দীর্ঘ আট বছর পর প্রাক্তন প্রেমিকার চিঠি পেয়ে অনেকটা হচকিত হয়ে পড়লেন মেজিস্ট্রেট সৌহার্দ্য, কাঁপা হাতে লিখা চিঠিটির দিকে তাকিয়ে রইলো সে, মার্জিত হস্তশিল্পে কালো কালিতে লিখা,
‘প্রিয় তুষার,
তুমি বলেছিলে আমাদের অনুভুতিগুলো পাহাড় সমান বিশাল না হলেও তা জল ফোয়ারার ন্যায় সীমাহীন, ক্লান্তিহীন! তুমি হয়তো ভুল কিছু বলোনি, কিন্তু কি জানো? জল ফোয়ারাও হয়তো একদিন বৃষ্টির অভাবে শুকিয়ে যায়। ঠিক যেমন আমার প্রতি তোমার অনুভুতিগুলো ফুরিয়ে গেছে,যত্নের অভাবে। তোমাকে ভালোবেসে আজ আমি ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত, নিজেকে আজকাল খালি খালি মনে হয়।মনে হয় তুমি হারিয়ে যাওয়ার সাথে আমাকেও নিয়ে গিয়েছো কোথাও একটা।নিজেকে খুঁজে পাইনা আজকাল, আমাদের সময়গুলো বড্ড তাড়া করে বেড়ায় আমায়। মনে আছে পুকুরপাড়ের বকুল গাছটার পাশে যখন আমি বকুল কুঁড়াতে ব্যস্ত ছিলাম তখন তুমি বলেছিলে আমাতে তুমি নীড় খুঁজে পাও, পড়াশুনোর ফাঁকে আমি তোমার প্রশান্তি। তোমার আর কখনো সেই নীড়ে ফিরতে ইচ্ছে হয়নি?আমি জানিনা তুমি ভালো আছো কিনা, নিজের যত্ন নাও কিনা। বাসা থেকে বের হওয়ার পুর্বে ইনহেলারটা মনে করে নিয়ে বের হও কিনা। তোমার জন্য বড্ড চিন্তা হয় আমার! কতোকাল তোমাকে কাছে পাইনা, তোমাকে একপলক দেখার ইচ্ছে পাগল করে দিচ্ছে আমায়।তুমি এই নিষ্ঠুর নির্দয় মানুষটাকে আমি তোমায় এতো মিস করি কেনো?
ইতি,
শুভ্রি নামের মেয়েটি ‘
চিঠিটা বেশ পুরোনো, কালির ছাপ স্পষ্ট।বিবর্ণ চিঠিটির কিছু জায়গায় ছোপ ছোপ কালো চক্র, অশ্রুসিক্ত নয়নে কেউ ভারী যত্নে লিখেছে হয়তো!
সৌহার্দ্য চিঠিটা নামিয়ে টেবিলের উপর রেখে দিলো। অপরাধবোধ আর লজ্জায় চোখের কোণায় জল চলে এলো তার। বাইরের ঝুম বৃষ্টি আর বজ্রপাতের সাথে তাল মিলিয়ে কেঁপে উঠলো তার শরীর, আট বছরের ফেলা আসা স্মৃতি মাথায় ঘুরপাক খেতে লাগলো। হঠাৎ দরজায় কড়াঘাত শুনে কাঁপা কন্ঠে চেঁচিয়ে বললো
“কাম ইন”
খাকি পোশাক পরা একজন লোক দরজার ফাঁকে মুখ ঢুকিয়ে বললো
“স্যার আপনার মেয়ে এসেছে, ভিতরে আসতে চাইছে”
সৌহার্দ্য এক ঝটকায় সিট থেকে উঠে দাঁড়িয়ে গেলো, টেবিলে রাখা চিঠিটা ড্রয়ারে লুকিয়ে রেখে দরজার কাছাকাছি আসতে আসতে বিড়বিড় করে বললো
“অদির আজকে তো স্কুল নেই, এই বৃষ্টির মাঝে কে নিয়ে আসলো ওকে অফিসে?”
দরজা পুরোটা খুলতেই দেখতে পেলো তার সদ্য তিনে পা দেয়া কন্যা অদিতা দাঁড়িয়ে আছে, তার পিছু নিয়েছে ড্রাইভার ও অদিতার ন্যানি ফজিলা খাতুন।অদিতা কেঁদে কেটে একাকার, চোখের পানি মুছতে মুছতেই বাবার দিকে তাকালো। বাবাকে দেখেই কান্নার বেগ বেড়ে গেলো, আহ্লাদী স্বরে ‘বাবাই’ হাত বাড়িয়ে দিলো। সৌহার্দ্য কোলে তুলে নিতেই কান্না থেমে গেলো, অশ্রুসিক্ত নয়নে পিট পিট করে বললো
“বাবাই, তুমি আমাল সাথে না দেখা কলে চলে আসলা কিনো?”
সৌহার্দ্য চোখের জল মুছে দিয়ে নরম স্বরে বললো
“আর হবে না মা, আসো বাবার চেয়ারে বসো।টেবিলের কিছু ধরবে না কিন্ত!”
মেয়েকে নিজের কর্মরত চেয়ারে বসিয়ে আস্তে করে দরজার বাইরে আসলো, ড্রাইভারকে নিম্নকন্ঠে একদফা শাঁসিয়ে বললো
“ওদের নিয়ে এসেছো কেনো এই বৃষ্টি দিয়ে? যদি রাস্তায় এক্সিডেন্ট হতো? কি তুমুল ঝড় হচ্ছে চোখে পড়েনি?”
ড্রাইভার মাথা নত করে চাপা কন্ঠে বললো
“আপনাকে ম্যাডাম ফোন করেছিলো সাহেব, আপনি না ধরাতে ছোট ম্যাডামকে নিয়ে আসতে বললো। সকাল থেকে খুব কান্না করেছিলো আপনাকে না দেখে, সামলানো যাচ্ছিলো না তাই বাধ্য হয়ে…”
সৌহার্দ্য আর কিছু না বলে ভিতরে চলে গেলো, যাওয়ার পুর্বে মুহুরি রহিম চাচাকে বললো অদিতার জন্য পাউরুটি আর দুধের ব্যবস্থা করতে। রুমে ঢুকে দেখলো তার মেয়ে কলম নাড়াচাড়া করছে।ও অদিতাকে কোলে নিয়ে নিশ্চুপে বসে রইলো।
ঘন্টাখানেক আগের ঘটনা, কিছু কাগজে প্রয়োজনীয় সই করেছিলো ঠিক তখনই রহিম চাচা দরজায় কড়া নেড়ে বললো তার জন্য চিঠি এসেছে। অফিশিয়াল চিঠি ভেবে হাতে নিলেও সম্পূর্ণ ভিন্ন কিছু পেলো, একটি ঠিকানাহীন চিঠি! কিন্তু পুরোটা পড়ে বুঝতে বাকি রইলো না চিঠিটা কার লিখা। মনের কোণঘেঁষে অনেক প্রশ্ন আঁকিবুঁকি করছে, সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হলো এতো গুলো বছর পর হঠাৎ কেনো খোঁজ নিলো তার? তাও আবার পুরোনো লিখা চিঠি পাঠিয়ে? কতো পুরোনো চিঠি? দুতিনমাস না তারো কম? কিন্তু প্রশ্নগুলো নিয়ে আর ঘাটাঘাটি করতে ইচ্ছে হলো না। অদিতাকে খাইয়ে দিতে দিতে বুঝলো মেয়েটা দ্রুতই বড় হয়ে যাচ্ছে, সময় কতো দ্রুত চলে যায়। কতোগুলো দিন চলে গেলো মাঝে। সময় পেরোনোর সাথে সাথে বুকে চিনচিন ব্যাথা হতে থাকলো, অপরাধবোধ তাড়া করতে থাকলো জড়সড়ভাবে। ড্রয়ার খুলে ইনহেলারটা হাতে কয়েক পাফ নিতে যাবে তখন তার কথা মনে পড়লো, কড়া শাসনে বলতো
‘ইনহেলার এনেছো সাথে? কেনো ভুলে যাও সবসময়? জানো না ওটা ছাড়া শ্বাস নিতে কষ্ট হয় তোমার?’
সৌহার্দ্য ইনহেলারটা রেখে দিলো। চোখ বন্ধ করে অদিতাকে কোলে নিয়ে চেয়ারে হেলান দিয়ে রইলো। তীব্র গ্লানিতে চোখের কোটরে অশ্রু জমলো আবারো। কিছু সময় পর পুরো ঘর জুড়ে খুকখুক কাশি কর্ণগোচরে এলেও সৌহার্দ্য কাজে মনোযোগ দিলো। নিজেকে শাস্তি দেয়ার ক্ষুদ্র প্রয়াস হয়তো!
——————
অফিসে যাওয়ার জন্য রেডি হচ্ছিলো মুগ্ধ, টাই বাধা অবস্থায় মা ঘরে চা নিয়ে ঢুকলেন। মুগ্ধ চায়ে চুমুক দিতেই রাজিয়া বেগম বেশ আফসোস নিয়ে বলে উঠলেন
“রোহিণীকে আজো পাত্র পক্ষ দেখতে আসবে জানিস? মেয়েটা এই নিয়ে কতোগুলো বিয়ের প্রস্তাব ফিরিয়ে দিলো। কেনো যে এমন করছে মেয়েটা! চেয়েছিলাম ঘরের বউ করে আনবো টাও তো ফিরিয়ে দিলো। মেয়েটার কপালে কি আছে কে জানে! ওইদিন ভাবি খুব মেরেছিলো তবুও বিয়ে করতে রাজি হলো না, পিঠের দাগ এখনো যায়নি”
মুগ্ধ চোয়াল শক্ত করে দাঁড়িয়ে রইলো, চোখ বন্ধ করে রাগ সংবরণ করলো। শান্ত গলায় বললো
“বিয়ে যখন করতে চায়না তাহলে এতো রেষারেষি কেনো?”
রাজিয়া আবারো আফসোসের স্বরে বললো
“বয়স কি কমছে তার! কয়দিন পর কে বিয়ে করবে তাকে? বুড়ো হয়ে গেলে মেয়েদের আর বিয়ে হতে চায়না, আশেপাশের লোকজন তো এখনই কওয়া কওই করছে। সবাই বলছে কার সাথে নাকি প্রেম হয়েছে তাই বিয়ে করতে চায়না, আমারো তাই মনে হয় বুঝলি। ওর পরিবারকে তো চিনিসই টাকা পয়সাই সবকিছু, মেনে নিবে না বলেই হয়তো বলতে পারছেনা। নাহয় কতো শান্তশিষ্ট মেয়েটা কি থেকে কি হয়ে গেলো, কতো ভালো স্টুডেন্ট ছিলো আর এখন তো পড়াশোনায় ছেড়ে দিয়েছে প্রায়। তারা তো বিদেয় করলেই বাঁচে এখন, রোহু তো মাটি কামড়ে বসে আছে। ইশশ শেষমেশ কোন বজ্জাতের সঙ্গ নিয়েছে কে জানে?”
মুগ্ধ মায়ের দিকে তাকিয়ে নরম স্বরে বললো
“তোমারও তো ঘরে মেয়ে আছে মা, তার দিকে নজর দাও। ওর তোমাকে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন”
রাজিয়া বেগম চুপ হয়ে গেলেন ছেলের কথায়, মুগ্ধ অর্ধখাওয়া চা রেখেই মাকে বিদায় জানিয়ে বেরিয়ে পড়লো। পাশের রুম থেকে ছোটবোন চেঁচিয়ে বললো
“ভাইয়া, আসার সময় আইসক্রিম আনবি কিন্তু”
কিছুক্ষণ স্থীর হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো, রোজকার রুটিনে এই অংশটায় নিজেকে অনুভুতিশুন্য লাগে। দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে শান্তভাবে ‘আচ্ছা’ বলে বেরিয়ে পড়লো।
ঘরের বাইরে বেরিয়ে হুন্ডায় স্টার্ট দিতে দিতে পাশের ছাঁদে তাকালো, প্রতিদিনের মতো আজো একই জায়গায় বসে আছে সে কিন্তু রোজকার মতো তার সাথে চোখাচোখি হয়নি। সে কখনো মুগ্ধর দিকে তাকায়না, সকালে কেউ একজন তাকে রোজ দেখে এই জিনিসটা গায়ে মাখায় না। একদৃষ্টিতে আকাশপানে চেয়ে কি যেনো ভাবে আর মলিন চেহারায় তাকিয়ে থাকে। তার চুলগুলো আগের চেয়ে ছোট করে কাটা অথচ একসময় সে ঘন কেশবতী ছিলো। অযত্নে থাকা শরীর জীর্ণশীর্ণ, চোখের নিচে কালি পড়েছে। প্রতিদিনের মতো আজোও মুগ্ধ একপলক দেখে বাইক নিয়ে বেরিয়ে পড়লো নিজ গন্তব্যে!বহুদিন হলো কেউ একজন হুট করেই এসে বলে না
‘আপনি মেয়েদের মতো কাজল পড়ে বাইরে বের হবেন, নাহয় যদি কারো নজর লেগে যায়?’
মুগ্ধও তা হেসে উড়িয়ে দেয়না, তার এখন আর কথা বলে না। কারো কলকল হাসিতে বিমোহিত হয়না। মনে মনে শক্ত হয়ে বললো
‘কি দরকার ফেলে আসা স্মৃতিগুলো টানার?
এই লগ্নকাল শুধু নিজেকে নিয়ে ভাবার…’
ঠিক কানের পাশটায় তখন যেনো কেউ ফিসফিসিয়ে বললো
“তবে কেনো লগ্ন খুঁজো তাকে নিয়ে ভাবার? শত বাহানাবাজি শুধু তাকে একপলক দেখার?’
না এর জবাব ওর কাছে নেই, শুধু জানে কাল আবারো তার নেত্রদ্বয় তাকেই খুঁজবে। এ যেনো কঠিন অসুখ, ক্ষণে ক্ষণে তাকে পাওয়ার অসুখ!
#জল_ফোয়ারা |১|
#লেখনীতেঃ Liza Bhuiyan
(বিঃদ্রঃ- অনেকদিন পর ধারাবাহিক গল্প শুরু করলাম, কেমন হয়েছে তা জানাবেন। ধীরে ধীরে চেষ্টা করছি কিছুটা ভালো লিখার। সবাই ভালো থাকবেন, আসসালামু আলাইকুম)