#ছায়া_সঙ্গিনী
#পর্ব-০২
#Israt_Bintey_Ishaque(লেখিকা)
পিছনে ফিরে তাকাতেই লক্ষ্য করলাম, ছায়া মানবটা রাহাত! চাঁদের আলোয় স্পষ্ট ই বোঝা যাচ্ছে তার অবয়ব।আর এমনিতেও পরিচিত মুখশ্রী অন্ধকারে ও অবলোকন করা যায়,আর এ তো রাহাত।হ্যা সেই রাহাত যে দুই বছর আগে একটা মেয়েকে হাজারো স্বপ্ন দেখিয়ে, খুবই নিচ মন মানসিকতার পরিচয় দিয়েছিল! সেই রাতের দৃশ্য টা এখনো মনের কোণে জমে আছে।যখন মেয়েটা মেহেদী নিয়ে বসেছে, নিজের হাতে খুব সুন্দর করে”R”অক্ষরটা সাজিয়ে তুলবে। পাশের বাড়ির শিরীন নামের মেয়েটি হাত দেখে পরিকল্পনা করছে, মেহেদীটা কিভাবে দিলে সেই ছোট্ট হাত টা আকর্ষণীয় হয়ে ফুটে উঠবে। তখনই পাশের রুম থেকে মেয়েটির বাবার উচ্চ কন্ঠস্বর শুনতে পাওয়া যায়। সবকিছু ভুলে, সবাই কে চুপ থাকতে বলে কান খাড়া করে ওপাশের কথাপোকথন শুনার জন্য। কিন্তু তেমন কিছুই বুঝতে পারে না, না বুঝেই মনের মধ্যে অজানা ভয় জেঁকে বসে।এই আনন্দ মুখর পরিবেশে, হঠাৎ করেই ঝরের পূর্বাভাস যেন জানান দিচ্ছে!
শিরীন তারা দিয়ে বললো,
– আপু মেহেদী দেওয়া শুরু করি? অনেক রাত হয়ে যাচ্ছে,আম্মা আবার আমাকে নিতে আসবো।
শিরীনের তারা দেখে, মেয়েটা হাত বাড়িয়ে দিল। তখন শিরীন কোণ আকার মেহেদীটা দুই হাত দিয়ে চেপে নরম করে নিল,যাতে করে দেওয়ার সময় মেহেদী শক্ত হয়ে না থাকে। তারপর হাতের কব্জিতে রেখা টেনে যেই সাজ তুলবে অমনি হুড়মুড় করে দৌড়ে আসে রাশিদা!এসেই নিজের মেয়ের হাতে মোবাইল ধরিয়ে দেয়। মেয়েটা মায়ের এরকম আকস্মিক কর্মকান্ডে হতভম্ব হয়ে তাকায়। মোবাইলে এক নজর তাকাতেই লক্ষ্য করলো, রাহাত এর নাম্বারে ডায়াল করা হয়েছে।এর মধ্যে শিরীন মেহেদী দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। রাশিদা মেয়েকে চিন্তিত স্বরে বললো,
– রাহাতের লগে কতা কইয়া দেক,তারা কয় বিয়া করতে আইতো না!
মায়ের এরকম অদ্ভুতুড়ে কথায়, চক্ষু বিস্ফোরিত হয়ে আসে। সাথে কথা বাম হাতের বৃদ্ধাঙ্গুল দিয়ে, মোবাইলের লাল বাটনে ক্লিক করে। তারপর নিজেকে ধাতস্থ করে বললো,
– আম্মু এসব কি বলছো তুমি? কারা আসবে না বলছো?
মৃদু হেসে বললো,
– তুমি এটাই তো বলছো তে রাহাত বিয়ে করতে আসবে না! তাইতো?
তা হয় না আম্মু, অন্যান্য ছেলেদের সাথে রাহাত কে গুলিয়ে ফেলেছো তুমি।
রাশিদা এবার শান্ত হয়ে মেয়ের পাশে বসে বলা শুরু করলো,
– রাহাতের মামু ফোন করছে তোর আব্বুর কাছে, তিনি কইতাছেন কাবিনের টাকা কতো দিতে চান আপনারা? তোর আব্বু তহন কইলো,আমাদের এখানে তো সচরাচর পাঁচ লাখ করা হয়।
তহন রাহাতের মামু কয়, আমরা এক লাখ করতে চাই কাবিন। এতে যদি রাজি থাকেন তাইলে আমরা কাইল ছেলে নিয়া আমু নতুবা আমু না! তখন তোর আব্বু বললো, আপনাদের কি এটাই সিদ্ধান্ত?আর বাড়াবেন না?
তখন তিনি বললেন “না”।
আয়রা মা তুই একটু রাহাতেরে ফোন কইরা দেখ ও কি চায়।
মায়ের কথা গুলো এতো সময় যাবত মনোযোগ দিয়ে শুনছিল মেয়েটা। তার মধ্যে যেন কথা বলার বাকশক্তি হারিয়ে গিয়েছে। তা-ও যথেষ্ট বিশ্বাসের সাথে মাকে বললো,
– মা রাহাত ওরকম ছেলেই না,যে কাবিনের টাকা নিয়ে দরকষাকষি করবে। তুমি দেখ আমি এক্ষুনি রাহাত কে কল করছি।
তৎক্ষণাৎ কল করলো রাহাতের ফোন নাম্বারে। প্রথম বার ডায়াল হতেই কল রিসিভ করলো রাহাত। মেয়েটা খুব নম্র, শান্ত কন্ঠে বললো,
– আসসালামু আলাইকুম।
শুনলাম মামা আব্বুকে কল করে বললো, কাবিনের টাকা বাড়াতে পারবে না বলে আগামীকাল আসবে না তোমাকে নিয়ে! তুমিও কি তাই চাও?
কলের ওপাশ থেকে রাহাত বললো,
– আসবো না, এমনটা নয়। তবে এর বেশি হলে সামনে আগাতে পারবো না আমি!
– তুমি কি আমাকে টাকাটা এক্ষুনি দিয়ে দিচ্ছো? দিচ্ছ না তো, আমিও তো তোমার থেকে টাকাটা চাচ্ছি না বলো। তুমি শুধু মুখে বলে দাও।
– আমার সামর্থ্যের বাহিরে হয়ে যায়।
মেয়েটা আর ধৈর্য ধরে, কথা চলমান রাখতে পারলো না।কলটা কেটে মায়ের হাতে মোবাইল ধরিয়ে দিয়ে,বেসিং থেকে হাত ধুয়ে নিল। শিরীন মেয়েটা প্রথমে কিছু না বুঝলেও, এতোক্ষণে সবটা পানির মতো ক্লিয়ার হয়ে গেছে। তখন বাহিরে থেকে মায়ের ঢাক শুনতে পেয়ে বুঝতে পারলো মা তাকে নিতে এসেছে,তাই রাশিদা কে বললো,
– চাচি, আমায় নিতে আসছে আমারে। আমি যাই।
রাশিদার সম্মতি পেতেই শিরীন চলে গেল তার মায়ের সাথে। এদিকে রাশিদা চোখের পানি বিসর্জন দিতে দিতে, আগামীকালের ভয়াবহ দৃশ্য টা ছক কষছে।গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে ছড়িয়ে যাবে ঘটনাটা, সবাই বলবে ওমকের মেয়ের বিয়ে ভেঙে গেছে। অনেকে বাড়ি ভয়ে এসে জিজ্ঞাসা করবে, কেন বিয়ে ভেঙে গেল? মেয়ের কি কোন দোষ ছিল!আর যারা জানবে না তারা সাজগোজ করে বিয়ের নিমন্ত্রণ খেতে আসবে।
এতো সব যন্ত্রনা কি করে সহ্য করবে, এই পরিবারের সদস্যরা? তাই ভোরের আলো ফোটার আগেই,গ্রাম ছেড়ে শহরমুখী হতে হয় পরিবার’টাকে।যাকে একপ্রকার পালিয়ে যাওয়া বলে।
_______
আর সে মেয়েটি আর কেউ নয়, বরং আমি আয়রা মেহেনূর! সেদিনের ধাক্কাটা ছোট্ট মনে সামলাতে পারিনি আমি।যাকে বলে পাথরে পরিণত হওয়া,হ্যা সেই আমি পাথর মানবে পরিনত হয়েছি।
বর্তমানে,
রাহাত একটু একটু করে এগিয়ে আসছে আমার দিকে!যার ফলে ঘৃণায় আঁখিপল্লব দুটো জ্বলজ্বল করছে।পারি না চক্ষু দিয়েই জ্বালিয়ে দেই সবকিছু।
রাহাত কাছাকাছি এসে আচমকা আমার বাম হাত টেনে ধরে! আমি ছাড়িয়ে নিতে চাইলে,আমার হাতের কব্জিটা শক্ত করে চেপে ধরে।যার ফলে নাড়াচাড়া করার শক্তি টুকু অবশিষ্ট থাকে না।
রাগে ফুঁসতে থাকি আমি, তখন সামনে থাকা লোকটার শান্ত কন্ঠস্বর শুনতে পাওয়া যায়,নরম স্বরে বললো,
– অন্যের সাথে রাগ করে, সবসময় নিজের ক্ষতি কেন করো? এতে কি শান্তি পাও তুমি?
লোকটা বলতে বলতে, হাতের কাটা স্থানে কুলজম ঔষধ টা লাগিয়ে দিল। এতে করে আমার শরীরের অবশিষ্ট শক্তিগুলো ও নিস্তেজ হয়ে গেল। দাঁত খিচুনি দিয়ে,জ্বলে যাওয়া ব্যাথাটা সহ্য করে যাচ্ছি।”কুলজম”হার্বাল বেদনা প্রশমক,জীবাণুনাশক বায়ু নিঃসারক ও শান্তকারক ঔষধ,যা অনেক গুলো রোগের প্রাথমিক চিকিৎসা হিসেবে কাজ করে। তবে ক্ষত স্থানে প্রয়োগ করলে প্রচুর জ্বালাপোড়া করে। কিন্তু খুব ভালো কাজ করে এতে।
আমার স্থানে অন্য কোন মেয়ে হলে এতোক্ষণে কেঁদে কেটে বাসাতো। কিন্তু আমি কাঁদবো না, কখনোই না। চোখের পানি সেদিন ই ফুরিয়ে গিয়েছিল যেদিন, চোখের সামনে আম্মুর নিথর দেহটা দেখেছিলাম!
আমরা যখন নারায়ণগঞ্জে চলে যাই,এর কয়েক মাস পর আম্মু খুব অসুস্থ হয়ে পরে।ডাক্তার দেখানো হলে,ডাক্তার বলেন আম্মু ভিতরে ভিতরে খুব দুশ্চিন্তা করেন।যার ফলে আম্মুর ব্রেনে আঘাত করছে। সবাই মিলে অনেক বুঝিয়ে ও আম্মু কে শান্ত করতে পারিনি আমরা। গ্রামের সহজ সরল মহিলা ছিল আমার আম্মু। এতো কিছু হয়ে যাওয়ার পরেও আমাকে বলতো,
– রাহাত কে ফোন করে দেখ না একটু, রাহাত যদি যদি তোরে এহন মাইনা নেয়।
আম্মুর এরকম কথা শুনে নিজের রাগ কে শংবরন করতে কষ্ট হয়ে যেত আমার। তাই সব রাগ আম্মুর উপর ঝারতাম। আফসোস এখন আর সেই মানুষটা কে কোথাও খুঁজে পাবো না।
_________
গ্রামের বাড়ি বলে, একতলা দালান টা চারিদিকে গাছপালায় ছেয়ে আছে। শুধু ছাদের জন্য মধ্যখানটায় গাছের আনাগোনা নেই।আর তাই মধ্যখানটাই চাঁদের আলোয় আলোকিত হয়ে আছে, মাঝে মাঝে কিছু তাঁরা চেয়ে দুজন মানব মানবীর দিকে। হয়তো চাঁদ মামা অব্যক্ত ভাষায় বলে চলেছে,”এই ছোট মন মাসিকতার লোকটার সাথে এখনো একই ছাদে দাঁড়িয়ে আছিস কিভাবে তুই”? চলে যা নিজের ঠিকানায়, কখনো এমুখী হসনে আর।
চাঁদের অব্যক্ত ভাষা মনে মনে আলোরন করে, ছিটকে হাত সরিয়ে নিলাম। তারপর দ্রুত পায়ে এগিয়ে গেলাম ছাদের দরজার কাছে, দরজায় হাত রাখতেই বুঝতে পারলাম ভিতর থেকে লক করে রাখা! কয়েকবার করাঘাত করলাম, কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হলো না।
রাহাত এসে দরজায় কড়াঘাত করলো।যা দেখে বললাম,
– কাউকে দিয়ে বন্ধ করে, এখন নাটক করছো কেন? আমার সাথে একদম নাটক করবে না বলে দিচ্ছি।
রাহাত প্রশান্তির হাসি হেসে বললো,
– সব কিছু পাল্টে গেলেও তুমি সম্বোধনটা পাল্টায়নি।”আলহামদুলিল্লাহ”।
লোকটার কথা শুনে ইচ্ছে করছে, অট্টহাসিতে ফেটে পরি। কিন্তু তা তো ইসলামে নিষিদ্ধ,তাই হজম করে নিয়ে বললাম,
– একজন প্রকৃত মুসলিম কখনো তার কথার খেলাপ করে না।
রাহাতের সাথে বিয়ে ঠিক হওয়ার আগের দিন বিকাল বেলা, রাহাত আমাকে প্রমিস করিয়ে নেয়, আমি যেন তাকে “তুমি” বলে সম্বোধন করি।আর তাই কথা রাখতে আজও তুমি করেই বললাম।
মাথা নিচু করে,ধরা গলায় রাহাত বললো,
– তাহলে তো আমি প্রকৃত মুসলিম নই তাই না? আমি তো প্রিয় মানুষটিকে খুশি করার কথা দিয়েও রাখতে পারিনি।
লোকটার কথা এই মুহূর্তে বিশের মতো লাগছে,তাই দরজায় পর পর কয়েকটা করাঘাত করলাম। শেষে ধৈর্য হারা হয়ে ছাদের দক্ষিণ পাশে রেলিং গেসে হাঁটু ভাঁজ করে বসে পড়লাম। এতোক্ষণে হাতে খেয়াল করে দেখলাম,ব্যান্ডেজে মুরিয়ে দেওয়া হয়েছে। ইচ্ছে করছে এক টানে খুলে ফেলে দেই, এখন বাহিরের ক্ষত শুকাতে আসছে। মনের ক্ষত স্থান টা যে আজো জ্বলে পুড়ে ছারখার হয়ে যায়,সে খবর তো রাখার কেউ নেই।এই মুহূর্তে ইচ্ছে করছে সুস্থ হাতটা ও ফাটিয়ে দেই!
আমি রাগ করে কখনো ঘরের জিনিসপত্র ভাঙচুর করি না,যা করি নিজেকে করি।কেউ যদি সূক্ষ্ম ভাবে আমাকে খেয়াল করে তাহলে দেখতে পাবে আমার হাত পায়ে কতো কাঁটার চিহ্ন বিদ্যমান রয়েছে।
ফেইস ব্যতিত রাগ গুলো হাত পায়ের উপর চালান করি আমি। এটাই অন্যদের সাথে আমার ভিন্নতা।
আমার থেকে দুই হাত দুরত্ব বজায় রেখে, রাহাত এসে বসলো। এতে কোন ভাবান্তর দেখলাম না আমি।
আকাশের দিকে প্রানভরে নিঃশ্বাস নিয়ে রাহাত বললো,
– তোমার বাসায় গিয়েছিলাম আমি, নিজের ভুল স্বীকার করে, তোমাকে নিজের করে নিতে! কিন্তু ততক্ষণে তোমাদের বাসায় মস্তবড় তালা ঝুলছে!,,,,,,
#চলবে ইনশা আল্লাহ।
(আসসালামু আলাইকুম।
আচ্ছা রাহাতের এতো বড় ভুলের পরও কি রাহাত কে মাফ করে দেওয়া উচিৎ?
আপনাদের মূল্যবান মতামতের আশা করছি।)