#জীবনসঙ্গী_১৮
#Chhamina_Begam
কিছুক্ষণ আগেই মৌ আর সেতুদের নাচের প্রদর্শনী হয়ে গেছে । এখন স্টেজে একটি মেয়ে মিষ্টি সুরে গাইছে ,
বাতাসে বহিছে প্রেম ,
নয়নে লাগিলো নেশা
কারা যে ডাকিলো পিছে
বসন্ত এসে গেছে ।
স্টেজের একপাশে দাড়িয়ে থাকতে থাকতে পায়ে ঝিম ধরে যাচ্ছে আদিলার । এদিকে পেটের ভেতর তান্ডব শুরু হয়ে গেছে । মৌ পাশ থেকে বলল,
-এই আদিলা , আমাদের বিরিয়ানি কখন দেবে রে ? পেটে তো ইদুর দৌড়াচ্ছে ।
বস্তুত প্ল্যানিং টিম , শিক্ষক-শিক্ষিকা এবং পারফর্মারদের জন্য বিরিয়ানীর আয়োজন করা হয়েছে । কিন্তু অনুষ্ঠান শেষ না হওয়া অব্দি দেওয়া হবে না ।অনুষ্ঠান শেষ হতে হতে সাড়ে তিনটা বাজবে ।এর আগেও হতে পারে । তারপর হবে রং খেলা । আর এখন মোটে তিনটা বাজে । আরো আধ ঘন্টার অপেক্ষা । আদিলা চোখে সর্ষে ফুল দেখছে। সকালে তাড়াহুড়ো করে একটা টোস্ট , চা আর একটা সিদ্ধ ডিম খেয়ে এসেছে । তার পর বলতে গেলে আর খাওয়াই হয়নি ।
অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে অবশেষে অনুষ্ঠান শেষ হলো । বেশিরভাগই খাওয়া শেষে চলে গেল মাঠের অন্য প্রান্তে । সেখানে ডিজে বসানো হয়েছে ।তাতে জোরেশোরে গান বাজছে । ছেলে মেয়ে সবাই একসঙ্গে নাচছে , হইহুল্লোড় করছে । একপাশে ক্যান্টিনের দুজন স্টাফ আর ভার্সিটির কয়েকজন সিনিয়র ছেলেদের তদারকিতে লস্যির স্টল বসিয়েছে । অন্যপাশে রঙবেরঙের থালা ভর্তি আবির । সবাই খাবলে খাবলে রঙ তুলে নিচ্ছে হাতের মুঠোয় ,নিজের বন্ধুদের হুড়োহুড়ি , দৌড়াদৌড়ি করে রঙ মাখাচ্ছে । ক্লান্ত হলে প্লাস্টিকের গ্লাসে ঢকঢক করে লস্যি পান করছে । মৌ, সেতু ,রিপন ওরাও যোগ দিয়েছে তাতে । নিরাপদ দূরত্বে দাড়িয়ে এসবই লক্ষ্য করছে আদিলা । ওর বারণ করায় কেউ ওকে জোর করে রঙ লাগায়নি । রিপন তাও একবার চেয়েছিল রঙ লাগিয়ে দিতে আদিলা বারণ করে দিয়েছে । সেতু মিষ্টি হেসে সঙ্গে সঙ্গে দূরে সরিয়ে নিয়ে গেছে রিপনকে । কারণটা খুব স্পষ্ট , আদিলা রেগে গেলে এখনি চলে যাবে রুমে অথবা অপছন্দের কিছুতে জোর করলে অনির্দিষ্ট সময়ের জন্য কথা বলা বন্ধ করে দেবে । রিপনকে এই কথা বোঝালে সেও আর সাহস করেনি ।
বার বার ফোন চেক করছে আদিলা । রাহাত মেসেজ করেছিল ও আসছে বলেছে । আদিলা জল পান করার প্রয়োজন বোধ করল । খেতে বসে বোতলের অর্ধেকের বেশি জল সেতু খেয়ে ফেলেছিল । তারপর প্রায় টেনে নিয়ে এসেছে মাঠে । তাড়াহুড়োয় আর জল খাওয়া হয়নি । এখন গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে আছে । তার ওপর একবার ওয়াশরুমে যাওয়া প্রয়োজন । শাড়ি , চুল ঠিকঠাক আছে কিনা দেখতে হবে ।
আজ সেতুর জোরাজুরি আর মনের সুপ্ত তাড়নায় ইচ্ছে করেই একটা সবুজ এবং কাচা হলুদ মিশেলের শাড়ি পড়েছে আদিলা । খোঁপা করা চুল গুলোয় পেচিয়ে দিয়েছে আর্টফিশিয়াল ফুলের মালা , তাজা পাওয়া যায়নি বলে । যত্ন করে নিজেকে সাজিয়ে তুলেছে আজ । ভার্সিটিতে প্রথম বারের মতো শাড়ি পরে আসায় অবাক নয়নে তাকিয়ে ছিল মৌ , সেতু ,রিপনসহ ক্লাসের অনেকেই । ওদের চোখে মুগ্ধতা দেখে প্রথমে ভীষণ লজ্জা পেলেও পরে নিজেকে ধাতস্থ করে ফেলেছে । এখন প্রিয় মানুষটি পছন্দ করলে হয় !না হলে সব ব্যর্থ । সব থেকে যে বিষয়টা আদিলাকে বেশি বিভ্রান্ত করছে তা হলো এতদিন পর্যন্ত সে কখনোই নিজের পোশাক পরিচ্ছদের বিষয়ে অন্যের হস্তক্ষেপ মেনে নিতে পারত না । নিজের কম্ফোর্ট জোনের খেয়াল সর্বদা রাখত সে । আর আজ সেই কিনা কোন বিশেষ একজনকে মুগ্ধ করতে নিজের সবচেয়ে অপছন্দের কাজটি করে বসল । তাকে খুশি করতে চেয়ে সারাদিন এই শাড়ির ঝামেলা সহ্য করতে হলো ।নিজের এই আংশিক পরিবর্তনে অবাক হয়ে যায় আদিলা । মানুষটি ধীরে ধীরে ও ওর মনে জায়গা করে নিচ্ছে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না । অথচ এতকিছুর পরেও সেই মানুষটির দেখা নেই । ঘড়ির কাঁটা যেন আজ ঘুরতেই ভুলে গেছে । ক্ষণে ক্ষণে নিজের হাতের কব্জি উলটে সময় দেখছে আদিলা আর ঘাড় ফিরিয়ে ভার্সিটির সদর দরজায় খুঁজে ফিরছে তাকে । একসময় বিরক্ত হয়ে সেতুকে ডাকল ,
-সেতু , আমার ভীষণ তেষ্টা পেয়েছে । জল খেতে যাব । তুই আসবি নাকি ?
– এখন ? একটু পরে যাই ?
– মৌ , তুই যাবি ?
– খুব আর্জেন্ট নাকি ?
কয়েক সেকেন্ড অপলকে তাকিয়ে আদিলা বলল,
– আজব তো !আমার জল তেষ্টা পেয়েছে । এখানে আর্জেন্ট অথবা লেট এসব ভাববো কেন ? তোরা এলে আয় নাহলে আমি একাই যাচ্ছি ….
– আরে ,আরে । একা যেতে হবে না । দাড়া ,আমি একটা ব্যবস্থা করছি ।
মৌ আসে পাশে তাকিয়ে দেখে সৌরভ কয়েকটা বোতল ভরে লস্যি নিয়ে যাচ্ছে কোথাও । মৌ দৌড়ে গিয়ে প্রায় ছিনিয়ে নিয়ে আসে একটা বোতল । সৌরভ ভ্যাবাচেকা খেয়ে স্থির হয়ে দাড়িয়ে পড়ে । চোখে মুখে ভয়ের চিহ্ন । কিছু একটা বলতে গিয়েও থেকে যায় ।
– নে ,ধর । এটা খেয়ে নে । হেব্বি হয়েছে খেতে । টেস্ট কর একটু ,,,
-কিন্তু । আমি আগে খাইনি এসব …..
– কিছু হবে না । খেয়ে নে । ভালো হয়েছে খেতে….
উপায়ান্তর না দেখে ঢকঢক করে অর্ধেক বোতল শেষ করে দেয় আদিলা। স্বাদটা অদ্ভুত ঠেকে ওর । তখনই ফোনের নোটিফিকেশন বেজে ওঠে । রাহাত মেসেজ পাঠিয়েছে দশ মিনিটে পৌঁছাবে সে । আদিলা নিজের সাঁজ নিয়ে আরেক দফা চিন্তিত হয় । সেই সকালে তৈরি হয়ে এসেছে । এত বেলা অব্দি ঠিক আছে তো ? বোতল থেকে আরো এক ঢোক লস্যি পান করে সেতুকে বলে ,
– সেতু ,আমি একটু ওয়াশরুমে যাচ্ছি ।
– হুম । যাহ ।
গানের সুরে দুলতে দুলতে জবাব দেয় সেতু । মৌ ঘাড় ফিরিয়ে আদিলার চলে যাওয়া দেখে ইশারায় সেতুকে জিজ্ঞেস করে কি হয়েছে ? সেতু মাথা নাড়িয়ে কিছু না জানায় ।
মাঠ ছেড়ে ভার্সিটির দিকে আসতেই আদিলার মাথা ঝিমঝিম করে । পা দুটো দুলে ওঠে আচমকা । সেসবে পাত্তা না দিয়ে এগিয়ে যায় সে ।
*****
-এই রিপন ? এই, শোন না ….
– হুম বল ,,
– এ দিকে আয় …
সৌরভ রিপনকে টেনে নিয়ে আসে সবার মাঝখান থেকে ।
– একটা সমস্যা হয়ে গেছে ।
সৌরভকে চিন্তিত দেখায় । রিপন সিরিয়াস হয়ে সুধায় ,
– কি হয়েছে ?
– আদিলা আমাদের স্পেশাল ড্রিংকটা খেয়ে ফেলেছে ।
প্রথমে সৌরভের কথার অর্থ ধরতে না পেরে সপ্রশ্ন তাকিয়ে থাকে রিপন । পরক্ষণেই লাফিয়ে ওঠে উত্তেজনায় ,
-কিই ! তুই দিয়েছিস কেন ? শালা ,তোদের বারণ করেছিলাম না আমি ? আনিস না এসব ছাইপাশ । শুনিসনি তখন ।দিলি তো সর্বনাশ করে । আদিলা কোথায় ?
-জানি না । আমি খুঁজে পাচ্ছি না ওকে ।
সৌরভের চোখে মুখে অপরাধের ছাপ । রিপন দিশেহারা বোধ করে । এদিক ওদিক ছুটোছুটি করে তন্নতন্ন করে খুঁজে ফেরে আদিলাকে । কিন্তু কোথাও খুঁজে পায় না । হতাশ হয়ে সৌরভের পাঞ্জাবির কলার চেপে ধরে হিসহিসিয়ে বললো ,
– যদি আদিলার কিছু হয় , দেখিস তোকে আমি কি করি ?
তারপর ভীড়ের মাঝে থেকে মৌকে ডেকে জিজ্ঞেস করে ,
– মৌ , আদিলা কে দেখেছিস ? ও কোথায় ?
-আছে বোধহয় এখানেই কোথাও !কেন ?
-শিট ….!!!
– রিপন ,কি হয়েছে ? তুই এমন করছিস কেন ?
-আদিলা কোথাও নেই । ওকে খুঁজে পাচ্ছি না আমি ।
– রিপন , ও ছোট বাচ্চা নয় । এসে পড়বে এখনি ।
ওদের ফিসফাস করতে দেখে ওদের ক্লাসের রীনা এগিয়ে আসে ।
– কি হয়েছে ? এনি প্রবলেম ?
– আসলে আদিলা যে কোথায় গেল ? বলে যায়নি আমাদের । তাই খুঁজছি ওকে ….
-ওহ , আমি তো ওকে আমাদের হলের দিকে যেতে দেখলাম ।
রীনার বলতে দেরি হয় রিপনের ছুটতে দেরি হয় না । রীনা হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে থাকে । রিপনকে ছুটতে দেখে সেতু এগিয়ে আসে নাচের আসর থেকে ভীড় ঠেলে ।
– কি হলো রে ? রিপন এত হন্তদন্ত হয়ে কোথায় গেল ?
মৌয়ের কিছু বলার আগেই পাশ থেকে সৌরভ নিচু স্বরে বলল ,
– আদিলা ভাং মেশানো লস্যি খেয়ে ফেলেছে । তারপর থেকেই ওকে আর পাওয়া যাচ্ছে না ।
-কিই !!!
সেতু মৌ দুজনেই সমস্বরে চিৎকার করে ওঠে । সেতু রাগে লাল হয়ে যায় ।
– সৌরভ , আদিলার যদি কিছু হয় না তোকে আমি খুন করে ফেলব দেখিস ।
বলেই সেতুও দৌড়ায় । দৌড়তে দৌড়তে অনেক অবাঞ্চিত ভাবনা চলে আসে মনে । আদিলার কোনো ক্ষতি হয়ে যায়নি তো ?আজ এমনিতেই অনেক বাইরের লোকজন ঘোরাঘুরি করছে ক্যাম্পাসে । নেশার ঘোরে কোথায় পড়ে আছে কে জানে ? দশ মিনিটের বেশি হয়ে গেছে ও যাওয়ার অথচ সে খেয়াল করেনি বিষয়টা । ওর আরো আগে খোঁজ নেওয়া উচিত ছিল! ছুটতে ছুটতে উপরওয়ালাকে অনুরোধ করে আদিলা যেন ভালো থাকে । ওর যেন কোনো ক্ষতি না হয় মাবুদ । মৌও মুখটা কাচুমাচু করে সেতুকে অনুসরণ করে । আত্মগ্লানিতে চোখে জল এসে যায় ওর । সেই তো জোর করে আদিলাকে লস্যি খাইয়ে ছিল । আদিলার কিছু হয়ে গেলে ও কখনোই নিজেকে ক্ষমা করতে পারবে না ।
*****
ইউনিভার্সিটির সদর দরজার সামনে দাড়িয়ে অনবরত কল করে যাচ্ছে রাহাত কিন্তু ওপাশ থেকে কল রিসিভ হচ্ছে না । বিরক্ত দেখায় ওকে । এই মেয়েটা ফোন রাখে কোথায় ? যদি কল রিসিভই করবে না তাহলে ফোন সাথে রাখার দরকার কি? কুঞ্চিত ভ্রু জোড়া সোজা করে মোবাইল পকেটে চালান করে দিয়ে এক পা দু পা করে ভেতরে ঢোকে । আজ অনুষ্ঠান ছিল জন্য গেটের কাছে কড়াকড়ি নেই । দারোয়ান বসে আছে ঠিকই তবে সদর দরজা সবার জন্য উন্মুক্ত । রাহাত ভেতরে ঢুকতেই দেখল এক দল ছেলেমেয়ে ছুটোছুটি করছে , কেউ কেউ বিশৃঙ্খল হয়ে নেচে নেচে ঘুরছে । সবার পড়নে হলুদ শাড়ি, পাঞ্জাবি । এই এত জন স্টুডেন্টের মাঝে আদিলাকে ও পাবে কোথায় ?
ইতিউতি চকিত দৃষ্টি চালিয়ে একটা পরিচিত মুখ দেখে দ্রুত সেদিকে এগিয়ে গেল রাহাত । সেতুর সঙ্গে আর একটি মেয়ে দৌড়ে যাচ্ছে মেইন ক্যাম্পাসের দিকে ।
– মিস. সেতু ?
হঠাৎ নিজের নাম কানে বাজতেই থমকে দাড়ায় সেতু । ঘাড় ঘুরিয়ে রাহাতকে দেখে চিনতে ভুল করে না । কাল রাতেই আদিলার ফোনে ছবি দেখেছে সে । থমকে দাড়িয়ে পড়ে সেতু । মৌও অপরিচিত একজনকে দেখে দাড়িয়ে পড়ে পাশে । ফিসফিসিয়ে প্রশ্ন করে কে সে ? সেতু মৌকে উপেক্ষা করে জিজ্ঞাসু হয় ,
– ভাইয়া , আপনি ?
– আদিলাকে ফোনে পাচ্ছি না । ও কোথায় ?
এবার ঝরঝর করে কেদেঁ ফেলে সেতু । নাক টানতে টানতে কোনো মতে বললো ,
-আদিলাকে পাচ্ছি না ভাইয়া ।
– মানে ? ……..কি আবোল তাবোল বলছেন ? আধঘণ্টা আগেই তো কথা হলো আমাদের !
রাহাতকে বিভ্রান্ত দেখালো । সে উদ্গ্রীব হয়ে চাইল উত্তরের আশায় ।
-হ্যাঁ ভাইয়া , একটু আগেও সে আমাদের সঙ্গে ছিল । তার পর কোথায় যে গেল ….?
আদিলার ভাং মেশানো লস্যি খাওয়ার কথা ইচ্ছে করেই চেপে গেল সেতু । বললো ,
– ও মনে হয় মেইন ক্যাম্পাসে গেছে । তাই আমরা সেদিকে খুঁজতে যাচ্ছি । আপনি ও আসুন ।
রাহাত আবার আদিলার নম্বরে কল করে অনুসরণ করে সেতুদের । এতক্ষণ যে সুন্দর মুহূর্তটা কল্পনা করে চিত্ত পুলকিত হচ্ছিল এখন সেখানে ভয় নিজের কালো ছায়া ফেলে রাজত্ব করছে । হৃদয়ের মনিকোঠায় যত্ন করে রাখা কোনো মূল্যবান রত্ন হারিয়ে ফেলার ভয়ে হাত পা যেন অবশ হতে চাইছে রাহাতের । চাকরি সূত্রে এরকম বহু ঘটনার সম্মুখীন সে আগে হয়েছিল । কিন্তু কখনো এতটা দিশেহারা হয়নি সে । শক্ত পদক্ষেপে সব কিছু সামলে উঠেছে । কিন্তু সেই একি ঘটনা যদি নিজের প্রিয় মানুষটির সাথে ঘটে তাহলে যে বিবশ অনুভূতি হয় এর সাথে পরিচিত ছিল না সে । কাজেই বিচক্ষণ রাহাত এবার স্থির হয়ে ভাবতে পারছে না কিছু । দৌড়াতে দৌড়াতে প্রানপনে ডাকছে মহান করুণাময়কে ।সব কিছুর নিয়ন্ত্রক যে সেইজন । এবারের মতো সব কিছু যেন ঠিক করে দেন তিনি । এরপর নিশ্চয়ই সে নিজেকে ঝিনুকের শক্ত খোলসের মতো করে নিজের প্রিয় মুক্তোটিকে আগলে রাখবে ।
******
ওয়াশরুমের আয়নায় নিজের ঝাপসা প্রতিবিম্বকে দেখে হাত দিয়ে আয়নাটা বার কয়েক মুছে দিলো আদিলা । অথচ ফলাফল একি । মাথাটা হঠাৎ করেই ভীষণ ভারি হয়ে গেছে যেন।সোজা হয়ে দাড়াতেই পারছে না । চোখ খুলে তাকাতেও কষ্ট হচ্ছে আদিলার। এমনটা কেন হচ্ছে বুঝতে পারছে না সে ? ভীষণ ঘুম পাচ্ছে যেন । বেসিনে হাত ধুয়ে চোখে মুখে জলের ছিটে দিল । একটু তরতাজা অনুভূতি হলে পার্স হাতে বেরিয়ে এসে সিড়ি বেয়ে নামতেই আবার মাথাটা দুলে উঠল । ঝটপট রেলিং ধরে সামলে নিল নিজেকে । আসার পর নিচের সব ওয়াশরুম গুলোয় ভীড় দেখে কষ্ট করে হলেও দ্বিতীয় ফ্লোরে চলে এসেছিল । এখানের ওয়াশরুম সহ পুরো তলাটা ফাঁকাই ছিল তখন । কিন্তু এখন মনে হচ্ছে এখানে আসা ঠিক হয়নি । সিড়ি গুলো কেমন দুলছে !নিচের স্টেপে পা দিতে গিয়েও দিল না । ভয়ে কাঁপছে ভেতরটা । মনে হচ্ছে পা দিলেই হয়তো গভীর কোনো খাদে পড়ে যাবে সে । তবুও সাহস করে আর এক পা বাড়াতেই প্রচণ্ড ভাইব্রেশনে কেঁপে উঠল আদিলা । তড়িঘড়ি ফোন বের করে কল রিসিভ করতেই হাত পিছলে ফোন টা সশব্দে গড়িয়ে পড়ে গেল নিচে । হতভম্ব হয়ে সেদিকে তাকিয়ে রইল সে । হতাশ হয়ে ধপ করে সেখানেই বসে পড়ল ।
রিপন যাকেই সামনে পাচ্ছে তাকেই আদিলার ছবি দেখিয়ে জানতে চাইছে দেখেছে কিনা । এক পর্যায়ে ক্লান্ত , বিধ্বস্ত হয়ে সিড়ির পাশে বসে পড়ল ।নিজেদের ক্লাসেও দেখে এসেছে সেখানেও আদিলা নেই । কোথায় গেল মেয়েটা ? ইচ্ছে করছে সৌরভকে ধরে বেধরক পেটাতে । কিন্তু তা করার সময় নয় এটা । তখনই কারো ফিসফিসানি শুনে উপরের দিকে চাইল রিপন । কৌতূহলী হয়ে উপরে উঠতেই দেখল দুটি ছেলে ধীর স্বরে কিছু একটা বলছে । ওদের দৃষ্টি বারবার সিড়ির উর্দ্ধস্তরে চলে যাচ্ছে । বিষয়টা কি দেখার জন্য এগিয়ে যেতেই একজনের হাতে ধরা পার্স আর ফোনের কভারটা দেখে সচকিত হয়ে গেল রিপন । ব্যস্ত পায়ে সিড়ি ভেঙে উপরে উঠে তাদের প্রশ্ন করতে যাবে তখনই চোখ চলে গেল মাঝামাঝি সিড়িতে হাটু ভেঙে বসা আদিলার ওপর । দেয়ালে মাথা ঠেকিয়ে চোখ বন্ধ করে বসে আছে সে । ছেলে দুটোর কাছ থেকে ফোন আর পার্স নিয়ে এগিয়ে গেল সে । হাত ঝাকি দিয়ে ডাকল আদিলাকে । চোখ খুলে রিপনকে দেখে আলতো হাসলো আদিলা ।
– এখানে কেন বসে আছিস ?
– রিপন ,এই মাত্র ভুমিকম্প গেল তাই না ? ভীষণ দুলছিল সিড়ি গুলো । আমি পা বাড়াতেই সাহস পাইনি ।
রিপন বুঝল ধীরে ধীরে ভাঙের নেশা চড়ছে । বললো ,
– নিচে চল ,সবাই চিন্তা করছে তোর জন্য ।
– রিপন , আ ..আমার ফোনটা কোথায় ? কল আসবে একটা …।কোথায় যে পড়ল ?
– আছে আমার কাছে । নিচে চল ।তারপর দিচ্ছি।
-হুম …..
– চল , আমি হেল্প করছি । হাটতে পারবি ?
রিপন আদিলাকে সাহায্য করতে চেয়ে হাত ধরতে নিলে হাত সরিয়ে নেয় আদিলা ।
– আমি পারব ।
রিপন হাত গুটিয়ে নিয়ে বলল, ঠিক আছে । চল ।
আদিলা কোনোক্রমে দেয়াল ধরে ধরে নিচে নামলেও বারান্দায় এসে আর সোজা হয়ে দাড়াতে পারল না । এলোমেলো পদক্ষেপে পা ফেললে পড়ে যেতে নিলে রিপন ধরে ফেলার আগেই দুটো বলিষ্ট হাত আগলে নিল আদিলাকে । সেদিকে চেয়েই রিপন ক্রুদ্ধ হয়ে তাকাল ।
– আপনি কে ?
রিপনের প্রশ্নের জবাব দেওয়ার পূর্বেই মৌ , সেতু দৌড়ে এলো সেখানে ।
– আমি রাহাত , দায়সারা ভাবে উত্তর দিয়ে আদিলাকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল সে।
– তুই ঠিক আছিস আদি ?
রাহাত আদিলাকে ধরে দাড় করিয়ে দিল। তা দেখে রিপন অধৈর্য হয়ে গেল ।
-কি হচ্ছে এসব ? উনি কে ?
সেতু রিপনকে পেছনে টেনে নিয়ে আস্তে করে বলল ,
-চুপ , উনি আদিলার হাসবেন্ড ।
– কি বলছিস !, রিপন বিস্মিত নয়নে তাকিয়ে রইল রাহাতের দিকে । মুখে কোনো কথা সরছেই না ।
– আদু , তুমি ঠিক আছ ? কি হয়েছে তোমার ? এমন করছ কেন ?
প্রিয় কন্ঠস্বর শুনে ভারী হয়ে আসা চোখ দুটো জোর করে টেনে খুলল আদিলা । রাহাতকে দেখে মিষ্টি করে হাসলো ,
-আপনি এসেছেন ।
– হুম ,চলো ।
কয়েক পা এগোতেই আদিলা দাড়িয়ে পড়ল ।রাহাতের দিকে ঘুরে জড়ানো গলায় বলল,
– দেখুন , আজ শাড়ি পড়েছি আমি । কেমন লাগছে আমায় ?
আদিলার অকপট কন্ঠস্বরে রাহাতসহ সেতুরাও বিব্রত হলো । এই আচরণ আদিলার সাথে একেবারেই যায় না । সে কখনোই নিজের লুকস নিয়ে প্রশ্ন করে না । ওকে সবসময় সন্তুষ্ট দেখা যায় । রাহাত আদিলার কপালে হাত রেখে বললো ,
– জ্বর তো নেই । তাহলে এমন করছে কেন ?
শেষের প্রশ্নটা সেতুর দিকে ছুড়ে দিল রাহাত । সেতু ভয়ে চুপসে গেল ।
– বলুন না , আমাকে ভালো দেখাচ্ছে ?
রাহাত আলতো করে আদিলার গালে হাত রেখে বললো ,
– মাশাল্লাহ , তোমাকে খুব সুন্দর লাগছে আদু । তারপর কয়েক সেকেন্ডের বিরতিতে রাহাত আবার প্রশ্ন করল , তুমি কি ড্রিংক করেছ?
-নাউজুবিল্লাহ , আমি ওসব খাই না ।
আদিলা অস্বীকার করলেও রাহাত উত্তরের আশা সেতুর দিকে তাকাল । মৌ ইতস্তত করে বললো ,
– স্যরি ভাইয়া । আমার ভুলের জন্য এমন হয়েছে । আমি জানতাম না লস্যিতে ভাং মেশানো ছিল । আ’ম রিয়েলি স্যরি ।
– ঠিক আছে । আমি ওকে নিয়ে যাচ্ছি ।
******
তোর্ষার পাড়ে বসে ঘাসের ওপর পাশাপাশি বসে আছে আদিলা রাহাত । রাস্তার পাশে টাটা টিগরটা দাড় করানো , বিকেলের আলো ম্লান হয়ে এসেছে । নদীর ধার বরাবর কিছু দূরে একটা ভাঙাচোরা নৌকা বাধা আছে । শীতের শেষ বলে নদীর জলে ভাটার টান পড়েছে । নৈঃশব্দ্য বিরাজ করছে দুজনের মাঝে । আসার পথে ঘুমিয়েই কাটিয়েছে আদিলা । পথের ধারে দোকান থেকে একটা সোডার বোতল কিনেছিল রাহাত সেটা খাওয়ার পর নেশা অনেকটাই কেটে গেছে আদিলার। বরং এখন লজ্জায় মুখ তুলে তাকাতে পারছে না । এদিকে রাহাতের মুখ থমথমে হয়ে আছে ।নিজের রাগ নিয়ন্ত্রণে রাখার যথাসাধ্য চেষ্টা করছে সে ।
রাহাতের দিকে আড়চোখে তাকিয়ে গলা শুকিয়ে গেল আদিলার । মানুষটা কি রেগে আছে ?মুখ চোখ এমন শক্ত করে রেখেছে কেন ? এতদিন এই মানুষটির ভালোবাসা , স্নেহ , যত্ন সম্পর্কে অবগত হলেও তার রাগ সম্পর্কে নূন্যতম ধারনা নেই আদিলার ।আচ্ছা, রাগ করে আবার চড়-থাপ্পড় দিয়ে দেবে না তো ? মানছে ওর ভুল হয়ে গেছে ।তবে ইচ্ছে করে তো করেনি । কিন্তু কিছু তো বলা দরকার । সেই এসে থেকে একটা কথাও বলেনি রাহাত । মুখে কুলুপ এটে বসে আছে । শেষমেশ ইতস্তত করে আদিলা বলেই ফেলল ,
– স্যরি ।
রাহাত ঘাড় ঘুরিয়ে আদিলাকে দেখল বটে কিন্তু কিছু বলল না ।আদিলা আবার বলল ,
– আমাকে ক্ষমা করে দিন প্লিজ । আমি জানতাম না লস্যিতে ভাং মেশানো ছিল । জানলে কক্ষনো খেতাম না ।
– আদিলা ,তুমি বুঝতে পারছ বিষয়টা কতটা সিরিয়াস হতে পারত । যদি তোমার বন্ধুরা হইহুল্লোড়ে মেতে থাকত । যদি ওরা তোমায় না খুঁজতো । কি হত তখন !! তুমি তো সেন্সে ছিলে না । এই সুযোগে অনেক কিছু হয়ে যেতে পারত তোমার সাথে ।আলহামদুলিল্লাহ , আল্লাহ সহায় ছিল বলে এমন কিছু হয়নি । কিন্তু হতে তো পারত । কত উটকো ছেলেপেলে ঘোরাঘুরি করছিল ক্যাম্পাসে । যদি তাদের নজরে পড়ে যেতে !ভাবতে পারছ তুমি ?
এতক্ষণ ভুলবশত নেশাজাতীয় কিছু খেয়ে ফেলার জন্য অপরাধ বোধে ভুগছিল আদিলা । মনে মনে পানাহ চাইছিল রবের কাছে । কিন্তু এই কনসিকুয়েন্স গুলোর কথা মাথাতেই আসেনি । রাহাত বলায় মাথায় বজ্র ভেঙে পড়ল যেন । অজানা আশঙ্কায় গুটিয়ে গেল নিজের মধ্যে । চোখে মুখে ভীতি ছড়িয়ে পড়ল ওর ।
– তুমি অনেকটাই ম্যাচিওর আদিলা । তোমার কাছ থেকে এমন বেখেয়ালি আচরণ আমি আশা করিনি ।
এবার ভীষণ রাগ হলো আদিলার । অভিমানী স্বরে বললো ,
-আমি বুঝি আগে অনেকবার ভাং টেস্ট করে দেখেছি যে বুঝতে পারব কোনটা নরমাল লস্যি আর কোনটা ভাং মেশানো!
বলেই আদিলা মুখ ফিরিয়ে নিল নদীর স্রোতের দিকে যার ওপর দিয়ে একঝাঁক পাখি কলকল করতে করতে উড়ে যাচ্ছে । সূর্য অস্ত যাওয়ার তোরজোর শুরু করেছে । যখন তখন ঝপ করে লুকিয়ে পড়তে পারে ।
আদিলাকে রেগে যেতে দেখে আলতো হাসলো রাহাত । সমস্ত চিন্তা ঝেড়ে ফেলে দিয়ে আদিলার একটা হাত টেনে নিল নিজের হাতের মুঠোয় । বললো ,
– তবে একটা কথা কি জানো , আজ তুমি ঐ লস্যি না খেলে তোমার এই রূপটা দেখাই হতো না আমার । তখন তোমায় খুব আদুরে দেখাচ্ছিল । তোমার ঘুমঘুম চোখে একধরনের নেশা ছিল । আর তোমার পাগলামি গুলো …..
লজ্জায় রাঙা হয়ে উঠল আদিলার মুখখানা । অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে ঠোট টিপে হাসল সে । রাহাতের থেকে হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করলে রাহাত আরো শক্ত করে চেপে ধরল হাতখানা । গোধূলির রাঙা আলোয় তখন শাড়ি পরিহিতা আদিলাকে মোহনীয় লাগছিল ।সেদিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে রাহাতের ভীষণ ইচ্ছে করল প্রেয়সীকে অধরবন্দি করতে । কিন্তু সে ইচ্ছেটাকে মাটি চাপা দিয়ে আদিলার হাতের পিঠে গাঢ় চুম্বন করল । এই মুহুর্তে নিজেকে ভীষণ সুখী মনে হতে লাগল আদিলার । দু চোখ ছলছল করে উঠল । আলতো করে রাহাতের কাধে মাথা এলিয়ে দিয়ে চেয়ে রইল দিগন্তে মিলিয়ে যাওয়া সূর্যটার দিকে ।
**আর একটা পর্বে শেষ হবে জীবনসঙ্গী । ওটা আজ রাতে আপলোড করে দেব ইন শা আল্লাহ ।