#জলফড়িং
লেখনীতেঃ #রিধিমা_জান্নাত_রূপা
পর্বঃ ০৩
.
সকাল সকাল মায়ের ডাকে ধড়ফড়িয়েই বিছানা ছেড়ে লাফিয়ে উঠলো দিয়া। জোরে জোরে শ্বাস টেনে এদিক ওদিক তাকাতে লাগলো। মুহুর্তেই ঘেমে একাকার হয়ে উঠলো দিয়ার শরীর। সারারাত না ঘুমিয়ে সকালের দিকে চোখ বন্ধ করার ফল হয়তো। এদিকে হতভম্বের ন্যায় তাকিয়ে রইলো দিয়ার মা শেলী বেগম। মেয়ের অবস্থার গতিবেগ দেখে দ্রুত পা চালিয়ে বিছানায় বসে পড়লেন, দিয়াকে দু’হাতে জড়িয়ে নিয়ে উত্তেজিত কণ্ঠে,
“দিয়া, কি হয়েছে মা? এমন চমকে উঠলি কেন, খারাপ স্বপ্ন দেখেছিস?”
বলতেই মায়ের দিকে তাকালো দিয়া, স্বাভাবিক করতে লাগলো নিজেকে। হ্যাঁ! খারাপ স্বপ্ন’ই দেখেছে দিয়া। সারারাত বিয়ে ভাঙার কথা চিন্তা করতে গিয়ে চোখে ঘুমের রেশ পর্যন্ত দেখা দেয় নি, ফজরের আজানের পর সবে ঘুমিয়েছিলো দিয়া। ইফাজকে নিয়ে ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে গিয়েছিল, আর তাতেই ইফাজ কে নিয়ে বাজে স্বপ্ন দেখেছে। কিন্তু এটা তো আর মা কে বলতে পারবে না দিয়া।
শেলী বেগমকে কিছু না বলে জড়িয়ে ধরলো দিয়া, নিজেকে স্বাভাবিক করে সামান্য সময় নিয়ে বলে উঠলো,
“কিছু হয় নি মা। হঠাৎ ডেকেছো তো, তাই চমকে উঠেছি।”
“ভয় পাইয়ে দিয়েছিস তো। রাতে কি ঘুমাস নি? চোখ দু’টো কেমন বসে গেছে।”
মায়ের মন, মেয়ের অবস্থা কিছুটা হলেও যেন আন্দাজ করতে পারলো। সুপ্ত নিশ্বাস ছাড়লো দিয়া, মা’কে এটা ওটা বলে কথা কাটালো। আর কথা না বাড়িয়ে মেয়েকে ফ্রেশ হয়ে রেডি হয়ে থাকতে বললেন শেলী বেগম, —এগারোটার মাঝেই ইফাজ এসে তাকে নিয়ে যাবে। সেটা জানালো। ইফাজের কথা বলতেই মনটা আবারও বিষন্নতায় ছেয়ে গেল দিয়ার। তবে শেলী বেগমকে তা বুঝতে দিলো না। জিজ্ঞেস করলো দিহানের কথা। তাতে শেলী বেগম জানালো অফিসে গেছে দিহান। ভাইয়ের কথা শুনে আবারও হতাশার নিশ্বাস বেড়িয়ে এলো। এরপর মায়ের তাড়াহুড়ায় উঠে ফ্রেশ হতে হলো দিয়ার।
.
ঘড়ির কাটা ঠিক এগারোটার কাছে যেতেই ইফাজ এলো দিয়াকে নিতে। বেশি সময় ব্যায় না করে দিয়া ও মিথিলাকে নিয়ে বেড়িয়ে গেল বিয়ের শপিংয়ের উদ্দেশ্যে। শপিংয়ে গিয়ে ইফাজের বোন ফুপি ও কাজিনদেরও পেল। সবাই হৈ চৈ করে কেনাকাটা করতে লাগলো। এসবের মাঝে বিষন্নতার মাঝে নিশ্চুপ হয়েই কাটাতে চাইলো দিয়া। কিন্তু বেশিক্ষণ যেন টিকে রাখতে পারলো না নিজেকে। হঠাৎই ইফাজ তার হাতটা ধরে ফেললো, সবাইকে উদ্দেশ্য করে,
“তোমরা সবাই দেখো, আমি একটু দিয়াকে নিয়ে ওদিকটায় যাচ্ছি।”
বলতেই যেন সবাই হৈ হৈ করে উঠলো, সামান্য লজ্জা পাবার ভান করলো ইফাজ। তারপর দিয়াকে টেনে নিয়ে চলে এলো সেখান থেকে। এতক্ষণ মুখ বুজে থাকলেও এবার চাপা স্বরে চেঁচিয়ে উঠলো দিয়া, এক ঝটকায় হাতটা ছাড়িয়ে নিতে চাইলো। কিন্তু পারলো না ইফাজের শক্তপোক্ত হাতের বাঁধণ হতে নিজের হাতটা মুক্ত করতে। বিরক্ত ও রাগ নিয়ে বলে উঠলো,
“কি সমস্যা আপনার? অসভ্যের মতো এমন করছেন কেন?”
“বউয়ের সামনে পুরুষজাতী অসভ্য না হলেও হয়ে উঠতে হয়। তুমি তো আমার হবু বউ, এখন থেকেই না হয় তোমার কাছে অকটু আধটু অসভ্য হয়ে উঠলাম।”
“দিশার সামনেও এমন অসভ্য হয়ে উঠতেন বুঝি? না… আমি তো আপনার হবু বউ, আর সে তো ছিলো আপনার গার্লফ্রেন্ড, মন থেকে মানা বউ। তার সামনে নিশ্চয়ই হাসবেন্ডের মতোই অসভ্যতামো করতেন।”
মুহুর্তেই ইফাজের হাতটা আলগা হয়ে গেল, নিশ্চুপে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে গেল। দিশার কথা কর্ণপাত হতেই বিষাক্ততায় ছেয়ে গেল ইফাজের মন। তার চেহারার পরিবর্তন লক্ষ্য করতেই দিয়া নিজের হাতটা ছাড়িয়ে নিলো। দিয়া জানে, দিশা ইফাজের কাছে ঠিক কতটা দূর্বলতা। আর ভালোবাসা? সেটাও আছে, চার বছরের ভালোবাসাকে তো হুট করেই ভোলা সম্ভব নয়। ইফাজের কোন জবাব না পেয়ে দিয়া আবারও বলে উঠলো,
“উহুঁ! হাসবেন্ডের মতো বলছি কেন? হাসবেন্ড হয়েই তো অসভ্যতামি গুলো করতেন, তাই না? দিশা এর সবটাই তো বলতো আমাকে।”
উঁহু! মোটেও সত্যি নয় কথাটা। দিশা ও ইফাজের কোন গোপন কথায় কখনো বলে নি দিয়াকে। ফিজিক্যাল রিলেশন বা চুমু টুমুর কথা দিশাকে বলতেই তা সুক্ষ ভাবে এড়িয়ে গেছে দিয়ার কাছ থেকে। খারাপ লাগতো দিয়ার, বেস্টফ্রেন্ডের এমন এড়িয়ে চলা কথায় বেশ খারাপ লাগলো। কিন্তু পরবর্তীতে কখনোই জানতে চায় নি দিয়া, তবে মনে মনে ঠিকই সন্দেহ করতো দিশার হাবভাবে। সেই ব্যাপারটাই কেন জানি দিয়ার মনে খচখচ করতে লাগলো, অজানা রাগ হতে লাগলো দিশার প্রতি। চার বছরের সম্পর্ক, অথচ কোন ফিজিক্যাল রিলেশন, জড়াজড়ি আর চুমু টুমু হয় নি তা মানতে পারে না দিয়া। সুযোগ বুঝে যেন এই কথাটায় ইফাজ কে বোঝাতে চাইলো দিয়া।
চোখ তুলে ইফাজের দিকে তাকালো দিয়া, তবে এবার তার মনোভাব বুঝতে পারলো না যেন। চেহারার পরিবর্তন এলো না ইফাজের বরং আগের চেয়েও স্বাভাবিকতায় ফিরে এলো। দূরত্ব ঘুচিয়ে এগিয়ে এলো দিয়ার কাছে, আবারও জড়িয়ে নিলো হাত। মুচকি হেঁসে,
“আচ্ছা, দিশার সাথে কেমন অসভ্যতামি করতাম সেসব না হয় আমাদের বাসর রাতে শোনাবো তোমাকে। এখন তো চলো বউ।”
বলেই দিয়ার কোমর জড়িয়ে নিলো ইফাজ। সামনের দোকানের দিকে যেতে চাইলো। তেঁতে উঠলো দিয়া। এক ঝটকায় ছাড়িয়ে নিতে চাইলো, কিন্তু পারলো না। রাগী কণ্ঠে বলে উঠলো,
“অসভ্য লোক, আবারও অসভ্যতামি শুরু করছেন? আপনাকে আমি কখনোই বিয়ে করবো না ইফাজ।”
“শুধু সময়ের অপেক্ষা। বিয়েও হবে, আর বাসর রাতে…. ”
কথাটা শেষ করলো না ইফাজ। কিছু একটা ইশারা করে চোখ মা’র’লো, তা দেখে আরও রেগে গেল দিয়া। বলে উঠলো,
“ছিঃ! অসভ্য, জঘন্য লোক।”
“আরে আরেএএ, বাসর রাতে দিশার সাথে করা অসভ্যতামি গুলোর বর্ণনা দিবো। কথাটা তো শেষ করতে দিবে তো না কি?”
মানলো না দিয়া। রাগে হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে গজগজ করতে লাগলো। সেদিকে ধ্যান দিলো না ইফাজ, তাকে টেনে দোকানের ভিতর নিয়ে গেল। কিছু জুয়েলারির সেট বের করতে বলে দিয়াকে পছন্দ করতে বললো তাদের বিয়ের রাতের জন্য। করলো না দিয়া, উল্টে সিনক্রিয়েট করলো। বেড়িয়ে এলো দোকান থেকে। দীর্ঘ শ্বাস ছাড়লো ইফাজ, নিজেও বেড়িয়ে এলো দোকান ছেড়ে।
.
বিষন্ন মন নিয়ে বসে আছে দিয়া। কেটে গেছে কয়েকটা দিন। ইফাজের সাথে তার বিয়ের আরও মাত্র গুণে গুণে এগারো দিন। ভেবে পাচ্ছে না দিয়া কি করবে। ভেবে পেলেও তা বাস্তবে বাস্তবায়ন করতে পারে নি এখনো, কথা বলতে পারে নি ভাইয়ের সাথে। অফিস ও দিয়ার বিয়ে নিয়েই ব্যস্ততা বেড়েছে দিহানের, বাড়িতে রাত ছাড়া সময়টুকুও দিতে পারছে না। যতটুকু পারছে তা ক্লান্ত শরীরে বিছানায় ঘুমিয়ে কাটাচ্ছে।
আজকে শুক্রবার। ছুটির দিনে দিহান সকাল থেকে বোনের বিয়ের কাজকর্ম ছেড়ে দুপুরের পর বাড়িতেই আছে। দুপুরের খাবার শেষ করে নিজের রুমেই আছে। দিয়া ভাবলো এখনই ভাইকে সবটা জানিয়ে দিবে, বলে দিবে দিশা ও ইফাজের সম্পর্কের কথা। ভেবেই উঠে দাঁড়ালো দিয়া, রুম ছেড়ে বেড়িয়ে ভাইয়ের রুমের সামনে এসে দাঁড়ালো। আধখোলা দরজাটা পুরোপুরি খুলতেই দেখতে পেল দিহান কে। বিছানায় আধশোয়া হয়ে মোবাইল টিপছে। সেখান থেকেই দিয়া ডেকে উঠলো ভাইকে।
“ভাইয়া!”
চকিতেই মাথা তুলে মোবাইল থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিলো দিহান। দিয়া’কে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বলে উঠলো,
“দিয়া! দাঁড়িয়ে আছিস কেন? ভেতরে আয়।”
আসলো দিয়া। সোজা এসে বিছানার কাছে ভাইয়ের সামনে দাঁড়ালো। বসতে বললো দিহান, বাধ্য মেয়ের মতো বসে পড়লো দিয়া। কিছু বললো না, চুপ করে মাথা নিচু করে রইলো।
আধা মিনিটের মতো অতিক্রম হতেই যখন দিয়া কিছু বললো না, তখন বোন যে কিছু বলতে চায় তা বুঝতে পারলো দিহান। মুচকি হেঁসে বলে উঠলো,
“কি রে? আজকে এত চুপ করে আছিস কেন, হু? কিছু বলবি?”
মাথা ঝাকালো দিয়া। বোঝালো —হ্যাঁ বলতে চায় কিছু। হাসলো দিহান। বোন যে তাকে কিছু বলতেই এসেছে তা ঠিকই আন্দাজ করে নিয়েছে। ঠোঁটের হাসিটা বজায় রেখেই দিহান বলে উঠলো,
“সে তো বুঝতেই পারছি। আজকাল অতি প্রয়োজন ছাড়া তো ভাইয়ের কাছে আসাও হয় না।”
“এমন কিছু না ভাইয়া। আসলে আমি তো….”
আচ্ছা, আচ্ছা ঠিক আছে। কিছু বলতে হবে না। এখন বল কি লাগবে?”
আমতা আমতা করলো দিয়া, বলতে গিয়েও আটকে যেতে লাগলো যেন। দিহান তাকে আবারও বলতে বলো। সামান্য সময় নিয়ে দিয়া বলতে লাগলো,
“ভাইয়া আমি, আসলে….”
“ভাইয়ের কাছে কিছু বলতে কবে থেকে এত ভাবতে শুরু করেছিস বুড়ি? নির্ধিদায় বলে ফেল তো।”
“আমি এই বিয়ে’টা করতে পারবো না ভাইয়া।”
হেঁসে উঠলো দিহান, বেশ শব্দ করেই হাসলো। বলে উঠলো,
“বিয়ের আগে এই সমস্যাটা সব মেয়ের’ই হয় না কি দিয়া? তোর ভাবীও আমাদের বিয়ের তিনদিন আগে ফোন দিয়ে বলেছিলো —দিহান, এই বিয়ে আমি কিছুতেই করতে পারবো না।”
বলেই একটু থামলো দিহান। শব্দ করেই হাসলো। সেকেন্ডের মতো সময় নিয়ে আবারও বলতে লাগলো,
“অথচ দেখ, বিয়ের আগে সাত বছরের সম্পর্ক আমাদের। সে কি কান্না তোর ভাবীর। ওকে তো এখনো এটা বলে রাগিয়ে দেই।”
সুপ্ত নিশ্বাস ছাড়লো দিয়া। ভাইয়ের কথায় সহসায় কিছু বলতে পারলো না যেন। সামান্যক্ষণ চুপ থেকে বলতে লাগলো,
“ভাইয়া আমি ইফাজকে….”
শেষ করতে পারলো না কথাটা, মাঝেই থেমে গেল। মূলত থেমে যেতে হলো দিয়াকে। মিথিলা ঘরে ঢুকতে ঢুকতে,
“এ্যাই! দিহান, দিয়াকে তো….”
বলতেই দিয়ার দিকে নজর পড়লো মিথিলার। তাকে দেখে হাসলো। বলতে লাগলো,
“ওও দিয়া, তুইও এখানে আছিস? ভালোই হলো।”
সামান্য থামলো মিথিলা। দিহানের দিকে তাকিয়ে তাকে উদ্দেশ্য করে আবারও বলে উঠলো,
“এই দিহান শোন না, ইফাজ ভাইয়া এসেছে। দিয়াকে নিয়ে একটু বাইরে যেতে চায়।”
হাসি ফুটে উঠলো দিহানের ঠোঁটে, কিন্তু চমকে উঠলো দিয়া। অবাকের ন্যায় তাকালো ভাবীর দিকে। সহসায় মুখ ফুটে বেড়িয়ে এলো,
“উনিইই? উনি কেনওও?”
“বললো তো কিছু কেনার আছে। তবে এসব কিছুই না ননদিনী, সবটায় বাহানা। মোট কথা বিয়ের আগে তোর সাথে একটু একান্ত সময় কাটাতে চায়।”
.
.
চলবে…..