#জীবন মানে তুমি
#লেখিকা:H.B.Rini (Irini Ori)
#পর্ব:২৫
(৯১)
এলার্মের আওয়াজে আবরারের ঘুম ভেঙে যায়।আস্তে করে বামহাতটা দিয়ে এলার্মটা বন্ধ করে দিয়ে ইয়ারাবীর দিকে তাকায়।মেয়েটা কাল রাতে ঠিক যেভাবে ওর বুকে ঘুমিয়ে ছিলো এখনো সেভাবে আছে।খুব ভয় পেয়েছিলো রাতে,তবে মেডিসিন দেওয়ার কারনে জ্বরটা আসেনি।দূর থেকে আযানের মিষ্টি ধ্বনি শোনা যায়।এই সুরের সাথে অন্যকোনো কিছুর তুলনা হয়না।আযানের সুর শুনলেই মনের মধ্যে এক শান্তি কাজ করে।
তবে আবরারকে আর শুয়ে থাকলে হবেনা উঠে নামায পড়তে হবে।কিন্তু ইয়ারাবী যেভাবে ঘুমিয়ে আছে ওকে না জাগিয়ে ওর পক্ষে উঠা সম্ভব নয়।আবার ওকে জাগাতেও ইচ্ছা হচ্ছে,মনে হচ্ছে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে যুগ যুগ পার করে দিতে। আবরার আস্তে করে ওর মাথায় আর পিঠে হাত বুলাতে বুলাতে ওকে ডাকতে থাকে।ওর একটু নড়ে উঠে আবার ঘুমিয়ে পরে।আসলে কাল অনেক রাতে ঘুমিয়েছে,এজন্য ওর মাথাও খুব ভার হয়ে আছে।আবরারের না চাইতেও ওকে ডাকতে হয়।কারো আলতো ডাকের আওয়াজে ইয়ারাবীর ঘুমটা ভেঙে যায়,মাথা প্রচুর ভার হয়ে আছে…মনে হচ্ছে কেউ লোহার কোনো ভারী বস্তু দিয়ে রেখেছে।ও পিটপিট করে চোখ খুলে আগে বুঝার চেষ্টা করে ও কোথায়।যখন দেখে ও আবরারের বুকে ঘুমিয়ে আছে তখন ওর সব ঘুম উড়ে যায়।ওর কাল রাতের এর কথা মনে পরতেই লাফ দিয়ে দূরে সরে যেয়ে মাথা নিচু করে বলে,
-“স্ সরি,আ্ আমি আসলে বুঝ্ বুঝতে পারিনি, আমার জন্য আপ আপনার কষ্ট হলো।”
আবরার মুচকি হেসে বলে,
-“পুরো আমিটা তো তোমার।আর আমার দশটা নয় পাঁচটা নয় একটা মাত্র বৌ তার জন্য কষ্ট করবো নাতো কার জন্য করবো।তাছাড়া আমার অনেক ইচ্ছা ছিলো বিয়ের পর আমার বৌ আমার বুকে ঘুমাবে,বুঝলে।”
ইয়ারাবী আবরারের কথা শুনে অবাক হয়ে যায়,কেননা প্রায় আবরার এমন এমন ককথা বলে যা শুনে ওর খুব লজ্জা লাগে।ওর ওভাবে তাকিয়ে থাকা দেখে আবরার আড়মোড়া ছেড়ে হেসে বলে,
-“তুমি এখন আরেকটু ঘুমিয়ে নাও,মাথা ব্যাথা করছে তো।আমি ততক্ষণে নামায আদায় করেনি।”
-“আপনি জানলেন কীভাবে আমার মাথা ব্যাথা করছে?”
-“দেখো কান্না করলে অনেক মানুষের মাথা করে।আর সেখানে তো তোমার আরো….খুব বেশি প্রশ্ন করো তুমি।”
আবরার বিছানা থেকে উঠে দাঁড়াতেই ইয়ারাবীর ওর হাত ধরে বলে,
-“আপনি কী বলছিলেন,আমার আরো?”
আবরার ইয়ারাবীর চুলগুলো একপাশে দিয়ে বলে,
-“কিছুনা,এতো চিন্তা করো সেটাই বলছিলাম।দেখি নামাযের টাইম আবার চলে যাবে।”
-“আমিও তো পড়বো,এতো ব্যাস্ত কেন হচ্ছেন?”
আবরার হেসে বলে,
-“আজ মাসের কয় তারিখ?”
-“কেন চার তারিখ,কী হয়েছে?”
-“কিছুনা আগে তুমি ফ্রেস হয়ে এসো তখন বুঝতে পারবে।”
ইয়ারাবী আবরারের কথার আগামাথা কিছু বোঝেনা।তবুও ও আগে ওয়াশরুমে যেয়ে আধাঘন্টা পরে ফিরে এসে চুপচাপ ব্লাঙ্কেটের ভিতর ঢুকে যায়।আবরার হাসতে হাসতে বলে,
-“এখন বুঝেছেন তো ম্যাডাম আমি ঠিক কী বলেছি?”
ইয়ারাবী মাথা নিচু করে বলে,
-“খুব ঘুম পাচ্ছে,সাতটার দিকে ডেকে দিবেন প্লীজ।”
-“ঘুমাও….”
কথাটা বলে হাসতে হাসতে আবরার ওয়াশরুমে চলে যায়।আবরার ওযু করে এসে দেখে ইয়ারাবী ঘুমানোর চেষ্টা করছে।ও আর ওকে বিরক্ত না করে নামাযে দাঁড়িয়ে যায়।নামায শেষ করে ঘুরে দেখে ইয়ারাবী ঘুমিয়ে পরেছে।তবে ঘুমানোর সময় ওর কিছু ঠিক থাকেনা।বালিশ একদিকে তো মাথা আরেকদিকে, রোজ রাতে আবরার ওকে ঠিক করে দেয়।আবরার জায়নামাজটা ভাঁজ করে টুপি খুলে কাবার্ডে রেখে ওকে ঠিক করে শুয়ে দিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে যায়।
-“কী ব্যাপার দেবর মশাই,আপনি আজ কিচেনে কেন?”
আবরার ঘুরে তাকিয়ে দেখে ইকরা কিচেনের দিকে আসছে।আবরার হেসে বলে,
-“তেমন কিছুনা,এক কাপ কফি….”
-“তুমি তো জগিং এর আগে কিছু খাওনা,তো হঠাৎ রুলস্ ব্রেক করছো?”
-“আজ যেতে ইচ্ছা করছেনা তাই।”
-“আচ্ছা তুমি দাঁড়াও আমি বানিয়ে দিচ্ছি।”
-“না ভাবী,তুমি থাকো আমি করছি।যদি নিজে না করতাম তাহলে সার্ভেন্টকে বলতাম বানিয়ে দিতে।তুমি বরং তোর বরের জন্য চা করে নিয়ে যাও।”
-“আবরার ও কিন্তু তোমার বড়ো ভাই হয়….”
-“বড়ো ভাই বলেই তো পিন্চ করতে মজা লাগে,ও ভাবী আমারও কফি চাই….”
মেঘ ঘুমঘুম চোখে সিড়ি দিয়ে নামতে নামতে বলে।ইকরা ওর দিকে তাকিয়ে হেসে দেয়।
-“তো মেঘ বাবুর এতো সকাল সকাল ঘুম ভেঙে গেলো।তুমিতো নামায পড়ে আবার ঘুমাও।”
-“আর বলোনা,জীবনটাই পুরো বেদনাদায়ক।শীত কালে একা ঘুমানো যায়।এই বাড়ির কেউ কষ্টটা বুঝেনা।”
আবরার মেঘের কান টেনে বলে,
-“বাদরামির আর জায়গা পাসনা,আগে লেখাপড়া পরে বিয়ে।”
-“আহ্,ছাড়ো।আচ্ছা বাবা আর বলবোনা…”
ইকরা কফি বানাতে আবরারকে উদ্দেশ্য করে বলে,
-“ইয়ারাবীকে কিছু বলেছো?”
-“না ভাবী,ওকে বাইরের থেকে যতটা স্ট্রং দেখা যায় ভিতর থেকে ততটা নয়।কাল ওর বোনের নামটা শুনার পর থেকে খুব হাইপার হয়ে গেছিলো,এই অবস্থায় কিছু জিজ্ঞেস করা উচিত হবেনা।”
ইকরা আর কিছু না বলে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে।বোনকে খুব ভালোবাসতো ইকরা,কেননা ওদের মা ছিলোনা।ইলা তার সব ইচ্ছা ইকরাকে জানাতো, তবে খুব জেদি ছিলো।নিয়তির উপর কারো হাত নেই।সকালবেলা বোনের সাথে কত মজা করলো, আর দুপুরের দিকে শুনতে পেলে তার আদয়ের বোনটা আর নেই।ইকরার পৃথিবী যেনো ওখানে থেকে গেছিলো,নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিলো ওর।কারো সাথে তো ইলার কোনো শত্রুতা ছিলোনা, তাহলে কে মারলো ওকে?
কথাগুলো ভাবতেই ইকরার চোখে পানি চলে আসে।কোনোভাবে নিজেকে সামলিয়ে কফি তৈরি করে ওদেরকে দিয়ে রুমে চলে যায়।মেঘ কফি হাতে করে আবরারের দিকে সূক্ষ্মদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।আবরার ওর তাকানোর ভঙ্গি দেখে ভ্রু নাচিয়ে বলে,
-“আমার কী দেখতে এলিয়েন লাগছে নাকী?”
-“ভাইয়া,একটি সত্যি কথা বলবে?”
-“কী?”
-“কেসটা কী তুমি আবার….”
আবরার মেঘকে আর কিছু বলতে না দিয়ে বলে,
-“পড়তে বস,আমি রুমে যাচ্ছি।”
মেঘ হালকা হেসে বলে,
-” হুমায়ূন আহমেদ একটা গল্প “আজ হিমুর বিয়ে” তে একটা লাইন পড়েছিলাম-“পৃথিবীতে আনন্দ এবং দুঃখ সব সময় থাকবে সমান সমান। বিজ্ঞানের ভাষায়-Conservation of আনন্দ। একজন কেউ চরম আনন্দ পেলে,অন্য জনকে চরম দুঃখ পেতে হবে।”কথাটার সাথে কিন্তু বাস্তবতার অনেক মিল ভাইয়া।তাই তুমি এমন…”
-“পাগলিটাকে বড্ড ভালোবাসি,জীবনের মানেটাই যে ও।”
কথাটা বলে আবরার রুমে চলে যায়।এই বাড়িতে এক এক মানুষ এক এক রকমের।কেউ মুখ ফুটে বলতে পারে,নয়তো কেউ কাজে তার কথাগুলো প্রকাশ করে,কেউ আবার লুকায় আর কেউ কেউ কষ্টকে নিজের মনের এককোনে আবদ্ধ করে রেখে চুপ করে থাকে।এজন্যই বলে মানুষ বিচিত্র প্রাণী।আচ্ছা জীবনটা এতো জটিল কেন? কেন জীবনের প্রতিটা পদক্ষেপে সংগ্রাম করতে হয়,প্রতিটা মুহুর্তে চাকতপাখির মতো উজ্জ্বল দিনের আশায় চেয়ে থাকতে হয়?
ইকরা আবীরের বুকে মাথা রেখে অনেকক্ষণ চুপচাপ শুয়ে আছে।আবীর কফির মগটা টেবিলে রেখে ওকে জড়িয়ে ধরে বলে,
-“এভাবে মন খারাপ করলে হবে ইকরা?তুমি কান্না করলে ওর আত্মা কষ্ট পাবে তো?”
-“আবীর আমার বোনটাতো কারো কোনো ক্ষতি করেছিলোনা,তাহলে কেন এমন হলো।তুমিতো জানো,মা ওকে জন্ম দিয়ে মারা যায়।তখন থেকে আমি ওকে নিজের কোলে পিঠে করে বড় করেছি, ও আমাকে আপুমা বলে ডাকতো সব সময়।আমি যখন শুনতাম,”তুই আমাকে আপুমা বলিস কেন?” ও কী বলতো জানো,বলতো,”তুমি আমার আপু হলেও মায়ের আদর তোমার কাছে থেকে পেয়েছি, কখনো মায়ের অভাব বুঝতে দাওনি।তাছাড়া তোমার শরীর থেকে মা মা গন্ধ পায় তাই।”আজও কথাগুলো আমার কানে বাজে আবীর।”
-“আমি জানি তোমাদের কষ্টের পরিমাপ কেউ করতে পারবেনা।ও আমারও বোন ছিলো,খারাপ আমার ও লাগে।তুমি ইয়ারাবীকে দেখেছো,শুনেছি ওর বোন মারা যাওয়ার পর ছোট বয়সে ডিপ্রেশনে চলে গেছিলো।তাছাড়া একবার ভেবে দেখো ওর ওপর আরো কী কী গেছে?”
আচ্ছা কাউকে হারানোর যন্ত্রনা কী এতোটাই কঠিন?এতোটাই গভীর হয় যে সুস্থভাবে বাঁচা মুশকিল হয়ে যায়,যে প্রতিটা মুহুর্ত সেই মানুষটির স্মৃতি তাকে কুড়ে কুড়ে খাই।হয়তো সেই মানুষটাই বলতে পারবে যে হারিয়েছে।ইকরা নিজের চোখের পানি মুছে বলে,
-“মেয়েটা খুব ভালো জানো..”
-“ঠিকই বলেছো”
ইকরা খানিকা চুপ থেকে আবার বলে,
-“আবীর?”
-“হ্যাঁ বলো…”
ইকরা আবীরের বুক থেকে মাথা উঠিয়ে বলে,
-“আচ্ছা এই বেডটা খুব ছোট হয়ে গেছে,তোমার মনে হয়না আরেকটু বড় বেডের দরকার?”
-“এতো বড় বেডকে তুমি ছোট বলছো,তাছাড়া রাতে তো তুমি আমাকে কোলবালিশের মতো মনে করে ঘুমাও।আর পুরো রাজ্য খালি পরে থাকে।”
-“হাদারাম,এই বেডটা তিনজনের জন্য খুব ছোট হবে…”
কথাটা বলেই ইকরা একটা মুচকি হেসে দু’হাত দিয়ে মুখটা ঢেকে ফেলে।আবীর বোকার মতো ওর দিকে তাকিয়ে বলে,
-“আমরা তো দু’জন,এই তৃতীয়…..একমিনিট,সত্যি ইকরা।”
-“পাশে ড্রয়ারে রাখা আছে দেখে নাও…”
আবীর টেবিলের ড্রয়ার থেকে কিটটা বের করে দেখে এক মিনিটের জন্য স্তব্দ হয়ে যায়।ও ইকরার সামনে ফ্লোরে হাটুগেরে বসে ওর পেটে হাত রেখে বলে,
-“সত্যি ইকরা,আমাদের একটা ছোট বেবি হবে।ঠিক এখানে আছে আমাদের অস্তিত্ব।কিছুমাস পরে আমাদের কাছে আসবে।আমি বাবা হবো আর তুমি মা।ছোট ছোট হাত-পা নাড়াবে,যখন ওর সাথে কথা বলবো ও হাসবে,কান্না করলে বুকে জড়িয়ে নেবে,রাতে কোলে নিয়ে হেঁটে হেঁটে ঘুম পারাবো, আধো আধো কন্ঠে ডাকবে আমাদের,একপা দু’পা করে হাটা শিখাবো ওকে।আমার ভাবতেই কী ভালো লাগছে তোমাকে বুঝিয়ে বলতে পারবোনা।”
ইকরা একদৃষ্টিতে আবীরের দিকে তাকিয়ে আছে,আসলে বাবা-মা হওয়ার একটা আলাদা অনুভুতি আছে…যেটা আবীর জানার পর থেকে ফিল করছে।ও ইকরার পেটে একটা আলতো করে চুমু দিয়ে বলে,
-“আমার মাম্মাম আমার প্রিন্সেসটা ঠিক এখানে আছে..”
ইকরা ওর দিকে ভ্রু কুচকে তাকিয়ে বলে,
-“মোটেও না,প্রিন্স আছে এখানে..”
-“না আমার প্রিন্সেস চাই…”
-“সবাই তো ছেলে বেশি চাই তাহলে তুমি মেয়ে কেন চাইছে?”
ওর ইকরার পেটে হাত রেখে বলে,
-“কারন আমি জান্নাতে যেতে চাই,যে বাবার মেয়ে আছে তার থেকে ধনী ব্যাক্তি আর কেউ নেই।জানো যার তিনটা কন্যা সন্তান আছে আর যদি তাদেরকে আল্লাহর রাস্তায় সুশিক্ষা দিতে পারে তাহলে সে আমাদের নবীজির সাথে জান্নাতে যেতে পারবে।তাছাড়া যাদের একটা কন্যা সন্তান আছে তারাও জান্নাতে যাবে।”
-“সত্যি আমি ধন্য তোমার মতো হাসবেন্ড পেয়ে।”
-“আমিও,আচ্ছা আমি সবাইকে জানিয়ে আছি..”
আবীর বের হতে গেলে ইকরা ওর হাত টেনে বলে,
-“এই পাগল হলে নাকী,আমার তো লজ্জা লাগে,তাছাড়া বাবা-মা নামায পড়ে আবার ঘুমাচ্ছে। ব্রেকফাস্টের সময় বলো।”
আবীর নিজের মাথায় একটা চাটি মেরে বলে,
-“এক্সাইটমেন্টে সব ভুলে গেছি,আসলে আমার ভাবতেই…মনে হচ্ছে এখনি যদি বেবীকে কোলে নিতে পারতাম।”
-“বেবীকে কোলে নেওয়ার অনেক দেরী,এখন বেবীর মাকে কোলে নিলেই হবে।”
-“অবশ্যই আমার রানী,কিন্তু কিন্তু কিন্তু।আজ থেকে হাঁটাচলা কম করবে।যদিও আমাদের বাসায় মেড আছে তবুও কিচেনে পা রাখবেনা।কোনো মতে ফ্লোরে বসবেনা।আর ভা…”
-“এই যে বেবীর জ্ঞানী বাবা,এসবের এখনো অনেক দেরী।এগুলো চার-পাঁচ মাস থেকে বুজলেন জনাব।”
-“না আমি অতো বুঝিনা,তুমি করবেনা মানে করবেনা ব্যাস।ইশ যদি ইন্জিনিয়ার না হয়ে ডাক্তার হতাম…”
ইকরা মুখ বাকা করে বলে,
-“এখনি বা কম কীসে?”
-“ও তুমি বুজবেনা,আমি চাইনা আমার প্রিন্সেস বা তার আম্মু কোনো ব্যাথা পাক।আরেকটু বেলা হলে ডাক্তারকে কল করবো।”
-“তুমি সত্যিই পাগল,মনে হচ্ছে এই প্রথম তুমি বাবা আর আমি মা হচ্ছি..”
আবীর ইকরার কথা শুনে হেসে ওর কপালে ভালোবাসার পরশ একে দেয়।সত্যিই কিছু কিছু মুহুর্ত আছে যা মানুষের কাছে জাদুর থেকেও অতুলনীয়।ইকরা নিজের মাতৃত্ব ফিল করছে অপরদিকে আবীর নিজের বাবা হওয়ার আনন্দ।দু’জনের অনুভুতি আলাদা হলেও সুঁতা কিন্তু একটাই।
(৯২)
-“আবরার আপনার কী মুড আছে?”
আবরার ইয়ারাবীর পাশে শুয়ে “দ্যা বুক থিফ” বইটা পড়ছিলো।হঠাৎ ইয়ারাবীর আওয়াজে ওর পাশে তাকিয়ে বলে,
-“উঠে পড়েছো?”
ইয়ারাবী ওর দিকে তাকিয়ে বলে,
-“অনেক আগেই ঘুমটা ভেঙে গেছে…”
-“বেশি খারাপ লাগছে?”
-“জানেন তো,হঠাৎ করেই এই কয়েকমাস ধরে এমন হচ্ছে।বুঝতে পারছিনা কারনটা কী?ডাক্তারকে বললে ওনি বললেন সব ঠিক আছে।”
আবরার ইয়ারাবীর মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,
-“উঠে ফ্রেস হয়ে নাও ব্রেকফাস্ট করতে হবে।”
ইয়ারাবী বসে চুলটা হাতখোপা করে চশমাটা চোখে দিয়ে বলে,
-“আমি কিন্তু কিছু জিজ্ঞেস করেছি?”
-“ইউ নো,প্রচুর খোদা লেগেছে।যাও ফ্রেস হয়ে আসো।”
ইয়ারাবী বুঝতে পেরেছে আবরার ওর প্রশ্নের উত্তর দিবেনা।তাই ও চুপচাপ বেড থেকে নেমে যেতেই আবরার ওর হাত ধরে ঘুরিয়ে দিয়ে বলে,
-“কিছু কিছু উত্তরের জন্য অপেক্ষা করতে হয়।মনের এক একটা শব্দকে সাজিয়ে একটা বাক্য তৈরি হতে কিছু সময় লাগে।কিছু কিছু চাওয়াগুলো পুরন না করাই ভালো।কারন কখনো কখনো এমন সব সত্যের মুখমুখি হই যা আমাদের কাছে বোধগম্য হয়ে উঠেনা।জানো ইয়ারাবী, হাসলে মানুষকে খুব সহজভাবে চেনা যায়।কারন সব মানুষ কান্না একভাবে করলেও হাসিটা হয় তাদের ভিন্ন ভিন্ন।”
-“আপনি কী বলেন সত্যিই আমি বুঝে উঠতে পারিনা।”
-“গরম পানি দিয়ে হাত-মুখ ধুবে…”
ইয়ারাবী আবরারের হাসি দেখে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে।মানুষটাকে সব সময় ওর কাছে অদ্ভুত লাগে।বিয়ের প্রথম ওই একবার ওর সাথে বাজে ব্যাবহার করেছিলো, তারপর থেকে আজ অব্দি পর্যন্ত কোনো খারাপ আচারন করেনি।প্রতিটা স্ত্রীর বিয়ের পর শ্বশুড়বাড়ি আর স্বামীর সেবা করতে করতে দিন কেটে যায়,নিজের জন্য কিছুই করতে পারেনা।কিন্তু এখন ইয়ারাবীর ক্ষেত্রে সেটা সম্পূর্ন উল্টো। অবশ্যই ইয়ারাবী অনেক সাবধানে কাজ করে,যদিও কোনো ভুল হয়ে যায় আবরার ওকে বুঝিয়ে বলে।যখনি ওর আবরারের প্রতি ভালো লাগা কাজ করে তখনি ওর মায়ের কথাটা ওর কানে বেজে ওঠে,
“তুই জীবনে সুখি হবিনা,সারাজীবন ধরে কাঁদবি।জেনে রাখ,তোর মতো অপয়া মেয়েকে কেউ তার সংসারে রাখবেনা।তুই মরিস না কেন?”
ইয়ারাবী চোখের পানি মুছে মুখে হালকা গরম পানির ঝাপটা দিয়ে আয়নার দিকে তাকায়।এই চেহারাতে প্রায় এক বছর আগে কত চিহ্ন ছিলো। অতীতের একদিনের ছবি হঠাৎ ওর চোখের সামনে ভেসে উঠে।
সময়টা ছিলো মার্চের শেষের দিকে,সুইসাইডের পর যখন ও হাসপাতালে নিজে পেলো তখন ওর খালা-খালু ওর সাথে তেমন কোনো কথা বলেনি।ইফাজ-ইমনও কেবিন থেকে বেরিয়ে চলে গেল।ওদের ওভাবে চলে যাওয়া দেখে ইয়ারাবীর খুব হাসি পেলো।সারা শরীরে অসম্ভব যন্ত্রনা করছে ওর,মাথার মধ্যে মনে হচ্ছে কেউ হাতুরি পেটাচ্ছে।কিছুক্ষণ বাদে ওর মা আর বড় খালা এলো।
ওনারা আসতেই ইয়ারাবী নিজের মুখটা বাম পাশে ঘুরিয়ে নেয়।যে সময় বাবা-মাকে খুব প্রয়োজন সেই সময়ই তারা ওকে অবহেলা করে।লোহায় যেমন মরিচিকার আস্তরণ পরে এক সময় ক্ষয় হয়ে যায় ঠিক তেমনি ওনাদের ব্যবহারে ওর মনটা ক্ষত-বিক্ষত হয়ে গেছে।হয়তো কিছু কিছু মানুষ কষ্ট পাওয়ার জন্য পৃথিবীতে আসে,নয়তো ইয়ারাবী কেন সুখের মুখ দেখলোনা?
মিসেস ইশানি মেয়ের মুখে হাত দিতে গেলেই ও দূরে সরে যায়।মেয়ের এরুপ আচারনে উনি রেগে যেয়ে বলেন,
-“বেশি বাড় ভালোনা,ঝড়ে ভেঙে যায়।তোর এখনো তেজ কমেনি।”
মিসেস জামান আগুনে আরো ঘি ঢেলে বলেন,
-“আরে ইশানি তেজের কী দেখলি,ফোন ভেঙে দিয়েছিস।ছেলেটার সাথেতো চুটিয়ে প্রেম করতে পারবেনা।আমার আবার বলেই দোষ,তোদের ছেলে-মেয়েরা নষ্টামি মাফ করিস কিন্তু যা সত্যি তাই বলছি আরকী…”
ইয়ারাবী ওর খালার কথা শুনে বলে,
-“তো আপনি কী?আপনাকে কেউ এখানে বিচার করার জন্য ডাকেনি।”
-“দেখলি ইশানি তোর মেয়ে আমাকে কীভাবে অপমান করলো।বুঝিস কিছু,মেরেছিস বলে মরতে চাইনি,ওই ছেলের সাথে কথা বলতে দেখে ফেলেছিস…তাই এখন মুখ লুকানোর জন্য মরতে গেছিলো।এসব ছেলেমেয়ের মুখ জুতিয়ে দে,তাহলে যদি শিক্ষা হয়।”
মিসেস ইশানি ওনার বড় বোনের কথা শুনে মেয়ের উপর খুব খেপে গেলেন।উনি ইয়ারাবীর চুলের মুঠি টেনে ধরে বলেন,
-“তোকে আমি এই শিক্ষা দিয়েছি,বড়দের মুখের উপর কথা বলিস।তুই মরে গেলেই ভালো হতো।দুধ কলা দিয়ে কাল সাপ পুষেছি।তোর জন্মের সময় যদি মুখে বিষ দিয়ে দিতাম তাহলে এমনটা হতোনা।”
ইয়ারাবী ওর মায়ের আচারনে আজ একটা কথাও বলছেনা।হঠাৎ ওর মেজো খালা রুমে ঢুকে মিসেস ইশানিকে ছাড়িয়ে নিয়ে কষে একটা থাপ্পড় মারেন।ইয়ারাবীর স্যালাইনে টান লাগার কারনে রক্ত পড়ছে।উনি তাড়াতাড়ি ডাক্তারকে ডাক দিয়ে ঠিক করেন।ওনার বোনের হাত ধরে বাইরে নিয়ে এসে মি.ফুয়াদের সামনেই বলেন,
-“এ্যাট লিস্ট আমাকে বলবি মেয়েটাকে নিয়ে তোদের সমস্যা কী?”
মি.ফুয়াদ ওনার দিকে তাকিয়ে বলেন,
-“সরি,আসলে ঠান্ডা মাথায় খোঁজ নেওয়া উচিত ছিলো।”
-“কী খোঁজ নিবে তোমরা?কোনো ছেলের সাথে হেসে হেসে ফোনে কথা বললে সে তার বয়ফ্রেন্ড হয়ে গেলো?তোমরা মানুষ নাকী অন্যকিছু?মেয়েটাকে এতো মারার পরও তোমাদের শিক্ষা হয়নি।ওকে তোমরা না চিনলেও আমি চিনি।”
মিসেস জামান চড়া গলায় বলে উঠেন,
-“দেখ তুই বেশি বুঝবিনা,আমাদেও তো মেয়ে আছে?কই ওমন তো ঢলাঢলি করে বেড়াইনা।”
-“বড় বলে কিছু বলবোনা এটা ভাবলে জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল করবি তুই,কেননা আমি কেমন সেটা তুই খুব ভালো করে জানিস।আর তোদের একটা কথা বলে রাখছি কান খুলে শুনে রাখ,ওর খালু বলেছে ও আমার সাথে আমার বাসায় যাবে।তোদেরকে রিকুয়েস্ট করছিনা,বলে রাখছি।আমি যেনো পরে কোনো ঝামেলা না পাই।”
সেদিনের পর হাসপাতাল থেকে ইয়ারাবীকে ওর খালা বাসায় নিয়ে আসে।কিন্তু এখানে নিয়ে এসে কেউ ওর সাথে কথা বলেনা।ওর খালু ছুটিতে বাসায় এসেছিলো,তিনিও কোনো কথা না বলে ওকে দেখে রুম থেকে চলে গেলেন।ওনারা ওকে টাইম টু টাইম খাবার,মেডিসিন সব কিছু দেয় তবে সমস্যা একটাই কথা বলেনা।
পরশু থেকে ওর বোর্ড এক্সাম শুরু,কিন্তু এসব ঘটনার জন্য লেখাপড়া কিছু হচ্ছেনা।সারাদিন রুমে শুয়ে থেকে ভালোও লাগছেনা।সারা শরীর, মুখে ক্ষতের চিহ্ন,চোখের নিচে কালি কপালে আর হাতের বিভিন্ন জায়গায় ব্যান্ডেজ।দুপুরের দিকে ও রুম থেকে বের হয়ে ওর খালার কাছে কিচেনে যেয়ে দাঁড়ায়।ওর খালা ওর উপস্থিতি টের পেয়ে ওর দিকে না তাকিয়ে বলে,
-“রুমে যা আমি খাবার নিয়ে আসছি।”
-“আমাকে এখানে কেন নিয়ে আসলে?”
-“তো মরার জন্য ওখানে ছেড়ে দিয়ে আসবো নাকী…”
-“মরে তো যাচ্ছিলাম বাঁচালে কেন আমাকে?”
-“ঠিক বলেছিস,তোকে বাঁচানো আমাদের সবচেয়ে বড় ভুল হয়ে গেছে।”
ওরা কথার আওয়াজে পিছনে তাকিয়ে দেখে ইরাক ফুল আর্মি স্যুটে হাতে ব্যাগ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।টানা ছয় মাস পরে ছুটিতে বাড়ি এসেছে।বিশেষ করে রক্তিম চোখে ইয়ারাবীর দিকে তাকিয়ে আছে,ওর ইচ্ছা করছে ইয়ারাবীকে আচ্ছামত মারতে।কিন্তু এখন কোনোভাবে নিজেকে কন্ট্রল করে রেখেছে।
ইয়ারাবী ওর চেহারা দেখে ওর খালার পিছনে লুকিয়ে পরে।দু’প্রকারের মানুষকে আমরা ভয় পায়।এক.যারা আমাদের প্রচুর ভালোবাসে,তাদের শাষনে আর দুই.যারা আমাদের ঘৃনা করে তাদেরকে।ইরাক প্রথম কাতারের মানুষ।ও যেমন ওকে ভালোবাসে তেমন শাষনও করে।মিসেস রহমান ওনার ছেলের দিকে তাকিয়ে বলে,
-“আসতে আসতেই ওকে বকা শুরু করলি।এই কয়দিনে আমরা ওকে বলেছি।তাছাড়া এমন পরিস্থিতিতে মাথা কাজ করেনা।মেয়েটাকে আর কিছু বলিস না তো।”
-“ইচ্ছা তো করছে ঠাটিয়ে চড় মারি…”
-“আহ্ ইরাক,খবরদার ওকে কিছু বলবিনা।”
-“আমি ওকে না,ওর বাবা-মার কথা বলছি।আর ওর ক্লাস তো আমি পরে নিচ্ছি।”
শেষের কথাটা ধমক দিয়ে বলেই রুমের দিকে পা বাড়ালো।মিসেস রহমান ইয়ারাবীর দিকে ঘুরে বলে,
-“ভয় পাসনা,জানিস তো তোর ভাইয়ারা কত ভালোবাসে।এখন রেগে আছে বলে এমন বললো।”
সেদিন বিকাল পর্যন্ত ইরাকের মান ভাঙাতে ভাঙাতে ওর অবস্থা আরো খারাপ।পরীক্ষা ওকে বসে থাকলে চলবেনা।সন্ধ্যার দিকে ও ইমনের রুমে যেয়ে দেখে ইরাক আর ইমন বসে গল্প করছে।ওকে দেখে ইমন বলে,
-“কীরে,তোকে না ছোট ভাইয়া রেস্ট নিতে বলেছে,তাহলে ঘুরে বেড়াছিস কেন?”
-” পরশু এক্সাম,তোমার ফোনটা একটু দিবে অনুকে ফোন করবো।”
-“কেন?”
-“ন্ নোট লাগবে,প্রাইভেটে যাওয়া হয়নি তাই।সমস্যা নেই আমি তোমাদের সামনেই কথা বললো।”
ইরাক নিজের ফোনটা ওর হাতে দিয়ে বলে,
-“তোর বাপ-মার মতো অবিশ্বাসী না,ইফাজকে বলেছি তোর জন্য ফোন কিনে আনতে।ততক্ষণ এটা দিয়ে চালা।”
হঠাৎ নিচে ওর মায়ের গলার আওয়াজ পাওয়া যায়।ওরা নিচে নেমে দেখে মিসেস ইসানি ওর মেজো খালার সাথে ওকে নিয়ে তর্ক করছে।উনি মেয়েকে দেখার সাথে সাথে ওর বইগুলো ওর দিকে দিয়ে বলেন,
“আমার সংসার,জীবনে আগুন লাগিয়ে তুই জীবনে সুখি হবিনা,সারাজীবন ধরে কাঁদবি।জেনে রাখ,তোর মতো অপয়া মেয়েকে কেউ তার সংসারে রাখবেনা।তুই মরিস না কেন?তোর জন্য কোনোদিন শান্তি পেলাম না।”
হঠাৎ ওয়াশরুমের দরজা নক করার আওয়াজে ওর ধ্যান ভাঙ্গে।তাড়াতাড়ি ও ওয়াশরুম থেকে বের হলে আবরার ওর দিকে তাকিয়ে বলে,
-“মনে তো হয়েছি আজ পুরোদিন ওখানেই থাকবে?এসে মেডিসিনগুলো নিয়ে ব্রেকফাস্ট করবে চলো,আমার পেটে হাতি দৌঁড়াচ্ছে।”
কথাটা বলে আবরার কয়েকপাতা থেকে কিছু পিলস্ আলগা করে ওকে দিলে ইয়ারাবী ওর বলে,
-“যার জীবন ছোট ছোট শিশি আর কয়েকপাতা পিলসে্র উপর নির্ভর তার জীবনের মূল্য কত,বলতে পারেন?”
আবরার খানিকটা চমকে বাম ভ্রু উঁচু করে ওর দিকে তাকিয়ে বলে,
-“মানে?”
ইয়ারাবী মৃদ্যু হেসে মাথা নাড়িয়ে বলে কিছুনা।ওরা নিচে ব্রেকফাস্ট করার সময় দেখে ইকরার চোখেমুখে লজ্জার ভাব আর আবীর মুচকি মুচকি হাসবে।ইয়ারাবী ইকরার দিকে তাকিয়ে বলে,
-“কী হয়েছে আপু?”
আবীর ওর দিকে তাকিয়ে বলে,
-“বাড়িতে নতুন অথিতি এলে মন্দ হয়না বলো?”
ওর বাবা হঠাৎ জুসের গ্লাসে চুমুক দিতে গিয়ে থেমে যেয়ে বলে,
-“আবার কে আসবে বাড়িতে?”
-“বাবা,আসবে তবে আজ থেকে গুনে গুনে নয়মাস পর,আর এই বাড়িতে পার্মানেন্টলি থাকবে সে।”
ওর মা ওনার বড় ছেলের দিকে তাকিয়ে,
-“মজা করার জায়গা পাস…ওয়েট এর মানে আমি দাদী হবো।”
-“ইয়েস মেরে আম্মাজান,বাড়িতে নতুন প্রিন্সেস আসছে…”
-“আলহামদুলিল্লাহ,আল্লাহর কোটি কোটি সুকরিয়া।”
জারবা আর মেঘ একসাথে চেঁচিয়ে উঠে বলে,
-“ইয়ে আমি ফুপু হবে,আর আমি চাচ্চু হবো।”
মুহুর্তে সব পুরো বাড়িতে খুশি ছেয়ে যায়।ইয়ারাবী ও প্রচুর খুঁশি হয়,কেননা ও ছোট বাচ্চাদের খুব ভালোবাসে।কচি কচি হাত-পা গুলো নেরে নেরে খেলা করে,যখন অবাক নয়নে ঠোঁট ফুলিয়ে সবাইকে দেখে তখন আলাদ এক অনুভুতি কাজ করে।ও ইকরার সাথে বেবীকে নিয়ে এটা ওটা বলে মজা করছে তবে দু’টো চোখ ওর দিকে স্থিরভাবে চেয়ে আছে।ওর চোখে এই আনন্দটা দেখে সত্যিই সেই চোখ দু’টোর খুব আফসোস হচ্ছে।
(৯৩)
সূর্যের আলো অনেক আগেই মেঘ আর কুয়াশাকে ভেদ করে ছোট স্ট্যাডি রুমে ছড়িয়ে পড়েছে।সেই রুমের এক পাশে কিছু কাগজের ভিড়ে একটা কিছু করতে দেখা যাচ্ছে।খুব ব্যস্ত,মুখে একরাশ চিন্তা নিয়ে খুব মনোযোগ দিয়ে একটা ইমেল আর কিছু ফাইল দেখছে,আর সেই মেয়েটা আর কেউ নয় য়ুহার।
য়ুহারের মাথা কিছুক্ষণের জন্য স্তব্দ হয়ে গেছে।ওর কাছে সব কিছু একটা গোলকধাঁধার মতো মনে হচ্ছে।শরীর স্তব্দ হয়ে গেছে ওর, হার্টবিটটাও ক্রমস বৃদ্ধি পাচ্ছে,এক রাশ ভয় আর অবাকের ফাঁদে আটকে গেছে।অংকটার শেষ টানতে গেলে শুরু মেলাতে পারছেনা আর যদি শুরু মেলাতে যায় তো উত্তর মিলছেনা।
য়ুহার বেশি দেরী না করে একটা অাননোন নাম্বারের কল করে।অদ্ভুত ব্যাপার কলটা করার সাথে সাথে অপর পাশের ব্যাক্তি সাথে সাথে রিসিভ করে একটা সালাম দিয়ে বলে,
-“জানতাম,সবটা জানার পরে তোমার কৌতুহল অনেক বেড়ে যাবে।তাইতো তোমার ফোনের জন্য ওয়েট করছিলাম..”
য়ুহার অপরপাশের ব্যাক্তির এরুপ আচারনে অনেকটা শক খেয়ে যায়।ওর মনে হচ্ছে লোকটা ওদের গতিবিধির উপর নজর রাখছে,কিন্তু কেন?কী চাই ও?সবকিছু যখন শূন্য মিলেছিলো তাহলে এতবছর পরে আবার কেন শুরু হলো?নিজেকে স্বাভাবিক করে ও বলে উঠে,
-“তুমি এগুলো করছো কিন্তু কেন?কী সম্পর্ক তোমার?”
-“সময় হলে সবটা জানতে পারবে”
-“তুমি যায় করোনা কেন সবার প্রথম বাচ্চাটার উপর টর্চার হবে,বুঝতে পারছো।”
-“এমন কিছুই হবেনা,”
-“কীসের ভিত্তিতে তুমি এই কথা বলছো যে ইয়ারাবীর কোনো সমস্যা হবেনা।কেননা একমাত্র ওই যে তিনজনের মধ্যে একজনকে দেখেছিলো।”
-“বিশ্বাস করা আর না করা সেটা সম্পূর্ন তোমার ব্যাপার,তবে আমি বলবো নিশ্চিন্তে থাকতে।একটা কথা কী জানো?যেখানে সব শেষ সেখানে আবার নতুন কিছু শুরু হয়।কেননা বাংলা অক্ষরে “ষ” আগে “শ” আর পরে “স” হয়।আর সেই “শ” দিয়ে কিন্তু “শুরু” আর “স” দিয়ে “সত্য” বানান করা হয়।তুমি বিচক্ষণ,বুদ্ধিমতী মেয়ে,তোমাকে আমার বোঝাতে হবেনা।”
লোকটার কথা শুনে য়ুহার একটা নিঃশ্বাস ফেলে ফোনটা কেটে দেয়।ওর কাছে সবকিছু গোলমেলে লাগছে।লোকটার সাথে কথা বলে যেনো য়ুহার আরো অনেক গোলকধাঁধায় আটকে গেছে।যে বয়সে একটা খেলনা দিয়ে ঠিকমত খেলতে পারতোনা সেই বয়সে কাধের উপর খুনের অভিযোগ এসে পড়লো।হাজার রঙিন স্বপ্নকে বির্সজন দিতে হলে।যদিও নির্দোষ প্রমাণ হলো তবুও এক কঠিন বেড়াজালে আটকা পড়লো।সব সময় যুদ্ধের ময়দানের বলিদান ওইটুকু মেয়েকে কেন হতে হবে?
-“আপু খাবেনা?”
য়ুহার নিলয়ের দিকে একবার তাকিয়ে ওকে ভিতরে ডাকলো।নিলয় ফোনটা বন্ধ করে পকেটে ঢুকিয়ে ওর সামনের চেয়ারে বসে বলে,
-“জটিল কোনো কেস?”
-“একটা কথা বলতো সব সময় নিজেকে নির্দোষ প্রমান করতে নিরপরাধীরা কী করে?”
-“আমি তো বলতে পারবোনা,তবে ইয়ারাবী আপু একবার বলেছিলো,মাঝে মাঝে চিৎকার করে নির্দোষ প্রমান করার চেয়ে চুপ করে থাকা ভালো।নিয়তি এমন একটা জিনিস,আমরা না চাইতেও তার কাছে অসহায়।কখনো কখনো নিয়তি এমন কিছু বয়ে আনে যা আমরা অন্যায় না করলেও দোষী হয়ে যায়।”
য়ুহার ওর ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বলে,
-“কথাটা একদম ঠিক বলেছিস,আসলে ভাগ্যের উপর কারো হাত নেই।আল্লা্হ যার ভাগ্যে যা লিখে রেখেছেন তার সাথে সেটাই হবে।তবে কিছু ভালো সঙ্গ পেলে খারাপটাও কিছুটা ভালো করা যায়।”
-“একবার হিটলার একটা কথা বলেছিলো,”আমি বিশ্বের সব ইহুদী মারতাম, কিন্তু কিছু ইহুদী বাঁচিয়ে রাখলাম যাতে পুরো বিশ্ব বুঝতে পারে যে কেন আমি তাদের মেরেছি।”লাইনটা কেন বললাম সেটা তুমি অবশ্যই বুঝেছো,তাই তোমাকে বুঝিয়ে বলতে হবেনা।”
য়ুহার হেসে ওর টেবিলের এলোমেলো কাগজগুলো ঠিক করতে করতে বলে,
-“বল তুই বুঝিয়ে বলতে পারিস না।কিন্তু তুই কবে থেকে হিটলারকে পছন্দ করলি।”
-“আমি তো একমাস আগেও জানতাম না হিটলার আসলে কে?শুধু নাম শুনেছিলাম,তাই পছন্দ তো দূরে পরে থাক।আসলে সেই প্রাইভেটে স্যার এই উক্তিটা বলেছিলো তাই…”
-“তুই ও পড়িস,আমি তো জানতাম সারাদিন ফোনের মধ্যে ঢুকে থাকিস।”
-“ওহ্ এতো কথা বলো কেন?চলোতো খুব খুদা পেয়েছে।”
য়ুহার হেসে গায়ের চাদরটা ভালো করে জড়িয়ে নিয়ে নিলয়ের সাথে নিচে নেমে যায়।মিসেস অচলা ওদের দেখে প্লেটে খাবার বাড়তে শুরু করে।নিলয়ের প্লেটে সবজি দিতেই নিলয় বলে উঠে,
-“ও আম্মু সবজি খাবোনা…”
মিসেস অচলা রেগে ওনার ছেলের দিকে তাকিয়ে বলেন,
-“হয়তো খাবি নয়তো ওই ফোন আমি আজ বারিয়ে ভেঙে ফেলবো।”
ওনার স্বামী স্ত্রীর রাগকে একটু বেশিই ভয় পান।উনি মুখ কাচুমুচু করে তাকিয়ে বলেন,
-“আহ্,বাচ্চাদেরকে এভাবে বকছো কেন?”
-“তোমার কী আজ ভাত খাওয়ার ইচ্ছা আছে?”
ওনার স্বামী আর দিত্বীয় কথা না বলে খাওয়াতে মনোযোগ দিলেন।নিলয় খেতে বলে,
-“আম্মু আজ একটু মাথা ব্যাথা করছে প্রাইভেটে যাবোনা।”
-“ওমা,এটা কোনো কথা।ফোন টেপ আরো বেশি করে বাবা,মাথা ব্যাথা সেরে যাবে।”
-“আম্মু তুমি সব সময় মাসুম ফোনকে ওসব কেন বলো?”
-“কী বললি তুই?”
-“কিছুনা…”
য়ুহার ওর ভাইয়ের কানে ফিসফিস করে বলে,
-“মাদার বাংলাদেশের আজ হয়েছে কী?জোরে জোরে মেঘের গর্জন হচ্ছে…”
-“কী জানি,তবে এটা সিউর।যাই হোক না কেন,এটার শোধ আমার উপর দিয়েই তুলবে মা জননী।”
#চলবে_____