ছায়া সঙ্গিনী পর্ব ১৯

0
645

#ছায়া_সঙ্গিনী
#পর্ব-১৯
#Israt_Bintey_Ishaque(লেখিকা)

সূর্য মামা তার তেজস্ক্রিয় রশ্মি নিয়ে, ধীরে ধীরে ডুবে যাচ্ছে পশ্চিম দিকে।তাই এবার আমাদের বের হবার পালা।যাত্রা ছোট আপু মানে রাহাত এর ছোট বোনের বাসায়।তাই তৈরি হয়ে জিহানদের রুমে এসেছি।জিহান ঘুমরো মুখে বসে আছে আমরা চলে যাচ্ছি বলে।জামান কিছুক্ষণ আগে স্কুল থেকে ফিরলো।জিহান এর বড় ভাই জামান। এবার পঞ্চম শ্রেণীতে পড়ে, বেচারা সেই সকাল স্কুল, কোচিং, প্রাইভেট পড়ে ক্লান্ত হয়ে বাসায় ফিরেছে। কিন্তু বিশ্রাম না নিয়ে আমাদের পিছু পিছু ঘুরছে যেন আমরা না যাই। ওদের এরকম কান্ড দেখে আমার খুব মায়া হলো তাই রাহাত কে বললাম,
– আজকে থেকে যাই ওরা এতো করে বলছে, আমার খুব খারাপ লাগছে ওদের ছেড়ে চলে যেতে।

রাহাত তখন ওদের কাছে গিয়ে আদুরে গলায় বললো,
– মামা আবার ছুটি পেলে তোমাদের মামি কে নিয়ে আসবো কেমন?জানো তো তোমাদের খালামণির বাসা থেকে আগামীকাল ঢাকায় ফিরে যেতে হবে।তোমরা মা শা আল্লাহ অনেক বিচক্ষণ বাবা আমার। তোমরা নিশ্চয়ই এখন বুঝতে পেরেছো মামার সমস্যা তাই না?

ওরা দুজন কিছুক্ষণ নিরব থেকে বললো,
– আচ্ছা ঠিক আছে, তবে আবার আসবে কিন্তু।

তারপর রাহাত ওদের কপালে চুমু এঁকে দিয়ে, দুজনের হাতে পাঁচশত টাকার দুটো নোট গুঁজে দিয়ে বললো চকলেট খাবে কেমন?
তারা বড়দের মতো করে বলো, না না আমাদের টাকা লাগবে না। ওদের দুজনকে দেখে আমার শৈশবের কথা মনে পড়ে গেল, আমার মামা,আন্টিরা যখন যাওয়ার সময় হাতে টাকা গুঁজে দিয়ে বলতো চকলেট কিনে খেও তখন এরকম ভাবে নিতে চাইতাম না। কিন্তু পরে ঠিকই অনেক খুশি হতাম।আর পরিকল্পনা করতাম কি কি ক্রয় করা যায় এই টাকা দিয়ে। শৈশবের স্মৃতি সত্যি ভুলার মতো নয়।
_______
অতঃপর, ছোট আপুর বাসায় এসে পৌঁছালাম। আপুর এক ছেলে এক মেয়ে।বড় মেয়েটা খুব কম কথা বলে, আমি আসার পর শুধু সৌজন্য মূলক সালাম দিয়ে কেমন আছি জিজ্ঞাসা করেছে। এছাড়া আমি কিছু জিজ্ঞাসা করলে বলে না হয় বলে না। ঠিক এরকম ছোট বেলায় আমিও ছিলাম। খুব শান্ত সিষ্ট, এর অনেকে প্রশংসা করতো আবার অনেকে আম্মুর কাছে বিচার দিতো। কেন কথা বলি না চুপচাপ বসে থাকি। আম্মুর ফোনে কল এসে কেটে যেত তাও রিসিভ করে কথা বলতাম না। এতে আম্মু খুব বকাঝকা করতো। তা-ও কথা কম বলতাম। কথা কম বললে মানুষ অহংকারী মনে করে, অথচ আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, চুপ থাকা পরিশ্রম বিহীন ইবাদত। আলহামদুলিল্লাহ।

আপুদের টিন সেট ঘর, কিন্তু টিন সেট হলেও খুবই সুন্দর। ঘরটায় সাতটা রুম!প্রত্যেকটা রুমে ফার্নিচার এ ভরপুর। একটা বিল্ডিং এর থেকে কোন অংশে কম নয়। শুনেছি দুলাভাই ব্যবসায় করেন, কিন্তু কিসের ব্যাবসায় আমার জানা নেই।

ছয় নাম্বার রুমটায় আমাদের থাকতে দেওয়া হয়েছে। খুবই সুন্দর রুমটা, গ্রামে এরকম ঘর হলে যান্ত্রিক শহরে যাওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। তবে একটাই সমস্যা গ্যাস সংযোগ নেই এখানে। না হয় সব কিছু দিয়ে শহর থেকে বেটার।

রাহাত জানালার পাশে দাঁড়িয়ে ফোনে কথা বলছে, মৃদু বাতাস প্রবেশ করছে জানালা দিয়ে তাই আমিও জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম। আমাকে দেখে রাহাত পিছনে চলে যায়, তার প্রশস্ত বুকের সাথে আমার পিঠ দূরত্ব বিহীন দাঁড়ায়। তারপর ধীরে ধীরে নিজের বাম হাতটা আমার পেটের উপর জায়গা করে নেয়। আমি জানালার গ্রিলে হাত রেখে বাহিরে তাকিয়ে আছি। চারিদিকে অন্ধকারে ডুবে আছে, চাঁদের আলো স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না তেমন। কাছের কয়েকটা গাছ দাঁড়িয়ে আছে,পাতা গুলো মৃদু দুলছে। রাহাত কথা বলা শেষ করে, আমার পিঠের চুল গুলো সাইটে সরিয়ে দেয়। তারপর, আমার গলায় তার ঠোঁট ছুঁয়ে দেয়। এবার দুই হাতে জড়িয়ে নিয়ে বললো,
– তোমার কি মন খারাপ?

আমি মাথা নাড়িয়ে না বোঝালাম। আমাকে তার দিকে ঘুরিয়ে বললো,
– তাহলে কথা বলছো না কেন?

আমি এবার তার গলা জড়িয়ে ধরে বললাম,
– আমার ছোট্ট বেবি চাই রাহাত! দেবে আমাকে বেবি? আমার খুব ইচ্ছে, আমার বেবি কে গর্ভে ধারণ করে, একটা মায়ের আনন্দ কষ্ট গুলো অনুভব করার। দিবে সেই অনুভব উপলব্ধি করার অধিকার?

রাহাত আমার গাল দুটো ধরে বললো,
– আয়রা মেহেনূর? আমাকে কি তোমার নিষ্ঠুর,পাষান মনে হয় বলো তো? এভাবে কেন বলছো তুমি? আমার ইচ্ছে হয় না আধো আধো কন্ঠে বাবা ডাক শোনার, একটা ছোট্ট শরীর’কে আদরে আদরে ভরিয়ে দেওয়ার। তাহলে এভাবে কেন বায়না ধরতে হবে আমার কাছে? কোন সুন্দর উপন্যাসের মতো করে, চাইলে তুমি তো আমাকে সারপ্রাইজ দিতে পারতে। কোন এক দিনে আমি যখন ক্লান্ত হয়ে অফিস থেকে ফিরতাম তখন তুমি লজ্জা মাখা কন্ঠে বলতে এই নাও তোমার সারপ্রাইজ! তখন ডাক্তারের দেওয়া রিপোর্ট টা খুলে দেখতাম আমি! রিপোর্ট টা দেখে পৃথিবীর সমস্ত সুখ অনুভব করতাম আমি। তোমাকে আদরে আদরে পাগল করে দিতাম। তোমার শরীরের যে স্থানে তার অস্তিত্ব ধীরে ধীরে প্রকাশ পাচ্ছে সেখানে কান পেতে তার অস্তিত্ব বোঝার চেষ্টা করতাম আমি।আর কিছু বলতে হবে এই ব্যাপারে?

আমি মুচকি হেসে জরিয়ে নিলাম তাকে, তার লোমশ বুকে অধর দুটি ছুঁয়ে দিলাম। এই স্থানে যেন সর্ব সুখ নিহিত রয়েছে। এখানে থাকলে কোন কষ্ট ছুঁতে পারবে না আমায়।
সেও এক‌ই ভাবে জড়িয়ে নিলো আমায়। তারপর দুজন দুজনাতে মত্ত হয়ে গেলাম। সর্ব সুখের ভেলায় ভাসতে ভাসতে ঘুম নামক আরেকটি সুখে পারি দিলাম।
______
মাঝ রাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে গেল আমার। খুব বড় দুঃস্বপ্ন দেখার কারণে। রাহাত গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে আছে, তাই ডাকলাম না। তাছাড়া খারাপ স্বপ্ন কাউকে বলতে নেই।
আমি দ্রুত উঠে বসলাম।বাম পাশে থুতু নিক্ষেপ করে, আল্লাহ তা’আলার নিকট শয়তানের অনিষ্ট হতে আশ্রয় প্রার্থনা করলাম।
আবু কাতাদাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন:

“ভালো স্বপ্ন আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে হয়ে থাকে আর খারাপ স্বপ্ন হয় শয়তানের পক্ষ থেকে। সুতরাং কেউ যদি ভীতিকর দু:স্বপ্ন দেখে তাহলে সে যেন বাম পাশে থুথু নিক্ষেপ করে এবং আল্লাহর নিকট শয়তানের অনিষ্ট থেকে আশ্রয় চায়। তাহলে শয়তান এই দু:স্বপ্ন তার কোন ক্ষতি করবে না।”
(সহীহ বুখারী, হাদিস নং-৬৫৮৩)

জাবের রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরো বলেছেন:

“যদি তোমাদের কেউ এমন স্বপ্ন দেখে যা সে পছন্দ করে না, তাহলে তিনবার বাম দিকে থুথু দেবে। আর তিন বার শয়তান থেকে আল্লাহ তাআলার কাছে আশ্রয় চাবে (অর্থাৎ আউজুবিল্লাহি মিনাশ শাইতানির রাজীম পাঠ করবে।) আর যে পার্শ্বে শুয়েছিল, তা পরিবর্তন করবে। (অর্থাৎ পার্শ্ব পরিবর্তন করে শুবে)।”
(সহীহ মুসলিম, হাদিস নং-২২৬১

আবূ হুরায়রা রা. হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরো বলেছেন:

“তোমাদের কেউ যদি অপছন্দনীয় কিছু স্বপ্ন দেখে তাহলে সে যেন উঠে সলাত আদায় করে আর মানুষের নিকট সে (স্বপ্নের) কথা গোপন রাখে।”
(সহীহ মুসলিম, হাদিস নম্বর: ৫৭৯৮ অধ্যায়ঃ হাদিস একাডেমি)

আবু সাঈদ খুদরী রা. হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরো বলেছেন:

“যখন কেউ ভাল স্বপ্ন দেখে-যা সে পছন্দ করে-তাহলে তা আল্লাহর পক্ষ থেকে। সুতরাং সে যেন এ ব্যাপারে আল্লাহর প্রশংসা করে (অর্থাৎ আল হামদু লিল্লাহ পাঠ করে) এবং তা মানুষকে বলে। আর যদি অন্য কিছু দেখে-যা সে অপছন্দ করে-তাহলে তা শয়তানের পক্ষ থেকে। সুতরাং সে যেন এর অনিষ্ট থেকে আল্লাহর নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করে এবং এটি কারো নিকট আলোচনা না করে। তাহলে তা তার কোন ক্ষতি করবে না।” (সহীহ বুখারী, হাদিস নং-৬৯৮৫, মুসনাদে আহমদ- ৭০৪৫)

অনেকে না বুঝে যার-তার কাছে স্বপ্নের বিষয় বলে বেড়ায়। এতে সে নিজেই নিজের ক্ষতির পথ প্রশস্ত করে। কেননা রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘স্বপ্নের ব্যাখ্যা যেভাবে করা হয়, সেভাবে তা বাস্তবায়িত হয়। তোমাদের কেউ যখন স্বপ্ন দেখে, সে যেনো আলেম বা হিতাকাঙ্ক্ষী ছাড়া কারো কাছে তা বর্ণনা না করে। (মুসতাদরাক হাকেম : ৪/৩৯১)

প্রখ্যাত স্বপ্নবিদ আল্লামা ইবনে সিরিন (রহ.) তাঁর বিখ্যান্ত ‘তাবিরুর রুইয়া’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন : ‘স্বপ্নের ব্যাখ্যাকারীদের জন্য কোরআনের তাফসিরের জ্ঞান, রাসুল (সা.)-এর হাদিস সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান, আরবি ও অনারবি বিভিন্ন ভাষার শব্দের বিবর্তন সম্পর্কে অবশ্যই জ্ঞান থাকতে হবে। স্বপ্নের ব্যাখ্যা জানার জন্য বুজুর্গ, সূক্ষ্ম জ্ঞানের অধিকারী ও সুসাহিত্যিক হওয়া জরুরি। এ ছাড়া যিনি স্বপ্নের তাবির বা ব্যাখ্যাদানকারী হবেন, তাঁর সার্বিক অবস্থা ভালোভাবে জানা থাকতে হবে। সব সময় সত্য পথে চলতে হবে। তাহলে আল্লাহপাক বিশেষ অনুগ্রহে তাঁকে সঠিক পথ প্রদর্শন করবেন। তাঁর জবান (মুখ) সত্য ও নেক হতে হবে। এর ফলে আল্লাহপাক তাঁকে বিশেষভাবে সাহায্য করবেন। তাঁর চিন্তাও হতে হবে সৎ ও স্বচ্ছ। খাবার হতে হবে হালাল। মোটেও অনর্থক কথা বলা যাবে না এবং সব ধরনের পাপ থেকে নিষ্কলুষ হতে হবে। তাহলে তিনি জ্ঞানী ও নবীদের প্রকৃত উত্তরসূরি হিসেবে গণ্য হবেন। সুতরাং যার তার কাছে স্বপ্নের বিবরণ বলার থেকে বিরত থাকুন।
________
এক সপ্তাহ পর,
মাকে সঙ্গে করে ঢাকায় ফিরে এসেছি আমরা।এখন থেকে আমি রাহাত মা এখানেই কোয়ার্টারে থাকবো। রাহাত অফিসে চলে গেছে,আর আমি পেট ব্যথায় কঁকিয়ে উঠছি খনে খনে। তবে আজকে পেটের ব্যাথা থেকে মনের ব্যাথাটা বেশি!যার কারণে চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে,,,,

#চলবে,,, ইনশা আল্লাহ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here