ছন্দহীন পদ্য পর্ব ১৬

0
273

ছন্দহীন পদ্য
.
পর্ব_১৬
.
আফরার হতভম্ব ভাব কাটার পর তাড়াতাড়ি রুমে গিয়ে মোবাইল হাতে নিয়ে নাঈমকে কল দেয়। দু’বার রিং হয়ে কেটে এলো। ধরছে না কেন কে জানে। আফরার কেমন ভয় করছে। অনিক হঠাৎ এমন অদ্ভুত আচরণ করবে কেন! কি হয়েছে ছেলেটার। খানিক ভেবে সে কল দিল শাশুড়ি সুফিয়া বেগমের কাছে। রিসিভ হতেই সালাম দিয়ে বললো, ‘আম্মা কেমন আছেন?’

– ‘ভালো, তোমরা কেমন আছো?’

– ‘ভালো আছি আম্মা, কিন্তু একটা কথা বলতে কল দিয়েছি। আসলে হয়েছে কি। নাঈম তো বাইরে, ইভাও বাইরে..।’

তিনি থামিয়ে দিয়ে বললেন,

– ‘এই মেয়ে, তোমার মা-বাপ কোনো আদব-কায়দা শিখায় নাই? স্বামীর নাম ধরো কেন! এইটা কেমন খাসলত?’

আফরা শুকনো ঢোক গিলে আমতা-আমতা করে বললো, ‘আচ্ছা আম্মা আগে শুনুন। অনিক কেমন যেন করছে। আর কেউ বাসাও নাই। খালি বাসা তাই কল দিছি আপনাকে..।

তিনি আবার থামিয়ে দিয়ে বললেন,

– ‘কি, কি বলতাছো? খালি বাসায় তোমারে কি করছে? এত মিনমিন না কইরা গলা ঝাইড়া বলো। হাপাইতাছো কেন?’

– ‘আম্মা, আমি বলতে চাইছি বাসায় আমি একা। অনিক বাইরে চলে গেছে। আমার সাথেও কেমন করে যেন কথা বলেছে। মনে হচ্ছে পাগল হয়ে গেছে।’

– ‘কি বলতাছো এইসব? পাগল হয়ে গেছে মানে?’

– ‘হ্যাঁ আম্মা, অফিসের জন্য রেডি হয়েছিল। হঠাৎ ওর বাথরুমে পানির শব্দ শুনে ছুটে গিয়ে দেখি ট্যাপের নিচে মাথা। বিছানায় সিগারেট চিবিয়ে খেয়ে ফেলেছে। এখন বাইরে গেছে৷ কোনো অসুবিধা হবে কি-না বুঝতে পারছি না আম্মা।’

তিনি আফরাকে লাইনে রেখে অস্থির হয়ে বললেন ‘এই অনিকের বাপ শুনছো, এইদিকে আসো, অনিক না-কি পাগল হইয়া গেছে, বউমা এগুলো কি বল..।’

আফরা শ্বশুরের কথা শুনতে পেল। ওপাশে তিনি ধমক দিয়ে বলছেন, ‘এত অস্থির হচ্ছ কেন? কি হয়েছে? দাও তো ফোন আমার কাছে দাও।’

তিনি ‘হ্যালো’ বলতেই আফরা সালাম দিল। মিরাজুল ইসলাম জবাব দিয়ে শান্ত গলায় বললেন, ‘বউমা কি হয়েছে বলো তো।’

– ‘আব্বা, অনিক হঠাৎ কেমন যেন করছে। মনে হচ্ছে পাগল হয়ে গেছে।’

– ‘কি করছে?’

– ‘ভোরে অফিসের কাপড় পরে নাশতা করলো৷ ওর ভাই অফিসে চলে গেছে। আমি ভাবছি সেও চলে গেছে। কিন্তু হঠাৎ ওর বাথরুমে মনে হলো পানির শব্দ। আমি গিয়ে দেখি ট্যাপের নিচে মাথা ধরে আছে। আমার সঙ্গেও কিরকম বাজে ব্যবহার করেছে। সিগারেটে চিবিয়ে বিছানায় ফেলেছে। মানে কি বলবো আব্বা। আমার ভয় লাগছে।’

তিনি আগের মতোই স্বাভাবিক গলায় বললেন,

– ‘ও আচ্ছা, খাবার টেবিলে কি নিয়ে আলোচনা হইছে?’

– ‘কিছুই না।’

– ‘আহা একেবারে কথা না বলে তো নাশতা করোনি।’

– ‘ওইতো নাঈম শুধু বলেছে আপনাদের ওখানে অনিকের কোন আপু না কার যে বিয়ে লাগছে সেটা। তারপর তো সে খেয়ে রুমে চলে গেল। আর কোনো কথা হয়নি। আমার মনে হয় আব্বা, ও পাগল হয়ে গেছে। এখন বাইরে গেছে। নাঈমও কল রিসিভ করেনি৷ ও এলে কি অনিককে গ্রামে পাঠিয়ে দেবো? এখানে রাস্তায় গিয়ে গাড়ি-টাড়ির নিচে পড়লে তো বিপদ।’

– ‘এত অস্থির হইয়ো না তো মা। পাগল হবে কেন? মানুষ কোনো কারণে রাগলে কি ভাংচুর করে না?’

– ‘ব্যাপারটা সেরকম না আব্বা। আমার সাথেও কিরকম রেগে কথা বলেছে৷ কিন্তু কেউ তো তার সাথে রাগারাগির মতো কিছু করেনি।’

– ‘এগুলো এত* ভেবো না। ধরো অফিস থেকে কোনো কল এসেছে। রাগারাগি করেছে৷ রাগে মানুষ দেয়ালে ঘু*সিও মারে। সিগারেট চিবিয়েছে সেরকম। তুমি পারলে দরজা লাগিয়ে রিকশা নিয়ে ওর সঙ্গে যাও। রাগারাগি না করে সঙ্গ দাও। বাসায় নিয়ে আসো। ঠিক হয়ে যাবে। আর ইভা মেয়েকে বলো বাইরে ঘুরতে নিয়ে যেতে। এত ভয় পেও না। পাগল হয়ে যায়নি।’

– ‘কিন্তু..।’

থামিয়ে দিলেন মিরাজুল ইসলাম৷ ‘কিন্তু কিন্তু কিছু না বউমা। যাও, ধরো রেগেছে কোনো কারণে৷ এখন সুন্দরভাবে শান্ত করে যেভাবে মানুষকে। সেভাবে করো। মানুষ অধিক দুঃখ কষ্টের সময় অথবা রেগে গেলেও অনেক সময় পা*গলের মতো আচরণ করে। বুঝতে পারছো? যাও গিয়ে দেখো কোথায় গেছে। ওকে একা ছেড়ো না।’

– ‘আব্বা ওর রাগ-দুঃখের কিছু কি ঘটছে? আমাকে বলা যাবে? মনে হচ্ছে আপনি কিছু জানেন?’

– ‘এত কথা বলো না তো বউমা। যাও তো। দেখো কোথায় গেছে। আর শোনো, গ্রামে পাঠানোর চিন্তা করো না৷ ওকে বাসায়ই রাখো। বুঝেছো?’

আফরা কিছুই বোঝেনি। তবুও বললো, ‘আচ্ছা আব্বা।’

তারপর মোবাইল হাতে নিয়ে অনিককে কল দিতে দিতে দরজা বন্ধ করে বাইরে এলো। অনিক কল রিসিভ করছে না। রাস্তায় এসে চারদিকে তাকাচ্ছে কোথাও দেখা যায় না। হঠাৎ দূরে ফুটপাতে সেলুনের দোকানের সামনে দেখে দু’জন লোক দাড়িয়ে আছে। রিকশা সামনে থাকায় নিচে কে বসা দেখা যাচ্ছে না। কেন যেন মনে হচ্ছিল অনিক মাথা ঘুরে পড়েছে হয়তো। সে রাস্তা পার হয়ে তাড়াতাড়ি ছুটে গেল সেদিকে। হ্যাঁ দুই হাতে হাঁটুতে ভর দিয়ে অনিকক বমি করছে। কাছে গিয়ে সে কাঁধে হাত রেখে বললো,

– ‘কি হয়েছে অনিক?’

রিকশাচালক আফরাকে দেখে বললো, ‘ম্যাডাম আপনে উনার কি হন?’

– ‘ভাবি।’

– ‘তাইলে দেখুন উনাকে। আমি যাই। রিকশায় উইটা হঠাৎ বললেন রাস্তার পাশে দাঁড় করাতে। আইনা রাখতেই বমি শুরু করছেন।’

– ‘ও আচ্ছা, তাহলে এক কাজ করুন। আমাদেরকে বাসার সামনে দিয়ে আসুন। অনিক উঠো।’

আফরা তাকে ধরে রিকাশায় তুলে। রিকশাওয়ালা গেইটের সামনে নামিয়ে দিল তাদের। আফরা অনিককে নিয়ে নেমে বললো, ‘ভাই আপনি দাঁড়ান আমি ভাড়া দিচ্ছি এনে।’

অনিক দুর্বল গলায় বললো, ‘আমি দিচ্ছি’ বলে পকেট থেকে মানিব্যাগ বের করে টাকা দিল। রিকশাওয়ালা চলে গেল। আফরা তার হাত ধরে বাসার ভেতরে নিয়ে এসে তোয়ালে বাড়িয়ে দিয়ে বললো, ‘বাথরুমে গিয়ে কাপড় ছাড়ো।’

– ‘আগে খাওয়ার পানি দাও ভাবি।’

অনিক বাথরুমে গিয়ে কুলি করে মুখ ধুয়ে বের হয়ে আসে৷ আফরা গ্লাসে পানি ঢেলে দিল। অনিক এক চুমুকে পানি খেয়ে গ্লাস বাড়িয়ে রাখলো টেবিলে। আফরা তাড়া দিয়ে বললো,

– ‘যাও ফ্রেশ হয়ে আসো। আমি বিছানা চেঞ্জ করে দিচ্ছি।’

অনিক তোয়ালে নিয়ে বাথরুমে গিয়ে পরনের কাপড় পালটে এসে শর্ট প্যান্ট আর গেঞ্জি পরে চেয়ারে বসে একটা সিগারেট ধরালো। আফরা নতুন বিছানা চাদর বিছিয়ে দিয়ে আগেরটা বাথরুমে রেখে এসে বিছানায় বসে বললো, ‘এখন কি ঠিক আছো?’

অনিক ম্লানমুখে বললো, ‘হ্যাঁ ঠিক আছি।’

– ‘কোনো অসুবিধা না থাকলে ভাবিকে বলো তো কি হয়েছে। কাউকে কিছু না বললে কি সমাধান হবে?’

– ‘কিছু হয়নি।’

– ‘না হলে এরকম আচরণ করছো কেন? আমার সাথেও বা এরকম কথা বলার কারণ কি?’

– ‘ভাবি আবার বিরক্ত করতে শুরু করেছো।’

আফরা উঠে গিয়ে ওর মাথায় হাত রেখে বললো, ‘আরে বোকা রেগে যাচ্ছ কেন? বলো কি হয়েছে। এরকম করছো যেহেতু, কিছু একটা তো আছে। আমি দেখি সাহায্য করতে পারি কি-না। অফিসে কোনো ঝামেলা হয়েছে কি? না লেখালেখি রিলেটেড কোনো প্রব্লেম।’

অনিক সিগারেটে টান না দিয়ে খানিকক্ষণ আফরার দিকে তাকিয়ে থেকে বললো, ‘এটা সমাধানের মতো বিষয় না।’

আফরা তার থুতনিতে ধরে মুখ তুলে বললো, ‘না থাকলেও ভাবিকে বলো। একা একা টেনশন না করে কাউকে বললে ভালো। তুমি তো বিবাহিত না যে বউকে বলবে। তোমার যেকোনো সমস্যা তো বন্ধু-বান্ধব বা ফ্যামিলির কারও সাথে শেয়ার করতে হবে, তাই না?’

অনিক সিগারেটে লম্বা একটা টান দিয়ে বললো, ‘একটা মেয়েকে ভালোবাসি, তার বিয়ে ঠিক হয়েছে।’

আফরা বিস্মিত হয়ে বললো, ‘হোয়াট! তুমি একটা মেয়েকে ভালোবাসো? কখনও বলোনি তো। কে সেই মেয়ে?’

– ‘তা জানার তো দরকার নাই।’

– ‘সকালে যে একটা মেয়ে কথা শুনলাম সে তো তোমার আপু বললো নাঈম। আর কার বিয়ে ঠিক হয়েছে? মানে বুঝতে পারছি না কিছু।’

– ‘বুঝে কি হবে? কোনো লাভ নাই।’

– ‘আচ্ছা বুঝলাম কোন মেয়ে জেনে কাজ নাই৷ কিন্তু তুমি এরকম পাগলামি না করে মেয়েটিকে বলো ভালোবাসার কথা।’

– ‘মেয়েটি ভালোবাসে না আমাকে। সেটা কয়েক বছর আগেই বলে দিয়েছে।’

– ‘তবুও তুমি এতই যেহেতু পাগল। মেয়েটিকে আবার বুঝিয়ে বলো। না হয় আমার সাথে পরিচয় করিয়ে দাও। আমি বলি।’

– ‘বলে লাভ নেই। মেয়ে রাজি হবে না। হলেও ওর পরিবার বা তোমরা কেউই মানবে না।’

– ‘কেন মানবো না আমরা? মেয়ে অন্য ধর্মের না-কি?’

– ‘এত কথা জেনে কি হবে ভাবি?’

– ‘আরে পাগল, মেয়েটি তোমাকে ভালোবাসে কি-না আগে জিজ্ঞেস করো। শেষবার বুঝিয়ে বলো। মেয়ে ঠিক থাকলে। আমি তোমার ভাইকে রাজি করাবো। আমরা দু’জন বুঝিয়ে বলবো আব্বা-আম্মাকে। মেয়েটির বিয়ে হয়ে গেলে আর কিছু তো করার থাকবে না।’

অনিক চুপচাপ বসে থেকে হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে বললো, ‘তুমি ঠিকই বলেছো ভাবি। আমার শেষবার কথা বলে নেয়া দরকার।’ তারপর তাড়াতাড়ি তোয়ালে প্যাঁচিয়ে শর্ট প্যান্ট খুলে জিন্স পরে, সেটার পরর গেঞ্জি পরে নিল সে।

আফরা ‘হা’ করে তাকিয়ে থেকে বললো, ‘এখন কি তুমি ওই মেয়ের কাছে যাচ্ছ?’

– ‘হ্যাঁ ভাবি।’

– ‘কোথায় সে? আমাকে নিয়ে যাও না হয়। মেয়েটা আসলে কে?’

অনিক মানিব্যাগ মোবাইল নিয়ে বললো, ‘কে জেনে কি করবে তুমি?’

– ‘তুমি পাগলের মতো আচরণ না করে আমাকে সব বলো অনিক। আমি তো বলেছি সাহায্য করবো।

‘তোমার সাহায্যের কিছু নাই’ বলে চলে যাচ্ছিল। আফরা তার হাত ধরে আঁটকে বললো, ‘তুমি ওই মেয়ের সাথে ফোনে কথা বলতে তো পারো, বিয়ে ঠিক হয়েছে বলছো মেয়ের। তাকে বলার মতো সুযোগ পাবে কোথায়? আর তোমার তো আচরণ এখন পাগলের মতো লাগছে। কি থেকে কি করবে তারই তো ঠিক নাই।’

অনিক দাঁড়িয়ে থেকে খানিকক্ষণ ভেবে বললো, ‘ও হ্যাঁ, তোমার মোবাইল দিয়ে কল দেই।’

– ‘তোমার মোবাইল দিয়ে দিলে কি হবে?’

– ‘সবকিছুতে ব্লক দিয়ে রেখেছে।’

– ‘আশ্চর্য! কোন নবাবের মেয়ে সে বুঝলাম না তো অনিক।’

– ‘এত কথা না বলে মোবাইল দাও।’

আফরা ওর ফোন দিল অনিকের কাছে। সে পদ্যের নাম্বার তুলে বেলকনিতে এসে কল দিল। দুইবার রিং হতেই রিসিভ করে পদ্য সালাম দিয়ে বললো, ‘কে বলছেন?’

অনিক যেন থমকে গেল ওর সুরেলা মিষ্টি কণ্ঠ শুনে। সে দেয়ালে হেলান দিয়ে নিজেকে শান্ত রেখে বললো, ‘আমি অনিক বলছি, তুমি কি এখন ফ্রি আছো? কিছু কথা ছিল আমার।’

ওপাশ থেকে কোনো জবাব এলো না। নিঃশব্দে ক্ষীণ সময় কেটে গেল ক্ষীণ। অনিক আবার বললো,

– ‘পদ্য, হ্যালো শুনছো?’

কলটা কেটে গেল তখনই। অনিক অস্থির হয়ে আবার কল দিল। কেটে দিল পদ্য। তারপর আর কলই ঢুকলো না। অনিক বুঝতে পারছে এই নাম্বারও ব্লক করে দিয়েছে। সে রুমে ফিরে এসে চেয়ারে বসে। আফরা বিছানা থেকে উঠে এসে বললো, ‘কি হলো? কথা বলেছে?’

সে বসা থেকে উঠে ওর দিকে মোবাইল বাড়িয়ে দিয়ে বললো, ‘আচ্ছা আমি যাচ্ছি।’

সে পিছু যেতে যেতে বললো,

– ‘আরে কি হলো, মেয়েটির সাথে কি কথা হয়েছে?’

‘না, কল কেটে দিয়েছে’ বলেই অনিক দরজা খুলে বের হয়ে গেল।
.
__চলবে….
লেখা: জবরুল ইসলাম

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here