#ছায়া_সঙ্গিনী
#পর্ব-১১
#Israt_Bintey_Ishaque(লেখিকা)
সকালের স্নিগ্ধ আবহাওয়ায় শরীরে হালকা শীতের আবাস দিচ্ছে।তার উপর দক্ষিণ পাশের জানালা খুলে রাখা।হুরহুর করে স্নিগ্ধ ঠান্ডা বাতাস প্রবেশ করছে চার দেওয়ালের মাঝে। সাধারণ থ্রিপিস পরে আছি আমি, বোরকা খুলে রেখে দিয়েছে। বোরকা পরে তো এতো সময় থাকা যায় না তাই।স্যুপের ট্রে টা পাশে রেখে ওরনা টা পুরো শরীরে জড়িয়ে নিলাম। তারপর রাহাত কে বললাম,
– এখন কোন কথা না বলে খাবার খেয়ে নাও। তাড়াতাড়ি সুস্থ হতে হবে তো নাকি?
রাহাত মলিন মুখে বললো,
– তুমি যদি এভাবে আমার পাশে থাকো তাহলে আমি সারাজীবন এভাবেই অসুস্থ হয়ে থাকতে চাই!
রাহাত কে চোখ রাঙিয়ে বললাম,
– কিসব অলোক্ষুনে কথাবার্তা বলছো? আমাকে একদম রাগাবে না বলে দিচ্ছি।রাগলে কি করবো তুমি নিজেও জানো না কিন্তু।
– কি করবে শুনি?
আমি পুরো রুমটা একবার চেক করে দেখলাম, তেমন কিছুই চোখে পরলো না যেটা দিয়ে আমি আহত হতে পারি! এদিকে রাহাত বাঁকা হাসি দিয়ে ভ্রু নাচিয়ে বললো,
– কি বলো?
চট করে মাথায় বুদ্ধি এলো,তাই ফট করে বললাম,
– ঐ যে থাই গ্লাস দেখতে পাচ্ছো? সেখানে হাতটা ঢুকিয়ে গ্লাস টা বন্ধ করলে কেমন হবে বলো তো?
_________
মুহূর্তেই কারো মুখশ্রী জুরে আঁধার নেমে এলো। শুধু তাই নয় লোকটা এরকম কান্ড করবে আমার ধারণার বাহিরে ছিল।এই প্রথম রাহাতের জন্য নিজেকে খুব অপরাধী মনে হচ্ছে।যে মুখে কথা গুলো বলেছি সে মুখটা ঝলসে দিতে পারলে বেঁচে যাই যেন! কি দরকার ছিল এভাবে বলার? একটু সুন্দর করে বললেই তো ও খাবার টা খেয়ে নিত।
থাই গ্লাস নিয়ে কথাটা বলতেই রাহাত দাঁতে দাঁত চেপে ধরে নিজের কপাল থেকে সাদা ব্যান্ডেজ টা টান দিয়ে খুলে ফেলে!
চোখের পলকে কি থেকে কি হয়ে গেল! আমি ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে গেলাম। তখন মা কেবিনে ঢুকে দেখে সদ্য সেলাই করা স্থান থেকে গড়িয়ে র*ক্তের ধারা বইতে শুরু করেছে। আমার গলা দিয়ে কোন কথা বের হচ্ছিল না তখন, মনে হচ্ছিল কোনো অদৃশ্য শক্তি আটকে রেখেছে!মা হেঁচকা টানে বসা থেকে দাড় করিয়ে আমাকে বলে,
– বউ? তুমি আমার ছেলেরে কি কইছো অয় ক্যান এমন করলো? চুপ কইরা আছো ক্যান? তুমি তারে বাধ্য করছো এই কাম করতে?কতা কওনা ক্যান? আমার ছেলেডার র*ক্ত সব র*ক্ত যাইতাছে গা।অ আল্লাহ আমি কি করুম।
মায়ের আহাজারি শুনে ডাক্তার নার্স রাহাতের কলিগ সবাই দৌড়ে আসে।ডাক্তার সব কিছু রেডি করে আবার নতুন করে ব্যান্ডেজ করার জন্য। কিন্তু রাহাত তখন সবাই কে অবাক করে বলে, আমি ব্যান্ডেজ করবো না!
একজন আর্মি অফিসারের এই ধরনের কাজ তার উপর এই কথা শুনে সবাই হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমি আগের মতই ছলছল চোখে তাকিয়ে আছি, কিছুই বলতে পারছি না। গলাতেই সব দলা পাকিয়ে আছে।মা পাগলের মতো বুঝিয়ে চলেছে,
– বাপ আমার ডাক্তরের কতা হুন, এমন করতাছস ক্যান?
রাহাত তখন শক্ত কন্ঠে বললো,
– মা ওরে বলো এই ধরনের কথা দ্বিতীয় বার বলবে কিনা?ওর এই নিষ্ঠুরতা আমি নিতে পারছি না।এসব বাক্য যেন মুখে ও উচ্চারণ না করে, প্লিজ মা বলো ওরে।
সবাই তখন আমার দিকে আশ্চর্য হয়ে তাকিয়ে আছে,যেন আমি কোন খু*ন করেছি। মা আমার কাছে এসে,কাদ জাঁকিয়ে বললো,
– কি বলেছোস জানি না,এহন ক আর অমন কতা কবি না?
সবাই অধীর আগ্রহে তাকিয়ে আছে আমার দিকে আমি কখন সম্মতি দিব। আমি তখন মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিলাম কিন্তু রাহাত অস্থির হয়ে বললো, এভাবে বললে হবে না মুখে বলতে হবে। তখন ওর দিকে তাকিয়ে খুব কষ্ট করে বললাম,
– আর বলবো না ইনশা আল্লাহ।
তারপর ডাক্তার ব্যান্ডেজ করে দেয়। নার্স নতুন করে স্যুপ নিয়ে আসলে,মা খাইয়ে দেয় রাহাত কে। খাওয়ানোর পর নার্স মেডিসিন দেয়, সাথে ঘুমের ও।চাই রাহাত শান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পরে। ঘুমানোর আগে ঘুম ঘুম চোখে,সৈনিক সোহরাব কে বলে দেয় আমাদের খাবারের ব্যবস্থা করতে।আর তাই এখন খাবারের টেবিলে বসে আছি আমরা। সবাই খাবার খেলেও আমি খাচ্ছি না।গলা দিয়ে খাবার নামছে না যেন, জোর করে খেলে বুমি হবে তাই বসে বসে নাড়াচাড়া করছিলাম তখন মা বললো,
– বউ খাইতাছস না ক্যান?
– খেতে ইচ্ছে করছে না মা,মা আমি হাত ধুয়ে নেই?
তখন রাহাতের মামাতো ভাই দুজন খাবার খেতে খেতে বললো,
– ফুফু আমরা তাইলে চইলা যাই? জানোই তো দোকানে কতো কাম আছে। এদিকে তো তোমরা সবাই আছো রাহাতেরে দেখার জন্য।
মা সম্মতি দিলেন, তারপর তারা খাবার খেয়ে রাহাত কে দেখে ফিরে গেলেন গ্রামে।
_______
রাহাত গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে আছে, এখন চারিদিকের খবরাখবর নিয়ে তার কোন ভাবান্তর নেই। আমি খুব কাছে গিয়ে চেয়ার নিয়ে বসেছি। নিস্তেজ হয়ে পড়ে থাকা ডান হাতটা আমার হাতে তুলে নিলাম।শ্যাম বর্ণের হাতের নখ গুলো লম্বা আর খুব সাদা,বেশ সুন্দর মা শা আল্লাহ। আমার নখ গুলো ও সাদা তবে খুব ছোট ছোট।
হাতটা কিছুক্ষণ বুলিয়ে, খুব ইচ্ছে করছে ঠোঁট ছুঁয়ে দিতে! একবার রাহাতের দিকে তাকালাম, নাহ তার এই মুহূর্তে জেগে যাওয়ার কোন সম্ভাবনা নেই। তাই ঝুঁকিমুক্ত পরিবেশ দেখে গভীর ভাবে ঠোঁট ছুঁয়ে দিলাম হাতটাতে। কিছুটা লম্বা করে মুখশ্রী টা ফ্যাকাশে হয়ে আছে, গভীর ভাবে পর্যবেক্ষন করে দেখলাম বাম পাশে চোখের একটু দুরত্বে ছোট দাগ মনে হয় পিম্পল হয়েছিল এরকম। তারপর লক্ষ্য করলাম নাকের ডগায় ছোট্ট একটা তিল!যা দেখে মুচকি হাসলাম। শুধু তাই নয় শাহাদাত আঙ্গুল তুলে নেড়ে দিলাম। তারপর কপালের ক্ষত স্থান টা চোখে পরতেই, বুকটা যেন ফেটে চৌচির হয়ে যাচ্ছে। সকালে ব্যান্ডেজ টা খুলে ফেলার পর সেলাই গুলো কিরকম দৃশ্যমান হয়ে উঠে!যা মনে পরলে শরীর শিউরে উঠে।এই প্রথম বার রাহাত এতোটা ভয়াবহ ভাবে আমার সাথে রাগ দেখালো।ওর রাগের সাথে আমি পরিচিত নই,সব সময় ঠান্ডা মেজাজের মানুষ বলে দেখে এসেছি আমি।আর এই মানুষটা এভাবে রেগে যেতে পারে? সম্পূর্ণ ধারণার বাহিরে ছিল আমার।
আমার যখন রাহাতের সাথে বিয়ের কথাবার্তা হচ্ছে তখন আমার স্কুল ফ্রেন্ড মিলি বলেছিল,
– বান্ধবী জীবনেও এই কাজ করিস না, আর্মি পুলিশ এগুলো বিয়ে করলে কথায় রেগে যাবে।এরা প্রচুর রাগী বদমেজাজী হয়ে থাকে। তখন কথায় কথায় শুনতে হবে,আই কিল ইউ! তাছাড়া তোর অনেক রাগ, রাগে রাগে মিলে স্কয়ার হয়ে যাবে। তখন সারাদিন ঝগড়াই লেগে থাকবে সংসারে, ভালোবাসা বাসি আর হবে না।
তখন আমি বলেছিলাম রাহাত একদম শান্ত প্রকৃতির ছেলে,ওর মধ্যে কোন রাগ নেই।যদিও থাকে তাহলে আমি ম্যানেজ করে নিব। আল্লাহ চান তো এমনিতেই ভালোবাসা তৈরি হবে।
জানালায় হাত রেখে দূরের ঐ শুভ্র নীলাভ আকাশের পানে তাকিয়ে আছি। ভাবছি পুরোনো দিনের কথা। ভাইয়ার ছয় জন বন্ধুর মধ্যে একজন যে সবসময় নিরব দর্শকের মতো মাথা নিচু করে বসে থাকে,আর বাকিরা হই হুল্লোড় করে পুরো পিকনিক স্পট মাথায় তুলে নিয়েছে যেন। এতো কথাবার্তা ভালো লাগছে না বলে, সাইটে গিয়ে, সুইমিং পুলের কাছে গিয়ে বেঞ্চে বসে থাকি আমি। বসে বসে আপুর ফোন স্ক্রল করছি। হঠাৎ পায়ের কাছাকাছি একটা কালো সাপ দেখে!দিকপাশ না ভেবে দৌড় দেই যার ফলে সুইমিং পুলে গিয়ে পরি। আকস্মিক ঘটনায় বরকে যাই আমি,যার ফলে অল্প পানিতেই হাবুডুবু খেতে থাকি! মানে পানি থেকে যে উঠে দাঁড়াবো সেই জ্ঞান টুকু লোপ পায় আমার। তাছাড়া বোরকা পরা,হাতে আপুর মোবাইল,কাঁদে সাইট ব্যাগ,সব কিছু মিলিয়ে সুচনীয় অবস্থা আমার। আশেপাশের লোকজনের চেঁচামেচি শুনে আপু ভাইয়া তারা দৌড়ে আসে। তখন সবার প্রথমে রাহাত পানিতে নেমে আমাকে উপরে তুলে নিয়ে আসে।নাকে মুখে অনেক পানি ঢুকে যায়। তারপর নিকটবর্তী হাসপাতালে ভর্তি করে পানি বের করা হয়। পানির কারণে নিউমোনিয়া পর্যন্ত হয়ে যায় আমার। শেষে জানা যায় ভাইয়ার বন্ধু রাকিব প্লাস্টিকের সাপ দেখিয়ে আমাকে ভয় দেখায়,যেটা আমি সত্যি সত্যি সাপ মনে করি।এ নিয়ে রাকিব ভাইয়ার সাথে অনেক ঝামেলা হয় রাহাতের। বেচারা রাকিব ভাইয়া ও বুঝতে পারেনি এতো বড় ঘটনা ঘটে যাবে।
এরকম আরো কিছু ঘটনা ঘটে,এর থেকে আমাদের একে অপরকে পছন্দ করা। আব্বু প্রথমে রাজী ছিল না বিয়েতে। আম্মুর খুব পছন্দ হয় রাহাত কে, সেই প্রথম থেকেই আম্মু চাইতো রাহাতের সাথে যেন আমার বিয়ে হয়। আম্মুর ধারণা ছিল এরকম একটা শান্ত শিষ্ট ভালো ছেলে তার রাগী বদমেজাজী মেয়েটাকে আগলে রাখতে পারবে।
_________
দুপুরে রাহাত কে খাবার খাওয়াতে নিলে, রাহাত বললো সে মায়ের হাতে খাবার খাবে। এতে কিছুটা কষ্ট হলো আমার, কিন্তু মুখে কিছু না বলে মায়ের হাতে খাবার দিয়ে দিলাম। তারপর রাহাত দ্বিরুক্তি না করে খেয়ে নিল।
শুধু তাই নয় প্রত্যেক বেলা এভাবেই মায়ের হাতে খাওয়া শুরু করলো রাহাত। আমার সাথে তেমন প্রয়োজন ছাড়া কথাও বলে না।ওর ক্ষতটা একটু শুকিয়ে আসলে কোয়ার্টারে চলে আসি সবাই। আমি প্রতিদিন নিয়ম করে ক্ষত স্থান গুলো ড্রেসিন করে দেই।সময় মতো মেডিসিন দেই। রাহাত বাসায় বসে থেকেই ল্যাপটবে কাজ করে, ফোনে কথা বলতে শুনে বুঝতে পারলাম ও আবার সেই পার্বত্য চট্টগ্রাম দূর্গম এলাকায় যাবে।
পায়ের ক্ষতটা শুকিয়ে এসেছে, এখন ব্যান্ডেজ করতে নিষেধ করে দিয়েছে ডাক্তার। তাই অফিসে গিয়েই কাজ শুরু করে দিয়েছে।এর মধ্যে একদিন গিয়ে মাকে গ্রামে রেখে এসেছে।
আমাদের মাঝে এখন স্বাভাবিক সম্পর্ক চলছে,খাই দাই ঘুমাই এই আর কি। নির্ঘুম রাত,তাই বেলকনিতে দাঁড়িয়ে দূরের আকাশ দেখছি। তখন রাহাত এসে বসলো,
– ঘুমাবে কখন?
আমি অনিমেষ চাহনিতে বললাম,
– আমার কথা তাহলে মনে পরলো তোমার? সারাক্ষণ তো কাজ নিয়েই থাক।
রাহাতের এতে কোন ভাবাবেশ নেই,সে বললো অনেক রাত হয়েছে ঘুমাবে চলো। আর শোন আগামীকাল তোমাকে তোমার বাসায় রেখে আসবো। তৈরি হয়ে নিও।
এটুকু কথায় বাতাসের বেগে আমার আঁখিপল্লব দুটো জ্বলজ্বল করে উঠলো। তবুও আড়ালে পানি টুকু মুছে নিলাম। আজো কি বাবার বাসাই আমার বাসা?
_______
আমাকে বাবার বাসায় রেখে যাওয়ার সময় তার শেষাক্ত কথা,
– খুব করে অপেক্ষায় ছিলাম কখন তুমি ঘড়িটা পরে বাকিটা আমাকে পরিয়ে দিবে! এতো গুলো দিন একসাথে থেকেও তুমি এই কাজটা করলে না আফসোস।যদি মিশন থেকে বেঁচে ফিরে আসি তাহলে দেখা হবে। তারপর,,,,
#চলবে,,, ইনশা আল্লাহ।
#ছায়া_সঙ্গিনী
#পর্ব-১২
#Israt_Bintey_Ishaque(লেখিকা)
ঢাকা থেকে নারায়ণগঞ্জের উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছি, আমি আর রাহাত। গাড়িতে চুপচাপ বসে আছি দু’জনেই, কারো সাথে কোন কথা নেই। আচার ওয়ালা বাসে বরই আচার নিয়ে এলো, তখন আমি এক প্যাকেট নিয়ে খাওয়া শুরু করলাম।যা দেখে রাহাত লোকটার পাওনা টাকা মিটিয়ে দেয়। সাইনবোর্ড কাছাকাছি এসে অনেক জ্যাম শুরু একটুখানি পথ পার হতে পারলেই নারায়ণগঞ্জ এর রাস্তায় চলে যেতাম, এখন একটুর জন্য বসে আছি কেমন লাগে?
অতঃপর জ্যাম কমলে নারায়ণগঞ্জ এর রাস্তায় গাড়ি মোর নেয়। তারপর ত্রিশ মিনিটের মধ্যে পৌঁছে যাই বাসায়। আমাকে গেইট অবধি পৌঁছে চলে যায় রাহাত, আমি শুধু তাকিয়েই থাকি। একবার ও পিছনে ফিরে তাকায় না। তারপর চোখের পানি মুছে বাসার ভিতরে যাই। হঠাৎ কোন খবর না দিয়ে আসায় ভাবী নানা রকম প্রশ্ন শুরু করে দেয়।তার প্রশ্ন সম্পূর্ণ এরিয়ে গিয়ে, নিজের রুমে চলে যাই। কোন রকম বোরকা খুলে, ফুল স্পীডে ফ্যান চালু করা দরজা জানালা বন্ধ করে শুয়ে রইলাম।
এক ঘুমে উঠলাম বিকাল সাড়ে চারটার দিকে। খুব খিদে অনুভব হচ্ছে তবুও খাচ্ছি না।আসরের আযান হতে আরো অনেক সময় বাকি তাই গিয়ে, অনেক সময় নিয়ে শাওয়ার নিয়ে আসলাম। ফোন টা হাতে নিয়ে দেখলাম, আরো দুদিন আগে তুলি চার বার কল করেছিল।কল বেগ করতে গিয়ে দেখি ফোনে ব্যালেন্স নাই। তাই আরিয়ানের রুমে গেলাম ওর ফোন দিয়ে কল করার জন্য। দরজা বিড়িয়ে রাখা তবুও নক করলাম কিন্তু কোন সাড়া শব্দ পেলাম না।তাই ঢুকে গেলাম। খাটের মধ্যখানে উল্টো হয়ে শুয়ে আছে যে ব্যক্তি, তাকে দেখার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না আমি!চিকন স্লিপের সাদা গেঞ্জি সাথে আরিয়ানের লুঙ্গি পরিহিত।চরম মাত্রায় অবাক হলাম আমি।
রাহাত কখন এলো বাসায়? আমাকে কেউ ডাকলো না কেন?ও দুপুরে খাবার খেয়েছে? কাছে গিয়ে মাথার কাছে গিয়ে বসলাম আমি। মাথায় হাত বুলিয়ে ধীরে ধীরে বললাম,
– রাহাত তুমি কখন এসেছো? আমাকে ডাকলে না কেন? দুপুরে খাবার খেয়েছো তুমি?এই রাহাত শুনতে পাচ্ছো?
ওর সারা না পেয়ে কিছুটা ঝুঁকে পরে আবারো ঢাকলাম,এই রাহাত?
আচমকা রাহাত আমাকে টেনে নিয়ে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে পুনরায় শুয়ে রইলো!এই প্রথম ওর এতো কাছাকাছি আসায় খুব অস্বস্তি বোধ হচ্ছে।তাই নড়াচড়া শুরু করলাম। তখন ও বললাম,
– সাপের মতো মোড়ামোড়ি করছো কেন,একটু শান্তিতে ঘুমাতে দাও না?চলেই তো যাবো!তখন ইচ্ছে মতো থেকো।
ওর এরকম কথায় স্তব্ধ হয়ে গেলাম আমি।ও এভাবে বলে যেন একেবারে চলে যাচ্ছে হুহ। আমার ভাবনার মাঝে,গলার দিকটায় তার মুখশ্রী রাখে। ফলে প্রতিটি উষ্ণ গরম নিঃশ্বাস আছরে পরছে আমার গলায়। শুধু এখানেই থেমে নেই সে, তার ঘ্রাণেন্দ্রিয় দিয়ে ছুয়ে দিতে শুরু করে! এতে করে শরীরের প্রতিটা শিড়া উপশিড়া শিরশির করতে শুরু করলো। প্রচুর পরিমাণে শুরশুরি লাগছে, কিছু বলতেও পারছি না। বললে আমি নিশ্চিত এখন রেগে যাবে। তাই বলছি না কিছু, তার এরকম রোমান্টিক অত্যাচার চলতে থাকলো টানা দশ থেকে পনেরো মিনিট।এর মধ্যে আযান হতে,নামাযের অজুহাত দিয়ে উঠে গেলাম। সাথে তাঁকে ও বললাম নামায পড়ে নিতে।
তারপর নামায পড়ে ড্রয়িং রুমে এসে দেখি আরিয়ান বসে গেইম খেলছে।ওরে দেখে বললাম,
– তোর ভাইয়া কখন আসছে?
ও গেইম অফ করে বললো,
– তুই আসার দশ মিনিট পর। অনেক বাজার নিয়ে আসছে। তোর পছন্দের পাবদা মাছ ই এনেছে তিন কেজির মতো। আরো অনেক কিছু তো আছেই।
আমি হতবাক হয়ে গেলাম, তখন ও বাজার করতে বাজারে গিয়েছিলো।আর আমি কিনা কিসব ভেবে অস্থির। অবশ্য ও আমাকে বলে যেতে পারতো যে আমি বাজারে যাচ্ছি। তাহলেই তো আমি এভাবে দরজা বন্ধ করে থাকতাম না।
– আমাকে ডাকলি না কেন?
– আমি ভাবী দু’জনেই ডেকেছি তোকে তোর কোন সাড়া শব্দ নেই।তাই ভাইয়া বললো তুই হয়তো ঘুমিয়ে আছিস।ডাকতে নিষেধ করলো।
– দুপুরে খাবার খেয়েছে ও ?
– হুম, আব্বু সহ সবাই একসাথে খেয়েছি।
– কি রান্না হয়েছে?
– ভাবী তাড়াতাড়ি করে ভাইয়ার আনা মাছ ভুনা করে দিয়েছে। তাছাড়া সকালে মুরগির গোশত,ডাল,পটল ভাজি রান্না করা হয়েছিল।
– ওহ্ আচ্ছা।
তাড়াতাড়ি কিচেনে গেলাম সন্ধ্যায় রাহাত কে নাস্তা দেওয়ার জন্য কিছু তৈরি করতে হবে। রান্নার করা পাতিলের ঢাকনা তুলে দেখলাম কিছু গোশত আছে, সেই থেকে শুধু গোশত গুলো তুলে নিয়ে, পানি দিয়ে ধুয়ে নিলাম। তারপর পানি গুলো ঝরে যাওয়ার জন্য রেখে দিয়ে, পেঁয়াজ কুচি করে নিলাম। চুলায় কড়াই দিয়ে তেল গরম করে পেঁয়াজ কুচি ছেড়ে দিলাম। পেঁয়াজ টা বাদামী রঙের হয়ে এলে একটু হলুদ, আদা রসুন ব্লেন্ডার দিয়ে নেড়েচেড়ে গোশত গুলো ভেঙ্গে দিয়ে দিলাম। তারপর একটু গুঁড়ো মরিচ দিয়ে হয়ে এলে নামিয়ে নিলাম। রাহাত ঝাল খেতে পারে না তেমন তাই মরিচ অল্পই দিলাম।
এখন আটা কাই করে নিতে হবে, সমস্যা হচ্ছে আঁটার কন্টিনার অনেক উপরের তাকে কিছুতেই নাগাল পাচ্ছি না। তখন রাহাত পিছন থেকে কোমড় জড়িয়ে ধরে, শূন্যে তুলে নেয় আমাকে। নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরি ওর এরকম কান্ড দেখে। তারপর কন্টিনার হাতে নিতেই নামিয়ে দেয়। আমি ওর দিকে না তাকিয়ে নিজের মতো কাজ করতে থাকি, লজ্জায় মুখ লুকানোর জায়গা পাচ্ছি না আমি।ওর একেকটা কর্ম কান্ড দেখে শিহরিত আমি।সব সময় ওর সাথে থাকলে আমার অবস্থা নাজেহাল করে ছাড়বে যেই লক্ষন দেখা যাচ্ছে।
আটা কাই করে এবার এগুলো মিশিয়ে নেওয়ার পালা,গরম বলে হাত দিতে পারছি না। তখন রাহাত বললো,
– দাও আমি করে দিচ্ছি।
আমার অবাক চাহনিতে তাকানো দেখে বললো,
– আমরা সব কিছু পারি। সমস্ত কাজে অভিজ্ঞতা আছে।
কিন্তু তবুও আমি দিলাম না, কেমন দেখায় এটা শ্বশুর বাড়ি এসে রান্নার কাজ করবে জামাই। বললাম, তুমি আব্বুর সাথে বসে গল্প করো যাও, আমি এগুলো তৈরি করে আসতেছি।
তারপর ও চলে গেল, আমি সব কিছু নিয়ে রুটি তৈরি করবো তখন কাটা ব্যান থেকে খুলে যাওয়া কিছু চুল,উড়ে এসে খুব বিরক্ত লাগছিল।বার বার হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে ঠিক করার ট্রাই করে চলেছি কিন্তু ঠিক করতে পারছিলাম না। তখন রাহাত এসে সব গুলো চুল খুলে নতুন করে কাটা ব্যান দিয়ে আটকে দিল।
তাকে ছোট্ট করে বললাম,
– ধন্যবাদ।
সে যেতে যেতে বললো,
– মুখে না বলেও, অন্য ভাবে প্রকাশ করা যেত।
তার কথার মর্মার্থ কিছুই বুঝতে পারলাম না, ধন্যবাদ আবার অন্য ভাবে কিভাবে দেয়?আর না ভেবে পিঠা তৈরি করতে মনোযোগ দিলাম। রুটি তৈরি করে,এর মধ্যে পরিমাণ মতো গোশত দিয়ে বাজ করে গরম তেলে ভাজা করলাম। এরকম করে সব গুলো করে বাজা করলাম। তারপর সুন্দর একটা নাস্তার প্লেটে সাজিয়ে মাঝ খানে টমেটো দিয়ে গোলাম বানিয়ে, সাথে সস দিয়ে পরিবেশন করলাম।এই প্রথম রাহাত আমার হাতের মেনু টেষ্ট করলো।যার ফলে মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে রইলো অপলক।
আব্বু চলে যাওয়ার পর রাহাত নিজ হাতে খাইয়ে দেয় আমাকে। ভাবী ও ছিল, তবে ভাবী এরকম পরিস্থিতির সাথে পরিচিত। ভাইয়া ও দেখতাম ভাবী কে প্রায় সময় নিজ হাতে খাইয়ে দিত। অনেক সময় ভাবী আলসেমি করে খাবার খাবে বললে, ভাইয়া নিজ হাতে খাইয়ে দিত।
আমার সাথে মাঝে মাঝে খুনসুটি ঝগড়া করলেও মানুষ টা ততোটাও খারাপ না। আজকের যুগে দাঁড়িয়ে ঠিক ই আছে। অন্যান্য ভাই বৌদের তুলনায়। অবশ্য আমার ভাইয়ার ও অবদান আছে এতে,ভাবী আমার বা আমাদের সাথে খারাপ ব্যবহার করেছে শুনলে ভাইয়া ভাবীর সাথে কথা বলাই অফ করে দিবে।তাই টুকটাক যাই ঝগড়া হয় সেসব কিছু ভাইয়া কে বলি না আমি।
________
এশা এর আযান হতে, আরিয়ানের সাথে মসজিদে যায় রাহাত। এদিকে আমি নামায পড়ে, আমার রুমটা সুন্দর করে গুছিয়ে নেই। অনেক থাকা হয় না তাই একটু এলোমেলো হয়ে অগোছালো পরে ছিল। কাজের মহিলা রুম মুছে চলে যায়, ভাবীর সময় নেই আমার রুমে আসার। তাই এই অবস্থা হয়ে আছে। রুমটা গুছিয়ে একটা সুন্দর দেখে বিছানায় চাদর বিছিয়ে, বালিশ গুলো সেট করে কিচেনে গেলাম। ভাবী নন্দার জন্য রান্না বান্না করছেন। জিজ্ঞাসা করলাম নামায পড়েছে কিনা? বললো পড়ে নাই তাই তাকে নামায পড়তে পাঠিয়ে দিয়ে আমি রান্না শুরু করলাম।
একটু পর, রাহাত আবার এসে দেখে আমি রান্না করছি। তখন পাশে দাঁড়িয়ে বললো,
– মা শা আল্লাহ, আমার বউ তো দেখছি বেশ কাজের। আমার কষ্ট কিছুটা লাঘব হবে দেখা যাচ্ছে। তো কি রান্না করছো বউ?
বউ শব্দটা শুনে গাড় ঘুরিয়ে পিছনে তাকালাম, তখন সে ভ্রু নাচিয়ে বললো,
– কি হয়েছে বউ? কোন সমস্যা বউ? আমাকে বলতে পারো বউ। আমি সমাধান করে দেব বউ। নির্দ্বিধায় অকপটে বলতে পারো বউ।
তার কথায় কথায় বউ শুনতে শুনতে শব্দ করে হেসে দিলাম আমি।আর সে অনিমেষ চাহনিতে তাকিয়ে রইলো,যেন এটাই চেয়েছিল এতো সময়।
রাতের খাবার খেয়ে শুয়ে পড়লাম দুজনে। বিকালের মতো নিজের সাথে মিশিয়ে নেয় আমাকে। তবে একটা কথাও বলে না। বুঝলাম না তার এই নিরবতার কারণ! তারপর দুজনেই ঘুমের দেশে পাড়ি দেই।
রাত তিনটা বেজে ছয় মিনিট,
এলার্মের বিকট শব্দে ঘুম ভেঙ্গে যায় দুজনের। ঘুমানোর সময় এলার্ম দিয়ে রেখেছি।যেন উঠে তাহাজ্জুদ নামায পড়তে পারি, আমার সাথে সাথে রাহাত ও পড়বে বলে উঠলো।যা দেখে আনন্দে মনটা প্রশান্তিতে ভরে গেল আমার।
তাহাজ্জুদ নামাজের ফজিলত সব নফল ইবাদত অপেক্ষা অধিক এবং এটি আল্লাহর কাছে অতি প্রিয়। যারা তাহাজ্জুদ নামাজ আদায় করেন এবং অপরকে এ ব্যাপারে উৎসাহিত করেন, তারা আল্লাহর অপার রহমতের মধ্যে বিচরণ করেন।
হাদিসে ইরশাদ হয়েছে, নবী করিম (সা.) বলেছেন, ‘আল্লাহ ওই ব্যক্তির ওপর রহমত নাজিল করেন, যিনি রাতে নিদ্রা থেকে জেগে তাহাজ্জুদ নামাজ আদায় করেন এবং তার স্ত্রীকে নিদ্রা থেকে জাগিয়ে দেন। অতঃপর তিনি (তার স্ত্রী) তাহাজ্জুদ নামাজ আদায় করেন। এমনকি যদি তিনি (স্ত্রী) ঘুম থেকে জাগ্রত হতে না চান, তাহলে তার মুখে পানি ছিটিয়ে দেন। ’ -আবু দাউদ ও নাসাঈ
হাদিসে তাহাজ্জুদ নামাজ আদায়কারী ব্যক্তি অধিক সম্মানের অধিকারী বলেও ঘোষণা করা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে হাদিসে ইরশাদ হয়েছে, হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘মুসলমানদের মধ্যে আল কোরআনে অভিজ্ঞ ও তাহাজ্জুদ নামাজ আদায়কারী ব্যক্তি সম্মানের অধিকারী হবেন। ’ –বায়হাকি
তাহাজ্জুদ নামাজের মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ করা যায়। এ জন্য হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) কখনো বিনা ওজরে তাহাজ্জুদ নামাজ পড়া ছাড়তেন না। সাহাবিরাও নিয়মিত তাহাজ্জুদ নামাজ আদায় করতেন।
_________
এভাবেই পাঁচটা দিন আনন্দ কাটালাম রাহাতের সাথে।এর মধ্যে একদিন, মোহরানার জন্য দেড় লক্ষ টাকার চেক আমার হাতে ধরিয়ে দিল রাহাত। আমি নিতে চাইনি তাও জোর করে দিয়ে বললো,
– তোমার সবকিছু যেমন আমার তেমনি আমার সবকিছু ও তোমার। তবে এই টাকার হক শুধু তোমার। আমাকে দিতে হবে তাই দিচ্ছি, কিন্তু তুমি কি করবে এটা তোমার ব্যাপার। অবশ্যই অপচয় করা ছাড়া।
তারপর,
আমাকে বাবার বাসায় রেখে,তার কাজে ফিরে যাওয়ার সময় তার শেষাক্ত কথা,
– খুব করে অপেক্ষায় ছিলাম কখন তুমি ঘড়িটা পরে বাকিটা আমাকে পরিয়ে দিবে! এতো গুলো দিন একসাথে থেকেও তুমি এই কাজটা করলে না আফসোস।যদি মিশন থেকে বেঁচে ফিরে আসি তাহলে দেখা হবে। তারপর,,,,
# চলবে,, ইনশা আল্লাহ।
(আসসালামু আলাইকুম।
নোট বার্তা:গতপর্বে রাহাতের এহেন আচরণের কারণ,আয়রা রাগের বসে নিজের ক্ষতি যেন আর কখনো না করে।
আপনারা পেইজে লাইক,ফলো দিয়ে আমাকে সাহায্য করুন প্লিজ?।)