চোরাবালি পর্ব ২৩

0
180

#চোরাবালি_২৪
রেশমা আক্তার

সোহা আহত হয়ে সোজা গিয়েছিল হাসপাতালে। ভোরবেলা ঘুম ভেঙে লানা নিজেকে তাই নিজের শরীরে হাসপাতালের বেডেই আবিষ্কার করেছিল। তার শরীরে একন রোগীর পোশাক। এখন চারিদিকে শুনশান। লানা কিছুই ভাবতে পারছে না। কী করবে সে এখন?

সে কী এখন নিকুঞ্জভিলায় যাবে? সোহার সমস্ত ক্ষোভ এখন লানার ওপর। তাকে পেলে সোহা কী ছেড়ে দেবে? কিন্তু তার চাইতেও বড় বিপদ মুনের। যদিও জোহারের কাছে ওই সুতোটা রাখা আছে। জোহার সাবধান হলে হয়ত সোহা ক্ষতি করতে পারবে না ওদের। তবে আপাতত এখন তাকে পালাতে হবে হাসপাতাল থেকে। এখন চারিদিকটা শুনশান। গেটে দাঁড়োয়ান না আটকালে বেরিয়ে যাওয়া কোন ব্যাপার না। কিন্তু এখন যাবে কোথায় সে? নিজের বাড়িতে?

লানা হাসপাতাল থেকে পালিয়ে সোজা নিজের বাড়িতেই এলো। তাকে ভাবতে হবে। অরক্ষিত আত্মহত্যার চেয়ে কিছুটা শক্তি সঞ্চার করে শত্রুর মোকাবেলা করাই বুদ্ধিমত্তার কাজ হবে।

হাশেম আঙ্কেল চিকন চোখে দেখছে তাকে দূর থেকে। লানা আহত। সে ওপরে নিজের ঘর পর্যন্ত যেতে পারল না। ধপাস করে বসে পড়ল সোফায়। জেসি এসে হাত জোড় করে দাঁড়িয়ে আছে অদূরে।

খানিকটা বিশ্রাম নিয়ে লানা ডাকল হাশেমকে
– হাশেম আঙ্কেল, তোমার সাথে আমার জরুরী কথা আছে
হাশেম স্বন্দীহান। লানা প্রথমে ভেবে নিল। তারপর বলল
– হাশেম আঙ্কেল, কাল রাতে সোহার সাথে আবার আমার শরীর ট্রান্সফর্ম হয়েছে। আমি এখন আমার নিজের শরীরেই আছি।

দ্বিধান্বিত হাশেম, বলল
– কীভাবে মানব, তুমিই লানা?

লানা কিছুটা বিমর্ষ। সে উদাসীন গলায় বলল
– মানতে হবে না। শুধু আমি এখন যা বলব মন দিয়ে শুনবে আর মনে রাখবে। আমি তোমাকে কয়েকটা দায়িত্ব দিয়ে যাব।
– কিসের দায়িত্ব?

– জোহার, ব্লু সি বিচের মালিক, আর ওর মেয়ে মুন। আমি যদি এরপর আর না ফিরি, তাহলে ব্লু সি বিচ আর আমার সমস্ত প্রপার্টি আমি জোহারের মেয়ে মুনকে দান করে গেলাম। লিখিত ইন্সট্রাকশন আর আইনী নির্দেশনা দেয়া থাকবে। আমার উকীল সব ব্যবস্থা করবে। তুমি আমার আর সোহার ব্যাপারটা কাউকে শেয়ার করবে না। তবে কখনও নীল ফিরে এলে তাকে বুঝিয়ে বলো, হয়ত ও বুঝতে পারবে। তবে না বুঝলেও ক্ষতি নেই। আর পারলে মমকে দেখ।

হাশেমের চোখের স্বন্দেহ মুছে গেল। দ্রুত কাছাকাছি এসে হাত চেপে ধরল লানার
– ছোটমনি , এভাবে কেন বলছ? কী হয়েছে বলতো? খুব বেশী বাড়াবাড়ি কিছু? আমরা তো পুলিশের সাহায্য নিতে পারি? কেন সেধে নিজেকে ঝুঁকিতে ফেলছ বলতো?

– ওসবে আরও ক্ষতি হবে হাশেম আঙ্কেল। বিষয়টা একটা ছোট্ট শিশুর জীবন নিয়ে। বাচ্চাটার জীবননাশ হলে একজন বাবা নিঃস্ব হয়ে যাবে। আরও ভয়াবহ হল, সোহা হয়ে যাবে অপ্রতিদ্বন্দ্বী। ওর ব্ল্যাকম্যাজিক আর ডেভিল পাওয়ার বেড়ে গেলে, মানুষের ক্ষতি হবে অনেক। আমাকেই কিছু করতে হবে। হয়ত মরব নয় বাঁচব।

– আর কোন সমাধান কী নেই?
– জানিনা হাশেম আঙ্কেল। হয়ত আছে, তবে তা আমাদের কারও জানা নেই। আমার হাতে বেশী সময়ও নেই। জানিনা কি হচ্ছে নিকুঞ্জভিলায়। তবে এটুকু সময় নিশ্চই পাব জানি। কারণ, আমার উপস্থিতি ওখানে অনিবার্য, সেটা জানে সোহা। ও আমার দুর্বলতা বুঝে গেছে…

– কী সেটা?

লানা চোখ বন্ধ করল। দুটো চেহারা প্রখর হলেও মুখে একটা নামই এলো, বলল
– মুন…
হাশেম অধৈর্য্য হল, বলল
– কী দরকার বলতো, পরের মেয়ের দায় নিয়ে তুমি কেন নিজের বিপদ ডেকে আনছ? তুমি বরং ছোট সাহেবের কাছে চলে যাও। ভাইয়ের কাছে, বিদেশে গিয়ে নিরাপদ থাকবে তুমি। এদেশে একা একা করবেটাইবা কী তুমি?

– এগজ্যাক্টলি হাশেম আঙ্কেল। আমি একা একা করবেটাইবা কি? এদেশ আর বিদেশ দুটোই আমার কাছে সমান। বরং এ পৃথিবীতে যাদের প্রতি আমার একটু হলেও ভালোবাসা জন্মেছে। দায়বদ্ধতা জন্মেছে, যাদের ভালো চিন্তা করলে আমার জীবনটা সার্থক মনে হয়, তাদের একটু ভালো হোক, তারা বেঁচে থাকুক। আর সবচেয়ে বড় কথা, এসব আমার ইচ্ছের ওপর নির্ভর করে না, পৃথিবীর যেকোন জায়গায় চলে গেলেও সোহার পক্ষে আমার শরীরে ট্রান্সফর্ম করা সম্ভব।

হাশেম মেলাতে পারেনি অঙ্ক। লানা তাকে অনেক বুঝিয়ে, অনেক ভয়ভীতি দেখিয়ে বেরিয়ে গিয়েছিল বাড়ি থেকে।

জোহারের ঘুম ভেঙেছিল দুপুর গড়িয়ে। জেগে উঠতেই মাথায় একটা ভোঁতা যন্ত্রণা ছড়িয়ে পড়েছিল। শরীরটা ভীষণ অবসন্ন লাগছিল। দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকিয়ে সময়ের হিসাব মেলাতে পারছিল না সে। এখন কি বিকেল চারটা নাকি ভোর? নাকি এ ঘরের ঘড়িটাই ঠিক নেই। টপ করে উঠে বসতেই ঘুরে গেল মাথাটা। এমন লাগছে কেন তার?

মুন, লানা, ওরা কোথায়? কাল রাতে তো তারা একসাথেই ঘুমিয়েছিল এ ঘরে। লানা ইতস্তত করছিল। কিন্তু সে জানত, সে এখন মুন ও জোহারের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে গেছে। তাকে ছাড়া মুন আর জোহার যেমন অসহায়, তেমনি জোহার আর মুনই লানার একমাত্র জীবনের লক্ষ্য। তার এই অদ্ভূত জীবনটার সাথে জড়িয়ে গেছে ওরা।

জোহার আর মুনকে হালকা কিছু খাইয়ে শোবার ঘরে এসেছিল লানা। মুনের একপাশে জড়সড় হয়ে শুয়ে একটা হাত তুলে দিয়েছিল ঘুমন্ত মুনের গায়ে। সেখানে স্পর্শ পেয়েছিল জোহারের হাতের। নিজের হাতটা সরিয়ে নিতে চাইলেও বাঁধা পড়েছিল। জোহার নিজের হাতের মধ্যে টেনে নিয়েছিল লানার আঙুলগুলো। নিঃসাড় ছিল লানা। জোহার বলেছিল

– কী ঘটতে চলেছে আমাদের সাথে, আমরা জানি না লানা। জীবন কী অদ্ভূতভাবে আমাদের দেখা করিয়ে দিল। আমরা না চাইতেই একজন আরেকজনের সাথে জড়িয়ে গেলাম। সম্পর্কহীন এক বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে গেলাম। তুমি এখন আমার আর মুনের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ

– কি জানি, আমি কীভাবে কখন একটু একটু করে জড়িয়ে গেছি তোমার আর মুনের সাথে। কখনও মনে হয় আমি তোমাদের মাঝখানে পড়ে গেছি। নইলে যেমনই হোক, সোহা তো তোমার স্ত্রী।
– কীভাবে এখনও এসব বলতে পার তুমি?

একটু চুপ থাকল লানা। বলল
– মুনকে আমি কিছুতেই পিহুর পরিনতিতে যেতে দেব না।
লানার হাতে চাপ বাড়ল। জোহার নিস্তেজ গলায় বলল
– আমি জানি লানা, তুমিই পারবে মুনকে রক্ষা করতে। প্লিজ আমাদের রেখে চলে যেও না।

– অবান্তর কথা বলছ তুমি জোহার, আমি চাইলেই তোমাদের রেখে চলে যেতে পারব না। আর সে সুযোগ থাকলেও হয়ত পারতাম না

– জানি, আমি চিনেছি তোমাকে লানা।

তারপর চুপ হয়ে গিয়েছিল তারা দুজনেই। কথা ফুরিয়ে গেলেও স্পর্শটুকু থেকে গিয়েছিল। আর ওটুকুই না বলা অনেক কথা বলে যাচ্ছিল। তারা তাদের নিজেদের মনে বলে গিয়েছিল অনেক কিছু।

সকালে বেলা করে উঠে জোহার ভাবল, লানা হয়ত মুনকে নিয়ে নিচে গেছে। আর সে হয়ত সিক, কাল হয়ত শরীরে বেশ বড় ধরনের ধাক্কা খেয়েছে বলেই ঘুম হয়েছে তার অনেক্ষণ।

জোহার স্বন্তর্পনে বেরিয়ে এলো ঘর থেকে। করিডোর ধরে খানিকটা এগোতেই নিচে চিকন একটা কিক্ কিক্ শব্দ মনযোগ আকর্ষণ করল তার।

জোহার এগিয়ে এসে একটা অদ্ভূত দৃশ্য দেখল নিচে। নিচতলার ড্রয়িংরুমের মাঝখানে বেশ খানিকটা জায়গা খোলামেলা। তার মাঝখানে রকিং চেয়ারে মুনকে বুকে জড়িয়ে বসে আছে লানা। সিঁড়ি দিয়ে কয়েক ধাপ নামতেই লানার একহাতে লম্বা সরু চাকুটা দেখতে পেল জোহার। কিন্তু কেন?
জোহারের পায়ের শব্দে দুলুনি থামিয়ে চট করে তাকাল লানা। তার চোখের দৃষ্টিটা কেমন যেন লাগছে জোহারের। লানা কেমন বিপজ্জনকভাবে মুনের পাঁজরের নিচে ধরে আছে চাকুটা। কয়েক ধাপ দ্রুত নেমে এলো জোহার।
সোহার ঠোঁটে চিকন একটা হাসি ফুটে উঠল। শরীরের রক্ত হিম হয়ে গেল জোহারের। আচমকা তার মনে হল, এ লানা নয়। সোহা চলে এসেছে সোহার শরীরে। কাল এ সুতো লানা বেঁধে দিয়েছিল জোহারের গলায়। তখন তারা কেউ এ ব্যাপারটা নিয়ে একবারও ভাবেনি। কী হয়ে গেল এটা? লানা কী জোহারকে বাঁচাতে নিজেকে সেক্রিফাইস করতে চায়? নিজের বিপদ বুঝেও এ সুতো জোহারকে পরিয়ে দিয়েছিল কেন?
– সোহা….?
হাসছে সোহা। ক্রমশ ঘর কাঁপিয়ে হাসছে সে।

– সুযোগ কীভাবে না চাইতেই চলে আসে, দেখলে জোহার? আজ এমন দিনে এমন একটা সুযোগ যেচে আমার কাছে চলে আসবে আমি ভাবতেই পারিনি।

খুশিতে উচ্ছ্বোসিত সোহার গলা।
অনেকগুলো প্রশ্ন জোহারের চোখে। সে বলল
– সোহা, তুমি আমাকে মেরে ফেল, আমি কোন বাঁধা দেব না। কেবল আমার মুনকে ছেড়ে দাও। ও কী অপরাধ করেছে বল? তুমি না ওর মম? কোন মা কী পারে নিজের বাচ্চাকে মেরে ফেলতে? প্লিজ সোহা, এমন কর না আমি….আমি আজও বিশ্বাস করতে চাই, পিহুর মৃত্যুটা একটা এ্যাকসিডেন্ট ছিল। আজও তোমাকে খুনী ভাবতে দ্বিধা হয় সোহা। প্লিজ তুমি এসব কর না। আচ্ছা, এসব করে কী লাভ তোমার বল?
– লাভ? হা হা হা হা….কিচ্ছু জাননা তুমি। এ ক্ষমতা আমাদের বংশানুক্রমিক সাধনার ফল। আমার মম অর্জন করেছিল তার মমের ব্ল্যাকম্যাজিক সাধনা থেকে। আমার মম আমাকে স্যাকরিফাইস করতে পারলে তিনিই হতেন সেই অপরিমেয় শক্তির সম্রাজ্ঞী। আফসোস তিনি তা পারেননি আমার হিংসুটে মামার জন্য। ফলে আমি তার সমস্ত ক্ষমতা পেয়ে গেছি। আজ আমি আমার সন্তানকে স্যাকরিফাইস করলে আমি হব সেই সম্রাজ্ঞী। খবরদার বাঁধা দিও না। তাহলে তোমরা সবাই মরবে।
– চুপ কর, আর শুনতে পারছি না এসব। তুমি একটা শয়তান, পিশাচীনী জানলে কোনদিন তোমার সাথে জড়াতাম না আমি। রিজভি সাহেব ঠকিয়েছিলেন আমাকে। আমার সরলতার সুযোগে সমস্ত প্রপার্টি লিখে দিয়ে বিভ্রান্ত করেছিলেন আমাকে। নইলে তোমার মত একটা ডাইনীকে নিয়ে সংসার করার কথা তো আমি স্বপ্নেও ভাবতে পারি না।

ক্রুদ্ধ সোহার চোখ দিয়ে যেন আগুন ঠিকরে পড়ছে। কাছেই রাখা একটা কাচের গ্লাস তুলে আচমকা ছুড়ে মারল জোহারের দিক। তাৎক্ষনিক মাথা হেলিয়ে এড়িয়ে গেল জোহার। ঝনঝন করে গ্লাস ভাঙার শব্দে জেগে উঠল মুন। ভয়ে জড়িয়ে ধরল সোহাকে।

জোহার দুহাত বারিয়ে এবার ডাকল মুনকে
– মুন বেবি, এদিকে আসো। ড্যাডের কাছে চলে এসো বেবি….

মুন দিকভ্রান্ত। সোহা জাপটে চেপে ধরে আছে তাকে। ব্যথা পেয়ে মুন নিজেকে ছাড়িয়ে ছুটে যেতে চাইল জোহারের কাছে। সোহা তীব্র চিৎকারে শাসাল মুনকে। তার গলায় চাকু চেপে ধরে সাবধান করল জোহারকে।

– না না না, সোহা প্লিজ অমন করনা। ভয় পাবে মুন। প্লিজ চাকুটা সরাও। থাকুক ও ওখানেই। ওর ক্ষতি কর না প্লিজ

হিসহিস করল সোহা
– এখনই শেষ করে দিতে পারতাম। কিন্তু সেটা এখন করব না, তবে এক শর্তে

– কি?
– লানাকে এনে দিতে হবে আমার হাতে।

– কেন শুধু শুধু ওই মেয়েটার ক্ষতি করবে সোহা। ছেড়ে দাও ওকে। তুমি বরং আমাকে আগে মার। এসব দেখার আগে, আমি চলে যেতে চাই পৃথিবী থেকে।
– আ… হা… এত দরদ! তোকে তো শেষ করবই। তবে আগে আমার লানাকেই চাই। ওর শরীরটা একন আমার স্টেশন। আমাকে এমন একজনের শরীরে ট্রান্সফর্ম হতে হত, যার ভেতর পজিটিভ পাওয়ার অফুরন্ত। অনেক কষ্টে, অনেক খুঁজে লানার শরীরটা পেয়েছিলাম আমি। মুন কে আমি ছেড়ে দিতে পারি কেবল এই শর্তে

বিস্ময়, ভয় আর ঘৃণা খেলা করছে জোহারের চোখে মুখে। মুন তারস্বরে কাঁদছে জোহারের কাছে যাবার জন্য। সোহা তাকে ধরে রাখতে পারছে না। রাগে ফুঁসছে সে। মুনকে হঠাৎ ছেড়ে দিল সোহা। কিন্তু পরক্ষণেই মুনের মাথার চুল মুঠিতে নিয়ে নিজের দিকে ঘুরিয়ে তার চোখে চোখ রাখল। মুহূর্তে টলে পড়ে গেল মুন। তার নিস্তেজ শরীরটা পড়ে রইল সোহার পায়ের কাছে। আর্তনাদ করে উঠল জোহার। সোহা বলল

– আপাতত কিচ্ছু হয়নি মুনের। চেতনা হারিয়েছে কেবল। তবে যত সময় নেবে ততই একটু একটু করে মুন এগিয়ে যাবে মৃত্যুর দিকে। সিধ্বান্ত তোমার

সোহা একটা কৌটো খুলে মুনের চারপাশে একটা পাউডার ছিটিয়ে দিল। তারপর নিশ্চিন্তে চলে গেল কিচেনের দিকে।
কিচেনে থালাবাসনের ঠুনঠান শব্দ হচ্ছে। সোহা নিশ্চই খাবার তৈরি করছে বা খাচ্ছে।

জোহার সুযোগটা নিতে চাইল। সে একটু একটু করে এগিয়ে গেল মুনের দিকে। মুনের চারপাশে সাদা পাউডারের বৃত্ত। জোহার কাছাকাছি হতেই আচমকা পাউডারের বৃত্তে আগুন জ্বলে উঠল। ছিটকে পেছনে পড়ে গেল জোহার। তার চোখে বিস্ময় আর ভয়। কী করে রক্ষা করবে সে মুনকে?

লানা আহত, তাই বাড়ি থেকে বেরিয়েছিল গাড়ি নিয়েই। সে যাচ্ছে এখন নিকুঞ্জভিলায়। ড্রাইভ করছিল নিজেই। হঠাৎ জ্যামের মধ্যে দ্রুত ক্রাচে ভর দিয়ে একজনকে রাস্তা পার হতে দেখল সে। এক হাতে পেট চেপে ধরে আরেক হাতে ক্রাচ সামলে কষ্টে পার হচ্ছে রাস্তাটা। চারিদিকে নজর বুলিয়ে রাস্তা পার হচ্ছে ইমাদ। গত দুই সপ্তাহ যাবৎ লানা ফোনে ট্রাই করছে ইমাদকে। ফোন আনরিচএবল বলছে। ওর বাড়িতেও খোঁজ নিয়ে জেনেছে, কেউ নেই বাড়িতে। হঠাৎ নেই মানেই স্বন্দেহ জাগিয়েছিল মনে অন্য কিছু। সোহা কি তবে ইমাদকেও…?

লানা কোনমতে গাড়িটা পার্ক করে বের হল। পেছন থেকে ডাকল নাম ধরে। ইমাদ পেছনে একবার তাকিয়ে যেন ভূত দেখল। তড়িঘড়ি, খুব বিপজ্জনকভাবে পার হল রাস্তাটা। তারপর দিক্বিদিক ছুটতে লাগল। লানার কেন যেন মনে হল, ইমাদ দৌঁড়াতে পারছে না ঠিকঠাক। সে খোঁড়াচ্ছে। ইমাদ আসলে লুকাতে চাইছে কোথাও। এগলি ওগলি ছুটে সে হাঁপিয়েও গেছে। এখন সন্ধ্যা হয় হয়। অন্ধকার মত একটা গলিতে একটা দেয়ালে হেলান দিয়ে দম নিচ্ছিল ইমাদ। তার চোখ বন্ধ, বুকে নিশ্বাসের হুড়োহুড়ি। কিন্তু ঠিক চোখ খুলেই সে দেখতে পেল মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে লানা।

আতঙ্কে আর্ত চিৎকার বেরিয়ে এলো ইমাদের গলা থেকে। সে হরবড় করে বলতে লাগল

– প্লিজ সোহা, প্লিজ মের না আমাকে। আমি কাউকে কিছু বলব না। প্লিজ ছেড়ে দাও আমায়… প্লিজ…প্লিজ….

– ইমাদ, আমি লানা। কি হয়েছে তোমার সাথে? এমন করছ কেন?
ইমাদ স্বন্দীহান চোখে তাকিয়ে বলল
– প্লিজ প্লিজ সোহা, আমিতো কোন দোষ করিনি, আমাকে কেন মারছ?

লানা এবার স্পষ্টচোখে তাকিয়ে ইমাদের ফোনের পাসওয়ার্ডটা বলল।
ইমাদ চোখ বন্ধ করে নিশ্বাস ছাড়ল জোরে। বলল
– লানা, কোথায় ছিলে এতগুলোদিন?
– কি হয়েছিল ইমাদ…?
ইমাদ ঢোক গিলল। সে লানার ব্যাপারে সেবার সোহার কাছে নিজের যে যে দূরভিসন্ধির কথা বলেছিল, তার যথেষ্ট শিক্ষা সে পেয়েছে। মনে মনে সে কারণে অনুতপ্ত সে। লানার প্রপার্টিতে লোভ ছিল বটে ইমাদের। তবে সোহার কাছ থেকে এমন একটা শিক্ষা পেয়ে কিছুটা আত্মোপলব্ধি এসেছে ইমাদের। লানা যে তাকে বন্ধুত্বের জায়গাটা দিয়েছে, তার মর্যাদা রাখতে পারেনি সে। ভীষণ অনুতপ্ত সে। বলল

– আই’ম সরি লানা। পারলে আমাকে ক্ষমা করে দিও।
– কি ব্যাপারে
– বলব পরে। তবে তার আগে তোমাকে কিছু দেবার আছে। তোমাকে আমার সাথে আমার বাড়ি যেতে হবে, চল
ইমাদের বাড়ি কাছেই, তবু লানা বলল
– এখন আর কিছু নেবার নেই ইমাদ। আমাকে যেতে হবে। তোমার সাথে যদি আবার কখনও দেখা হয়, সেদিন না হয়…

ইমাদ থমকে গেল। বলল
– সে তোমার ইচ্ছে। কয়েকদিন আগে আমার এ্যাড্রেসে ইউ এস থেকে একটা পার্সেল এসেছে। পার্সেলে সেন্ডার অপশনে রিজভি নামের একজনার নাম দেখে মনে হল, পার্সেলটা সম্ভবত তোমার। তবে এমন একটা পার্সেল আমার এ্যাড্রেসে কেন আসবে ভাবছি। আমার কেয়ারটেকার রিসিভ করে রেখে দিয়েছে। সোহা আমার ওপর মার্ডার এটেম্পট করার পর আমি আর যাইনি ও বাড়িতে।

চমকে উঠল লানা। মনে পড়ে গেল, আসার আগে সে রিজভিকে ইমাদের মেইলিং এ্যাড্রেসটা দিয়ে এসেছিল। যদি কখনও তেমন প্রয়োজন পড়ে। কারণ নীলকুঞ্জ বা লানার বাড়ির ঠিকানা, কোনটাই সোহার কারণে নিরাপদ নয়। কিন্তু রিজভি হঠাৎ পার্সেলে কি এমন পাঠাল? চাইলে তো সে ইমেইল করতে পারত।

হাতে সময়ও বেশি নেই। তাকে যেতে হবে নীলকুঞ্জ। যত তারাতারি সম্ভব। তবু কি এমন পাঠাল রিজভি, তা দেখার কৌতূহলও দমাতে পারল না লানা। ইমাদকে গাড়িতে উঠিয়ে তার বাড়ির দিকে রওয়ানা হল লানা।
পথে সোহা, ইমাদকে কীভাবে মারতে চেয়েছিল, সেই ঘটনাটা খুলে বলল ইমাদ। শিউরে উঠল লানা। ইমাদকে চাকু মেরে ফেলে রেখে যাবার কিছুক্ষণপর জ্ঞান ফিরেছিল ইমাদের। অনেক কষ্টে পরিচিত একটা ক্লিনিকে কনটাক করতে পেরেছিল সে।

পার্সেল খুলে লানা একটা চিঠি আর একটা লকেট ওয়ালা চেইন পেল। লকেটটা একটা গোলাকার চ্যাপ্টা, মোটা কাঁচের তৈরি। তবে গোলকটা দিয়ে যেন আগুন ঠিকরে বের হচ্ছিল। অথচ জিনিসটা ঠান্ডা বরফের মত।
লানা জিনিসগুলো পুরে নিল পকেটে। তারপর ইমাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে এলো বাইরে। রাত হয়েছে বেশ। লানা এখন নীলকুঞ্জ যাবে কিনা ভাবছে। কিন্তু যত দেরীই হোক। সোহার মুখোমুখি তো আজ তাকে হতেই হবে।

গাড়িটা নীলকুঞ্জের বেশ খানিকটা দূরে একটু নিরিবিলিতে পার্ক করল লানা। নিজেকে তেরি করে বেরিয়ে এলো গাড়ি থেকে। গেটে কোন লোক নেই, একটু ঠেলতেই খুলে গেল। বাড়ির ভেতর আলো জ্বলছে। তবে বাগানের পথটা অন্ধকার। দোতলার একটা ঘরেও আলো দেখা যাচ্ছে। উপরের খোলা বারান্দার দিকে তাকিয়ে থাকল লানা কিছুটা সময়।

সদর দরজাটা খোলা। ভেতরে উঁকি দিয়েও সরে এলো লানা। ভেতরে সে অদ্ভূত কিছু দেখতে পাচ্ছে। ড্রয়িংরুমের মেঝেতে গোলাকৃতি ঘেরাও একটা জায়গায় আগুন জ্বলছে। বেশ কিছুটা জায়গা জুড়ে ছড়িয়ে আছে আগুন। বাড়ছেও না কমছেও না। খুব কড়া একটা ঝাঁঝাল গন্ধ। জোহার, মুন, সোহা এদের কাউকেই দেখা যাচ্ছে না কোথাও। লানা কি ঢুকবে ভেতরে? সব কিছু শেষ হয়ে যায়নি তো?

লানা স্বন্তর্পনে ঢুকল ভেতরে। দরজাটা ভেজিয়ে ঘরের চারিদিকে চোখ বোলাল। কোথাও কেউ নেই। উপরের করিডোরটাও ফাঁকা। লানা কি ডাক দেবে জোহারকে?

বুকটা কাঁপছে, সে কী খুব দেরী করে ফেলল?

সিঁড়িতে পা দিতেই করিডোরে দেখা গেল জোহারকে। দু’ এক পা এগিয়ে এসে বলল
– তুমি এসেছ লানা? খুব দুশ্চিন্তা হচ্ছিল তোমায় নিয়ে। আমিতো বুঝতেই পারিনি তুমি চলে গেছ। উপরে এসো…

লানা থমকে গিয়ে জানতে চাইল, সোহা কোথায়? আর মুন? তোমার গলার সুতোটা কোথায় জোহার?

জোহার বলল
– আছে, ভয় নেই। ওইতো… ওঘরে মুন। এসো উঠে এসো…

লানা দ্রুত উঠে এলো। জোহারের হাতদুটো চেপে ধরে বলল, জোহার, মুনের কিছু হয়নিতো? সোহা কি চলে গেছে? তোমরা ঠিক আছ তো?

– আমরা একদম ঠিক আছি লানা। ওইতো দেখো, মুন ওঘরেই আছে।

লানা জোহারের হাত ছেড়ে মুনের ঘরের দিকে চলে গেল। ঘরে ঢুকে স্তম্ভিত লানা। কয়েক মিনিট লাগল পরিস্থিতি বুঝতে।

একটা লম্বা চাকু মুনের গলায় ধরে দাঁড়িয়ে আছে সোহা। লানা তখন ঘরের মাঝ বরাবর। সোহা মুনকে এক ধাক্কায় দরজার দিকে ঠেলে দিয়ে তাৎক্ষণিক লানার হাতদুটো পিছমোড়া করে, তার গলায় চেপে ধরল চাকুটা।
ঘটনার আকস্মিকতায় লানা কোন প্রতিরোধের সুযোগ পেল না।

মুনকে তড়িতে কেড়ে নিল জোহার। কাতর চোখে লানার দিকে তাকিয়ে শুধু বলল
– আই’ম সরি লানা। আমি নিরুপায়…

( চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here