#চোরাবালি_২৪
রেশমা
মুনকে নিয়ে জোহার আড়াল হলে দরজা লাগিয়ে দিল সোহা ভেতর থেকে। লানার হাতদুটো পেছন থেকে সোহার কাছে বন্দি। লানার কানের কাছে হিসহিস করে বলল
– খুব চালাক ভেবেছিলি নিজেকে, তাই না? আমি জানতাম, প্রেমিক আর তার বাচ্চাকে বাঁচাতে আসবি তুই। কিন্তু দেখ, কি দুর্ভাগ্য। তোর প্রেমিক তোকে মৃত্যুর মুখে ছেড়ে রেখে চলে গেল….
ঘর ফাটিয়ে হাসল সোহা। একটু থেমে বলল।
– তবে জোহারটা খুব বোকা। ওকে বলেছিলাম তোকে আমার হাতে তুলে দিলে আমি মুনকে ছেড়ে দিব। ও সেটাই বিশ্বাস করে বসে আছে।
আমি আসলে কাউকেই ছাড়ছি না।
আবারও হাসছে সোহা। লানা নীর্জীব হয়ে ছেড়ে দিল নিজেকে সোহার হাতে। সে তো এখানে মুনকে রক্ষা করতেই এসেছিল। সোহার শিকার হবার আগে সে এ সুযোগটা অবশ্যই নিত, যাতে মুন আর জোহার সব বিপদ থেকে দূরে সরে যেতে পারে। সেজন্য সে সোহার সাথে যতটা ফাইট করার করত। কিন্তু জোহার যা করল, সেটা কি বুঝে শুনেই করল? সে কী লানাকে সোহার হাতে বলি চড়িয়ে নিজের মেয়েকে নিয়ে নিরাপদে চলে যাবে ভেবেই একটা চুক্তি করেছিল সোহার সাথে? সে না হয় করল। মুনের জন্য এর চাইতেও বেশী কিছু করতে রাজি ছিল লানা। জোহার কি সেটা জানে না বা বুঝতে পারেনি কখনও? নাকি লানা এখনও জোহারের সেরকম বিশ্বাসটা অর্জন করতেই পারেনি?
বুকের ভেতর একটা অজানা ব্যাথাবোধ। লানা বুঝে নিতে চাইল ঘটনাটা। নিজেকে বোঝাতে চাইল, জোহার যা করেছে মুনের জন্য করছে।
চেয়ারে বসিয়ে সোহা তাকে একটা দড়ি দিয়ে বাঁধল। তারপর বেড়িয়ে গেল দরজা লক করে। জোহার কি আজও চেনেনি সোহাকে? মুনকে টোপ দিয়ে জোহারকে বোকা বানাল আর লানাকে আটকাল সোহা। এবার গিয়ে মুন আর জোহারকেও আগল দেবে। ইস, জোহারটা এত বোকা কেন? লানা তো এসেছেই তাদের মুক্ত করতে। কেন লোকটা এভাবে তার হাত পা বেঁধে রাখার ব্যবস্থা করল? নিরুপায় দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল লানা।
জোহার মুনকে নিয়ে বেড়িয়ে যাবার আগেই পথ বন্ধ করে দিয়েছিল সোহা। নিচে সিঁড়ি দিয়ে নামতেই সদর দরজায় আগল দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল জোহার, সোহাকে। বিস্ময়ে উপরের করিডোরে তাকাল জোহার। সিঁড়ি দিয়ে নামছিল সে, তাহলে সোহা কীভাবে তার আগে এলো এখানে? ব্যাপারটাতো অসম্ভব। চালাকি করে জোহারের গলার সুতোটা ফেলে দিতে বাধ্য করেছে সোহা। একন জোহার অরক্ষিত। সোহার দুরভিসন্ধি বুঝতে পেরে জোহার বলল
– এমন তো কথা ছিল না সোহা? তুমি বলেছিলে মুনকে ছেড়ে দেবে, লানাকে পেলে?
– হুম, লানাকে পেয়ে গেছি। তাই আর মুনকে ছাড়ছি না।
কঠিন হল জোহারের মুখ। এতটা রাগ তার বুঝি আর কখনও হয়নি। তবু নিয়ন্ত্রণ করল নিজেকে। বলল
– বেইমান, একটা ফ্রড তুমি। তোমাকে বিশ্বাস করা বিরাট ভুল হয়ে গেছে আমার। কিন্তু খবরদার, মুনের দিকে হাত বাড়াবে না।
সোহা কোমল স্বরে এবার হাত বাড়িয়ে ডাকছে মুনকে। মুন একটু একটু করে হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করছে জোহারের। জোহার চিৎকার করল, বলল
– মুন, তাকিও না। তোমার মমের দিকে তাকিও না মুন…
মুন সেকথা বুঝল না। তার চোখ দুটো এখন তার মমের চোখের গভীরে নিবদ্ধ। সে জোহারের হাত ছাড়িয়ে দৌড়ে গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল সোহার কাছে। খপ করে জাপটে ধরল সোহা মুনকে।
জোহারও দৌঁড়ে এসে ছাড়িয়ে নিতে চাইল মেয়েকে। সোহা ক্ষিপ্ত হাতে একদিকে সরিয়ে দিল মুনকে। আর তারপর দুহাতের প্রচণ্ড ধাক্কায় দূরে সরিয়ে দিল জোহারকে। দরজায় ধাক্কা খেয়ে আবার ফিরে এলো জোহার। আচমকা তার মনে পড়ল লানার কথা। এতবড় একটা ভুল কী করে করল সে? তার মানে এসব সোহার ধোকা ছিল? কি ভাবল তাকে লানা?
জোহার এবার দৌঁড়ে উপরে উঠে গেল। মুনকে জ্বলন্ত আগুনের গোলকের মধ্যে রেখে সোহাও পিছু নিল জোহারের। সিঁড়ির মাথায় এসে ধরল তাকে। কলার ধরে ধাক্কা মারল বাদিকের দেয়ালে। বলল
– মুনকে বাঁচানোর চেষ্টা করে লাভ নেই জোহার।
তীব্র ঘৃনায় চোখ কুচকাল জোহার।
– মুন তোমার মেয়ে সোহা। এতটা নিষ্ঠুর কীভাবে হতে পার তুমি?
– মুন আমার মেয়ে বলেইতো ওকে আমার প্রয়োজন জোহার। আমি যদি ওকে স্যাকরিফাইস না করি তাহলে আমার এতদিনের সাধনালব্ধ সমস্ত পাওয়ার ট্রান্সফার হয়ে যাবে মুনের মধ্যে। যেটা আমার আর আমার মমের বেলাতেও হয়েছিল। তবে আমার মৃত্যুর পর মুন হয়ে উঠবে আমার চেয়ে দ্বিগুন শক্তিধর। বংশানুক্রমিক এই ঘটনা ঘটতেই থাকবে। তাহলে কি দরকার বল, মুনকে বাঁচিয়ে রেখে…?
স্তম্ভিত জোহার। কি বলছে এসব সোহা? তার ছোট্ট আদরের মুন, সে কিনা বড় হয়ে তার মায়ের মত হবে? এত জঘন্য!
– আমি বিশ্বাস করি না। তুমি মিথ্যে বলছ। মুনকে আমি ফেরত চাই। মুনকে দিয়ে দাও সোহা, ওকে নিয়ে আমি দূরে কোথাও চলে যাব। তোমার ছায়া পড়তে দিব না ওর ওপর।
সোহা ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে জোহারের দিকে। আর জোহার পিছু হটতে হটতে প্রায় দেয়ালে ঠেকে গেছে। সে এখন যেখানে দাঁড়িয়ে আছে তার পেছনের কাচের দেয়াল। সে ঠেকে গেছে সেখানে। সোহা বলল
– আমার বাচ্চা আমি যা খুশি তাই করব। তাছাড়া স্যাকরিফাইস করলেই ভাবছ কেন মুন মরে যাবে? মুন তো বেঁচে থাকবে আমার মাঝে? আমার শক্তি হবে মুন।
– মুন তোমার বাচ্চা? যে পিশাচীনী তার বাচ্চাকে নিজ হাতে খুন করার কথা ভাবে, সে আবার কারোও মা হতে পারে?
রাগে জ্বলে ওঠে সোহার চোখদুটো। কিছু বুঝে ওঠার আগেই প্রচণ্ড ধাক্কা মারে জোহারের বুকে। সোহার অতিরিক্ত শক্তি প্রয়োগে জোহারের পেছনের কাঁচ ভেঙে দোতলা থেকে বাইরে পড়ে যায় জোহার।
কাঁচ আর জোহারের পতনের শব্দে হো হো হো করে হেসে ওঠে সোহা।
– নির্বোধ…! তবু যা হোক, একটা শেষ হল ।
সোহা পিছনে ঘুরে কিছুদূর সামনে এগিয়ে থমকে দাঁড়াল। লানার ঘরটা বাইরে থেকে লাগানো। সে কি একবার দেখে আসবে সব ঠিক আছে কিনা? মেয়েটা অতিরিক্ত চালাক। দরজাটা খুললে যদি আবার কোন চালাকি করে?
এখনও বারোটা বাজতে বেশ কিছুটা সময় বাকি। সোহা বরং তার চূড়ান্ত সাধনার প্রস্তুতি নিক। লানাকে নির্দিষ্ট সময়ের আগে বরং নিয়ে যাবে সে। তাছাড়া ঘরের ভেতরে হাতবাঁধা অবস্থায় আছে ও। কোন বেচাল করার ক্ষমতা নেই ওর। আর কিছুক্ষণ সময় মাত্র। তারপর মুনের রক্ত উৎসর্গ করে নিজের শরীর ত্যাগ করে লানার শরীরে ঢুকবে সে। লানাকে নিজের শরীরে স্থানান্তর করে খুন করবে। এরপর সুবিধামত অন্যের শরীরে শরীরে ঘুরে বেড়াবে সে।
আর মাত্র কিছুটা সময়।
লানার হাতগুলো পিছমোড়া করে বেঁধেছে সোহা। জোহারকে ধরার তাড়া ছিল বলে বাঁধন আলগাই ছিল। লানা ইচ্ছে করেই বসে আছে এখানে। রিজভির চিঠিটা শেষ সময়ে, ইমাদের মাধ্যমে হাতে পেয়েছিল লানা। রিজভি লিখেছিল
” ডিয়ার লানা”
তোমরা চলে যাওয়ার পর ভীষণ চিন্তায় ছিলাম আমি। কোন মতেই যোগাযোগ করা সম্ভব ছিল না কারণ, সোহা যে কখন কোথায় থাকে আমি বুঝতে পারতাম না। হতাশা আর দুশ্চিন্তা নিয়েই সিধ্বান্ত নিলাম আমি আমার শহর ছেড়ে অন্য কোথাও চলে যাব। সেরকমই প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। কিন্তু তার আগেই আমার সাথে অদ্ভূত একটা ঘটনা ঘটে গেছে।
সেদিন খুব দুর্যোগের রাত ছিল। আমি একটু রাত করেই ফিরছিলাম। পথঘাট বরফে ঢাকা। পায়ে হেঁটেই ছুটছিলাম। এত দ্রুত চলছিলাম যে, আমার গায়ে ধাক্কা লেগে ছিটকে পড়েছিল একটা লোক। কালো শীতের পোশাকে ঢাকা লোকটা, পড়ে গিয়েছিল জুবুথুবু হয়ে। আমি গিয়ে দুঃখপ্রকাশ করে তুলে দিলাম। লোকটার মুখের দিকে ভালো করে তাকিয়ে চমকে গেলাম আমি। মনে হল, কোথায় যেন দেখেছি তাকে। লোকটাও যেন তাড়াতাড়ি ছাড়িয়ে নিল নিজেকে। চলেই যাচ্ছিলাম, হঠাৎ মনে পড়ল, একে তো আমি চিনি। পেছনে তাকিয়ে দেখলাম বিপরীত দিকে ছুটছে লোকটা। আমি পিছু নিয়ে থামতে বললাম তাকে। দৌড়ে গিয়ে ধরলাম। বললাম, তুমি তো জন…। কোথায় ছিলে এতদিন? তোমাকে কত খুঁজেছি আমি জানো…?
জন আমাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে পালানোর চেষ্টা করল। আমি দৌড়ে গিয়ে আবার ওকে ধরলাম। বেশ ধস্তাধস্তি হল আমাদের। আমি বললাম
– জন, তুমি নিশ্চই চিনতে পেরেছ আমাকে? কোথায় ছিলে তুমি? আমার তোমাকে ভীষণ প্রয়োজন ছিল। কত জায়গায় যে খুঁজেছি তোমাকে।
জন কর্কশ গলায় বলল
– কে তুমি, আমি চিনিনা তোমাকে। দূর হও…
– না, তার আগে একটা প্রশ্নের জবাব দিতে হবে তোমাকে। বল, কেন সেদিন সব জেনেশুনে সারার মত একটা বাচ্চাকে তুলে দিয়েছিলে আমার কোলে? তুমিতো জানতে সারা সাধারণ বাচ্চা নয়। কেন আমার সর্বনাশ করলে? আমি তো বাবা হওয়ার জন্য একটা বাচ্চা চেয়েছিলাম তোমার কাছে। তুমি একটা খুনী, তুলে দিলে কেন আমার কাঁধে? বল, বলতেই হবে তোমাকে।
জন ছাড়া পাবার চেষ্টা করতে করতে বলল
– তুমি বাচ্চা চেয়েছিলে, বাচ্চা পেয়েছো, ব্যাস…
আমি সজোরে জনকে একটা ঘুষি মারলাম। জন সম্ভবত কিছুটা মাতাল ছিল। সামলাতে না পেরে পড়ে গেল নিচে। আমি বললাম
– কতগুলো মৃত্যুর কারণ ঘটিয়েছ তুমি জানো? সারা এখন ধ্বংসযজ্ঞ চালাচ্ছে। মানুষ মারতে মারতে ও এখন নিজের স্বামী সন্তান উজাড় করে দিচ্ছে। ওর একমাত্র মেয়ে মুনকেও স্যাকরিফাইস করতে চলেছে। প্লিজ বাঁচাও ওর বাচ্চাটাকে, প্লিজ কিছু কর জন।
জন বলল
– আমি কী করব? আমার কি করার আছে?
আমি কঠোর হলাম। ওর কলার চেপে ধরে বললাম
– নিশ্চই তুমি জানো। নিশ্চই আছে কোন না কোন উপায়। একদিন তুমিওতো তোমার বোনের
হাত থেকে বাঁচিয়েছিলে সারাকে।
জন জোর করে ছাড়িয়ে নিল নিজেকে। হিসহিস করে বলল
– কেউ বাঁচবে না। সব শেষ হয়ে যাবে। মুনকে বাঁচিয়ে দিলে মুনও একসময় সারার মত হয়ে উঠবে। কোন লাভ নেই।
জঘন্যভাবে খ্যাঁকখ্যাঁক করে হসল জন।
আমি কাতর মিনতি জানালাম, বললাম
– প্লিজ জন, তুমি জাননা কত ক্ষতি হয়ে গেছে আমাদের। এবার থামাও। সারার জন্য কতগুলো নির্দোষ প্রাণ বলিতে চড়তে চলেছে।
– জানি জানি, সব খবর রাখি আমি। সেদিন এ্যাকসিডেন্ট থকে আমিইতো বাঁচিয়ে দিয়েছিলাম ওদেরকে।
– তুমি? তার মানে সব জানো তুমি?
– হ্যা ওই মন্ত্রপূত সুতোটা আমিই দিয়েছিলাম। এও জানি আর মাত্র কয়েকদিন পরেই সারা তার মোক্ষ লাভে সফল হতে চলেছে। কেউ আটকাতে পারবে না তাকে।
– কেন কেন আটকাচ্ছ না তাকে? ওর মাকে তো আটকেছিলে, তাইতো বেঁচে গিয়েছিল সারা।
– সারা ওর মায়ের চাইতে বহুগুণ বেশী শক্তিধর, ওকে আটকানো সহজ নয়।
– তাহলে কি চাইছ, সারা তার শেষ বংশধর শেষ করে ফেলুক? কি হবে ক্ষমতা আর শক্তি দিয়ে? পৃথিবীর কিছু ক্ষতি, কিছু মৃত্যু, কিছু সর্বনাশ।
একটা কিছু উপায় বল। একটা পথ বলে দাও প্লিজ…
মহা বিরক্ত জন, ঝাঁঝাল গলায় বলল
– আর কতবার বলব, আমার হাতে কিছু নেই। আর সময় নেই ওকে থামানোর। আগামী পঁচিশে সেপ্টেম্বর, সারা ত্রিশ বছরে পদার্পণ করবে। ওইদিন শেষ প্রহরে যদি সারা তার নিজ রক্ত বা নিজ সন্তানের রক্ত উৎসর্গ করে সাধনা করতে পারে, তবে সে হয়ে যাবে অপরিমেয় ক্ষমতার আধার আর অমর। সে নিজ শরীর থেকে মুক্তি নিয়ে একটার পর একটা মানুষের শরীরে দখল নেবে।
– এ তো ভয়ঙ্কর কথা….। আর কয়েকদিন পরই তো আসতে যাচ্ছে সেই দিন
– হ্যা
– তোমার কিছুই করার নেই জন? একটা নিস্পাপ শিশুকে রক্ষা করার উপায় জানা সত্বেও তুমি তাকে ঠেলে দিচ্ছ মৃত্যুর মুখে।
কিছুটা ছায়া পড়ল জনের মুখে। নিরুপায় রিজভি মাথা নিচু করে চলে যাচ্ছিল। কিছুদূর এগোতেই পেছন দিকে ডাকল জন। বলল
– একটা উপায়ই অবশিষ্ট আছে।
অতি উৎসাহিত আমি।
– কি…. প্লিজ বল আমাকে
– হয় সারা, নয় মুন একজনকে মরতে হবে।
– কীভাবে?
– সাধারণ উপায়ে মারলে সারার মৃত্যু হবে না।
– মানে?
– মানে, সারাকে মারতে হবে…অন্য উপায়ে।
– এতগুলো মৃত্যুর জন্য যে দায়ী তার তো মৃত্যুদণ্ডই প্রাপ্য। আমার উচিৎ ছিল সেদিনই ওকে গলা টিপে মেরে ফেলা, যেদিন আমার তিহামকে জেনে বুঝে, পরিকল্পিতভাবে মেরে ফেলেছিল, আমার সন্তান সম্ভবা স্ত্রীকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছিল সিঁড়ি দিয়ে। আরও কত কত যে মৃত্যু দেখেছি আমি। সেদিনই ওর একটা ব্যবস্থা করতে পারতাম, পারিনি। ওই বাবা ডাকের মোহে বছরের পর বছর সয়ে গেছি সব। কিন্তু আজ আর কোন পিছুটান নেই। সারা… মানে সোহাকে থামাতে না পারলে সর্বনাশ হয়ে যাবে জন
– বললাম তো, সারাকে কোন সাধারণ মৃত্যু স্পর্শ করতে পারবে না।
– তাহলে তুমি কী বলতে চাও, সোহার মৃত্যু নেই?
– আছে, তবে অন্য উপায়ে।
– কী সেটা?
– সারার মা, এডির মন্ত্রপূত আগুন। কেবল মাত্র সেই আগুনেই পুড়িয়ে মারা সম্ভব সারাকে। তবেই চিরতরে ধ্বংস হয়ে যাবে এই ক্ষমতার চক্র। বেঁচে যাবে মুন, বাঁচতে পারবে সাধারণ মানুষ হয়ে।
– কোথায় পাব সেই মন্ত্রপূত আগুন? এডি, মানে সারার মম তো অনেক বছর আগে মরে গেছে?
রহস্যময় হাসল জন। বলল
– আমার বলতে মানা আছে…
উত্তেজিত হলাম আমি, বললাম
– তীরে এসে তরী ডুবিয়ে দিও না জন। এতটাই যখন বললে বাকিটাও বলে যাও…
– বললাম তো আমার বলা নিষেধ। আমিতো মরতে চাইনা। ওই নাম উচ্চারণ করার সাথে সাথে ভস্ম হয়ে যেতে পারি আমি।
– এসব কি বলছ? তাহলে কীভাবে জানব আমি? প্লিজ জন একটা কিছু বল…
জন হাঁটা দিয়েছে উল্টো দিকে। আমি আর্তনাদ করছি দাঁড়িয়ে।
– প্লিজ জন… এভাবে চলে যেওনা। বাঁচাও আমাদের। তুমি নিশ্চই বাঁচাতে চাও মুনকে…. নিশ্চই বাঁধা দিতে চাও সোহাকে। নইলে কেন সেদিন এ্যাকসিডেন্ট থেকে রক্ষা করলে ওদের। তুমি তো জানতে এসব সোহার পূর্ব পরিকল্পনা?
আমি কথাগুলো বলতে বলতে পিছু নিচ্ছিলাম জনের। জন থমকে দাঁড়িয়ে দূর থেকে বলল
– তোমার কাছেই আছে সব। মাথা খাটাও, খোঁজ।
কথাগুলো বলেই জন একটা অন্ধকার গলিতে অদৃশ্য হল। আমি অনেক খুঁজেও ওকে আর পেলাম না।
জনের শেষ কথাগুলো হাতড়াতে থাকলাম মনে মনে। বাড়ি ফিরে সারাক্ষণ শুধু ভাবলাম আর ভাবলাম। কোন ক্লু খুঁজে পেলাম না। সারারাত ছটফট করলাম। শেষরাতের দিকে চোখ লেগে এসেছিল। একটা অদ্ভূত স্বপ্ন দেখলাম। দেখলাম সোহা সেই ছোট্ট বেলার। সোহার সারা গায়ে ফোসকা। যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে সোহা। সোহার গলায় একটা সুন্দর ডিম্বাকৃতি লকেট ওয়ালা চেইন।
চট করে ঘুম ছুটে গেল। উঠে বসে ভাবতে লাগলাম, আজ এতবছর পর এই স্বপ্নটা কেন দেখলাম? সোহাকে নিয়ে বেশি ভাবছি বলেই কি?
তখন মাথা কাজ করতে শুরু করল। সোহাকে আমার হাতে দেয়ার সময় জন একটা ছোট্ট কাঠের বাক্স দিয়েছিল আমাকে। বাড়ি ফিরে কিছুদিন পর কৌতূহল বশত আমার স্ত্রী বাক্সটা খুলেছিল। একটা ডিম্বাকৃতি কাচের গোলক বা লকেট সমেত চেইনটা পাওয়া গেল বাক্সে। লকেটটা সুন্দর, যেন আলো ঠিকরে বের হচ্ছে। অথচ বরফের মত ঠাণ্ডা। আমার স্ত্রী ভেবেছিল, ওটা সোহারই। তাই সে সোহাকে চেইনটা পরিয়ে দিয়েছিল।
ঘন্টা খানেক পর থেকে সোহার গায়ে বড় বড় ফোসকা পড়তে শুরু করল। দেখতে না দেখতে ছড়িয়ে গেল সারা গায়ে। সোহা যন্ত্রনায় ছটফট করতে লাগল। আমরা ওকে হসপিটালে নিয়ে গেলাম। টানা তিনদিন চিকিৎসা করেও ডাক্তাররা আইডেন্টিফাই করতে পারল না কিছু। সোহা তখন মরনাপন্ন। আমার স্ত্রী কান্নাকাটি শুরু করল। তিনদিনে সোহা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গিয়েছিল। চেইনটা গলায় থাকায় ওর শুশ্রূষায় বিঘ্ন ঘটেছিল। আমার স্ত্রী ওটা খুলে রেখে দিয়েছিল ব্যাগে। তার কিছুক্ষণ পর থেকেই ইমপ্রুভ করতে শুরু করল সোহা।
পরদিন সম্পূর্ণ সুস্থ হলে ওকে নিয়ে বাড়ি ফিরলাম আমরা।
স্বপ্নের ব্যাখ্যা খোঁজার চেষ্টা করলাম। দৌঁড়ে ছুটে গেলাম স্টাডিতে। যেখানে বই পুস্তকের আড়ালে, গোপন চেম্বারে অবহেলায় পড়েছিল কাঠের বাক্সটা। আমরা সেদিন সোহার সুস্থতার পেছনে এই লকেটের ভূমিকা বুঝতে পারিনি। কিন্তু স্বপ্নটা দেখার পর সব কেমন অর্থবহ হয়ে উঠছিল। লকেটটা বের করে খুব ভাল করে দেখলাম। এডির মন্ত্রপূত আগুন কি তবে এই লকেটেই লুকানো আছে?
জানিনা, কিচ্ছু বুঝতে পারছি না। জনের দেয়া ক্লু, সোহার শরীর খারাপের স্মৃতি আর এই লকেট, এদের মধ্যে যদি কোন আন্তঃসংযোগ থেকে থাকে তবে আমার ধারণা এই লকেটই সোহার মৃত্যু সংরক্ষিত আছে।
লানা মাই চাইল্ড, এটা আমি তোমার কাছে পাঠালাম। যদি তোমার হাতে এটা পাও, তুমি এর উপযুক্ত সদ্ব্যবহার করো। আমি খুব চেষ্টা করব তোমার পাশে থাকার। পরিস্থিতি বুঝে যেকোন সিধ্বান্ত নিতে পিছপা হবে না।
মুনকে রক্ষার দায়িত্ব দিলাম তোমার হাতে। ওকে ওর মায়ের কুপ্রভাব থেকে রক্ষা কর।
তোমার ড্যাড,
রিজভি আহমেদ।”
লানা নিজের হাত প্রায় খুলে ফেলেছে। একটা তীব্র পোড়া গন্ধ অনেক্ষণ থেকে নিশ্বাসে বাঁধা দিচ্ছে তাকে। কি হচ্ছে নিচে জানে না সে। কোন অঘটন নয়তো? একটু আগে একটা ঝনঝন শব্দ কাঁপিয়ে দিয়েছিল তাকে। উপর থেকে নিচে কিছু পড়ল বুঝি। কি হতে পারে? আশঙ্কায় স্থির থাকতে পারছে না সে।
একটু আগে জোহারের, তাকে নিরুপায় করে সোহার হাতে ফেলে যাওয়ায় যে ব্যথাবোধ তৈরি করেছিল। ওই পতনের শব্দটা নিমিষেই সেটা দুশ্চিন্তা আর উদ্বেগে রুপান্তরিত করল। জোহারের কিছু হল নাতো? জোহার, মুনকে নিয়ে পালাতে পেরেছিল তো?
লানা হাত খুলে দরজায় হাত দিল। দরজা বাইরে থেকে লক। দিশেহারা বোধ করল সে। এখন কি উপায় হবে? পোড়া গন্ধটা তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। ঘড়িতে বাজে সোয়া এগারোটা। তার মানে আর বেশী সময় নেই হাতে। লানা লকটা জোরে ঘোরাতে চাইল, হল না। এঘর থেকে মুক্ত হতে হবে তাকে। লকটা ভাঙতে গেলেও শব্দ হবে জোরে। কি করা যায়? ঠিক এসময় কারো পায়ের আওয়াজ এলো। প্রস্তুত হল লানা। একটা ভারি কিছু খুঁজল সে চারিদিকে। কোথাও কিছু না পেয়ে কাঠের চেয়ারটাই তুলে নিল উঁচিয়ে।
দরজা খুলে সোহা ঢোকার সাথে সাথে পেছন থেকে মাথায় আঘাত করল লানা। হুড়মুড় করে পড়ে গেল সোহা। লানা দ্রুত বেরিয়ে এসে দৌঁড়ে নেমে এল নিচে।
ড্রয়িংরুমের আগুনের গোলক তখনও জ্বলছে ধিক ধিক করে। মুন স্থির হয়ে শুয়ে আছে মাঝখানে। লানা ছুটে গেল তার পাশে। ডাকাডাকি করেও লাভ হল না। এই আগুনের ভেতর যাওয়া কি ঠিক হবে তার? লানা স্পর্শ করল মুনকে। মুনের শরীর বেশ ঠান্ডা। দুশ্চিন্তায় কাতর হল সে। আচ্ছা, রিজভির পাঠানো লকেটটা কি কোন কাজ করবে এখন? লানা এবার তার পকেটে হাত দিল। অনুভব করল, তার পকেট শূণ্য। আতকে উঠল মনটা। সেকি, কোথায় গেল লকেট সহ চেইনটা? উপরের ঘরে যখন বাঁধা অবস্থায় ছিল, তখন পড়ে যায়নি তো? নাকি গাড়িতেই রয়ে গেছে? কি হবে এখন?
লানা দ্রুত সিধ্বান্ত নিল। না উপরে যাওয়া যাবে না। লানার হাতে যেচে ধরা দেয়ার কোন মানে হয়না। বেটার, আগে মুনকে নিরাপদে পাচার করা হোক। লানা একটা লাফ দিয়ে বৃত্তের ভেতরে ঢুকল। কোলে তুলে নিল অচেতন মুনকে। সাথে সাথে জ্বলে উঠল পুরো বৃত্তটা। আর একটু হলে আঁচ লাগত তাদের, তীব্র ঝাঁঝাল গন্ধে দমবন্ধ পরিবেশ।
লানা মুনকে নিয়ে বের হল সদর দরজা দিয়ে তার কাঁধের ওপর মুন। গেটের বাইরে বেড়িয়ে লানা যথাসম্ভব ছুটল। পথে অসংখ্য কাঁচের টুকরা আর রক্ত। আশঙ্কায় কেঁপে উঠল মন। জোহার কোথায় গেল? ওকি চলে গেছে মুন কে ফেলে? ও নিশ্চই আহত। বোকা লোকটা একটু ভরসা রাখতে পারল না লানার ওপর?
বাগানের পথটা অন্ধকার। গেটের বাইরেটাও নিরিবিলি। লানা দ্রুত দৌঁড়াল মুনকে কাঁধে নিয়ে। কষ্ট হচ্ছে তার, তবু ছুটছে প্রাণপণ।
গাড়ির কাছাকাছি আসতেই ছায়ামূর্তিটা দেখতে পেল লানা। কু্ঁজো হয়ে বসে আছে ফুটপাতে। জোহার? লানাকে দেখে খোঁড়াতে খোঁড়াতে ছুটে এলো জোহার। বলল
– লানা….? তুমি ঠিক আছ? মুন…? কিছু হয়নিতো মুনের?
লানা কোন জবাব না দিয়ে ঘুমন্ত মুনকে হস্তান্তর করল জোহারের কোলে। তারপর গাড়ির দরজা খুলে গাড়ির ভেতর খুঁজল কিছু। যা ভেবেছিল ঠিক তাই। নিচে পড়েছিল লকেটসহ চেইনটা। লানা গাড়ির চাবিটা জোহারের মুঠোয় দিয়ে ঠেলে তাকে মুন সহ ভেতরে ঢুকতে বাধ্য করল। দরজা লাগিয়ে দিয়ে বলল
– মুনকে নিয়ে চলে যাও জোহার। দূরে কোথাও। এখানে থাকাটা মুনের জন্য নিরাপদ নয় একদম। যত দূরে সম্ভব চলে যাও। আজ রাতটা বড় অশুভ ওর জন্য।
জোহার হাত চেপে ধরল লানার, বলল
– তুমিও চল লানা
– সেটা সম্ভব নয় জোহার, তুমি জান।
হাত ছাড়িয়ে নিতে চাইল লানা। জোহার ছাড়ল না। আধো অন্ধকারেই গভীর চোখে তাকাল লানার চোখে, বলল
– আই’ম সরি লানা। আমি স্বার্থপরের মত আচরণ করছি।
নিজের হাতটা টেনে নিয়ে লানা বলল
– আমি হলেও তাই করতাম জোহার। তোমার কাছ থেকে এটাই আশা করতাম আমি। তুমি ঠিক ছিলে। এখন যাও। সোহা জেগে ওঠার আগে পৌঁছতে হবে আমাকে। আর, ততক্ষণে মুনকে নিয়ে তুমি দূরে কোথাও গা ঢাকা দিবে।
যাও, ভালো থেকো। বিদায়…
লানা আর এক মুহূর্তও দেরী করল না। উল্টো হাঁটা দিল নিকুঞ্জভিলার দিকে।
নিরুপায় উদ্বেগে অন্ধকারে তার গন্তব্যে চেয়ে থাকল জোহার। কোথাও কি একটা অভিমান ছিল, লানার গলায়?
নিচতলাটায় আগুন জ্বলছে দাউদাউ করে। খোলা চত্বর ছাড়িয়ে আসেপাশের আসবাব ছুঁইছুঁই আগুন। বাড়ির আলোগুলো নিভে গেছে কখন। লানা ভয়ার্ত চোখে দেখছে চারিদিক। তার পকেটে লকেটসমেত চেইন। তবে সে জানেনা, কীভাবে ব্যবহার করবে এটা। লানা সিঁড়ির কাছাকাছি এসে উপরের দিকে তাকাল। সোহা কী এখনও উপরেই আছে? সেকি উঠে যাবে সেখানে?
লানা দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকাল। আগুনের শিখায় দেখল ঘড়ির কাটা বারোটা ছুঁইছুঁই।
কি হতে যাচ্ছে কিছুই জানে না লানা। ঠিক এমন সময় হঠাৎ পেছন থেকে জাপটে ধরল তাকে সোহা। একহাতের কুনুইয়ের মধ্যে লানার মাথাটা আটকে নিয়ে নিশ্বাস বন্ধ করে দিতে চাইল তার।
ছটফট করল লানা। তার পকেটে আছে লকেটটা, কিন্তু সেটা কীভাবে ব্যবহার করতে হয় তা জানে না সে। রিজভি এ ব্যাপারে কিছুই বলেনি তাকে। আদৌ এটা কাজ করে কিনা সে ব্যাপারেও অনিশ্চিত। লানা নিজেকে ছাড়াতে চাইল খুব। ধস্তাধস্তি হল দুজনে কিছুক্ষণ। আগুনটা ক্রমশ ছড়িয়ে পড়ছে। ধোয়ায় আচ্ছন্ন চারিদিক। নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে তার। হঠাৎ ছেড়ে দিল সোহা তাকে। ক্রুদ্ধ গলায় বলল
– মুন কে সরিয়ে দিয়ে আমার ক্ষতি করলি তুই। এবার মর। আমি আমার শরীরের রক্ত বিসর্জন দিব এ আগুনে। তারপর তোর শরের ট্রান্সফর্ম হব। তুই আসবি আমার শরীরে। আর তখনই মারব তোকে। আমরা শরীরটা তোকে সহ বিসর্জন দেব এই আগুনে আর আমি হব অমর।
সোহা লম্বা একটা চাকু নিল হাতে। আগুনের কাছাকাছি গিয়ে নিজের হাতের তালুতে পোঁচ দিল। ঝরঝর করে ঝরছে রক্ত আগুনের মধ্যে। বিড়বিড় করে কি যেন আওড়াচ্ছে সোহা। দূরে লানার শরীরে কেমন ঝিমঝিম অনুভূতি আসছে। সচেতন হল লানা। পকেট থেকে লকেটটা বের করল হাতে। প্রচণ্ড চেষ্টায় চোখদুটো খুলে রাখতে চাইল সে। সোহা ঘুরে দাঁড়িয়েছে তার দিকে। ক্রমশ শক্তিহীন হয়ে পড়ছে লানা।
ঠিক সেই মুহূর্তে দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকল জোহার। বিস্ময় আর ভয়ে আতঙ্কিত লানা তাকিয়ে দেখল জোহারকে। তার দৃষ্টি এলোমেলো, জোহারের চেহারাটা ক্রমশ ভেঙেচুরে যাচ্ছে যেন তার চোখে। বোকা লোকটা আবার কেন এলো এখানে? শেষ মুহূর্তে লানা তার হাতটা ছুড়ে মারল জোহারের দিকে। আর তার পর মুহূর্তেই এদিক থেকে তীব্র গতিতে ছুটে এলো সোহা, লানার দিকে। প্রচণ্ড ধাক্কা খেল দুটি শরীর মুখোমুখি। বারোটা বাজতে আর মাত্র দু’ মিনিট বাকি।
জোহার লানার ছুড়ে মারাটা লক্ষ্য করে লুফে নিয়েছিল জিনিসটা। তবে সেটা কি, তখনও বুঝতে পারেনি সে। হাতে নিয়ে মুঠি খুলে দেখল জ্বলজ্বল করছে কাচের টুকরোটা। মনে হচ্ছে আগুন জ্বলছে ভেতরে।
ওদিকে লানা আর সোহার শরীরের ট্রান্সফর্ম হয়ে গেছে কখন, আধো অন্ধকারে জানতেই পারল না জোহার। সে শুধু এবার তাকিয়ে দেখল সোহা সিঁড়ির নিচে দাঁড়িয়ে, আর লানার হাতে লম্বা ধারাল একটা চাকু। জোহার যেন এই কাঙ্ক্ষিত দৃশ্যটা দেখার জন্যই ব্যাকুল ছিল।
এবারে লানা প্রচণ্ডভাবে চাইছে চাকুটা সোহার পাঁজরে ঢুকিয়ে দিতে। তীব্র বাঁধাদানে সচেষ্ট সোহা। সোহা চিৎকার করে বলল
– জোহার হেল্প…। আটকাও ওকে প্লিজ….
জোহার জ্বালাময়ী চোখে তাকিয়ে সোহার দিকে, বলল
– তোমার মোক্ষ লাভের সময় চলে এসেছে সোহা। এবার প্রস্তুত হও। লানা, শেষ করে দাও এই জঘন্য মেয়েটাকে। একটুও ঘাবড়িও না। আমি নেব সবকিছুর দায়। মারো ওকে…
চিকন হাসি লানার ঠোঁটে। ভয়ার্ত সোহা প্রতিরোধের চেষ্টায় ব্যর্থ প্রায়। তবু শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে শেষবারের মত তীব্র ধাক্কা মারতে পারল লানাকে। লানার হাতের চাকুটা এবার ছিটকে পড়ল জোহারের পায়ের কাছে। জোহার তড়িতে তুলে নিল এক হাতে চাকুটা।
তীব্র ভয় বাসা বাঁধল সোহার চোখে। সে আর্তনাদ করল
– জোহার, আমি লানা। ভুল করনা, সতর্ক হও। আমাদের শরীর চেঞ্জ হয়ে গেছে। চাকুটা আমাকে দাও। আর সময় নেই।
অন্যদিক থেকে লানা মায়াবী গলায় বলল
– জোহার, প্লিজ ওর কথা শুন না। মারো ওকে। নইলে ও তোমার মুনকে শেষ করে দেবে।
মুনের কথায় জ্বলে উঠল জোহারের চোখ। চাকুটা তাক করে সে একটু একটু এগিয়ে গেল সোহার দিকে। সোহার চোখদুটোতে নিরুপায় আতঙ্ক, পিছু হটতে হটতে সিঁড়ির রেলিং এ পিঠ ঠেকে গেছে তার। লানা ইন্ধন জোগাচ্ছে জোহারকে প্রতিনিয়ত।
– মারো জোহার, মারো এই শয়তানীকে। তোমার মুনের চিরশত্রু ও। ছেড় না ওকে। মেরে ফেলো, জলদি কর…
অপ্রতিরোধ্য জোহার নিমিষে চালিয়ে দিল চাকুটা সোহার পেটে। বিস্ফোরিত দুটি অবিশ্বাস্য চোখ সোহার। বেদনার্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে জোহারের চোখের দিকে। চাকুটা বের করে এনেছে জোহার। এবার সে বিজয়ীর চোখে ফিরে তাকিয়ে দেখল লানার দিকে।
লানা দু’হাত তুলে প্রদক্ষিণ করছে আগুন। আর অস্ফুট কিসব মন্ত্রতন্ত্র পাঠ করছে। বিস্ময়ে বিমুঢ় জোহার। সোহা সিঁড়ির গোড়ায় পড়ে গেছে ইতিমধ্যে। জোহার একবার তাকাল সোহার দিকে। ক্ষতস্থান চেপে ধরে যন্ত্রণায় কুঁকড়ে যাচ্ছে সোহার মুখ। আর একদিকে তাকিয়ে দেখল পাগলের মত আগুনকে ঘিরে হাত দোলাচ্চে লানা।
কে লানা? কে তবে সোহা? চুড়ান্ত বিভ্রান্ত জোহার।
( চলবে)