#জনম_জনমে
#পর্বসংখ্যা_১০ [অন্তিম পর্ব]
#ইসরাত_ইতি
প্রাসাদের সিংহদুয়ার রুদ্ধ করে দেওয়া হলো। দ্বারের দিকে ছুটতে ছুটতে যেতে থাকা পারু চোখের পানি মুছছে। কানের কাছে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে তার দেবদার বলা সেই কথাগুলো,
“আচ্ছা দুলি একটু মজা করছি,রেগে যাসনা! একটা দৃশ্য কল্পনা কর। ধর তুই পারু। আমি তোর দেবদা। পারিবারিক দ্বন্দ্বে তোর অমন করে অন্য আরেকজনের সাথে বিয়ে হলো। আমি ওভাবে মাতাল হয়ে তোর দুয়ারে গিয়ে চেগিয়ে পরে থাকলাম। তুই শাড়ির আঁচল উড়িয়ে দৌড়ে দৌড়ে এলি, কাঁদতে কাঁদতে। তুই আমার কাছে এসে পৌঁছানোর আগেই সিংহদ্বার বন্ধ হয়ে গেলো।”
তার দেবদা আসেনি, অভিমানী দেবদা আসেনি দোলার কাছে। শুধু অভিমানেই দূর থেকে আরেকটু দূরে চলে যেতে চাইলো। আসেনি দোলার দোরে। তাতে কি? জারিফের স্বার্থপর পারু যাবে। গিয়ে শুধু বলবে,“জারিফ শাস্তি আমরা দু’জনেই পেয়েছি দেখো! আমিও ভালো নেই। তুমি ভেবো না আমাকে ছাড় দেওয়া হয়েছে! ভেবো না।”
আর কি কি বলবে দোলা সাজাতে লাগলো,তবে গিয়ে দেখলো সিংহদ্বারে তালা ঝোলানো। বড় একটা তালা। তবে এখন উপায়?
হাপাচ্ছে দোলা। বাড়ির কাজের লোকেরা আঙিনায় দাঁড়িয়ে ভ্রষ্টাচারিনী দোলার ছটফটানি দেখছে। কিছু মুখে না বললেও মনে মনে ধিক্কার দিচ্ছে দোলাকে। দোলা দাড়োয়ান চাচাকে বললো গেটের তালা খুলতে। দাড়োয়ান চাচা নির্বিকার। কাঁদতে কাঁদতে মুর্ছা যেতে চাইলো দোলা। তখনই তার বৈধ পুরুষ এসে তার চুলের মুঠি ধরলো। ধরবেই তো! স্বাভাবিক! ভ্রষ্টাচারিনীকে শাস্তি দেওয়া উচিত।
টেনে হিচরে শেখ বাড়িতে ঢোকানো হলো পারুকে। পারু শুধু বলতে লাগলো,“মাত্র আধাঘণ্টা। দূর থেকে দেখে চলে আসবো!”
বৈধ পুরুষ অমন মুখপুড়ি,চরিত্রহীনাকে টেনে হিচরে ঘরে নিয়ে যাচ্ছে। পুরো দোতলা ফাঁকা। আজ স্বামী স্ত্রীর মধ্যে কেউ ঢুকবে না। সবাই যার যার ঘরে দরজা লাগিয়েছে।
ঘরে ঢুকিয়ে বিছানার উপরে ফেলে ঘরের দরজা বন্ধ করা হলো। পারু কাঁদছে। কাঁদার প্রয়োজন কি এখন? সে গেলেই কি দেবদা সুস্থ হয়ে যাবে?
স্বামী ভ্রষ্টাচারিনী স্ত্রীকে শাস্তি স্বরূপ চামড়ার বেল্ট দিয়ে কিছুক্ষণ মা’রলো। কত বড় দুঃসাহস! আজ জন্মের তরে দ্বিচারিতার শখ ঘুচিয়ে দিলো। হাপাচ্ছে সে। ততক্ষণে চুপ হয়ে গিয়েছে দোলা। শরীরের যন্ত্রনা আর টের পেলো না সে। উপুড় হয়ে পরে রইলো। বৈধ পুরুষ এসে চুলের মুঠি ধরে স্ত্রীকে ঘুরিয়ে শুইয়ে দিয়ে চোখে চোখ রেখে বললো,“এই প্রথম আর এই শেষ। এরপর পরপুরুষের জন্য চোখের পানি ফেলতে দেখলে শক্তি অপচয় করবো না আর। জানে মে’রে বাড়ির আঙিনায় কবর দিয়ে দেবো।”
দোলা নিষ্পলক সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে আছে। তার চোয়াল চে’পে ধরে বৈধ পুরুষ চেঁ’চি’য়ে ওঠে,“শরীরে স্বামীর গন্ধ নিয়ে মামাতো ভাইয়ের জন্য শোক? এই তোর হয়না? কি কম দিয়েছি তোকে? জবাব দে! জবাব দে!”
জবাব পাওয়ার জন্য শেখ তৌসিফ আহমেদ প্রশ্নটা করেনি। স্ত্রীকে নিয়ন্ত্রণে আনতে প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে এতটুকু মা’র যথেষ্ট ছিলো।
শেখ বাড়ি নিস্তব্ধ এখন। তৌসিফ বারান্দায় দাঁড়িয়ে ঘন্টা খানেক সিগারেট ফুঁকতে থাকে। শরীরকে আটকানো যায়,কিন্তু মন? মন কিভাবে আটকাবে তৌসিফ বুঝতে পারছে না। শেখ তৌসিফ আহমেদ জীবিত থাকতে তার বৌকে তালাক দেবে না, তাহলে মানুষ বলার সুযোগ পাবে বৌ দ্বিচারীনি হুলো কারণ শেখ তৌসিফ আহমেদ ব্যর্থ! হয়তো তার ত্রুটি আছে! সে দেবে না তালাক। সে ঐ বৌকেই মানুষ বানিয়ে সংসার করবে। কুমারী ছিলো, শুদ্ধ শরীর ছিলো। মনটা শুধু বেহায়া। ঐ বেহায়া মনকে নিয়ন্ত্রণে আনতে না পারলে মনটাকেই ন’ষ্ট করবে তৌসিফ।
রাগ আর প্রচন্ড জেদেও তৌসিফ উত্তেজিত হয়না। এক হাতে মাথার চুল খামচে ধরে,চার নাম্বার সিগারেটে শেষ টান দিয়ে সে বারান্দা থেকে ঘরে ঢোকে।
বিছানায় স্ত্রীর কাছে এগিয়ে যায়। আজ একে একেবারে জব্দ করে তবেই তৌসিফ থামবে। যেন ভবিষ্যতে এমন পাপ করার সাহস না পায়। একটানে শাড়ির আঁচল সরিয়ে হামলে পরে। পারু শুধু সিলিংয়ের দিকেই তাকিয়ে। তার বৈধ পুরুষ তার অবস্থান বুঝিয়ে দিতে তাকে আরো একবার দখল করে নিলো।
সময় গড়ায়। শেখ তৌসিফ তার স্বামীত্ব ফলিয়ে তার স্ত্রীর থেকে সরে গিয়ে আবারও চোয়াল চে’পে ধরে বলে,“হয়নি? নাকি আরো লাগবে? এখনও মামাতো ভাইয়ের কথা মনে পরছে?”
দোলা নিষ্পলক তাকিয়ে আছে ঘরের সিলিংয়ের দিকে।
তৌসিফ দোলার খুলে ফেলা লাল রঙের শাড়িটা তুলে দোলার শরীর ঢেকে, নিজে টি-শার্ট পরতে পরতে উঠে দাঁড়ায়। হন্তদন্ত হয়ে ড্রয়ার থেকে সবধরনের জন্মনিরোধক ওষুধের পাতা ন’ষ্ট করে বিনে ছুঁড়ে ফেলে একটা সিগারেট ধরায়। মন আটকানোর একটা অভিনব উপায় পেয়ে গিয়েছে শেখ তৌসিফ আহমেদ।
সিগারেট টা শেষ করে ঘর থেকে বেরিয়ে বাইরে থেকে দরজা লাগিয়ে চলে যায় তৌসিফ।
বিছানায় স্বামীর অত্যাচার আর সম্ভোগের চিহ্ন শরীরে নিয়ে পরে হয় দোলা। আর মেঝেতে পরে রয় শেখ তৌসিফ আহমেদের চামড়ার বেল্ট। যেটা একজন ভ্রষ্টাচারিনীকে শাস্তি দিয়েছে আজ।
★★★
বাড়ির বৌয়ের এমন আচরণ কারোরই সহ্য হচ্ছে না। রাতে খেতে বসে এই নিয়ে বিশদ আলোচনা সভা বসেছে শেখ বাড়ির পুরুষদের মধ্যে। এ বাড়ির মানসম্মান জড়িত,তাই তৌফিকুল ইসলাম ছেলের কাছে জানতে চাইছে তার ছেলে এখন কি করবে। শেখ তৌসিফ আহমেদ সাফ জানিয়ে দিলো সে বৌ তালাক দেবে না,বৌকে মানুষ বানিয়ে ফেলবে।
তৌসিফ বৌকে মানুষ বানাতে কি কি করতে চায় তা কেউ জানতে চাইলো না। রাতের খাবার শেষে তৌসিফ বৌয়ের জন্য প্লেটে খাবার আর একটা মলম নিয়ে নিজের ঘরের দিকে গেলো। শরীরে যতো আঘাত পরেছে সেগুলোতে মলম লাগাবে তৌসিফ আহমেদ। পথভ্রষ্টা হলেও বৌ তো! মেজাজ টা তার রাতে ঠিক হয়েছে খানিকটা। সিদ্ধান্ত নিয়েছে এখন একটু বোঝাবে। এমনিতেও কম মা’র পরেনি গায়ে। অত সুন্দর নরম শরীর, কিভাবে এতো মা’র খেয়েও না চেঁ’চি’য়ে পারলো তৌসিফকে বেশ অবাক করেছে।
দরজার সিটকিনি খুলে ভেতরে ঢুকে দেখে দোলা তখনও বিছানায়। তৌসিফ বেড সাইডের টেবিলে খাবার প্লেট টা রেখে গিয়ে দরজা লাগিয়ে মলম নিয়ে এগিয়ে যায় বৌয়ের কাছে। চোখ বন্ধ দোলার। গা থেকে শাড়িটা সরিয়ে তৌসিফ দেখলো সায়া-ব্লাউজ পরিহিতা অর্ধনগ্ন শরীরে রক্ত লাল আঘাতের দাগ।
মেজাজ তখন পরেই গিয়েছিলো পুরোপুরি, বৌয়ের জন্য খানিকটা দরদও লাগলো তার। ভীষণ শখের বৌ তার। কখনও কোনো মেয়েকে দেখে এক দেখায় তৌসিফের মাথায় বিয়ের ভুত চাপেনি।
সে দোলাকে না ডেকে দরদ নিয়ে মলম আঙুলে নিয়ে দোলার পেটের কাছে আঘাতে লাগিয়ে দিতেই চ’ম’কে ওঠে।
মুহুর্তও লাগলো না তার,দোলাকে আগলে নিয়ে গালে চা’পড় মেরে বলে,“দোলা! দোলা!”
দোলা সাড়া দেয়না। তৌসিফের বুঝতে বাকি নেই দোলা কখনোই আর সাড়া দেবে না। শরীরটা কাঁপছে তার। এসব কেনো! এসব কি! কেনো হলো!
★★★
ক্ষীণ আশা দোলা বেঁচে আছে। দোলার দায়িত্ববান বৈধ পুরুষ অ্যাম্বুলেন্সে দোলার হাত ধরে বসে ছিলো। বাকরুদ্ধ সে। দোলার অর্ধনগ্ন শরীরটা তার স্বামীর কেনা চার হাজারের লাল শাড়িতে মোড়া।
অ্যাম্বুলেন্স থেকে দোলাকে নামানো হলো,ডাক্তার দেখলেন, জানালেন দোলা নেই।
মৃত্যুর কারণ অজানা,শরীরে শুধু আঘাতের চিহ্ন।
দোলার পোস্ট মর্টেম রিপোর্টে এলো দোলাকে হসপিটালে নিয়ে আসার তিনঘন্টা আগে দোলা মারা গিয়েছে। মৃত্যুর কারণ “কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট!”
দোলার গল্প ফুরিয়ে গেলো। বাকি রইলো দোলার জীবনে বৈধ মানুষ গুলো। তারা শোকাহত হলেন, বিষন্ন মনে দোলার দাফন কার্য সম্পন্ন করলেন। পুলিশ কেস হয়নি,কারন দোলা দোলার স্বামীর হাতে তো মরেনি। রিপোর্টে “কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট” থাকলেও দোলার মৃত্যুর আসল কারণ দোলা ব্যতীত এই পৃথিবীর কেউ না জানুক। ওটা রহস্য হয়েই থাকুক।
দোলার কবর শেখ বাড়ির পূর্ব পাশের পারিবারিক কবরস্থানে। দোলার শ্বশুর ভাসুর মনে মনে পছন্দ করলো না অমন দ্বিচারীনি বৌয়ের কবর এবাড়িতে হোক। কিন্তু তবুও দোলার কবর স্বামীর বাড়িতেই হলো। এতে শেখ বাড়ির মান সম্মান জড়িত। বাড়ির বৌয়ের কবর অন্যখানে কেনো হবে?
শোক যথাযথ ভাবে পালন হলো দোলার মৃত্যুর। দোলার দায়িত্ববান স্বামী দোলার দাফনের দিন থেকে এতিম খাইয়েই যাচ্ছেন। এখন অবধি মাথা থেকে টুপিটা খোলেনি, সিগারেট হাতে নেয়নি।
আত্মহত্যা মহাপাপ। পাপী দোলার এই মহাপাপ টা করতে হলো না। তার প্রতি সৃষ্টিকর্তা সদয় হলেন। অত্যন্ত সুখের মৃ’ত্যু ছিলো ওটা।
বৌ মরে গেলো,আত্মীয়তা ফুরিয়ে গেলো। শেখ বাড়ির ছোট ছেলে বিপত্নীক হলেন। দোলার কবরের পাশে লাগানো পাতাবাহার গাছগুলো ডালপালা ছাড়ার আগেই শেখ বাড়ির মুরব্বিরা শেখ তৌসিফ আহমেদের জন্য মেয়ে খুঁজতে লাগলেন। এবার তারা নিজেরা পছন্দ করবেন, ভালো মেয়ে।
শেখ তৌসিফ আহমেদ বিষন্ন ভঙ্গিতে সরাসরি বারণ না করলেও সময় চাইলেন। সম্ভবত তিনি ভুলে গিয়েছেন সময়ের দরকার হয়না স্বামী হতে,একদলা মাংস পিন্ড হাতের কাছে পেলে আর শারীরিক সক্ষমতা থাকলেই স্বামী হওয়া যায়।
সময় লাগে তো স্ত্রী হতে, এতগুলো দিন নিজের মনকে মানিয়েও যা হতে পারেনি দোলা, বেঁচে থাকলে হয়তো পারতো, যদি তৌসিফের পরিকল্পনা মাফিক তৌসিফের বাচ্চা তার পেটে আসতো।
কবরস্থান নতুন। দোলার কবর রাজমিস্ত্রীরা মার্বেল পাথরের দেয়ালে ঘেরাও দিয়ে দিতে এসেছেন। শেখ তৌসিফ আহমেদ জীবিত থাকতে বৌকে অলংকারে আবৃত করে রাখতে চাইতেন,মরে যাওয়ার পর বৌয়ের কবরটাও পরিচ্ছন্ন রাখার ব্যবস্থা করলেন। স্বামী হিসেবে তিনি যে দায়িত্ববান।
রাজমিস্ত্রীরা তাদের কাজ করছে, শেখ তৌসিফ তার ঘরের বারান্দা দিয়ে তা দেখছেন, একদৃষ্টে। কাজের মেয়ে এসে তৌসিফের হাতে একটা নোংরা কাগজ দিয়ে বলে এটা ময়লার ঝুড়িতে পেয়েছে সে,দেখে মনে হয়েছে গুরুত্বপূর্ণ কোনো কাগজ।
কাগজটা আসলেই গুরুত্বপূর্ণ ছিলো, একটা চেক তাতে রয়েছে সাত লক্ষ টাকা। যার বিনিময়ে সে তার বৌকে পেয়েছিলো, তবে শুধু শরীরটা। মন নয়। কারন তার বৌ ছিলো যে ভ্রষ্টাচারিনী।
★★★
দোলা মরলো,সব ল্যাটা চুকে গেলো।
গল্পে তো দেবদা মরে যায়। বাস্তবে একটু ভিন্নই থাক। পারু মরুক। দেবদারা বেঁচে থাকুক।
আর এই পৃথিবীর সব দুধে ধোয়া তুলসী পাতা মানুষ গুলো বেঁচে থাকুক। যারা খুব গুছিয়ে জীবন যাপন করতে পারে, দোলার মতো অগোছালো নয়, হটকারী নয়, অসহায় নয়, স্বার্থপর নয়,চরিত্রহীনা নয় সবশেষে যারা দোলা নয়।
পারু মরেছে, পৌষ গিয়ে মাঘ পেরিয়ে ফাল্গুন এসেছে। শেখ বাড়ির ছোট ছেলের বৌয়ের কবর ফুলে ফুলে ভরে গিয়েছে। দোলার স্বামী নিয়ম করে সপ্তাহে একবার পরিষ্কার করায়, দায়িত্ব থেকে।
আচ্ছা দোলার স্বামীর কথা বাদ দিই। চলুন পারুর দেবদার কাছে যাই। সে কি করছে জানতে ইচ্ছে করছে না?
★★★
অ্যাক্সিডেন্টের পরে তিনমাস সময় নিয়ে দোলার দেবদা সুস্থ হলো। গল্পের মতো দেবদা কখনও জানতে পারেনি পারু তার কাছে আসবে বলে ছুটছিলো। দেবদার জানার প্রয়োজন তো নেই, সে জানলে তার কষ্ট বাড়তো বৈ কমতো না। রাগও হতো। দেবদা জানেনি ভালো হয়েছে।
আজকাল দেবদা দেখে শুনে বাইক চালায়। মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরে এসে সে জীবনের মানে বুঝতে পারলো, এবারের অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার টা ছিড়লো না সে। চাকুরী টা গ্রহণ করলো, জীবনে ফিরলো দেবদা। নিজেকে বদলে ফেললো। শুধু বদলাতে পারলো না পারুর প্রতি তার ভালোবাসা,কমাতে পারলো না কিছুতেই।
পারু ম’রেছে তা সে জেনেছে। তবে তাতে কি? পারুর শরীরটা ম’রেছে। ঐ শরীরের সাথে দেবদার কি লেনা দেনা?
সে তো ভালোবাসে ঐ নামটিকেই,তার দুলিকে। অফিস শেষে ফাঁকা সময়ে ছুটে যায় জারিফ দুলির পছন্দের যায়গাগুলোতে। রাতে নিস্তব্ধ মফস্বলে হেটে বেড়ায়। হাটতে হাটতে ফজিলাতুন্নেসা ছাত্রী নিবাসের পেছনের গলিতে যায়। আজও গেলো,শেফা ফার্মেসির সামনে কুকুর ডাকে। সে তাড়িয়ে দেয়। ঘাড় ঘুরিয়ে তিনশো চারের কামরার জানালার দিকে তাকায়। তাকিয়ে আজ জারিফ অবাক হলো,তার বুকে কাঁপন ধরলো। তিন তলার রুমটাতে আলো জ্বলছে আজ।
দেবদার শরীর কাঁপছে। থ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে সে। জানালা খুলে যায়। দেখে এক অন্য মেয়ে জানালার গ্রীল ধরে দাঁড়িয়ে আছে। সম্ভবত ঐ রুমে নতুন এসেছে। তার কানেও ফোন চে’পে ধরে রাখা।
জারিফ মেয়েটিকে দেখে। ঠিক তখনই গলিতে একটা বাইক এসে থামে। একটা ছেলে বাইক থেকে নেমে ফোন কানে চেপে ধরে কথা বলছে, ছেলেটার দৃষ্টি তিনশো চারের কামরায়।
জারিফ দুজনকেই দেখে। তারপর স্মৃতিচারণ করে। জারিফের একবার ইচ্ছে করলো ওদের থামিয়ে দিতে,বলতে,“অনিশ্চয়তা নিয়ে স্বপ্ন বুনতে নেই।”
কিন্তু সে থামালো না। দেখুক না স্বপ্ন, মন ভাঙবে বলে স্বপ্ন দেখা বারণ নাকি!
কিছুক্ষণ দেখে জারিফ চলে যায়। কাল হয়তো আর আসবে না এখানে। এদেরকে বিরক্ত করা যাবে না,স্বপ্ন দেখতে দিতে হবে,যে স্বপ্ন ভাঙবে বছর চারেক পরে।
রাত করে হলেও জারিফ বাড়িতে যায়, আজও গিয়েছে। পরপর কলাপসিবল গেট খোলার শব্দ হয়, বন্ধ হয় গেট। জারিফ ভেতরে ঢুকে দেখে জাহিদা আনাম খাবার নিয়ে বসে আছে। জারিফ ফ্রেশ হয়ে বাধ্য ছেলের মতো মায়ের সামনে বসে রাতের খাবার খায়। কি কি বাজার লাগবে তা জানতে চায়। খেয়ে হাত ধুয়ে উঠে পরে। তারপর বলে,“তোমার তেইশতম পাত্রী রিজেক্টেড মা। পছন্দ হলোনা!”
জাহিদা শোনে। জারিফ নিজের ঘরের দরজা খোলা রেখে বিছানায় গিয়ে উপুড় হয়ে শোয়। মাথাটা ঢুকিয়ে দেয় বালিশের নিচে। বালিশ দিয়ে চেপে ধরে মাথা।
জাহিদা আনাম ডাইনিং টেবিলের চেয়ারে বসে রোজ অর্ধেক রাত ছেলের চাপা আর্তনাদ শোনে। খুব ক্ষীণ স্বরে। কিছুক্ষণ পর থেমেও যায়। জারিফ ঘুমিয়ে যায়। তার ছেলে তাকে শাস্তি দিচ্ছে,রোজ।
সকালে ঘুম থেকে ওঠে জারিফ, নাস্তা খেয়ে মায়ের প্রেসক্রিপশন নিয়ে নেয় ওষুধ আনবে বলে। রোজ খুব মন লাগিয়ে অফিস করে,অফিস শেষে ছুটে যায় আবারও তার দুলির পছন্দের যায়গা গুলোতে।
মাঝে মাঝে জারিফের খুব ইচ্ছে করে দোলার কবরটা একটু দেখতে। সবসময় না। মাঝে মাঝে। তবে সে নিজেকে সংযত করে নেয়। পারু পরস্ত্রী তাই। ওটা তো পরস্ত্রীর কবর। দুলি তো তার মনেই আছে,যার কখনো দাফন হয়নি। এইতো এখনও জারিফ স্টাফ কোয়ার্টারের দিঘির পাড়ে বসে আছে। তার পারুকে সাথে নিয়ে। তবে পাশে নয়,মনে।
সূর্যি মামা পশ্চিমে ঢলে পরলো,আজান হলো,জারিফও তার দুলিকে নিয়ে উঠে দাঁড়ায়। আর তারপর?
তারপর আর কি! ইতির গল্প ফুরালো,নটে গাছটিও মুড়ালো।
~~~~~সমাপ্ত~~~~~