ছত্রিশ ঝামেলা পর্ব ১৬

0
271

#ছত্রিশ_ঝামেলা
#পর্ব_১৬

গাড়িতে উঠবার আগে নিশাত থামলো। স্ট্রিট লাইটের অল্প আলোয় অঝোর বৃষ্টির ফোঁটাগুলো ভীষণ অপার্থিব লাগছে। শাকিবের হাত ছেড়ে দিয়ে নিশাত মুখোমুখি দাঁড়ালো মানুষটার। বৃষ্টিতে দুজনে নীরব দাঁড়িয়ে রইলো কিছুক্ষণ।
নিশাত হাঁটু গেড়ে বসে পড়লো রাস্তায়। এই কথাগুলো এক্ষুনি না বললে, সারাজীবন সে আত্মগ্লানিতে ভুগবে।
-“আমি আপনার বাড়িতে যেতে পারবো না স্যার।
আপনি আমাকে সাহায্য করতে চাইছেন কিন্তু আমি আপনার থেকে সাহায্য নিতে পারবো না স্যার।”
-“কেন?”
-“সেই কেন’র উত্তরটা আমি একদিন আপনাকে মাথা উঁচু করে দিতে চাই।”
শাকিবও হাঁটু গেড়ে বসে পড়লো।
-“তুমি কি একবারও বুঝতে পারছো না, এটা তোমাকে সাহায্য করা নয় নিশাত। আমি শুধু আমার মনের কথা শুনছি।”
-“আমিও আমার মনের কথাই বলছি। প্লিজ স্যার। আপনি আমায় একটু বুঝতে চেষ্টা করুন। লজ্জায় ছোট হতে হতে আমি মাটিতে মিশে যাচ্ছি। আমায় একটু একলা ছেড়ে দিন। জীবন যে পরীক্ষাটা আমার থেকে নেবে ঠিক করেছে, তা আমি একা দিতে চাই। আজ যদি আমি আপনার থেকে ফেবার নিই, যে স্বপ্ন, যে বেঁচে থাকা আমি বুকে ধারণ করছি এতদিন, তা হয়তো আমি আমার জীবনে কোনোদিন ফিরে পাবো না। আমি আমার মতো করে বাঁচতে চাই স্যার। আমার লড়াইটা আমি আমার হিসেবে করতে চাই৷”
শাকিব তুলে ধরে দাঁড় করালো নিশাতকে।
-“আমার বাবা হারিয়ে গেলেন এক সকালে। তারপর হুট করে একদিন হালিম চাচা এলেন মায়ের জীবনে। এই দুটো ঘটনার কোনো কানেকশান আছে কি না, আমি খুঁজতে চাই স্যার৷ আমার খুব করে মনে হচ্ছে, একটা সূক্ষ্ম জট আমার চোখের সামনে আমি দেখতে পাচ্ছি না। বাবার সাথে হালিম চাচার চেহারার অনেক মিল৷ বাবার হারিয়ে যাবার আগে বাবা আমাকে একটি বিশেষ জায়গায় নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। সেই বিশেষ জায়গাটাই বা কোথায়? আমার দাদী কখনোই আমার দাদুর গল্প করেননি আমাদের সাথে। আমরা দাদুর গল্প শুনতে চাইলে বলেছেন, যে মারা গেছে তাকে নিয়ে আলাপ আলোচনা করার কিছু নেই। আজ মনে হচ্ছে, আমার অনেক কিছু জানবার বাকি। মায়ের জন্য আমার জীবনের জন্য, এসব জানতেই হবে। আমার অনেক কাজ করতে হবে। অনেক!”

বৃষ্টি ভেজা এই চুপসানো মেয়েটাকে আজ বড্ড অন্যরকম লাগছে। শাকিবের মনে হলো, এই পাহাড় সম চারিত্রিক কাঠিন্য নিশাতকে সত্যিই জিতিয়ে দেবে। এই পরিস্থিতি, এই প্রেক্ষাপট নিশাত অকপটে উতরে যাবে। এই শক্তি নিশাতের আছে। যে এত বিপদে এই সূক্ষ্ম ব্যাপার নিয়ে ভাবতে পারে সে নিশ্চয়ই লাফ দিয়ে এই বিপদের বিশাল খাদ পেরিয়ে যাবে।
শাকিব মাথায় হাত রাখলো নিশাতের। তার দৃষ্টিতে একরাশ নির্ভরতার ছাপ। ভালোবাসা আর ভরসায় হৃদয় পরিপূর্ণ হয়ে এলো নিশাতের।
-“তুমি ঠিক যেভাবে লড়াইটা করতে চাও, সবটা ঠিক সেভাবেই করো নিশাত।”
নিশাত ফিসফিস করে বললো,
-“আমি খুব সাহস পাচ্ছি স্যার। আপনার এইটুকু পাশে থাকা আমার সবটুকু সাহসের উৎস৷”

নিশাতের মোবাইল ফোন বাজছে। পিয়াসা ফোন করেছে। নিশাত ফোন ধরতেই ওপাশে পিয়াসার জোর কান্না শোনা গেল।
-“নিশু তুই কোথায় বলতো? আমি আসছি।এক্ষুনি আসছি।”
নিশাত কান্নাভেজা স্বরে বললো,
-“এক্ষূণি আসবি না। তোর মুখ দেখতে আমার ইচ্ছে করছে না।”
-“মুখ দেখতে ইচ্ছে না করলেও আমি আসছি। তোর জন্য আমি বিয়ে করতে পারিনি। বাড়িতে চিঠি লিখে গিয়েছিলাম, ফিরে এসে দেখি বাবার বুকে ব্যথা উঠে মরণদশা। মন্না মামা আমায় খোঁজাখুঁজি করতে গিয়ে পুলিশের হাতে প্যাদানি খেয়েছেন। এতকিছু ঘটেছে শুধু তোর কারণে। এর সমাধানও তোকেই করতে হবে। অন্যকে বিরাট সমস্যায় ফেলে তুই শুধু তোর নিজের সমস্যার সমাধান করবি, তা তো হতে পারে না। আমি তোকে একা ছাড়ছি না।”
নিশাত কান্নার মাঝেই হেসে ফেললো।
-“হাসবি না। ঠিকানা বল।”
-“আমি তোকে একদম ঠিকানা বলবো না।”
শাকিব সরে এলো নিশাতের সামনে থেকে। হঠাৎ করেই তার নিজেকে খুব হালকা লাগছে। পৃথিবীটাকে একটু আগেও যতটা অসহ্যের মনে হচ্ছিল, এখন তা একটুও মনে হচ্ছে না। এই রাতের বৃষ্টি কি সব ব্যথা, যন্ত্রণা মলিনতা, ধুইয়ে দিবে বলেই এসেছে?
শাকিব দু-হাত মেলে দাঁড়ালো। আজ এই ভরভর্তি বৃষ্টির রাতটা তার জীবনে অনন্ত দীর্ঘ হয়ে গেলে কেমন হয়?

লায়লা দরজায় উঁকি দিয়ে বললো,
-“মা আসবো?”
রেহনুমা শুয়ে ছিলেন, উঠে বসলেন।
-“মা একটু বাইরে আসবেন? ভীষণ বৃষ্টি হচ্ছে। আপনাকে নিয়ে বৃষ্টিতে ভিজবো।”
রেহনুমা টু শব্দটি না করে লায়লার হাত ধরে ছাদে আসলেন। বৃষ্টির বড় বড় ফোঁটা গায়ে কাঁপন ধরিয়ে দিচ্ছে। তারপরও ভালো লাগছে। শেষবার কবে এমন ঝুম বৃষ্টিতে তিনি ভিজেছেন, তা তিনি মনে করার চেষ্টা করলেন। রেহনুমার এমন কোনো স্মৃতি মনে পড়লো না।
-“আমি শেষবার বৃষ্টিতে ভিজেছিলাম হাসিবের সাথে। মিমি যখন কনসিভ করলো, তখন। যেদিন খবরটা কনফার্ম হই, সেদিন এত বৃষ্টি হয়েছিল! প্যাথলজি ল্যাব থেকে ফেরার পথে খুশিতে দুজন বৃষ্টিতে ভিজেছিলাম। আপনার ছেলে বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে এত শাসন করলো আমায়। বলেছিল, দেখো কিন্তু, আমার বাবুর ঠান্ডা লাগলে। আমি কিন্তু তোমায় ছেড়ে দেবো না।”
রেহনুমা নিজের দীর্ঘশ্বাস চাপলেন। এই ছেলের কথা ভেবে বউমার সাথে বৃষ্টি ভেজার এমন আনন্দ তিনি মাটি করতে চান না।
-“মিমির যখন ও প্রথম মুখ দেখলো, আপনার ছেলে কি করলো, জানেন মা? হাসপাতালে সবাইকে লুকিয়ে আমায় টুক করে আংটি পরিয়ে দিলো। বললো, মেয়ের মা এখন আমার সাথে এনগেজ। আমি এত আফসোস করেছিলাম৷ ইশ! তখন একটা আংটি থাকলে ওকে তো আমিও পরাতে পারতাম৷”
লায়লা হাতের আংটিটা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে কয়েকবার নিজে নিজেই দেখলো। প্রবল বৃষ্টিতে তার ভেজা মুখখানি অপূর্ব সুন্দর দেখাচ্ছে। রেহনুমার মনে হলো, লায়লার বয়সটা হুট করেই কমে গেছে। ষোলো সতেরো বছেরের কিশোরী অবস্থায় ফিরে গেছে সে। যে কিশোরীর জীবনে আনন্দ এবং দুঃখের বাইরেও অন্য একটা অনুভূতি থাকে-অভিমান। বয়স্কদের অভিমান সাধারণ ব্যাপার। কিশোরীর অভিমান ভীষণ সাংঘাতিক বিষয়।
লায়লা বৃষ্টির মধ্যেই জড়িয়ে ধরলো রেহনুমা সুলতানাকে।
-“মা আমি ঠিক করেছি, হাসিবের সার্জারির সময়টা আমি মিমিকে নিয়ে ওর পাশে থাকবো। মিমির সাথে ওর দেখা হোক। পিতার যন্ত্রণার এই কঠিন সমে সন্তানকে পাশে থাকতে হয় মা। আপনিও আমার সাথে চলুন মা। আপনি ছাড়া আমি ওখানে কিছুতেই একা যেতে পারবো না। এতটা মনের জোর আমার নেই মা।”
রেহনুমা ফিসফিস করে বললেন, মাগো তুমি আমায় যেখানে যেতে বলবে, আমি সেখানে যাবো মা। হাসিব যে ক্ষতি তোমার করেছে, তারপর আমি যে তোমার কাছে সবসময় ক্ষমাপ্রার্থী গো মা।
বৃষ্টির সাথে হঠাৎ দমকা বাতাস বইতে শুরু করলো। রেহনুমা নিজের আঁচলে আদর করে জড়িয়ে ধরলেন লায়লাকে।
লায়লা ভেজা স্বরে বললো,
-“মা… আমি ভালো নেই মা। আমি একটুও ভালো নেই। আমার জীবনের হিসেবটা কেন এত গোলমেলে হয়ে গেল?”
রেহনুমা জবাব খুঁজে পেলেন না৷ তিনি একাধারে মাথায় হাত বুলাতে লাগলেন লায়লার৷ মাঝে মাঝে এমন কেন হয়? যার সবটুকু পাওনা সে কেন সবকিছু থেকে বঞ্চিত হয়?কেন?

কলি রফিকের হাত ধরে চুপচাপ বসে আছে। মানুষটার আজ গা কাঁপিয়ে জ্বর এসেছে। বিয়ে করেই মানুষটা এমন অসুখে কেন পড়লো? দুশ্চিন্তায় কলির কিছুই ভালো লাগছে না। জ্বরের ঘোরে মানুষটা আবোল তাবোল বকছে। বারবার বলছে, রাহেলা আমারে তুমি ক্ষমা করো। রাহেলা আমি তোমার সঠিক চিকিৎসা করাইতে পারি নাই আমারে তুমি ক্ষমা করো।
কলি মাথায় হাত বুলিয়ে জিজ্ঞেস করেছে,
-“রাহেলা কে? সে কে হয় আপনার?”
-“সে আমার ইস্তিরি। সে আমার পরথম ইস্তিরি।”
কলির মনটাই খারাপ হয়ে গেল। মানুষটার তার প্রথম স্ত্রীকে এত ভালোবাসতো।
-“তার কি কোনো ছবি আছে?”
-“নাই। তার ছবি আমার মনে আছে। অন্তরে আছে।”
কলির চোখ ভিজে এলো।
-“ও কলি… কলি। তুমি কি রাহেলার কথা শুইনা রাগ করলা। রাগ কইরো না। তুমি যেমন আমার ইস্তিরি, রাহেলাও আমার ইস্তিরি ছিল। রাহেলা ভালো মেয়ে ছিল। তুমিও ভালো মেয়ে। আমার কাছে তোমরা দুজনের সমান আপন। ও কলি… কলি… বউ আমার।”

কলি রফিকের হাতটা নিজের গালে ছোঁয়ালো। গভীর ভালোবাসায় তার হৃদয় ভারী হয়ে এসেছে। মানুষটা অসুস্থতার মাঝেও কলির মন খারাপের চিন্তা করছে।
কলি ফিসফিস করে বললো, আপনের মতো ভালো স্বামী যার আছে তার মনে কি কখনো রাগ হইতে পারে?

চলবে

#তৃধাআনিকা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here