জীবন মানে তুমি পর্ব-২০

0
4331

#জীবন মানে তুমি
#লেখিকা:H.B.Irini Ori
#পর্ব:২০

(৭৩)

নামাযের পর ইয়ারাবীর নানাসহ সকল মরহুমের জন্য প্রচুর দোয়া করা হলো।সবকিছু মিলিয়ে প্রায় বিকাল হয়ে এসেছে।ইয়ারাবী মানুষের ভিড়ভাড় যায়গা একদম পছন্দ করেনা।তাই একটা চেয়ার নিয়ে এক পাশে বসে ফোনে কাজ করছে।হঠাৎ জারিকা কিছু একটা ভেবে ওর সামনে এসে বসে বলতে শুরু করে,

-“এসে ধরে তো কারোর সাথে কোনো কথাই বলছিস না,বড়লোক হয়ে বেশি ভাব নিচ্ছিস।”

ইয়ারাবী ফোন থেকে চোখ সরিয়ে বলে,

-“এখানে তো ভাব নেওয়ার কিছু নাই আপু,তাছাড়া তুমিতো এসে নিজের মতো ঘুরে বেড়াচ্ছো।”

-“আর তুইতো ঘরে বসে থাকছিস।শোন ভাবছি ব্রিজের নিচে যে সরিষার মাঠ আছে ওখানে যাবো,যাবি তুই?”

ইয়ারাবী একবার ওর ডানপাশের দিকে তাকিয়ে দেখে কিছু একটা ভেবে ওকে বলে,

-“না আপু,ভালো লাগছেনা।তোমরা যাও,আমি যাবনা।”

জারিকা এবার রেগে বলে,

-“ভালো লাগছেনা নাকী ভাইয়ারা নিষেধ করে রেখেছে আমার সাথে মিশতে”

ইয়ারাবী ওর মাথার ওড়না ঠিকভাবে দিয়ে বলে,

-“তুমি জানোতো,তাহলে বলছো কেন?তাছাড়া খাওয়ার পর ভালো লাগছেনা।”

এর মাঝে ওর সেজো খালা পল্লবীর মা মিসেস রায়ীনা এসে ওদের সামনে বসে।ইনি পেশায় একজন স্কুল শিক্ষক হলেও ওনার চিন্তা-ভাবনা কিছুটা সেকালের।এই চিন্তা-ধারার জন্য পল্লবীকে দ্রুত বিয়ের পীড়িতে বসতে হয়,বলিতে হয় নিজের স্বপ্নকে।ইয়ারাবীর সাথে ওনার সম্পর্ক গভীর না হলেও কেন জানি ইয়ারাবী এনার কথায় আর কাজে খুব রেগে যায়।মিসেস রায়ীনার প্রথম কাজ হলো কোনো মেয়েকে দেখলে ঘর-সংসার নিয়ে লম্বা-চওড়া বক্তব্য প্রদান করা।প্রথম প্রথম পল্লবী যখন এসে বলতো ওর শ্বশুড়-শ্বাশুড়ি ভালোনা, তখন মিসেস রায়ীনার বক্তব্য ছিলো,

-“শ্বশুড়বাড়ির মানুষ এমন হয়,তাদের সাথে মানিয়ে চলবি।যদি ওনারা গায়ে হাত তোলে তাহলে মুখ বুজে সহ্য করবি।মেয়েদের নিয়ম লাল শাড়ি পরে শ্বশুড়বাড়ি যাবে আর সাদা কাফন পরে বের হবে।”

সেদিনের পর পল্লবী নিজের জীবন যুদ্ধে নিজে নেমে যায়।ও জানতো ওর মাকে বলে কোনো লাভ নেই।কেননা মিসেস রায়ীনা নিজের বিবাহিত জীবনে শ্বশুড়বাড়িতে কম মার,অপমান সহ্য করেননি।এখনো তো মাঝে মাঝে ওনার স্বামী ওনার গায়ে হাত তোলেন।উনি ইয়ারাবীর দিকে তাকিয়ে বলেন,

-“কী কথা হচ্ছে বোনেরা মিলে?”

-“তেমন কিছুনা।”

ওর খালা একবার ওর মাথা থেকে পা পর্যন্ত চোখ বুলিয়ে,

-“তোদের বিয়ের তো মনে হয় প্রায় একমাস হতে চললো তাইনা?”

-“হ্যা সামনের সোমবারে একমাস হবে মনে হয়।”

-“শুনলাম তোর বলে পড়তে দিচ্ছে আবরার,তা ওই বাড়ির লোকজন কেমন?”

-“সবাই খুব ভালো,কেন?”

-“তেমন কিছুনা,তা বাচ্চা কবে নিবি?”

-“আগে স্ট্যাডি শেষ করবো তারপর…”

-“পাগল তুই,যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বাচ্চা নিয়ে ফেল।বাচ্চা হলো একটা শক্ত খুঁটি বুঝলি, তোর বরতো আবার শুনেছি খুব ফেমাস।বিদেশে ছিলো এতদিন,এসব ছেলেদের আবার চরিত্র ঠিক থাকেনা।আমিতো তোকে এখানে বিয়ে দিতে না করেছিলাম,কিন্তু তোর বাবা আর ইরাকের মা আমার কথা শুনলোনা।”

জারিকা ওর ফুপির তালে তাল মিলিয়ে বলে,

-“তুমি ঠিক বলেছো ফুপি,কে জানে কত মেয়ের সাথে রিলেশন ছিলো।আপনার বলেছিলাম না ফুপি,আমাদের পাশের বাড়ির পলাশ ছেলেটার কথা।ও বেচারার চেহারা কতটা সাদা-মাটা,ভদ্র মনে হয়,তা নয়।দেশে এসে বিয়ে করবে সেই সময় জানা যায় ওর ওই দেশে কয়েকটা মেয়ের সাথে পরকীয়ায় যুক্ত ছিলো।ভাবা যায়,এসব মানুষের পরকীয়ার জন্য আমাদের দেশটা একেবারে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে।”

-“তুই যাই বলিস না কেন জারিকা,তবে মেয়েদের আসল যায়গা হলো ঘর-সংসার আর সন্তান সামলানো।দেখ তোর শ্বশুড়বাড়ির লোকেরা উপর উপর কিছু না বললেও নিচে নিচে কিন্তু চাই তুই সংসার সামলা,এসব পড়াশোনা করেই বা কী লাভ?সেই চাকরি তো আর করতে পারবিনা।শোন শ্বাশুরবাড়ির লোকের অভিসাপ একবার লাগলে খন্ডানো যায়না,তুই তো এখন বুঝবিনা পরে বুঝবি।দেখেছিস কেমন জারিকা,মিলিস্তা বিয়ের পর বাচ্চা নিয়েছে।এজন্যই তো পল্লবীকে নিতে বলেছিলাম,কেননা বাচ্চা মানে তোর থাকার জায়গা পাকাপোক্ত।”

ইয়ারাবীর খুব রাগ উঠে কথাগুলো শুনে।ও বলেই ফেলে,

-“নিজের মেয়েরে বলির পাঠা বানিয়ে শান্তি হয়নি বলে এখন আমাকে বানাতে এসেছেন।এই যে জারিকা আপু মাত্র আঠারোতে বাচ্চা নেওয়ার জন্য কত বড় ঝুঁকিতে ছিলো।আর পল্লবী আপু তো মরতে মরতে বেঁচে ফিরলো।এসব আদিকালের ভ্রান্ত ধারনা আমাকে শুনাতে আসবেননা।আর আপু,আমার স্বামী যদি পরকীয়া করে তবে সেই চিন্তা আমি করবো…আপনাকে করতে হবেনা।”

ওর খালা ওর রেগে যাওয়া দেখে বলে,

-“দেখ একদম তেজ দেখাস না,আমি তোর মা নই যে চুপচাপ দেখবো।জীবনে তোকে ভালো কোনো পরামর্শ দেওয়া যায়না।যাইহোক,এমন করলে আবার তোর মা কিছু না বললেও তোর খালা আমার চৌদ্দগুষ্টি উদ্ধার করবে।এখানে দেখি মার থেকে মাসির দরদ বেশি।”

জারিকা ওর বাম হাতটা নিয়ে ব্যাসলেটের উপর হাত রেখে বলে,

-“এটা নিশ্চয়ই আবরার দিয়েছে…বিয়ের রাতে দিয়েছে গিফ্টটা তাইনা।”

-“না,বিয়ের আগেই দিয়েছিলো।”

-“ওহ্,তো সব সময় পরে থাকিস নাকী?খুলিসনা কখনো।”

-“না আপু,খোলা হয়না।একবার মনি বলেছিলো বিয়ের পর হাত কখনো খালি রাখতে নেই,আমিতো চুরি পরতে পারিনা,তাই সব সময় এটা পরে থাকি।তাছাড়া উনিও খুলতে বারন করেছেন।”

-“আসল হিরার এটা…”

-“হ্যাঁ,আপু…আচ্ছা তোমরা থাকো আমি খালামনির কাছ থেকে আসছি।”

ইয়ারাবী ওদের উত্তরের কোনো অপেক্ষা না করেই ওখান থেকে হাঁটা দেয়।ওর খালার কথা শুনে তো রাগ উঠেছিলো এমনিতেই,তার উপর জারিকার চোখের চাহনি।ওর চোখের দৃষ্টি ইয়ারাবীর কাছে স্বাভাবিক লাগেনি।কেন মনে হচ্ছে,ও প্রচন্ড রকমের হিংসা করছে ইয়ারাবীকে…খুন করতে পারলে হয়তো ওর দৃষ্টি শান্ত হতো।এদের সাথে এতগুলো বছর কাটিয়ে ও অন্ততপক্ষে এটা বুঝতে পেরেছে কে ওর ভালো চাই আর কে খারাপ।জারিকা ওর বড় হলেও সব সময় ওর সাথে পাল্লা দিতো।শুধু জারিকা নয় এই পরিবারের অনেকেই ওকে সহ্য করতে পারেনা…পথের কাঁটা মনে করে ওকে।ও আজও মনে আছে ওই দিনের কথা,কেন যে ওর সাথে এমন করলো ও আজও বুঝতে পারেনা।

সময়টা ছিলো হেমন্ত কালের মাঝামাঝি,তখন ইয়ারাবীর আট বছর বয়স।রংপুরে এসেছিলো ওর এক মামার বিয়ে উপলক্ষে।ছোট বাচ্চা সাধারনভাবে বাকীদের সাথে মিশতে চাইবে।জারিকারা তখন ওর থেকে কিছুটা বড়ো।সবাই ওদের ছাদের উপর খেলা করছে।ও ওর মায়ের পিছু ঘুরঘুর করছিলো।কিন্তু ওর মায়ের এসব একদম পছন্দ নয়।উনি হাতের কাজ রেখে ওরদিকে তাকিয়ে বলেন,

-“তোকে বলেছিনা,আমার পিছনে আসবিনা।”

-“তুমি আমার সাথে এমন করো কেন আম্মুনি?তোমার কাছে না আসলে কার কাছে যাবো।”

-“ওহ্,যা এখান থেকে…”

ইয়ারাবী দু’পাশে মাথা হেলিয়ে না করে।মিসেস ইশানি রেগে কিছু বলতে যাবেন তার আগেই ইমন ওকে কোলে নিয়ে বলে,

-“ফড়িং চকলেট খাবি…”

ইয়ারাবী ওর ছোট মাথা দুলিয়ে হেসে হ্যাঁ বলে দেয়।ইমন ওর পকেট থেকে চকলেট বের করে বলে,

-“তোকে না বলেছি,এখানে আসলে আমাদের সাথে থাকবি…তাহলে খালার কাছে কেন ঘুরছিস?”

ও নিজের ঠোঁট ফুলিয়ে ছোট ডান হাতের একটা আঙ্গুল দিয়ে ছাদের দিকে ইশারা করে বলে,

-“দেখো ভাইয়া,আমার ছাদে খেলছে অথচ আমাকে নিচ্ছেনা।আমিও খেলবো…”

ওর মা কথাটা শুনেও না শুনার ভান করে ওখান থেকে চলে যায়।ইমন ওর দিকে তাকিয়ে বলে,

-“য়ুহার আপু কোথায়?”

-“প্রানো আপুর বাসায়,আমাকে নিতে চেয়েছিলো আমি যায়নি।”

-“ওদের সাথে তোর খেলতে হবেনা,ভাইয়ারা মাঠে ফুটবল খেলছে।চল ওখানে যেয়ে খেলা করবি।”

ইয়ারাবী চোখগুলো ছোট ছোট করে মাথা দুলিয়ে বলে,

-“ওরা আমাকে ছোট বলে খেলতে নেয়নি, ভাইয়ারা আরো বড়ো..আমাকে নিবেনা।”

ইমন কিছু একটা ভেবে বলে,

-“বিকাল বেলা মাঠে কিন্তু ফড়িং পাওয়া যায়।”

-“তুমিও খেলবে তো।”

-“হ্যাঁ,খেলবো এখন চল…”

ইমন ইয়ারাবীকে মাঠে নিয়ে যায়।কেননা মিসেস ইশানির ভরসায় ওকে রাখতে ওর মা মানা করেছে।এটা গ্রাম এলাকা তাছাড়া বিয়ে বাড়ি,যা কিছু হতে পারে।ওদের মাঠটা অনেক বড়,পাশে একটা পুকুর।ইমন ওকে পুকুর থেকে দূরে দাঁড়িয়ে খেলতে বলে।ফড়িং দেখার সাথে সাথে ইয়ারাবীকে আর পায়কে।এদিক-ওদিক ফড়িং এর পিছন দৌঁড়াচ্ছে।

ওই রাস্তা দিয়ে মিলিস্তা ওর মায়ের সাথে আসছিলো।কী একটা মনে করে ও মিসেস নিন্দুর কাছে থেকে যেয়ে আস্তে আস্তে ইয়ারাবীর পিছনে দাঁড়ায়।ইমনের ও বয়স তখন কম,ও ভাইয়াদের খেলা দেখছে…আসলে ও নিজেও খেলতে চেয়েছিলো কিন্তু ও খেললে ইয়ারাবীর মন খারাপ হবে তাই বসে আছে।হঠাৎ একটা চিৎকারে ও পাশে তাকিয়ে দেখে ইয়ারাবী পানিতে পরে গেছে অপরদিকে ওর ভিতু চেহারা দেখে মিলিস্তা হাসছে।ইমন তখন হালকা সাঁতার পারে,তবে এই সাঁতারে কাউকে বাঁচানো সম্ভব নয়।

এদিকে ইরাকরা চলে এসে যখন দেখে ইয়ারাবী পরে গেছে তখন ইরাক ওকে পানি থেকে তুলে আনে।ও অনেকটা ভয় পেয়ে কান্না করছে,পুরো শরীর শীতে কাঁপছে।ইফাজ ওর গায়ে জ্যাকেটটা ওকে পরিয়ে দেয়।ইরাক মিলিস্তার হাসি দেখে ওকে জোরে একটা থাপ্পড় মেরে দিয়ে বলে,

-“তুই জানিস না ও সাঁতার পারেনা,তাহলে ধাক্কা কেন দিলি ওকে?”

-“তাই বলে আমাকে মারবেন ভাইয়া,আমিতো মজা করে..”

-“এটা কী ধরনের মজা,তুই ওর বয়সে বড়ো হয়ে,ছোট বাচ্চার সাথে মজা করতে তোর বিবেকে বাঁধলো না।”

মিলিস্তা গালে হাত দিয়ে বলে,

-“সহ্য হয়না আমার ওকে তাই ফেলেছি”

কথাটা বলেই দৌঁড়ে ওখান থেকে চলে যায়।ইরাকের তো রাগে শরীর কাঁপছে।ইয়ারাবী ওর কাধে মাথা রাখা অবস্থায় বলে,

-“ভ্ ভাইয়া, শীত লাগ্ লাগছে।”

ইরাক ওর গায়ে ভালো করে জ্যাকেটটা দিয়ে বাসায় এসে দেখে মিলিস্তা কাঁদতে কাঁদতে সবার কাছে ইরাকের নামে বিচার দিচ্ছে।ইয়ারাবীকে ওই অবস্থায় ওর মা আর ওর খালামনি দৌঁড়ে এসে জিজ্ঞেস করে কী হয়েছে।ইরাক পুরো ঘটনা বললে মিসেস নিন্দু বলে,

-“আব্বু তাই বলে তুমি ওকে এতো জোরে মারবে।পুরো দাগ বসে গেছে।”

-“ওর আপনার মেয়ে যে পিচ্চিকে মেরে ফেলতে গেছিলো তার বেলায়।আপনার মেয়ের বয়স হয়েছে আর ভালো-মন্দ বুঝতেও শিখেছে…”

মিসেস ইশানি ইরাকের দিকে তাকিয়ে বলে,

-“তারপরেও তোর এতো জোরে মারা উচিত হয়নি,কানে যদি সমস্যা হয়ে যেতো।”

-“আর আপনার মেয়ের বেলায় কিছুই না…”

-“আমিতো তা বলছিনা…ওকে আমার কাছে দে”

-“থাক লাগবেনা,কেমন মা আপনি সেটা আমি ভালো জানি।আম্মু একে নিয়ে যেয়ে ড্রেসটা চেন্জ করে দাও।আদিব ভাইয়া ডাক্তারকে কল করছে।”

ডাক্তার ওকে দেখে গেলে ওর বাবা ওর পাশে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি।অবশ্য ঘুমিয়ে আছে সেজন্য,জেগে থাকলে কেন যে মেয়ের প্রতি রাগ দেখায় সেটা উনি ভালো বলতে পারবেন।ইয়ারাবী মা রুমে ঢুকে ওকে ঘুমের থেকে টান দিয়ে বসিয়ে মারতে থাকেন।মিলিস্তা ওদের ঘরের জানালা দিয়ে দেখছে আর হাসছে।মি.ফুয়াদ ওনার স্ত্রীকে ছাড়িয়ে নিয়ে বলেন,

-“মারছো কেন ওকে?”

-“তো কী করবো,যতবার কোথাও যায়,কোনো না কোনো ঝামেলা বাঁধায়।একে না মারলে শিক্ষা হবেনা।”

ইয়ারাবী ছোট থেকে নিঃশব্দে কান্না করে।ওর দু’চোখ থেকে বৃষ্টির ধারার মতো পানি পরছে।ও অবশ্য এই ভয়টা পেয়েছিলো ওর মা ওকে মারবে।ও ওর মায়ের দিকে তাকিয়ে বলে,

-“আম্মুনি,আমাকে কেন মারছো?আমিতো ইচ্ছা করে পরিনি,মিলিস্তা আপু ফেলে দিয়েছে।”

-“তুই পুকুর পারে না গেলে ও তোকে ফেলতো নাকী?তোকে সাদে অপয়া বলি,তোর জন্য মেজো আপা আমাকে যা নয় তাই বললো।মাও আমাকে বকা দিলো…”

মি.ফুয়াদ বাইরে বেরিয়ে ওর খালামনিকে বলেন ইয়ারাবীকে নিজের কাছে রাখতে।সেদিন রাতে ইয়ারাবী ওর খালার কাছে ছিলো।পরদিন মিলিস্তা ওকে বলেছিলো,

-“তোকে ধাক্কাটা আমি ইচ্ছা করে দিয়েছি কেননা দাদী সবার থেকে তোকে বেশি ভালোবাসে।তোর জন্য আজ সকালে দাদী আমাকে বকা দিয়েছে।এবার দেখ বকা খেলে কেমন লাগে?”

অতীতের কথাগুলো ভাবতে ভাবতে ইয়ারাবী ওর খালামনির রুমের সামনে এসে নক করে।ওর খালামনি ইমনের সাথে কিছু নিয়ে কথা বলছিলো।ওকে দেখে বলে,

-“আম্মু তোকে না বারন করেছি,পারমিশন নিয়ে আসতে।আয় ভিতরে….”

-“পুরানো অভ্যাস…তুমি ডাকছিলে কেন?”

-“দেখতো এই চুড়ি দু’টো কেমন?”

-“অনেক সুন্দর,এগুলো তো সেদিন তুমি অর্ডার দিয়েছিলে তাইনা…কিন্তু সাইজে ছোট লাগছে,হাতে হবেনা মনে হচ্ছে।”

ওর খালা হেসে ওর বাম হাতটা ধরে ওকে পরিয়ে দিয়ে বলে,

-“পাগলি,এগুলো আমি আমার জন্য না,তোর জন্য বানিয়েছি…”

ইয়ারাবী কথাটা শুনার সাথে সাথে হাত থেকে চুরি খুলতে গেলে বলে,

-“খবরদার খুলবিনা এটা…”

-“কিন্তু খালামনি আমি এটা নিতে পারবোনা…এটা নিলে সবাই খুব রাগ করবে,তুমি বুঝছোনা কেন?”

-“আজ নিজের মেয়ে হলে এমন করতিস না”

-“কিন্তু খালা…”

-“কোনো কিন্তু না মা,রাখ তোর কাছে।আমার খুব শখ ছিলো নিজের মেয়েকে এমন চুরি বানিয়ে দিবো।কিন্তু আমার তো আর মেয়ে নেই,আছে এই তিনটা বাঁদর…তাই তোকে নিজের মনে করে দিলাম।”

-“ইমোশনাল ব্লাকমিল,তুমি পারো বটে..”

ইয়ারাবী ওর খালার সাথে কথা বলে রুমের দিকে পা বাড়ায়।

(৭৪)

-“আর কখনো স্বপ্ন নামক মরিচিকার পিছনে ছুটতে চাইনা।”

-“লোহার উপর থেকে মরিচিকা সরিয়ে কিন্তু তার উপর নতুন করে প্রলেপ দেওয়া হয়।সৃষ্টি হয় এক নতুন রুপ।”

-“দিলেও বাকী,সেই আবার মরিচিকা ধরে ক্ষত সৃষ্টি করবে…একটা সময় দুর্বল হয়ে ভেঙে যাবে।যার কোনো মুল্য থাকবেনা।”

-“হাসালে তুমি য়ুহার…যার শুরু আছে তার অবশ্যই শেষ থাকবে এটাও স্বাভাবিক।”

-“মহাকাশ সম্পর্কে একটু হলেও জ্ঞান আছে আপনার।তাহলে বলুন তো কোথায় শুরু কোথায় শেষ সেটা কেউ জানতে পারেনা কেন?”

য়ুহারের কথা শুনে শৈল হেসে দেয়।ও জানে ওর চাওয়া ওর জেগে থেকে স্বপ্ন দেখা দু’টা এক ।কেননা য়ুহার কখনো ওকে নিজের সঙ্গী হিসাবে মেনে নিবেনা।তবুও বারবার ও য়ুহারের কাছে ছুটে যায় নিজের ভ্রমটাকে সত্যি করার জন্য।

শৈল য়ুহারকে চেনে স্কুল জীবন থেকে,ওর তিন বছরের সিনিয়র শৈল।অর্কভ আর শৈল দু’জনে বন্ধু ছিলো।প্রথম দেখায় য়ুহারকে ভালো লেগে যায় শৈলের,কিন্তু অর্কভের জন্য নিজের চাওয়াকে বির্সজন দেয় শৈল।কিন্তু সেই অর্কভ আগলে রাখতে পারেনি য়ুহারকে।কথায় আছেনা,”লোহাকে আগুনে রেখে যত পিটাবে তত শক্ত হবে।”য়ুহার ক্ষেত্রেও তাই,অর্কভের করা এক একটা তাসছিল্য ওকে আজ এতদূর নিয়ে এসেছে।

শৈল প্রানোর কাছে যখন জানতে পারে য়ুহার এসেছে তখন ওর সাথে দেখা করার জন্য ছুটে আসে।শৈল একজন সরকারী কলেজের বিজ্ঞান বিভাগের প্রফেসর।বাড়ির উত্তর দিকে কাঁঠাল গাছের সাথে পিঠ ঠেকিয়ে কথা বলছে য়ুহার।আর শৈল অপলক ভাবে সেটা দেখে যাচ্ছে।

শৈল য়ুহারের প্রশ্ন শুনে বলে,

-“নিজের স্বপ্নগুলোকে মাকড়সার জালের সাথে তুলনা করো।তাহলে এটা জানোনা মাকড়সার জাল একবার ছিড়ে গেলে তারা অবার বুনে।”

-“কিন্তু আমি বুনতে চাইনা,সব সুঁতো ফুরিয়ে গেছে শৈল ভাইয়া।আচ্ছা মাগরিবের আযান দিবেই হয়তো নামায পড়তে হবে,আসি আমি।”

শৈল য়ুহারকে কথা বলার সুযোগ না দিয়ে বাড়ির ভিতর চলে যায়।শৈল প্রতিবারের মতো এবারও শূন্যে দৃষ্টি মেলে বিশাল আকাশ দেখতে থাকে।য়ুহার একটা বারও পিছনে তাকিয়ে দেখেনা মানুষটা কী করছে?এমনটা নয় যে য়ুহারের ভালো লাগেনা,শৈলকে য়ুহারের ভালো লাগে কিন্তু আর কোনো নতুন জাল বুনতে চাইনা।আগুনে পুড়ে নিজে দগ্ধ হতে চাই,কিন্তু সেই আগুনে অন্যকে পুড়াতে চাইনা।

য়ুহার রুমের ভিতরে যেতেই জারা আর টিকলি ছুটে আসে য়ুহারের কাছে।য়ুহার তাদের এমন আসা দেখে ভ্রু যুগল কুচকে বলে,

-“কী চাই তোদের?”

জারা মুখে একটা হাসি ফুঁটিয়ে বলে,

-“আপু,আপিপুকে বলোনা কাল থাকতে…”

য়ুহার বিছানার এলোমেলো চাদরটা ঠিক করতে করতে বলে,

-“কেন,কোথায় যাচ্ছে ও?”

-“দুলাভাই বললো কাল সকালে চলে যাবে…প্লীজ আপু তুমি ওদের আটকাও।আমি ভাইয়াদের বললাম কিন্তু ভাইয়া বললো আপিপুর কিছুদিন পর পরীক্ষা চলে যেতে হবে…”

-“তা তো ঠিকই,এমনিতে মেয়েটার বিয়ের প্যারার জন্য অনেক পড়া গ্যাপ গেছে…আর এতোদিন অসুস্থও ছিলো,তোদের তো বুঝতে হবে।”

টিকলি পেয়ারা খেতে খেতে বলে,

-“একদিনে কিছু হবেনা,আপনি একটু চেষ্টা করেন।”

-“দেখ টিকলি,ইয়ারাবীকে গ্রামে থাকতে বলা রিক্স,তুই না বুজলেও জারা জানে।তাছাড়া এখন শুধু ইয়ারাবী নয় আবরারও আছে…”

জারা বলে,

-“আপু জানি সবটা,কিন্তু তারপরও একটা চেষ্টা করে দেখ।”

-“একটা কাজ কর,তোরা আবরারের সাথে কথা বলে দেখ…ওকে রাজী করাতে পারলে ইয়ারাবীও থাকবে।”

-“দুলাভাই কী মানতে চাইবে আমাদের কথা?”

-“অবশ্যই,তোরা শালী,মানতে তো হবেই…এখন যেয়ে দেখ মনে হয় ঘরে আছে….”

কথাটা শুনে জারা আর টিকলি দৌঁড়ে ওর বাসায় ঢুকে।মিসেস ইশানি ওনার মেজো বোনের সাথে কথা বলছিলেন বারান্দায়।ইয়ারাবী ওর খালার কাধে মাথা দিয়ে ফোনে কাজ করছিলো।মিসেস ইশানি ওদের এভাবে আসা দেখে বলে,

-“এভাবে গরুর মতো ছুটতে ছুটতে য়ুহারের ঘর থেকে বের হলি কেন?”

টিকলি হাফাতে হাফাতে বলে,

-“তেমন কিছু না খালা,আগে বলেন দুলাভাই কই?”

-“কোন দুলাভাই?এখানে তোদের অনেকগুলো দুলাভাই আছে।”

জারা পাশে রাখা পানির বোতল থেকে পানি খেয়ে বলে,

-“বাকিগুলোকে দিয়ে কাজ নেই,আপাতত আবরার দুলাভাইকে লাগবে।”

-“জানিনা তো মা…ইয়ারাবী আবরার কোথায়?”

ইয়ারাবী ফোন থেকে চোখ না সরিয়ে হাতের আঙ্গুল দিয়ে ছাদের দিকে ইশারা করে বলে,

-“উপরে বসে সবার সাথে কথা বলছে…”

-“থ্যাংকু আপিপু,তুমি খুব উপকার করলে……”

জারা আর টিকলি এক দৌড়ে ছাদে যেয়ে দেখে আবরার চেয়ারে বসে ওর ভাই আর দুলাভাইদের সাথে কথা বলছে।ইমন জারা দিকে তাকিয়ে বলে,

-“কীরে সাদি,বাদরের মতো লাফাচ্ছিস কেন?”

জারা মুখ ফুলিয়ে রেগে বলে,

-“তোমার সাথে কথা বলতে আসিনি আমি…আবরার ভাইয়া আপনার সাথে কথা আছে আর হ্যাঁ,আগেই বলছি শালিরা কিছু চাইলে দিতে হয়।”

আবরার ওদের কথা শুনে হাসতে হাসতে বলে,

-“কী চাই তোমাদের?আমি যদি দিতে পারি তবে অবশ্যই দিবো।”

-“তেমন কিছু চাইনা,আপনার কাছে একটা রিকুয়েস্ট করতে এসেছি…”

-“কী রিকুয়েস্ট?”

-“বলছি কালকের দিনটা থেকে পরশুদিন গেলে হয়না…প্লীজ দুলাভাই”

-“তোমার আপুর তো এক্সাম আছে,ওকী বলছে?”

-“আপিপুকে কিছুই বলা হয়নি,জানি কিছু বললেও ওই ঘুরে-ফিরে আপনার কাছে আসতে হতো।তাই বেশি কষ্ট না করে একবারে আপনার কাছে আসলাম।কারন আপনি হ্যাঁ বলা মানে আপিপুর থেকে যাওয়া।”

আবরার জারার দিকে তাকিয়ে বলে,

-“তোমার এমন কেন মনে হয়,আমি রাজি হলে ও থাকবে?”

-“আমরা জানি আপিপু আপনার সব কথা শোনে,প্লীজ আপিপুকে বলেন।”

-“আচ্ছা ঠিক আছে,তবে পরশু কিন্তু চলে যাবে”

-“থ্যাংকু,থ্যাংকু দুলাভাই…”

জারারা যেতেই মাগরিবের আযান দিয়ে দেয়,ওরা সবাই মসজিদে নামাযের জন্য চলে যায়।ইয়ারাবী নামাযের জন্য উঠতে যাবে ঠিক তখনি ও নিজের পেট চেপে ধরে বসে পরে।মিসেস ইশানি ওনার মেয়ের দিকে তাকিয়ে বলে,

-“এই কী হয়েছে রে তোর?”

-“কিছুনা,খালামনি আমার সাথে রুমে চলো একটু..”

মিসেস ইশানি মেয়ের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকেন আর ভাবেন,

-“মেয়েটা এতটাই আমাকে পর ভাবে যে,সমস্যার কথা ওর মাকে না বলে খালাকে বলে।অবশ্য দোষটা আমাদের…যা আমাদের কাছে পাওয়ার কথা তা ওর খালার কাছে পেয়েছে।ও বাড়ি থেকে যাওয়ার পর বুঝতে পারছি ঘর কতটা শূন্য…আসলে তুই ঠিক বলতি,”দাঁত থাকতে দাঁতের মর্ম কেউ বোঝেনা।”তুই বাড়িতে চুপচাপ থাকলেও মনে হতো বাড়িতে কেউ আছে,চোখের সামনে তো দেখতে পেতাম।”

মা যেমনি হোক না কেন,মায়ের মন তার সন্তানের জন্য কাঁদে।হাজার হোক নাড়ী ছেড়া ধন,একটু হলেও যন্ত্রনা হয়।তবে মেয়ে থাকতে তার মর্ম উনারা বুঝতে পারেননি।এক একটা আঘাতে ওকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়েছেন প্রতিনিয়ত।আসলে মিসেস ইশানির খারাপ লাগাটা কীসের জন্য?মেয়ের শূন্যতার অনুভব নাকী ওর প্রতি অবিচার করার অপরাধ?

(৭৫)

দেখতে দেখতে একটা রাত পার হয়ে যায়।ইয়ারাবী দিনে যতটা সাহসী থাকুক না কেন রাতে ঠিক ততোটা ভীতু।প্রতিরাতের মতো সেই রাতেও হাইপার হয়ে যায়,তবে সকালে উঠে কিছু মনে থাকেনা।আবরার ব্যাপারটা বুঝতে পারছেনা আসলে সমস্যাটা কোথায়।তাছাড়া ওর সাথে কথা বলতে গেলে,বুঝতে পারে রাতেই কথা কিছু মনে নেই।তবে ইয়ারাবী বিকাল থেকে কিছুটা অসুস্থ কেননা ওকে প্রতি দু’দিন পর পর ইনজেকশন নিতে হবে।কিন্তু ওরা একদিন থাকার জন্য এসেছিলো।সারাদিন ধরে রুমে বসে ছিলো ইয়ারাবী সাথে আবরারও ছিলো।বিকালের দিকে ও ঘুমালে আবরার রুম থেকে বের হতেই মি.ফুয়াদ ওর কাছে এসে বলে,

-“আবরার,ইস্মার কী হয়েছে?”

-“তেমন কিছু না আব্বু ও একটু অসুস্থ আরকী… মেডিসিন আনা হয়নি তাই।আসলে আমাদের থাকার উদ্দেশ্য ছিলোনা।”

মি.ফুয়াদ ওর সামনের চেয়ারে বসে বলে,

-“তুমি কিছু লুকাচ্ছো বাবা সেটা বুঝতে পারছি, ওতো মরে গেলেও বলবেনা।”

-“আব্বু কিছু মনে না করলে একটা কথা বলি..”

-“হ্যাঁ,বাবা বলো..মনে করার কী আছে।”

-“আসলে ওর শরীরে বিভিন্ন দাগ দেখেছি,যেগুলো দেখে মনে হচ্ছে ওকে ফিজিক্যালি টর্চার করা হয়েছে…কে করছে এমন কিছু বলতে পারেন?”

মি.ফুয়াদ চেয়ার থেকে উঠে নিজের হাত ঘড়িটা দেখে বলেন,

-“আমি তোমার সাথে পরে কথা বললো,একটু বাজারে যেতে হবে..কাজ আছে।”

মি.ফুয়াদ হন্তদন্ত হয়ে ওখান থেকে চলে যান।আবরার ওনার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে ঠোঁট বাকিয়ে হাসতে থাকে।কিছু মানুষের অপূর্ণ কথা তাদের আচারনের মাঝে পূর্ণতা পায়।আর মি.ফুয়াদের আচারনে আবরার সেটা ঠিক বুঝতে পেরেছে।তবে ইয়ারাবীকে পুরোটা সুস্থ করতে হলে এই কাহিনীর গভীরে যেতে হবে…খুঁজতে হবে আসল ঘটনার শিকর।

-“‘কত বড় আমি’ কহে নকল হীরাটি|
তাই তো সন্দেহ করি নহ ঠিক খাঁটি||”

-“সন্দেহের কারন তাইতো।”

আবরার পাশে তাকিয়ে দেখে য়ুহার দাঁড়িয়ে আছে।আবরার ওর দিকে তাকিয়ে হেসে বলে,

-“তেমন কিছুনা,কবিতাটা ভালো লাগে তাই…আপনি এসে বসুন না।”

য়ুহার হেসে ওর সামনে বসে বলে,

-“তুমি কথাটা যে খালুকে উদ্দেশ্য করে বলেছো সেটা আমি খুব ভালো বুঝতে পারছি।আর এটাও জানি ইয়ারাবীর বাবা-মার আচারনে তোমার কৌতুহলের শেষ নেই,ওনারা তোমাকে যতটা ভালোবাসবে,সম্মান করবে তার এক তৃতীয়াংশ ওকে দিবেনা।”

-“য়ুহার আপু,আপনার কথা শুনে মনে হচ্ছে আপনি অনেক কিছু জানেন।”

য়ুহার দূর আকাশে দৃষ্টি মেলিয়ে বলে,

-“এই বিশাল আকাশের বিস্তৃতি অনেক হলেও এর একটা শেষ আছে,কিন্তু জানার কৌতুহলের শেষ নেই আর সব প্রশ্নের উত্তরও কিন্তু হয়না।”

-“আপনি ইয়ারাবীর ব্যাপারে কিছুটা হলেও জানেন।আপনার কেয়ার দেখে মনে হয় আপনি সব সময় চান ও ভালো থাকুক।”

-“ইফাজ সব আমাকে বলেছে,আর আমি এটাও জানি ওর কীসের ট্রিটমেন্ট করছো।জানো ও যদি মারা যায় তাহলে অনেকের মুখে হাসি ফুটবে।”

-“কারনটা কী?”

-“‘পর দোষ তোমার নিকটে যেই কয়,
বলে সে তোমার দোষ অপরের নিশ্চয়!’

মানেটা বুঝতে পারছো তুমি?”

-“হামম তা তো বুঝেছি..”

-“দেখ আবরার ও ছোটবেলায় খুব হাসি খুশি মেয়ে ছিলো।তবে ওকে সব সময় চোখে চোখে রাখতো। ওর বাবা-মা বাকি বাচ্চাদের মতো ওকে কখনো ফ্রিডম দেয়নি।যখন বাকী বাচ্চারা মাঠে খেলা করতো তখন ওকে রুমে রাখা হতো।সব সময় তাদের পছন্দ মতো ওকে চলতে হতো,এমনি স্কুলের ফ্রেন্ড ও মা বেছে দিতো।পাঁচ বছর বয়স পর্যন্ত ওকে খুব আদর যত্নে রাখতো সবাই।কিন্তু তারপর থেকে ওর প্রতি অবহেলা শুরু করে।দিন দিন অবহেলার মাত্রা বাড়তেই থাকে।

একবার কী হয়েছিলো জানো?ওর বয়স তখন মাত্র ছয় বছর।শপিং এ গিয়েছিলাম সবাই,ওর গলায় সব সময় একটা স্বর্ণের চেইন থাকতো।শপিং থেকে এসে দেখি ওর গলায় চেইনটা নেই।তার জন্য ফুপি ওকে প্রচুর মেরেছিলো।তার বক্তব্য ছিলো,ও খেয়াল করেনি কেন চেইনটা নেই।এখন তুমি বলো,একটা ছয় বছরের বাচ্চা আর কতটুকু বা বুঝে?এমনভাবে মেরেছিলো যে ওকে হসপিটালে ভর্তি করতে হয়েছিলো।সেদিনের পর থেকে ও কোনো স্বর্ণের জিনিস পরেনা।এখন বিয়ের পরে চেইনটা পরে আছে,তাই সব সময় জামার ভিতর কভার করে রাখে।”

আবরারের মনে পরে বিয়ের দিনের কথা।ইয়ারাবী ওযু করতে যাওয়ার আগে সব জুয়েলারি খুলে যখন চেইনটা খুলতে যায় তখন আবরার বলেছিলো,

-“ওটা থাক,খুলতে হবেনা।”

-“ন্ না মানে য্ যদি হারিয়ে যায়…”

-“গেলে যাবে,আবার কিনে দিবো।চেইনটা সব সময় পরে থাকবে।”

আবরার ভাবনা থেকে ফিরে এসে বলে,

-“তারপর?”

-“ধীরে ধীরে নানা ঘটনা ঘটতে থাকে।যে মেয়েকে সব সময় নয়নের মনি করে রাখতো তাকে এখন সহ্য করতে পারেনা।আমি লেখাপড়ার জন্য খালাদের সাথে থাকতাম।একবার ওর দাদু বাড়িতে যায়,তখন ওর দাদু বেঁচে ছিলো।পরিবারের একটা মেয়ে,তাই ওর দাদু একটু বেশিই ভালোবাসতো।বেশি একটা বুঝতো না ও।বাপ্পি কয়েকটা পাখি কিনেছিলো,ওর ভালো লেগেছে ওদের সাথে খেলার জন্য বায়না করছে।কিন্তু বাপ্পি দিতে চাচ্ছিলোনা।ওর দাদু আবার বাপ্পিকে দিতে বলে।ও খেলতে খেলতে একটা সময় খাঁচার মুখ খুলে ফেলে।যেই মুখ খোলা পেয়েছে ওমনি একটা পাখি বেরিয়ে যায়।সেটা নিয়ে বাপ্পি ওর বাবার কাছে নালিস করলে ফুপা ওকে খুব বকাবকি করে।এক পর্যায়ে গায়ে হাত তুলতে গেলে ওর দাদু খুব রাগারাগি করে।সেদিন শুধুমাত্র ওর দাদুর জন্য মার থেকে বেঁচে গিয়েছিলো।শুধু এসব নয় আরো অনেক ঘটনা আছে।

জানো ওর বিড়াল ছানা খুব পছন্দের।আমি যখন ওদের বাসা থেকে চলে আসবো তখন আমাকে বলেছিলো,”আপু আমার একটা বিড়াল ছানা দাও।”আমিও ওকে একটা কিনি দিয়েছিলাম।ওযে কত খুশি হয়েছিলো বলার বাইরে,সারাদিন ওটার সাথে খেলছিলো।বাসায় চলে আসার চারদিন পরে আমি ফোন করলে কান্না করতে করতে বলে,ওর ছানাকে নাকী ফুপি মেরে ফেলেছে।কারন ফুপি বিড়াল পছন্দ নয়।”

আবরার ওর দিকে তাকিয়ে বলে,

-“হঠাৎ এমন করা কেন শুরু করলো?”

-“আসল কারনটা একমাত্র ওর বাবা-মা ভালো বলতে পারবে।তবে মেজো ফুপা-ফুপি কিছু জানে হয়তো।তারা তোমাকে সবটা বলতে পারবে।”

য়ুহারের ফোন আসাতে ও ওখান থেকে চলে যায়।দেখতে দেখতে রাত চলে আসে।ভাইবোন সবাই মিলে বাসার পাশে বারবিকিউ করছে।শীতের রাতে সবাই অগুনের পাশে চেয়ারে বসে গল্প করছে।রাত সাড়ে দশটা মতো বাজে।ইয়ারাবী নিজের রুমে ঘুমাচ্ছে,আবরার এদের সাথে বসে গল্প করছে।হঠাৎ হাসান আবরারের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে,

-“আচ্ছা,তুমি তো লন্ডনে স্ট্যাডি কম্পিলিট করেছো,ইফাজ ও শুনেছি লন্ডনে পড়াশোনা করতো।তোমরা দুজনে ডাক্তার….একে অপরকে চিনো নাকী আগে থেকে?”

আবরার প্রশ্নটা শুনে স্বাভাবিক ভাবে উত্তর দেয়,

-“না ভাইয়া,আমরা আগে থেকে কাউকে চিনিনা।তবে এখন ডাক্তার হওয়ার সুবাদে একটু বেশি কথা হয়।”

ইফাজের যেনো দেহে প্রাণ ফিরে এলো।কেননা এখানে এমন অনেকে আছে যারা সত্যিটা জানলে ইয়ারাবীর কানে পৌঁছাতে দেরি করবেনা।স্পন্দন আবরারকে বলে,

-“লন্ডনে থাকাকালীন ফ্রায়েড জ্যাম ক্রাইস্যান্ট, খেয়েছো তুমি?”

আবরার হেসে বলে,

-“হ্যাঁ,ওটাতো প্রতিদনে কমপক্ষে তিন-চারবার খাওয়া হতো।লন্ডনের আলবিওনের এই স্ট্রিট ফুডটি পেস্ট্রির মত একটি খাবার। কিন্তু এর শেইপটা একটু ভিন্ন, দেখতে অর্ধচন্দ্রাকৃতির হয়। আলবিওনের রাস্তায় পাওয়া এর স্বাদ জিভে জল আনার মত! দেখতে অর্ধচন্দ্রাকৃতির খাবারটি খেতে আর দেখতো পেস্ট্রির মত।”

-“হামম তবে কিছু খাবার ভালো লাগেনা,যেমন মাংসের ব্যাপারটা…”

-“হ্যাঁ,ঠিক বলেছেন তবে ওদেরকে যদি বলা হয় সম্পর্ন সেদ্ধকৃত মাংস তবে ওরা তাই দেয়।আমি অবশ্যই আগে জানিয়ে দিতাম।তবে প্রথম প্রথম সমস্যা হতো,তারপর থেকে ঠিক হয়ে গেছিলো।”

-“তা অবশ্যই ঠিক,আমাকে প্রায় কোম্পানির কাজে যেতে হয়,তবে অভস্ত্য নই। তাই বেশি সমস্যা হয়।”

হঠাৎ আবরারের একটা ফোন আসতেই ও উঠে চলে যায়।একটু পর জারিকাও বাহানা দিয়ে ওর পিছু চলে যায়।আবরার কথা বলে ফোনটা রেখে ঘুরে দেখে জারিকা।ও পাশ কাটিয়ে আসতে গেলে বলে,

-“কানঅন আবরার,তুমি বাংলার টিপিক্যাল স্বামীর মতো অভিনয় করে নাতো।ভয় নেই,তোমার বৌ ঘুমাচ্ছে।”

-“আমি তোমার প্রতি আকৃষ্ট নই….তাই আমার পিছনে ফালতু সময় নষ্টে না করে কাজে লাগাও।অনেক আফসোস হচ্ছে মি.সায়ন না আসায় তাইনা।”

-“ত্ তুমি কীভাবে জানো?”

আবরার বাঁকা হেসে বলে,

-“আমি তোমাকে আগেই বলেছি,আমি দেখতে যেমন মোটেও কিন্তু তা নই।রাস্তা ছাড়ো…”

-“আবরার জাস্ট একটা বার…”

-“কথা বললে বোঝনা কেন?”

কথাটা বলেই আবরার ওর হাত ঝাড়া দিয়ে এসে দেখে ইয়ারাবীর পিংক রঙের একটা জ্যাকেট পরে তার উপর চাদর গায়ে দিয়ে আছে।অসুস্থ হওয়ায় বাকীদের থেকে একটু বেশি শীত করছে ওর।আবরার এসে ওর পাশে বসে বলে,

-“উঠলে কখন?”

-“এইতো কিছুক্ষণ আগে..”

-“খেয়েছো কিছু,টেবিলে মেডিসিন রেখে এসেছিলাম?”

-“খালামনি খাইয়ে দিয়েছে…”

জারা মুখটা কালো করে এসে বলে,

-“সরি আপু,আমার জন্য তোমার এই অবস্থা।আমি সত্যি জানতাম না তুমি সিক…জানলে রিকুয়েস্ট করতাম না।”

-“পাগল তুমি,আমি ঠিক আছি।এতে তোমার কোনো দোষ নেই।”

আবরার হেসে জারা দিকে তাকিয়ে বলে,

-“তোমার মন খারাপ করতে হবেনা,মজা করো।আর এমনিতে তোমার আপু এখন ঠিক আছে…”

ইয়ারাবীর ফোনে একটা ম্যাসেজ আসে।ইয়ারাবী ফোনটা খুলে দেখে আজকে সকালের কিছু ছবি।যখন ও ওয়াশরুমে ড্রেস চেন্জ করছিলো।ছবিগুলো দেখে ইয়ারাবীর এক পর্যায়ে রাগ উঠে অন্যদিকে ভয়ও পায়।নিচে লিখা আছে,

“যদি ছবিগুলো ভাইরাল না করতে চাও একটার দিকে পুকুর পাড়ে দেখা করবে।”

পুরোটা সময় ইয়ারাবী ভয়ে ভয়ে পার করে আর বারবার ওর ভাই আর আবরারের দিকে তাকায়।ওর ধারনা আবরার এগুলো দেখলে ওকে মেরে ফেলবে।সামান্য ছবি দেখে যা রিয়্যাক্ট করেছিলো এটা দেখলে তো নির্ঘাত ওকে খুন করবে।

দেখতে দেখতে রাত একটা বেজে যায়।শীতের রাতে সবাই ঘুমাচ্ছে।আবরারও ইয়ারাবীর পাশে নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে।ও নিজের মনের সাথে অনেকক্ষণ যুদ্ধ করে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেই।ও আস্তে করে আবরারের পাশে থেকে আস্তে করে উঠে দরজা খুলে বেরিয়ে পরে পুকুর পাড়ের উদ্দেশ্যে।প্রায় ঘন্টাখানিক দাঁড়িয়ে ওখান থেকে চলে আসতে গেলে পিছন থেকে কেউ বলে,

-“বেবি আমার জন্য কষ্ট করে এসেছো আমিতো ধন্য হয়ে গেলাম।”

ইয়ারাবী পিছনে ঘুরে দেখে পিয়াসের ছোট ভাই প্রনয় দাঁড়িয়ে আছে,মুখে শয়তানি হাসি।ইয়ারাবী ওর দিকে তাকিয়ে বলে,

-“ছবিগুলো দে…”

-“এইগুলো তো হাতিয়ার,আমার ভাই কী বোকা জানিস,সহজ রাস্তা ছেড়ে তোকে নিজের করার বাকা রাস্তা দেখেছিলো।তোকে সেই ছোট থেকে ভালো লাগতো বাট্ ভাইয়ের জন্য বলতে পারতাম না।কিন্তু এখন তোকে নিজের করে নিবো।”

-“তোর মনে হয় তুই আমাকে নিজের করে পাবি।”

কথাটা বলেই প্রনয়কে জোরে একটা চড় দিয়ে মাটিতে ফেলে দেয়।তারপর বলে,

-“তোরা কী ভেবেছিস মেয়েরা দুর্বল,আমার চুপ থাকাকে তুই দুর্বলতা ভেবে বড় ভুল করেছিস।আমি কারো হাতের খেলার পুতুল নই।”

প্রনয়কে মাটিতে ফেলে আচ্ছা মতো মারতে থাকে।ইয়ারাবী ওই ঘটনার পর ওর খালামনি ওকে মার্শাল আর্টে ভর্তি করে দেয়।ইয়ারাবী এখন নিজের স্লেফ ডিফেন্স করতে পারে।প্রনয় কোনোভাবে ওর সাথে পেরে উঠছে না।ও সুযোগ বুঝে যেই পালাতে যাবে ইয়ারাবী পিছন থেকে ওর ঘাড়টাকে এমন ভাবে চেপে ধরে যে কিছুক্ষণের জন্য ওর ফুল বডি কাজ করা বন্ধ করে দেয়।প্রনয়ের মুখ চোখ দিয়ে রক্ত পরছে,অবস্থা বেগতিক দেখে কোথার থেকে ইফাজ এসে জোর করে ছাড়িয়ে নেই।ইয়ারাবী ওকে ছাড়বেনা,ওর প্রনয়কে না মারা পর্যন্ত শান্তি হবেনা।আবরার ওকে দু’হাত দিয়ে আটকে রাখে।ইফাজ প্রনয়ের ফোনের মেমোরিটা নিয়ে ভেঙে ফেলে সেই সাথে ফোনটাও।তারপর ওকে হাসপাতালে নিয়ে যায়।

#চলবে____

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here