জান্নাহ্
পর্বঃ৭
লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি
শান্ত,স্থির,নিষ্কম্প দৃষ্টিতে বসে আছে জান্নাহ্ এর সেই চির আকাঙ্ক্ষীত সুদর্শন পুরুষটি।তার বুক চিরে গড়িয়ে পড়া উষ্ণ লহুর দিকে তাকিয়ে আছে জান্নাহ্।
তার দুচোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে শীতল নোনতা জলের প্রস্রবণ।জান্নাহ্ এর নির্নিমেষ আঁখি চাইছে থেমে যাক এই সময়,থেমে যাক এই ধরা।তার প্রাণ তারই থাক।এই প্রাণ কে নিজের করে পাওয়ার জন্য জান্নাহ্ দুনিয়ার সবচেয়ে ভয়ংকর খেলা খেলেছে।তাহলে তার প্রাণ কেন তার হতে পারলো না?
জান্নাহ্ এর প্রাণ আজ কথা বলছে না।সে শুধু তার হৃদমোহিনী কে দেখছে।একটু পরেই তাকে তার দুই চক্ষু মুদন করতে হবে।গলায় শ্বাস আটকে আছে।নিজের অজান্তেই চোখের কোণ বেয়ে ঝরছে শ্রাবণের ধারা।কিন্তু মুখে ঔজ্জ্বল্য।ঠোঁটে সেই ভুবন ভোলানো স্মিত হাসি।তার চোখ আবদ্ধ তার প্রাণনাশকারিনীর ওই পদ্মলোচন আঁখিতে।যার হিংস্রতা আজ তার ভালোবাসাকে হার মানিয়েছে।জান্নাহ্ তার ছুরিটা আরেকবার তার প্রাণের বুকের বা’পাশের সেই কম্পিত নরম যন্ত্রটার উপর ঢুকিয়ে দেয়।গলগল করে মুখ ভর্তি রক্তবমি করে তার প্রাণ।জান্নাহ্ এর প্রাণআত্না কেঁপে উঠে।তার প্রাণ তাকে ছেড়ে যেতে পারে না।কখনোই না।
ধড়ফড়িয়ে উঠে বসে জান্নাহ্।তার হাত,পা কাঁপছে।কান দিয়ে যেনো ধোঁয়া বের হচ্ছে।কপাল বেয়ে ঝরছে ঘাম।হাপরের মতো উঠানামা করছে তার বুকটা।গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে আছে।ঘনঘন নিঃশ্বাস পড়ায় তার শ্বাস যেনো বন্ধ হয়ে আসছে।বিছানা থেকে নেমে জগ থেকে গ্লাসে পানি ঢেলে ঢকঢক করে গিলে নেয়।ধাতস্থ হয়ে বিছানায় বসে জান্নাহ্।তার চোখে,মুখে অবিশ্বাস্য অনুভূতি।এমনটা হতে পারে না,কিছুতেই না।বড় বড় নিঃশ্বাস নিচ্ছে জান্নাহ্।সে কোনো ভাবেই তার প্রাণকে আঘাত করতে পারে।এই স্বপ্ন কখনো সত্যি হতে পারে না।
আচমকা বজ্রপাতের আওয়াজ শুনতে পায় জান্নাহ্।বাইরে ঝুম বৃষ্টি শুরু হয়েছে।জান্নাহ্ এর মনের গহীনেও ঝড় শুরু হয়েছে।সে এখনো কাঁপছে।তার প্রাণকে আঘাত করার কথা সে ভুলেও ভাবতে পারে না।দ্রুতপায়ে বারান্দায় আসে জান্নাহ্।বারান্দার গ্রীলের ট্রান্সপারেন্ট নামিয়ে দেয় এতে করে বারান্দা আর ভিজবে না।মফস্বলে এমন ডুপ্লেক্স বাড়ি খুব কম দেখা যায়।জান্নাহ্দের বারান্দায় গোলাপ,কচমচ,বেলী আরো নানা রকমের ফুলের গাছ লাগানো।বারান্দায় ডিবানের কাছে একটা কৃত্রিম পদ্মফুলের জার রাখা।জান্নাহ্ দুটো মোমবাতি ভাসিয়ে দেয় সেই পানিতে।নিভুনিভু তার আলো।বাইরের বৃষ্টির ঝুমঝুম আওয়াজ আসছে জান্নাহ্ এর কানে।খানিক পরপর মৃদু বিদ্যুতের ঝলকানি।তা অস্পষ্ট।জান্নাহ্ একটা ডাইরি নিয়ে ডিবানের উপর বসে।একটা জলচৌকিতে তা রাখে।মোমবাতির ঈষৎ হলদে আর লালচে আলোয় জান্নাহ্ তার ডাইরির লেখাগুলো স্পষ্ট দেখতে পায়।অনেক আগে থেকেই ডাইরি লেখার অভ্যাস জান্নাহ্ এর।নিজের একাকিত্ব কাটানোর সবচেয়ে সহজ উপায় এইটা তার কাছে।বৃষ্টির তোড়ে মৃদু হিমেল হাওয়া ছুঁয়ে যাচ্ছে জান্নাহ্কে।আজ অনেকদিন পর জান্নাহ্ তার প্রাণকে নিয়ে লিখবে।আজকাল সময়ই হয় না তার।নিজের বিবাহিত জীবন সামলে হাঁপিয়ে উঠে জান্নাহ্।ফোঁস করে এক দম ফেলে সে।
কলমটা হাতে নিয়ে আবারো সেই স্বপ্নের কথা ভাবে জান্নাহ্।শ্বাসরুদ্ধ হয়ে আসে তার।কী বীভৎস !
জান্নাহ্ লেখা শুরু করে।বাতাস একটু বাড়তেই তা ট্রান্সপারেন্ট ছাঁপিয়ে যায়।কেঁপে উঠে মোমবাতির আলো।জান্নাহ্ দীর্ঘশ্বাস ফেলে।
“প্রিয় প্রাণ,
বর্ষণমুখর এই নিকষকৃষ্ণ রাতে আমার পাখোয়াজ মন আপনারে শুধায়,
প্রাণ;
এক বারো কী মনে পড়ে না আমায়?এতোটা কাল,এতোটা দিন যে সুখের প্রত্যাশায় আমি আপনার পথ চেয়ে নিরভিমান অপেক্ষমান,আমার এই অপেক্ষার অবসান কী এই জনমে আর হবে না?
আপনার ওই নিটোল আঁখির নির্নিমেখ চাহনি আমায় যে নিঃশেষ করে প্রতিটি ক্ষনে ক্ষনে,আপনার ওই পাখলঝোরা হাসি আমার হৃদযন্ত্রে তোলে ঝড়।
আমার পূজনীয় প্রাণেশ্বর,আবার অবচেতন মনের অধিরাজ,যার প্রতিটি ছোঁয়ায় আমার কোমলাঙ্গ দেহ সুখের বন্যায় ভাসে।দেখা কী হবে না আমাদের এই জনমে?
আমার হৃদয়রাজ,
এক নিশিসমাগম বেলায় আপনার আর আমার প্রথম দেখা।সেই প্রথম দেখায় আমার কী যে হলো!আমি আজো বুঝতে পারিনি।
আপনার ওই অধরপল্লবের অনুরণন,আমার সমস্ত দেহপিঞ্জরে ঝংকার তোলে।আমি অবদমন করি আমার সেই তৃষ্ণাকে যা আমার সারা দেহকে নিশ্চেতন করে দিচ্ছে।
আমার নয়নাসার কী আপনার চোখে পড়ে না প্রাণ?তাহলে কেন বাস্তব জীবনে আমি আপনার দেখা পাই না!আমার সত্ত্বা তন্ময় হয়,একবার আপনার দেখা পেতে।যেমনটি আমি ভেবেছি ঠিক তেমনটি।
আমার নির্মেঘ আকাশের নবারুণ আপনি,যার কোমল স্পর্শে শুরু হয় আমার দিন।আমার চাতক মন খোঁজে আপনায়,বৈকালের ওই নিভন্ত প্রভাকরের নিমিষ আঁখিতে।
কবে দিবেন দেখা?কবে করবেন আমায় আপন?আমি আপনারই প্রতিক্ষায় কাটাই অজস্র প্রহর।আপনি আসবেন তো প্রাণ?সেই নিশিসমাগমে,যেমনটা আমি চেয়েছি!আপনার প্রতিক্ষায়,
আপনারই
হৃদমোহিণী”
জান্নাহ্ থামে।বুক ফুলিয়ে শ্বাস নেয় সে।তার মনে হচ্ছিলো কোনো দম বন্ধ করা গহব্বরে আটকা পড়েছে সে।হঠাৎ বিদ্যুৎ চমকে উঠে।জান্নাহ্ সে আওয়াজ শুনতে পায়।দক করে উঠে তার বুকটা।দ্রুতহস্তে কলমটা হাতে নেয়।গড়গড়িয়ে লিখতে থাকে–
“প্রাণ, জানেন আজ কী হয়েছে!আজ আমি এক অকল্পনীয় স্বপ্ন দেখেছি।ছিঃ!কী বিদঘুটে,বীভৎস,অবর্ণনীয়।ভয়ে আঁতকে উঠি আমি।ভাবি,এও কী সম্ভব!
কী করে আমি আমার প্রাণকে আঘাত করি!আমার কী ইচ্ছে জানেন!ইচ্ছে হচ্ছে নিজের সমস্ত স্মৃতি ভুলে যাই।মুছে ফেলি আমার অস্তিত্ব।কিন্তু!
কিন্তু,তাহলে যে আমি আপনাকে হারাবো।আপনাকে আমি হারাতে পারবো না প্রাণ।কোন একদিন তো আপনি সত্যি হয়ে আসবেন।আমি সেই আশায় পথ চেয়ে থাকবো আপনার।আমার অন্তিম শ্বাস পর্যন্ত।”
জান্নাহ্ বেশ কিছুক্ষন নিরব থাকে।মোমবাতির আলোয় তার ছায়া পড়ছে লম্বভাবে দেয়ালে।তা দেখেই হেসে উঠে জান্নাহ্।ফুঁ দিয়ে আদো আদো জ্বলন্ত মোমবাতির শিখা নিভিয়ে ফেলে সে।ঘরে এসে বিছানায় উঠে বসে।মনের উচাটন কমে নি।এমন একটা স্বপ্ন কেন দেখলো সে!যার গায়ে একটা সূঁচ বিঁধার কথা সে ভাবতেও পারে না তার বুকে ছুরি!
ঝনঝন করে উঠে জান্নাহ্ এর দেহপিঞ্জর।নাহ,সে আর ভাবতে চায় না।জানালার পাশে গিয়ে হাঁটু মুড়ে বসে জান্নাহ্।থাই খুলতেই এক পশলা বৃষ্টি তার চোখে,মুখে ঝাঁপটে পড়ে।থইথই করে জান্নাহ্ এর মন।এখনো অবিরত মুষলধারে বৃষ্টি পড়ছে।জান্নাহ্ আকাশের দিকে তাকায়।বৃষ্টির তোড়ে মনে হচ্ছে এখনি খসে পড়বে চাঁদ।আকাবাকা চাঁদ।জান্নাহ্ হাত বাড়িয়ে দেয় বাইরের দিকে।বৃষ্টির ফোঁটা ছুঁয়ে যাচ্ছে তার হাত।জান্নাহ্ সেই শীতল জলধারা তার গালে মাখে।প্রস্ফুরণ হয় তার শরীরে।লোমকূপগুলোও শিউরে উঠে এই ছোঁয়ায়।জান্নাহ্ মৃদু ছন্দে হাসে।তার হাসিতে যেনো বৃষ্টিও আজ হাসছে।
হঠাৎ জান্নাহ্ এর সারহানের কথা মনে পড়ে।কাঁপন ধরে তার গায়ে।এই কাঁপন হয়তো সারহানের উষ্ণতাই সারাতে পারতো।লজ্জামিশ্রিত হাসে জান্নাহ্।লোকটা থাকলে আজ আর তার ঘুম ই হতো না।জান্নাহ্ বাইরের দিকে চেয়ে বসে থাকে।আলো ফুটতে শুরু করেছে।বৃষ্টির ছন্দও ক্রমশ কমে আসছে।এলাকার মসজিদ থেকে মিষ্টি সুরে ভেসে আসছে আযানের ধ্বনি।জান্নাহ্ আশ্বস্ত হয়।এখন আর ঘুমিয়ে কাজ নেই।অযু করে নামাজের জন্য তৈরি হয় জান্নাহ্।স্নিগ্ধ একটা সকাল।
,
,
,
গম্ভীর হয়ে বসে আছে রাফাত।তার বিক্ষিপ্ত অক্ষিযুগল অক্লান্তভাবে খুঁজছে তার জানেমানকে।কিন্তু কোথাও নেই সে।জান্নাহ্দের স্কুল গেটেই একটা সিসি ক্যামেরা লাগানো।ছেলেমেয়েরা ক্লাস শেষে আড্ডা দেয়।একদিন কথা কাটাকাটিতে মারামারি বেঁধে যায়।কিন্তু আসল দোষীকে খুঁজে পাওয়া ছিলো দুষ্কর।তাই ভবিষ্যতে ঘটা এই ধরনের ঘটনা থেকে বাঁচার জন্য ক্যামেরার ব্যবস্থা।
তার মনিটরিং রুমে গত কয়েকদিন ধ্যান ধরে ঘন্টা পার করে রাফাত।আজোও বসে আছে।পাশে বসা ইশাক ঝাঁঝিয়ে উঠে বললো–
“কী শুরু করলি তুই?রেজিষ্টারে গিয়ে নামটা দেখলেই সব ল্যাটা চুকে যায়।আর তুই কিনা!
ইশাকের কথায় বিন্দুমাত্রও বিরক্ত হয় না রাফাত।তার নির্নিমেখ চাহনি এখনো মনিটরে।স্কুলে প্রবেশ করা প্রতিটি ছেলে মেয়েকে ভালো করে দেখছে সে।খেয়ালিপনায় বললো–
“যা সহজে পাওয়া যায় তার মোহ অতি সহজে কেটে যায়।কিন্তু যা অর্জন করা যায় তার মায়ায় পড়ে যায়।”
ইশাক নাক ফুলিয়ে বিরক্তি প্রকাশ করে বললো–
“তোর এইসব আউল ফাউল বাউলা ঘ্যানঘ্যান শুনতে ভালো লাগছে না।এইভাবে কী তুই ওকে খুঁজে পাবি?
“পাবো বন্ধু পাবো।”
ইশাক জ্বলন্ত চোখে তাকায়।হঠাৎ করেই রাফাত উন্মনা গলায় বললো–
“জানিস ওর না চেরি ফুল ভীষন পছন্দ ছিলো।আমি আসার সময় জাপান থেকে ওর জন্য চেরি ফুল নিয়েও এসেছিলাম।কিন্তু হারিয়ে ফেললাম আমি ওকে।ওর প্রিয় রং হলো লাল।রেড চেরি।ভীষন পছন্দ করতো।ঠিক রেড চেরির মতো ছিলো আমার জানেমান।আমি কখনো খেতে পারতাম না।এতোটা মিষ্টি আমার সহ্য হতো না।কিন্তু ও পারতো।এই জন্যই ও এতোটা মিষ্টি ছিলো।
প্রতি বছর ওর জন্মদিনে ওকে রেড কালারের ড্রেস গিফ্ট করতাম।কিন্তু কখনো ওকে সেই ড্রেসে দেখার সৌভাগ্য হয়ে উঠেনি।সব কিছু শেষ হয়ে গেলো।”
বুকটা ভারি হয়ে আসে রাফাতের।তার কলিজায় যেনো কেউ ছেদ করে দিয়েছে।তা আর জোড়া লাগানো সম্ভব হচ্ছে না।চোখের কোণে জল জমে রাফাতের।তা ইশাকের চোখ এড়ালো না।বন্ধুকে সান্ত্বনা দিয়ে বললো–
“চল,রেজিস্ট্রার থেকে ওর নাম দেখে আসি।আর ওখানেই ঠিকানা পেয়ে যাবো।”
“উঁহু।এতো সহজে না।ওকে আমি খুঁজে বের করবোই।কথা দিয়েছে ও আমাকে।ছোটবেলা থেকে ভালোবেসেছি আমি ওকে।এই,এই এইটুকুন ছিলো ও।তখন থেকে।ভালোবাসা কী বুঝতে পারতাম না আমি তখন।তবুও ওকে চেয়েছি।আর আজ সব বুঝেও শুধু ওকেই চাই।আমার রেড চেরি।আমার জানেমান।খুঁজে আমি ওকে বের করবোই।”
ইশাক নিরস্ত্র সৈনিকের মতো আত্নসমর্পণ করে।রাফাতকে বোঝানো দায়।
চলবে,,,