#জলফড়িং
#রোজা_ইসলাম
#পার্ট ৬
বেশ অনেকক্ষন যাবত দরজায় দাঁড়িয়ে একাধারে সবাই ডেকে যাচ্ছে ইরা’কে। মীতি ইতিমধ্যেই কেঁদে দিয়েছেন। সাথে ইরার মা। ইরার বড় মা উনাকে ধরে আছেন। উনার কান্নায় ইরার বাবা ধমকে উঠে দুজনকে থামালেন ঠিকি কিন্তু মনে মনে উনি মেয়ের এহেন কান্নায় চিন্তায় মরে যাচ্ছেন। অতঃপর সবাইকে থামিয়ে আজমল খাঁন ধীরেসুস্থে দরজার একদম সান্নিধ্যে গিয়ে শান্ত মোলায়েম কণ্ঠে বলে উঠলেন,
—” ইরা মা, থাম এত কেন কাঁদছিস? আমাকে বল? শরীর খারাপ করেছে? কেউ কিছু বলেছে? না বললে বুঝবো কী করে! ”
বড়বাবার আদুরে কণ্ঠে ইরার আরো তীব্র ভাবে কান্না পেল। কিন্তু এবার ও নিজেকে ধাতস্থ করলো। শব্দ করে কান্না বন্ধ করলো ফলস্বরূপ হেঁচকি উঠে গেলো। হেঁচকি আর থামাতে সক্ষম হলো না ও। কান্নার ফলশ্রুতিতে গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে যেন। জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে শুকনো ঢোক গিলে ইরা ক্রন্দনরত, ভাঙ্গা কণ্ঠে বলে উঠলো,
—” বড় বাবা আমি একদম ঠিক আছি। শুধু একটু একা থাকতে চাই। আমাকে একটু সময় দাও! ”
আজিম খান ইরার কথার পিঠে কিছু বলতে নিলেন। আজমল খান থামিয়ে দিলেন ইশারায় ভাইকে৷ আগত্য চুপ করে যেতে বাধ্য হলেন সবাই। অতঃপর উনি সময় নিয়ে কী যেন ভেবে ধীরে সুস্থে ক্ষীণ স্বরে শুধালেন,
—” ওকে একা থাকতে দেওয়া উচিৎ। কেউ ওকে আজকের বিষয়ে কিছু বলবে না। আমি ওর সাথে এ-বিষয়ে পরে কথা বলে নিব ঠিক আছে? ও বের হলে সবাই ওর সাথে স্বাভাবিকভাবে কথা বলিও। আর তোমরাও স্বাভাবিক থাকো তেমন কিছুই হয়নি দুশ্চিন্তার। ”
আজিম মাথা দুলিয়ে বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন। তখন ব্রেকফাস্টের সময় ছিলো। কেউ আর মুখে খানা তুললেন না সেদিন যে যার কাজে চলে গেলেন। ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো শুধু আদি ইরার দরজার সামনে। ভেতর থেকে তখনও কান্নার মৃদু শব্দ আসছিলো। আদি আরো কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে অফিসে লেট হচ্ছে বিদায় যেতে বাধ্য হলো। না চাইতেও ইরার আজব বিহেভিয়ারের জন্য চিন্তা হচ্ছিলো। তবে শুধু আদির নয় বাড়ির সবার ইরার জন্য চিন্তা হচ্ছিলো। কিন্তু বাড়ির বড় কর্তার কথায় বাধ্য হলো সবাই স্বাভাবিক থাকতে৷
__________
পৃথিবীতে আঁধার নামতেই রাদ আবারও উপলব্ধি করতে পারে সে আবার রেগে গিয়ে ভুল করেছে৷ অর্থাৎ সন্ধ্যায় অফির থেকে বেরিয়েই একটা দুইটা করে প্রায় শ খানেক কল দিয়ে ফেলে রাদ ইরাকে। একটা কল ও তুলেনি ইরা৷ রাদ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বাড়ি পৌঁছায়। না সে ফ্রেশ হয়, না সে চেঞ্জ করে না, সে খানা খায়। সোজা নিজের রুমে গিয়ে বারান্দায় দাঁড়িয়ে একের পর এক কল রাদ ইরাকে করতে থাকে। বরাবরের মতোই কল তুলে না ইরা রিং হয়ে কেটে যায়৷ বারান্দায় দাঁড়িয়ে রাদ একটি দীর্ঘ রাত্রি নির্ঘুম কাটায়! পুরো রাত রাদ শুধু ইরাকে কলই দিয়ে গেছে। তাতে ইরার বিন্দু মন গলেনি হয়তো, কেননা ইরা তো একটা ফোনও তুলেনি৷ ফজরের আযান পরতেই ফোনের দিকে তাকিয়ে রাদের চোখ দুটো হঠাৎই ভেঁজা অনুভব করে সে..। সাথে প্রচণ্ড ভাবে অসহায় মনে হয় নিজেকে। যার এই মুহূর্তের কিছুই করার নেই।
______________
সেদিনের পর সবাইকে অবাক করে দিয়ে ইরা পড়াশোনায় মনোযোগী হলো। পড়াশোনাই যেন একমাত্র ও একমাত্র গুরুত্বপূর্ন বিষয় ওর জীবনে। অন্যদিকে ধ্যান দেওয়ার ফুরসত ওর নেই। ঠিক এমনটাই ও দেখিয়েছে ওর ফ্যামিলিকে। ওর বড় বাবা ওকে ডেকেছিলেন প্রায় সাপ্তাহ খানিক পর নিজের রুমে। ফলস্বরূপ কিছু মিথ্যা বলতে বাধ্য হয়েছিলো ইরা। ও বলেছে ওর পড়াশোনা অনেক বাজে দিকে যাচ্ছিলো তাই ও ভয়ে কেঁদেছিলো সেদিন। তাই তো পরদিন থেকে পড়াশোনায় মনযোগী হয়েছে ও! আজমল খান ও ইরার কথা বিশ্বাস করতে বাধ্য হয়েছিলো ইরাকে স্বাভাবিকভাবে পড়াশোনায় মনযোগী হতে দেখে।
তারপর দেখতে দেখতে প্রায় ৬ টা মাস কেটে গেছে৷ সবার জন্য দিনের আলোয় ইরা হাসিমুখেই থাকতো পড়াশোনাও মনযোগ দিয়েই করতো। কিন্তু নিকষকালো আঁধারে নিরবে কাঁদতো মেয়েটা। তবু্ও কিছুতেই রাদের সাথে কথা বলেনি।
এই ছয়টা মাসে এমন কোনও দিন ছিলো না রাদ ছোট্ট খাটো ফোন কলের ঝড় তুলতো না ইরার ফোনে। কিন্তু ইরা ছিলো নির্লিপ্ত এ ব্যাপারে, রাদের এতো এতো কল ম্যাসেজ দেখেও। তবে যখনি ফোনের উপর রাদের নাম্বারটা জ্বলজ্বল করতো। ইরা এক দৃষ্টিতে ফোনের স্ক্রিনে তাকিয়ে থাকত৷ এটা যেন ওর অভ্যাস হয়ে গিয়েছে। রাত জেগে চোখের পানি ফেলতে ফেলতে রাদের কলের অপেক্ষা করা কিন্তু যদিও ইরা ফোন তুলতো না। এ সিদ্ধান্তে যেন অটুট ছিলো মেয়েটা।
______________
জুহা আস্তে ধীরে কফি বানিয়ে ট্রেতে নিয়ে ছেলের ঘরের দিকে এগুলেন৷ কাশিশ তখনও বাসায় ফেরেনি। রাদ মিনিট পনেরো আগেই ফিরেছে। আজ রাদ অন্যদিনের তুলনায় দ্রুতই ফিরেছে। ইদানিং রাত করে বাড়ি ফিরে সে। কাশিশ, জুহার কারোর সাথে তেমন কথা বলেনা৷ এক প্রকার এড়িয়ে চলে সবাইকে। সে ক্ষেত্রে আজ যেন রাতের বেলা চাঁদ উঠেছে। রাদ আজ কয়েক মাস পর দ্রুত বাড়ি ফিরেছে। এটাই বুঝি মোক্ষম সুযোগ জুহা আজ একান্ত ভাবে ছেলের সাথে কিছু কথা বলতে চান৷
রাদের রুমে ঢুকে দেখলেন৷ ছেলে বেডে আধশোয়া হয়ে সিলিং এর দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে। জুহার বুকটা ধ্বক করে উঠে রাদের শুকনো, ফ্যাকাসে, অনুভূতিশূন্য ফর্সা মুখটা দেখে। তার হাস্যোজ্জ্বল, প্রাণবন্ত ছেলেটা আজ কয়টা মাসে একদম নির্জিব, নিস্তব্ধ হয়ে পরেছে৷ যেন কোনও ঝড় রাদকে পুরো এলোমেলো করে দিয়েছে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে ছেলের সামনে কফির মগ বাড়িয়ে দিতেই রাদ সোজা হয়ে বসে। অনেকদিন পর সন্ধ্যায় মায়ের হাতের কফি পেল ও। আগে অফিস থেকে ফিরে মায়ের হাতের এক কাপ কফি খাওয়ার চরম অভ্যাস ছিলো ওর। এখন যেন পুরনো অভ্যাস গুলো ফিকে লাগে রাদের।
এখন নতুন অভ্যাসে অভ্যস্থ রাদ। সকালে অফিসে গিয়ে পুরো দিন হার ভাঙ্গা খাটুনি। তারপর বাসায় না ফিরে নিরিবিলিতে বসে রাত ১/২ টা পর্যন্ত ইরাকে কল করতে থাকা। সঙ্গে সিগরেটে টান লাগানো তার নতুন অভ্যাস। ব্রেকফাস্ট, লাঞ্চ, ডিনার এগুলোর সময় কখন যায় কখন আসে রাদ বলতেও পারবেনা৷ যার ফলশ্রুতিতে রাদ আগের থেকে খানিক শুকিয়েও গেছে। যদিও এসবে ওর বিন্দুমাত্র ধ্যান জ্ঞান আগ্রহ কিছুই নেই।
একটা মৃদু শ্বাস ফেলে রাদ কফির মগ হাতে নিলো। এই মুহূর্তে কফি খাওয়ার ওর বিন্দুমাত্র ইচ্ছে নেই। শুধু মাকে খুশি করতেই ও তৃপ্তির সাথে মগে ঠোঁট বসালো৷ একটু খেয়ে চিরচেনা গুরুগম্ভীর কণ্ঠে বলল,
—” কিছু বলবে মা?”
জুহা চমকালেন কিয়ৎপরিমাণ! ছেলের কণ্ঠ যেন দিন দিন যেন আরও গম্ভীর হয়ে উঠছে, মাথা নেড়ে জুহা শান্ত কণ্ঠে শুধালেন,
—” বলবো বাবা!”
চোখ মুখের আদল পরিবর্তন করে বিগলিত হাসে রাদ। শান্ত সুরে বলে,
—” হ্যাঁ বলনা!”
জুহা ভনিতা না করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,
—” এভাবে কতদিন রাদ? আমাকে কাশিশ সব বলেছে। আর আমার মনে হচ্ছে সব দোষ তোর! ”
মুহূর্তে মায়ের দিকে পুরনো সেই গম্ভীরমুখে প্রশ্নবিদ্ধ চোখে তাকালো রাদ। জুহা শান্ত কণ্ঠে বলল,
—” একটা মেয়ে প্রেম করে সে কথা বাসায় বলতে পারে? মেয়েটাকে শুধু শুধু জোর করছিস না তুই? মেয়ে তো ভয় পাবেই তাতে। তোর উচিৎ ছিলো ওর বাসায় আমাকে পাঠানো বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে৷ তানা তুই ওকে জোর করছিস৷ আর এখন নিজের কী অবস্থা করছিস তুই। এমন জেদ ধরছিস কেন তুই বলতো? বলছি কী রাদ এভাবে বসে না থেকে। আমি কাশিশকে সাথে নিয়ে ইরার বাসায় যাই? ওর মা-বাবার পরিবারের সাথে আমি কথা বলি। ওরা ঠিক মেনে নিবে তোকে দেখিস। ”
মায়ের কথা মন দিয়ে সম্পূর্ণ শুনে এক দীর্ঘশ্বাস ফেলল রাদ। এক ব্যথিত দীর্ঘশ্বাস যাকে বলে৷ কিন্তু কোনও প্রত্যুত্তর করলো না মায়ের কথার বিপরীতে! ছেলেকে চুপ দেখে জুহা এবার রাগান্বিত কণ্ঠে বললেন,
—” তুই এখনও জেদ ধরে থাকবি?”
মায়ের রাগী কণ্ঠে! গম্ভীরমুখেই এবার হাল্কা হেসে রাদ বলল,
—” তোমার মনে হয় না মা? এটা করতে পারলে আমি আরো আগেই করতাম?”
ভ্রুঁদ্বয় কুঞ্চিত হলো, জুহা গভীর সমুদ্রে থৈথৈ করছে! কিছুই কূলকিনারা পাচ্ছে না। প্রশ্নবিদ্ধ চোক্ষে ছেলের দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে বললেন,
—” মানে! এখন এতে কি সমস্যা? ”
রাদ জানে পরের বাক্যটি শুনকে ওর মা অনেক অসুন্তুষ্ট হবেন৷ উল্টো পালটা ভাববেন। দুশ্চিন্তা করবেন৷ কিন্তু এই সময় মায়ের কাছে আর একটি বাক্য মিথ্যে বলতে চায় না রাদ। অতঃপর অত্যন্ত স্বাভাবিক, সাবলীলভাবে জবাবে বলল,
—” ইরা এটাও চায় না মা! আমার বাসা থেকে ওর বাসায় বিয়ের প্রস্তাব যাক। ও যদি বলতো আমি অবশ্যই তোমাকে ওদের পাঠাতাম মা। কিন্তু ওর নিষেধ করেছে বলে এটা করতে পারছিনা। ”
রাদের পূর্বের ভাবনা সত্যি করে দিয়ে। রাদের কথা পিঠে জুহা এক মুহূর্ত না ভেবে বলল,
—” বাবা মেয়েটা তোকে ভালো বাসে তো?”
যদিও রাদ জানতো এমন কিছুই বলবে ওর মা। তবুও মায়ের সহজ স্বীকারোক্তিতে রাদ ভীষণ কষ্ট পেলো। ইরার অবহেলা গুলো মাথা চাড়া দিয়ে উঠলো। বুকে সূক্ষ্ম ব্যাথা তিরতির করে বাড়তে লাগলো। না চাইতেও নিজের মনেও প্রশ্ন জাগলো সত্যি ইরা ওকে ভালোবাসেতো? ভালোবাসলে ৬ মাসে একটা বার ওর ফোন তুলতোনা? এতো নিষ্ঠুর মেয়ে ইরা জানা ছিলো না। অতঃপর আহত হৃদয় নিয়ে আপন মনে বিরবির করলো রাদ,
—” ইরা আমাকে ভালোবাসুক আর না বাসুক মা! তোমার ছেলে ইরা ছাড়া অন্যকোনও নারীর কথা ভাবতেও পারে না। খুব ভালোবাসি নিষ্ঠুর মেয়েটা’কে। ”
চলবে!
ইন শা আল্লাহ্ নতুন পর্ব দ্রুতই আসবে!