালোবাসা লাগলে,দুঃখ কষ্টের কথা এসে কার কাছে বলবো?আমার তো খালামনি ছিলো যার কাছে সব কথা বলতাম।আমার মাথার ছায়া হয়ে ছিলো এতেদিন,সেই ছাঁয়াও চলে গেলো।আচ্ছা ভাইয়া বলতো আমার সাথে এমন কেন হয়?আমার প্রিয় জিনিসগুলো এভাবে চলে কেন যায়?”

ইরাকের কথাগুলো শুনে বুকের ভিতর ছিড়ে যাচ্ছে।ঠিকই তো বলেছে,ওর মা ছিলো একমাত্র ছায়া যার জন্য ইয়ারাবী এই পর্যন্ত বেঁচে আছে।সকল ঝড়-ঝাপটা থেকে মেয়েকে বাঁচিয়ে রেখেছে।
-“কে বলেছে তোর কেউ নেই?তোর সব আছে সোনা,আবরার যে তোর একটা শক্ত খুটি।”

ইয়ারাবী কোনো কথা না বলে কাঁদতে থাকে।তৌফিক ওদের দিকে তাকিয়ে বলেন,
-“এই দু’জনকে সামলাও,নয়তো আপুর সাথে আরো নতুন দু’টা কবর খুঁড়তে হবে।যেভাবে কাঁদছে এরা,তাতে মারা যেতে বেশি সময় লাগবেনা।”
য়ুহার মনে মনে একটা কথায় ভাবছে,
-“ফুপু তুমি আমার আগে কেন চলে গেলে?তোমার তো আরো বেঁচে থাকার দরকার ছিলো।”

ঘনিয়ে এলো সেই সময়,জানাযার জন্য মিসেস রহমানকে নিয়ে যাওয়া হলো।ইমন প্রচুর কান্না করতে ছিলো,তাই লাশের খাটিয়া ইরাক,ইফাজ,তৌফিক আর মি.রহমান ধরলেন।এরা এক একজন প্রচুর সুস্থ সবল মানুষ,তবুও এদের দেখে মনে হচ্ছে লাশের খাটিয়ার ভর এরা নিতে পারছেনা।অনেক কষ্টে ইমন আর ইয়ারাবীকে আটকে রাখা হয়েছে।মেয়ে কেঁদে কেঁদে অসুস্থ হয়ে পরেছে তবুও একবারের জন্য ওর বাবা-মা ওর কাছে ঘেষেনি।আবরার ওর মা আর ভাবীর কাছে ইয়ারাবীকে রেখে গেছে।মেয়েটা এখন ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে, মিসেস রায়হান সবকিছু জানেন এর ব্যাপারে তাই তিনি সবটাই বুঝতে পারছেন।মিসেস রহমানকে দাফন সম্পূর্ন করে সবাই ফিরে আসে।কবরটা বাসার পাশে দেওয়া হয়েছে,উনি জীবিত অবস্থায় বলতেন যেন উনার করব বাসার পাশে দেওয়া হয়।যাতে ওনার সন্তানরা মায়ের কবরকে রোজ জিয়ারত,আর পাশে বসে কোরআন শরীফ পড়তে পারে।

ইমনকে অনেক বোঝানোর পর কিছুটা চুপ হয়ে আছে।হঠাৎ করে ইয়ারাবী বেড থেকে উঠে ওয়াশরুমে যেয়ে বমি করতে থাকে।সেটা মিলিস্তা খেয়াল করার পর জারিকার কাছে যেয়ে বলে,
-“আপু খবর কী কিছু জানো?”
জারিকা এক প্লেট খিচুরি নিয়ে বসে খেতে খেতে বলে,
-“কীসের খবর?”
-“মনে হয় ইস্মার হবে।”
-“ইয়ারাবীর আবার কী হবে?”
-“আরে গাধী,ও একটু আগে বমি করছিলো ওয়াশরুমে।তারমানে বুঝতে পারছোনা….”
-“প্রেগন্যান্ট….তার মানে ওদের মধ্যে সব কিছু হয়ে গেছে”

জারিকা কথাটা কিছুটা চিল্লিয়ে বলে।য়ুহার ওর মা আর কিছু পরিচিত মানুষদের সাথে রান্নার খাবারের ব্যাবস্থা করছে।সেখানে পল্লবীও হাতে হাতে সাহায্য করছে।পল্লবী য়ুহারকে খুঁচিয়ে বলে,
-“আপু ইয়ারাবী নাকী প্রেগন্যান্ট?”

কথাটা শুনার সাথে সাথে ওর মাথা ঘুরে উঠে।একজন মানুষ মারা গেছে এরা আজগুবি কথা বের করছে।য়ুহার কিছুটা রেগে ওর দিকে তাকিয়ে বলে,
-“এসব আজগুবি কথা তোকে কে বললো?আর ইয়ারাবী কোন দুঃখে প্রেগন্যান্ট হতে যাবে?”
-“জারিকা বললো তাই,আর কোন দুঃখে মানে?ও বিবাহিত,হতে কতক্ষণ।”

য়ুহার জারিকার সামনে যেয়ে বলে,
-“তোকে কে বললো ও প্রেগন্যান্ট?”
-“মিলিস্তা ওকে বমি করতে দেখেছে,তাছাড়া একবার তো বেহুশঁ হয়ে গেছিলো।”
-“অল্প বিদ্যা ভয়ংকরী,তাই হলো তোদের অবস্থা।একজন মা মারা গেলে সন্তান তো স্বাভাবিক ভাবে অসুস্থ হবে।আর ইয়ারাবী ফুপুকে নিজের মা ভাবতো।বারো ঘন্টা জার্নি করে সোজা এখানে এসে যদি এমন খবর শোনে তবে কোনো মানুষের পক্ষে সুস্থ থাকা সম্ভব নয়।আর তোরা এক একটা মুর্খের দল ওসব বুঝবিনা।”
জারিকা খানিকা উৎসাহিত কন্ঠে বলে উঠে,
-“তার মানে ওদের মধ্যে কিছু হয়নি।তাই তো বলি ও কীভাবে মা হতে পারে?”
-“কিছু হয়েছে কী হয়নি আমি কীভাবে বলবো?তবে ও প্রেগন্যান্ট না,তাই আলতু-ফালতু কথা বারিয়ে মাথা নষ্ট করবিনা।তবে তুই এত খুশি হচ্ছিস কেন?”
জারিকা কিছুটা থতমত খেয়ে যায়,ও ইনিয়ে-বিনিয়ে য়ুহারকে বলে,
-“না মানে ছোট বয়সে বাচ্চা নিলে সমস্যা হয় তাই..”
-“তুই কবের থেকে ওর ভালো চাইলি,আমার মতে ওর ভালো চাওয়ার থেকে খারাপ চাওয়া লোকের তালিকা অনেক বড়।”
য়ুহার কথাটা বলে ওখান থেকে যেতেই জারিকা যেন হাফ ছেড়ে বাঁচলো।মিলিস্তা সন্দেহের দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে বলে,
-“তুই এত খুশি কেন হচ্ছিস বলতো?”
-“খুশি কেন হবো আমি,ফালতু বকিস না।সর এখান থেকে তোর ভাইয়াকে খেতে দিতে হবে।”

(১২৩)

মিসেস জামানরা কেউ মুখে খাবার নিতে পারছেন।আত্মীয়রা অনেক বুঝিয়ে তাদের খাওয়াচ্ছে।ইরাক-ইফাজ ভিতর থেকে ভেঙে পড়লেও বাইরে সেটা প্রকাশ করছেনা।ওরা নিজেরা বাবাকে জোর করে খাইয়ে নিজেরাও কিছু খেয়ে ইমনকে খাওয়ানোর চেষ্টা করছে।কিন্তু ইমন কিছুতেই খাবেনা।মিসেস ইশানি ইমনকে বুঝিয়ে নিজের হাতে খাইয়ে দেয়।মিসেস রায়হানদের খাবারের জন্য ডাকলে ওনারা খেতে মানা করে দেন।আবরারকে খেতে দিলে ওর খাবার নিয়ে ইয়ারাবীর কাছে যায়।যেয়ে দেখে ওর মায়ের বুকে মাথা রেখে চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে।মিসেস রায়হান ছেলেকে দেখে বলেন,
-“কিছু বলবি?”
-“হ্যাঁ,মম আসলে বাইশ-তেইশ ঘন্টা ধরে ও তেমন কিছুই খায়নি।যার জন্য মেডিসিন না নেওয়াতে হেল্থ বেশি খারাপ হয়ে গেছে।খাবার এনেছি খাওয়াতে হবে।”
-“ওর সেই বোন পল্লবী খাবার নিয়ে এসেছিলো কিন্তু কিছুই খেলোনা।দেখ তুই কিছু খাওয়াতে পারিস নাকী?”

ইয়ারাবী চোখ বন্ধ করে রেখেই বলে,
-“আম্মু ওনাকে যেতে বলেন,আমি কিছু খাবোনা।”
-“খাবোনা মানে,গলা থেকে স্বর বের হচ্ছেনা আর উনি খাবেনা।দেখি উঠে বসো।”
-“আপনি কথা বলবেন না,আপনি…আপনি জানতেন খালামনি আরে নেই কিন্তু আপনি বলেননি।মিথ্যা বলেছেন আমাকে,আপনি মিথ্যুক..”

আবরার কী বলবে বুঝতে পারছেনা।হ্যাঁ,লাস্ট ওর ফোনে যে ম্যাসেজ আসছিলো সেটা ইরাক পাঠিয়েছিলো।আর সেটাই লেখা ছিলো,”মা আর নেই,পিচ্চিকে নিয়ে দেশে আয়।ওকে কিছু বলার দরকার নেই,সহ্য করতে পারবেনা।”আবরারও জানতো ওকে তখন কিছু বললে আরো বেশি সমস্যা হতো।তার জন্য ওকে মিথ্যা বলে নিয়ে আসে।মিসেস রায়হান ইয়ারাবীর মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,
-“আম্মু দেখ,আবরার যেটা করেছে তোর ভালোর জন্য করেছে।সোনা কিছু খেয়েনে।তিন-চারবার বমি করেছিস,এবার কিন্তু সিরিয়াস কিছু হয়ে যাবে।”
-“হোক…”
-“দিবো একটা থাপ্পড়,আমি জানি তোর মা থেকেও নেই।তাই তুই তোর খালাকে তোর মায়ের জায়গায় বসিয়েছিলি আর উনি তোকে মেয়ের আসনে।”

ইয়ারাবী অবাক হয়ে শ্বাশুড়ির দিকে তাকায় তো একবার আবরারের দিকে।আবরার ইশায়ার বোঝায় ও কিছু বলেনি।আসলে ইয়ারাবীও ওকে বেশি কিছু বলেনি তবে উনি জানলো কীভাবে?মিসেস রায়হান ওর মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,
-“আমি সব জানি,তবে এটা ভেবোনা এই বাদর বলেছে আমাকে।ইয়ারাবী আমি কিন্তু মা হিসাবে খারাপ না মা,তুই যেভাবে উনার সাথে নিজের সব কথা বলতে পারতি আমার সাথেও পারবি।”
-“খালামনির জায়গা কাউকে দিতে পারবোনা।”
-“চাইনা আমার,তবে এখন একটু খেয়েনে।”
-“আম্মু আমি খাবোনা,প্লীজ জোর করবেননা।”

-“কে খাবেনা?”
আবরার দরজার দিকে তাকিয়ে দেখে ইরাক ভিতরে ঢুকছে।আবরার ওর দিকে তাকিয়ে বলে,
-“তোমার বোন খাবেনা…”
-“তোরা দু’ভাই বোন মিলে কী শুরু করেছিস বলবি আমাকে।ওটাকে তো খালা বুঝিয়ে খাওয়ালো কিন্তু তুই তো ঘাড়ত্যাড়া,হাজার বুঝালেও বুঝিসনা।”

ইয়ারাবী অবাক হয়ে ওর ভাইয়ের দিকে তাকায়।কতটা সহজ ভাবে কথা বলছে?তাহলে কী আর্মিদের হৃদয় পাথরের হয়?সেটা কী করে সম্ভব, ও ইরাককে চিনে।তাহলে ওর ভাইয়া এভাবে কেন কথা বলছে?
-“ভাইয়া,তুমি ঠিক আছো?”
-“আমার কী হবে?আমি ঠিক আছি,জানি মায়ের জন্য তোর পরাণ পুড়ছে।কিন্তু সোনা কান্না করলে কী চলবে?মায়ের জন্য দোয়া কর,মা যেন জান্নাতে যেতে পারে।”

ইয়ারাবী ওর ভাইয়ের বুকের মধ্যে মাথা দিয়ে কাঁদতে থাকে।ওর ভাইও নিজেকে আটকাতে পারেনা,ও চোখের জলও বিসর্জন করে তবে নিঃশব্দে।আসলে ছেলেরা যতটা শক্ত দেখায় তারা ততটা শক্ত হয়না,তাদেরও মন আছে।তারা পাষাণ নয়,তবে খুব সহজে অনুভুতি আড়াল করতে পারে।

রাত বাজে প্রায় একটা,কারো চোখে ঘুম নয়তো কেউ জেগে আছে।আর ইফাজ ওর মায়ের কবরের পাশে বসে আছে।ঘুম আসছিলোনা,শান্তি পাচ্ছিলোনা কিন্তু এখানে এসে কিছুটা মন স্থীর হয়েছে।হঠাৎ ওর কাঁধে কারো স্পর্শ পায়।ফিরে তাকিয়ে দেখে তারা দাঁড়িয়ে আছে।চোখের কোনে জল চকচক করছে।আসলে প্রিয়জনের কষ্ট কেউ সহ্য করতে পারেনা,বুকের ভিতর তীরের আঘাতের মতো সব ক্ষত-বিক্ষতের যন্ত্রনা হয়।তাই মনে হয় তারার ক্ষেত্রে হয়েছে।
-“এত রাতে এখানে কী করো?বাসায় যাওনি?”
-“না হয়নি,পুতুল এখানে আছে।তাই আপনার ভাইয়া বললো থাকতে।”
-“মেয়েটার শরীর ভালো না,জোর করে খাইয়ে ঘুম পারিয়ে রাখছে।”
-“আপনি ঘুমাবেন না।”
-“ঘুম যে আসবেনা,আমার ঘুমটা যে এখানে শান্তির ঘুম দিচ্ছে।জানো যখন কোনো অস্বস্তি বা ক্লান্তি ফিল করতাম তখন মায়ের কোলে মাথা রেখে ঘুমাতাম।কিন্তু আজকের পর থেকে আর কারো কোলে মাথা রাখতে পারবোনা।ডাক্তার হয়ে কী করলাম বলো?নিজের মাকে বাঁচাতে পারলাম না।”
-“জন্ম-মৃত্যু কারো হাতে নেই,সব উপর আলার ইচ্ছা অনুযায়ী হয়।এখানে আপনার কিছু করার ছিলোনা।”

#চলবে_____

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here