ছন্দহীন পদ্য পর্ব ২৩

0
331

ছন্দহীন পদ্য
.
পর্ব_২৩
.
পদ্যদের বাড়িতে বেশ কয়েকজন মানুষ এসেছেন। বাজার থেকে ডাক্তারও আনা হয়েছে। মতিন মাস্টার রাতে হঠাৎ মনিরা বেগমকে বলেছিলেন ঘাড় ব্যথা করছে। চোখে অস্পষ্ট দেখছেন। একবার প্রস্রাব করতে উঠতে যেয়ে পড়েও গেলেন। মনিরা বেগম ধরে বিছানায় এনে শুইয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু ভোরে অবস্থা দেখে তিনি অস্থির হয়ে সবাইকে ডাকলেন। মতিন মাস্টার বিছানা থেকে উঠতে পারছেন না। বাঁ হাত আর পা অবশ হয়ে গেছে। মুখ একদিকে বেঁকে গেছে খানিকটা। সেখানে এসে লালা জমছে। মনিরা বেগম সাদা কাপড় দিয়ে বারবার মুছে দিচ্ছেন। পদ্য ডাক্তারকে বললো, ‘কী হয়েছে? হাসপাতাল নেয়া লাগবে তাই না?’

ডাক্তার মাথা নেড়ে বললো, ‘হ্যাঁ, তাড়াতাড়ি নেওয়া দরকার৷’

মিরাজুল ইসলাম সাবেক মেম্বার থাকায় কেউ কেউ এখনও সে নামে ডাকে৷ রইসু মিয়া বললেন, ‘মেম্বার, লক্ষণ ভালো না। তাড়াতাড়ি পাঠানো দরকার।’

মিরাজুল ইসলাম পেছনে হাত বেঁধে দাঁড়িয়ে আছেন। খানিকক্ষণ ভেবে বললেন, ‘বাজার পর্যন্ত নিতে হলে তো লোক লাগবে।’

– ‘আমি গিয়ে পলো আর দড়ি নিয়ে আসতেছি। দেখি মানুষও পাই কি-না। আপনি এক কাজ করেন। নাঈম, অনিক তো শহরে আছে ওদের কল দিয়ে জানান৷ এরা মহিলা মানুষ, কিছুই তো বুঝবে না।’

মিরাজুল ইসলাম ইতস্তত করে বললেন, ‘আচ্ছা আমি নাঈমকে বইলা দিচ্ছি।’

তিনি বাইরে গিয়ে নাঈমকে কল দিয়ে এসে মনিরা বেগমকে বললেন, ‘রেডি হোন ভাবি। আর টাকা-পয়সা নিয়ে যান। কখন কি লাগে বলা তো যায় না।’

মনিরা বেগম এসে তাড়াতাড়ি বোরখা পরতে পরতে বললেন, ‘এই মনিসা যেতে হলে রেডি হ।’

– ‘আম্মা আপু যাবে না?

– ‘ওর কথা মুখে আনবি না৷ এই সর্বনাশীর কারণে আজ এই অবস্থা।’

পদ্য বোরখা হাতে নিয়ে কাঁদো কাঁদো গলায় বললো, ‘আম্মা এখন এসবের সময় না। দয়া করে চুপ থাকো..।’

মিরাজুল ইসলাম ঘরে ঢুকছেন দেখে সে চুপ হয়ে গেল। মনিরা বেগমও আর কিছু বললেন না।

মিরাজুল ইসলাম বিছানায় বসে বললেন, ‘পদ্য মা, নাঈমকে শহরে গিয়েই কল দিয়ো। আমিও যেতাম। কিন্তু তার দরকার হবে না। নাঈম তো আছেই।’

– ‘আচ্ছা চাচা।’

– ‘নাঈমের নাম্বার আছে তো?’

– ‘হ্যাঁ, আছে।’

– ‘তাহলে আর কোনো অসুবিধা হবে না৷ আল্লাহর হাউলা।’

তারা তিনজনই রেডি হলো। মনিসাকে একা রেখে যাওয়া যায় না। ঘর তালা দিয়ে তারা বের হলো বেলা এগারোটার আগেই। দু’জন লোক মতিন সাহেবকে পলোতে বসিয়ে কাঁধে করে নিয়ে এলো রসুলপুর বাজারে। পুরো রাস্তায় মনিরা বেগম পদ্যকে কখনও দাঁত কটমট করে আবার কখনও চোখ রাঙিয়ে তাকালেন। কারণ আজকের এই অবস্থার জন্য তো পদ্যই দায়ী।
.
নাঈম অফিসে যাওয়ার আগেই কলটা পেয়েছিল। মতিন সাহেব তারও স্যার। পাশাপাশি বাড়িও তাদের। তাই ব্যাপারটা কোনোভাবেই এড়িয়ে যেতে পারে না। অফিসে কল দিয়ে ছুটি নিয়েছে। অবশ্য অনিককে দিয়েও হয়ে যেত। কিন্তু মিরাজুল ইসলাম ফোনে বলেছেন অনিককে না জানিয়ে সবকিছু যেন সে করে। অফিসে যাচ্ছে না দেখে আফরা তাকে বলেছিল, ‘অফিসে যাবে না?’

সে জবাবে বলেছে, ‘না, পদ্য আছে না? ওর বাবা অসুস্থ। ওরা ডাক্তারের কাছে নিয়ে আসবে। হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে দিতে হবে। বুঝোই তো গ্রামের মানুষ, এর মাঝে পুরুষ কেউ সঙ্গে নাই।’

– ‘বলো কী! কী অসুখ?’

– ‘আব্বা যেসব বলেছেন। তাতে মনে হয় মাইল্ড স্ট্রোক হয়েছে।’

– ‘অফিসে না গিয়ে তাহলে ভালোই করেছো।’

– ‘হ্যাঁ, তা তো একটু করতেই হবে। উনি আমাদের স্কুলের স্যার। তাছাড়া পাশের বাড়ি হিসাবে তাদের সাথে অনেক ভালো সম্পর্ক ছিল।’

– ‘অনিককে বলি, সেও জানে না হয়তো..।’

নাঈম হাত ধরে আঁটকে বললো, ‘দরকার নেই, আব্বা না করেছেন।’

আফরা সেই থেকে চুপচাপ বসে আছে। নাঈমের সঙ্গে কথাই বলছে না। এই বিপদে নাঈম না গিয়ে অনিক ছোটাছুটি করলে হয়তো পদ্য সহ ওর পরিবার তার প্রতি খানিকটা খুশি হতো। এই সুযোগও ওরা কাজে লাগাতে দেবে না।

নাঈম হাসপাতাল থেকে রাতে বাসায় ফিরে এলো। আফরার সাময়িক রাগ ততক্ষণে পড়ে গেছে। সে জিজ্ঞেস করলো, ‘কী অবস্থা ওদের?’

নাঈম শার্টের বোতাম খুলতে খুলতে বললো, ‘টেস্ট-বেস্ট করেছে, হাসপাতালে থাকা লাগবে কিছুদিন। থেরাপি-টেরাপিও লাগবে।’

– ‘ওরা খাবে কোথায়?’

– ‘বাইরে থেকে খেতে হবে। পদ্যকে রেস্টুরেন্ট দেখিয়ে দিয়েছি।’

– ‘আমি একবার দেখতে যেতে চাচ্ছিলাম।’

– ‘কাল অফিসে যাওয়ার আগে আমি ওদের দেখে যাব। তুমি তখন সঙ্গে যেতে পারো।’

– ‘আচ্ছা ঠিক আছে।’

– ‘একটা সমস্যা আছে। ওরা থাকবে কীভাবে বুঝলাম না৷ তিনজন সঙ্গে এসেছে।’

– ‘আমাদের বাসায় নিয়ে আসতে। ওরা একেকদিন, একেকজন থাকলো রোগীর সাথে।’

– ‘তা ঠিক বলেছো। কিন্তু পদ্যকে তো আনা যাবে না৷’

– ‘আনলে সমস্যা কী?’

– ‘জানো না মনে হচ্ছে।’

– ‘তুমিও নাঈম বেশি বাড়াবাড়ি করছো।’

নাঈম হেঁসে বললো, ‘আরে আমার কী এখানে। আব্বা শুনলে রাগারাগি করবে।’

– ‘আব্বা শুনবে কীভাবে?’

– ‘না শুনলেও। তবে মনিসা আর চাচিকে তুমি কাল গেলে বইল। রাতে আমাদের বাসায় চলে আসতে। একদিন আমি নিয়ে আসলেই ওরা একা আসতে পারবে।’

আফরা কোনো জবাব দিল না। সোফায় বসে রইল। নাঈম ওর পাশে বসে কাঁধে হাত রেখে বললো, ‘তুমি অনিকের বিষয়টার জন্য অকারণ আমার সাথে কিছুদিন থেকে রাগারাগি করছো।’

– ‘আমি রাগারাগি করব কেন? তোমার ভাই, কিছু হলে তোমার ভাইয়ের হবে, আমার কী?’

নাঈম তাকে পিঠের দিকে হাত নিয়ে জড়িয়ে ধরে বললো, ‘আচ্ছা পদ্যকে আনতে পারবে না বলে রাগ করছো তো? তুমি এটা ছাড়াও একটা ভালো কাজ করতে পারো।’

– ‘কী?’

– ‘এই কাজ করলে আব্বাও জানবে না। সেটা হলো ওদেরকে খাওয়ানো। আমি অফিস যাওয়ার সময় দিয়ে যাব। একটু বেশি করে দেবে যাতে পদ্য রাতেও খেতে পারে। আর চাচি মনিসা এখানে এসে থাকবে যেহেতু। রাতে খেতে পারবে।’

– ‘আচ্ছা ঠিক আছে।’

নাঈম ওর কপালে চুমু খেয়ে বললো, ‘ইভা আর যাওয়ার সময় পেল না বুঝি? বললাম কিছুদিন অনিককে সময় দিতে।’

– ‘ও থেকেও কাজ হতো না নাঈম। অকারণ তোমরা এসব করছো। সিরিয়াস প্রেমে বিচ্ছেদ হলে কেউই স্বাভাবিক হয় না।’

– ‘কত দেখেছি মেয়ের বিয়ে হয়ে যায়। ছেলে রাতে দুই-তিনটা সিগারেট টেনে ভোরে সবকিছু ভুলে যায়।’

– ‘এগুলো তেমন সিরিয়াস না। সিরিয়াস প্রেম হলে বিচ্ছেদ কম হয়। পালিয়ে-টালিয়ে বিয়ে করে ফেলে। অথবা ছেলে-মেয়েরা অতিরিক্ত পাগলামি করলে পরিবার মেনে নেয়। আর যাদের নেয় না এরাই আত্মহ*ত্যা করে অথবা পা*গল হয়। কেউ কেউ স্বাভাবিক হলেও পুরোপুরি হয় না।’

নাঈম হেঁসে উঠে বললো, ‘তুমি অকারণ দুশ্চিন্তা করছো।’

– ‘নাঈম তোমরা কাজটা ঠিক করছো না। অনিক অনেক শক্ত ছেলে। সেও এমন ভেঙে পড়েছে বুঝতে পারছো ব্যাপারটা? অফিসে যায় না। সারাক্ষণ অন্ধকারে বসে থাকে। উলটা-পালটা কথা বলে।’

– ‘তো আমি কী করবো বলো? পদ্য নিজেই তো মানেনি তাকে। এরপর আছে দুই পরিবার। ব্যাপারটা এত সহজ না-কি?’

– ‘তোমার ভাইয়ের বাঁচা-মরার প্রশ্নে তোমার কিছুই করার নেই?’

– ‘তুমি যেরকম ভাবছো এরকম কিছুই হবে না। কিছুদিন পর ভুলে যাবে।’

আফরা ওর বুকে মুখগুঁজে ফ্যাসফ্যাসে কেঁদে ফেললো। নাঈম অবাক হয়ে মাথায় হাত রেখে বললো, ‘আরে পাগল না-কি? হঠাৎ কাঁদছো কেন?’

– ‘অনিক মোটেও ভুলতে পারবে না। কিছু একটা করো নাঈম। আমি আজ অনিকের ডায়েরি পড়ে সারাদিন একা একা কেঁদেছি। এত কষ্ট হচ্ছে ছেলেটার জন্য।’

– ‘কীসের ডায়েরি?’

– ‘গতকাল দুপুরে ওর রুমে গিয়েছিলাম৷ গিয়ে দেখি সে ঘুমিয়ে আছে। পাশে নীল ডায়েরি একটা। তুলে এনে পড়তে শুরু করে ভীষণ কষ্ট হচ্ছিল। সহ্য করতে না পেরে রেখে এসেছি আবার। ইস কত ভালোবাসে ছেলেটা৷ অথচ পদ্যকে পাবে না? কিছুই কী করার নেই? আমাদের জন্য যা করার সবই তো করেছিল সে।’

– ‘তুমি সব সময় এত ইমোশনাল হও কেন বলো তো? আমাদের কি করার আছে এখানে?’

আফরা মাথা তুলে চোখ মুছে বললো, ‘তুমি তো যতটুকু করার তাইই করছো না। আব্বা যা বলেছেন তাইই শুনে যাচ্ছ।’

– ‘তো এখন কী পদ্যকে এখানে এনে রাখতে হবে? আনলে কী ওদের বিয়ে হয়ে যাবে?’

– ‘তুমি অনিককে ব্যাপারটা শুনতে দিচ্ছ না কেন? তাছাড়া পদ্য এ বাসায় আসুক তা চাচ্ছ না কেন? আব্বা তো দেখছেন না এগুলো? এই ছোটো কাজেই তো তুমি বিরোধিতা করছো।’

– ‘পদ্য এলে লাভ কী? এলেই কী সকল সমস্যা সমাধান হয়ে যাবে? তাছাড়া পদই যেখানে অনিককে ফিরিয়ে দিয়েছে, তুমি কেন অস্থির হচ্ছ বলো তো?’

আফরা তাচ্ছিল্য করে হেঁসে বললো, ‘পদ্যও অনিককে ভালোবাসে, আমি ওর সাথে কলে কথা বলেছিলাম। মেয়েটা শুধু সমাজ আর পরিবারের কথা ভেবে প্রকাশ করছে না।’

– ‘বলো কী! সত্য না-কি?’

– ‘এখন কী বাড়িতে কল দিয়ে জানাবে না-কি? মেয়েটি তো তোমার ভাইয়ের কাছেও প্রকাশ করেনি।’

– ‘কিন্তু ওদের কি মাথায় সমস্যা? জানে না এর পরিণতি কী হবে?’

– ‘আচ্ছা তুমি কী অন্ধ নাঈম? তুমি কী সত্যিই বুঝো না, না-কি অভিনয় করো? প্রেম কী এত ভেবে হয়? ওদের হয়ে গেছে। ওরা নিজেরাই বিপদে। পদ্য প্রকাশই করেনি। বুঝতে পারছো না ব্যাপারটা? ওরা নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করেও পারেনি। হিন্দু, মুসলিম ছেলে-মেয়েদের প্রেম হতে দেখোনি কখনও? কত হয়। ওরা কী জানে না আগে পরিণতি কি? গ্রামগঞ্জে এরকম অনেক ঘটনাই তো আছে। মানুষ হইচই করবে জানে তবুও তো প্রেমে পড়ে, বিয়ে করে। এগুলো একটু ভাবো।’

নাঈম হেঁসে উঠে বললো,

– ‘তুমি রাজি ওদের বিয়ে দিতে?’

– ‘হ্যাঁ, অবশ্যই রাজি। মানুষের চিন্তা করলে হবে? দুইটা মানুষ যদি আত্মহ*ত্যা করে তখন কেমন লাগবে? মানুষ বাঁচাতে পারবে তখন?’

নাঈম খানিকক্ষণ চুপ থেকে বললো, ‘পদ্যও অনিককে ভালোবাসে, সত্য বলছো?’

– ‘হ্যাঁ, তবুও মেয়েটা অনিককে বলেনি।’

– ‘বুঝেছি, আচ্ছা চলো তো। অনিকের সাথে কথা বলি।’

– ‘কী বলবে?’

– ‘এই বিষয়ে কথা বলি, বুঝাই৷ অফিসেও তো যাচ্ছে না। এভাবে কতদিন।’

– ‘যাও, তোমার যা ইচ্ছা করো।’

নাঈম উঠে অনিকের দরজায় এসে নক করে। কৌতূহল থেকে খানিক পর আফরাও উঠে এলো। কয়েকবার নক করতেই অনিক দরজা খুলে দিল।

‘ও ভাইয়া, আসো’ বলে সে বাতি জ্বেলে দিল। নাঈম চেয়ার টেনে বসলো গিয়ে৷ আফরা বিছানায়। নাঈম ক্ষীণ সময় পর বললো, ‘কিরে তোর হয়েছেটা কি? চেহারার এই অবস্থা৷ অফিসে যাচ্ছিস না, সারাদিন দরজা বন্ধ করে পড়ে থাকিস।’

– ‘কিছু না ভাইয়া। এমনিই, ভালো লাগে না তাই।’

– ‘কিছু না মানে কী? আমি তো শুনেছি পদ্যের বিয়ে হয়ে যাচ্ছে তাই এমন করছিস।’

অনিক ঘাড় ঘুরিয়ে আফরার দিকে তাকায়। আফরা ফিক করে হেঁসে বললো, ‘আমার দিকে তাকিয়ে লাভ নেই। আমি কিছু বলিনি।’

নাঈম পুনরায় বললো, ‘তোর কাছে কেউ বয়সে বড়ো একটা মেয়েকে বিয়ে দিতে যাবে কেন?’

– ‘পদ্যই এসব না করে দিয়েছে ভাইয়া। সুতরাং এগুলো নিয়ে কথা বলে লাভ নেই।’

– ‘পদ্য রাজি হলেই বা কী করার? কী করতি?’

– ‘পদ্য রাজি হলে বিয়ে করে নিতাম।’

– ‘বয়সে বড়ো একটা মেয়েকে বিয়ে করে নিতি? এলাকার মানুষ কী বলতো?’

– ‘এলাকার মানুষ কী বলতো তাতে আমার কী? এলাকার মানুষের চয়েজ মতো আমি জীবন-যাপন করবো না-কি?’

– ‘সমাজ বলতে তো একটা কথা আছে।’

– ‘কোন সমাজ? এরা তো মুসলিম সমাজই। মোহাম্মদ (সঃ) ২৫ বছর বয়সে ৪০ বছরের খাদিজাকে বিয়ে করেছিলেন। তাহলে মুসলিম সমাজের আবার সমস্যা কী এখানে? তাছাড়া প্রচুর ডিভোর্সী নারীর দ্বিতীয় বিয়ে হয় বয়সে ছোটো পুরুষের সঙ্গে। তাহলে অবিবাহিত অবস্থায় করলে সমস্যা কী? এসব মূর্খের মতো প্রশ্ন আমাকে করো না ভাইয়া। তোমরা রুম থেকে যাও।’

নাঈম ইশারা দিয়ে আফরাকে নিয়ে বের হয়ে গেল। আফরা খানিক পর টেবিলে ভাত দিয়ে অনিককে টেনে-টুনে খেতে নিয়ে গেল। খাওয়া শেষে বিছানায় যাওয়ার পর নাঈম বললো, ‘আসলেই, এগুলো তুচ্ছ বিষয় মানুষ বড়ো করে দেখে৷ মনের মিলই আসল। কিন্তু আমরা বুঝলেই কী হবে? লোকের মুখ তো আর বন্ধ রাখা যাবে না। পদ্যের ফ্যামিলিও রাজি হবে কি-না সন্দেহ আছে।’

আফরা ওর হাত ধরে বললো, ‘এইতো বুঝেছো, তাহলে পদ্যের আব্বা সুস্থ হলে তুমি একদিন কথা বলে দেখো না। মানতেও তো পারেন।’

নাঈম কোনো কথা বললো না। দীর্ঘ সময় চুপ থেকে বললো, ‘আচ্ছা তুমি আরও একদিন পদ্যকে জিজ্ঞেস করে দেইখো অনিককে পছন্দ করে কি-না। করলে না হয় আমরা দু’জন আব্বাকে রাজি করালাম। আব্বা তখন স্যারের সঙ্গে কথা বলবেন।’

আফরা প্রচণ্ড খুশি হয়ে নাঈমকে জড়িয়ে ধরে গলায় চুমু খেল।

পরেরদিন ভোরে ঘুম থেকে উঠে আফরা রান্নাবান্না করে টিফিনবাক্সে খাবার নিল। নাঈম অফিসে যাওয়ার সময় সেও চলে এলো হসপিটাল। দু’বার নক করতেই পদ্য খুলে দেয় দরজা। দু’জন সালাম দিয়ে ভেতরে যায়। মতিন সাহেবের মাথার পাশে মনিরা বেগম বসে আছেন। পাশের বিছানায় আফরা আর নাঈম গিয়ে বসে। মনিসা আর পদ্য দাঁড়িয়ে আছে। আফরা পদ্যকে চিনতে পারছে। তবুও যেন শিওর হতে চাচ্ছে। সে মুচকি হেঁসে বললো, ‘তোমরা দু’জন দাঁড়িয়ে আছো কেন? বসো এসে।’

মনিসা এসে বসলো পাশে৷ আফরা মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো, ‘তোমার নাম মনিসা?’

– ‘হ্যাঁ।’

– ‘উনার নাম পদ্য?’

– ‘হ্যাঁ।’

আফরা মাথা তুলে পদ্যের দিকে তাকিয়ে রইল খানিক্ষণ। কী মায়াবী চেহারা মেয়েটির। এমন চেহারায় কখনও মেকাপ করতে হয় না। চোখ দু’টো প্রচণ্ড সুন্দর৷ ভ্রু এবং চোখের পাপড়ি ভীষণ কালো। একটা সাধারণ সেলোয়ার-কামিজ পরনে। ওড়না মাথায়। মোটেও অনিকের থেকে বড়ো মনে হয় না। ইস ওরও চোখের নিচে কালি পড়ে গেছে৷ সে এভাবে তাকিয়ে থাকায় পদ্য লজ্জা পাচ্ছে। আফরা চোখ ফিরিয়ে মনিরা বেগমকে বললো, ‘চাচি আমি টিফিন এনেছি৷ প্রতিদিন আপনাদের জন্য নিয়ে আসবো।’

– ‘না না মা, তোমাদের কষ্ট করতে হবে না। আমরা বাইর থেকে এনে খেতে পারবো।’

– ‘না চাচি, নাঈম অফিসে যাওয়ার সময় দিয়ে যাবে। আর এখানে তিনজন থাকা অসুবিধা। আপনারা একজন একেকদিন এখানে থাকুন। আর দুইজন আমাদের বাসায়।’

– ‘হ্যাঁ থাকাটা একটু সমস্যার। এক্সট্রা কিছু আনিওনি যে নিচে থাকবো।’

নাঈম বললো, ‘আমাদের বাসায়ই থাকতে পারবেন। আর যেকোনো দরকার হলে কল দিয়েন। আমি অফিসে থাকলেও আফরা আছে৷ আমি এখন যাই, অফিসের সময় হয়ে গেছে।’

– ‘আচ্ছা বাবা তুমি যাও।’

নাঈম চলে গেল। আফরা পদ্যকে বললো, ‘আসো, বাইরে গিয়ে একটু হেঁটে আসি’ বলে সে ওকে বাইরে নিয়ে এলো। হসপিটালের বারান্দা ধরে দু’জন হেঁটে এক মাথায়। সেখান থেকে বাইরে সবুজ মাঠ আর গাছগাছালি দেখা যাচ্ছে। আফরা রেলিঙ ধরে দাঁড়িয়ে পদ্যের দিকে তাকিয়ে বললো, ‘তুমি অনেক মিষ্টি দেখতে।’

পদ্য ফ্যাকাশে মুখে হেঁসে বললো, ‘আপনিও ভাবি।’

– ‘দু’জনেরই চোখের নিচে কালি পড়ে গেছে। কেউ কারও থেকে কম পু*ড়ছো না।’

পদ্য কোনো জবাব দিল না। আফরা পুনরায় বললো, ‘যাইহোক, হসপিটাল এসে এসব কথা না বলি। আর আঙ্কেলের জন্য চিন্তা করো না ঠিক হয়ে যাবে।’

পদ্য দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো, ‘তাই হোক, না হলে আমি নিজেকে কখনও ক্ষমা করতে পারবো না।’

– ‘কেন? তোমার এখানে কী হয়েছে?’

– ‘আসলে আমি আপনার সাথে ফোনে কথা বলার পর আমি আব্বা-আম্মাকে অনিকের কথা বলে দিয়েছিলাম। আর আব্বার হাই প্রেশারের সমস্যা ছিল। হয়তো এসব নিয়ে চিন্তা করেই এমন হয়েছে..।’

বলতে বলতে পদ্যের গলা ধরে এলো। আফরা ওর হাত ধরে বললো, ‘এসব ভেবে মন খারাপ করো না পদ্য। যা হওয়ার হয়ে গেছে।’

পদ্য আফরাকে জড়িয়ে ধরে ফ্যাসফ্যাস করে কাঁদতে কাঁদতে বলে, ‘অনিককে একটু বুঝিয়ে বইলেন। আমার আসলে আর কিছু করার নেই ভাবি। বুঝতেই পারছেন এখন আব্বার কথার বাইরে যাওয়া অসম্ভব৷ ওকে আমিও ভীষণ ভালোবেসে ফেলেছি৷ মানুষটাকে খুবই দেখতে ইচ্ছা করে। তাকে কষ্ট দিয়ে আমিও সমানভাবে কষ্ট পাই ভাবি। কিন্তু কী করবো বলুন? আর কোনো পথ যে খোলা নেই৷ আমি আজ ভেবেছি আব্বার পছন্দের পাত্রের সঙ্গে বিয়েতে রাজি হয়ে যাব। অনিককে একটু দেখে রাখবেন, বোঝাবেন।’ বলতে বলতে পদ্যের কান্না আরও বেড়ে গেল। সঙ্গে কেঁদে ফেললো আফরাও।
__চলবে…
লেখা: জবরুল ইসলাম

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here