#জনম_জনমে
#পর্বসংখ্যা_৪
#ইসরাত_ইতি
[ এই পর্বে কিছু স্থানে অশালীন শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে,গল্পের প্রয়োজনে তার জন্য ক্ষমাপ্রার্থী ]
জারিফ মায়ের দৃষ্টি থেকে দৃষ্টি সরিয়ে জাহিনের দিকে তাকায়। জাহিন বলতেই থাকে,”তারপর শার্ট টা কিনে আপু বললো আমাকে আইসক্রিম খাওয়াবে,আমার সাইকেলে আপুকে নিয়ে অনেকক্ষণ ঘুরলাম!”
জারিফ নিচুগলায় বলে,”তাই নাকি! বেশ!”
জাহিন বলে,”তুমি কোথা থেকে নিলে শার্ট টা? তুমিও জেন্টস পয়েন্ট থেকে নিয়েছো?”
জারিফ জাহিনের কথার উত্তর না দিয়ে মায়ের দিকে আরেক পলক তাকিয়ে নিজের রুমে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দেয়। জাহিদা আনাম নিশ্চুপ হয়ে তাকিয়ে আছে সেই বন্ধ দরজার দিকে।
★★★
“ঐ কে যায়,ঐখান দিয়া কে যায়!”
বাচ্চাসুলভ রিনরিনে কন্ঠস্বর দোলার পায়ের গতি থামিয়ে দেয়। সে শেখ বাড়ির দোতলার পুর্ব দিকের সবথেকে কোণের ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে পরেছে। ঘরটা এ বাড়ির সবথেকে প্রবীণ ব্যক্তি, তৌকির আহমেদ ও তৌসিফ আহমেদের দাদী গুলবাহার বেগমের। বয়স প্রায় নব্বইয়ের কাছাকাছি। চোখে খুব কম দেখে। ওয়াকার ছাড়া হাঁটাচলা করতে পারেন না, মাঝে মাঝে তিন চারদিনের জন্য পুরোপুরি বিছানা নেন। তবে এত অক্ষমতার পরেও ওনার মুখটা খুব চলে। এই বাড়িতে বোজো আর বোজোর মনিবের পরে দোলার আরো একজন অস্বস্তি হচ্ছে এই গুলবাহার বেগম। বৃদ্ধা মানুষ,অতিরিক্ত কথা বলবে স্বাভাবিক,তবে এই বৃদ্ধা এক লাইন কথা বললে দশটা গালাগাল দেয়। সব সময় অশ্লীল, অশালীন কথা বলে অন্যদের সাথে। এটাই দোলার বিরক্তির কারন। সেদিন দোলার সামনে এই বাড়ির মেয়ে তারানা,যার সপ্তাহখানেক আগে বিয়ে হয়েছে,সে কথায় কথায় ফারিনকে বলছিলো,”আমি এখনও ছোটো ভাবী।”
পাশ থেকে গুলবাহার বেগম তার দন্তবিহীন কুঁ’চ’কে যাওয়া মুখ নে’ড়ে নে’ড়ে সাথে সাথে উত্তর দেয়,”কিয়ের ছোডো? যে মাইয়া একবার ভাতারের তলে যায় হে মাইয়া আর ছোডো থাহে না।”
কথাটা মনে পরায় পুনরায় দোলার গা কাঁটা দিয়ে উঠেছে। একে এই বাড়ির সবাই সহ্য কিভাবে করে কে জানে! তবে বৃদ্ধার স্মৃতি শক্তি খুবই কম। কাউকে মনে রাখতে পারে না।
দোলা বরাবর এই বৃদ্ধা মহিলাকে এড়িয়ে চলে। তবে আজ ইউরার ওয়াশরুম ব্যস্ত, তাই দোলা দোতলার গেস্টরুমের ওয়াশরুমে ঢুকেছিলো। গেস্টরুম টা গুলবাহার বেগমের ঘরের ঠিক পাশেই।
দোলা থমথমে মুখে গুলবাহারের ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। এখন সে দু’টো কাজ করতে পারে,হয় এখান থেকে পালিয়ে যাওয়া নয় দুমিনিট ঐ অশ্লীল বৃদ্ধার যৌন বিষয়ক লেকচার শোনা। দোলা পালিয়ে যাওয়ার মনস্থির করলো, এক পা সামনে বাড়াতেই গুলবাহার আবারও চেঁ’চি’য়ে ওঠে,”ঐ ছেড়ি! তুই কেডা! আয় এম্মে আয়! আয় কইছি! পানি খাওয়াইয়া যা মোরে।”
একটা গভীর নিঃশ্বাস ফেলে দোলা গুলবাহারের ঘরে ঢোকে। গুলবাহার বিছানায় হেলান দিয়ে বসে ছিলো,পরনে তার সুতি কাপড়ের মেক্সি ধরনের পোশাক। সে চোখ সরু করে দোলাকে দেখছে।
দোলা একটা গ্লাসে পানি ঢালে। গুলবাহার বলে ওঠে,”তুই কার বৌ!”
দোলা পানিটা গুলবাহারকে খাওয়াতে খাওয়াতে বলে,”আমি ইউরার টিচার।”
_তুই কিচার? হুরা কেডা?
_আপনি পানি খান দাদী।
দোলা পানি খাইয়ে দিতেই গুলবাহার বলে ওঠে,”তোর গায়ে গোস্ত নাই ক্যান। শেখ বাড়ির বৌরা থাকপি থলথলা। এই শরীর নিয়া এই গুষ্টির পোলাগো সামলান যায়না,তোর ধরবে কোনহানে…..!”
“ছিহ!!!”
চেঁচিয়ে ওঠে দোলা। দোলার আওয়াজে গুলবাহার বেগমও কেঁ’পে ওঠে। দোলা এক মুহুর্তও অপেক্ষা না করে হাতের গ্লাসটা টেবিলে বেশ শব্দ করে রেখে হন্তদন্ত হয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে নিলে কারো সাথে ধাক্কা লেগে তিনপা পিছিয়ে যায়।
তৌসিফ দোলার দিকে এক পলক তাকিয়ে চোখ সরিয়ে নেয়। দোলা ব্যস্ত হাতে ওড়না দিয়ে মাথা ঢাকে। তৌসিফ গুলবাহারের ঘরের দরজা থেকে সরে ভেতরে ঢোকে। দোলা পালিয়ে যাওয়ার মতো ছুটে বেরিয়ে যায় ঘর থেকে,আড়চোখে দোলাকে একপলক দেখে তৌসিফ দাদীর দিকে তাকায়। গুলবাহার তখন থেকে চেঁচিয়ে যাচ্ছে দোলার ওপর,”ঐ ছেড়ি তুই কার লগে চিল্লাইয়া উডলি। ঐ ছেড়ি! ঐ মইষের মতো দৌরাও ক্যা।ঐ”
তৌসিফ শান্ত স্বরে দাদীকে বলে,”চেচাচ্ছো কেনো!”
_তুই কেডা? তোকি?
_না তসু!
_ঐ ছেড়ি কেডা? কার বৌ। ও চিল্লাইয়া উডলো ক্যান। কার বৌ ও?
তৌসিফ দাদীর দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে শান্ত, গম্ভীর স্বরেই বলে,”তৌসিফের।”
★★★
টিফিন পিরিয়ডে স্কুলের টিচার্স রুমে চুপচাপ বসে ছিলো জাহিদা আনাম। মাথাটা বেশ ধরেছে। আজ সকালে ঘুম থেকেও সময়মতো উঠতে পারেনি,সকালের রান্নাটাও হয়নি ঠিকভাবে। কোনোমতে ডালে চালে খিচুড়ি বসিয়ে ফুটিয়েছেন। ঐ দিয়েই আজ দুপুর পর্যন্ত চালিয়ে নিতে হবে সবার। একটা ঠিকা কাজের লোক রাখলে ভালো হতো। তবে অসুবিধা হচ্ছে আঠাশ হাজার টাকা বেতনের ছয় হাজার টাকাই যাবে কাজের লোকের বেতন দিতে। জারিফ এখনও বেকার,জাহিন বড় হয়েছে,সংসারের খরচ বাড়ছে। জারিফ যদিও খুব কমই নেয় জাহিদার থেকে,জোর করে দিলে তবেই নেয়। তবুও জাহিদা টাকা পয়সার খরচ বাড়াতে চাচ্ছে না কাজের লোক রেখে। দুই ছেলের জন্য সেভিংস করতে হবে। তার কাঁধে অনেক দায়িত্ব। জারিফের বাবা তো একটা বাড়ি ছাড়া অর্থ কিছুই রেখে যেতে পারেনি। ছেলে দু’টোকে বড় জাহিদা একা করেছে।
তবুও মাঝে মাঝে জাহিদার ইচ্ছে করে একটু আরাম করতে এই বয়সে। তাড়াতাড়ি রিটায়ারমেন্ট নিয়ে নিতে ইচ্ছে করে। নবম-দশম শ্রেনীর যে তিনটে ব্যাচ পড়ায় বাড়িতে সেগুলো বাদ দিয়ে দিতে ইচ্ছে করে। শরীর আর সায় দেয় না এসবে। যুবতী বয়সে শাশুড়ি ননদ স্বামীর মা’র খেতে খেতে শরীরটা এখন অকেজোই হয়ে গিয়েছে প্রায়। কখন হুস করে প্রান পাখিটা উড়ে যায় তা বলা যায়না। গত তিনদিন থেকে ব্লাড প্রেসার একটু হাই হয়ে ছিলো, তার ওপর গতকাল রাতের পর মনটা কোনো কারনে বেশ বিক্ষিপ্ত হয়ে আছে জাহিদার। মনটা কিছুতেই শান্ত হচ্ছে না,অস্থির লাগছে। মনে হচ্ছে একটা অঘটন ঘটে গিয়েছে।
জাহিদাকে এভাবে একা টিচার্স রুমে বসে থাকতে দেখে একজন সহ শিক্ষিকা ভেতরে ঢোকে।
“কি জাহিদা আপা! অসুস্থ নাকি!”
জাহিদা নড়েচড়ে বসে। রিহানা ম্যাডামের দিকে তাকিয়ে হাসার চেষ্টা করে। বললো,”না আপা। বসুন।”
রিহানা বসে,জাহিদার দিকে তাকিয়ে বলে,“অসুস্থ দেখাচ্ছে আপনাকে।”
_আসলে বয়স হয়ে গিয়েছে তো আপা। শরীর টা আর আগের মতো সায় দেয়না পরিশ্রমে।
_কেন করেন পরিশ্রম। দু দু’টো ছেলে আপনার, বিয়ে করিয়ে ঘরে বৌ নিয়ে আসুন। সেবা যত্ন করবে।
জাহিদা হাসে। রিহানা ম্যাম বলতে থাকে,”জারিফের চাকরির কি খবর? হলো কিছু?”
_ঐ তো,সব যায়গা থেকে ইন্টারভিউয়ের জন্য ডাক আসছে।
_বেশ,ভালোয় ভালোয় একটা চাকরি পেয়ে গেলেই হয়। তারপর বিয়ে করিয়ে দেবেন ছেলেকে।
_হু। দোয়া করবেন। আমার ছোটো বোনের মেয়ে অরিনকে তো চিনেন?এই স্কুলের ছাত্রী ছিলো,এস.এস.সি. ২০১৮ ব্যাচ। এখন একাউন্টিং নিয়ে পড়ছে, দ্বিতীয় বর্ষে আছে। ওকে পছন্দ করে রেখেছি জারিফের জন্য।
রিহানা এদিক ওদিক তাকিয়ে নিচুগলায় বলে,”জারিফের অন্যত্র রিলেশন আছে নাকি তা না জেনেই পছন্দ করে ফেললেন?”
জাহিদা চিন্তিত ভঙ্গিতে রিহানার দিকে তাকায়,বলে,”বুঝলাম না আপা।”
_আসলে প্রায়ই জারিফের সাথে একটা মেয়েকে দেখি,সার্কিট হাউসে। স্টাফ কোয়ার্টারের দিঘির পাড়েও দেখেছি বেশ ক’দিন। ভেবেছি হয়তো প্রেমিকা। মেয়েটি সুন্দর, দু’জনকে ভালোই লেগেছে একসাথে।
জাহিদা আনাম রিহানার দিকে দীর্ঘসময় তাকিয়ে থেকে তার ভ্যানিটি ব্যাগ থেকে ফোনটা বের করে। অনেক খুঁজে খুঁজে দোলার একটা ছবি বের করে রিহানার সামনে তুলে ধরে বলে,”আপনি কি এই মেয়েটার কথা বলছেন আপা!”
_হ্যা হ্যা। এই মেয়েটাই তো। আপনি একে চিনেন নাকি!
ধাক্কাটা সামলে উঠতে জাহিদার বেশ কিছুক্ষণ সময় লাগে। তার সমস্ত শরীর ভেঙেচুরে যাচ্ছে। রিহানা অবাক হয়ে বলে,”কি হলো আপা। শরীর খারাপ লাগছে নাকি! আর এই মেয়ে কি হয় জারিফের!”
জাহিদা ঝাপসা চোখে রিহানার দিকে তাকায়। কাঁপা কাঁপা গলায় বলে,”ও জারিফের ফুপাতো বোন। আর কিচ্ছু না।”
★★★
দুপুরের সময়। অলসতায় চোখ দুটো লেগে যাচ্ছে বারবার। বইটা বুকের ওপর নিয়ে চিৎ হয়ে চুপচাপ শুয়ে আছে। ইউরার অর্ধবার্ষিক পরিক্ষা শেষ,দোলারও পরীক্ষা সামনে তাই পনেরো দিনের জন্য ফারিনের সাথে কথা বলে এই টিউশনি টা বন্ধ রেখেছে, অথচ পড়াশোনা কিছুই হচ্ছে না। সারাদিন ঝিম মেরে রুমে বসে থাকে।
তৃতীয় বারের মতো ফোন বেজে ওঠে। দোলা বিরক্ত হয়ে ফোনটা হাতে তুলে নিয়ে রিসিভ করে কানে ধরে। ওপাশ থেকে দবির রহমান বলে ওঠে,”ব্যস্ত নাকি তুমি!”
_না পড়ছিলাম। বলো।
_তা তোমার পরিক্ষা কবে? ডেট দিয়েছে?
_হঠাৎ আমার পরিক্ষা নিয়ে পরলে যে আব্বু। ব্যাপার কি!
_তোমার জন্য একটা সম্বন্ধ এসেছে। সেটা নিয়েই আলোচনা করতে চাই তোমার সাথে।
_মানে! সেদিন না বললাম আমি বিয়ে করবো না এখনি। আবার কেনো!
দোলা কিছুটা উঁচু গলায় বলে ওঠে।
_শোনো আগে কথাটা, বেশ ভালো ঘর থেকে সম্বন্ধ এসেছে। ছেলে কোনো ইন্টারমিডিয়েট পাশ কসমেটিকসের দোকানদার না। ছেলে উচ্চ শিক্ষিত,ঢাকায় পড়াশোনা করেছে…..
_থামো থামো আব্বু। তুমি ভেবেছো আমি প্রস্তাব গুলো ফিরিয়ে দিই শুধুমাত্র পাত্র দোকানদার আর অল্পশিক্ষিত থাকতো বলে?
_তবে? অন্য কোনো কারণও তো তুমি বলো নি। পড়াশোনা করতে চাও,করবে পড়াশোনা। এই ছেলে পড়াবে তোমাকে। দিয়ার বিয়েটা আটকে আছে তোমার জন্য,আসিফ বিয়ের অনুমতি পেয়েছে। তুমি এখন এতো নটাঙ্কি করো না।
_তো দিয়ার বিয়ে নিয়ে সমস্যা? তো দিয়ে দাও না ওর বিয়ে। কে বারণ করেছে তোমাদের!
_তুমি অনুমতি দিলেই তো হয়ে যায়না মা। আমরা তো আমেরিকায় থাকি না, এই মফস্বলের সমাজে বড়বোনের আগে ছোটো বোনের বিয়ে হয়ে যাওয়া মানে বড়বোনের খুত আছে বলে ধরে নেয় লোকে। জীবিত থাকতে মেয়ের এতো বড় ক্ষতি তো করতে পারবো না। ভালোয় ভালোয় তোমার বিয়েটা দিয়ে তবেই দিয়ার বিয়েটা দেবো।
_মেয়ের ক্ষতি চাওনা? তো মেয়েকে জোর করে যার তার গলায় ঝুলিয়ে কোন উপকার করতে চাও মেয়ের?
_গলা নামিয়ে কথা বলো, একেবারে মায়ের মতো বেয়াদব হয়েছো। মুখ চালাতে জানো। সবাই খুব একটা খারাপ বলে না, মায়ে মান ঝি!
আচমকাই দোলার দু’চোখ ভিজে ওঠে। সে চুপ হয়ে যায়। দবির বলতে থাকে,”যার তার গলায় ঝোলাবো কে বললো তোমাকে? আমাকে কি এতো অবিবেচক মনে হয়? উপজেলা চেয়ারম্যান তৌকির আহমেদের ছোটোভাই তার বাবাকে দিয়ে তোমার ছোটো চাচার কাছে প্রস্তাব দিয়েছে বিয়ের। যার তার গলায় ঝুলবে না, সারাজীবন রানী বানিয়ে রাখবে তোমায়!”
দোলা ভীষণ অবাক হয়। গলার কাছে দলা পাকিয়ে থাকা কান্না দমিয়ে ফেলে বলে ওঠে,”কার কথা বললে?”
_ছেলের নাম শেখ তৌসিফ আহমেদ। তৌকির আহমেদের ছোটোভাই। ঢাকা থেকে পড়াশোনা শেষ করে বরগুনা এসে বাপের ব্যাবসা সামলাচ্ছে। তোমাকে পছন্দ করেছে। আজ বিকেলে তৌকির আহমেদ নিজে আসবেন আমার সাথে কথা বলতে,ফোনে বললো….
দোলা আর কিছু না শুনেই ফোন কে’টে দেয়। কিছুক্ষণ বিছানায় নিষ্প্রভ হয়ে বসে থেকে উঠে দাঁড়ায়। তারপর আলমারি থেকে একটা শপিং ব্যাগ বের করে । রেডি হয়ে সে নিচে নেমে একটা রিকশা দাড় করায়। রিকশা ওয়ালা দোলার গন্তব্যের ঠিকানা জানতে চাইলে দোলা বলে,”উপজেলা চেয়ারম্যানের বাড়িতে যাবো।”
★★★
শেখ বাড়িতে উৎসব উৎসব ভাব। তৌকির-তৌসিফের বাবা তৌফিকুল আহমেদ সপ্তাহখানেক আগে তামিলনাডু থেকে ফিরেছেন চিকিৎসা নিয়ে। তার আসা উপলক্ষে বাড়িতে রাজ্যের মেহমান এসেছে।
তন্ময় আহমেদ,এ বাড়ির মেজো ছেলে স্ত্রী পুত্র নিয়ে এসেছে বরিশাল থেকে। সে তৌকিরের থেকে তিনবছরের ছোটো এবং তৌসিফের থেকে সাত বছরের বড়। বরিশাল ব্রজমোহন কলেজের প্রফেসর তন্ময় , পরিবার নিয়ে সেখানেই থাকে। তৌসিফেরা পাঁচ ভাইবোন, তৌকির, তন্ময়, তৌসিফ,তানিয়া,তারানা। তৌসিফের ভাই বোন সবার বিয়ে হয়েছে। শুধুমাত্র তৌসিফ বাকি ছিলো। তৌসিফই বিয়েতে আগ্রহ দেখাতো না। বাড়ির সবাই এতোদিন চুপ ছিলো, কিন্তু শেখ তৌসিফ আহমেদ পড়াশোনা শেষ করে আঠাশে পা রাখতে না রাখতেই তৌকির আহমেদের ভাইয়ের বিয়ে নিয়ে মাথা ব্যাথা শুরু হয়ে গিয়েছে। বেশ খোজ খবর লাগিয়েছিলো ঢাকায় তৌসিফের কোনো গার্লফ্রেন্ড আছে কিনা এটা জানতে। কিন্তু সেরকম কিছু জানা যায়নি। বাড়ির ছোটো ছেলেকে নিয়ে সবার একটু অন্যরকম আশা। পাত্রী দেখাও শুরু করেছিল সবাই।
হুট করেই একদিন বড় ভাবী ফারিনের কাছে তৌসিফ সরাসরি জানিয়ে দিলো দোলাকে তার ভালো লেগেছে,বিয়ে করতে চায়। সবাই প্রথমে অবাক হয়েছে কিছুটা। পরে চিন্তা করে দেখলো দোলা তৌসিফের উপযুক্ত। অসম্ভব সুন্দরী, চব্বিশ বছর বয়স, বয়স অতি অল্প নয়-বেশিও নয়, একেবারে ঠিকঠাক। সবথেকে বড় কথা দোলার মতো শান্তশিষ্ট ভদ্র মেয়ে খুব কমই দেখা যায় আজকালকার দিনে। তাই সামাজিক অবস্থান নিয়ে মাথা না ঘামিয়েই সবাই একবাক্যে খুশি মনে তৌসিফের পছন্দকে মেনে নিয়েছে। এর মাঝে তৌসিফের বাবা তৌফিকুল আহমেদ ইন্ডিয়া চলে যায়। সিদ্ধান্ত হয় সে ফিরলেই বিয়ের কথা আগাবে। হলোও তাই, তৌফিকুল আহমেদ ফেরার দিনই ফারিন গিয়ে শশুরকে বলে,“এবার তবে প্রস্তাব টা পাঠিয়ে দিন।”
শেখ বাড়ির সবাই ধরেই নিয়েছে সপ্তাহখানেকের ভেতরে বিয়েটা হয়ে যাবে। এই মফস্বলে শেখরা নামী লোক,বিত্তবান, তা কারো অজানা নয়। দোলার পরিবার নিশ্চয়ই এক বাক্যে রাজি হবে এই প্রস্তাবে। তাই এখন থেকেই তারা প্রস্তুতি শুরু করেছে বিয়ের। তানিয়া আর তারিন তো শশুরবাড়ি থেকে আগেভাগেই চলে এসেছে।
ল্যাপটপে কিছু হিসেব দেখছিলো তৌসিফ। হঠাৎ ইউরা এসে দরজার বাইরে থেকে ডাকে,”চাচ্চু!”
তৌসিফ মাথা তুলে তাকায়।
“কিছু বলবি?”
_মা তোমাকে ডেকেছে।
তৌসিফ ল্যাপটপ রেখে পাশ থেকে টি-মগ টা তুলে উঠে দাঁড়ায়। সোজা হেঁটে ভাই ভাবীর ঘরে যায়। ফারিনের ঘরে তৌসিফের মেজো ভাবী শান্তাও ছিলো। দুই ভাবী তৌসিফকে দেখে মজার ছলে বলে ওঠে,”এখনই ঘরকুনো হয়ে গিয়েছো! বৌ আসলে তো সপ্তাহে একদিন ঘর থেকে বেরোবে ভাই!”
ভাবীদের মস্করায় তৌসিফ নির্বিকার। গম্ভীর হয়েই বললো,”কিছু হিসেব দেখছিলাম। বলো!”
শান্তা খানিকটা খোঁচা মেরেই তৌসিফকে বলে,”ভেবেছিলাম ঢাকা থেকে এ বাড়ির ছোটো বৌ আসবে। কিন্তু দেখছি তুমিও তোমার ভাইদের মতো বাড়ির পাশের নদীতেই ডুবলে!”
তৌসিফ বাঁকা হাসি হাসে। শান্তা বলতে থাকে,”এভাবে বিয়ে করবে বুঝতে পারিনি। কিছুদিন প্রেম করে নিতে পারতে। একটু বাজিয়ে দেখতে।”
_আমার যা দেখার দেখে নিয়েছি।
ঠান্ডা গলায় জবাব দেয় তৌসিফ।
শান্তা মজার ছলে বলে,”তাই নাকি! তা কি কি দেখালো? মুখটা তো ওড়নার নিচেই থাকে।”
ফারিন শান্তাকে থামিয়ে তৌসিফকে বলে,”তোমাকে ডেকেছি এক জরুরি কাজে ভাই। আমার শাশুড়ি মায়ের যা গয়না তার ছোটো ছেলের বৌয়ের জন্য রেখে গিয়েছে তার বাইরে আর কি কি গড়াতে দেবো! একটা লিস্ট করছি। তুমি একটু দেখবে?”
_লিস্ট দেখার প্রয়োজন নেই। যা যা দিয়ে অলংকৃত হওয়া যায় সব লাগবে। তবে সবকিছুই বেস্ট আর ইউনিক হতে হবে, তৌসিফের পছন্দের মতো ইউনিক!
চলমান…..