জান্নাহ্
পর্বঃ১২
লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি
কমিউনিটি হল জুড়ে ঝলমলে আলো।সবার মুখেই নির্লিপ্ত হাসি।কিন্তু কারো চোখে জ্বলছে তীব্র আগ্নেয়গিরির লাভা।সারহানের পাশেই নিরুত্তাপ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে জান্নাহ্।তার ভীত দৃষ্টি মেঘনোলিয়ার দিকে।মেঘনোলিয়া সুযোগ সন্ধানী।জান্নাহ্কে একা পাওয়ার তুমুল আগ্রহ তার।
জান্নাহ্ এর অস্বস্তি বাড়তে থাকে।এসি অন করা রুমেও থমথমে পরিবেশ।জান্নাহ্ এর চিন্তিত মুখ দেখে স্বশব্দে প্রশ্ন ছুঁড়ে সারহান–
“আপনার কী সমস্যা হচ্ছে রজনীগন্ধা?
জান্নাহ্ ঠোঁট চিপে না বোধক সম্মতি দেয়।সারহান এক ভ্রু উঁচু করে তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে মেঘনোলিয়ার দিকে তাকায়।নাকের ডগা ফুলিয়ে ঠোঁট কামড়ে ধরে।মেঘনোলিয়া এখনো তাকিয়ে আছে।ফোঁস ফোঁস করছে সে।রাগে গলার শিরাগুলো ফুলে ফেঁপে উঠেছে।তার অরুনলোচন আঁখি বলে দিচ্ছে আজ কিছু তো একটা হবে।পাশ দিয়ে যাওয়া সার্ভিস বয়ের সাথে ধাক্কা লেগে খাবারের কিঞ্চিৎ অংশ লেগে যায় মেঘনোলিয়ার গায়ে।ক্ষেপে উঠে মেঘনোলিয়া।কয়েকটা কড়া কথা শুনিয়ে মামলা ঠান্ডা হতেই ওয়াশরুমের দিকে এগিয়ে যায়।সারহান সেদিক থেকে চোখ ফিরিয়ে জান্নাহ্ এর দিকে তাকায়।জান্নাহ্ এর শান্ত মুখে গভীরতার ছাপ।তাকে স্পর্শ করতেই সারহান টের পায় জান্নাহ্ শরীর ঈষৎ উষ্ণ।তার গলায় আর কপালে হাতের উল্টো পিঠ ছুঁইয়ে বললো–
“শরীর খারাপ লাগছে রজনীগন্ধা ?
জান্নাহ্ অস্ফুট আওয়াজ তুলে বললো-
“উঁহু।”
সারহান ঠোঁট চেপে ধরে এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে।একটা কোল্ড ড্রিংকসের গ্লাস নিয়ে জান্নাহ্ এর হাতে দেয়।আলতো গলায় বললো–
“এইটা খান,আমি আসছি।”
জান্নাহ্ ভীত গলায় বললো–
“কোথায় যাচ্ছেন?
সারহান বিগলিত হাসে।রহস্য গলায় বললো–
“আপনাকে ছেড়ে কোথায় যাবো?
সারহান যেতেই ঠান্ডা ড্রিংসটা গলায় ঢালে জান্নাহ্।খালি পেটে কার্বোনেটেড বেভারেজ পড়তেই মোচড় দিয়ে উঠে জান্নাহ্ এর পেট।যেনো সব বেরিয়ে আসবে।
নিজের হাত বেয়ে গড়িয়ে পড়া রক্তের স্মিত ধারা মুছে সেখানে ফাস্টএইড করে নেয় সারহান।এইসবে তার বিন্দুমাত্র ভাবাবেশ নেই।অভ্যস্ত সে।চিন্তা হয় জান্নাহ্ এর জন্য।রক্ত একদম সহ্য করতে পারে না মেয়েটা।সারহান ফিচেল হাসে।এই মেয়ে নাকি আবার ডক্টর হবে।জান্নাহ্ এর কোনো ইচ্ছেই সারহান অপূর্ণ রাখে না।যথাসাধ্য চেষ্টা করে পূরণ করার।তাই সব জেনেও সাইন্স নিয়ে পড়ার বিরুদ্ধে টু শব্দ করে নি সারহান।নির্দিষ্ট জায়গায় এসে জান্নাহ্কে পেলো না সারহান।এদিক ওদিক চড়ুই পাখির মতো খুঁজতে থাকে।
আচমকাই মানুষের কোলাহলে দৌঁড়ে ওয়াশরুমে আসে সারহান।জান্নাহ্ ফ্লোরে পড়ে আছে।ঘিরে রেখেছে তাকে মানুষ।সারহান জান্নাহ্ এর কাছে যেতেই দেখে তার সমস্ত শরীর লালচে হয়ে চাকা চাকা হয়ে আছে।জান্নাহ্ এর পালস রেট টগবগিয়ে চলছে।অধৈর্য গলায় ডেকে উঠে সারহান—
“রজনীগন্ধা,রজনীগন্ধা।কী হয়েছে আপনার?এইসব হলো কী করে?
জান্নাহ্ নিশ্চল,নিস্তব্দ।সারহান পাঁজাকোলে করে জান্নাহ্কে তুলতে গেলেই চোখ পড়ে ওয়াশরুমের দরজায়।রক্তের ক্ষীনধারা বেরিয়ে আসছে।চোখের পাতা প্রশস্ত করে সারহান।কিন্তু এখন অন্য কিছু ভাবতে চাইলো না।
জান্নাহ্কে নিয়ে সেখানকার রেস্টরুমে শুইয়ে দেয় সারহান।জান্নাহ্ এর সারা দেহে লাল হয়ে চাকা চাকা হয়ে আছে।পুরো শরীরে আঁচড়ের দাগ।তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলে সারহান।নিশ্চয়ই হিং যুক্ত কিছু খেয়েছে।জান্নাহ্ এর চিংড়ি মাছে অ্যালার্জি।ভয়াবহ অ্যালার্জি।জান্নাহ্ এর জন্য সারহান নিজেও চিংড়ি মাছ খাওয়া ছেড়ে দিয়েছে।আর এই মেয়ে!
বাইরে বেশ হৈ হুল্লোড় চলছে।পুলিশ এসেছে।ওয়াশরুমের ভেতর একটা লাশ পাওয়া গেছে।কিন্তু সারহান নড়লো না।জান্নাহ্কে আধশোয়া করে নিজের বুকের সাথে চেপে ধরে বসে আছে।প্রায় ঘন্টাখানেক পরে নড়ে উঠে জান্নাহ্।সারা শরীরের অসহনীয় ব্যথা।কুঁকড়ে উঠে জান্নাহ্।সারহান আলতো হাতে তাকে বিছানার হেডবোর্ডের সাথে হেলান দিয়ে বসায়।চোখ দুটো লাল হয়ে ফুলে উঠেছে।শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে জান্নাহ্ এর।মাথায় প্রচন্ড যন্ত্রণা হচ্ছে।যেনো কেউ ড্রিল মেশিন চালিয়ে দিয়েছে তার মগজে।চুলকানিতে অসহ্য লাগছে জান্নাহ্ এর কাছে।কেঁদে ফেলে জান্নাহ্।ঝপাৎ করে সারহানকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে উঠে।ব্যতিব্যস্ত সারহান জান্নাহ্ এর পিঠে হাত বুলিয়ে শান্ত ও স্বাভাবিক গলায় বললো–
“রিল্যাক্স,কী খেয়েছেন আপনি?
জান্নাহ্ মাথা ঘষতে থাকে সারহানের বুকে।যতই কান্না গিলে নেওয়ার চেষ্টা করছে ততই উপচে আসছে।মরে যেতে ইচ্ছে করছে জান্নাহ্ এর।অবর্ণনীয় যন্ত্রণা সে সহ্য করতে পারছে না।জান্নাহ্ এর মাথাটা ঠিক সারহানের গলার নিচটায় আবদ্ধ।ঘনঘন দম ফেলছে জান্নাহ্।রেস্টরুমের দরজা খুলে কেউ একজন ভেতরে আসে।সাথে পুলিশ।হালকা মাথা উঁচিয়ে তাদের দেখেই সারহানকে খাঁমচি মেরে ধরে জান্নাহ্।সারহানের বলিষ্ঠ শরীরের মাংসও দলিয়ে যায় জান্নাহ্ এর খাঁমচিতে।সারহান নির্বিকার গলায় বললো–
“ডোন্ট ওয়ারি,আমি থাকতে আপনার একটা লোমকূপও কেউ স্পর্শ করতে পারবে না।”
ইন্সপেকটর হতভম্বের মতো তাকিয়ে থাকে।নরম গলায় বললো–
“কে হয় সে আপনার?
সারহান ঠান্ডা কিন্তু দাম্ভিক গলায় বললো–
“ওয়াইফ।”
ইন্সপেকটর হেয়ালি গলায় বললো–
“ও আচ্ছা।তাকে কিছু প্রশ্ন করা দরকার।লাশটা সবার আগে তিনিই তো দেখছেন।”
চমকে উঠে জান্নাহ্।অবিশ্বাস্য গলায় বললো–
“লাশ!কিসের লাশ?কার লাশ?কী হয়েছে সারহান?
সারহান মৃদু গলায় জান্নাহ্কে আশ্বস্ত করে বললো–
“ক্লাম ডাউন।কিচ্ছু হয় নি।”
ইন্সপেকটর বিরক্ত হয়।একজন মানুষ খুন হয়েছে আর উনি বলছেন কিছু হয়নি!আজিব!
সারহান সোজা করে বসায় জান্নাহ্কে।জান্নাহ্ এর শরীর ভীষণ ক্লান্ত।চোখে মুখে রাজ্যের অবসাদ।তবুও কোমল গলায় প্রশ্ন করে সারহান–
“কী হয়েছিলো আপনার?আর কী খেয়েছেন আপনি?
জান্নাহ্ বেশ কিছুক্ষন আবেগশূন্য হয়ে তাকিয়ে থাকে।নিজেকে ভাসমান মনে হচ্ছে তার।সারহানের গায়ের সাথে লেপ্টে কাতর গলায় বললো–
“আআমি নুডুলস খেয়েছিলাম।তারররপর অ্যালার্জি অ্যাটাক হয়।তাতে চিংড়ি মাছ ছিলো আমি খেয়াআল করিইইনি।বমিটিং হচ্ছিলো।তাই ওয়াশরুমে যাই।যখন বেএএএর হবোওও তততখখন…।”
ঝমঝমিয়ে কাঁদতে থাকে জান্নাহ্।তার পুরো শরীর থরথর করে কাঁপছে।জান্নাহ্ এর মাথাটা সজোরে বুকের সাথে চেপে ধরে সারহান।জান্নাহ্ এর দেহপিঞ্জর উতপ্ত।ইন্সপেকটর দাঁত মুখ খিঁচে দারাজ গলায় বলে উঠে–
“এইসব কী ধরনের নাটক!একটা খুন হয়েছে আর আপনারা…।”
দাঁতে দাঁত চেপে খলবলিয়ে উঠে সারহান।দাঁড়িয়েই ইন্সপেকটরের কলার চেপে ধরে গমগমে গলায় বললো–
“এএ একদম চুপ।কানে শুনতে পাসনি কী বলছে সে।জানেনা সে কিছু।বের হ এখান থেকে।”
হতচকিত ইন্সপেকটর ভড়কে উঠে হিনহিনে গলায় বললো–
“দেখুন মি.ভালো হবে না বলে দিচ্ছি।ছাড়ুন,ছাড়ুন বলছি।”
জান্নাহ্ ভয়াতুর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।জান্নাহ্ এর হিমোফোবিয়া।রক্তের প্রতি এংজাইটি।এর কারণে সামান্য পরিমাণ রক্ত দেখলেও আক্রান্ত রোগীর পালস রেট বেড়ে যায়।শ্বাসকষ্ট শুরু হয়।অনেক সময় রক্তচাপ বেড়ে রোগী অজ্ঞান হয়ে যায়।জান্নাহ্ এর সাথেও তাই হয়।সে যখন ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে আসছিলো তার পাশেরটাতে তাকাতেই রক্তের ধারা দেখে সেখানেই সেন্সলেচ হয়ে যায়।আর অ্যালার্জি অ্যাটাক।দুই মিলেই পুরোই কাবু করে ফেলে জান্নাহ্ কে।ইন্সপেকটর রাগে গজরাতে গজরাতে বাইরে আসে।একটা স্ট্রেচারে রাখা হয়েছে মেঘনোলিয়ার লাশ।সারহান আরো বেশ কিছুক্ষন পরে বের হয়।মেঘনোলিয়ার লাশের দিকে গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে।সে চাহনিতে মায়া ছিলো না।ছিলো আক্ষেপ।মেয়েটার চোখ দুটো মায়াবী ছিলো।ফোঁস করে এক শ্বাস ছাড়ে সারহান।ইন্সপেকটর কঠিন দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সারহানের দিকে।কেন যেন সারহানকে সন্দেহ হচ্ছে তার।চকিতে তার দৃষ্টি পড়ে সারহানের হাতের দিকে।সেখানে ব্যান্ডেজ করা।ইন্সপেকটর মেঘনোলিয়ার দিকে তাকায়।মেয়েটা চিৎকার দেওয়ারও সুযোগ পায়নি।উদ্ভাসিত অক্ষিযুগল।গলার ঠিক মাঝ বরাবর একটা সুদীর্ঘ গর্ত।ইন্সপেকটর অবাক হয়।এভাবেও আজকাল খুন হয়!
ইন্সপেকটর সারহানের সামনে গিয়ে তার হাতের কথা জিঙ্গেস করতেই সারহান কমিশনারের দিকে ক্ষেপা দৃষ্টি নিক্ষেপ করে।কমিশনারের পিএ ইন্সপেকটরকে সেখান থেকে সরিয়ে নিয়ে আসে।সারহান ধীরগতিতে মেঘনোলিয়ার লাশের সামনে বসে।মেয়েটার চোখ দুটো এখনো জীবন্ত মনে হচ্ছে।কী দরকার ছিলো এইসব করার!ভালোই তো ছিলো সব।সারহান স্বগতোক্তি করে বললো–
“তোমার উপর আমার কোনো রাগ নেই।তবে জান্নাহ্ এর সাথে খারাপ আচরণ করে তুমি ঠিক করো নি।এর জন্য আমি তোমাকে ক্ষমা করবো না।”
মেঘনোলিয়ার গলার ক্ষতটা দেখে সারহান।একটা তীক্ষ্ম চাকু ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে।আর কোনো আঘাতের চিহ্ন নেই।রহস্য হাসে সারহান।পাক্কা ক্রিমিনাল।
সারহানের কথামতো সিসিটিভি ফুটেজ দেখা হয়।সেখানে দেখা যাচ্ছে জান্নাহ্ ওয়াশরুমে ঢোকার পর কেউ একজন বের হয়েছে।কালো রঙের হুডি পরা হলেও সে যে পুরুষ তা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে।সারহান জান্নাহ্কে জিঙ্গেস করে সে কাউকে দেখেছিলো কিনা!জান্নাহ্ বলেছে সে যখন ভেতরে যায় তখন একটা ওয়াশরুমে দরজা বন্ধই ছিলো।যখন বের হয় ওয়াশরুম থেকে তখন সে দেখে ওয়াশরুমের দরজা ভেজানো।আর তার নিচে রক্তের স্রোত।
চলবে,,,
Jannah series er baki part koi ,apnara shob eibavhe kn den ,shob part ek shathe dite paren na