#জলফড়িং
#রোজা_ইসলাম
#পার্ট ৯
দীর্ঘ চুম্বন শেষে। রাদ নিজের বক্ষপিঞ্জরের মাঝে ঝাপটে ধরে রাখে ওর প্রেয়সীকে! ইরা যখন প্রাণপুরুষের বুকে মুক্ত শ্বাস নিতে ব্যাস্ত। নাসারন্ধ্রে প্রাণপুরুষের সুভাষ মাখতে ব্যাস্ত। রাদ রুদ্ধশ্বাসে স্পষ্ট গলায় বলে উঠে,
—” ইরা এ-ই ছয় মাসে আমি এটুকু বুঝেছি। ভালোবাসায় বিশ্বাস, ভরসার পাশাপাশি। একে অপর’কে সাপোর্ট করাও অত্যন্ত জরুরী! ভুল হলে বুঝিয়ে বলা জরুরী। পথভ্রষ্ট হলে সঠিক পথ দেখিয়ে দেওয়া জরুরী। অথচ এতো বিশ্বাস ভালোবাসার পরেও আমরা দু’জনেই সেটা পারিনি। হয়তো শুরুটা আমিই করেছি। যখন তোমাকে সাপোর্ট করা প্রয়োজন ছিলো, আমি রেগে গিয়েছি, ধৈর্য হারা হয়েছি, তোমাকে কটুকথা শুনিয়েছি ভীতু বলেছি! আমার এমনটা করা মোটেও উচিৎ হয়নি। তুমি ভীত ছিলে আমার তোমাকে সাহস দেওয়া প্রয়োজন ছিলো। তোমার পাশে দাঁড়ানো উচিৎ ছিলো। এসব কিছুই না করে আমি তুমি যা করেছি ফলাফল দুজনেই কষ্ট পেয়েছি। পাচ্ছি..!
ইরা, আজ থেকে আমরা এই ভুল আর করবো না। একে অপরকে পাই না পাই দুজনের মধ্যে দুরত্বের সৃষ্টি করবো না। শেষে দেখা গেলো সব হলো অথচ আমাদের বিশ্বাস, সম্মান সম্পর্ক কিছুই আগের মতো নেই। আজ থেকে আমরা স্বাভাবিক ভাবে আমাদের সম্পর্ক আগাবো। ভবিষ্যতে যা হয় হোক। একজন আরেকজনকে ভালোবাসার পাশাপাশি সাপোর্ট করে যাবো নিজের সর্বোচ্চ দিয়ে।
এবং আমি আমার সকল ভুলের জন্য ক্ষমা চাইছি! ”
ইরার বিমুগ্ধ হয়ে ভেলো রাদের কথা গুলো শুনে। ঠোঁটে স্মিথ হাসি ফুটিয়ে মাথা তুলে মুগ্ধ নেত্রদ্বয় স্থির করে রাদের স্বচ্ছ চক্ষে। ক্ষীণ মোলায়েম গলায় শুধায়,
—” তুমি এতো ভালো কেন? ”
রাদ গাঢ় চুমু আঁকে ইরার কপোলে। বিগলিত গলায় বলে,
—” আমি মোটেও ভালো নই। তাহলে আমার ইরানীর এতটা কষ্ট পেতে হতো না। ”
—” ভুল আমিও করেছি রাদ!”
ইরা ঝুমঝুমিয়ে কেঁদে উঠলো। রাদ শাসিয়ে বলল,
—” একদম কাঁদবে না। চলে যাবো কিন্তু!”
ইরা ক্রন্দনরত মলিন গলায় বলল,
—” আমার তোমাকে কিছু বলার আছে, রাদ!”
রাদ প্রেয়সীর চক্ষে টইটম্বুর করতে থাকা অথৈজল যত্নের সঙ্গে মুছিয়ে দিলো! আশ্বস্ত করে নরম গলায় বলল,
—” সব শুনবো। কিন্তু কান্না করা যাবে না। আমার ভালো লাগেনা ইরা তোমার কান্না। ”
ইরা মাথা দুলালো। রাদের বলিষ্ঠ বুকে মাথা ঠেকিয়ে অসহায় কণ্ঠে। নীলা বেগমে কথাগুলো খুলে বলল। বলতে বলতে পুনরায় কেঁদে দিলো। খুব কষ্ট হচ্ছিলো মায়ের কথাগুলো বলতে। ওর মা ওকে ধোকা দিয়েছে। রাদ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে গাঢ় গলায় বলল,
—” এসব নিয়ে ভেবোনা ইরা মা তো কখনো খারাপ চায় না। ভাগ্যে থাকলে অবশ্যই আমাদের কেউ আলাদা করতে পারবে না। হ্যাঁ, অবশ্যই আমারকেও চেষ্টাও করতে হবে সেটা সঠিক উপায়ে। রেগে গেলে চলবে না। আন্টি খারাপ কিছুই বলেনি আপাদমস্তক তুমি পড়াশোনায় মনোযোগ দাও। নিজের যত্ন নাও। তারপর না হয় আবার আন্টিকে বুঝিয়ে বলো। এছাড়া আর কোনও উপায় নেই। ”
ইরা ঠোঁট জোড়া বাঁকিয়ে ক্রন্দনতর অস্পষ্ট গলায় বলল,
—” উপায় আছে কিন্তু আমি সত্যি ভীতু সাহস নেই আমার সেই উপায় পা বাড়াবার! ”
ইরার কথাগুলো রাদের বুকে বিঁধে। শুধু মাত্র ওর জন্য সাহসী ইরানী আজ এভাবে ভাবছে। কনফিডেন্স হারিয়ে ফেলছে। রাদ অনুরক্তি করে গাঢ় গলায় বলল,
—” এভাবে বলো না ইরা, আমি তাহলে নিজেকে ক্ষমা করতে পারবো না। তুমি ভীতু নও। দেখবে সময় হলে সব ঠিক হয়ে যাবে। ধৈর্য ধরো! ”
ইরা নাক টেনে অস্ফুটে গলায় আওড়ায়,
—” হুম!”
রাদ খানিকটা চিন্তিত গলায় বলল,
—” এখন আমাকে যেতে হবে। ঘন্টা হয়েছে এসেছি!”
ইরা রাদের বুকে আরেকটু আড়ষ্ট হয়ে। অসহায় গলায় বলল,
—” থেকে যাও! ”
রাদ ইরা মাথা চুমু খেলো শক্ত, প্রগাঢ়! অতঃপর শান্ত, মোলায়েম গলায় বলল,
—” আমি থাকবো না! একদিন তোমাকে নিয়ে যাবো আমার কাছে। একদম আমার বুকে বন্দী করে রাখবো তোমাকে কোথাও যেতে দেবো না। এখন আমাকে যেতে হবে। তোমার ভাই উঠে গেলে কখনো আমার স্বপ্ন পূর্ণ হবে না!”
ইরার টনক নড়ে উঠে। বুকে মোচড় দেয়! আদির কথা মন মস্তিষ্কে আসতেই। আবার রাদ চলে যাবে ভেবেও কষ্ট হচ্ছে! তবুও যেতে যে হবেই। রাদ ইরার কষ্ট বুঝে শীতল গলায় বলল,
—” চিন্তা করো না। দ্রুতই আবার দেখা করবো ঠিক আছে? ”
ইরা মাথা দুলালো। অতঃপর শেষ বারের মতো শক্ত আলিঙ্গনে আবদ্ধ হলো দুজন। একজন আরেকজনকে সুভাষ নিজের সাথে মেখে নিচ্ছে নির্বিঘ্নে। নিশি রাতে বাগানে থাকা কিছু জঙ্গলি পোকা গা ছমছম শব্দ তুলে ডাকছে। চাঁদের গাঢ় আলোয় সর্বত্রে নজর বুলিয়ে ইরা রাদকে বের করে দিলো বাসা থেকে। পরপর দুরুদুরু বুকে যেভাবে বেরিয়েছিলো সেভাবেই বাসায় ঢুকলো। হৃদপিণ্ডটা অসম্ভব ভাবে ধরফর করছিলো। নিজের হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া নিজের কাছেই ভয়াবহ লাগছিলো ইরার! তবে বাসার পরিবেশ সব ঠিকঠাক আছে দেখে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল। সব রুমের দরজা বাহিরে থেকে খুলে দিলো নিস্তব্ধতায়। নরম পায়ে রুমে ঢুকে দরজা লক করে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল অবশেষে। এখনো যেন ইরার আশেপাশে রাদ দাঁড়িয়ে এমনটাই মনে হচ্ছে ওর কী প্রখর অনুভূতি! ইরা হাতে থাকা ফোনটা কানে রাখলো রাদ এখনো লাইনেই আছে ওরা কেউ কারো কল কাঁটেনি। ইরা ফিসফিস করে বলল,
—” কোনও সমস্যা হয়েছে? ”
রাদের কপালে সরু ভাজ! নিজেও ফিসফিস করে চিন্তিত গলায় বলল,
—” নাহ, এভরিথিং ওকে? ”
ইরা ক্ষীণ মোলায়েম স্বরে হাসে। প্রফুল্ল গলায় বলে,
—” এভরিথিং ইজ ওকে, এবার বলো তুমি কেন ফিসফিস করে কথা বলছো?”
রাদের কপালের সরুভাজ মিলিয়ে গেলো। প্রসন্ন হেসে বিগলিত গলায় বলল,
—” আমার ইরানীকে ফলো করি। ”
ইরা মৃদুস্বরে হাসে। শুরু হয় পুনরায় ওদের প্রেমকথন। কিয়ৎক্ষন পর শোনা যায় ফজরে মধুর ধ্বনি। রাদ তখন বাসায় পৌঁছে গেছে। কিন্তু প্রেমে আবদ্ধ, মগ্ন দুই নর নারীর কথপোকথন চলতেই থাকে। যেন এই জনমে ওদের কথা শেষ হওয়ার নয়!
_____________
সকাল ৯-টায় অনিচ্ছায় রাদ ফোন রাখতে বাধ্য হলো কেননা ইরার বাসায় ঘটা করে ব্রেকফাস্ট টাইম ঘোষণা করা। ইরা’কে ব্রেকফাস্ট করে ঘুমিয়ে পরতে বলে। নিজে না খেয়েই ঘুমিয়ে পরলো। কতদিন শুদ্ধ, পরিপুষ্ট ঘুম হয় না। আজ শরীর মন দু’টোই ভালো। তাই রাদের ঘুমিয়ে পরতে বিন্দুমাত্র সময় ব্যায় করতে হলো না। অথচ কতগুলো রাত নির্ঘুম ছটফটিয়ে কেঁটে গেলো। ভালোবাসা মাঝেমধ্যে যন্ত্রণার আরেক নাম মনে হয়। আবার সেই একটু ভালোবাসাতেই যেন প্রশান্তি। এই প্রশান্তি অন্য কোথাও নেই। এর সাথে অন্যকারো তুলোনাই হয় না! কী ভারী অদ্ভুত!
______________
ইরা চক্ষুদ্বয় স্বাভাবিক করতে অসংখ্যবার চক্ষুদ্বয়ে পানি ছিঁটকে নিজেকে যথাসম্ভব স্বাভাবিক করে নিচে এসেছে। গোল ডাইনিং জুড়ে সবাই বসে। নীলা বেগম ব্রেকফাস্ট সাজাচ্ছেন। বাসার প্রত্যেকটি জানালা, দরজা খোলা সঙ্গে কড়া লাইট জালানো বিদায় আলোয় ঝকঝকে সফেদ টাইলস চিকচিক করছে। ইরার চোখ ধাঁধিয়ে গেলো নির্ঘুম চোখ দু’টোতে তীর্যক ঝকমকে আলো রশ্মির ছোটায়। তবুও আজ সব ভালো লাগছে। পিছনের বাগান থেকে মৃদুমন্দ পাখির কিচিরমিচির ডাক কানে বেসে আসছে। ভালোই লাগছে সকালটা।
বিড়াল পায়ে ইরা ডাইনিং এ চেয়ার টেনে বসে! এবং প্রথমেই যেটা নরজ কাড়লো সেটা মায়ের উজ্জ্বল, প্রফুল্ল মুখশ্রী! ইরা একটুও ভাবলো না এতটা খুশির কারণ। এখনো রেগে ও মায়ের উপর। মাকে নিয়ে ভাবতেও চায়না ও। বরং নিজ মনে খেয়ে নিলো সবার সাথে। আজমল খাঁন চেয়ে ছিলেন ইরার শুকনো ফুলে যাওয়া মুখের আদলে। বিষাদে ছোয়া মুখে কিঞ্চিৎ খুশির আমেজ!
এই মেয়েটাকে তিনি অত্যন্ত ভালোবাসেন। এর একটি কারণ আছে ইরা সম্পূর্ণ রূপে, গুণে, স্বভাব, আচরণে হুবহু উনার মৃত মায়ের মতো। খান বাড়িতে সবাই ফর্সা চামড়ার হলেও ইরা খানিকটা ফ্যাকাসে ঠিক নিজের দাদীর মতো। কিন্তু এই রঙের জন্যেই ওর মাতা, পিতা অতিরিক্ত ভাবুক ওকে নিয়ে। কালো মেয়ের বিয়ে ভবিষ্যৎ সব নিয়ে ওরা চিন্তিত! বড় ভাই হিসেবে তিনি আজিম খানের এই ভাবুক ভাব টালতেই আদির সাথে ইরার বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে রেখেছেন সেই অনেক আগে তখন ইরা সবে ইন্টার দিবে। আসলে তিনিই চাননি ইরা এই বাড়ি থেকে দূরে যাক। কালো বলে যদিও সুখী না হয় মেয়েটা? উনায় মায়ের মতো মেয়েটা কষ্ট পাবে কালো বলে অবজ্ঞা করবে সহ্য হবে না উনার।
বাসায় তখন রাহুল অঘটন ঘটায়নি। আদি আগে ইরাকে বোনের নজরেই দেখতো। কিন্তু আজমল ভাইয়ের সামনে প্রস্তাব রাখার আগে ছেলের মত নিয়েছিলেন ইরার সাথে ওর বিয়েতে মত আছে নাকি? আদি স্পষ্ট কিছু বলেনি৷ ছেলের মৌনতাকে তিনি সম্মতি ভেবে নেন। ফলস্বরূপ ধীরে ধীরে বুঝতে পারেন আদি এখন ইরাকে নিজের হবু বৌ ভাবে। অধিকার, অধিপত্য দেখাতে চায় ইরার উপর। তবে ইরা আদিকে মানে না। সে একরোখা জেদী!
এতদিন আজমল ভাবতেন আদির কড়া শাসনের জন্যেই ইরা ওকে মানতে চায় না। কিন্তু বিষয়টি যে উনার ভাবনার সম্পূর্ণ ভিন্ন সেটা আজ উপলব্ধি করতে পারছেন তিনি। এখন এই মেয়েটির কথা ভাবতে গেলে। আদির অনুভূতি’কে তুষ্ট করা হবে। বাবা হয়ে উনি এটা কী করে করবেন? স্বপ্ন যে নিজেই ছেলেকে দেখিয়েছেন। ভীষণ দোটানায় পরে গেলেন উনি। এতবড় সত্য এই সময়েই জানতে পারলেন উনি? ছেলের দিকে গম্ভীর চক্ষু নিবদ্ধ করলেন তিনি। ছেলে লুকিয়ে লুকিয়ে ইরাকে দেখছে। হতাশার নিশ্বাস ফেললেন আজমল খান!
________________
দু’দিন পেরিয়ে গেছে। ইরার বাসায় সব স্বাভাবিক ছিলো ওর মা ওকে কিছু বলেনি! না ও কিছু বলেছে৷ সব স্বাভাবিক দেখে আজ সকালেই ইরা ফ্রেন্ডের বাসায় যাবে বলে বাসা থেকে বেরিয়েছে। উদ্দেশ্য রাদের সাথে দেখা করা৷ সব সময়ের মতো সেই পুরোনো স্টাইলাস রেস্টুরেন্টে এসে বসেছে ও। এই রেস্টুরেন্টের ইট পাথর পর্যন্ত ইরা রাদের আসক্তি সম্পর্কে অবগত। এটা রাদ ইরার এলাকা থেকে অনেক দূরে৷ এবং নিরাপদ বলেই সব সময় এখানেই দেখা করে ওরা।
ওদের সম্পর্কে কিছু ধরাবাঁধা নিয়ম ছিলো না কখন। তবে সময় সুযোগ পেয়ে অন্ততপক্ষে মাসে দুবার ইরা আদির চক্ষু ফাঁকি দিয়ে এখানে আসতো। রাদকে তো ইরা দেখা করার কথা বললেই সে ফ্রী! ছেলেটা হুট করে যে ওকে এতটা ভালোবেসে ফেলবে ইরা কখনোই ভাবেনি। রাদ পাগলাটে প্রেমিক পুরুষ নয়৷ সে ভদ্র প্রেমিক পুরুষ। রাদের থেকে প্রেমিকা হিসেবে যতটুকু আশা করেছে ইরা নিঃসন্দেহে এর অনেক বেশি পেয়েছে সব সময়, সর্বদা৷ এই যেমন তিন বছর সম্পর্কে ইরা রাদের কতকাছে এসেছে অথচ নিজে যথেষ্ট দূরত্ব বজায় রেখেছে রাদ। যেন কোনও অন্যায় হয়ে যায় দায় ওদের ধারা। ইরা না বুঝলেও রাদ বুঝতো সে এসবে খেয়াল রাখতো পূর্ণদৃষ্টিতে! বড্ড বিচক্ষণ!
সেদিন রাতে ওর প্রাণপুরুষ একটু বেসামাল হয়ে গিয়েছিলো। এতেও ইরাই দোষী এতটা কাছে যাওয়া ওর ভুল ছিলো! অবশ্য এর জন্যেও ওর ভদ্র প্রেমিক পুরুষ ওর কাছে ক্ষমা চেয়েছে। এতটা ভালো কে বলেছে হতে ছেলেটাকে। আজকাল এসব অহরহ হয় রিলেশনে! তাছাড়া এতো যন্ত্রণা, কষ্ট, অবহেলা সহ্য না করে তো মায়ের পছন্দে বিয়ে করে নিতে পারতো রাদ। যেখানে ইরা কিচ্ছুটি করছে না ওদের সম্পর্কের জন্যে। আসলে থেকে গেলে শত বাঁধাতেও থেকে যাওয়া যায়। চলে যাওয়ার তো হাজারো বাহানা আছে! সবাই কী আর থেকে যেতে পারে? ইরা ভাগ্যবতী ওর প্রাণপুরুষকে পেয়ে!
আজ ইরা একটা ধবধবে সাদা থ্রিপিস পরেছে সাথে টকটকে লাল ওড়না। শ্যামবর্ণ মুখে নেই কোন কৃত্রিমতার ছোঁয়া। স্বচ্ছ, পরিষ্কার চোখ দুটোতে, পাতলা ঠোঁট দু’টোতে লাজুকলতানো হাসি। স্বচ্ছ গ্লাস ভেদ করে বারবার বাহিরে তাকাচ্ছে ইরা।
১১টা বাজে সূর্য মামার তীর্যক, উত্তপ্ত রশ্মি মানব মানবীর মাথার ঘাম পায়ে ফেলতে ব্যাস্ত! যানবাহন ভালোই চলাচল করছে। যার পেপু পেপু শব্দ কানে ভেসে আসছে। তবে সকাল হওয়ায় রেস্টুরেন্টে তেমন মানুষ নেই। দুই একজন আর ওয়েটার গুলো এই যা। রাদ এখনো আসেনি। ইরা রাদের জন্যেই অপেক্ষা করছে। শেষে ধৈর্য হারা ইরা বাহিরে থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলো। কুচকুচে কালো গ্লাসের গোল টেবিলের উপর থেকে ফোন হাতে নিয়ে কল লাগালো কাঙ্ক্ষিত নাম্বারে। একবার রিং হতেই ফোন রিসিভ হলো। ওপাশ থেকে রাদের শান্ত শীতল গলা ভেসে এলো,
—” নিচে দেখো? ”
ইরা তৎপর চক্ষে পুনরায় গ্লাস ভেদ করে নিচে চাইলো। রাদ কালো রঙের ফর্মাল পোশাকে নিমজ্জিত। অসম্ভব স্মার্ট লাগছে। দেখেই বুঝা যাচ্ছে সোজা অফিস থেকে এসেছে। ফর্সা মুখশ্রী ঘামে চুবচুব। তবুও কী সুন্দর লাগছে ওর প্রাণপুরুষকে। রিকশা ভাড়া মিটাচ্ছে সে। এক হাতে কানে ফোন ধরে রেখেছে। অন্য হাতে টাকা বের করতে কিঞ্চিৎ কষ্ট হচ্ছে ওয়ালেট থেকে তবুও সে ফোন কানে ধরে আছে। ইরা কল কেটে দিলো। রাদ এবার ফোন নামায় কান থেকে দু’হাতে দ্রুত ভাড়া মিটিয়ে উপরে তাকিয়ে হাই দেয়। ইরা ইশারায় দ্রুত উপরে আসার আবেদন করে।
অর্থাৎ এক মিনিটের মধ্যেই রাদ এসে ধপ করে বসলো ইরার মুখোমুখি হয়ে৷ ইরা একটু হেসে নিঃশব্দে টিস্যু বের করে দিলো ব্যাগ থেকে ঘাম মুছে নেওয়ার জন্য। রাদের সিল্কি ছিলো চুল ঘামে ভিজে কপালে লেপ্টে আছে। সে বিনাবাক্য হাত চালালো এবং কিছুটা হা হুতাশ করে বলল,
—” ইশ, কবে যে বৌ নিজের হাতে মুছে দিবে! ”
ইরা ঝড়া হেসে। রূঢ়, কিন্তু স্বাভাবিক গলায় বলল,
—” দ্রুতই! ”
রাদ ইরার চোখে আজ কেমন যেন সাহসী সাহসী ভাব দেখছে৷ সেই পুরোনো সাহস! এই যেমন ও একপ্রকার টিচার-ই তো ছিলো ইরার কিন্তু মেয়েটা ওকে ভালোবাসার সাহস দেখিয়েছে! প্রকাশ করা সাহস দেখিয়েছে। ওকে নিজের ভালোবাসায় ডুবিয়ে মেরেছে। তখন রাদের মনে হতো ইরা অত্যন্ত সাহসী মেয়ে! তবে সেটা আগের কিছু দেখাসাক্ষাৎ এ ছিলো না। আচ্ছা ওর একটু সাপোর্টেই কী মেয়েটা পুরনো সাহস ফিরে পেয়েছে? প্রিয় মানুষ গুলো এতটা ক্ষমতা রাখে? হয়তো! অথচ আমরা কতটা কঠিন করে ফেলি সব কিছু।কিন্তু একটু ভরসা সাপোর্ট মানুষকে কোথা থেকে কোথায় নিয়ে যায়। রাদ ইরাকে ধন্যবাদ দিলো ৬-টা মাস ওকে শাস্তি দেওয়া জন্য বিরহে দগ্ধ করার জন্য। নাহলে রাদ এতবড় একটা শিক্ষা কোথা থেকে পেতো? তবে রাদ ইরাকে সাহস সাপোর্টের নামে ফুসলিয়েও দিতে চায়না। ইরার চোখের জ্বলন্তভাষা রাদ পরতে পারে। মেয়েটাকে বুঝাতে হবে নাহয় ধুমধাম কিছু একটা করে ফেলবে যা রাদ একদম চায় না৷ রাদ জানে সেদিন ইরার বাসায় এভাবে যাওয়াও ওর ঠিক হয়নি। তবে কিছু জিনিস হাতের থাকে না। আবেগ অনুভূতি বলেও যে একটা বাক্য আছে। সেটা ইগনোর করার ক্ষমতা সবার থাকে না রাদের ও নেই। ও ভালোবাসার ভীষণ কাঙ্গাল! রাদ দীর্ঘশ্বাস নির্গত করে আশ্বস্ত, নরম গলায় বলল,
—” আমার ইরানী, এতটা রেগে যাওয়ার কিছু হয়নি!”
ইরা হাস্যোজ্জ্বল ভাবভঙ্গি মুখে বজায় রেখে। নিগূঢ় চাহনির সাথে সাবলীলভাবে প্রতুক্তি করে,
—” তুমি কী করে বুঝলে আমি রেগে আছি?”
রাদ বিগলিত হাসে। রাদ হাসলে ওর স্বচ্ছ, পরিষ্কার চক্ষুদ্বয় প্রশ্বস্ত হয় যেন চোখ জোড়াও হাসে। মুখে স্মাইললাইন তৈরি হয় চমৎকার লাগে। ইরা চক্ষে মায়া, ভালোবাসা নিয়ে সেই হাসি দেখলো। রাদ পুনরায় মোলায়েম গলায় শুধায়,
—” ইরা, সব কিছুরই একটা ভালো দিক এবং খারাপ দিক থাকে। তেমনি আমাদের সাময়িক বিচ্ছেদেও একটি ভালো দিক এবং খারাপ দিক আছে। ভালো হলো আমি আজীবন তোমার! মা’কে এই কথা স্পষ্ট জানিয়ে দিতে পেরেছি। যেটা এক সময় আমি সম্ভবই ভাবতাম! এবং অনেক কিছু শিখেছি যা একটি সম্পর্কে প্রয়োজন! আমি তোমাকে ঐদিন রাতে বলেছিও সেটা। এবং খারাপ দিকটি হলো আমরা দু’জনেই কষ্ট পেয়েছি। তুমিই বলো আজ এই বিচ্ছেদ না হলে আমরা আমাদের ভুল গুলো বুঝতে পারতাম? উপলব্ধির বড্ড প্রয়োজন ছিলো আমাদের ইরা! ”
ইরা মনোযোগ দিয়ে রাদের কথা শুনলো। কথা সম্পূর্ণ শেষে রাদ গাঢ় শ্বাস ফেলল! ইরা স্নিগ্ধ আঁখিদুটি রাদের উপর বিদ্ধ করে রেখেছে। রাদ সেই আশা ভরা মায়াময় চক্ষে চক্ষু রেখে আশ্বস্ত গলায় বলল,
—” বিশ্বাস রাখো ইরা। যা হবে ভালো হবে! এটা আমার বিশ্বাস! আমি সেদিনি বলেছি ভাগ্যে থাকলে আমাদের কেউ আলাদা করতে পারবে না। এমন কিছু করোনা যেন ভালোর পরিবর্তে খারাপ হয়ে যায় সব কিছু! বুঝে শুনে ঠান্ডা মাথায় যা করার, সিদ্ধান্ত নেওয়ার নিবে ঝোকের বশে নয়! আমি ছায়ার মতো তোমার পাশে আছি!”
ইরার সত্যি এবার মায়ের প্রতি সকল রাগ গলে পানি হয়ে গেলো! উনি হয়তো জানেনই না। উনি রাদের ভালোবাসা আরও নিখুঁত করে দিয়েছে ইরার প্রতি। কী করে রাখবে ইরা রাগ পুশে মায়ের প্রতি। প্রশ্রয়ের হাসি হাসলো ইরা। রাদ স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল। চটপটে গলায় বলল,
—” এবার আমার ইরানীর জন্য কিছু অর্ডার করি? ”
ইরা তৎপর হয়ে প্রফুল্ল গলায় বলল,
—” মিটবক্স! ”
রাদ হাসলো। দু’জনেই সকালে ব্রেকফাস্ট করেছে তাই হাল্কা পাতলা অর্ডার করলো। ওয়েটার অর্ডার নিয়ে যেতেই রাদ মাথা নিচু করেই গাঢ় গলায় বলল,
—” সুন্দর লাগছে আমার ইরানীকে! লাল ওড়নায় বৌ বৌ লাগছে! ”
ইরা লজ্জা পেলেও। দমে গেলো না। ভেংচি কেটে বলল,
—” বৌ বৌ ভাব বৌয়ের অভাব!”
রাদ ঝরা হাসলো। পুরুষালী গম্ভীর সেই হাসিতে ইরা রাদের প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে! ইরা প্রসন্ন হেসে দুষ্টু গলায় বলল,
—” ইশ, এমন চমৎকার হাসি যদি করা অর্ডার যেতো! খেতে ইচ্ছে করে। ”
রাদের মুখের হাসি মিলিয়ে গেলো। ঢোক গিলে গাঢ় চক্ষে চাইলো ইরার দুষ্টু, মিষ্টি সংমিশ্রণে মায়াময় মুখশ্রীতে! শ্যাম সুন্দরী মেয়েটা দুষ্টু হাসিতে মত্ত্ব! মেয়েটা সর্বদা ওকে ঘায়েল করতে প্রস্তুত থাকে! এতে যে ওর পুরুষ মনে কী ঝড় উঠে আদৌ যদি মেয়েটা বুঝতো! তবে সব হিসেব নিকেস একদিন অবশ্যই হবে! বাঁকা হাসলো। পরপর ওর চক্ষুদ্বয় বৃহৎ আঁকার ধারণ করে। কেননা ইরা ওর বাঁকা হাসি দেখে তৎক্ষনাৎ বুকে হাত রেখে বলল,
—” হায়!”
রাদ বিরবির করে শুধায়,
—” সাংঘাতিক মেয়েরে বাবা!”
ইরা চাপাস্বরে হেসে ফেলে রাদের অস্পষ্ট বাক্যগুলো শুনে। অতঃপর রাদ জব্দ হয়ে গম্ভীরমুখে বসে রইলো। এই মেয়ের কাছে ও সময় হেরে যায়!
______________
সেদিনের পর আরও প্রায় সাপ্তাহ খানিক চলে গিয়েছে। কলেজ থেকে ইরা বেশ ফুরফুরে মেজাজে বাসায় এলো। আজকাল আবার আগের মতো চুটিয়ে প্রেম করছে প্রাণপুরুষের সঙ্গে। ফলস্বরূপ ইরা এখন কিছুটা স্বাভাবিক!
তবে আজ বাসার পরিবেশ বেশ ভিন্ন লাগছে। আফরোজ এবং নীলা বেগমের মুখ কেমন থমথমে। আদি আজ বাসায়! তাও দুপুরেই বিষয়টি ভিন্ন, গুরুত্বপূর্ণ কাজ ছাড়া এই সময় বাসায় থাকে না সে! অফিস থেকে ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা হয় আদির! তবে আজ কী হলো।
ইরা কাউকে প্রশ্ন করার সাহস পেলো না। নিজের রুমে ঢুকে ফ্রেশ হয়ে মীতির রুমে গিয়ে দেখে এই মেয়ে ঘুমে পরনে কলেজ ড্রেস। এই দুপুর বেলা কে ঘুমায় এভাবে? ইরা ধাক্কাধাক্কি করে ওকে উঠালো! মীতি প্রথমে বিরক্ত হকেও এক সময় একদম স্বাভাবিক ভাবে উঠে বসলো। ইরা ফিসফিস করে কৌতূহলের সঙ্গে প্রশ্ন বলল,
—” বাসায় কী কিছু হয়েছে? আজ তোর ভাই বাসায় কেন? আমার দিকে কিভাবে তাকাচ্ছিলো! ”
মীতি সপ্রতিভ হয়! ঘটনা তো অনেক ঘটে গিয়েছে! মীতি কোনটা ছেড়ে কোনটা বলবে? ভাবনায় পরে গেলো ওর ছোট্ট মস্তিষ্ক! ওর ভয় করছে ভীষণ! ওর ইরাপু যেই উড়নচণ্ডী এবং রাগী মেয়ে নিশ্চয়ই হাঙ্গামা হবে বাসায় আজ? ইরা উত্তর না পেয়ে ধাক্কা দিলো বোনকে। ক্ষীপ্ত গলায় ঝামটা মেরে বলল,
—” কী জিজ্ঞেস করছি আমি? কী ভাবছিস তুই? ”
তখনই ইরা শুনতে পেলো ড্রইংরুমে থেকে ইরার ছোট্ট ফুপির কর্কশ গলা! ইরা কান খাড়া করে শোনার চেষ্টা করে এবং পরপর বুঝে ড্রইংরুমে আরও মানুষ আছে। ও আশঙ্কিত মবে ভ্রুঁদ্বয় কুঞ্চিত করে মীতির দিকে তাকায় তৎক্ষনাৎ! মীতি মাথা দুলিয়ে ভীতসন্ত্রস্ত গলায় বলল,
—” ছোট্ট ফুপি এসেছে। সবাই মিলে বাসায় তোমার এবং আদি ভাইয়ার বিয়ের কথা বলছে!”
ইরার মস্তিষ্কের স্নায়ুকোষে যেন মীতির মুখনিঃসৃত বাক্যগুলো একেকটা বজ্রপাতের ন্যায় শুনালো। বিবশ হয়ে গেলো শরীর মন, অন্তরআত্মা! এই কারণেই আজ ওর মা ওকে ইচ্ছে করে কলেজে পাঠিয়েছে মা ওকে আবার ধোঁকা দিলো এভাবে?
চলবে!