#জলফড়িং
#Roja_islam
#part ২১ [প্রথম অংশ]
উত্তপ্ত ভোর দুপুরে রাদ ইরা’কে বাসায় পৌঁছে দিতে এলো। তবে বাসার থেকে অনেক’টা দূরে নেমে গিয়েছে ইরা। ওর চোখেমুখে এখনো রাজ্যের উৎফুল্লতা, আনন্দ। বাইক থেকে নেমে হাসি মুখে-ই রাদ’কে বিদায় জানাতে নরম গলায় বলল,
–” থ্যাংক ইউ স্যার! চিন্তিতপূর্ণ দিন’টা আনন্দ, ভালোবাসায় এভাবে বদলে দেওয়া’র জন্য। ”
প্রত্যুত্তরে রাদ সম্পূর্ণ ভিন্ন বাক্য উচ্চারণ করলো গাঢ় গলায়,
–” বিউটিফুল! ”
চকিতে ইরা অবাক গলায় শুধালো,
–” মানে? ”
–” টুডে ইউ লুকিং সো বিউটিফুল এন্ড প্রিটি, থ্যাংক ইউ ফর অল ইউর কাইন্ডনেস এন্ড লাভ। ”
ইরা চূড়ান্ত বিস্ময়কর চক্ষুদ্বয় মেলে স্থির চেয়ে রইলো রাদে’র দিকে। এ-ই কথাগুলো ওদের দেখাসাক্ষাৎ হওয়ার পর সর্বদা বলবে রাদ৷ তবে সেটা কখনো মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলে না। বাসায় গিয়ে টেক্সট করে দিবে। ইরা ওর প্রাণপুরুষের জন্য সাজবে। ওর প্রাণপুরুষ সেটা লক্ষ্য করবে না সেটা কখনো হয়নি। কিন্তু এভাবে ঘোরলাগা নেশাক্ত চোখে চেয়ে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে অনুভূতি কখনো প্রকাশ করেনি রাদ। বরাবরই নিজেকে নিয়ন্ত্রণে পটুত্ব এবং শান্ত ছেলে’টা। আজ যে কী হলো পুরোটা দিন চমকপ্রদ করে গিয়েছে ইরা’কে রাদ। হয়তো ইরা যেখাবে সর্বদা ওর প্রাণপুরুষ’কে কল্পনা করতো। সেগুলোই পরিপূর্ণ করেছে একে একে আজ। এতটা কিভাবে বুঝে ওকে রাদ? নিজেও ভেবে পায়না মেয়ে’টা। কিঞ্চিৎ লজ্জিত আড়ষ্ঠ মুখে স্মিত হাসলো ইরা। আর্দ্র গলায় বলল,
–” এমন সারপ্রাইজ আমি প্রতিদিন চাই স্যার। একদিন সারপ্রাইজ দিয়ে পাগারপার হলে কিন্তু চলবে না। ”
রাদ ঝরা হাসে। ফিচলে গলায় শুধালো,
–” এতো প্রিটি স্টুডেন্ট’র চাওয়া পাওয়া অপূর্ণ রাখা বড্ড কঠিন ম্যাডাম। ”
ইরা খিলখিল করে হাসলো রাদে’র কথা বলার ভঙ্গি দেখে। বাঁক ফিরে সম্মুখে হাঁটতে হাঁটতে হাস্যোজ্জ্বল রসিকতাপূর্ণ চঞ্চল গলায় শুধালো,
–‘ স্যার এখন বিদায় নিন। হবু শ্বশুর দেখতে পেলে খবর করে ছাড়বে। ”
রাদ কিঞ্চিৎ গলা উঁচু করে দৃঢ় গলায় আওড়াল,
–” ভয় দেখাবেন না ম্যাডাম, আজ চলে যাচ্ছি। কাল শ্বশুরবাবা যখন মেয়ে’কে আমার হাতে তুলে দিবেন তখন এ-ই রাস্তা দিয়ে-ই আপনাকে তুলে নিয়ে যাবো। ”
ইরা’র বক্ষঃস্থলে তুমুল কম্পন শুরু হলো তুলে নিয়ে যাবো বাক্যটুকু শুনে। প্রাণপুরুষ’টা হঠাৎ যেন স্বপ্নের মতো লাগামহীন হ’য়ে গেলো। লজ্জায় ইরা’র কপোল টুকটুকে লাল বর্ণ ধারণ করলো। আবার কোথাও মনে হচ্ছে সত্যি ও কাল রাদে’র সঙ্গে চলে যাবে? হঠাৎ কোথাও একটু কষ্টও হচ্ছে। ভারাক্রান্ত অস্থির হৃদয় নিয়ে ইরা বাড়ি’তে পৌঁছে গেলো। ইরা’কে বাড়ির মোড়ে ঢুকে যেতে দেখে হাস্যোজ্জ্বল মুখে রাদ বাইক স্টার্ট দিলো, এ-ই তো শুরু হলো ব্যাস্ততা। এ-ই মুহূর্ত থেকে তরী’র বিয়ে পর্যন্ত ব্যাস্ততম একটা সময় কাঁটবে ওর। লং-টার্ম জার্নি অবশ্যই স্ট্রং থাকতে হবে কেননা আমাদের পরিকল্পনা থেকে-ও বাস্তবতা ভিন্ন এবং সম্পূর্ণ আলাদা ভাবেই সম্মুখে এসে উপস্থিত হয়। অর্থাৎ সকল কিছু’র জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে অবশ্যই!
___________
ইরা মুখে বিস্তৃত হাসি নিয়ে মাত্রই ফ্রেশ হয়ে এসে বেডে বসলো। হাতের ঝকঝকে রিংটা বারবার দেখছে। যতবার দেখছে অজান্তেই ঠোঁটে ফুঁটে উঠছে মোহনীয় এবং তৃপ্তির হাসি। বক্ষঃস্থল জুড়ে তীব্র ভালোলাগা এবং শান্তি। অনুভূতিটুকু যতদিন বেঁচে থাকবে ইরা কখনো ভুলতে পারবেনা। হঠাৎ দরজায় নক পরতেই ইরা দাঁড়িয়ে গেলো। আজমল খান ওর দরজায় দাঁড়িয়ে ইরা তড়িঘড়ি গলায় শুধালো,
—” বাবা কিছু লাগবে? ”
—” তোমার সঙ্গে কিছু কথা আছে আম্মা!”
—” তাহলে এসো না ভেতরে এসো। ”
আজমল খান ভেতরে ঢুকে মেয়ে’র দিকে এক নরজ চাইলেন। ইরা কিঞ্চিৎ ভীতসন্ত্রস্ত হ’য়ে বাবা’কে বসতে দিলো এবং নিজেও মুখোমুখি বেডে বসলো। আজমল স্বাভাবিক শান্ত গলায় বলে উঠলেন,
—” রাদে’র মায়ের সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। কাল আমরা রাদে’র সঙ্গে দেখা করবো। মনে রেখো পছন্দ হলে খুব দ্রুত ওর হাতে তোমাকে তুলে দিবো আনন্দের সাথে। কিন্তু তোমার বাবা’র অপছন্দ হলে আমি কোনো রিকুয়েষ্ট রাখবো না। বরং তোমার বাবা’র পছন্দের ছেলে’র সঙ্গেই তোমার বিয়ে হবে। আর সেটা তোমাকে বাধ্য মেয়ে’র মতো মেনে নিতে হবে!”
ইরা কিয়ৎপ্রহর নিরবে কিছু ভাবলো। আজমল খান প্রশ্নবিদ্ধ চোখে ওর দিক চেয়ে ইরা ভীত গলায় শুধালো,
—” আমার তোমাকে কিছু বলার আছে বাবা!”
আজমল খান আস্বস্ত গলায় আওড়ালেন,
—” অবশ্যই বলো কী বলতে চাও।”
ইরা আমতা-আমতা করে বলল,
—” বিষয়’টা, রা..হুল আদি ভাইয়া’কে নিয়ে। ”
একপর্যায়ে কিঞ্চিৎ গম্ভীরমুখে আজমল খান বললেন,
—” খুলে বলো!”
ইরা রাহুলের ব্যাপারে সমস্তটা খুলে বলল। আজমল খান বিস্ময়ে কিংকর্তব্যবিমুঢ় ছিলেন লম্বা একটি সময়। বাড়ি’র আদরের ছোট ছেলে অন্যায় না করেও এতগুলো দিন বাড়ির বাহিরে ছিলো বিতারিত হ’য়ে। নাহ্ বিতারিত হ’য়ে না! সম্পূর্ণ নিজ ইচ্ছায়, অভিমানে বাবাদের উপর রাগ থেকে। এটা তো হওয়ার ছিলো। এবার অংক মিলছে রাহুল স্পষ্ট ভাষি ছেলে অন্যায় করলে সর্বদা ক্ষমা চেয়ে নেওয়া ওর যেন কর্তব্য ছিলো। সেখানে এত বড় অন্যায়ের পর একটি বার বাড়ি মুখি হয়নি ছেলে’টা এ-ই তাহলে এ-র কারণ। উনারাই ছেলের উপর বিশ্বাস রাখতে পারেননি। এটা যেন ভাবতে পারছেন না তিনি। আজীম খাম সন্তানের সাথে কিঞ্চিৎ তেজীয়ান, রাগান্বিত, গম্ভীর স্বভাবের হলেও আজমল খান এর সম্পূর্ণ বিপরীত নিজের সন্তানদের নিকট। উনি ছেলেমেয়েদের ভীষণ স্নেহ করেন। উপর উপর শক্ত কঠোরতা দেখালেও ভেতর ভেতর উনি ছেলেমেয়েদের উপর বেশীক্ষণ রাগান্বিত থাকতে পারেন না। রাহুলের জন্য উনি কতটা কষ্ট পেয়েছেন এতগুলো দিন এটা উনার অসুস্থতা প্রমান দেয়। অথচ সকলে ভাবে উনি সম্মানহীনতায় অসুস্থ হয়েছেন আসলে এটা মিথ্যে উনি অসুস্থ হয়েছেন এ-ই ভেবে ছেলেটা এতটা বদলে গেলো কী করে, একটিবার ক্ষমাও চাইতেও বাড়ি ফিরে এলো না। আজমল খান ও বলতে পারলেন না ছেলে’কে বাড়ি ফিরে এসো যা হওয়ার হয়েছে। লম্বা একটি দীর্ঘ শ্বাস বেরিয়ে এলো বুক চিরে। হতাশাজনক ভারী নিশ্বাস। আর এক মুহুর্ত না ভেবে উনি দৃঢ়ভাবে বললেন,
—” আদিত্য’কে বাড়ি ফিরে আসতে বলো। আমি আজকেই যাবো রাহুল’কে বাড়ি ফিরিয়ে আনতে। ইন শা আল্লাহ সকালে রাদের সঙ্গে দেখা করতে বাড়ির সকল পুরুষ যাবে। ”
ইরা কেঁদে ফেলল। এক ছুটে বাবা-র পা জড়িয়ে নিয়ে ফ্লোরে বসে পড়লো। আজমল খানের চোখেও পানি। কেউ জানলোনা। একা ঘরে বাবা মেয়ে মিলেমিশে কেঁদে হাল্কা হ’য়ে নিলো। কিয়ৎকাল পর ভয়ে ভয়ে হঠাৎ-ই ইরা সাবলীল ভাবে কিছু’টা অস্বস্তির সাথে নিজের হাতের রিংটা দেখিয়ে কম্পিত গলায় বলল,
—” এটা রাদ আজ আমাকে পড়িয়ে দিয়েছে বাবা। বলেছে এটা আমাদের এনগেজমেন্ট রিং। আমি এটা এখন তোমাকে দিয়ে দিতে চাই। যদি কাল তোমার রাদ’কে পছন্দ হ’য় আমি চাই তুমিও এমন একটা রিং ওকে পড়িয়ে দিবে। যদি অপছন্দ হয় তাহলে এ-ই রিংটা ওকে ফিরিয়ে দিবে। ”
বাক্যটুকু শেষ করে ইরা লম্বা একটা শ্বাস ফেলে আবারও বলল,
—” বাবা কাল যদি তোমার ওকে পছন্দ হয়। তাহলে রাদ তোমার কাছে এমন কিছু চাইতে পারে যেটা তোমার কাছে অসম্ভব মনে হতে পারে। কিন্তু আমি চাই তুমি ওর কথাটা রাখো প্লিজ।”
আজমল খান চোখে আস্বস্ত করলেন মেয়ে’কে মুখে বললেন,
—” তোমার পছন্দের উপর আমার ভরসা আছে আমি নিজের সর্বোচ্চ চেষ্টা করবো আম্মা তোমার খুশি সবচেয়ে উর্ধ্বে রাখার। তুমি আদিত্য’কে বাড়ি ফিরতে বলো। আমি তোমার ছোট বাবা’র সঙ্গে কথা বলে আসছি। আমি চাই কাল রাহুলও ওর বোনের জন্য ছেলে দেখতে যাবে। ”
এক মুহূর্তে জন্য বাবা-র বক্তব্য শুনে ইরা’র শ্বাসপ্রশ্বাস অস্বাভাবিক হ’য়ে এলো খুশিতে। ও বাবা-র কথায় সায় জানালো, প্রশ্বস্ত হেসে মাথা দুলালো। আজমল খান স্মিত হেসে উঠে বেরিয়ে গেলেন। ইরা শূন্য চেয়ে রইলো সব কেমন স্বপ্নের মতো হচ্ছে। ধ্যাৎ চ্যুত হতে দ্রুত আদি’কে কল লাগালো। দু’বার রিং হতে-ই রিসিভ হলো। ইরা কান্নারত গলায় আওড়ালো,
—” আদি ভাইয়া? ”
—” হ্যাঁ বলো। নিশ্চয়ই কেঁদেকেটে ন্যাকামি করে বাবা’কে সব বলে ফেলেছিস?”
ভ্রুঁদ্বয় কুঁচকে গেলো ইরা’র। মেকি গম্ভীর গলায় শুধালো,
—” আমি ন্যাকামি করিনা। ”
—” সেটা আমি জানি তুই কী করিস। ”
—” বড়বাবা আজ-ই রাহুল ভাইয়া’কে যাবে। তোমাকে এক্ষুণি বাসায় ফিরতে বলছেন বাবা। ”
কিয়ৎকাল নিস্তব্ধতার পর। আদি চিন্তিত গলায় শুধালো,
—” এখন অলরেডি দুপুর ২-টা বাজে। বল কাল সকাল সকাল বেরিয়ে যাবো আজ কোনো ভাবে সম্ভব না!”
এপর্যায়ে ইরা ভীতসন্ত্রস্ত নিরীহ গলায় শুধালো,
—” কাল বাবা রাদের সঙ্গে দেখা করতে যাবে। ডেট চেঞ্জ করা যাবে না প্লিজ। ”
ওপাশে আদি নিশ্চুপ। ইরা আবারও বলল,
—” প্লিজ আদি ভাইয়া..!”
—” এতো তাড়া বিয়ে করার? ”
—” এটা শুধু বিয়েনা ভাইয়া অনেক কিছু তুমি বুঝবে না। ”
—” আমি দোকান থেকে গাড়ি নিয়ে আসছি ওদের বেরুতে বল। ”
ইরা উচ্ছ্বসিত গলায় শুধালো,
—” আই লাভ ইউ ভাইয়া, ইউ আর দ্যাবেষ্ট। তুমি দ্রুত রাহুল ভাইয়া’র এড্রেসটা লিখে নাও আমি বলছি। ”
আদি এড্রেস লিখার অবস্থায় আর ছিলো না। আই লাভ ইউ ভাইয়া শব্দটুকু ঘূর্ণিঝড় বইয়ে দিয়ে গেলো আদি’র বক্ষঃস্থলে। অস্বাভাবিক হৃদস্পন্দনের সঙ্গে আদি ইরা’র সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করলো আচমকা। ফোন রেখে আদি নিজেকে সংযত করতে পারলো না। ওর পুরুষালী কান্নায় ভার হলো আশপাশ।
সম্মুখে বসে থাকা নাহিদ অবাক চক্ষুদ্বয় স্থির নিবদ্ধ করে রাখলো গম্ভীরমুখো সল্পভাষী আদি’র কান্নারত মুখশ্রীর উপর। তবে আদি’র মনে হচ্ছে এটাই শেষ নয় সারাজীবনের জন্য ইরা নামক মেয়েটি ওকে দূর্বল করে দিয়ে গেলো।
নাহিদ উঠে এসে আদি’র কাধে হাত রাখতেই থেমে গেলো আদি। নাহিদ বলল,
—” ঠিক আছিস ভাই? ”
আদি মাথা দুলালো। ঘন ঘন শ্বাস ফেলে নিজেকে সংযত করে প্রত্যুত্তরে বলল,
—” হ্যাঁ। আন্টি’কে একটু চা দিতে বল না। মাথাটা ধরেছে। ”
—” তুই শান্ত হ আমি এক্ষুণি চা নিয়ে আসছি৷ ”
__________
ইরা’র বাড়িতে কয়েক মুহূর্তে’র জন্য হইচই বেঁধে গেলো যখন রাহুমের ব্যাপারটা বাড়ির দুই কর্তীর কানে পৌঁছালো। ড্রইংরুমে বাড়ি’র দুই মা ইতিমধ্যে কেঁদেকেটে একাকার। একি সঙ্গে খুশিতে বিলাপ করে যাচ্ছেন। ইরা নিজের বাবা-র মুখে অন্যরকম একটা ঝলক দেখতে পারছে যেটা কিছুক্ষণ আগেও ছিলো না। মৃদু হাসলো ইরা। ওর বিশ্বাস কাল রাদ’কে দেখার পর বাবা’র মুখে পরিপূর্ণ হাসি ঝলমল করবে। ইতিমধ্যে আদি গাড়ি নিয়ে বাড়ি’র সম্মুখে চলে এসেছে। দুই ভাইও তখন টিপটপ রেডি এক্ষুণি বেরিয়ে পড়বে। ইরা হাত থেকে আংটিটা খুলে বড় বাবা’র হাতে তুলে দিলো। আজমল খান ইরা’র মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে সবার থেকে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে গেলো বাড়ি’র ছোট ছেলে ছেলে’র বৌ’কে ফিরিয়ে আনতে। ইরা মনে মনে আরেকটু হাসলো আদি’কে হয়তো একবার বলেছিলো তবে বাসার কেউ জানেনা। ওর ভাই দুই সাপ্তাহ হলো বাবা হ’য়ে গিয়েছে। ইশ যখন গিয়ে দুইভাই দেখবে ওরা দাদা হ’য়ে গিয়েছে কী খুশি হবেন। ওদের সারপ্রাইজ দিতেই মূলত ইরা এটুকু লুকিয়ে গিয়েছে।
ইরা মিটমিটিয়ে হাসলো। পাশ ফিরে দেখলো নীলা বেগম ওর দিক ভ্রু কুঁচকে চেয়ে ইরা থতমত খেয়ে দৌড়ে ঘরে চলে গেলো। মা মেয়ে’র এহেন কাণ্ডে মীতি হাসতে হাসতে শেষ। বড় মা এ-র কিছু-ই বুঝলেন না তিনি চোখে পানি মুখে অবাকতা নিয়ে ফ্যাল ফ্যাল চেয়ে রইলেন।
ইরা রুমে এসে বসতেই খালি আঙুল’টা দেখে মন খারাপ হ’য়ে গেলো। মনে পরে গেলো রাদের নিষেধাজ্ঞা। ও মানা করে দিয়েছিলো আংটিটা কখনো খুলতে। অথচ আজ পরিয়ে দিয়েছে আজকেই ইরা আংটিটা খুলে ফেলেছে। রাদ’কে এ-ই কথা ভুলেও বলা যাবেনা। ইরা আবারও ওর কথা রাখেনি। ওর বিশ্বাস কাল সব ঠিক হয়ে যাবে। মন ভালো করতে ইরা ঘুরেফিরে রাদ’কে ফোন দিলো। রিং হয়ে কেঁটে গেলো রিসিভ হলো না। হতাশার একটা নিশ্বাস নির্গত হতেই আচমকা ফোনের রিংটোন বেজে উঠলো। রাদ কল ব্যাক করেছে। ইরা ফোন রিসিভ করতেই শুনতে পেলো প্রাণপুরুষের ব্যাস্ত, ক্লান্ত পুরুষালি ভরাট গলা,
—” হ্যালো, কী করছো? আমি তোমার জন্য শপিংয়ে ব্যাস্ত। সাথে আম্মু কাশিশ। ওরা আমাকে জাস্ট পাগল করে দিচ্ছে। তোমাকে আমাকে কিনে দেওয়া বদলে আমার পকেট ফাঁকা করে নিজেরা শপিং করে নিচ্ছে ভীষণ অন্যায় হচ্ছে আমার সাথে। ”
রাদ এক নিশ্বাসে অভিযোগ শেষ করে দিলো। ইরা খিলখিল করে হেসে উঠলো। রাদ’কে ভীষণ প্রফুল্ল এবং সজীব লাগছে। ও আজ কতটা খুশী সেটা হয়তো ওর কথা বলার ভঙ্গি কিংবা ওর সুদর্শন তৃপ্ত মুখশ্রী’টা দেখে যে কেউ ব’লে দিতে পারবে ইরা’র বিশ্বাস। কিন্তু এতটা খুশি কপালে সইবে তো৷ কাল সব উলোটপালোট হ’য়ে যাবে না তো? হঠাৎ এহেন ভাবনায় ঘাবড়ে গেলো ইরা খানিকটা ভীত গলায় শুধালো,
—” রাদ? ”
রাদ ইরা’র এহেন কণ্ঠে ঠিক টের পেলো প্রেয়সীর বক্ষঃস্থলের উদ্বিগ্নতা, ভয়। আশ্বস্ত, নরম গলায় বলল,
—” তোমার আমার উপর বিশ্বাস আছে তো ইরানী? ”
ইরা এক মুহূর্ত না ভেবে প্রত্যুত্তরে বলল,
—” নিজের থেকেও বেশী! ”
রাদে’র গলায় প্রবল আত্মবিশ্বাস,
—” তাহলে নিশ্চিন্তে থাকো, আমি আমার সবটুকু দিয়ে, সব ঠিক করে দিবো। ”
একমুহূর্তের জন্য কথা গুলো এতো স্বস্তি এনে দিলো ইরা’র মনকুঠুরিতে যে ও আবেগপ্রবণ মোলায়েম গলায় আনমনে আওড়ালো,
—” ভালোবাসি! ”
এপর্যায়ে রাদ কিঞ্চিৎ বিচলিত গলায় আওড়ালো,
—” ইয়ে মানে, আই এম ইন পাবলিক প্লেস সো ট্রাই টু আন্ডারস্ট্যান্ড। ”
ইরা দুষ্টু হাসলো। কঠোর বিরোধিতা করে বলল,
—” নোপ! এক্ষুণি উত্তর দাও। বলো ভালোবাসি ইরানী। ”
—” ইরা! ”
—” বলতেই হবে! ”
চক্ষুদ্বয় বুজে রাদ স্বাভাবিক ভাবেই বলল,
—” ভীষণ ভালোবাসি ইরা, তুমি আমার প্রশান্তি। কখনো আমার হাত ছেড়ে দিও না। ”
স্থির হয়ে রইলো ইরা। মনে পড়ে গেলো বাবাকে দেওয়া কথা। পরপর মনে পড়লো রাদে’র আশ্বাস। একটু থেমে ইরা প্রত্যুত্তরে বলল,
—” দিবো না। কখনো না। ”
ফোন রেখে ইরা স্তব্ধীভূত হ’য়ে গেলো। ওর দ্বারা ভুল হয়ে গিয়েছে সবাইকে মানিয়ে বিয়ে করার চেষ্টায় শেষে না সবাই’কে দ্বিগুণ কষ্ট দিতে হয়। বাবা’কে কথা দেওয়া একদম উচিৎ হয়নি ওর৷ তবে যা হওয়ার হয়ে গিয়েছে। এখন শুধু নিজের জন্য পার্থনা করতে পারে ইরা। আর কিছু নয়। মাথা চেপে ধপ করে বেডে শুয়ে পড়লো ও।
______________
রাদ ফোন রেখে স্মিথ হাসলো। ওরা ইরা’র জন্য বিয়ের শপিং করতে এসেছে। যদিও রাদ ঢাকা থেকে সব শপিং করেছিলো ইরা’র জন্য। কিন্তু জুহা মানতে নারাজ। উনি পুত্রবধূর জন্য নিজে পছন্দ করে শপিং করতে চান ফলাফল পুনরায় শপিংয়ে বেরিয়েছে ওরা। শাড়ী’র দোকান বসে শাড়ি চুজ করছিলো তিনজন। রাদ ইরা’র ফোন পেয়ে দূরে গিয়ে কথা বলছিলো বোকা মেয়ে’টা সেটা টের পায়নি হয়তো আশেপাশে ক্রাউড একটু বেশি বলে। রাদ পুনরায় দোকানের দিকে এগিয়ে গিয়ে দেখলো। কাশিশ এবং জুহা দু’জনে মধ্যে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই চলছে রীতিমতো মতো। কাশিশ চুজ করেছে টকটকে লাল লেহেঙ্গা এবং জুহা চুজ করেছে টকটকে লাল শাড়ি। দু’জনের তেজী চোখ ওর উপর পড়তেই দু’জন চেপে ধরলো ওকে। জুহা আবেগ অনুভূতি মিশিয়ে বলে উঠলেন,
—” তুই বল বাবা। শাড়িটা বেশি সুন্দর না? ”
কাশিশ ও থেমে নে-ই জোর গলায় বলল,
—” হ্যাঁ হ্যাঁ রাদ তুই বলো। শাড়িটা ওল্ড ফ্যাশন। লেহেঙ্গা’টা জোস না? ইরা’কে জোস লাগবে। ইনফেক্ট মেয়েরা এখন ট্রেন্ডি লেহেঙ্গা পছন্দ করে। ”
জুহা ক্ষেপে গেলো,
—” এ-ই তুই কী ইনডিরেক্টলি আমাকে ওল্ড ফ্যাশন বললি?”
কাশিশ হেসে বলল,
—” ইনডিরেক্টলি বলবো কেন। আমি ডিরেক্টলি বলছি শাড়িটা ওল্ড ফ্যাশন। ”
—” গুরুজন’কে সম্মান দিয়ে কথা বল। রাদ তুই বল না বাবা শাড়িটা বেশি সুন্দর না? ”
কাশিশ ও অধীর আগ্রহ নিয়ে চেয়ে বন্ধুর পানে। রাদ পড়েছে বিপদে দুই জেনারেশনের মধ্যে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই। যেটাই চুজ করুক একটা বাঁশ ওকে খেতেই হবে নিশ্চিত। দোকান দার রাদে’র দিক চেয়ে হাসছে৷ হয়তো ওর অবস্থা টের পেয়েছিলো। রাদ নিজেও বোকার মতো একটু হাসলো। তবে বরাবরই রাদ বিচক্ষণ, ও বুদ্ধিমান ফলাফল ও এমন একটা ভাণ করলো যে শাড়ি এবং লেহেঙ্গা’টা দুটোই মনোযোগ দিয়ে দেখছে অতঃপর একটু হেসে স্বাভাবিক গলায় বলল,
—” দুটোই আমার ভীষণ পছন্দ হয়েছে। শাড়ি’টা নাহয় ইরা কাল পড়বে। আর লেহেঙ্গা’টা তরী’র বিয়েতে। ওর বিয়ের থীম তো লেহেঙ্গা। এ-ই লেহেঙ্গা’টা তরীর বিয়ের দিন পড়ার জন্য পার্ফেক্ট। আমাদের এ-ই দুটোই প্যাক করে দিন প্লিজ। ”
জুহা কাশিশ দু’জনেই একটা যুদ্ধজয়ের হাসি দিলো। রাদ হাফ ছেড়ে বাঁচলো। মা বন্ধু’কে দেখলে রাদের কখনো কখনো মনে হয় ওরা ছোট বেলায় হারিয়ে যাওয়া দুইবন্ধু একে অপরের পিছনে লেগে থাকবে। আবার একে অপর’কে ছাড়া চলবেও না।
সম্পূর্ণ শপিংয়ে ওরা এভাবেই যুদ্ধে নিযুক্ত ছিলো কিছু-ই রাদ পছন্দ করে কিনতে পারেনি দু’জনে লড়াই করে নিজেদের পছন্দ অনুযায়ী কিনেছে। রাদ শুধু পেমেন্ট করেছে, কখনো বা শাড়ির মতো ডাবল পেমেন্ট করতে হয়েছে। কিছু বলতেও পারেনি বেচারা। ভাগ্যিস রাদ নিজে আগেই পছন্দ করে ইরা’র জন্য কিছু শপিং করেছিলো নাহলে আফসোস হতো বৌয়ের জন্য নিজে কিছু কিনতে পারলো না। তবে আজকের শপিং গুলোর মধ্যে যে-ই আবেগ, ভালোবাসা, স্নেহ মিশে আছে সেটা রাদ ইরা কোথায় বা খুঁজে পেতো? এ-ই ভালোবাসা গুলো-ই তো থেকে যাবে চিরকাল। মানুষের অস্তিত্ব যে শুধু কয়েক মুহূর্তে’র মধ্যে বিলিন হ’য়ে যায়।
______________
রাজশাহী টু ঢাকা রোড। গাড়ি চলছে আপন গতিতে আদি চোয়ালদ্বয় শক্ত করে ক্রমশ দ্রুত গতিতে ড্রাইভ করে যাচ্ছে। শা শা করে অসংখ্য গাড়ি ক্রসিং করে যাচ্ছে। আজমল খান দীর্ঘশ্বাস ফেলে ছেলে’র দিক চাইলেন। আদি’র চোখে স্পষ্ট হতাশার ছাপ, নির্ঘুম রাতে’র সাক্ষী চোকের নিচে কালো দাগ। ঘাড় ঘুরিয়ে ছোট ভাইয়ের দিকে চাইলেন উনি। আজীম খান সীটে মাথা ফেলে ভাত ঘুমিয়ে দিয়েছেন। মোক্ষম সুযোগ পেয়ে গলা পরিষ্কার করে হঠাৎ ছেলে’র উদ্দেশ্যে গম্ভীর গলায় বলে উঠলেন,
—” সেদিন ইরা’র গায়ে হাত উঠিয়ে ভুল করেছো তুমি। আশাকরি ইরা’র বিয়েতে ঝামেলা করা’র বিন্দুমাত্র চেষ্টা করবেনা তুমি। তোমার মনের অবস্থা আমি বুঝি। তা-ই বলে নিজের ব্যাক্তিত্ব নিচু করে ফেলবেনা আশাকরি। কাল রাদ’কে দেখতে তুমিও যাবে আমাদের সাথে অবশ্যই ইরা’র ভাই হিসেবে। ”
আদি দাঁতে দাঁত নিষ্পেষণ করে দ্রুত মাথা ঘুরিয়ে জানালা দিয়ে বাহিরে চাইলো। চক্ষুদ্বয় বন্ধ করে নিজেকে ধাতস্থ করতে ব্যাস্ত হলো। ওর অস্থিরতা দেখে আজমল খান পুনরায় ওকে সাবধান করলেন,
—” নিজেকে সামলাও আদি। রাদ সম্পর্কে এখনো জানা, দেখা বাকি আমাদের। মনে রেখো দেখলে-ই বিয়ে হ’য়ে যায় না। ইরা কথা দিয়েছে আমাকে আমাদের রাদ’কে পছন্দ না হলে। ও আমাদের পছন্দেই বিয়ে করবে। এবং আমাদের পছন্দ’টা অবশ্যই তুমি। ”
আদিত্য বিস্ফোরিত চোখে বাবা-র দিক চাইলো। আজমল খান উনার শান্ত চক্ষুদ্বয় দ্বারা ছেলে’কে আশ্বস্ত করলেন। অস্বাভাবিক ভাবে আদি সম্পূর্ণ শান্ত হ’য়ে গেলো। বাবা-র কথার উপর ওর বিশ্বাস রাখতে হবে।
চলবে!
Roja Islam