ছন্দহীন পদ্য
.
পর্ব_১২
.
রাতে স্মৃতি রোমন্থন করে পদ্য কখন ঘুমিয়ে পড়েছিল বুঝতেই পারেনি। ঘুম থেকে উঠেছে দেরিতে। অসুখী, দুঃখী, অসুস্থ, অস্থির মানুষেরা বোধহয় অনিদ্রার সমস্যায় ভুগে, অথবা ঘুম অনেক বেশি বেড়ে যায়। পদ্যেরও তাই হয়েছে। ঘুম বেড়ে গেছে। তাড়াতাড়ি বিছানা ছেড়ে উঠে গোসল করে নিল সে। মনিরা বেগম টেবিলে খাবার দিলেন। দেরিতে ঘুম থেকে উঠলে তিনি চা-নাশতা না দিয়ে ভাত দেন। পদ্যের খেয়ে যেতে ইচ্ছা না করলেও মায়ের জন্য খেতেই হয়। খেয়ে-দেয়ে বোরখা-নেকাব পরে উঠানে বের হতেই দেখে পুকুর পাড় দিয়ে আতাই ঘটক আসছে। থুতনিতে দাঁড়ি, সাদা পাঞ্জাবি আর লুঙ্গি পরনে৷ ঠোঁটের এককোণে সুপারির লাল রস দেখা যাচ্ছে। পদ্যের বুকটা কেঁপে উঠে। কেন এসেছে কে জানে। মতিন মাস্টার বারান্দার চেয়ারে বসা ছিলেন। ঘটককে দেখে এগিয়ে গেলেন। পদ্য দাঁড়িয়ে আছে দেখে মনিসা তাড়া দিয়ে বললো, ‘আপু আসো।’
সে পিছু ফিরে তাকিয়ে হাঁটে। স্কুলে গিয়ে পুরো দিন গেল তার একধরনের অস্থিরতায়। বিকেলে বাড়ি ফিরে মা-বাবাকে খুবই হাসি-খুশি দেখা গেল। আছরের নামাজ পড়ে মতিন মাস্টার চটের ব্যাগ নিয়ে বাজারের জন্য বের হলেন। অন্যদিন রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকেন। কাউকে বাজারে যাওয়ার মতো পেলে টাকা আর ব্যাগ দিয়ে দেন। ওরা বাজার করে বাড়ি এসে দিয়ে যায়। দেবেই না কেন, গাঁয়ের বেশিরভাগ ছেলে-মেয়েরাই উনার প্রাক্তন ছাত্র। আজ ফিরছেন না দেখে মনিরা বেগম পদ্যকে বললেন, ‘কিরে পদ্য, তোর আব্বা এই শরীর নিয়ে বাজারে চলে গেল না-কি।’
পদ্য বিছানা ঝাড়ু দিতে দিতে বললো, ‘কাউকে মনে হয় রাস্তায় পায়নি আম্মা।’
– ‘কি যে বলিস। বিকালে কত লোক বাজারে যায় এদিকে।’
– ‘তাহলে রাস্তা থেকে দেখে আসো গিয়ে।’
– ‘হ্যাঁ দেইখা আসি।’
মনিরা বেগম গিয়ে দেখে এসে বললেন, ‘নাই কোথাও, হাই প্রেশার নিয়া বাজারে না গেলে হত না তার?’
– ‘চিন্তা করো না তো আম্মা। রাস্তা-ঘাটে মানুষ আছে। বাজারে যাক, সবার সাথে দেখা হবে। হাঁটাচলা হবে। তাতে শরীর ভালো থাকবে। তুমি আব্বাকে বাড়িতে আঁটকে রেখে আরও অসুখ বাড়াচ্ছ।’
– ‘হ্যাঁ পন্ডিত হইছিস। উনি বাজার টেনে আইনা খাইয়ে বিছানায় পড়ে মরু*ক। তোর ভাই আছে তো দু’একটা৷ বাপ ম*রলে বুঝবি দুনিয়ায় ব্যাটা মানুষ না থাকলে কি হয়।’
– ‘কোন কথা থেকে কোথায় চলে গেলে আম্মা। আর বাজারে কি আমি পাঠালাম না-কি। আর তোমার ছেলে নাই কে বললো। আমি আছি না। আমিই তো তোমার ছেলে-মেয়ে সবকিছু।’
– ‘ঢং করবি না আমার সাথে। তোর ঢং এর কথা শুনলে আমার গা জ্বলে। তোর চিন্তায় আরও মানুষটার অসুখ ছাড়ে না।’
মনিসা বাড়ির পাশের মাঠে খেলতে যাচ্ছিল। কয়েকদিন থেকে তারা গোল্লাছুট খেলে। মনিরা বেগম হাত বাড়িয়ে ওকে ধরে পিঠে ধড়াম করে কি*ল দিয়ে বললেন, ‘বিকাল হইতেই চলে যাচ্ছিস তিড়িংতিড়িং করতে। ওইদিকে অসুখ নিয়া বুড়া বাপ বাজারে গেল না-কি কোথাও পড়ে ম*রলো সেই খেয়াল তো তোদের নাই৷ ম*রলে বুঝবি। এর আগে না।’
মনিসা কি*ল খেয়ে বক্র হয়ে পিঠে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে৷ পদ্য হেঁসে বললো, ‘আম্মা অকারণ কি শুরু করলে তুমি। চটের ব্যাগ কি এত ভারী যে আব্বা নিয়ে আসতে পারবে না?’
– ‘তোলা বহন করতে করতে লোহার ভার হয়, বুঝলি? এইগুলার তোরা কি বুঝবি। লোকটার শরীরের বাতও আছে। পা ফুইলা থাকে সারাক্ষণ৷’
– ‘আচ্ছা, আব্বার আসতে দেরি আছে। মনিসা আর তুমি সন্ধ্যার আগে খেয়াঘাটে চলে যেও। আব্বা যেভাবেই হোক সন্ধ্যার আগেই ফেরার চেষ্টা করবে।’
মনিরা বেগম কিছু না বলে রান্নাঘরে চলে গেলেন। মনিসা ধীরে ধীরে বারান্দায় গিয়ে হঠাৎ দৌড়ে চলে গেল মাঠের দিকে৷ মাগরিবের ঠিক আগে৷ মনিরা বেগম পুকুরে অজু করছেন। দেখলেন হাসি হাসি মুখে মতিন মাস্টার আসছেন। তিনি কিছুই বললেন না৷ ঘরে যেতেই পদ্য ব্যাগ হাতে নিয়ে বললো, ‘বাবা সিগারেটের গন্ধ কোত্থেকে এলো?’
মতিন মাস্টার ফতোয়া খুলে রাখতে রাখতে বললেন, ‘খাই না তো রে মা। বাজারে লোকজনের সাথে বসলাম। হাতে ধরিয়ে দিল। তাই আরকি এক, দুই টান।’
– ‘তোমার শরীরের অবস্থা নাই৷ আবার সিগারেটে না টানলে হয় না আব্বা? তোমার বাজারেই বা যাওয়ার কি দরকার।’
মনিরা বেগম ঘরে ঢুকলেন। মতিন সাহেব বিছানায় বসে বললেন, ‘কৈ মাছ এনেছি পদ্যের মা। মেয়েটা কৈ মাছ ভুনা অনেক পছন্দ করে।’
মনিরা বেগম জবাব না দিয়ে চলে গেলেন। পদ্য বাবাকে এনে এক গ্লাস পানি দিল। মতিন মাস্টার গ্লাস হাতে নিয়ে বললেন, ‘বস মা, পাশে বস।’
– ‘চা বসাবো আব্বা।’
– ‘তোর মা পারবে। তুই এখানে বস।’
পদ্য বসলো বাবার পাশে। তিনি তিন চুমুকে পানি খেয়ে বললেন, ‘পানি খেতে হয় তিন চুমুকে, এবং বসে বসে।’
– ‘তোমাকে আজ এত খুশি খুশি লাগছে কেন আব্বা।’
– ‘মা রে এতদিন কত ছেলে দেখলাম। ঘর জামাই বানানোর মতো কোনো ভালো ছেলেই পাওয়া যায়নি। একটা গাঁ*জাখো*র মিলে তো আরেকটা ভ*ণ্ডা। এখন এমন একটা যুগ। কে ভালো কে মন্দ বুঝা মুশকিল। সকল পোলাপানকে একই রকম লাগে। আমাদের সময় ভণ্ড, গুন্ডা-ফান্ডাদের দেখলেই চেনা যেত। এদের হাতে আর গলায় মোটা মোটা চেইন। চুল লম্বা। বসতো গাছের গোড়ায় না হয়ে দেয়ালে। এগুলোই আড্ডার জায়গা। তাদের প্রধান খেলা ছিল তাস। এখন এরকম না…।’
পদ্য থামিয়ে দিয়ে বললো, ‘তুমি এত কথা কেন বলছো আব্বা? কথা বলতে বলতে তো হাঁপিয়ে যাচ্ছ৷ কি বলতে চাও সেটা বলো।’
– ‘কথা হলো মা, একটা ভালো ছেলে পাইছি। আতাই ঘটকই আলাপ এনেছে। ছেলের ত্রিভুবনে কেউ নাই। থাকে মামার বাড়ি। কৃষিকাজ করে মামার সাথে। আর পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ে মসজিদে গিয়ে। মাঝে মাঝে মুয়াজ্জিন না থাকলে না-কি আজানও দেয়। বাজারে দেখা করিয়ে দিল আতাই ঘটক। দূর থেকে দেখা আরকি। চায়ের দোকানে বসে আছি। পোলা হেঁটে হেঁটে যাচ্ছে। ঘটক বললো ওই দেখো যায়।’
পদ্যের মুখ মলিন হয়ে এলো। এরকম কিছুই সে আঁচ করেছিল। মনিরা বেগম এসে বললেন, ‘তুমি ছেলে দেইখাও আসছো তাহলে।’
– ‘হ্যাঁ, ঘটক বলেছিল বাজারে গেলে দেখাইতে পারবো।’
মনিরা বেগম বিছানায় বসে বললেন, ‘পদ্য যা তো চা দেখ গিয়া, বসিয়ে আসছি।’
তারপর মতিন সাহেবকে বললেন, ‘ছেলে কেমন দেখতে?’
– ‘কেমন দিয়ে কি হবে মনিরা। মানুষ হলো আল্লাহর দান। তার ভেতরই আসল। বাইর খোলস। ছেলেটা কিছু খাটো।’
– ‘থাকুক খাটো, ঘর-জামাই করে বিয়ে দিতে হলে এত ছেলে খুঁজাখুঁজি করে কই পাবে?’
– ‘হ্যাঁ, তাছাড়া ছেলে যত নরমাল হবে। ততই ভালো। পদ্যের কথায় উঠবে-বসবে। ঘর-জামাই এরকমই হওয়া ভালো।’
মনিসা খানিক পর এসে পড়ার টেবিলে বসলো। পদ্য এসে চা দিল তাদের। মনিরা বেগম চায়ে চুমুক দিয়ে বললেন, ‘সবকিছু ঠিক কইরা এত লোক জানাজানি না করে বিয়া দিয়া দাও। লোক আগে জানাইলে কত জনের কত কথা৷ জামাই খাটো, ঘর-জামাই কইরা বিয়া দিছে কত কি বলবে। এর চাইতে একদিন ওরা এসে দেখে বিয়ার তারিখ ঠিক করে নিক।’
মতিন মাস্টার বিছানায় পা তুলে বসে বললেন, ‘সে কথাও আমি বলেছি। ছেলের মামাকে নিয়ে একদিন আসুক। পছন্দ হইলে একদিন কাজি ডেকে এনে বিয়ে পড়িয়ে দেবো। শেষ।’
পদ্য রান্নাঘরে চলে গেল। রান্নাঘরের পালায় হেলান দিয়ে জলচৌকিতে বসলো। চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছা করছে। মুখ থেকে একটা শব্দ, একটা কথা বের করারও আর যেন পথ খোলা নেই। কি করবে সে কথা বলে? অকারণ নিজের মা-বাবাকে হয়রানি করা ছাড়া কাজের কাজ কি কিছু হবে? এই যে ঘর-জামাইয়ের কথা বলেছিল। ওরা পাগলের মতো ছোটাছুটি করে বের করেছে এমন ছেলে। এখন যদি বলে এই ছেলে পছন্দ হয়নি। তারা আরেকটা ছেলে খুঁজবে। এর শেষ আসলে কোথায়? কিছুই ভালো লাগছে না৷ কিছুই ভাবতে পারছে না। চুপচাপ গিয়ে বিছানায় শুয়ে রইল। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে ঘুমে চোখবুজে আসতে লাগলো। কি অদ্ভুত। চিন্তার সময় মানুষের ঘুম আসে না। অথচ সে চোখ টেনে খুলে রাখতে পারছে না। রাতে ভাত খেতে ডাকলেন মনিরা বেগম। সে ঘুম ঘুম গলায় বললো ‘ক্ষিধে নেই। আজ খাবে না।’ অনেক্ষণ ডেকেও তিনি নিতে পারলেন না। কিন্তু সেই যে ঘুম ভাঙিয়ে দিয়ে গেলেন, পদ্যের আর ঘুম এলো না। উলটো মাথা ব্যথা শুরু হলো। মনিসাও বাতি নিভিয়ে পাশে এসে শুয়ে পড়ে। পদ্য মাথা ব্যথা নিয়ে মধ্যরাত অবধি ছটফট করে কাটিয়ে দিল। তার বমি পেল রাত তিনটার দিকে৷ তাড়াতাড়ি উঠে বারান্দায় গেল বমি করতে। মনিরা বেগম বমির শব্দে শুনে বাতি জ্বালিয়ে বাইরে গিয়ে দেখলেন পদ্যকে।
– ‘কিরে পদ্য, শরীর খারাপ করছে না-কি?’
– ‘আম্মা পানি দাও।’
মনিরা বেগম গ্লাসে করে পানি এনে দিলেন। সে কুলি করে, মুখ ধুয়ে পুনরায় বিছানায় চলে এলো। মনিরা বেগম পাশে বসে বললেন, ‘কি হয়েছে হঠাৎ?’
– ‘মাথা ধরছে আম্মা, কিছু না, তুমি যাও।’
– ‘বমি করেছিস মাথা ধরা কমবে এখন। ভাত এনে দেই অল্প খা।’
– ‘না তুমি বাতি নিভিয়ে যাও তো। আলো সহ্য হচ্ছে না।’
মনিরা বেগম বাতি নিভিয়ে চলে গেলেন। পদ্যের মাথা ধরা কিছুটা কমেছে। কিন্তু আবারও চিন্তা শুরু হয়ে গেছে৷ কি করবে আসলে সে? অনিককে রেখে আরেকজনের সঙ্গেই বা সে সংসার করবে কিভাবে? আরেক ছেলেকেই বা সে কি দেবে? শরীর ছাড়া কি কিছু দিতে পারবে? অনিকের মতো ছেলেকে ভালোবাসার পর আর কোনো ছেলেকে কি ভালোবাসা সম্ভব? বমি করতে গিয়ে একটা কথা মনে পড়ে গেল। সেবার পদ্যের ভীষণ জ্বর। অনিক অনেকটাই বড়ো হয়ে গেছে। ইন্টার সেকেন্ড ইয়ারে পড়ে। কথাবার্তায় আরও বেশি বড়ো। কথা বলার সময় কোনটা রসিকতা আর কোনটা সিরিয়াস বুঝা ছিল মুশকিল। মানুষকে পলকে বোকা বানিয়ে ফেলতো। একটা সময় পদ্যের মনে হতো অনিকের কাছে অসাধ্য বলতে কোনোকিছুই নেই। অথচ সে ছাড়া কেউ সেটা জানে না। লম্বাও বেশ হয়ে গিয়েছিল তখন। পদ্যের নিজেকে ওর থেকে ছোটই মনে হতো। গরমের দিন তখন। পদ্যের প্রচণ্ড জ্বর। রাত এগারোটার দিকে অনিক তার ফোনে কল দিল। তখন তাদের দুজনেরই মোবাইল আছে। ঘরের মোবাইল থাকতো পদ্যের কাছে। অনিককে তার চাচা দিয়েছিলেন ইংল্যান্ড থেকে। অনিক কল দিয়ে বললো, ‘আপু দরজা খুলো। তোমাকে দেখে যাই।’
পদ্যের অবস্থা জ্বর-সর্দিতে নাজেহাল। রূঢ় গলায় বললো, ‘এখন কেন আসছো অনিক? আমরা ঘুমিয়ে গেছি।’
– ‘অসুস্থ মানুষকে যখন-তখন দেখতে আসা যায় আপু। ঘুমানোর আগে দেখে যাওয়াটা কর্তব্য। রাত মানে কত ঘণ্টা জানো? এই সময়ে একজন অসুস্থ মানুষের কত কিছু হয়ে যেতে পারে। তাই রাতে দেখা যাওয়া নিয়ম।’
– ‘ফা*জিল, এখন আমার জ্বর নিয়ে উঠে খুলে দিতে হবে।’
– ‘তুমি কি দিচ্ছ?’
– ‘হ্যাঁ, দাঁড়াও দিচ্ছি।’
হাসতে হাসতে বললো,
– ‘ওয়েট, ওয়েট, উঠা লাগবে না এখন শুয়ে থাকো।’
– ‘কেন? আসছো যখন ফিরে যাবে কেন?’
– ‘আমি আসিনি এখনও, দেখলাম খুলে দেবে কি-না। আসছি একটু পর।’
বলেই কল কেটে দিল সে। মিনিট তিরিশেক পড়েই এসে দরজায় নক দিল। মা এসে দরজা খুলে দিলেন। পদ্য বিছানা থেকে তাকিয়ে আছে। স্মিথ হাসছে সে। অনিক হয়তো মা’কে দেখে বিব্রত হবে। কারণ সে ভেবেছিল পদ্য দরজা খুলে দিবে। কিন্তু অনিক বিব্রত হলো না। কেমন করে যেন পুরো পরিবেশ তার নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নিল। মা দরজা খুলে তাকে বললেন, ‘কে, অনিক না-কি? এত রাতে।’
সে ভেতরে এলো। একটা চায়ের ফ্ল্যাক্স, বিস্কুট আর একটা বক্স। টেবিলে রাখলো। মা হেঁসে বললেন, ‘এসব কি বাবা?’
অনিক বিছানায় বসে বললো, ‘অসুস্থ মানুষকে দেখতে এলে না-কি কিছু নিয়ে আসতে হয়।’
– ‘কে বললো?’
– ‘সন্ধ্যার সময় যে এসেছিলাম তখন পদ্য আপু খোঁচাটা দিল। তাই এখন সাইকেল নিয়ে দোকানে গিয়ে নুডলস, বিস্কুট নিয়ে এলাম। এসে নিজে বানিয়ে রোগী দেখতে এসেছি। এখন রোগীর সেবাও করবো। তুমি ঘুমিয়ে যাও চাচি। পানি আর কোনো কাপড় দিয়ে যাও শুধু। জলপট্টি দেবো। আমি যাওয়ার পর আপু দরজা লাগিয়ে নিবে। তুমি ঘুমাও। আর একটা চামচ, দু’টা কাপ দিয়ো।’
পদ্য “হা” করে তাকিয়ে রইল। মনিরা বেগমও হাসতে হাসতে চলে গেলেন। পদ্য তখন ফিসফিস করে বললো, ‘আমি কখন খোঁচা দিয়ে বললাম রোগী দেখতে হলে কিচ্ছু নিয়ে আসতে হয়? এরকম মিথ্যে বলে এগুলো করার কারণ কি অনিক?’
পদ্যের স্পষ্ট মনে আছে, অনিক তাকেও বোকা বানিয়েছিল। তখন বুঝতে পারেনি, এখন বুঝে৷ তার চিন্তা অন্যদিকে ঘুরিয়ে দিয়েছিল। যাতে পদ্য তার আলাদা গুরুত্ব দেওয়াকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে না পারে। অনিক ঠোঁটে আঙুল রেখে ‘চুপ’ থাকতে ইশারা করে বিছানায় বসে ফিসফিস করে বললো, ‘আমরা এক সঙ্গে বড়ো হয়েছি কি-না বলো?’
– ‘হ্যাঁ।’
– ‘আমরা কি বন্ধুর মতো না?’
– ‘হ্যাঁ।’
– ‘তো তুমি কি ছেলে বন্ধুর মতো আমার সঙ্গে থাকতে পারো? আমার ইচ্ছা করছিল দেখতে। অসুস্থ হয়ে পড়ে আছো ভাবলাম দেখে আসি৷ নুডলস, চা আমি লেখালেখির জন্য প্রায় রাতেই বানাই। তাছাড়া আমার ইউটিউবে তুমি কত কষ্ট করে ভয়েজ দাও। কৃতজ্ঞতাবোধও তো থাকে মানুষের। আমি কি এতই অকৃতজ্ঞ? তাই ভাবলাম এগুলো বানিয়ে নিয়ে যাই। বসে গল্প করবো, চা খাব। কিন্তু আসতে হলে দশবার ভাবতে হচ্ছে কারণ তুমি মেয়ে। চাচিও ভালোভাবে নিবে না। তাই এরকম মিথ্যে বললাম, বলতে হয়। তুমি এখন উলটো অবিভাবকদের মতো প্রশ্ন শুরু করেছো। কখনও এরকম করবে না। বরং তুমি এখন আন্টি এলে কি বলবে জানো?’
– ‘কি?’
– ‘বলবে আম্মা অনিককে চেনো না? সে ওই দেখো খাতা এনেছে। তার স্বার্থ আছে বলেই এগুলো নিয়ে এসেছে। এখন তার ওই লেখা পড়াবে আমাকে। লেখা ভালো হলো কি-না পড়িয়ে জানবে। আর জলপট্টি দিবে। চাও এনেছে। এর কারণ হলো তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে যেন ভয়েজ দিতে পারি। তারই লাভ।’
– ‘কেন, এগুলো কেন?’
সে কপাল থেকে হাত সরিয়ে গাল টিপে ধরে বললো,
– ‘আবার বলো কেন? একটু ছল-চাতুরী ছাড়া কি আসতে পারতাম না-কি?’
– ‘সেটা না, তুমি এখন স্বার্থের জন্য এসেছো এটা কেন মা’কে বলবো?’
– ‘বুঝা লাগবে না। তুমি বলবে শুধু।’
– ‘বসে আছি নাটক করতে।’
– ‘তুমি বলার পর দেইখো আমি কি নাটক করি। সেই নাটক দেখার জন্য, এই নাটক করবে।’
মা তখনই আসলেন। অনিক সঙ্গে সঙ্গে বললো, ‘বাবা আপুর প্রচুর জ্বর তো চাচি। আর সারাদিন শুয়ে থেকেছে তো, তাই আরও বেশি শরীর ব্যথা। আপু তুমি উঠে বসো তো।’
পদ্য উঠে বসে বললো, ‘অনিককে চেনো না তো আম্মা। ওর স্বার্থ আছে বলেই খাতির দেখাচ্ছে। ওইযে খাতা দেখছো। গল্প লিখে এনেছে। এখন আমার পড়তে হবে, পড়ে কেমন হয়েছে বলতে হবে। আর চা নুডলস এনেছে যাতে তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে ভয়েজ দেই।’
অনিক সঙ্গে সঙ্গে মুখ কালো করে চুপচাপ বসে রইল। মনিরা বেগম মেয়েকে ধমক দিয়ে বললেন, ‘ধু*রো, বোকার মতো কি থেকে কি বলে। বাতাসে বড়ো হয়েছিস। এখনও কথা বলতে শিখিসনি।’
অনিক বসা থেকে উঠে বললো, ‘আচ্ছা চাচি আমি তাহলে এখন যাই। ফ্লাক্স থাকুক।’
– ‘আরে না বসো তুমি। ওর কথায় রাগ করলে হয়। বোকার মতো কথা বলে।’
– ‘না চাচি, আপু সব সময় এরকম নেগেটিভ চিন্তা করে।’
মনিরা বেগম তাকে হাত ধরে বসিয়ে বললেন, ‘পদ্য তুই না বড়ো হবি না। খাতায় গল্প লিখে আনছে একটু পড়ে দিলে মুখ পড়ে যাবে না৷ মানুষের সাথে এভাবে কথা বলে কেউ? ছেলেটা এত কষ্ট করে চা নুডলস বানিয়ে এনেছে। একটু পড়ে দিলে কি হবে।’
– ‘না আন্টি পড়া লাগবে না। আপু বলছে তো আমি এই কাজে এসেছি। আমি তাকে মাথায় জলপট্টি দেবো। চা খাইয়ে, নুডলস খাইয়ে খাতা না পড়িয়ে চলে যাব৷ আর এরপর থেকে ভয়েজও নেব না। একা একা ভয়েজ দেবো। সে ভাবছে এই কাজগুলোর জন্যই আমি খাতির জমাই।’
মনিরা বেগম খাতা পদ্যের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, ‘আরে না, ও তোমাকে রাগায় এরকম। রাগ করো না বাবা৷’ বলে তিনি চলে গেলেন।
পদ্য বিছানায় চোখ বড়ো বড়ো করে বললো, ‘এটা কি ছিল অনিক? এই নাটকের কারণ কি?’
– ‘এত প্রশ্ন করবে না তো আপু। বুঝবে না তুমি। নাটক কেমন হলো সেটা বলো?’
– ‘তুমি তো আমাকে উলটো বকা খাইয়ে নিয়েছো।’
অনিক চেয়ার নিয়ে এসে বিছানার পাশে বসে বললো, ‘বকা খাওয়ানো লক্ষ্য না। বুঝবে না তুমি। এবার আগে পানি দিচ্ছি, পানি খাও’ বলে টেবিল থেকে গ্লাসে পানি ঢেলে এনে হাতে দিল। পদ্য দুই চুমুক পানি খেয়ে ফিরিয়ে দিল। অনিক বক্সটা খুলে আসন পেতে বিছানায় বসে বললো, ‘তোমার হাত কাঁথার ভেতর থেকে বের করলে ঠাণ্ডা লাগবে। আমি খাইয়ে দিচ্ছি।’
পদ্য না করতে যাবে তার আগেই এক চামচ এগিয়ে এনে বললো, ‘নাও।’
পদ্য মুখে নিল। কয়েক চামচ খাওয়ার পর এক টুকরো নুডলস পদ্যের থুতনি বেয়ে বিছানায় পড়লো। অনিক বুড়ো আঙুল দিয়ে আলগোছে থুতনি মুছে দিল। সেই স্পর্শ এখনও মনে আছে। ওর চাহনিও। কত আবেগ নিয়ে ছেলেটা ছুঁয়ে দিয়েছিল কে জানে। নুডলস পুরোটা খেতে পারলো না পদ্য। অনিক তখন বললো, ‘খাবার নষ্ট করা ঠিক না। আমিই শেষ করি খেয়ে।’
একই চামচ দিয়ে খেতে শুরু করে অনিক। পদ্য অবাক হয়ে বললো, ‘আরে চামচ তো ধুয়ে আনো। আর না হয় অন্য চামচ গিয়ে নিয়ে আসো।’
সে অদ্ভুত চোখে তাকিয়ে মুচকি হাসলো কেবল। পদ্য আবার বললো, ‘জ্বরও ছুঁয়াচে রোগ৷’
– ‘খেয়েই তো ফেলেছি সমস্যা নেই।’
তারপর দু’টা কাপে চা ঢেলে পদ্যকে দিয়ে সে চেয়ারে বসলো একটা কাপ নিয়ে। তেমন কোনো কথাও বললো না। চা শেষে বললো, ‘তুমি শুয়ে যাও। আমি জলপট্টি দেই। তারপর চলে যাব।’
পদ্য বাঁধা দিয়ে বললো, ‘তুমি চলে যাও লাগবে না।’
সে মাথায় হাত রেখে বললো, ‘তোমার কি বিরক্ত লাগছে? লাগলে চলে যাব। আর ভালো লাগলে ঠেলে দিয়ো না।’
পদ্য তখন শুয়ে যায়৷ অনিক কাপড় ভিজিয়ে ভালো করে চিপে বললো, ‘তোমার মুখ আর গলা মুছে দেই আগে? দেখবে ফ্রেশ লাগবে।’ পদ্য জবাব দেয়ার আগেই সে মুখ, গলা, ঘাড় মুছে নিল। তারপর কপালে জলপট্টি দিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছিল। এরপর পদ্য আর কিছুই জানে না। ঘুমিয়ে পড়ে সে। সেবার যখন অনিকের নীল ডায়েরিটা তার হাতে আসে। সেটায় পুরো ডায়েরি ভর্তি পদ্যকে নিয়ে লেখা। এই অসুস্থতার রাত্রির অংশও ছিল। সেই অংশটা আজ ভীষণ মনে পড়ছে। গোটা গোটা অক্ষরে লেখা,
“পদ্য নামটাও সুন্দর। কিন্তু ওর নাম পদ্ম হলেই ভালো হতো। পুষ্পের মতো রমণীটির নাম ফুলের নামে হতো। আমার চোখে যাকে ফুল লাগে৷ তাকে ছুঁয়ে দেখার অধিকার কি আমার নেই? ফুল স্পর্শ করার অধিকার সবার আছে। আজ রাতে আমার পদ্যের পদচুম্বন আমি করেছি। আপাতদৃষ্টিতে এটা অন্যায়। ভারী অন্যায়। একজন অসুস্থ, ঘুমন্ত নারীর পায়ে চুমু খাওয়া কোনোভাবেই ঠিক নয়। কিন্তু আমি কি নিষ্পাপ, ফেরেশতা? আমি অবশ্যই অনেক অন্যায় করি। সেরকম একটা অন্যায় এটা। তাছাড়া মানুষ অপরাধ করার পর সেটার পক্ষে নানান যুক্তি দাঁড় করায়। আমিও করেছি। সেটা হলো পদ্য নামের এই মেয়েটি পুষ্প। পুষ্পের মতো সুন্দর, পবিত্র। তাকে ছুঁয়ে দেখেছি। ছিঁড়ে ফেলিনি তো। ফুল ছেঁড়া অন্যায়। ঘ্রাণ নেয়া, ছুঁয়ে দেয়া নয়। যুক্তিগুলো নিজের কাছেই খোঁড়া যুক্তি মনে হচ্ছে। কিন্তু কি করবো? পদ্য ঘুমিয়ে আছে। কি মায়াময় মুখ। চোখের লালচে পাতা। আমার বারবার ঘোর লেগে যাচ্ছিল। একবার দেখি কাঁথার ভেতর থেকে ওর পা বের হয়ে গেছে৷ কি সুন্দর মায়াবী পা। পায়ের নখগুলো ঈষৎ লম্বা। মোমের মতো মসৃণ ফরসা পাতা। আমার তখন মনে হলো পায়ে হয়তো চুমু খেলে সমস্যা নেই। তাতে কোনো অন্যায় নেই৷ নিজেকে প্রশ্রয় দিয়ে আমি হাঁটু গেড়ে বসে ওর পায়ে ঠোঁট ছুঁয়ে দিলাম। পদ্য নামের পদ্মফুলটা ঘুমের ভেতরেই খানিকটা কাঁপলো। আমার যেন তৃষ্ণা মিটলো না। আমি গাল চেপে রাখলাম পায়ে। অনেক্ষণ চেপে রাখলাম। তারপর দেখি আমার চোখ ভিজে গেছে। গায়ের লোম দাঁড়িয়ে গেছে। আমি ওর পা-টা ঢেকে দিয়ে চেয়ারে চলে আসলাম। জীবনের প্রথম চুম্বন আমার। প্রিয় পদ্মফুলের পায়ে সেই চুম্বন। ভাবলেই আমার গা বারংবার কাটা দিয়ে উঠছে। একটা অপরাধ করলাম। অথচ গর্বে বুকটা যেন ফেটে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে এই জন্মের সেরা প্রাপ্তি ছিল এই চুমুটা।’
পদ্য ফ্যাসফ্যাস করে কেঁদে উঠলো। মনিসা পিঠে ধাক্কা দিয়ে বললো, ‘কি হয়েছে আপু, কাঁদো কেন?’
মনিরা বেগম পাশের রুম থেকে বললেন, ‘কি হয়েছে?’
– ‘আম্মা, আপু কাঁদছে এসে দেখো।’
মনিরা বেগম উঠে এসে বললেন, ‘কিরে বমি করেও মাথা ধরা যায়নি?’
পদ্যের মাথা ধরা নেই। অনিকের জন্য ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। তাই এই কান্না। তবুও মনিরা বেগমের প্রশ্নের জবাবে সে বললো, ‘হ্যাঁ আম্মা, মাথা ব্যথা করছে।’
__চলবে…
লেখা: জবরুল ইসলাম