#জল_ফোয়ারা |৭|
#লেখনীতেঃ Liza Bhuiyan
১০.
সকালে খাবার টেবিলে হলো আরেক ঘটনা, সৌহার্দ্যর চাঁচি নিজে খাবার না বেড়ে রোহিণীকে একপ্রকার জোর করেই বললেন খাবার পরিবেশন করতে। রোহিণী কিছুটা হতবাক হয়ে পরিবেশন করলো ঠিকই কিন্তু মায়ের দিকে নজর করাটা আরো প্রখর হলো। কয়েকদিন হলো ও বিয়ে করার জন্য তেমন খোঁ!টা শুনেনা, আর সেই খোঁ!টার রেশ ধরে
ঝ!গ/ড়ার ফাঁকে ওকে মা*রও খেতে হয়না। মায়ের হঠাৎ পরিবর্তনের কারণ শুরুতে ধরতে না পারলেও একটা সময় তা বেশ দৃষ্টিগোচর হলো। হুট করেই সকাল বেলা একটা শাড়ি নিয়ে এসে বললেন
“রোহু, আজকে শাড়িটা পড়িস তো। কতোদিন তোকে সাজগোছ করতে দেখিনা।”
যদিও রোহিণী মায়ের আদেশে শাড়িটা পরেনি, কোন কারণ ছাড়া শাড়ি পরাটা অদ্ভুত। কিন্তু ওর ভাইয়ের সামনে যখন প্রতিনিয়ত তারা প্রশংসায় পঞ্চমুখ, তখন বিষয়টা পানির মতো পরিষ্কার হয়ে গেলো। তারা যেকোনো মূল্যে ওকে বিয়ে দিয়ে ছাড়বে এটা ও জানে, কিন্তু মেয়ে থাকা সত্ত্বেও একজন বিসি*এস ক্যা*ডারের গলায় ঝুলানোর প্রচেষ্টা তাও আবার যে কিনা সম্পর্কে ওর ভাই হয়। রক্তের সম্পর্ক না হোক, ভাই তো ভাইই হয় তাইনা?
রোহিণী এরপর থেকে সৌহার্দ্যকে কিছুটা এড়িয়েই চলে, সৌহার্দ্য যেনো বিষয় বুঝতে পেরে ওর থেকে নিজেও দুরত্ব বজায় রাখে। রোজ সকালে বেরিয়ে পড়ে অদিতার সাথে। সারাদিন কোথায় যেনো থাকে তারপর বিকেলবেলা ফিরে আসে। এমন ঘটনার আজ তিনদিন হতে চললো, রোহিণীর মনে হলো আর চুপ করে থাকা যায়না।
সৌহার্দ্য নিজের কন্যাসহিত ফিরতেই ও একপ্রকার
হা*ম*লেই পড়লো রুমে। অদিতা ফ্লোরে হাতে থাকা পুতুল নিয়ে অস্পষ্ট শব্দে কি যেনো বলছে আর খেলছে। সৌহার্দ্য ফোনে মনোযোগ সহকারে টাইপ করতে ব্যস্ত। রোহিণী গলা খাঁকারি দিতেই মাথা তুলে তাকালো, হাল্কা হাসির প্রয়াসমাত্র করলো তারপর মৃদু কন্ঠে বললো
“বাইরে কেনো দাঁড়িয়ে? ভিতরে আয়।”
রোহিণী উঁচুস্বরে ফিসফিসিয়ে বললো
“কবে ফিরে যাচ্ছো ঢাকায়? কয়দিনের ছুটি নিয়ে এসেছো তুমি?”
সৌহার্দ্যের কপালে হাল্কা ভাঁজ পড়লো, ঠোঁটের কোনে হাসি ধরে রেখেই বললো
“আমি এখানে থাকাতে তুই খুব একটা খুশি বলে মনে হচ্ছে না, এ রা*গ কিসের আমার উপর?”
রোহিণী দীর্ঘশ্বাস ফেললো, অদিতার দিকে একবার তাকিয়ে বলা শুরু করলো
“আমি পুর্বেও বলেছি বিষয়টা আমার অখুশির নয়, যদি তুমি এখানে শুধু থাকতে তাহলে সমস্যা হতো না। নুরকে রোজ ফলো করছো কেনো? তাও আবার অদিতাকে শহর ঘুরানোর বাহানায়? ও ছোট বাচ্চা! ঘুরাঘুরির ‘ঘ’ ও বুঝেনা, নুরের থেকে তোমায় দূরে থাকতে বলা হয়েছিলো, কেনো মানছোনা সেই কথা?”
সৌহার্দ্য ওর কথায় পাত্তা না দিয়ে বললো
“নুর ঠিক আগের মতোই আছে কিছুটা, কেমন যেনো মনে হয় কিছুই বদলায়নি। ওর সামনে গেলে আগের মতোই কথা বলে, কোন রা*গ নেই, অভিমান নেই!”
রোহিণী দরজায় হেলান দিয়ে আনমনে দাঁড়িয়ে বললো
“পৃথিবীতে সবচেয়ে সুখী মানুষ কারা জানো? যারা
ক!ষ্ট অনুভব করেনা, নুর তাদের একজন! ওর ক!ষ্ট তো হয় কিন্তু সেটা অনুভব করার শক্তি ওর নেই, বলতে পারো প্রতিনিয়ত ওর মস্তিষ্ক আর মনের ল*ড়া*ইয়ে ও সবকিছু ভুলে থাকে।”
সৌহার্দ্যের কপালের ভাঁজগুলো ক্রমশ বেড়ে গেলো, ভ্রু কুঁচকে রোহিণীর দিকে তাকিয়ে নতুন কথাগুলো বুঝা চেষ্টা করলো। একজন মানুষ দুঃখ পেলে তা অনুভব করবে না? এটা আদোও সম্ভব। রোহিণীর বলা পরের শব্দগুলো যেনো ওকে ঘোর থেকে বের করে নিয়ে আসলো, ধীরে তাদের অর্থ ওর মাথায় ঢুকতে লাগলো।
“তোমাদের পরিবার হুট করে না জানিয়ে চলে যাওয়ার পর সবচেয়ে বেশি ক!ষ্ট পেয়েছে নুর, কিন্তু কাউকে বুঝতে দেয়নি জানো! সবার সামনে হেসে খেলেই কাটাচ্ছিলো, শুধু আমাকে দেখলে উদাসী মনে বলতো
‘আমার দোষটা কোথায় ছিলো বলবে রোহু আপু? কেনো আমি পেয়েও সবকিছু হারিয়ে ফেললাম?’
প্রত্যুত্তরে আমি কিছু বলিনি, শুধু জড়িয়ে ধরতাম শক্ত করে। ও কাঁ!দতো না, যেনো বিশ্বাসই করতে পারছে না কি হয়েছে, ঘোরের মাঝে ছিলো পুরোটা সময়। দীর্ঘ একবছর পরও যখন তুমি ফিরে এলে না তখন যেনো বুঝতে পেরেছিলো তোমার সাথে হয়তো আর দেখা হবে না। বিষয়টা এক্সেপ্ট করারও সময় পায়নি, বাবা-মায়ের প্রে*শার আর তোমার হঠাৎ চলে যাওয়া। বিষয়টার সাথে খাপ খাইয়ে নিতে পারছিলো না।”
রোহিণী থামলো, কান্নায় কথা জড়িয়ে এলো কিন্তু ওকে বলে শেষ করতে হবে। কেউ একজনকে বলতে হবে সবটা, সৌহার্দ্যর সবটা জানা প্রয়োজন। নিজেকে কিছুটা সামলে বললো
“সেদিন ওর বিয়ের দিন ছিলো। লাল বেনারসি, হাতে চুড়ি, গহনা! কিন্তু ও পাথর হয়ে বসেছিলো। বিয়ের ঠিক পূর্বমুহুর্তে ওকে আর খুঁজে পাওয়া গেলো না, তোমার বন্ধু পুরো শহর খুঁজে বেড়িয়েছে কিন্তু পায়নি। নুর যেনো এক প্রকার উধাও!
তিন দিন পর-”
রোহিণীর কথা জড়িয়ে এলো, পরের শব্দ গুলো বের হতে চাইলো না। কয়েকবার দীর্ঘশ্বাস ফেলে সেই ভয়াবহ অবস্থা মনে করতে লাগলো। কিছুক্ষণ পর আবার বললো
“তিনদিন পর ঢাকার এক হাসপাতাল থেকে কল আসলো, যেহেতু নুরের ছবি পত্রিকায় দেয়া হয়েছিলো তাই সেই হসপিটালের একজন ডাক্তার খবরের কাগজ পড়তে গিয়ে দেখতে পায় আর মুগ্ধর সাথে যোগাযোগ করে। আমরা সবাই ছুটে যাই, নুরকে তারা বাইরে ফেলে রেখেছিলো। পরিবারের কেউ আসেনি, টাকা দেয়ার মানুষ নেই তাই ডাক্তাররা ওকে দেখেনি। মায়া করে হয়তো করিডোরে রেখে দিয়েছিলো। তিনদিন পর ওর ট্রিটমেন্ট শুরু হয়, কিন্তু ততক্ষণে যা ক্ষ*তি হওয়ার হয়ে গিয়েছিলো। নুরের সাথে কি হয়েছিলো আমরা কেউ জানিনা কিন্তু ওর ব্রেইন হেভিলি ডে*মে*জ হয়। ও যেনো থেকেও ছিলো না। সবার দিকে শুধু তাকিয়েই থাকতো, ডাক্তার বলেছে ট্রিটমেন্টের অভাবে ওর ব্রেইন কাজ করছে না। প্রায় দশদিন পর নুর আমাদের চিনতে পারলো আর প্রশ্ন শুরু করলো, ও এখানে কেনো! কি হয়েছে। কিছু বলার পরও যেনো কোন কিছুই বুঝতে পারলো না। অনেক পরিক্ষা নিরিক্ষার পর ডাক্তার জানতে পারলো বিষয়টা”
রোহিণী চুপ থেকে আবার বলা শুরু করলো
“ওর হিপ্পোক্যামপাস ডে*মে*জ হয়ে গিয়েছিলো, হিপ্পোক্যামপাসের কাজ হচ্ছে স্বল্পস্থায়ী স্মৃতিসমুহকে একত্রিত করে দীর্ঘস্থায়ী স্মৃতিতে রুপান্তরিত করা। যার জন্যই আমাদের ছোটবেলার স্মৃতি মনে থাকে, কিন্তু সেটা ওর ডে*মেজ হয়ে যায়। তাই প্রতিনিয়ত যে জিনিস গুলো ও নতুন করে জানে তা ওর দীর্ঘস্থায়ী স্মৃতিতে রুপান্তরিত হয়না, বলা যায় দিনেরটা দিনেই ভুলে যায়। কিন্তু ডাক্তারের ভাষ্যমতে এই অবস্থা বেশিদিন থাকার কথা ছিলো না যেহেতু নুর খুবই অল্পবয়সী ছিলো কিন্তু নুর আর ভালো হয়নি। একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত ওর মস্তিষ্ক সবকিছু মনে রাখলো আর বাকিটা মনে করার কিংবা নতুন করে কোন কিছু নেয়ার ক্ষমতাই হারিয়ে ফেললো। ডাক্তার বলেছে ও বিষয়টা ভুলে থাকতে চায় বলেই ওর ব্রেইনে কোন কিছু সেভ হচ্ছে না, এটা সম্পূর্ণ ওর উপর ডিপেন্ড করে ও ভালো হতে চায় কিনা”
সৌহার্দ্যের মনে থাকা সকল জট খুলে গেলো, মনে হলো সকল উত্তর ও পেয়ে গেছে।ও নিজের মাথার চুল শক্ত করে টেনে বসে রইলো। নুরের স্বাভাবিক আচরণের কারণ ও সবকিছু মনেই রাখেনি, ওর মস্তিষ্ক এখনো ওদের সম্পর্কের সময়টাতে আছে। এই জন্যই নুর রোজ একই স্থান ওর অপেক্ষা করে আর মুগ্ধর ব্যবহার! ও এখন টের পাচ্ছে সবটা। রোহিণী সৌহার্দ্যের অবস্থা দেখে কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো তারপর বলা শুরু করলো
“ও সেই অবস্থায় শুধু তোমাকে খুঁজছিলো কিন্তু কাউকে মুখ ফুটে বলতে পারেনি ও তোমাকে চায়। আমি যদিও জানতাম বলে ও সন্দেহ করেছিলো কিন্তু আমাকে জিজ্ঞেস করার সাহস হয়নি কখনো। আট বছর ধরে সেই একই পার্কের একই জায়গায় তোমার অপেক্ষায় রোজ বসে থাকে তারপর বাড়ি ফিরে আসে শুন্যতা আর বিষণ্ণ মন নিয়ে। আমাদের কিছু করার থাকে না, না ওর ভাইয়ের আর না আমার কিন্তু নুরের ভাই হাল ছাড়েনি। সময়মত ঠিকই চেকাপ করতে নিয়ে যায় যদিও ভালো হওয়ার কোন লক্ষণ নুর দেখায়নি।”
রোহিণী তারপর হাল্কা হাসলো, অশ্রুসিক্ত নয়নে ঠোঁট প্রসারিত হলো। কিছুটা তাচ্ছিল্যের ছলে বললো,
“এখানের সবচেয়ে বড় সত্যি কি জানো?ও ঢাকায় সেদিন রাতে তোমার সাথেই দেখা কতে গিয়েছিলো তাও বউ সেজে বিয়ের আসর থেকে পালিয়ে। নাহয় ঢাকায় যাওয়ার কোন কারণ ছিলো না ওর, আর তুমি ঢাকায় আছো এটা আমিই ওকে বলেছিলাম।কি ভেবে গিয়েছে জানা নেই কিন্তু শেষমুহুর্তেও ও তোমাকে খুঁজেছে আর এখন তো রোজ তোমায় খুঁজে বেড়ায়। অজান্তেই!”
সৌহার্দ্যের হঠাৎ মনে পড়লো নুরের বলা সেদিনের কথা, নুর কিছুটা আনমনা হয়েই বলেছিলো
*কথাটা অ’দ্ভুত শুনালেও বলতে চাই, আই মিসড ইউ! নিজের কাছেই অ’দ্ভুত শুনায় যদিও তবুও মনে হলো অনেকদিন পর তোমায় দেখলাম। ভালো আছো?*
মনে হলো নুরের মস্তিষ্ক বিষয়টা লুকিয়ে রাখলেও ওর মন ঠিকই জানিতো ওদের দুরত্বের কথা, জানিতো ওর লিখা চিঠিতে থাকা পা*ষা*ণ তুষার নামক ছেলেটা ওর কাছে ছিলো না, সে নিজের ক্যারিয়ারের পেছনে ছুটতে ছুটতে সবকিছু পিছু ফেলে গিয়েছিলো, আর যখন ফিরলো তখন অনেক দেরি। কোন কিছুই ওর হাতে নেই! সৌহার্দ্য অনুচ্চস্বরে বললো
“আমি আসতে চেয়েছিলাম, যখন আসার সুযোগ হয়েছে তখন চেয়েছিলাম কিন্তু ততোদিনে খুব দেরি হয়ে গিয়েছিলো। কোন মুখে এসে দাঁড়াতাম আমি? যে আমি ছেড়ে যেতে চাইনি? কিন্তু সবকিছুর প্রেশার আর নিতে পারছিলাম না? কিন্তু ওর সামনে এসে ওই বাহানাগুলো দেয়ার সাহস হয়নি, তাছাড়া আমি ভাবতাম ও মুভ অন করে ফেলেছে কিন্তু ওর এমন কিছু হবে আমি স্বপ্নেও কল্পনা করিনি। আমি কখনোই ওর খারাপ চাইনি”
রোহিণী কিছুটা রা!গ নিয়ে বললো
“আমাদের সাথে যোগাযোগ কেনো করোনি, তাহলেই তো সবটা জানতে! কেনো সব বদলে ফেলেছো?”
সৌহার্দ্য জড়িত গলায় বললো
“তখন সেটাই সঠিক মনে হয়েছিলো, আর নাম্বার আমি নয় বাবা চেঞ্জ করেছে যাতে আমার কোন পিছুটান না থাকে। আমার কয়েকটা নাম্বারই মুখস্থ ছিলো শুধু, আর তাছাড়া আমি যোগাযোগ নিয়ে জানতে চাইনি নুর কিভাবে মুভ অন করেছে, ওর কোথায় বিয়ে হয়েছে। ওই কষ্টটা আমি সহ্য করতে পারতাম না। আমি অনেক স্বার্থপর রোহিণী, ওর অন্যকারো হয়ে যাওয়া আমাকে বাঁচতে দিতো না। তাই মনে হলো সবটা না জেনেই ভালো থাকবো। আর একটা সময় মনেও হলো ভালো আছি সব ভুলে, মা আর অদিতাকে নিয়ে। কিন্তু এমন কিছুর জন্য আমি প্রস্তুত ছিলাম না কখনোই, আর যাইহোক আমি নুরের কখনোই খারাপ চাইনি”
রোহিণী কিছুটা ক্ষীণ কন্ঠেই বললো
“তোমাকে কিছু বলার ভাষা আমার নেই আর না আমি কোন সাইড পিক করতে চাই না কিন্তু আমার তবুও মনে হয় নুর এখন ভালো আছে, সবকিছু ভুলে সুখে আছে। নাহয় সেই ক*ষ্টগুলো নিয়ে ও বেঁচে থাকতে পারতো না, শুধু শ্বাস নিতো হয়তো।আল্লাহ যা করে হয়তো ভালোর জন্যই করে!”
সত্যিই তো! পৃথিবীতে সবচেয়ে সুখী মানুষ সেই যার
ক!ষ্ট অনুভব করার ক্ষমতা থাকেনা। হোক না সে ইল্যুশন মাঝে বিরাজমান কিন্তু সে তো ভালো থাকে, অন্তত সাধারণ মানুষ থেকে হাজারগুন ভালো থাকে।যদি এভাবে সবার সব ভুলে থাকার ক্ষমতা থাকতো…
#চলবে…