#জীবন মানে তুমি
#লেখিকা:H.B.Rini (Irini Ori)
#পর্ব:২১
(৭৬)
অবহেলা,ডিপ্রেশন,কঠিন বাস্তবতার সম্মুখীন যারা হয়,তারাই বুঝে জীবনের আসল অর্থ কী?মনের চিলেকোঠায় বন্ধী হয়ে থাকা আহাকার যখন কাউকে বলতে পারবেনা,তখন সেই আহাকারকে হাতিয়ার বানিয়ে কখনো কখনো তার উপর প্রকাশ করতে হয় যে তোমাকে মজা ভেবেছিল একটা সময়।একটা বইয়ের উপরের মলাট দেখে তাকে বিবেচনা করা উচিত নয়।তাকে বিবেচনা করতে হলে তার ভিতরের আমি’কে দেখতে হয়।একটা মেয়েও কিন্তু সেই বইয়ের উপরের মলাটের মতো।কখনো একটা মেয়ের চুপ থাকাকে তার দুর্বলতা ভাবা ঠিক নই…হতে পারে সে তার ভিতরের আমি সত্ত্বাকে কাউকে দেখাতে চাইনা,তাই যে সর্বদা চুপ থাকে।
কিন্তু প্রনয় আজ সেই ভুলটা করতে এলো।ওকে দুর্বল ভেবে আরো আঘাত করতে এলো,পূরন করতে চাইলো নিজের কামনাকে।ইয়ারাবী কখনো নিজের এই রূপটাকে পরিবারের সামনে আনতে চাইনা।তাই বলে ও ভয় পায়নি তা কিন্তু নয়।ভয় পেয়েছিল আর এখনো পাচ্ছে এটা ভেবে যে কাল সকালে কী হবে?ছাদের এক কোনে রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে কুয়াশাচ্ছন্ন আকাশে দৃষ্টি মেলিয়ে রাতের আলো-আধারের গহীনে মিশে একাকার হয়ে আছে।
হঠাৎ কেউ ওকে গরম চাদরে আবৃত করে দিতে ও খানিকটা চমকে ওঠে।পাশ ফিরে তাকিয়ে দেখে আবরার দাঁড়িয়ে আছে…তবে অদ্ভুত ব্যাপার যে এত কিছু হয়ে যাওয়ার পরো আজ কোনো রিয়্যাক্ট করেনি।ইয়ারাবী অবাক চোখে ওর দিকে তাকিয়ে আছে।আবরার ওর চাহনি দেখে খানিকটা হেসে বলে,
-“কাল সকালে কমপক্ষে ৭-৮ঘন্টার জার্নি আছে,ঘুমিয়ে পরো।না ঘুমালে আরো বেশি পেইন করবে।”
-“আজ যে কিছু বললেন না।”
আবরার খানিকটা হেসে বলে,
-“ভয় পাও নাকী আমাকে?”
ইয়ারাবী ওর দিক থেকে চোখ সরিয়ে চাদরটা ভালোমতো গায়ে চাপিয়ে দিয়ে আবারও শূন্য দৃষ্টি মেলিয়ে বলে,
-“ভয় এমন একটা জিনিস যা না চাইতেও মনের এক কোনে বাসা বাঁধে। যার ফলে মানসিক চাপে থাকে এবং চিন্তার কথা কোনো কোনো সময় তা মারাত্মকও হয়।আচ্ছা আবরার আপনি জানেন আমার কিছু ডিসঅর্ডার আছে।”
আবরারও মনে হয় এই উত্তরের অপেক্ষায় ছিলো।কেননা ওর সমস্যা একমাত্র ওই বলতে পারবে, যার ফলে আবরারেরও অনেক সুবিধা হবে।আবরার দু’হাত বুকে বেঁধে রেলিং এর সাথে হেলান দিয়ে ওর সামনে দাঁড়িয়ে বলে,
-“কেমন?”
ইয়ারাবী পূর্বের ন্যায় আকাশের দিকে তাকিয়ে বলে,
-“ডা.ফারহানের ভাষায় যাকে বলে…ব্যক্তিত্ব ডিসঅর্ডার আর এঙ্গযাইটি ডিসঅর্ডার আরো অনেক আছে।বাট্ ওনার মতে এই দু’টা আমার মধ্যে আছে।জানেন উনি আমার ব্যাপারে খালামনিকে কী বলেছিলো?দেখলেন আমিও কতো বোকা…আরে আমি যদি না বলি আপনি জানবেন কীভাবে?আচ্চা শুনুন উনি বলেছিলো:
আগ্রাফোবিয়া (Agraphobia) যাকে বলে যৌন নিপীড়নের ভয়। এলটোফোবিয়া (Altophobia) – উচ্চতা ভীতি।এন্ড্রোফোবিয়া (Androphobia) – মানুষের ভয়।এনথ্রোপোফোবিয়া (Anthropophobia) – মানুষের বা মানুষের সঙ্গী হওয়ার বা এ জাতীয় ভয়।এরেখনোফোবিয়া (Arachnophobia) – মাকড়শার ভয়।এটিচিফোবিয়া (Atychiphobia) – অকৃতকার্য হওয়ার ভয়।গ্লসোফোবিয়া (Glossophobia) – জনসম্মুখে কথা বলার ভয়।সিবোফোবিয়া, সিটোফোবিয়া (Cibophobia, Sitophobia) – খাবারের প্রতি বিরক্তি বা ভয়।জেনোফোবিয়া (Xenophobia) – বিদেশি, অচেনা কিছু বা লোকের ভয়।
আরে বাবা আমি কত করে বললাম,এগুলো কী কোনো ফোবিয়া নাকী।এগুলো আমার ভালো লাগেনা বলে এভয়েড করে চলি।কিন্তু ডাক্তার তো এক ধাপ উপরে।”
কথাগুলো বলে ইয়ারাবী হাসতে থাকে।আবরার ওর কথা শুনে বলে,
-“ডা.ফারহান যা বলে সেগুলো ঠিকই বলে।আমি পার্সোনালি ওনাকে চিনি।তো তুমি বলতে চাচ্ছো তোমার এগুলোতে ফোবিয়া নেই,তাইতো?”
ইয়ারাবী মাথাটা দুলিয়ে বলে,
-“”নাহ”,নেই তো।জানেন ছোটবেলায় আমি কত সাহসী ছিলাম,কিন্তু আম্ম….না কিছুনা।”
-“পুরো বাক্যটা শেষ করলে খুশি হবো?”
-“কিছু না…”
আবরার বুঝতে পারছে ইয়ারাবী কথাটা বলতে চাইনা,তবে এটা ওর বাবা-মাকে নিয়ে ছিলো তা ঠিকই বুঝতে পেরেছে।আবরার একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,
-“তুমি ডা.ফারহানের কাছে কেন গিয়েছিলে?”
-“আমি যেতে চাইনি,খালামনি-খালু নিয়ে গেছিলো।জানেন কী সব আজগুবি মার্কা প্রশ্ন করলো তারপর বললো আমি নাকী সিক?আরো অনেক কিছু বলেছিলো খালুকে,কিন্তু আমাকে শুধু এগুলো বলেছিলো।জানেন আরো শুনছিলো আমার পরিবার কেমন?আমি কী বোকা নাকী ওনাকে ভিতরের কথা বলতে যাবো।”
আবরার খেয়াল করে ইয়ারাবী কেমন একটা অস্বাভাবিকভাবে কথা বলছে।আবরার ইয়ারাবী কাঁধে হাত রেখে বলে,
-“এভাবে কথা বলছো কেন,তুমি ঠিক আছো?”
-“আমার কী হবে?আমি একদম…”
পুরো বাক্যটা বলার আগেই ও আবরারের বুকের উপর ঢলে পরে।আবরার ওকে ভালো করে ধরে মাথা তুলে দেখে ও বেহুশ হয়ে গেছে।ও ব্যাপারটা নিয়ে বেশি চিন্তা করেনা।কেননা এর কারনটা ও ভালোভাবে জানে।হঠাৎ আবরারের ফোনে একটা কল আসলে ও বামহাত দিয়ে ইয়ারাবীকে শক্ত করে ধরে ডানহাত দিয়ে ফোনটা বের করে দেখে ইফাজ ফোন করেছে।আবরার ফোনটা রিসিব করে সালাম দিয়ে বলে,
-“ওদিকের কী খবর?”
-“পুলিশ চলে এসেছে,ওর জ্ঞান ফেরার অপেক্ষা।তবে পিচ্চি যেভাবে মার দিয়েছে ওর বাম কাঁধ থেকে হাত পর্যন্ত পুরো শেষ।কপালে দু’টা সেলাই লেগেছে।ডান পায়ের পাতাটা ভেঙে গেছে।”
-“ওকে যে আমি মারিনি সেটা ওর সৌভাগ্য।”
-“তোর মার খেলে পরোপারে পৌঁছে যেতো।পিচ্চি কী করছে?”
-“কথা বলতে বলতে আবার বেহুশ হয়ে গেছে।খুব ক্লান্ত,আর ভয়ও পাচ্ছে।”
-“কবে যে নরমাল একটা লাইফ পাবে?”
-“চিন্তা করিসনা,এখন ও একা নয় আমি ওর সাথে আছি।আচ্ছা,তাড়াতাড়ি ঝামেলা মিটিয়ে চলে আসিস…রাখছি।”
আবরার ফোনটা কেঁটে পকেটে ঢুকিয়ে ওকে কোলে তুলে রুমে যেয়ে বিছানায় শুয়ে দেয়।তারপর লেপটা ঠিক মতো গাঁয়ে চাপিয়ে দিয়ে নিজেও পাশে শুয়ে পরে।
আজ রাতে যখন ইয়ারাবী ম্যাসেজটা পেয়েছিলো ,তখন ওর ভিতু চোখ দেখে আবরার কিছু একটা আচ করেছিলো।আবরার বিষয়টা তখন নরমাল রাখার জন্য কিছু বলেনা।রাতে যখন আড্ডা দেওয়া শেষে রুমে যেয়ে ইয়ারাবী চেন্জ করতে যায় তখন আবরার ওর ফোনটা নিয়ে সব চেক করে ম্যাসেজটা দেখতে পায়।ছবিগুলো দেখে ওর প্রচন্ড পরিমান রাগ উঠে যায়।কেননা আগের কালপিটের কোনো খোঁজ এখনও পাওয়া যায়নি তার উপর নতুন আরেকজন।তবে শান্ত হয় তখন যখন আবরার নিচের ম্যাসেজটা পরে।
ইয়ারাবী ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে আবরারের হাতে ফোন দেখে চমকে যায়।ওর চোখ-মুখে স্পষ্ট ভয় লেগে আছে।
-“আ আপনি ফোনে ক্ কী করছেন?”
আবরার একবার ইয়ারাবীর দিকে তাকিয়ে শান্তভাবে বলে,
-“কেন,তোমার কী আমার ধরা বারন আছে?”
-“ন্ না ,তা ক্ কে ন হবে?আমি এমনি ব্ বলছি,আ আসলে অনেক রাত হ হয়েছে তাই…”
-“এমনি দেখছিলাম,এসো শুয়ে পরি।বেশি রাত জাগলে বেশি অসুস্থ হয়ে যাবে।”
ইয়ারাবী চুপচাপ শুয়ে ভাবতে থাকে,আজ এমন একটা জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে যেখানে ৪ বছর আগে এক ভয়ানাক রাতের সূচনা হয়েছিলো।নিজের কোনো অপরাধ না থাকলেও তাকে তিরস্কারের সম্মুখীন হতে হয়েছিলো।আর কখনও এই জায়গাটাই আসতে চেয়েছিলোনা।তবে কথায় আছেনা,”অতীত কোনোদিন পিছু ছাড়েনা।সেটা ভাল হোক বা খারাপ”।ও যতই ওর অতীতকে ভুলতে চাচ্ছে ততো ওর অতীত ওর দরজায় কড়া নেড়ে জানিয়ে দিচ্ছে যে ওর পিছু ও কখনও ছাড়বেনা।আজ ও আবরারের দিকে উল্টো হয়ে শুয়ে ঘুমের ভান করে নিরবে চোখেন পানির বিসর্জন দিচ্ছে।আবরার সব বুঝেও চুপ করে আছে,কেননা ও দেখতে চাই ইয়ারাবী ঠিক কী করবে।তাই যখন ইয়ারাবী বাইরে যায় তখন ও ইফাজকে সবটা বলে ওর পিছু নেয়।
(৭৭)
সকালের মিষ্টি আলো ইয়ারাবীর চোখে পরতেই ওর ঘুমটা ভেঙে যায়।ঘুম জড়ানো আধোআধো চোখ খুলে প্রথমে বোঝার চেষ্টা করে ও কোথায় আছে?যখন ও বুঝতে পারে ও নিজের রুমে শুয়ে আছে তখন লাফ দিয়ে উঠে বসে পরে।পাশে তাকিয়ে দেখে আবরার নেই,হতে পারে জগিং এ গেছে।ঘড়িতে তাকিয়ে দেখে আটটা বাজে।কিন্তু ওর ঠিক মনে আছে ও ছাদে দাঁড়িয়ে ছিলো,তাহলে রুমে কীভাবে এলো?তার থেকেও বড় কথা কাল রাতে যে কান্ড হয়েছে সেটা নিয়ে বাড়ির মানুষ এতোটা শান্ত কীভাবে আছে?
-“জানি প্রশ্ন অনেক মাথার ভিতর ঘুরঘুর করছে বাট্ এতো চাপ না নিয়ে ফ্রেস হয়ে নাও।”
ইয়ারাবী দরজার দিকে তাকিয়ে দেখে আবরার গ্রে কালারের একটা জগিং স্যুট পরা,মাথার চুলগুলো এলোমেলো,শরীরটা পুরো ঘেমে গেছে।আবরার রুমে ঢুকে কাবার্ড থেকে ফরমাল ড্রেসটা বের করে ওয়াশরুমে যাওয়ার সময় ওর দিকে তাকিয়ে বলে,
-“জার্নি করতে পারবে তো তুমি?”
-“না পারার কী আছে?আচ্ছা একটা কথা বলুন, আপনি কাল রাতে ঘুমিয়ে ছিলেন তাহলে ওখানে কীভাবে গেলেন?”
-“তোমার কৌতুহল অনেক,কিন্তু আমার এখন বলার মুড নেই…অন্য সময় বলবো।”
বলেই আবরার ওয়াশরুমে ঢুকে যায়।এদিকে ইয়ারাবী দাঁত দিয়ে নিজের হাতের নখ কাঁটতে কাঁটতে বিরবির করে বলে,
-“কী লোক রে বাবা?মুড নেই বলে বলবেনা,এক নাম্বারের ঘাড়ত্যাড়া।”
আবরার বের হতেই ইয়ারাবী বেড থেকে আস্তে করে নেমে কাপড় নিয়ে ওয়াসরুমে চলে যায়।ইয়ারাবী ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে চুল বাঁধছে,আবরার বিছানায় বসে একবার ওর দিকে তাকিয়ে বলে,
-“আজ বোরখা পরতে হবেনা,”
-“কেন?”
-“যদিও রাস্তায় ব্রেক নিবো তারপরও,জার্নিতে তুমি অসুস্থ হয়ে পরবে।”
-“ঠিক আছে,পরবোনা।”
-“আচ্ছা একটা কথা বলোতো,আমি তোমাকে যা বলি তুমি সেটাই করো কেন?”
ইয়ারাবী ওর দিকে তাকিয়ে বলে,
-“বিয়ের পর একটা মেয়ের জীবনে ওনার স্বামী সব।রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘তার কোনো নামাজ কবুল হয় না, কোনো নেক আমল ওপরে উঠানো হয় না; যতক্ষণ স্বামী তার প্রতি সন্তুষ্ট না হবে।’ (ইবনে হিব্বান)
আমি চাইনা আমার নামায কবুল না হোক।জানিনা জান্নাতে যেতে পারবো নাকী তবুও চেষ্টা করি।জানেন,মনি একবার আমাকে বলেছিলো,
স্বামীর সঙ্গে স্ত্রীর আচরণ কেমন হবে তা প্রিয়নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সঙ্গে এক নারীর আলাপচারিতায় ফুটে ওঠেছে। হাদিসে এসেছে-
হজরত হুসাইন ইবনে মুহসিন থেকে বর্ণিত, তাঁর এক ফুফু প্রিয়নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে কোনো প্রয়োজনে এসেছিলেন। তাঁর প্রয়োজন পূর্ণ হলে প্রিয়নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, তুমি কি বিবাহিতা? তিনি বললেন, ‘হ্যাঁ’। প্রিয়নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, তুমি স্বামীর সঙ্গে কেমন আচরণ করে থাক? তিনি বললেন, আমি একেবারে অপারগ না হলে তার সেবা ও আনুগত্যে ত্রুটি করি না।
তখন প্রিয়নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, ‘স্বামীর সঙ্গে তোমার আচরণ কেমন তা ভেবে দেখ। কারণ স্বামীই তোমার জান্নাত কিংবা জাহান্নাম।’ (মুসনাদে আহমদ)”
আবরার বিছানা থেকে উঠে ওরা কাছে এসে কাধে হাত রেখে বলে,
-“বাহ্,তুমি তো অনেক কিছু জানো।”
-“আপনি আমার থেকে আরো বেশি জানেন।”
আবরার ইয়ারাবীর কথা শুনে হেসে দিয়ে বলে,
-“চলো নিচে যেয়ে ব্রেকফাস্ট করতে হবে।”
আদিবা আজ ফজরের নামাযটা পরে আর ঘুমাইনি।বলতে গেলে ঘুম ওর চোখে নেই বললে চলে।অতীতের কৃতকর্মগুলো অপরাধ হয়ে ওর সামনে হানা দিচ্ছে।যদি এমন কোনো মৃত্যু সমান ভয়ানক ঘটনার সামনা-সামনি না হতো তবে বুঝতে পারতোনা,মৃত্যু ভয়টা কেমন।ওর সাথে যা ঘটেছে তার থেকেও বেশি ইয়ারাবীর সাথে ঘটতে পারতো,ভেবেই গায়ে কাঁটা দিচ্ছে।আসলে কোনো মানুষ অপরাধ করে চুপ করে বসে থাকতে পারেনা।কোনো না কোনো সময় সেই মানুষটা অপরাধ বোধে ভুগতে থাকে।আদিবারও তাই হচ্ছে,বারবার মনে হচ্ছে ইয়ারাবীর কাছে যেয়ে ক্ষমা চেয়ে নিবে।কিন্তু তাও কোথাও একটা অস্বস্তি হচ্ছে ,যে বড় বোন হয়ে এসব বলতে কেমন একটা লজ্জাও করছে।
ওর মায়ের ডাকে ভাবনা থেকে ফিরে রুম থেকে হাসানকে নিয়ে খেতে চলে আসে।আগে থেকে ওখানে ইয়ারাবী ওর স্বামীর পাশে বসে আছে।আদিবা ইয়ারাবীর দিকে তাকিয়ে বলে,
-“ইস্মা,যাওয়ার আগে আমার সাথে একবার দেখা করতে পারবা,কিছু কথা আছে তোমার সাথে।”
ইয়ারাবী খানিকটা হাসার চেষ্টা করে বলে,
-“ঠিক আছে আপু..”
মিসেস ইসানিরা টেবিলে নানা রকম পিঠা আনেন,তারমধ্যে চিতাই,ভাপা,কাটা পাকান,পাটিসাপটা,নারিকেলের তিল পুলি,দুধ চিতাই,দুধ পুলি,নকশি পিঠা,মালপোয়া,সাগুদানা পিঠা,লবঙ্গ লতিকাপিঠা।ইয়ারাবী পিঠাগুলোর দিকে একবার দেখে ওর খালামনির দিকে তাকিয়ে বলে,
-“সকালে কী শুধু পিঠা করেছো নাকী?”
-“আরে বাবা,এত মনখারাপ করার দরকার নেই।জানি তো তুই পিঠা খাসনা।রান্না হয়ে গেছে আনছি,তবে এগুলো খেতে থাকো সবাই।”
সবাই পিঠা খুব মজা করেই খাচ্ছে আর ইয়ারাবী গালে হাত দিয়ে সবগুলোকে দেখছে।বুঝতে পারছেনা,মানুষ এতো মিষ্টি খায় কী করে।হঠাৎ সমীর খেতে খেতে বলে,
-“সকালে নামায পড়তে যেয়ে শুনলাম প্রনয়কে নাকী পুলিশ এরেস্ট করেছে,ওর বাবাও কিছু করতে পারছেনা।”
ইয়ারাবী কেবল পানি খেতে যাচ্ছিলো ওর কথা শুনে থেমে যেয়ে ইফাজের দিকে তাকায়।ইফাজ ওর দিকে তাকিয়ে হেসে বলে,
-“নিশ্চয় কোনো অকাজ-কুকাজ করতে গেছে তাই পুলিশ এরেস্ট করেছে।”
মিসেস ইশানি টেবিলে খাবার রাখতে রাখতে বলে,
-“প্রনয় মোটেও খারাপ ছেলে নই,না জেনে কারো ব্যাপারে উল্টো-পাল্টা বলবে না আব্বু।”
-“ইয়েস খালা,এটাই যে কারো ব্যাপারে উল্টো-পাল্টা বলতে নেই।তবে কী জানো ও একটা মেয়েকে হ্যারাজমেন্ট করছিলো তাই মেয়েটা ওকে আচ্ছামতো কেলিয়ে পুলিশের হাতে তুলে দিয়েছে।”
-“তুমি কী ভাবে জানলে?”
ইফাজ ভাপাপিঠায় একটা কামর দিয়ে বলে,
-“এখানের যে এসপি ও আমার ফ্রেন্ড,তাই আমাকে বললো।তবে কী জানো খালা মেয়েটা যেভাবে মেরেছে ,বেচারা মনে হয় কোনো দিন কোনো মেয়ের দিকে চোখ তুলে তাকানোর সাহসও পাবেনা।”
-“কী কথা এটা,ওই ছেলেকে দেখলে বোঝা যায়না ও এতোটা খারাপ।ভাবতেই তো অবাক লাগছে,ওর বাবা আরো তোর মাযের কাছে এসে বললো,যেনো ইরাককে একটা কল করে ওকে ছাড়িয়ে আনতে।”
-“আসলে কী বলোতো খালা,আমরা যা দেখি তা কিন্তু কখনো সত্যি হয়না।অনেক সময় সত্যিটা অনেকটা গভীরে লুকিয়ে থাকে,যাকে বাইরে এনে প্রমান করার আগেই আমরা মিথ্যাকে হজম করেনি।তবে সত্যি যে সব সময় লুকিয়ে থাকে তা কিন্তু নয়,তবে যখন বাইরে আসে তখন হাজার চেষ্টা করলেও আমরা সেই জিনিসকে ফিরে পায়না।”
ইফাজ কথা শেষ করে ইয়ারাবীর দিকে তাকিয়ে দেখে ও মাথা নিচু করে ফোন টিপছে।আসলে ফোন টিপছে না,আসলে ওর মনে যে ঝড় বইছে তা সবার থেকে আড়াল করার জন্য ছোট একটা অভিনয় করছে।আসলে এটা ওর নিত্যদিনের অভিনয়…এই অভিনয় দিয়ে কষ্টকে সব সময় আড়াল করে রাখে।রাতে অন্ধকারে কান্না করলে কেউ না দেখলেও দিনের বেলার হাসিটাকে সবাই দেখে।তাই দিনের বেলায় রোজ এক একটা অভিনয় করে সবাইকে বোকা বানাতে চাই।তবে সবাই যে বোকা হয় তা কিন্তু নয়…মাত্র হাতে গোনা কয়েক মানুষ ওর অভিনয়কে বুঝতে পারে।ইয়ারাবী বুঝতে পারে ইফাজ ওকে উদ্দেশ্য করে কথাটা ওর মাকে বলেছে…তবে মিসেস ইশানি ইফাজের কথার মানে বুঝলেও আসল কারনটা বুঝতে পারেনি।
ইয়ারাবী নিজেকে নরমাল করে ওর খালামনিকে জোরে করে ডেকে বলে,
-“খালামনি পেটে ভিতরে ইঁদুর দৌঁড়াচ্ছে,কই তুমি?”
মিসেস ইশানি কিছু বলতে যেয়েও বলতে পারেননা।মেয়েটা তার সত্যিই অনেকটা দূরে সরে গেছে।মিসেস জামান ইয়ারাবীর দিকে তাকিয়ে বলে,
-“সামনে মা দাঁড়িয়ে আছে,আর তুই খালাকে ডাকছিস?”
-“আপনাকে তো বলিনি কিছু,”
মিসেস রহমান ওনার অন্য বোনের সাথে টেবিলে খাবার রাখতে রাখতে বলে,
-“আরে আপু তুই ওর সাথে ঝগড়া করছিস কেন?”
-“আমি কোথায় করলাম,ওই তো করছে।ইশানি তোর মেয়ে আমাকে এমন কথা বললো আর তুই কিছুই বলবিনা।”
ইশানি সবার প্লেটে খাবার বেড়ে দিতে দিতে বলে,
-“কী বলবো আপু,এখন কথার জন্য কী ওকে মারতে হবে নাকী?এখানে তো এমন কিছু বলেনি যার জন্য তুই এমন রিয়্যাক্ট করছিস।তুই জানিস,ও আমার থেকে মেজো আপুর সাথে বেশি থেকেছে…আপুর যদি কোনো সমস্যা না হয় তাহলে তোর এতো সমস্যা হচ্ছে কেন?”
মিসেস জামান কখনো কল্পনায়ও ভাবতে পারেননি ওনার বোন এমন করে ওনাকে কথা শুনাবেন।ইয়ারাবী ইমনের কানে ফিসফিস করে বলে,
-“ভাইয়া,তোমার খালার কী ভুতে ধরলো নাকী,আমার পক্ষ নিয়ে কথা বলছে?”
-“এতো কেবল শুরু দেখ আরো আগে কী হয়?”
-“মানে?”
-“ছোট মাথায় চাপ নিসনা।”
-“ওই তোরা এতো ফিসফিস করে কী বলছিস রে।আর ইয়ারাবী তোর আপুদের দেখ জামাইদের প্লেটে যত্ন করে খাবার তুলে দিচ্ছে আর তুই এই বাদরের সাথে ফিসফিস করছিস।বলছি আবরারকে ভালো করে খেতে দে।”
আবরার খেতে খেতে খানিকটা হেসে বলে,
-“খালামনি,কোনো ব্যাপার না।আমার লাগলে আমি নিজে তুলে নিবো,তাছাড়া ওর হাত কেঁটে গেছে…ও এসব পারবেনা।”
জারিকা ফট করে বলে উঠে,
-“ও পারেই বা কী?শুনছি বিয়ের পর থেকেই বলে অসুস্থ।বলছি শ্বশুড়বাড়িতে যেয়ে সারাদিন পরে পরে ঘুমাস নাকী কাজকর্মও কিছু করিস।”
ইয়ারাবী কিছু বলার আগেই মিসেস ইশানি জারিকার দিকে তাকিয়ে রাগী স্বরে বলে,
-“ও যা পারে তার নখের যোগ্যও তুই না।আমার মেয়েকে নিয়ে কোনো উল্টো-পাল্টা কথা বলবিনা জারিকা,যার যার সংসার তার তার।তোর নিজের সংসারে মন দিলেই চলবে।”
ইয়ারাবী একের পর এক অবাক হয়ে যাচ্ছে ওর মায়ের কর্মকান্ড।ও এবার সিরিয়াস হয়ে ইমনকে বলে,
-“ভাইয়া,নিশ্চয় তোমার খালাকে জিনে ধরেছে,নয়তো আমি কোনো স্বপ্ন দেখছি।”
ওর কাছে এটাকে স্বপ্ন মনে হচ্ছে,কেননা জ্ঞান হওয়ার পর থেকে শুধু মিসেস ইশানির অবহেলা পেয়েছে।কোথার থেকে য়ুহার এসে ওর মাথায় একটা গাট্টা মেরে বলে,
-“ফাও প্যাচাল বন্ধ করে চুপচাপ খেয়েনে।জানিস আর ফুপি তোর পছন্দের “সিদল” বানিয়েছে।”
-“খালামনি..”
-“নারে বুদ্ধু তোর মা..আয় তোকে খাইয়ে দি।ইমন ওই চেয়ারে যা।”
ইমন উঠে পাশের চেয়ার বসতেই য়ুহার ও চেয়ারে বসে,একটা প্লেটে পোলাও নিয়ে তার সাথে সিদলের পেঁয়াজ ভুনা নেয়।কেননা আজকের খাবারে গরুর মাংস করা হয়েছে কিন্তু ওর গরুতে প্রবলেম।য়ুহার ভাত মাখিয়ে ইয়ারাবীর গালে দিতে যাবে এমন সময় মিসেস ইশানি বলে,
-“য়ুহার তুই এখন খেয়েনে,আজ আমি ওকে খাইয়ে দি।”
কথাটা শুনে ইয়ারাবী আশ্চর্যের শেষ সীমানায় পৌঁছে যায়।ইফাজ তো সেই লেভেলের বিষম খেয়ে যায়।ওর খালামনি ওদের অবস্থা দেখে মুচকি মুচকি হাসতে থাকে।য়ুহারও খুব অবাক হয় তবুও বলে,
-“ঠিক আছে ফুপি,এই নাও।”
-“য়ুহার আপু তুমি বলেছিলে খাইয়ে দিবে,”
-“আমার হাতে তো খেলি এবার মায়ের হাতে খেয়েনে।আর প্লীজ আবরারের সামনে উল্টো-পাল্টা কোনো রিয়্যাক্ট করিসনা।”
ইয়ারাবী য়ুহারের কথা শুনে চুপ হয়ে যায়।ওই যে ওর মায়ের হাতে খাবার খেতে চায়,সেই মনে হয় ছয়-সাত বছর বয়সে খাবার খেয়েছে তারপর আর কখনো খায়নি।মিসেস ইশানি প্লেটটা নিয়ে ওর সামনে বসে ওকে এক লুকমা খাইয়ে দেয়।আজ কেন জানি ওনার খুব ভালো লাগছে।ইয়ারাবী কোনো কথা না বলে অন্যদিকে তাকিয়ে খাবারটা খেতে থাকে।হঠাৎ মিসেস জামান আবরারের প্লেটে সিদল দিলে আবার ওনার দিকে বলে,
-“সরি আন্টি,এটা কী জিনিস?দেখতে পিঁয়াজ ভুনার মতো লাগছে কিন্তু এগুলো কী?”
-“সিদলের পিঁয়াজ ভুনা।”-পাশ থেকে ইয়ারাবী খেতে খেতে কথাটা বলে উঠে।
-“আমি কোনোদিন খায়নি।”
-“রংপুরের বিখ্যাত খাবারের মধ্যে এটাও একটা।”
-“বানায় কীভাবে?”
-“আমি শুধু খেতে জানি,কীভাবে বানায় তা জানিনা।”
মিসেস ইশানি মেয়ের কথা শুনে হেসে দিয়ে আবরারকে বলেন,
-“সিদল খাবারটির সাথে আমরা অনেকেই পরিচিত না।আর তোমার হওয়ারও কথা নয়,কারন তুমি তো রংপুরের নও তাই।যারা একবার খেয়েছে তারা কখনই ভুলবেন না এর স্বাদ। যে কোনো শুঁটকি মাছ আর সাধারণ কচুর ডাটা এবং পাতা দিয়ে তৈরি করা হয় এই সিদল।
প্রথমে কচুকে সামান্য হলুদ এবং হালকা লবণ দিয়ে অল্প সেদ্ধ করে নিতে হয়। তারপর ঢেঁকি অথবা শিলপাটায় শুঁটকি মাছ আর কচু ভর্তা করতে হবে। তারপর এই পেস্ট ছোট ছোট আকারের পাতলা গোল গোল টিকার মতো আকার দিয়ে রৌদ্রে শুকাতে হবে।
খুব ভালো ভাবে শুকিয়ে গেলে সিদলগুলিকে তুষের ছাইয়ের মধ্যে দুই মাস রেখে আবার রৌদ্রে শুকিয়ে নিতে হবে। এরপর সিদলের ওপর থেকে কালো আস্তরণ চেঁছে ফেলে এগুলিকে কাঁচের বয়ামে সংরক্ষণ করা হয়। কখনো কখনো মাটির বড় বড় কলসিও ব্যবহার করা হয়।
তারপর এটাকে বিভিন্ন ভাবে রান্না করে খাওয়া যায়।শুধু পেঁয়াজ দিয়ে ভুনা খাওয়া যায়। আবার সবজি বা মাছের সঙ্গেও খাওয়া যায়।তবে পিঁয়াজ দিয়ে করেছি কেননা অনেকে পছন্দ করে তাই।”
আবরার একবার গালে দিয়ে বলে,
-“আমার মম যদি রংপুরের হতো তাহলে অনেক বেটার হতো।আসরেই অসাধারন এই খাবারটা।”
-“এবারতো খাও,যে কালে ফড়িং রান্না শিখবে সেই কালে অবশ্যই খেতে পাবে।”
-“আদেও কী রান্না পারবে নাকী তাই সন্দেহ।এতো বড় হয়ে গেছে অথচ গ্যাস জ্বালাতে পারেনা।”
শাহরিয়া কথাটা বলে হাসতে থাকে।ইয়ারাবী মুখ ঘুরিয়ে বলে,
-“ঠিক আছে জীবনের প্রথম রান্নাটা তোমাকে দিয়েই টেস্ট করাবো,যেমনটা কফির সময় করিয়েছিলাম।”
কথাটা শুনে শাহরিয়ার হাসি থেমে যায়।কথাটা মনে পড়লেই ওর মাথা ঘুরতে থাকে।ইয়ারাবী যখন ক্লাস এইটে ছিলো তখন জীবনের প্রথম কফি বানায়।ওর ভাইয়ারা হালকা টেস্ট করে কোনো ভাবে কাটিয়ে শাহরিয়ার উপর চাপিয়ে দেয়।অগত্য শাহরিয়ারকে পুরো কফি শেষ করতে হয়,তবে বেচারার পুরো রাত টয়লেটে কাটাতে হয়েছিলো।
-“বোন তোর কাছে মাফও চাই,দোয়াও চাই।এবার আমি টেস্ট করতে পারবোনা।তোর বর আছে বরকে দিয়ে করিস।”
-“আরে বাবা সেই বারতো চিনির জায়গায় মনের ভুলে ওটা দিয়ে দিয়েছিলাম।পরীক্ষার পরে দাওয়াত থাকলো দুই বাদর চলে আসবা।”
হাসি-তামাশার মাঝে ওরা খাওয়া শেষ করে রুমে যেয়ে গুছিয়ে নেয়।এর মধ্যে ইফাজ রুমে ঢুকে ইয়ারাবীকে বলে,
-“এক্সাম কবে থেকে স্ট্যাট হবে?”
-“এইতো কয়েকদিনের মধ্যে,কেন?”
-“ডা.রূপক আমেরিকা থেকে আসছে,একবার যেতে হবে।”
-“কেন,আমি তো ঠিক আছি আবার কেন যাবো?”
-“যেতে বললাম যাবি,অতো তর্ক করিস কেন?”
-“বাট্ ভাইয়া…”
-“আহ্ ইয়ারাবী তোমার ভাইয়া তো তোমার ভালোর জন্যই বলছে তাইনা।”
-“কিন্তু আবরার…”
-“রেডি হয়ে গেছো তো, এখন সোজা নিচে যাবে…তোমার ভাইয়ার সাথে আমার কিছু কথা আছে।”
-“আচ্ছা।”
ইয়ারাবী আর একটা কথা না বলে নিচে গিয়ে আদিবার সাথে দেখা করে।
-“তুমি ডেকেছিলে আপু..”
-“সরি,মাফ করে দাও আমাকে”
-“কেন,তুমি তী করছো যে মাফ করবো?”
ইয়ারাবী জানলেও না জানার ভান করে।কেননা কথাটা ইতি ওকে জানিয়ে ছিলো,আর ও চাইনা ইতির কোনো ক্ষতি হোক।আদিবা একবার ইয়ারাবীর দিকে তাকিয়ে যা যা ও আর ওর মা করেছে তার সবটা খুলে বলে।ইয়ারাবী কথাটা শুনে বলে,
-“আজ কেন কথাটা বলছো?”
-“তোমার দুলাভাই আমাকে বুঝিয়েছে,এসব শয়তানের ধোঁকা ছাড়া আর কিছুই না।প্লীজ আমাকে ক্ষমা করে দাও।”
-“আসলে কী বলোতো,এখানে তোমারও দোষ নেই।আবরার মানুষটা এমন যে…যে কেউ ওর প্রেমে পড়বে,ভালোবাসবে।আচ্ছা আমাদের বেরতে হবে,আল্লাহ হাফেজ।”
ওরা সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে গাড়িতে বসে পরে।আবরার ড্রাইভ করছে,ইয়ারাবী ওর পাশে বসে ফোনে অনুর সাথে চ্যাট করছে।ঘন্টাখানিক পর ইয়ারাবী কারের গ্লাসটা নামিয়ে দেয়।আবরার ওর দিকে তাকিয়ে বলে,
-“ঠান্ডা বাতাস আসবে,আর ধুলাবালিও প্রচুর সমস্যা হবে।”
-“আবরার আমার সমস্যা হচ্ছে বলে খুলেছি,একটু পরে দিয়ে দিবো।”
-“কী হচ্ছে তোমার?”
-“ভ্ ভোমেট আসছে…”
আবরার সাথে সাথে ব্রেক মেরে গাড়িটা থামায়।তারপর ওর দিকে তাকিয়ে বলে,
-“খুব বেশি খারাপ লাগছে,গাড়ি থেকে নামবে?”
-“না,পেটে খুব পেইন শুরু হয়েছে আর যার জন্য।আমি গাড়ি চালান সমস্যা নেই,আমি করবোনা।”
-“দেখো ভোমেট হলে আটকে রাখতে নেই,আমি বলেছিলাম তুমি জার্নি করতে পারবে নাকী?”
-“আপনি গাড়ি চালান,কাল প্রনয় যখন ধাক্কা মেরেছিল পেটে আঘাত পেয়েছিলাম।আমি ঠিক আছি…”
-“তুমি একটু ঘুমানোর ট্রাই করো..”
আবরার ইয়ারাবী সিটটা হালকা হেলিয়ে দেয়।তারপর আবার ড্রাইভ শুরু করে।ঢাকায় পৌঁছাতে এবার একটু দেরী হয় ওদের।রাত আটটার দিকে ওরা বাসায় পৌঁছায়।ইয়ারাবী চার-পাঁচ বার বমি করে দেয়,ও ভালোর জন্য আবরার অনেক জায়গায় ব্রেক নেয়।
ওরা বাসায় ফিরে দেখে বাড়িতে সবাই চলে এসেছে।ইয়ারাবী ওর শ্বশুড়-শ্বাশুড়িকে সালাম দেয়,জারবা দৌড়ে ইয়ারাবীকে জড়িয়ে ধরে বলে,
-“তোমাকে খুব মিস করেছিলাম জানো ছোট ভাবী।”
-“আমিও তোমাদের সবাইকে খুব মিস করেছি।”
-“ওই পেত্নীর কথা বিশ্বাস করিসনা।”
ইয়ারাবী তাকিয়ে দেখে মেঘ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কোক খাচ্ছে আর কথাটা বলছে।আবরার মেঘের মাথায় গাট্টা মেরে বলে,
-“আর তুই যে কেমন তা আমরা সবাই জানি।”
-“মেঘ কাজটা হয়েছে তো…”
ইয়ারাবী প্রশ্নটা করলে মেঘ হেসে বলে,
-“আজ পর্যন্ত মেঘ কোনো কাজ অসম্পূর্ণ রাখেনি।”
ইকরা ইয়ারাবীর গালে হাত দিয়ে বলে,
-“তোমাকে এমন লাগছে কেন?”
-“হ্যাঁরে, মা তোকে এমন দেখাচ্ছে কেন?”
-“তেমন কিছুনা আম্মু,জার্নি করে এসেছি তাই।”
-“মম,তোমার ছোট বৌমা,যেয়ে ধরেই অসুস্থ।আমারও মেডিসিন নিতে মনে ছিলোনা,আসার সময় আরো বেশি অসুস্থ হয়ে পরেছে।”
মিসেস রায়হান ওনার ছেলেকে তাড়া দিয়ে বলেন,
-“আর তুই ওকে দার করিয়ে রেখেছিস,যা মেয়েকে নিয়ে উপরে।বৌ অসুস্থ আর উনি বাবুর মতো চেয়ারে বসেছে।”
-“মম আমিও খুব টায়ার্ড।”
-“ওর টায়ার্ডের কাছে তুই কিছুই না,যা আগে উপরে।”
-“বৌ পেয়ে সবাই ছেলেকে ভুলে গেছে,কপাল রে ভাই সব কপাল।এবার ভাইয়ার কষ্টটা বুঝতে করতে পারছি।”
-“তুই কী যাবি?”
আবরার ইয়ারাবীকে নিয়ে উপরে চলে আসে।
(৭৮)
-“কী বলছিস তুই,গ্রাম থেকে চলে এসেছে?”
-“তাই তো বলছি।”
-“শিকার খুব কাছে আছে..”
-“আমার মনে হয়না তুই কিছু করতে পারবি।”
-“দেখ সুমন ওকে যে কোনো কিছুই মূল্যেও ওকে আমার চাই।একটা রাত হলেও চাই,ওর সব তেজ আমি যদি না ভেঙেছি তবে আমার নাম…রাখছি এখন।”
কথাটা বলেই ছেলেটা ফোনটা কেটে দিয়ে ইয়ারাবীর দুই বছরের পুরাতন একটা ছবির দিকে তাকাই।
মাত্র ষোল বছরের একটা মেয়ে কীভাবে ওকে মারলো সেটা ভাবলেই ওর রাগ উঠে।ইয়ারাবী তখন ওর খালাদের সাথে সিলেটে বেড়াতে গিয়েছিলো।পড়নে ছিলো একটা ব্লাক কালারের প্লাজু,আর একটা ব্লাক কালারের টপস্,এমন কী স্কার্ফটাও ব্লাক কালারের।শ্যামলা মেয়েটাকে পুরো কালো রঙে অনেকটা ফুটে উঠেছে।পাহাড়ে ওঠা নিয়ে একটা ২৪ বছরের ছেলের সাথে ঝগড়া করছে।
-“ভাইয়া আমি বলছিতো আমি যাবোনা।”
-“দেখ সবাই যাবে সোনা,বলছিতো কিছু হবেনা।”
-“তোমরা যাও,আমি যাবোনা।”
-“আচ্ছা তুই এখানে ফুসকা খা,কোথাও যাবিনা।আমরা চলে আসবো।”
কথাটা ছেলেটা উপরের দিকে উঠতে থাকে।ইয়ারাবী ফুসকা স্টলে যেয়ে ফুসকা খেতে থাকে।আসলে ফুসকা পেলে ওকে আর পায় কে।পরপর তিন প্লেট ফুসকা খেয়ে ওর সেলফি তুলতে থাকে।কিন্তু কেউ যে ওকে দেখছে সেটা ওর একটুও খেয়াল হচ্ছেনা।
হঠাৎ একটা ছেলে ওর দিকে তাকিয়ে হাত বারিয়ে বলে,
-“হাই…”
-“আসসালামুআলাইকুম”
-“ওয়ালাইকুমুসসালাম, তোমার নাম কী?”
-“আপনাকে কেন বললো আমার নাম কী?”
-“না মানে একা একা আছো তাই ভাবছি তোমার সঙ্গ দি।”
-“আমি কী আপনাকে দিতে বলেছি…যান এখান থেকে।”
-“আসলে একটা কথা বলতে এসেছিলাম..”
-“কী?”
-“তোমাকে না আমার ভালো লেগেছে,বিশেষ করে তোমার বডি ল্যাঙ্গুয়েজ জাস্ট অসাম,আই লাভ ইউ।”
ইয়ারাবী এমন কথা শুনে রাগটা কন্ট্রোল করতে পারেনি।ঠাস করে একটা চড় মেরে দেয়,আর বলে,
-“নিজের বয়স দেখেছেন,আর কাউকে দেখলাম আর বললাম ভালোবাসি।ফাজালামি করছেন নাকী?”
-“তুমি আমার গায়ে হাত তুলে অনেক ভুল করেছো বাচ্চা….ইউ নো ভালো কথা তোমাকে বললাম আর তুমি চড় মারলে।”
-“আমি তো শুধু চড় মেরেছি,আমার ভাইয়ারা জানলে আপনাকে খুন করে ফেলবে।”
ছেলেটা ইয়ারাবীর চুলের মুঠি ধরে ওকে নিজের কাছে আনতে যায় তখনি ইয়ারাবী স্লেফ ডিফেন্স টেকনিকে ওর হাত মুচড়িয়ে ওকে উল্টে ফেলে দেয়।এর মাঝে কোথাও থেকে ইমন এসে দেখে ইয়ারাবী কাউকে মারছে।ইমন সব শুনে ছেলেটা আচ্ছামত মারে।ওখানকার লোকজন ওদের ছাড়িয়ে নেয়।
লোকটা ইয়ারাবীর ছবির দিকে তাকিয়ে বলে তোমার কাছ থেকে অনেক হিসাব নেওয়া বাকী সুইটহার্ট।এমনভাবে জ্বালাবো তোমাকে তুমি বাঁচার রাস্তা খুঁজে পাবেনা।
(৭৯)
ইয়ারাবী রুমে বসে চেলসির সাথে খেলা করছে।আবরার রুমে এসে দেখে টেবিলের উপর খাবারটা পরে আছে আর উনি চেলসিকে নিয়ে ব্যাস্ত হয়ে গেছে।
-“চেলসির সাথে বসে থাকলে পরীক্ষায় লাড্ডু পেতে বেশি টাইম লাগবেনা।”
-“আমিতো পড়ছি….”
-“রাত কয়টা বাজে খেয়াল আছে,ঘুমাতে হবে।আর এখনো খাওনি কেন?”
-“খেতে ভালো লাগছেনা,”
-“এমন বললে কী হবে,চলো খাইয়ে দিচ্ছি।”
-“আবরার সত্যি খেতে পারবোনা।”
-“তোমার মেডিসিন নিতে হবে ইয়ারাবী,এমন করলে বেশি খারাপ হয়ে যাবে।আর চেলসি নিজের ঘরে যাও।”
চেলসি আবরারের কথা শুনে রুম থেকে বেরিয়ে চলে যায়।আবরার বিরিয়ানি এক লুকমা ইয়ারাবীর মুখে তুলে দিয়ে বলে,
-“রাতে কখনো খালি পেটে শুতে নেই।”
-“কিন্তু আমি খেতে পারছিনা,খেলে ব্যাথা করছে।”
-“চিন্তা করোনা,মেডিসিন নিলে ঠিক হয়ে যাবে।”
-“আবরার আপনি কী আমাকে আগে থেকে চেনেন?”
-“হু,কেন?”
-“কীভাবে?”
-“পুরোটা খেতে হবে,আর আজ রাতে পড়তে হবেনা।”
ইয়ারাবী বুঝতে পারছে আবরার ওকে কিছু বলতে চাইছেনা।তাই ও বিষয়টা আর আগে বাড়াতে চাইনা।আবরার ওকে খাবার খাইয়ে মেডিসিন দিয়ে বসতে বলে ইনজেকশন রেডি করে নেই।ইয়ারাবী ওর দিকে তাকিয়ে বলে,
-“ইনজেকশনের বদলে মেডিসিন নেই?”
-“না,এটাই নিতে হবে।দেখি হাতটা দাও…”
ইয়ারাবী হাত না দিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে থাকে আর তখন…
#চলবে_____