#জল_ফোয়ারা |৬|
#লেখনীতেঃ Liza Bhuiyan
ঝিরি ঝিরি বৃষ্টিতে দুজন কপোত-কপোতী দৌঁড়ে গাছতলা ছেড়ে একটি ছোট্ট দোকানের ছাউনিতে দাঁড়ালো। কাঠফা’টা রোদের মাঝেই হুট বৃষ্টি পড়াটা অযাচিত, কিন্তু অশোভনীয় নয়। দাদি-নানীরা প্রায়ই রসিকতা করে বলে উঠে ‘রোদ হচ্ছে বৃষ্টি হচ্ছে, কাঠবিড়ালির বিয়ে হচ্ছে’, আশেপাশের সবাই হয়তো তখন কলকল শব্দে হেসে উঠে!
নুর নিজের কাঁধে থাকা ব্যাগ সাবধানে সরিয়ে হাত বাড়িয়ে দিলো বৃষ্টি ছোঁয়ার আশায়, শিতল-ঠান্ডা হাওয়ায় চোখ বুঝে এলো ওর। প্রাণ খুলে শ্বাস নিলো, মনে হলো অনেকদিন শ্বাস আটকে ছিলো, দমবন্ধ অবস্থা থেকে এই মাত্রই মুক্তি পেলো। নুর এমন অনুভুতির মানে বুঝলো না, বৃষ্টি থামার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে রইলো নিশ্চুপে, উপভোগ করতে লাগলো প্রকৃতির রহমত!
সৌহার্দ্য পাশে দাঁড়িয়েই সবটা দেখলো, নুরের সাথে ওর দেখা প্রায় আট বছর পাঁচ মাস দশদিন পর! অথচ মেয়েটা কি সাবলিল আচরণ করে যাচ্ছে শুরু থেকেই, সৌহার্দ্য কথা বলার সুযোগ পায়নি। নুরের আচরণ, কথা বলার ভঙ্গিমা সেই কখন থেকে লক্ষ্য করে যাচ্ছে! নুর সেই শুরু থেকেই এ কথা ও কথা বলেই যাচ্ছে, যদিও ওদের সম্পর্ক থাকাকালীন সময়ে ও কমই কথা বলতো কিন্তু আজ সৌহার্দ্য শুধুমাত্র নিরব দর্শক।
নুরের প্রতিটি পদক্ষেপ খুব মনোযোগ সহকারে পর্যবেক্ষণ করছে। নুরের চেহারায় আগেরমতো কিশোরীভাবটা নেই, চেহারায় পরিপূর্ণতা এসেছে। আগের গোলগাল চেহারায় এখন লম্বাটে গড়ন, ফুলে থাকা গালগুলো আর নেই। বয়স বাড়ার সাথে সাথে এই সুক্ষ্ম পরিবর্তন।
বৃষ্টি থামতেই নুর সৌহার্দ্যের হাত ধরে বেরিয়ে পড়লো, এদিক ওদিক তাকিয়ে মুখ ঢেকে নিলো তারপর স্বাভাবিকভাবেই ওর হাত ধরে হাঁটা শুরু করলো যেনো তা নিত্য দিনের কাজ। সৌহার্দ্য হাল্কা কেশে বলা শুরু করলো
“আসলে কি বলে কথা শুরু করবো বুঝতে পারছিনা তবে সবকিছুর আগে বলবো আমি দুঃখিত, প্রচণ্ড দুঃখিত। তোমার পাঠানো চিঠিগুলো আমি পেয়েছি, তুমি জানো নিজেকে কতোটা অ’মানু’ষ মনে হচ্ছে আমার!”
নুর সৌহার্দ্যর দিকে কপাল ভাঁজ করে তাকালো, কিছু একটা হিসেব যেনো মিলাতে পারলো না। মৃদু কন্ঠে বললো
“চিঠি? কিসের চিঠির কথা বলছো।কাল তো আমি কোন চিঠি পাঠাইনি!”
সৌহার্দ্য দ্রুততার সাথে বললো
“আমি তো কাল চিঠি পাঠানোর কথা বলিনি, একমাস পুর্বে-”
নুর লজ্জা পেয়ে গেলো, মুখের উপরে থাকা চুলগুলো কানের পিছনে নিয়ে আস্তে করে বললো
“আমরা তো এই বিষয়ে কথা বলবো না বলেছিলাম, তবে কেনো সামনাসামনি এগুলো বলছো!”
তারপর গলার স্বর একটু উঁচু করে বললো
“উফফ তুমিও না, মাঝেমাঝে কিসব বলে বেড়াও। বুঝিনা বাপু!”
রাস্তা দিয়ে হেটে চলে যাওয়া লোকগুলো পিছু ফিরে ওদের দিকে আড়চোখে তাকালো, সৌহার্দ্য আর কথা বাড়ালো না। নুর রাস্তার ধারের চা সাধলেও ও খেলো না, চায়ের পুরোনো অভ্যেসটা এখন আর নেই। সুযোগ পেলেই এখন কফি ছাড়া অন্যকিছু খাওয়া হয়না, সতেজ থাকতে কড়া কিছু দরকার হয় যে!
বৃষ্টি কিছুক্ষণ পর থেমে গেলেও তার রেশ রয়েই গেলো, ওরা দুজন হাঁটতে হাঁটতে কলেজ গেট পেরিয়ে বকুলতলায় এলো। সেখানেও এখন ছোটখাটো বসার জায়গা, দুজন একফাঁকে গিয়ে বসলো। নুর বাদাম হাতে একথা ও কথা বলছে আর সৌহার্দ্য তা আনমনে শুনছে। কথার ফাঁকেই নুর ভ্রু কুঁচকে বললো
“তুমি আবার শার্ট পরো কবে থেকে? টাও আবার কালো শার্ট? তোমার প্রিয় রং না নীল?”
সৌহার্দ্য কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললো
“সময়ের সাথে কতো কিছুই তো বদলায়, সেখানে প্রিয় রং বদলে যাবে এটাই স্বাভাবিক। সাদা কালো জীবনে রঙ্গিন জিনিস ভালো লাগে না এখন আর।”
নুর খিলখিল করে হেসে বললো
“একদিনেই বুঝি রঙ বদলে যায়? আমাকে ইম্প্রেস করতে চাইছিলে বললেই পারো। যদিও আমার প্রিয় রঙ সবুজ, কিন্তু তোমায় কালো শার্টে কিন্তু দারুণ লাগছে। ইশশ ক্যামেরা থাকলে ছবি তুলতাম একটা তোমার!”
সৌহার্দ্য অবাক হয়েই বললো
“তোমার প্রিয় রং সবুজ এখনো?”
নুর সাবলিলভাবে মাথা নাড়লো তারপর আশপাশ তাকিয়ে বললো
“প্রকৃতি আমার ভালো লাগে, চারপাশে গাছপালা দেখলে নিজেকে খুঁজে পাই এমন লাগে”
তারপর সৌহার্দ্যর দিকে তাকিয়ে তারপর বললো
“কথাটা অদ্ভুত শুনালেও বলতে চাই, আই মিসড ইউ! নিজের কাছেই অদ্ভুত শুনায় যদিও তবুও মনে হলো অনেকদিন পর তোমায় দেখলাম। ভালো আছো?”
সৌহার্দ্যর চোখ হাল্কা ঝাপসা হয়ে এলো, হাল্কা করে মাথা নেড়ে অস্ফুট স্বরে বললো ‘হুম’। এতোক্ষন স্বাভাবিক কিভাবে থাকছে ওর জানা নেই, ও ভেবেছিলে নুরকে দেখলে ও বিষয়টা সহ্য করতে পারবে না। হয়তো জমানো কষ্টগুলো প্রকাশ পাবে, নুরের স্বাভাবিক আচরণ বিষয়টা অনেক স্বাভাবিক করে দিয়েছে।অনেকদিন পর মনে হলো শ্বাস নিচ্ছে।
—————–
যতক্ষনে ওরা দুজন রোহিণীদের বাড়ির সামনে এলো তখন শেষবিকেল। ওদের দেখে রোহিণী দৌঁড়ে নিচে এলো, নুরের দিকে তাকিয়ে জোর’পূর্বক হেসে সৌহার্দ্যকে দ্রুততার সাথে বললো
“তুমি ঘরে যাও, মা ডাকছে তোমায়”
সৌহার্দ্য কিছু বলতে যাবে তা আর হলো না। গালে খুব জো’রে কেউ ঘু’ষি মা’রতেই ও চার-পাঁচ কদম পিছিয়ে গেলো। ঠোঁট ফে’টে র’ক্ত বের হওয়া শুরু হলো, ও চোখ তুলে তাকাবে তার মাঝেই আরো এ’কটা প’ড়লো। এবার সৌহার্দ্যর বেশ রা’গ হলো, হাত মু’ষ্টিব’দ্ধ করে পাল্টাঘা’ত করতে যাবে ঠিক তখনই নুরের কথা কানে ভেসে এলো
“ভাইয়া! ওনাকে এভাবে মা’রছি’স কেনো? কি সমস্যা তোর?”
নুরের কথা তো’য়াক্কা না করে মুগ্ধ সৌহার্দ্যর দিকে তে’ড়ে গেলো, রোহিণী তার ফাঁকে নুরের হাত ধরে নুরদের বাসার গেটের ভিতর নিয়ে গেলো। ফিসফিসিয়ে বললো
“তুই এসবে জড়াসনা নাহয় ঝা’মে’লা আরো বেড়ে যাবে, দুজনের ব্যাপার তাদের সামলাতে যে। তোর ভাইয়ের মে’জা’জ গর’ম এখন, নিজের ঘরে গিয়ে ঘাপটি মেরে বসে থাক নাহয় সবাই সবটা বুঝে যাবে।”
বলেই রোহিণী বেরুতে যাবে ঠিক তখন নুর হাত চেপে ধরে বললো
“সবটা সামলে নিয়ো প্লিজ!”
রোহিণী সম্মতিসূচক মাথা নাড়তেই নুর দ্রুত নিজের কামরার দিকে ছু’টলো, রোহিণী বেরিয়ে এসে দেখলো দুজনের কথা কা’টাকা’টি হচ্ছে। দুজনের মাঝে থাকা মানে আ’গু’নে ঘি ঢা’লার মতো তাই নিজের বাসার দরজার আড়ালে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো।
মুগ্ধ ততক্ষণে সৌহার্দ্যর কলার টে’নে আরো কয়েকটা মা’র’লো, সৌহার্দ্যও দু একটা দি’লো। মুগ্ধ বেশ জো’র গ’লায় বললো
“আমার বোন থেকে একশো হাত দূ’রে থাকবি, আটবছর পুর্বে যখন ওকে ছে’ড়েছি’স তখন তোর সা’হস কি করে হয় আবার ফিরে আসার? তুই ওর থেকে দূ’রে থাকবি এটাই তোর জন্য মঙ্গল!”
সৌহার্দ্যর হাত থেমে গেলো, গলায় কথা জড়িয়ে এলো। ওদের ব্যাপারে মুগ্ধ জানতো তাহলে? কই ওর কথায় কখনো তো মনে হয়নি যে ওদের সম্পর্কে রোহিণী ছাড়া আর কারো খোঁ’জ ছিলো! তবে কি রোহিণী বলে দিয়েছে? সৌহার্দ্যর প্রশ্নগুলো নিজের কাছেই রেখে দিলো, রা’গের মাথায় বলেই ফেললো
“তোর বোন কোন ছোট বাচ্চা না যে তুই তাকে এভাবে ক’ন্ট্রোল করবি, ওর ভালো ম’ন্দ বোঝার যথেষ্ট বয়স হয়েছে। ট্রিট হার লাইক এন এডাল্ট ফর ওয়ান্স!”
মুগ্ধ কলার ছেড়ে দিয়ে চোয়াল শক্ত করে বললো
“যখন ও জানেই না কোন মানুষটা থেকে সবচেয়ে বেশি দূরে থাকতে হবে, তখন আমার ওকে এডাল্ট ভাবার প্রশ্নই আসেনা। আর তুই! এসব কথা বলার কে তুই? নুরের নাহয় মানুষ বোঝার ক্ষমতা নেই, তাই আমি তোর মতো পা’ষা’ণ মানুষের ছায়াও আমার বোনের উপর পড়তে দিবো না”
মুগ্ধর কথা শুনে সৌহার্দ্য চুপ হয়ে গেলো, মাথা নিচু করে শান্তভাবে বললো
“আমি ওকে শখ করে ছেড়ে যাই নি, আমি একপ্রকার বাধ্য ছিলাম আর-”
মুগ্ধ ওকে বলতে না দিয়ে নিজেই বললো,
“নিজের ক্যারিয়ার গড়তে সবকিছু পিছনে ফেলেছিস তো? ভালো কথা। ভালো ক্যারিয়ার গড়েছিস, ফ্যামিলি-বাচ্চা নিয়ে সুখে থাক। আমার বোনের চৌদ্দ সীমানায়ও ঘে’ষবি না, নাহয় এই মুগ্ধর চেয়ে খা’রা’প আর কেউ হবে না।”
কথাগুলো বলে মুগ্ধ দাঁড়ায়নি, ঘরের ভিতরে গিয়ে বেশ শব্দ করেই সদর দরজা বন্ধ করে দিলো। সৌহার্দ্য সেখানেই দাঁড়িয়ে রইলো দরজার পানে তাকিয়ে, একসময় বেশ আয়েশ করেই এই দরজা দিয়ে যাওয়া আসা হতো। নিজের বাড়ির মতো গিয়ে থাকা যেতো সেখানে, অথচ মুগ্ধর ব্যবহার ওকে স্পষ্টতই বলে দিয়েছে ও বাড়িতে ওর প্রবেশ নি’ষেধ! সেখানে ওর আগমন সমর্থিত নয়, আর এটাই সবচেয়ে স্বাভাবিক আচরণ যা ও আশা করেছিলো কিন্তু নুরের সবকিছুই অস্বাভাবিক, অদ্ভুত! যে মানুষটির ওকে সবচেয়ে বেশি ঘৃ’ণা করা উচিৎ সেই ওর দিকে ভালোবাসার দৃষ্টিতে তাকিয়েছে?
রোহিণী গেটের ওপাশ থেকে বেরিয়ে আসলো, অ’শ্রুসিক্ত নয়নে তাকিয়ে বললো
“কেনো চলে গিয়েছিলে ভাইয়া? তুমি যদি আরেকটু জোর করতে হয়তো ঠিক থেকে যেতে পারতে!”
সৌহার্দ্য মাথা নাড়িয়ে বললো
“বাবার উপর কথা বলার অভ্যেস আমার কখনোই ছিলো না, হুট করেই তাই কিছু বলতে পারিনি কারণ আমার বলাতে কিংবা না বলাতে তার সিদ্ধান্ত বদলাবে না। এখন হয়তো মুখের উপর না বলাটা খুব সহজ, কিন্তু আমাদের যুগটা অন্যরকম ছিলো। আমিও চাইলেও কিছুই করতে পারতাম না আর যদি নুরের কথা জানাতাম তবে কেলে’ঙ্কারি হয়ে যেতো। প্রেম করাটা এইরকম জায়গায় অস্বাভাবিক বিষয় ছিলো। তারউপর আমার রেজাল্ট খুব একটা ভালো হচ্ছিলোনা, বাবা কিছুটা বুঝতে পেরেই হয়তো এমনটা করেছেন। কিন্তু এগুলা নিতান্তই বাহানা ছাড়া এখন আর কিছু নয়।আমি যে কতোটা অনু’শোচনায় ভুগি তা শুধু আমিই জানি, আমি সত্যিই স্যরি”
রোহিণী আনমনে বললো
“তোমার স্যরি হওয়াতে কিছু বদলাবে না, তোমায় অনু’শোচনা সময় ফিরিয়ে আনবে না। মজার বিষয় কি জানো? যে নুরকে তুমি ফেলে রেখে গেছো, সেই এখনো ও সেই নুরই আছে। একটুও বদলায়নি। এটা সৌভাগ্য, না ঠিক দুর্ভাগ্য তা আমার জানা নেই, তবে তোমার অপ’রাধ’বোধ তোমাকে আরো পুর্বে এই শহরে ফিরিয়ে আসলে ভালো হতো!”
সৌহার্দ্যর হুট করে মনে হলো কিছু কিছু শহরের মায়া চাইলেও ত্যাগ করা যায়না, ওই শহরের স্মৃতি আর তার মানুষগুলো আ’মৃ’ত্যু পিছু ছাড়ে না।
#চলবে…
(ভুল ত্রুটি ক্ষমাশীল দৃষ্টিতে দেখবেন)