ছন্দহীন পদ্য
.
পর্ব_১৫
.
ইভা বেশ পালটে গেছে। সচেতনভাবেই কি তার এই পরিবর্তন? বিছানায় উঠে বসে বালিশের পাশ থেকে মোবাইল হাতে নিয়ে টাইম দেখলো। ছয়টা এগারো বাজে। ‘হাই’ তুলে পালঙ্ক থেকে নেমে বাথরুমে গিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়ায়। নিজের কাছেই ভালো লাগছে চেহারা। ঘুম ঘুম মুখ। খোঁপা বাঁধা চুল। তবুও একগোছা গালে এসে পরেছে। অনিক ভাইয়ের উপন্যাসের অনামিকা মেয়েটার চুল কি এমন? হতেও পারে। মেয়েটাকে কিছুটা তার মতোই মনে হয়। ইভা নিজেও এখন চায় পুরোপুরি অনিক ভাইয়ের “ছন্দহীন কবিতা” উপন্যাসের অনামিকার মতো হতে। সমস্যা হলো পুরো উপন্যাসটা সে এখনও পড়েনি। বইমেলায় অনিক ভাই এই বইটা বের না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। দীর্ঘ কলেবরের মোটা বইটি কেবল বের হয়েছিল। ত্রিকোণ প্রেমের উপন্যাসটা অর্ধেক লিখে বাদ দিয়ে দিয়েছিলেন। তাকে একদিন ডেকে নিয়ে বললেন, ‘ইভা, তোমার এখন থেকে আর আমার সামনে বসে উপন্যাসের অংশ পড়া লাগবে না। তাছাড়া প্রেমের উপন্যাসটা এবার বের করবো না। সমকালীন উপন্যাসও লেখা শেষের পথে। সেটুকু হোয়াটসঅ্যাপে দেবো তোমাকে। তুমি হোয়াটসঅ্যাপেই জানালে হবে।’
শেষ, এরপর থেকে অনিক ভাই ধীরে ধীরে পালটে গেলেন। তার সঙ্গে আগের মতো কথা বলেন না। বইমেলা শেষে জব নিয়েছেন। টিউশনি বাদ। এভাবেই চলছিল। গতকাল তাকে খাবার টেবিলে বললেন, ‘ভাবছি আবার “ছন্দহীন কবিতা” উপন্যাসটায় হাত দেবো ইভা। লেখা শুরু করে তোমাকে আবার হোয়াটসঅ্যাপে পাঠাবো। তেমন তাড়া নেই। অফিস থেকে এসে প্রতিদিন রাতে অল্প অল্প করে লিখে পাঠাবো।’
ইভা আগ্রহ নিয়েই বলেছে পাঠাতে। উপন্যাসটার শেষ জানতে চায় সে।
এতদিন অপেক্ষায়ই ছিল। ভীষণ ইচ্ছা করে সমাপ্তিটা জানার। অনামিকাই পাবে নায়ককে। এটাই তার বিশ্বাস। সবকিছু মিলিয়ে এটাই মনে হচ্ছে ইভার।
ক’মাস থেকে সে উপন্যাসের ওই অনামিকার মতোই তোয়ালে নিয়ে রোজ ভোরে ঘুম থেকে উঠে ছাদে যায়। ব্যায়াম করে। হাঁটে। খোলা আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে। পাখির কিচিরমিচির শুনে। অনামিকা একসময় বই পড়তো না। শেষে বই পড়া শুরু করে। কবিতা পড়ে। প্রশান্তির জীবন। ভোরে সূর্য উঠলে রোদে গিয়ে চোখবুজে হাত বাড়িয়ে দাঁড়ায়। এটা ছিল অনামিকার রৌদ্রস্নান। চোখবুজে থাকে চোখে সূর্যের আলোয় ক্ষতি হবে তাই। ইভাও এখন অনামিকার মতো জীবন-যাপন করার চেষ্টা করছে। অনামিকার পুরো জীবনটাই যেন ভীষণ টানে তাকে। দাঁত ব্রাশ করে হাত-মুখ ধুয়ে ছাদে চলে এলো সে। ছাদে পাশের বাসার কয়েকটা পায়রা ছিল। তাকে দেখেই উড়াল দিয়ে অন্যদিকে চলে গেল। ইভা তোয়ালে বিছিয়ে নিল। সেখানে লম্বা হয়ে শুয়ে দু’পা খাড়া উপরে তুলে রাখে। তারপর দু’হাত নিয়ে বারংবার দু’পায়ের আঙুলে লাগায়।
অনিক ঘুম থেকে উঠলো সাতটার দিকে। দাঁত ব্রাশ করে জল খেয়ে বাইরে খানিক হাঁটতে বের হলো। এসে গোসল করে অফিসে যাবে। তার রুটিন অনেকটাই পালটে গেছে। সেবার বাবা-মা এসে ভাই-ভাবীর সঙ্গে যোগ দিলেন। তাকে বিয়ের জন্য অনেক বোঝালেন। রাজি হলেই ইভার পরিবারে আলাপ দেবেন। সে না করে দিয়েছে। বলেছে দরকার হয় জব করবে। তবুও বিয়ে করবে না। তারপরই মেলার পর জবটা নিয়ে নেয়। এখন এভাবেই চলছে তার জীবন। এসবের সঙ্গে লেখালেখি আর বই পড়াও চলছে। তবে কয়েক বছর পর আবার জব ছেড়ে দিয়ে পুরোদমে লেখালেখিতে মনযোগ দেবার ইচ্ছা আছে। বাইরে থেকে এসে গোসল করে অফিসের জন্য রেডি হয়ে নাশতার টেবিলে যায়। নাঈম, আফরা, ইভা বসে আছে। সে চেয়ার টেনে বসতে যাবে তখনই নাঈম বললো,
– ‘কিরে তোর পদ্য আপুর তো বিয়ে লেগেছে, দাওয়াত কি পেয়েছিস?’
অনিক অবিশ্বাস্য চোখে তাকিয়ে থেকে ধীরে ধীরে চেয়ারে বসে বললো, ‘না তো, তোমাকে কে বললো?’
– ‘আম্মা ফোন করেছিল। ঘর-জামাই করে বিয়ে দিচ্ছে। অনুষ্ঠান-টুনুষ্টান নাই।’
– ‘ও আচ্ছা।’
আফরা নাঈমের দিকে তাকিয়ে বললো, ‘তার পদ্য আপু আলাদা করে বলার মানে কি?’
– ‘তাদের যা গলায় গলায় ভাব ছিল জানো না তো, তাই মানে বুঝতে পারছো না।’
– ‘ও আচ্ছা।’
অনিক আর কোনো কথা বললো না। নিঃশব্দে নাশতা করে রুমে ফিরে এলো। অফিসে যাওয়ার জন্য ক্রিম কালার ফুলহাতা শার্ট ইন করে পরেছিল। এখন যেন হাঁসফাঁস লাগছে। টেনে বের করে নিল শার্ট। টেবিলে বসে চেয়ারে পা রাখলো। মুষ্টিবদ্ধ ডান হাত আস্তে-আস্তে টেবিলে আঘাত করছে। সিগারেট কোথায়? টেবিল থেকে নেমে বালিশের পাশ থেকে লাইটার আর সিগারেটের প্যাকেট নিয়ে একটা সিগারেট ধরায়। চেয়ারে ধরে দাঁড়িয়ে কয়েক টান দিয়ে মনে হয় কি যেন একটা হচ্ছে না। ভেতরের অস্থিরতা কাটছে না। এবার চারটা সিগারেট নিল ঠোঁটে। লাইটার চেপে জ্বালিয়ে নিল চারটাই। বিছানায় গিয়ে চিত হয়ে পড়ে ঘন ঘন টানতে লাগলো।
নাঈম ঘড়ি হাতে দিয়ে আফরাকে বললো, – ‘যাই তাহলে?’
আফরা তোয়ালে বারান্দায় মেলে দিয়ে এসে বললো, ‘কেন যে আমার জব ছাড়ালে, বাড়িতে একা এখন একদম ভালো লাগে না। সারাদিন তোমাকে মিস করি।’
নাঈম এক হাত ওর পিঠের দিকে নিয়ে বাহুতে ধরে বুকে টেনে এনে বললো, ‘এখন আমার ভালো ঘুম হয় দেখেছো? তুমি প্রতিদিন এসে বসের গল্প করে করে আমার ঘুম নষ্ট করতে। তোমার বসের নজর ভালো না আগেই জানতাম। তাছাড়া শুনি প্রেমের বিয়ে টিকে না। স্ত্রী চাকরি করলেও ডিভোর্স হয় বেশি। সবদিকেই রিস্ক। মিষ্টি বউটাকে হারানোর ভয় বেড়ে গিয়েছিল।’
আফরা ফিক হেঁসে বললো,
– ‘তুমি একদম মেয়েদের মতো। এরকমও কি মানুষ হয়?’
– ‘তোমার মতো কি বউ হয় সবার?’
– ‘যাও তো অফিসে যাও, এখন ঢং করা লাগবে না।’
নাঈম ওর কপালে চুমু দিয়ে বের হয়ে গিয়ে আবার ফিরে এসে বললো, ‘এই শোনো, আব্বা আমাকে কেন যেন গতকাল কলে বললো এখন থেকে ইভাকে অনিকের সাথে আরও বেশি মিশতে বলতে।’
– ‘কি যে বলেন তারা। ইভা কি গায়েপড়া মেয়ে না-কি? ওকে এসব বললে অপমানবোধ করবে না?’
– ‘বলেছিলাম আব্বাকে। আমাকে উলটো বললো, আরে বলদ, সরাসরি বলতে হয় না-কি। তোর বউকে বলবি ইভাকে চা-টা বা যেকোনো কাজে অনিকের রুমে বেশি বেশি পাঠাতে। এভাবে করলেই হবে। সবকিছু কি শিখিয়ে দিতে হয়।’
আফরা ঠোঁট উলটে বললো,
– ‘কি জানি তাদের মাথায় কি ঘুরছে।’
– ‘হয়তো ইভাকে তাদের অনেক পছন্দ হয়েছে।’
– ‘আচ্ছা যাও তুমি। দেরি হয়ে যাচ্ছে।’
নাঈম বের হয়ে চলে গেল। আফরা ইভার রুমে এসে দেখে সে আয়নার সামনে বসে সাজগোজ করছে। ওর বিছানায় বসে বললো,
– ‘কিরে আজ ভার্সিটিতে যাবি না?’
– ‘না, তবে একটু পর বের হব। এক বান্ধবীর ভাইয়ের বিয়ের দাওয়াত দিছে৷ না গেলে মা*রবে ধরে।’
– ‘ভালো, এখন তুই একা একা ঘুরাঘুরি শিখে গেছিস। আগে অনিক টিউশনি থেকে অবধি গিয়ে নিয়ে আসতো।’
– ‘সে তো অনেক আগের কথা আপু। তোমার দেবর প্রথম প্রথম আহ্লাদ দেখিয়ে টিউশনি থেকে আনতে যেতেন৷ হঠাৎ একদিন কি করেছেন জানো?’
– ‘কি?’
– ‘এক রিকশাওয়ালার নাম্বার দিলেন আমাকে। সে ওই রাস্তায়ই চালায় আরকি। তো আমি বের হওয়ার আগে কল দিলেই গিয়ে আনবে। উনি আর যেতে পারবেন না।’
– ‘তোকে ও তো এখন ওর রুমে বেশি যেতে দেখি না।’
– ‘ওমা আমি অকারণ উনার রুমে গিয়ে উঁকিঝুঁকি মারবো না-কি? আগে উনি ডাকতেন, সামনে বসে পড়তে বলতেন। বইমেলার আগে একদিন বললেন সেটাও আর লাগবে না।’
অনিক কেন এগুলো করেছে ইভা বুঝতে না পারলেও, আফরা বিষয়টা বুঝতে পারছে। তার শ্বশুর-শাশুড়ি আসার পর ওদের বিয়ের ব্যাপারে কথা উঠায়ই হয়তো অনিক ইভার থেকে নিজেকে কিছুটা গুটিয়ে নিয়েছে। খানিক পর ইভার কল এলো, রিসিভ করে, ‘আসছি আসছি, এইতো বের হচ্ছি’ বলে ফোন রেখে আফরাকে বললো, ‘গেলাম আপু।’
ইভা বাসা থেকে বের হয়ে যাওয়ার পর আফরা দরজা লাগিয়ে আসার পথে হঠাৎ শুনলো অনিকের বাথরুমে পানির শব্দ। ট্যাপ ছেড়ে রেখে অফিসে চলে গেল না-কি দেখার জন্য সে গিয়ে অবাক হয়ে যায়। বাথরুমের দরজা খোলা। অনিক হাঁটু গেড়ে বসে ট্যাপের নিচে মাথা ধরে আছে। ঘাড় বেয়ে তার অফিসের শার্ট ভিজে একাকার। আফরা এগিয়ে গিয়ে বললো, ‘কি হয়েছে অনিক? মাথায় পানি দিচ্ছ কেন?’
– ‘বমি পাচ্ছিল। বিছানা থেকে উঠে এসে এখন অনেক চেষ্টা করেও বমি আসছে না।’
– ‘হঠাৎ করে কি হলো? তুমি তো অফিসে যাওয়ার জন্য রেডি হয়ে নাশতা করতে বসেছিলে। অফিসে যাওনি কেন?’
সে মাথা না তুলেই রূঢ় গলায় বললো, ‘রেডি হলেই কি অফিসে যাওয়া লাগবে? ইচ্ছা হইছে রেডি হয়েছি। পরে ইচ্ছা হইছে যাব না, তাই যাইনি। আমার জীবনে আমিই জমিদার, রাজা-বাদশা, প্রেসিডেন্ট..।’
‘পাগলের মতো কি বলছো এসব’ বলে
আফরা বাথরুমে ঢুকে ট্যাপ বন্ধ করে ওর হাত ধরে বললো, ‘এভাবে মাথায় পানি দিলে তো অসুস্থ হয়ে যাবে।’
অনিক লাল টকটকে চোখ তুলে তাকিয়ে বললো, ‘মাথা ঘুরছে ভাবি।’
– ‘চলো বিছানায় চলো। হঠাৎ মাথা ঘুরছে কেন?’
অনিক কোনো জবাব দিল না৷ আফরা তাকে নিয়ে এসে বিছানার দিকে তাকিয়ে আরেকবার বিস্মিত হয়ে বললো, ‘আরে এ কি অবস্থা! বিছানায় এত অ্যাশ কোত্থেকে এলো? আর চারদিকে জর্দার মতো এগুলো কি?’
অনিক বিছানায় লম্বা হয়ে পড়ে আচ্ছন্ন গলায় চোখবুজে বললো,
– ‘অ্যাশ পড়েছে সিগারেট থেকে। সিগারেট টানতে টানতে হঠাৎ মুখে পুরে চিবোতে শুরু করলাম। বালের সিগারেট টানতে ভালো, খেতে না, তাই মুখ থেকে ফেলে দিয়েছি। সেটাকেই বলছো জর্দার মতো।’
– ‘মাতালের মতো কি বলছো তুমি অনিক? আর মাথা না মুছেই বিছানায় শুয়ে গেলে কেন? উঠো, মাথা মুছে নাও। বিছানা পরিষ্কার করতে হবে।’
– ‘রুম থেকে বের হয়ে যাও ভাবি। এত জোরে কথা বলো কেন? মাথা ধরার সময় কেউ জোরে কথা বললে তাকে আমার গ*লা টিপে মে*রে ফেলতে মন চায়।’
– ‘আশ্চর্য! তুমি আমার সাথে এভাবে কথা বলছো কেন? কি হয়েছে তোমার।’
– ‘রুম থেকে বের হয়ে যেতে বলছি না? কানের কাছে এত আশ্চর্য আশ্চর্য বলে চেঁচামেচি শুরু করেছো কেন?’
– ‘আমি রুম থেকে বের হয়ে গেলে বিছানা পরিষ্কার করবে কে? আর তুমি মাথা মুছে ঘুমাও।’
– ‘সব যেরকম আছে সেরকম থাকবে। বিদায় হও, আমার রুমে আমি রাজা।’
– ‘আচ্ছা তোমার কি হয়েছে বলো তো অনিক?’
বিছানা থেকে উঠে গেল সে। আফরার দিকে লাল টকটকে চোখে তাকিয়ে বললো ‘প্রশ্নের যন্ত্রণায় আর শান্তিতে ঘরে থাকা গেল না বা*ল। এজন্য বিয়ে-শাদির পক্ষে আমি নাই। রুমে একটা মেয়ে মানুষ মানেই প্যানপ্যান।’ কথাগুলো বলেই সে দরজা খুলে বাইরে চলে গেল। আফরা নির্বাক হয়ে বিস্মিত চোখে তাকিয়ে রইল।
__চলবে…
লেখা: জবরুল ইসলাম