ছন্দহীন পদ্য
.
পর্ব_২৯
.
পদ্য কল না দিয়ে বাইরের দিকে চুপচাপ তাকিয়ে রইল।
অনিক দীর্ঘশ্বাস গোপন করলো। পদ্যকে আজ অস্বাভাবিক লাগছে। আচরণগুলো কেমন অসামঞ্জস্য। ইমোশনাল কথাবার্তাগুলো অবিশ্বাস্য লেগেছে। ওর ব্যক্তিত্বের সঙ্গে যেন এমন ভেঙে পড়া, দূর্বল হওয়া যায় না। তবুও তো মানতে হবে, মানুষ কোনো একজনের কাছে এসে নিজের ব্যক্তিত্বের, কাঠিন্যের খোলস খুলে ফেলে দিতে চায়। পদ্যেরও হয়তো সেই মানুষটি সে। আচ্ছা আসা মাত্রই জটিল বিষয় নিয়ে আলোচনা শুরু করাটা কী ঠিক হয়নি? সে নিজেও আসলে এগুলো ছাড়া কিছুই ভাবতে পারছে না। পদ্যের হয়তো একটু মানসিক প্রশান্তি দরকার৷ অথচ সে কি-না আসা মাত্রই জটিল বিষয় নিয়ে আলাপ শুরু করে দিয়েছিল।
অনিক পদ্যের হাতের দিকে তাকায়। ফরসা হাতে পাতলা লালচে লোম। নখগুলো এখনও লম্বা রাখে ও। সে ধীরে ধীরে পদ্যের কোমল হাতটা ধরে। পুরো শরীর যেন কাটা দিয়ে উঠে তার। পদ্য ফিরে তাকায়। অনিক অভয় দিয়ে বললো, ‘আচ্ছা এখন কল দিতে হবে না। এত তাড়াহুড়ার কিছু নেই। বাইরে গিয়ে কি হাঁটবে? দেখো ঝকঝকে নীল আকাশ। রাস্তায় পাহাড়ের ছায়া। চারদিকে সবুজ চা গাছ।’
– ‘না থাক, এখানেই ভালো লাগছে। আমি আসলে ভাবছি কল দিয়ে কীভাবে বলবো। কেমন লজ্জা লাগছে।’
– ‘থাক, বাসায় গিয়েও দিতে পারবে। চাপ নিতে হবে না।’
– ‘হ্যাঁ বাসায় গিয়েই দিলে ভালো হবে৷ এখন কল দিয়ে গুছিয়ে কথা বলতে পারবো না।’
– ‘আমরা ওই বিষয়গুলো মাথা থেকে এখন ঝেড়ে ফেলি৷ আচ্ছা তোমার মনে আছে আমরা হারিকেনের আলোয় একসঙ্গে পড়তে বসতাম?’
পদ্য মিষ্টি হেঁসে বললো, ‘গতকাল সন্ধ্যায় তোমার বারান্দায় মোমবাতির আলো আর মাদুর দেখে মনে পড়েছিল।’
– ‘আমার সব সময় মনে পড়ে। তুমি কী মিষ্টি করে গান গাইতে। কী সুন্দর চুল, চোখ। আর তোমার চোখের ব্যাপার কী জানো?’
– ‘কী?’
– ‘তোমার ভ্রু এবং চোখের পাপড়ি অনেক কালো, চোখের মণির চারপাশের সাদা অংশ পরিষ্কার সাদা, অন্যদের একটু লালচে হয়। তোমার তা নয়, চারদিকে সাদা, আবার চোখের মণি প্রচণ্ড কালো। ফলে তাকালে মনে হয় চোখ যেন কেমন গভীর অতল নদী৷’
পদ্য মুখে হাত দিয়ে ফিক করে হেঁসে বললো, ‘এবার তোমাকে ছোটবেলার সেই অনিক মনে হচ্ছে। না হলে অচেনা লাগে।’
– ‘অচেনা লাগে?’
– ‘অনেকটা।’
– ‘অচেনা ভালো লাগে না-কি চেনা?’
– ‘প্রেমিক হিসাবে তো এখনকার অচেনা ব্যক্তিত্ববান অনিকই পারফেক্ট। আর আগের অনিক আগের জন্য ঠিকই ছিল। কারণ আমরা তখন ছোট ছিলাম। আচ্ছা বাইরে যেতে বলেছিলে, চলো একটু হেঁটে আসি।’
– ‘হাত ধরে?’
পদ্য মুচকি হেঁসে বললো,
– ‘আজ আর না করবো না। না করার পর কিন্তু কষ্ট লাগে, জানো?’
‘তোমার লাগে জানতাম না।’
দু’জন বাইরে এলো। অনিক হাতটা ধরে বললো, ‘ওই দিকে যাই।’
পদ্য মাথা নাড়লো। ছায়াময় রাস্তা। দুইপাশে পাহাড়কে চাদরের মতো ঢেকে রেখেছে সবুজ চা গাছ। অনিক পদ্যের দিকে তাকিয়ে বললো, ‘আমরা চাইলে কোথাও বেড়েতে যেতে পারি৷ ভাবি সামলে নিবে, যাবে?’
– ‘না থাক, আজ এমনিতেই বেশি হচ্ছে।’
‘আচ্ছা ঠিক আছে’ বলে পদ্যের দিকে তাকিয়ে পুনরায় বললো, ‘আমাকে কাপড় আনতে না করেছিলে কেন? অসুবিধা হচ্ছে না?’
পদ্য মুচকি হেঁসে বললো, ‘জেদ, তোমাকে দিয়ে আনাতে চাইছিলাম না। অথচ দেখো ভাবির শাড়ি-টাড়ি পরে থাকতে হচ্ছে। অসুবিধাই বটে।’
– ‘সেটাই আমাকে অবাক করছে। কেমন যেন স্বপ্ন লাগছে। মনে হচ্ছে একজন হৃদয়হীন নারী হুট করে আমার সঙ্গে এত ঘনিষ্ঠ হওয়ার কারণ কী।’
পদ্য ঠোঁট টিপে হেঁসে বললো, ‘আসলে আমি অনেক আগে থেকেই তো ভালোবেসে ফেলেছিলাম। এতদিন শুধু নিজেকে সামলে রেখেছি। গতকাল সন্ধ্যার পর থেকে আর পারিনি। ওখান থেকে চলে এসে পুরো রাত চাপা কষ্ট হচ্ছিল। এদিকে ভোরে উঠেই শুনি তুমি চলে গেছো। সবকিছু কেমন বাঁধ ভেঙে দিয়েছে আমার। তোমার কাছে অস্বাভাবিক লাগলেও, আমার কাছে না। কারণ তোমাকে আমি প্রশ্রয় না দিলেও অন্যদিকে পরিবারে তোমার কথা বলেছি। হৃদয়হীন হলে তা কেন বললাম?’
– ‘যাও বিশ্বাস করলাম হৃদয় আছে৷’
– ‘তোমার লেখালেখির খবর কী?’
– ‘সবকিছু গোল্লায়। জবও চলে গেছে। অবশ্য বই মেলায় বই ভালোই চলেছে। কিন্তু আরেকটা লেখায় এখনও হাত দিতে পারিনি।’
– ‘অল্প কয়দিনে জব চলে গেল?’
– ‘চলে যাক, আপাতত ট্রাই করবো না নতুন জবের। যদি আমাদের বিয়ে হয়, বিয়ের পর দুয়েক মাস গ্রামে থাকবো। তারপর এখানে এসে জবের ট্রাই করবো।’
পদ্য মুচকি হেঁসে বললো, ‘তুমি এত আত্মবিশ্বাস নিয়ে বিয়ের কথা বলো কীভাবে?’
– ‘বিয়ে তো আমাদের হাতে, ধরো এখন গিয়ে যদি করে ফেলি?’
– ‘এরকম করা যাবে না। আমার পরিবারে আমাকে দরকার আছে।’
– ‘চিন্তা করো না, ওরা মানবে, না মানলে পরে দেখা যাবে।’
– ‘আর হ্যাঁ, তুমি জব করলে লেখালেখিতে পুরোপুরি সময় দিতে পারবে তো? আমি যতদূর জানি তোমার সব বইই ভালো সাড়া ফেলেছে।’
– ‘তা ফেলেছে। কিন্তু পেশা হিসাবে নেয়ার মতো না৷ আরও কয়েক বছর যাক। তখন জব ছেড়ে পুরোপুরি লেখায় মনযোগ দেবো।’
পদ্য অন্যদিকে তাকিয়ে বললো,
– ‘শুধু বিয়ে বিয়ে করছো কেন। কাল রাতে তো বউও বলে ফেলেছিলে।’
অনিক চুলে আঙুল চালিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো, ‘পাগলের সুখ মনে মনে।’
– ‘তুমি আসলেই পাগল। এরকম কেউ বলে? কী যে কষ্ট লাগছিল রুমে এসে।’
– ‘আমি তো কষ্ট দিতে বলিনি। আমি আমার কথা বলেছিলাম।’
– ‘আচ্ছা যাই, গাড়িতে গিয়ে বসি। তারপর চলে যাব।’
– ‘চলো।’
দু’জন আবার ফিরে এসে গাড়িতে বসলো। অনিক খানিকক্ষণ চুপ থেকে বললো, ‘আচ্ছা তুমি কী এখনও গুনগুন করে গান গাও?’
– ‘না তো, গাইতাম না-কি আগে?’
– ‘হ্যাঁ, সারাক্ষণ গুনগুন করতে।’
– ‘তোমার সবকিছু এত মনে আছে?’
– ‘হ্যাঁ, এবার গ্রামে গিয়ে সবকিছু এত মনে পড়ছিল। জানো, বাইক কিনেছি। রোজ নদীর পাড়ে গিয়ে বসি। এলাকায় এদিক-ওদিক যাই। সবকিছুতে কেমন তুমি মিশে আছো। নদীর পাড়ের কথা মনে আছে?’
– ‘তা আছে, মিথ্যে বলে নিয়ে গিয়েছিলে।’
– ‘রোজ গিয়ে বসি সেখানে।
আমাদের বিয়েটা সবাই মেনে নিলে কী ভালো হতো তাই না? পুরো জীবনটা শৈশবের মতো আনন্দময় হয়ে যেত।’
পদ্য দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বিষণ্ণ মনে বাইরের দিকে তাকায়। অনিক ইতস্তত করে পুনরায় বললো,
– ‘আচ্ছা চলেই তো যাবে এখন। একবার জড়িয়ে ধরে বসতে পারি তোমায়?’
পদ্যের আবার শরীরটা কাটা দিল। ফিরে তাকায় ওর দিকে। মানুষটার চোখের দিকে তাকানো যায় না। এত ভালোবাসে কেন? চোখের দিকে তাকালেও দেখা যায় সেটা। পদ্য মাথা কাত করে সম্মতি জানায়। অনিক মোবাইলে একটা গান ছাড়লো। অনুপম রায়ের গান। তারপর পদ্যের পিঠের দিকে হাত নিয়ে জড়িয়ে ধরে। পদ্য মাথা রাখে তার কাঁধে। অনিক ওর মাথায় ঠোঁট ছুঁয়ে দেয়। পদ্যের হাতটা এনে চেপে ধরে তার গালে, ঠোঁটে৷ সেই মাতাল করা ঘ্রাণ। পদ্যের মৌলিক ঘ্রাণ। যা সে এতদিন দূরে থেকেও পেত। সেই উষ্ণতা। যে এতদিন দূরে থেকেও অনুভব করতে পারতো। অনিকের চোখটা ভিজে আসে। ওর গালে হাত রেখে কানের কাছে ফিসফিস করে বলে, ‘পদ্য।’
– ‘হুম।’
– ‘আমার এই নির্জীব, নিরস জীবনটাকে হঠাৎ এভাবে রাঙিয়ে দেয়ার জন্য ধন্যবাদ। সত্যিই আমার কাছে স্বপ্ন মনে হচ্ছে।’
পদ্যের কথা বলতে ইচ্ছা করছে না। ভালো লাগার আবেশে তার চোখবুজে আসছে। চুপচাপ এভাবে মানুষটার বুকে মাথা রেখে অনন্তকাল কাটিয়ে দিতে পারলে ভালো হতো। অনিকের উষ্ণ শ্বাস তার মাথায় পড়ছে৷ এত আদর করে গালে হাত রেখেছে। যেন সে শিমুল তুলো৷ সবকিছু এত ভালো লাগছে কেন? মৃদু সুরে অদ্ভুত মায়াময় একটা গানও বাজছে,
“কি মায়ায় বেঁধেছো আমায়,
পিয়া গো,
বুকে ধরে রাখো আরও কাছে থাকো,
ভালোবেসে ফেলেছি তোমায়,
সানাই এর সুর বাজে
মন নেই কোনো কাজে,
পান পাতা দিয়ে ঢেকে রেখেছি হৃদয়
কি মায়ায় বেঁধেছো আমায়,
পিয়া গো……।”
পদ্য ‘ওম-ওম’ গলায় বললো, ‘অনিক এরপর যে না পেলে দুজনের আরও বেশি কষ্ট হবে। ঠিক এই কারণে তোমাকে দূরে রাখতে চাইতাম সব সময়।’
পদ্যের মাথাটা তার কাঁধেই। ফিসফিস করে উষ্ণ শ্বাস ছেড়ে কথা বলায় তার রক্তে কেমন উষ্ণতা ছড়িয়ে গেল। পা থেকে এক অদ্ভুত শিহরণ উঠলো গিয়ে মাথায়। অনিক ওর মাথায় গালটা আরও চেপে ধরে, নিজের হাতের বাঁধন আরেকটু শক্ত করে বলে, ‘পদ্য এতদিন জানতাম তুমি আমাকে ভালোবাসো না। তাই নিজের কষ্ট সহ্য করেছি। এখন যে জানি আমার পদ্মফুলটারও আমার জন্য কষ্ট হয়। তোমাকে আমি এই কষ্ট পেতে দেবো না। দেখো ঠিকই তোমাকে পাব৷ তোমাকে পাওয়ার জন্য আমি এখন সবকিছু করতে পারবো। এতদিন তো জানতাম তুমি আমাকে চাও না।’
– ‘অনিক।’
– ‘হুম।’
– ‘তুমি যখন কাল আমার গালে হাত রেখে তাকিয়ে ছিলে। বলছিলে সরাতে ইচ্ছা করছে না। তখন আমারও ইচ্ছা করছিল এভাবে তাকিয়ে থাকি। তবুও ভয়ে তাড়াতাড়ি চলে এসেছিলাম। কাউকে ভালোবাসার পর সেটা গোপন রেখে ঘৃণা করার অভিনয়ের যন্ত্রণা কতটুকু তুমি জানো? জানো না, তোমার লেখায় কাজে লাগতো জানলে।’
– ‘না, তা জানি না। তবে মানুষের স্বভাব হচ্ছে ঘৃণা বুকের ভেতর লুকিয়ে রাখা আর ভালোবাসা প্রকাশ করা। মানুষ অহরহ ভালোবাসার অভিনয় করে, কিন্তু ঘৃণার অভিনয় করে না৷ ঘৃণা গোপন রাখে, ভালোবাসা পারলে আরও বেশি দেখায়। তুমি যেহেতু মানব জাতির স্বভাব বিরোধী কাজ করেছো, কষ্ট হবারই কথা।’
– ‘ঠিকই বলেছো৷ বুকে অসীম প্রেম নিয়ে মুখে ঘৃণার প্রলাপ বকেছি৷ এত কষ্ট হতো। অথচ এখন দেখো, প্রকাশ করতে গিয়ে কেমন শান্তি লাগছে। ইচ্ছা করছে শুধু বলতে থাকি। আচ্ছা আজ দিনটা এমন কেন অনিক?’
– ‘আজ দিনটা তোমার জন্য যেমনই হোক। এই ছোট্ট জীবনের মধ্যে আমার শ্রেষ্ঠ একটা দিন ছিল আজ আর গতকাল সন্ধ্যা৷’
পদ্য মাথা তুলে চুল ঠিক করতে করতে বললো, ‘আচ্ছা এবার যাই তাহলে।’
অনিক ওর মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে আঁজলা করে মুখ ধরে বললো, ‘ইস এলোমেলো চুল আবার মুখটাও কেমন লাল হয়ে আছে তোমার। মনে আছে ছোটবেলায় বলতাম তুমি কেমন ‘মায়া-মায়া’।’
পদ্য ঠোঁট টিপে হেঁসে বললো ‘হ্যাঁ।’
অনিক গাল থেকে হাত সরিয়ে নিল। পদ্য তাকিয়ে রইল খানিক্ষণ ওর দিকে৷ লম্বা চুল। দাড়ি-গোঁফ। অসম্ভব সুদর্শন একজন পুরুষ। তার নিজেরও ইচ্ছা করছে হাত ধরতে। মুখটা একটু ছুঁয়ে দিতে৷ কিন্তু তা অনিকের মতো কখনও প্রকাশ করতে পারবে না সে। অনিক ড্রাইভারকে ডেকে আনার জন্য নামতে চাচ্ছে। পদ্যের কেমন যেন লাগে। অনিক গ্রামে চলে যাবে৷ সে বাসায়। দু’জন দিকে। আচ্ছা সে যদি এখন বলে অনিক তোমার শরীর অনেক গরম মনে হয়েছিল আগে। কপালে হাত দিয়ে দেখি ‘জ্বর-টর’ এলো কি-না। তাহলে কী বুঝে ফেলবে অনিক? হয়তো বুঝে যাবে। অনিক পুনরায় বললো, ‘ম্যাডাম পথ দাও। আমি ড্রাইভারকে নিয়ে আসি।’
– ‘বসো আরেকটু সময়।’
– ‘আচ্ছা বসলাম।’
– ‘চাচাকে কল দিয়ে দেই। বাসায় গিয়ে তো অসুবিধা৷ অন্যরা থাকে।’
– ‘আচ্ছা দাও।’
– ‘আমি আমার মতোই কথা বলবো? ঠিক আছে?’
– ‘আচ্ছা বলো, বুঝেছি বিয়ের পর শ্বশুর হবেন। তাই কথা বলতে এত লজ্জা।’
পদ্য মুচকি হেঁসে বললো, ‘কম কথা বলো, কল দিলাম’ বলে পদ্য মোবাইল কানে লাগায়।
তিনবার রিং হতেই রিসিভ করলেন মিরাজুল সাহেব৷ সে সালাম দিল। তিনি জবাব দিয়ে বললেন,
– ‘পদ্য মা, কী খবর তোমাদের। ভালো আছো?’
– ‘হ্যাঁ চাচা ভালো।’
– ‘কিছু বলবে?’
– ‘আসলে কীভাবে বলবো চাচা বুঝতে পারছি না।’
– ‘কী বলবে বলো মা, নির্দ্ধিধায় বলো।’
– ‘চাচা অনিকের ব্যাপারটা মনে হয় সিরিয়াসলি নেয়া দরকার আপনার। ওর আচরণ পুরাই অস্বাভাবিক।’
– ‘হ্যাঁ, মা তা তো আমিই দেখছি। গ্রামে এসে যেদিকে ইচ্ছা যাচ্ছে। চোখ লাল করে হাঁটছে। ঘুম-খাওয়ার কোনো ঠিক নাই। এখন সেখানে গিয়ে কি করছে মা?’
– ‘আসলে চাচা আপনি তো জানেন ওকে কিছুদিন আগে আমি অপমান করে তাড়িয়ে দিয়েছিলাম। তারপর ভাবির কাছে শুনলাম সিগারেট চিবিয়ে খেয়েছে। রাস্তায় গিয়ে বমি করেছে। জব ছেড়ে দিয়েছে। খাওয়া ঘুম বাদ। মানে এগুলো শুনলে কষ্ট লাগে। এবার এসে আরেক বিপদে ফেলেছে।’
– ‘কী?’
– ‘ও আমাকে একা পেয়ে অনেক পাগলামি করেছে। তারপর বললো আমার যেদিন বিয়ে হবে সেদিন বি*ষ খাবে অথবা গলায় দ*ড়ি দেবে। আমার অনেক ভয় করছে চাচা। আফরা ভাবিকেও বলেছি। উনি বলে সত্যিই খেতে পারে। আমাকেও বলেছে।’
– ‘আরে না মা। ভয় দেখাইছে এরকম হবে না।’
– ‘চাচা আমি একটা কথা বলি। আমার লজ্জা লাগছে তবুও বলতে চাই৷’
– ‘আহা লজ্জা পাচ্ছ কেন মা, বলো। আমি তো একদিন বলেছিলাম সবকিছু আমাকে বলতে।’
– ‘চাচা ওর কষ্ট দেখে আমার সহ্য হয় না৷ সত্যি কথা বলতে দুই পরিবার রাজি থাকলে অনিককে বিয়ে করতে আমার কোনো সমস্যা নেই। আমি শুধু আপনার কথায় ওর সাথে খারাপ ব্যবহার করেছি। এখন আর করার সাহস নেই। যদি সত্যিই বি*ষ খায়?’
– ‘তুমি ভয় পাচ্ছ কেন মা? ও বি*ষ খাবে না।’
– ‘আমি শুধু আপনাকে জানালাম চাচা। আমি ওর সঙ্গে খারাপ আচরণ করতে পারছি না। আমি সব কথা আপনাকে বলতে লজ্জাও পাচ্ছি। কিন্তু কি করবো বলুন। অবিভাবকদের মাঝে শুধু আপনি জানেন ব্যাপারটা। অনিককেও আমি কখনও প্রশ্রয় দেইনি। কিন্তু আমিও তো মানুষ চাচা। ও এত ভালোবাসে, বিয়ে করতে চায়। তার তো কোনো দোষ নেই। বিয়ে করতে চাওয়া তো খারাপ কিছু না৷ অথচ ওইদিন আমি গ্রাম থেকে বিদায় করে দিয়েছি আজেবাজে কথা বলে।’
– ‘তুমি এত দূর্বল হলে তো চলবে না মা।’
– ‘চাচা আমি তো অনেক চেষ্টা করেছি। এখন উলটো নিজেই দূর্বল হয়ে যাচ্ছি। ও বারবার এমন করলে এক সময় যদি বলে দেই আমার কোনো সমস্যা নেই দুই পরিবার মানলে।’
– ‘দুই পরিবার মানবে কীভাবে? তুমি তার বয়সে বড়ো৷’
– ‘এটা ওকে আমি আর বুঝাতে যেতে পারব না চাচা। আপনি ব্যাপারটা বুঝুন। আমার বয়সও তো ভুল করার। অলরেডি বলেছি সবাই রাজি থাকলে অনিককে আমার বিয়ে করতে সমস্যা নেই। তারপরও আপনি ওকে বুঝাতে বলছেন? আমার মনে হয় আপনি একদিন আমাদেরকে নিয়ে এক সঙ্গে বসে বুঝান। আমার আব্বা অসুস্থ। আম্মা তো আছেন। আপনি, নাঈম ভাই আছেন। সবাই বসে তাকে বুঝান। আমাকেও একা বুঝিয়ে লাভ কী। ব্যাপারটা এখন সিরিয়াসলি নেন।’
– ‘তা তো নিতে হবে মনে হচ্ছে। তুমি ওকে যদি বলে দাও সবাই রাজি থাকলে তোমার বিয়ে করতে আপত্তি নেই। তাহলে তো ঝামেলা হবে মা। আর তুমিই বা বয়সে ছোট ছেলেকে কীভাবে বিয়ে করতে আপত্তি নাই বলছো।’
– ‘চাচা আমার লজ্জা লাগছে এগুলো নিয়ে কথা বলতে। আসলে আমি নিজেই ওকে তাড়িয়ে দিয়েছি। চ*ড় মেরেছি। কিন্তু ও বারবার পাগলামি করায়। এত বছর পর এখন আর আমার কাছে ছোটো মনে হয় না৷ তবুও চাচা আমি ওকে বলিনি কিছু। আপনারা তাকে বুঝাতে পারলেই হবে।’
– ‘আমাকে বলেছো মা খুশি হয়েছি। এজন্যই তোমাকে এত পছন্দ করি। আমাকে সময় দাও। ভাবতে দাও বিষয়টা। ওকে তুমি বলতে যেও না আবার দুই পরিবার রাজি থাকলে বিয়েতে তোমার সমস্যা নেই।’
– ‘আচ্ছা চাচা, রাখি তাহলে।’
পদ্য ফোন রেখে অনিককে বললো, ‘পানির বোতলটা দাও, বাবা এত লজ্জা লাগছিল। আমার বুক ধড়ফড় করছে।’
– ‘একদম পাক্কা অভিনেত্রী তো তুমি। আমি তোমাকে শিখিয়ে দিচ্ছিলাম কেন বুঝলাম না। তুমি তো আমাকেও বোকা বানিয়েছিলে। এখন আমার বাপকেও।’
পদ্য পানি মুখে নেয়ার আগে হেঁসে বললো, ‘দাঁড়াও হাসলে পানি খেতে পারবো না।’
– ‘আচ্ছা খাও।’
পদ্য পানি খেয়ে বললো, ‘এখন উনি কী করবেন?’
– ‘জানি না। আব্বা কিন্তু তোমাকে দিয়ে যে কাজটা করেছিল সেটা খুবই ইউনিক। এবং কাজও হয়েছিল। এতটা বছর আমরা আলাদা ছিলাম। অন্য বাবারা ওইদিনই হাউকাউ করতো৷ কিন্তু উনি এমন কাজ করেছে কেউ জানে না, আবার আমাদের আলাদাও রেখেছে৷’
– ‘ভয় করছে আমার।’
‘ভয় পেও না তো, যাই ড্রাইভারকে ডেকে আনি’ বলে অনিক নেমে গেল গাড়ি থেকে।
.
__চলবে…
লেখা: জবরুল ইসলাম