ছন্দহীন পদ্য
.
পর্ব_৩১
.
পদ্য উঠানে এসে আকাশের দিকে তাকায়। ঝকঝকে নীল আকাশ। শীতের সকাল, তবুও আজ তেমন কুয়াশা নেই। একটা চিল পালক না নেড়ে চক্রাকারে ঘুরছে। এই দৃশ্য কয়েক মাস আগে প্রথম খেয়াল করেছিল সে। এখন প্রায়ই দেখে। আগে দেখতে পায়নি কেন? না-কি দেখলেও খেয়াল করেনি? হেঁটে হেঁটে উঠানের মাথায় এসে মনে হলো শাল নেয়ার কোনো মানে হয় না। আজ তেমন শীত নেই। চনমনে রোদ উঠেছে। মনিসা তখন বুকে বই জড়িয়ে ধরে বের হয়ে, ‘আপু আমাকে রেখে চলে যাচ্ছ কেন।’ বলে তাড়াতাড়ি কাছাকাছি এলো।
পদ্য তখন শালটা খুলে ওর কাছে দিয়ে বললো, ‘রেখে আয়।’
মনিসা দাঁত কটমট করে তাকিয়ে শাল হাতে নিয়ে তাড়াতাড়ি গিয়ে রেখে এলো। পদ্য পুকুর পাড় পেরিয়ে রাস্তায় চলে এসেছে। মিনিট তিরিশেক আগে অনিকের বাইকের শব্দ শুনেছিল। কোথায় গিয়ে দাঁড়িয়ে আছে কে জানে। মনিসা কাছাকাছি এসে বললো, ‘আপু অনিক ভাইয়ের আম্মু বলতো তুমি আর অনিক ভাই সারাক্ষণ এক সঙ্গে থাকতে। এখন দেখি আসেই না। তোমরাও কথা বলো না।’
– ‘কানমলা খেতে না চাইলে চুপ থাক।’
– ‘আমি কিন্তু সব জানি।’
ভ্রু কুঁচকে পদ্য বললো, ‘কী জানিস?’
– ‘কিছু না।’
পদ্য আর কিছু বললো না। মনিসা পুনরায় বললো, ‘তোমার যার সাথে বিয়ে ঠিক হইছে তার ছবি আমি দেখেছি। একটুও পছন্দ হয়নি।’
পদ্য এবারও চুপ। মনিসা পুনরায় বললো, ‘অনিক ভাইই ভালো। আব্বা-আম্মা কেন যে মানে না বুঝি না।’
পদ্য ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে বললো, ‘অনিককে ভালো লাগে?’
– ‘হ্যাঁ।’
– ‘তুই তো দেখলাম সারাক্ষণ নাঈম ভাইয়ের সাথে গল্প করিস। অনিকের সাথে তো কথা বলতেই দেখিনি।’
– ‘উনাকে লজ্জা লাগে।’
পদ্য মুচকি হেঁসে বললো,
– ‘লজ্জা?’
– ‘হ্যাঁ।’
হেঁটে হেঁটে তারা খেয়াঘাটের কাছাকাছি চলে আসে। মনিসা আঙুল তুলে বলে, ‘ওই দেখো অনিক ভাই দাঁড়িয়ে আছে।’
পদ্য ওর আগেই দেখেছে। তাল গাছের নিচে একটা বাইকে বসে আছে অনিক। জিন্স প্যান্ট, কেডস আর হাত লম্বা একটা কফি কালারের গেঞ্জি পরনে। আঙুলের ফাঁকে সিগারেট। পদ্যকেও হঠাৎ দেখে ফেলে সে৷ পলকে সিগারেট ফেলে পায়ের নিচে পিষে নিল। সঙ্গে মনিসা থাকায় হতাশ হলেও মাথায় বুদ্ধি এলো দ্রুত। ওরা কাছে আসতেই ফোন কানে লাগিয়ে বললো, ‘হ্যাঁ আসছি আসছি’ ফোন কানে নিয়েই বাইক রেখেই রাস্তায় উঠে এসে মনিসাকে বললো, ‘স্কুলে যাচ্ছ মনিসা?’
– ‘হ্যাঁ, ভাইয়া।’
অনিক আবার ফোনে, ‘হ্যাঁ এইতো আসছি’ বলে রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে অনেক দূর চলে এসে খেয়াল হলো খেয়াঘাট থেকে আর দেখা যাচ্ছে না। পদ্য আস্তে-আস্তে হেঁটে আসছে৷ আজ বোরখা নেই। সেলোয়ার-কামিজ। মাথায় ওড়না। বয়স কেমন কম লাগছে। পদ্য কাছাকাছি এসে বললো, ‘নাটক করে আসলেও মনিসা ঠিকই বুঝবে।’
– ‘তা বুঝলে বুঝুক। হাঁটো তোমাকে এগিয়ে দিয়ে আসি।’
পদ্য কিছু না বলে শ্লথ পায়ে হাঁটছে। অনিক চারদিকে তাকিয়ে বললো, ‘এদিকটা অনেক নির্জন তাই না? দুইপাশে গাছ থাকায় ভালোও লাগে।’
– ‘হ্যাঁ, এখানেই গাল কেটে দিয়েছিলাম লিটনের। তুমি যেভাবে পিছু নিতে শুরু করেছো তোমাকেও কিছু একটা করতে হবে।’
– ‘হ্যাঁ এখন বলো তো৷ কোন লিটনের গাল কেটে দিয়েছো?’
– ‘চেয়ারম্যানের ছেলে লিটন।’
– ‘তাই না-কি? তাহলে তো আব্বা খুশি হয়েছিল মনে হয়। ঘটনা কী বলো তো।’
– ‘অন্যসময় বলা যাবে, এখন যাও। লোকে দেখবে।’
– ‘আরে দেখুক তাতে কী।’
– ‘যেতে বলছি যাও। না হলে সত্যিই দেবো কেটে।’
– ‘কীভাবে কাটবে?’
– ‘ব্লেড দিয়ে।’
আর আমি ব্লেড ছাড়াই কেটে দেবো। পদ্য ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে বললো, ‘বাজে ইঙ্গিত করবে না একদম। যাও তো এখান থেকে।’
– ‘একা একা যাবে না-কি?’
– ‘আমি তো রোজই একা যাই। সত্যিই চলে যাও তুমি। বুঝতে পারছো না স্কুলে পড়াই আমি। বিয়ে হয়ে গেলে ভিন্ন বিষয়।’
অনিক দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো, ‘আচ্ছা যাচ্ছি, আর চাপাকলে ছাতা নিয়ে গিয়েছিলে কেন?’
পদ্য মুচকি হেঁসে বললো, ‘হঠাৎ পর্দা করতে মন চাইছিল।’
– ‘ও হ্যাঁ, আর তুমি না বোরখা পরে স্কুলে আসতে। আজ বোরখা ছাড়া যে?’
– ‘এই তোমার পেটের ভেতরে এত কথা কেন? যাও তো। চ্যাটেও তো কথা বলা যাবে, যাও।’
অনিক মলিন মুখে বললো, ‘আচ্ছা যাচ্ছি, কিন্তু কেমন যেন শুকনো মুখে চলে যাচ্ছি মনে হচ্ছে।’
– ‘তোমার মতলবটা কী বলো তো?’
– ‘কমপক্ষে হাতটা তো একবার ধরতে দেবে।’
– ‘গ্রামের রাস্তাঘাটে এসব কী বলো। তাছাড়া ওইদিন গাড়িতে আমি অনেক ইমোশনাল ছিলাম। তাই বলে ভেবো না বিয়ের আগে আমি এখন শুধু এগুলো করে বেড়াবো। যাও তো এখন।’
অনিক দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো, ‘তাহলে একটা কাজ করবে?’
– ‘কী?’
অনিক অ্যাশ কালারের একটা রুমাল পকেট থেকে বের করে দিয়ে বললো, ‘এটা ধোয়ার পর আর ব্যবহার করা হয়নি। তুমি এখন নিয়ে হাত, মুখ, ঘাড় আর গলা মুছে দাও।’
– ‘আশ্চর্য! কেন?’
– ‘তাড়াতাড়ি দাও তো, বিয়ের আগপর্যন্ত তোমাকে আর স্পর্শও করবো না। শুধু এভাবে ডেইলি এই রুমাল ইউজ করে ফেরত দেবে। আমি রাতে আবার ধুয়ে রাখবো। আবার ভোরে ইউজ করে দেবে।’
– ‘পাগলামি করো না, যাও তো।’
– ‘এটুকুও দেবে না আমায়?’
পদ্য ওর দিকে তাকিয়ে রুমাল টান দিয়ে নিয়ে সত্যি সত্যিই মুখ, হাত আর গলা মুছে ফেরত দিল। অনিক রাস্তার মাঝখানে রুমাল মুখে রেখে দাঁড়ায়, তারপর দুই হাত পকেটে পুরে আকাশের দিকে তাকিয়ে থেকে খানিক্ষণ বুকভরে শ্বাস নেয়। পদ্য তাকিয়ে থাকে। আকাশের দিকে মুখ তুলে থাকায় ওর ফরসা গলা কেমন টানটান হয়ে আছে। পকেটে হাত রেখে দাঁড়িয়ে থাকায় ইচ্ছা করছে মানুষটাকে গিয়ে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বুকে মাথা রাখতে। পদ্যের বুকটা কেমন শিরশির করছে। চোখ নামিয়ে, নিজেকে সামলে নিয়ে ‘আমি যাচ্ছি’ বলে মাথা নীচু করে হাঁটতে থাকে। বিকেলে যখন স্কুল থেকে ফিরেছে। পুকুর পাড়ে এসে দেখে অনিক ছাদের রেলিঙ ধরে দাঁড়িয়ে আছে। বাঁ হাতের কবজিতে সেই রুমালটা বাঁধা। তার সঙ্গে চোখাচোখি হতেই রুমালে চুমু খেল। পদ্য আঁতকে উঠে আশেপাশে তাকিয়ে দেখে কেউ আছে কি-না। তারপর দাঁত কটমট করে তাকিয়ে ঘরে চলে আসে।
হাত-মুখ ধুয়ে খাওয়া-দাওয়ার শেষে হোয়াটসঅ্যাপে দেখে অনিক মেসেজ দিয়েছে, ‘পদ্য তুমি তাড়াতাড়ি স্যারকে কাগজ দাও। আব্বা আমাকে সন্ধ্যায় তোমাদের ঘরে যেতে বলেছে। আজ কথা বলবে ওরা।’
পদ্য রিপ্লাই না দিয়ে কাগজটা বের করে পড়লো। পড়ে মনে হলো মুখে হোক বা কাগজে। এরকম কিছু কথা তার বলতেই হবে। ভয় বা লজ্জা পেয়ে তো কাজ হবে না। অনিককে তো তার পেতেই হবে। পদ্য মনিসার খাতা এনে একটা পৃষ্ঠায় নিজের মতো লিখতে শুরু করে। লিখতে গিয়ে অনিকের লেখা থেকে অনেককিছু পরিবর্তন হয়ে আরও বড়ো হয়ে গেল। তারপর পৃষ্ঠা ছিঁড়ে মুঠোয় নেয়। গলা কেমন শুকিয়ে আসছে। জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে নিয়ে বুক ভরে শ্বাস নিয়ে বারান্দায় গেল। মতিন সাহেব সেখানে চেয়ারে একা বসে আছেন। পদ্য কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই তিনি বললেন, ‘কিছু বলবি মা?’
– ‘হ্যাঁ আব্বা, তুমি অসুস্থ তাই বলতে পারছি না। লজ্জাও লাগে। না বলেও কোনো উপায় নেই। তাই একটা কাগজে লিখে আনলাম।’
তিনি অবাক হয়ে তাকিয়ে বললেন, ‘দে তো দেখি।’
পদ্য কাগজটা বাবার হাতে দিয়ে চলে গেল। মতিন সাহেব চেয়ারে বসে পৃষ্ঠা খুলে পড়তে লাগলেন,
“আব্বা আগেই বলে রাখছি। লেখাটি পড়ে তোমার উত্তেজিত হওয়ার কিছু নেই। কারণ কোনোকিছুই তোমার নিয়ন্ত্রণের বাইরে নয়। তুমি চাইলে আমি তোমার ঠিক করা পাত্রের কাছেই বিয়ে বসতে রাজি। সুতরাং তুমি শান্ত থাকো। সবকিছু তোমার বিবেচনার উপরেই আছে। আমি শুধু চাই, তুমি যাতে সিদ্ধান্তটা আরও ভেবে-চিন্তে নিতে পারো।
আব্বা, অনিক আর আমার ব্যাপারটা তুমি স্ট্রোক করার আগেরদিন শুনলেও মিরাজুল চাচা অনেক আগে থেকে জানেন। আমিও অনিককে কখনও প্রশ্রয় দেইনি। একপর্যায়ে সেও আর কখনও সামনে আসেনি।
আজ এত বছর পর বিয়ে ঠিক হয়েছে শুনে সে বিয়ে করতে চাচ্ছে। বিয়ে করতে চাওয়া তো অপরাধ নয়। তোমরা তো আমাকে একটা জায়গায় বিয়ে দেবেই। সেই বিয়েটা অনিকের সঙ্গে হলে আমি খুশিই হবো এবং মনে করি ভালো থাকবো। এখন নিশ্চয় ভাবছো অনিক আমার ছোটো। কিন্তু আব্বা বয়সে-ছোটো বড়ো কী আসলেই কোনো সমস্যা? আমাদের ধর্মে, রাষ্ট্রে কী অসম বিয়েতে কোনো বাঁধা আছে? যদি নাইই থাকে তাহলে কেন আমি আমার পছন্দের ছেলেকে বিয়ে করতে পারবো না? শুধুমাত্র সমাজের লোক হাসাহাসি করবে বলে কী তোমার মেয়েকে তুমি আজীবন কাঁদাতে চাও? অনিক আমাকে কত ভালোবাসে জানো আব্বা? বিয়ের খবর শুনে পাগল হয়ে গিয়েছিল। গ্রামে এসে একদিন দেখাও করেছিল। মিরাজুল চাচার পরামর্শে আমি তাড়িয়েও দিয়েছিলাম। এরপর আর আসেনি। কিন্তু একা একা ঠিকই কষ্ট পেয়েছে। জব ছেড়েছে। পাগলের মতো ঘুরে বেড়িয়েছে৷ আচ্ছা আব্বা, আমাদের সম্পর্কের ব্যাপারটা বাদ দাও। অবিভাবকরা বিয়ে দিতে হলে কী দেখে? পাত্র মানুষ হিসাবে কেমন, তার চরিত্র কেমন, আর্থিক অবস্থা, শিক্ষা-দীক্ষা। এগুলোই তো? এসব বিবেচনা করলেও কী তোমাদের ঠিক করা পাত্রকে রেখে অনিকের কাছে বিয়ে দেয়া উচিত নয়? অনিক আমার কারণে জব ছেড়েছে, আবার চেষ্টা করলে পাবে। ওর প্রতি বছর ২-৩ টা করে বই বের হয়৷ সেগুলো ভালো সাড়াও পায়। তার ফিউচারও ব্রাইট। তাহলে কেন তোমরা বিয়ে দেবে না? সমাজের লোকের জন্য? শুধু মাত্র বয়সে ছোট বলে? আব্বা দুনিয়ায় আগে-পরে আসা কী আমাদের হাতে? বয়সে ছোটো হওয়া কী অনিকের অপরাধ? না-কি বড়ো হওয়া আমার অপরাধ? এই সমাজে কী ডিভোর্সি নারী বয়সে ছোটো ছেলেকে বিয়ে করে না? বড়ো ছেলে মারা গেলে বাপ কী ছোটো ছেলের কাছে তার ভাবিকে বিয়ে দেয় না? তখন তো সমস্যা হয় না। তাহলে অবিবাহিত অবস্থায় কেন সমস্যা হবে? হ্যাঁ অনিক আমাকে এক সময় আপু বলে ডাকতো। কিন্তু সেই ডাক তো শুধু একটা সম্মোধন। বয়সে ছোটো একটা অচেনা মেয়েকেও তো একটা ছেলে আপু ডাকতে পারে, পারে না আব্বা?
তাছাড়া আমাদের নবী মোহাম্মদ (সঃ) তো বয়সে বড়ো খাদিজা (রাঃ) কে বিয়ে করেছেন। ধর্মের দিক থেকেও কোনো বাঁধা নেই।
তাহলে আমাদের সঙ্গেই কেন এমন হবে আব্বা? আমি তোমার কাছে সবকিছু বিবেচনার দায়িত্ব দিয়ে দিলাম। আমি জানি আমার বাবা একজন শিক্ষক। তার বিচার-বিবেচনাও শিক্ষিত মানুষের মতো হবে। তোমার কোনো দুশ্চিন্তার কিছু নেই আব্বা। এই চিঠি পড়ার পরও যদি বলো অনিককে বিয়ে না করতে, আমি করবো না। তোমাদের ঠিক করা পাত্রকেই আমি বিয়ে করবো, সংসারও করবো। কিন্তু জেনে রেখো, আমি মন থেকে সুখী হব না। মনের সঙ্গে তো আর জোরাজুরি চলে না।এই একটা সিদ্ধান্ত তিনটা মানুষের জীবন একেবারে তছনছ করে দিতে পারে। তাই আমি চাই তুমি নিজের সিদ্ধান্তটা সবকিছু ভেবে-চিন্তে নাও আব্বা৷ চিঠির টপিকটা আমি জানি লজ্জার। কিন্তু যেখানে আমার জীবনের প্রশ্ন৷ যে বিষয়ের সঙ্গে আমার পুরো জীবন জড়িত। যেখানে আমার সবকিছু বুঝার যথেষ্ট বয়সও হয়েছে। তাই সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে আমার কিছু কথা তোমাকে বলা দরকার বলে মনে করেছি। ভুল হলে ক্ষমা করবে।”
__চলবে…
লেখা: জবরুল ইসলাম