জলফরিং পর্ব ১৭

0
533

#জলফড়িং
#Roja_islam
#part ১৭

রাহুল অকপটে স্বগতোক্তি করে,

—” হ্যাঁ, আমি বিয়ে করেছি সে-ই মেয়ে’কে। আমি কোনো অন্যায় করিনি ইরা। এ-ই পৃথিবীতে সকলের ভালো থাকার রাইট আছে। আমি শুধু সে-ই মেয়েটা’কে একটা উপায় করে দিয়েছি ভালো থাকার। ”

আতঙ্কিত ইরা’র হৃদপিণ্ডটা ধড়াস করে উঠে। কী বলছে কী এসব ওর ভাই। ভীতসন্ত্রস্ত নিরীহ গলায় ইরা বলে,

—” ভাইয়া প্লিজ খুলে বলো না। আমি জানি তুমি অন্যায় কিছু করোনি? কে সে-ই মেয়ে আর ঐ মেয়ের হাসবেন্ড..? সত্যি মেয়ে’টা বিবাহিত? ”

–” হ্যাঁ মেয়ে’টা বিবাহিত, তবে ওটা ওর পাস্ট। মেয়ে’টা মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে ইরা। ওর একটা ছোট ভাই মা-বাবা। এ-ই নিয়েই ওদের ছোট্ট পরিবার। তেমন আত্মীয় স্বজন নেই। গরীব বাবা নিজে পছন্দ করে-ই ঐ জানোয়ারের সঙ্গে বিয়ে দেয় মেয়েটার স্কুল শেষে। মেয়েটার ভাগ্য খারাপ ছিলো। অল্প বয়সে বিয়ে, খারাপ স্বামী শুধু তা-ই নয়। ঐ জানোয়ারের মতো, ঐ অমানুষ’টার পরিবারও বাজে ছিলো। সহজ সরল মেয়েটার উপর ক্রমাগত নির্যাতন করে ওরা বিয়ের পরদিন থেকে। পরিবার’কে প্রথমে মেয়েটা সব জানালে বাবা-মা ওকে সব অশান্তি সহ্য করেই সংসার করতে বলেন। ডিভোর্সি মেয়েদের সমাজে চলতে কষ্ট এ-ই সে-ই বুঝান। সরম মেয়ে’টা মেনে নেয়, হাজার কষ্টের মধ্যেও মা-বাবা’কে আর কিছু জানায়নি। মেয়ে’র নিরবতায় অমানুষ এবং ঐ অমানুষটার পরিবার মেয়েটার উপর নির্যাতন আরও বাড়িয়ে দেয়। ”

নয়ন জোড়া বৃহৎ করে ইরা অবিশ্বাস্য গলায় শুধালো,

–” কী বলছো! এমন পরিবারও হয়? তারপর কী করে মেয়ে’টা ঐ পরিবার থেকে বেরিয়ে এলো? ”

মেসের ছোট বিছানায় গা এলিয়ে চুল টেনে ধরে রাহুল দীর্ঘশ্বাস ফেলে। ম্লান গলায় বলে,

–” এভাবেই চলছিলো ওর জীবন। কিন্তু হঠাৎ মেয়ে’টার উপর একদিন নির্যাতনের মাত্রা এতটাই জঘন্যতম ছিলো যে মেয়েটাকে হসপিটালাইজড হতে হয়। ঐ জানোয়ার আবার গর্বের সঙ্গে সে-ই খবর মেয়ের বাবাকে জানান। হসপিটালে ছুটে আসে মেয়ের পরিবার। মেয়ে’র মুমূর্ষু অবস্থা দেখে মধ্যবিত্ত বাবা-মা আর চুপ থাকতে পারেননি। মেয়ে’টাকে নিজেদের সঙ্গে নিয়ে আসেন হসপিটাল থেকে। মেয়ে’টা তখন প্রচণ্ড অসুস্থ ছিলো অনেক টাকা খরচ করে মেয়ে’কে সুস্থ করেন উনারা। স্বামী’র তখন মেয়েটা’কে দেখতেও আসেনি। যখন মেয়ে’টা সুস্থ হলো ৩-মাস পর মেয়েটাকে মেয়ের হাসবেন্ড নিতে এলো। রাগে মেয়ের বাবা-মা সাফ জানিয়ে দিলো ঐ অমানুষ’কে উনার মেয়ে ডিভোর্স চায়। এতে ঐ জানোয়ার রেগে যায়, হাঙ্গামা করেন। মেয়ের বাবা’র গায়ে হাত তুলেন। মেয়ের বাবা বুঝতে পারে এতদিন উনার সরল মেয়ে কী কী সহ্য করেছে। উনি পরদিনই ডিভোর্সের ব্যাবস্থা করেন। যথারীতি এ-ই কাজের নোটিস ঐ জানোয়ারের কাছে পৌঁছাতে-ই। অমানুষ’টা আবারও মেয়ের বাড়ি এসে হাঙ্গামা করে। ”

কিঞ্চিৎ থেমে রাহুল মৃদু শ্বাস নিলো। ইরা প্রচণ্ড উৎসুকভাব প্রশ্ন করে,

–” তারপর কী হলো ভাইয়া? ”

–” সেদিন হাঙ্গামা করতে এলে মানুষ জড়ো হয়ে যায়। লোকটা মেয়ের বাবা’কে অপমান করতে চায় সকলের সামনে। মেয়ের সমন্ধ্যেও উল্টাপাল্টা রটায় যা সব ছিলো মিথ্যে। তখন ওর ছোট ভাই বুদ্ধি করে, ছেলেটা ক্লাস এইটে পড়ে। ও যানতো আমি সবার হেল্প করি এলাকায় ও সেদিন দৌড়ে এসে আমাকে সব যানায়। কেঁদে কেঁদে সব খুলে বলে। সব শুনে রাগ উঠে যায় জানিস। শাহিন, আলভি’কে নিয়ে আমি তৎক্ষনাৎ ঐ ছেলেটার সঙ্গে ঘটনাস্থলে পৌঁছে দেখি। ঐ লোকটা মেয়ে’র বাবার সামনে মেয়েটা’কে টেনে হিঁচড়ে বাড়ি থেকে নিয়ে যেতে চাইছে। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এলাকার মানুষ সে-ই তামাশা দেখছে। মিথ্যে বলবো না। ছেলেটার বোন’কে দেখে আমি থমকে যা-ই। ঠিক তোদের বয়সী একটা মেয়ে। গায়ের রঙটা শ্যামবর্ণের। চেহারায় কেমন বোকাসোকা লাগে। শুকনো পাটকাঠির শরীর। কী পরিমাণে মেয়েটাকে হেনেস্তা করা হতো মিষ্টিমুখে তখনও যেন স্পষ্ট ছিলো। আতঙ্কে মেয়ে’টা বাবা বাবা বলে কাঁদছে। কখনো ঐ জানোয়ারের কাছে ক্ষমা চাইছিলো অনুরোধ করছিলো ওকে ছেড়ে দিতে। ও বুঝেনি এ-ই সব জানোয়ারের কাছে ক্ষমা নয়। অনুরোধ নয়। অগ্নিদৃষ্টিতে তাকাতে হয়। জুতোপেটা করে নিজের স্থান বুঝাতে হয়। অথচ ঘটনা ঘটছিলো সম্পূর্ণ ভিন্ন। রাগে আমাদের তিনজনেরই মাথা দপদপিয়ে উঠে এরপর নিজেদের কন্ট্রোল করা মুশকিল ছিলো ছেলেটা’কে কঠিন ধোলাই দেই তিন জন মিলে। এরপর শুনেছি আহত অবস্থায় বিছানায় ছিলো। ঐদিনের শোধ তুলতে আজ ৫-মাস পর বিছানা থেকে উঠেই হয়তো চলে এসেছে আমাদের স্বাভাবিক জীবন অস্বাভাবিক করে দিতে। ওদের এলাকায় রটিয়েছে আমার সঙ্গে পরকীয়া করে বলেই নাকি লোকটাকে ডিভোর্স দিয়েছে ঐ নিরিহ মেয়ে’টা। এবং আমাদের বাড়ি এসে আবারও হাঙ্গামা করেছে যেটা লোকটার পুরনো অভ্যাস। এসবে আমার কোনো আফসোস নেই ইরা। কিন্তু আমার বাবা ভাই কী করলো ভুল বুঝলো আমাকে। ” এপর্যায়ে রাহুলের গলা ধরে আসে। জোড়ালো গলায় স্থিরচিত্তে বলে যায় ছেলেটা, ” যেখানে আমার পরিবার আমাকে বিশ্বাস করেনি। মানুষ কিভাবে বিশ্বাস করবে ইরা। কিভাবে বিশ্বাস করবে আমার এবং ঐ মেয়ের মধ্যে আদৌ কোনো সম্পর্ক ছিলো না। তাছাড়া আমি ছেলে মানুষ হয়তো এসব কথায় কিংবা নিজ পরিবার থেকে বিতাড়িত হলেও আমার কিচ্ছু হবে না। কিন্তু ঐমেয়েটার জীবনে দু’টো কলঙ্ক লেগে যেতো। ঐ মেয়েটারো নিশ্চিত ভালো থাকার সুখে থাকার রাইট আছে! তা-ই আমি ওকে বিয়ে করে নিয়েছি। আমি মনে করিনা আমি ভুল কিছু করেছি। কিছু না করেও যখন দোষী সাব্যস্ত হলাম। তখন কাউকে নতুন জীবন উপহার দিয়ে সারাজীবন কিছু মানুষের মুখে দোষী থেকে যাবো সেটা-ই ভালো। অন্তত কারো তো ভালো থাকা হলো। আচ্ছা, আমি কী সত্যি কিছু ভুল করেছি বোন? ”

হাস্যোজ্জ্বল, রসিকতাপূর্ণ চঞ্চল ভাইয়ের জমে যাওয়া গলা জীবনের প্রথম শুনে নেত্রদ্বয় মুদে নৈশব্দ্যে কেঁদে উঠলো ইরা। পাছে কেউ কান্নাকাটি আওয়াজ শুনে না ফেলে সে-ই ভয়ে। ভাইয়ের এহেন প্রশ্নে শ্রবণেন্দ্রিয়ে ধাক্কা দিতেই ক্রন্দনরত, ক্ষীণ আওয়াজে বলে,

–” তুমি কোনো ভুল করোনি ভাইয়া। শুধু আমি হয়তো আমার ভাইয়া’কে হারিয়ে ফেললাম? ”

পুরুষ জাত হলে-ও রাহুল সেদিন বোনের সঙ্গে ভার হৃদয়ের অভিযোগ, অভিমান শূন্য করতে নৈশব্দ্যে কাঁদে। দু’পাশে-ই কিয়ৎকাল নিরব প্রহর অতিবাহিত হয়৷ সময় নিয়ে নিজেকে ধাতস্থ করে রাহুন দৃঢ় গলায় শুধায়,

–” ধূর বোকা। আমরা হয়তো এক ছাঁদের নিচে আর কখনো থাকতে পারবো না। তবুও আমাদের ভালোবাসা চিরদিন একরকম থাকবে। তুই আমাকে রোজ ফোনদিবি আমি অবশ্যই তোর সাথে রোজ কথা বলতে চাই। নাহলে আমি থাকতে পারবো নারে ইরা। ”

শ্যাম মুখশ্রী জুড়ে পড়েছে লালিত আস্তরণ। নাকমুখ ফুলিয়ে রূদ্ধশ্বাসে ইরা শব্দ করে কেঁদে উঠে মুখ চেপে ধরে। ভাই-বোন টান পূর্বের মতো সতেজতা ভরা হলে-ও। ওরা দু-জনে বুঝতে পারছিলো দূরত্ব তৈরী হয়েছে নিজেদের মধ্যে। আগের মতো কিচ্ছুটি আর নেই। চাপাশব্দে কান্নায় ইরা’র শ্বাসপ্রশ্বাস অস্বাভাবিক ভাবে বৃদ্ধি পায়। অস্বাভাবিক ভাবে উঠানামা করছিলো বক্ষঃস্থল। তৎপরে শুধায়,

–” ভাইয়া তুই কী আর কখনো বাড়ি ফিরবি না এভাবে কেন বলছিস। প্লিজ চলে আয় সবাইকে সত্যিটা খুলে বল, দেখবি আমার মতো সবাই বুঝবে। ”

গম্ভীরমুখে রাহুল আওড়ায়,

–” না ইরা। এতটুকু বয়সে কেউ আমাকে এভাবে অপমান করতে পারেনি। আজ নিজের বাপ ভাইরা আমাকে চরমভাবে অপমান করেছে। এ-ই অপমান আমি কখনো ভুলতে পারবো না। ভুলতে চাইও না। আমি ওদের বুঝাতেও চাইনা। যে আমি নির্দোষ। ওদের আমাকে নিয়ে যা ধারণা সেটাই বেরিয়ে এসেছে এ-ই ঘটনায়। আর যাদের আমাকে নিয়ে এমন নিচু ধারণা আমি তাদের সঙ্গে একি ছাঁদের নিচে থাকতে চাইনা। তুই কাউ’কে আমার সম্পর্কে যানাবি না। আমি ঢাকা চলে এসেছি এখানেই জব ম্যানেজ করবো, নিজের একটা ঠিকানা বানাবো যেখান থেকে আমাকে কেউ বের করে দিতে পারবেনা। তারপর তোর ভাবী’কে নিয়ে আসবো আমার কাছে। আপাতত বব্ধুর সাথে মেসে আছি ভালো আছি । আমি রোজ তোর সঙ্গে কথা বলবো। কিন্তু তুই কাউ’কে এসব যানাবি না। ঠিক আছে? ”

দীর্ঘলম্বা একটি শ্বাস ফেলে ইরা চুক্ষুদ্বয় মুছে নেয়। মাথা দুলিয়ে সায় জানায় ভাইয়ের কথায়। অতঃপর নাক টেনে ম্লান গলায় বলে,

–” ঠিক আছে আমার মনে থাকবে, কাউকে জানাবো না কিছু। কিন্তু তুমি সব বললে শুধু আমার ভাবীর নাম ছাড়া। তখন থেকে মেয়ে মেয়ে করছো ”

পরিবারের জন্য বেলামাল বক্ষঃস্থল সামলাতে ব্যাস্ত থাকা রাহুল মৃদু হেসে ফেললো এহেন কথায়। স্মিত হেসে নরম গলায় বলল,

–” ওর নাম আদর! ”

নাম শুনেই কেমন আদর আদর পেলো ইরা’র। দীর্ঘপ্রহর পর ঠোঁটের কোণে ফুঁটে উঠলো স্মিত প্রশান্তির হাসি। মৃদু উচ্ছ্বাস মিশ্রিত গলায় বলল,

–” শোনো ভাবী’কে ঢাকা নিয়ে যাওয়ার পর দুজন ছবি তুলে আমাকে কাপল পিক দিবে। আমি দোয়া করি ভাইয়া। তুমি এবং ভাবী অনেক ভালো থাকো।”

জ্বলজ্বলে নেত্রদ্বয় বুজে রাহুল পুনরায় মোলায়েম হাসলো। ভেসে উঠলো অক্ষিপটে আদরের বোকা বোকা সরল আদুরে মুখটা। মেয়ে’টা অনেক সহ্য করেছে। রাহুল মেয়েটার সঙ্গে নিজের জীবনটাও নতুন করে শুরু করবে। এক ভিন্ন পরিবেশে, ভিন্ন শহরে সম্পূর্ণ নতুনভাবে। পুরনো কোনো আঘাতের তীর সিমান্তে ওরা রইবেনা।

ভাই-বোনের কথোপকথন শেষ ইরা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল ও ভেবেছিলো ওর ভাই সত্যি কোনো অঘটন ঘটিয়েছে আদৌ? যদি-ও বিশ্বাস ছিলো রাহুল এমন কিছু কখনো করতে পারেনা। এবং সব শুনে ভাইয়ের উপর ভালোবাসা বেড়ে গেলো যেন।

কিন্তু বাড়ির পরিস্থিতি অস্বাভাবিক থমথমে। যেন রাজ্যের নিশ্চুপতা ওদের বাড়িতেই নেমে এসেছে। ইরা সেদিকে আর পাত্তা দিলো না। যদি-ও বাড়ির ছোট বড় সকলের মুখশ্রীর রঙ বিষণ্ণতায় ভরা।
_______

বছরের শুরুর মাসগুলোতে কিছু জায়গায় পূর্বকালের রীতিনীতি অনুযায়ী বড়সড় করে মেলার আয়োজন হয়। ইরাদের বাড়িতে প্রতিবছর সকলে মিলে এসব মেলায় ঘুরাঘুরি করতে ব্যাস্ত থাকে। কিংবা দূরে কোথাও ট্যুরও দেওয়া হয়৷ তবে এবারের পরিবেশ ভারী ভিন্ন। মা-চাচী, কর্তাদের থমথমে দাম্ভিক গম্ভীর মুখশ্রীতে তাকিয়ে এসব কল্পনাতেও চাওয়া যেন পাপ। কেটে গিয়েছে মাঝে আরও কিছু দিন।

ইরা রাদ’কে চিন্তা-চেতনা থেকে দূরে থাকার আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছে। ফলাফল খুব একটা পাওয়া যায় না আসলে। রাদে’র আইডিতে নিরবে ঘুরঘুর করা নিত্যদিনের ঘটনা। কিংবা আইডির পাশে সবুজ রঙের ঐ গোল বৃত্তের দিক চেয়ে নয়ন জোড়া ঘোলাটে করে ফেলা একটা জঘন্য অভ্যাস। রাদ সে-ই ঘটনার পর কয়েকদিন মেসেজ দিলেও পড়ে আর মেসেজ দেয়নি। ইরা যানে হয়তো আর কখনো রাদে’র ফোন থেকে ওর কাছে কখনো মেসেজ আসবে না। নিজেকে শক্ত করার পূর্ণ চেষ্টা করে ইরা ঘোলাটে নয়নে।

দু’দিন পর ইরা’র এক্সাম এ-র জন্য বড়বাবা’র সঙ্গে আজ ডিনারে কথা বলবে বলে ভেবেছে ইরা। পরিকল্পনা অনুযায়ী ডিনারে যখন সকলে নৈশব্দ্যে নৈশভোজে ব্যাস্ত। তখন গলা পরিষ্কার করে ইরা নম্র গলায় আওড়ায়,

–” বড় বাবা? ”

আজমল খান মেয়ে’র উপর এক নজর চেয়ে। গম্ভীরমুখে জবাবে বললেন,

–” আম্মা কী বলবে? বলো শুনি। ”

ইরা ভীতসন্ত্রস্ত নিরীহ গলায় শুধালো,

–” আমার পরশু এক্সাম। ঢাকা যাওয়ার ব্যাবস্থা..! ”

বাক্য সম্পূর্ণ করার পূর্বে-ই নিরবে খেতে ব্যাস্ত আদি চোয়ালের পেশীগুলো শক্ত করে গর্জে উঠে,

–” কোনো প্রয়োজন নেই ঢাকা গিয়ে এক্সাম দেওয়ার। কখন আবার ভাইয়ের মতো অঘটন ঘটাস। আমি এখানেই ভালো কলেজে তোর ভর্তির ব্যাবস্থা করছি। ”

আদি’র এহেন রূপ এবং কথায় ইরা স্তব্ধীভূত। স্পষ্ট মনে হলো আদি রাহুল এবং ওকে ছোট করছে। রাহুল আদি ভাই কম দুই বন্ধুর মতো এক সঙ্গে বড় হয়েছে। আদি চাইলেই সম্পূর্ণ সত্যি ঘটনা উদঘাটন করতে সক্ষম ছিলো। আজমল, আজিম দুভাইকে সত্যিটা খুলে বলতে পারতো। কিন্তু সে এমন কিছু করেনি। যেটা করেছে সেটা অপমান, সুযোগের সদ্ব্যবহার। এবং আজ ইরা’কেও যেনেবুঝে অপমান করছে ওর আকাশ ছোঁয়া স্বপ্ন ভেঙ্গে গুড়িয়ে দিচ্ছে। ইরা’র সম্মুখে যেন স্পষ্ট আদি ইচ্ছে করে জেনে-বুঝে এরকম করছে।

ইরা’র নয়ন জোড়া জলে টইটম্বুর। পাতলা অধরপল্লব তীব্রভাবে কম্পিত হচ্ছে। হৃদয় জুড়ে চলছে আন্দোলন। আদি’র এহেন গর্জনের পড়েও ডাইনিং জুড়ে ঘন নিস্তব্ধতায়। কারো মুখে কিঞ্চিৎ প্রতিবাদ নেই। যেন এটাই স্বাভাবিক। পুনরায় স্তব্ধ হলো ইরা। ঘাড় ঘুরিয়ে নিজের মা-বাবা’র শান্তমূর্তি এক নজর স্থির চেয়ে দেখলো। নীল অম্বল যেন ওর মস্তকে খণ্ডিত হলো। মীতি, আজমল খান ছাড়া সবাই স্বাভাবিক ভাবে খেতে ব্যাস্ত। ইরা আজমল খানের মুখশ্রীতে এক নজর গাঢ় দৃষ্টি ফেলে উঠে দৌড়ে নিজের রুমে এসে দরজা দিলো। ওর কান্না, চিৎকার সবাই ডাইনিং এ বসে শুনলেও প্রতিক্রিয়া দেখালো না। শুধু আজমল খান দীর্ঘশ্বাস ফেলে ডাইনিং ত্যাগ করলেন।

বলা যায় এ-ই ঘটনার পর থেকেই ইরা জেদি, অস্বাভাবিক, ঘাড়ত্যাড়া প্রকৃতির হ’য়ে যায়। আদি হয়ে উঠে ওর চোখের বিষ। যে-ই মানুষ’টা ওর স্বপ্ন ধূলিসাৎ করে দিয়েছে। যদি-ও মুখে বলা হয়নি কিন্তু মন থেকে ইরা আদি’কে ক্ষমা করতে পারেনি। এ-র পর দু’দিন ইরা ছিলো সম্পূর্ণ অস্বাভাবিক। রাহুল ফোনে যথাসম্ভব বোন’কে সান্ত্বনা দিয়ে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করে ফলাফল শূন্য ছিলো বটে।

দু’দিন পর যখন হাজারো স্টুডেন্ট নতুন স্বপ্নের সঙ্গে এক্সাম হলে বসে স্বপ্ন পূর্ণ করতে যুদ্ধ করে যাচ্ছে। সেসময় ইরা বন্ধ রুমে হৃদয় ভাঙা, স্বপ্ন ভাঙা এক অসহায় মানুষ। যে ক্ষণে ক্ষণে রুদ্ধশ্বাসে কেঁদে পরিবেশ ভারী করতে ব্যাস্ত। বাড়ির সকলে ডাকলেও ইরা দরজা খুলে না। শুধু হৃদয় ভাঙা কান্নার শব্দ ভেসে আসে দরজার ভিতর হতে। যদি-ও ওর মা-বাবা আদি, বড় বাবা খুব একটা ডাকেনি ওকে। শুধু মীতি, এবং বড়মা বারবার ওকে সান্ত্বনামূলক বাণী দিচ্ছিলো দরজার ওপাশ হতে। সেদিন গভীর রাতে এলোমেলো, দূর্বল, প্রায় দু’দিন নাওয়াখাওয়া বিহীন অবস্থায় ঘুমিয়ে থাকা ইরা’র ফোন শব্দ করে বেজে উঠে। কাঁচা ঘুম ছুটে যায় ইরা’র। বন্ধ দরজায় চেয়ে ঠাওর হয় বড়মা চলে গিয়েছে হয়তো। আর কতবার ডাকবেইবা মানুষটা। উনার ও নিশ্চয়ই ক্লান্তি আছে। লাগাতার শব্দ করে বেজে উঠা ফোনটা প্রচণ্ড বিতৃষ্ণা’র সঙ্গে হাতে তুলে নেয় ইরা। স্ক্রিনে ভেসে উঠা নাম দেখে কিঞ্চিৎ কেঁপে উঠলো ইরা। শান্ত হৃদস্পন্দন হলো বেসামাল। পরমুহূর্তেই ফুঁপিয়ে কান্না পেলো। কিয়ৎপ্রহর ফোন হাতে নিরবে অশ্রুবিসর্জন দিয়ে গেলো মেয়েটা। চতুর্থ বারের মতো ফোন’টা কম্পিত হতে-ই ইরা কল রিসিভ করলো। কম্পিত হস্তে কর্ণধারে ফোন রাখলো। স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে ভাঙা ভার নম্র গলায় বলল,

–” আসসালামু আলাইকুম, স্যার। ”

দু-তিন ফোঁটা মোটা মোটা অশ্রু গড়িয়ে পড়লো লালিত কপোল বেয়ে। রাদ মনে মনে সালামের জবাব নিলেও। বাস্তবে নিরব রইলো। হৃদপিণ্ডটা কেমন বেসামাল, অস্বাভাবিক প্রচণ্ড অস্থির। বেশ সময় নিয়ে মোলায়েম গলায় শুধালো,

–” কেন যেন আমার মনে হচ্ছিলো তুমি এক্সাম দিতে পারবেনা। বিয়ষটা মিথ্যে হওয়ার কোনো চান্স আছে ইরা? ”

নরম পাতলা অধরপল্লব কামড়ে ধরে ইরা রুদ্ধশ্বাসে দ্বিগুণ উদ্বেগে কেঁদে উঠলো। সে-ই কান্না’র শব্দে রাদে’র যেন তৎক্ষনাৎ জ্বর এসে গেলো। সম্পূর্ণ বলিষ্ঠ তরতাজা শরীর ভার হ’য়ে গেলো। ইরা নিরবতা ভেঙে ক্রন্দনরত গলায় সম্পূর্ণ’টাই খুলে বলল কেন ও এক্সাম দিতে পারেনি। ওর একেকটা বাক্য যেন তীরের ন্যায় বিদ্ধ হলো রাদে’র শক্ত আস্তরণে ঢাকা নরম হৃদপিণ্ডে। সহ্য হচ্ছিলো না রাদে’র ইরা’র কান্না। মিষ্টি, নরম স্বর’টা বড্ড ফ্যাকাসে লাগছিলো। রাদ মেনে নিতে পারছিলো না ইরা’র ক্রন্দনরত মলিন গলার স্বর। সে-ই থেকে ইরা’র কান্না সহ্য করতে পারেনা রাদ। সেদিন প্রথম বার অদ্ভুত গলায় বলেছিলো রাদ,

–” মেয়ে এভাবে কেঁদ না। তোমার কান্না আমার সহ্য হচ্ছে না। । ”

সাহসা ইরা চমকে উঠলো অতঃপর একদম নিরব হ’য়ে গেলো হটাৎ। রাদ পুনরায় অদ্ভুত গলায় আওড়ালো,

–” আমার না জ্বর এসেছে ইরা। আমি একটু উল্টাপাল্টা কথা বলতে পারি! তুমি কিছু মনে করো না কেমন। ”

রাদে’র অনাকাঙ্ক্ষিত ফোন কল বদলে দিয়েছিলো সম্পূর্ণ গল্প। জ্বরের ঘোরে রাদ সত্যিই উল্টাপাল্টা আচরণ করেছিলো যেটা বাস্তবে শক্ত আস্তরণে ঢেকে রাখে খুব কৌশলে। ইরা সেদিন রাদে’র জোড়ালো ঘোর লাগা কণ্ঠে কখনো চমকে উঠে, কখনো লজ্জা পায়, কখনো বা কেঁদে উঠে। কী অদ্ভুত সংমিশ্রণে অনুভূতি। কী ভীষণ ভালোলাগা, আদুরে একটা অনুভূতি যেন আলো, বাতাস, শ্বাসে প্রশ্বাসে প্রেম প্রেম গন্ধ বইছে। মোহাবিষ্ট, সম্মোহনী করে তুলছে দু’জন নারী পুরুষের মন ফলস্বরূপ এক অদৃশ্য বাঁধনে বেঁধে যায় দু’জন!
________

কল্পনায় ডুবে থাকা ইরা আনমনে হাসলো কী ভীষণ মিষ্টি হাসি। এ-ই শ্যামাঙ্গিনী’র মিষ্টি হাসির প্রশংসা-ই বুঝি রাদ করে। ঘোরে ডুবে থাকা ইরা যদি-ও অতীতের টক, ঝাল, মিষ্টি সময়ের স্মৃতিচারণ করে হাসছিলো। কিন্তু মীতি ভুল বুঝে ধাক্কাধাক্কি শুরু করলো। ওর বোনটা কী একের পর এক ঘটনায় পাগল হ’য়ে গেলো। চিৎকার চেঁচামেচি করে ডাকছিলোও বোন’কে। ওর গলায় তীব্র আতঙ্ক প্রকাশ পাচ্ছে,

–” ইরাপু, এ-ই মিষ্টিপু এ-ই তোমার কী হলো। একা একা হাসছো কেন? এ-ই মা দেখো না..!”

এপর্যায়ে ইরা কল্পনা থেকে ছিঁটকে বেরুলো যেন। এতক্ষণে মীতির চিৎকার শ্রবণেন্দ্রিয়ে পৌঁছালো তৎক্ষনাৎ হকচকিয়ে উঠলো। জ্ঞানশূন্য হাতে বোনের মুখ চেপে ঘোরলাগা গলায় শুধালো,

–” ম..মীতি এভাবে চেঁচামেচি করছিস কেন। কী হয়েছে কী ভয় পেয়েছিস! ”

মীতি’র মাথায় হাত! ওর বোন এসব কী বলছে। ইরা’র হাত মুখ থেকে সরিয়ে মীতি ঝাঝালো গলায় আওড়ালো,

–” কখন থেকে ডাকছি তোমাকে শুনছিলেই না তুমি। কী সব উল্টাপাল্টা ভাবছো বলতো। একা একা হাসছো বসে বসে, পাগল হলে নাকি। ”

ইরা সত্যি উন্মনা ছিলো মীতির কথা হয়তো বা ইরা’র মস্তিষ্কের স্নায়ুকোষ সরাসরি পৌঁছাতে অক্ষম। এর পূর্বেই ইরা মৃদু চিৎকার করে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে উঠে। আতঙ্কিত মীতি ভয় পেয়ে যায় এহেন কাণ্ডে। ওকে আরও একবার হতভম্ব করে ইরা আলমিরাতে লুকিয়ে রাখা রাদে’র সেল ফোনটা বের করে তাতে চুমু খায় অসংখ্য। সুন্দর নয়ন জোড়া জ্বলজ্বল করছে মেয়ে’টার। অতঃপর বড়বাবা’র রুমে ছুটে যায় এক মুহুর্ত বিলম্বনা না করে। সম্পূর্ণ কাণ্ডে মীতি হতবিহ্বল।

________

রাদ ইরা’র সঙ্গে রেগেমেগে অভিমানের বশেই কাশিশের ছোট বোন অত্রী’র বিয়ে খেতে ঢাকা’তে ওর পদধূলি রেখেছে। এবং জোড়েসোড়ে কাশিশ’কেও হুমকি ধামকি দিয়ে এসেছে। ইরা’কে কোনও প্রকার সাহায্য করা যাবে না। এবার ওর ইরানীর ও একটু বুঝতে হবে অবহেলা কেমন পীড়াদায়ক! ফলশ্রুতিতে দু’বন্ধুর ফোন আপাদমস্তক বন্ধ! ফলাফল যা হওয়ার তা-ই হচ্ছে।

যদি-ও রাদ এখনো কিছু’টা অসুস্থ। রাদের বাসার মতো কাশিশের বাসায় রাদের প্রচণ্ড দাম। যেটা ও নিজের বাসায় পায়না কাশিশের জন্য। ফলাফল কাশিশের বাসায় এলো রাদ অন্য লেভেলের ভাবসাবে, হম্বিতম্বি নিয়ে চলাচল করে। এবং কাশিশের হিংসাত্মক তৎপরতা বেশ ইঞ্জয় করে।

কাশিশের ভাই বোন সংখ্যা পাঁচ। বড় বোনের পর তিন ভাই সবার ছোট অত্রী। ভাই হিসেবে কাশিশ নিজেও সবার ছোট। কাশিশ, অত্রী ছাড়া সবাই বিবাহিত, পুচকে পুচকো ছেলে মেয়েও আছে সবার। যদিও শিগগিরই অত্রীর পাশেও বিবাহিত ট্যাগ লাইনটি ঝুলেই যাচ্ছে। অত্রী ছোট ভাই অন্ত প্রাণ। বড় ভাই বোনদের সঙ্গে বয়সের পার্থক্য থাকায় সম্পর্ক শিথিল না। তবে কাশিশের ব্যাপার’টা ভিন্ন। সে ছোট বোনের সঙ্গে ভীষণ ফ্রেন্ডলি। অত্রীর ৬-বছরের একটি সম্পর্ক পূর্ণতা পেয়েছে শুধুমাত্র বুদ্ধিচাতুর্য কাশিশ এবং রাদের নিরব পরিচালনা’র জন্য। এতে ভাইয়ের উপর ভীষণ কৃতজ্ঞ এবং নরম অত্রী। অত্রী কাশিশের মতো রাদ বলতে মেয়েটা পাগল। কাশিশের থেকে-ও বেশী সম্মান করে রাদ’কে। এ-র একটি কারণ আছে। ইন্টারে এক্সিডেন্টলি ইংরেজিতে ফেল এসেছিলো অত্রী’র৷ তখন এ-ই রাদ ওকে অন্ধকারে তলিয়ে যাওয়া থেকে বাঁচায়। এতটা অনুপ্রেরণা দেয় মানুষটা ঘুরে দাঁড়াতে বাধ্য হয় ও। অত্রী বারংবার মুগ্ধ হয় রাদে’র উপর। সব মিলিয়ে বিষণ্ণতা থেকে একটু বেড়িয়ে এসেছে রাদ এখানে এসে।

আজ সকলা সকাল অত্রী আবদার ওর বিয়ের শপিংয়ে কাজিনদের সঙ্গে সঙ্গে কাশিশ রাদ’কে থাকতে হবে৷ রাদ কাশিশ ছোট বোনের বায়নার মুখে পড়ে-ই অত্রী’র সঙ্গে বসুন্ধরা এসেছে। মেয়েলী ব্যাপার স্যাপার হলেও রাদ বেশ হেল্প করছে শপিংয়ে ব্যাপারে অত্রী’কে। অত্রী’র যুবতী কাজিন গুলো। বুদ্ধিদীপ্ত এবং সুদর্শন পুরুষ রাদের উপর ক্রাশিত এবং মুগ্ধ। রাদে’র সেদিকে নজর নেই। অত্রী’র জন্য এটা সেটা দেখতে গিয়ে রাদে’র বারংবার কিছুনা কিছু পছন্দ হ’য়ে যাচ্ছে ইরা’র জন্য। নিজেকে কিছুতেই আঁটকাতে পারছে না ছেলেটা। অত্রীরা বিকেলে যখন শপিং মল ত্যাগ করলো বিয়ের যাবতীয় শপিং শেষে। তখন কাশিশ’কে নিয়ে শুরু হলো রাদে’র শপিং যা যা ওর পছন্দ হয়েছিলো ইরা’র জন্য রাদ সব কিনে ক্লান্ত পরিশ্রান্ত হয়ে দুই বন্ধু বাড়ি ফিরতে রওনা দিলো। বাইকে টান দিয়ে কাশিশ তীব্র বাসাতেও উৎসুকভাব একটা জটিল প্রশ্ন করে বসলো,

–” আচ্ছা এ-ই যে এতসব কিনলি। যদি কখনো তোর ইরানীকে এসব দিতেই না পারিস। ”

রাদ একটু এদিক সেদিক নজর বুলিয়ে। বিগলিত সহজ গলায় প্রত্যুত্তরে বলল,

–” আমার বিশ্বাস ইরা আমার হবে। হোক সেটা কম সময়ের জন্য। তখন আমি ওকে এ-সব দিব। আমার ভীষণ ইচ্ছে হয়েছে দেওয়ার। আমার শপিংয়ে নিশ্চয়ই ওকে সুন্দর লাগবে। ”

কাশিশ স্মিথ হাসে। ঢাকার ব্যাস্ত, ধুলোবালি ভরা রাস্তায় চুল, শার্ট উড়িয়ে তীব্র গতিতে বাইট টেনে ছুটে চলে গন্তব্যের দিক।

চলবে!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here