চোরাবালি পর্ব ২

0
420

#চোরাবালি_২
রেশমা আক্তার

লানা দরজা খুলে বাইরে তাকাল। সেখানে তার জন্য অপেক্ষা করছে চরম বিস্ময়। কয়েক ধাপ সিঁড়ির নিচে খোলা অনেকটা জায়গা। বিশাল হল রুমের মত ঘর। একদিকে ড্রইং একদিকে ওপেন কিচেন কাম ডাইনিং। মাঝখানে কার্পেটের ওপর অজস্র খেলনার মাঝে বসে তারস্বরে কেঁদে চলেছে একটি এক, দেড় বছরের মেয়ে বাচ্চা। পুতুলের মত দেখতে। মাথাভর্তি ঝাকড়া চুল। বাদামি চোখ। লানার মনে হল সে বাচ্চাটিকে আগেও কোথাও দেখেছে বা তার চেনা। লানাকে দেখে বাচ্চাটি দু’ হাত বাড়িয়ে এগিয়ে আসছে তার দিকে।

লানা শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এমন সময় কিচেনের আড়াল থেকে বেরিয়ে এলো সুদর্শন এক ভদ্রলোক। পরনে গ্যাবার্ডিন আর নীল রঙের একটা ক্যাজুয়াল টিশার্ট। কে যেন বলেছিল, স্বপ্নে কোন জিনিসের রং দেখা যায় না। কিন্তু লানা তো সবকিছুর রং দেখতে পাচ্ছে।
লোকটি কিছুটা হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছে তার দিকে। লানাও চরম বিস্ময়ে তাকিয়ে আছে লোকটার দিকে।

বাচ্চাটি কাঁদছে, এলোমেলো পায়ে এগিয়ে আসছে লানার দিকে। সিঁড়ির গোড়ায় এসে থমকে দাঁড়িয়ে হাত উঁচিয়ে দিয়েছে। তার আশা, লানা তাকে তুলে নেবে। আহারে বাচ্চা…

লোকটা বাচ্চাটাকে তুলে নিয়ে সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠছে। লানার কাছাকাছি এসে বেদনার্ত গলায় বলল
– কেমন মা তুমি সোহা, বাচ্চাটা এত কাঁদছে, তোমার হুঁশ নেই?

লোকটা বাচ্চাকে এবার লানার কোলে হস্তান্তর করল। নিতান্ত অনিচ্ছায় অপ্রস্তুত হাতে লানা বাচ্চাটা নিল।
দীর্ঘশ্বাস ফেলল লোকটা। বলল
– আজ ক’তারিখ খেয়াল আছে তোমার? আজ মার্চের আঠারো তারিখ। আজ ডক্টর পার্থ আসবেন আমাদের এখানে। তোমার সাথে একটা কাউন্সিলিং সেশন আছে, মনে আছে?

কপাল কুচকে আছে লানার। সে কি বলবে যে, সে আসলে সোহা নয়। সে আসলে লানা। যদিও তার চেহারা বদলে গেছে। লোকটা তাকে সোহার মত দেখে সোহা ভাবছে। আর ভাবছে এই বাচ্চাটার মা সে। আচ্ছা এই লোকটা কি এই বাচ্চাটার বাবা? তার মানে তো সোহা লোকটার স্ত্রী।
এসব কি ঘটছে? আচ্ছা যাই ঘটুক এসবতো সত্যি নয়। এটা নিতান্ত একটা স্বপ্ন। একটু পরই লানার ঘুম ভাঙবে এবং লানা তার নিজের জায়গায় খুঁজে পাবে নিজেকে।

বাচ্চাটা লানার বুকে মুখ ঘষছে। লোকটা বলল
– মুনকে একটু ফিডিং করে তাড়াতাড়ি নিচে এসো। আমি ব্রেকফাস্ট রেডি করছি।

লোকটা নেমে গেলো। লানা অগত্যা আবার ঘরে ঢুকল। বাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে সে আবার এসে দাঁড়াল আয়নার সামনে। এই বাদামী চোখের, ফর্সা মেয়েটা আসলে সে নয়। সে লানা, শ্যাম বর্ণের হালকা পাতলা একটা তেইশ বছরের তরুণী।
সোহার বয়স সাতাশ বা আটাশ হতে পারে। সে মুন নামের একটা বাচ্চার মা। তার শরীরে মাতৃত্বজনিত হালকা মেদ। লানা নিজের বুকের দিকে তাকাল। মুন খুব সহজেই নিজের খাবার খুঁজে নিয়েছে। অতি আশ্চর্যকথা হল, লানা কেমন অভ্যস্ত বোধ করছে। লানা নিজেকে আস্বস্ত করল, এটা স্বপ্ন আর স্বপ্নে যা খুশি তাই হতে পারে। স্বপ্ন কারো ইচ্ছেমত হয় না সুতরাং লানার এখানে কিছুই করার নেই।

ভীষণ কান্না পাচ্ছে লানার। ইচ্ছে করছে বাচ্চাটাকে ছুড়ে ফেলে দিতে। উহ, এই অসহনীয়, বাজে স্বপ্নটা শেষ হচ্ছে না কেন?
মুনের একটা হাত লানার গাল স্পর্শ করে আছে। ইচ্ছে করলেও কেন যেন ছুড়ে ফেলতে পারছে না সে বাচ্চাটাকে।

সুতরাং, লানা ধৈর্য্য ধরল। সে মুনকে নিয়ে বসল বিছানার এক কোণে। স্বপ্নের মধ্যে সে এখন এই বাচ্চার মা । সুতরাং কি হচ্ছে হোক। স্বপ্নে তো কতরকম অদ্ভুত ঘটনাই ঘটে। ঘরে একটা দেয়াল ঘড়ি আছে, কিন্তু কোন ক্যালেন্ডার নেই। আজ আঠারই মার্চ? কিন্তু রাইসুলের পার্টি তো ছিল ফার্স্ট আগস্ট। লানা আবারও নিশ্চিন্তবোধ করল যে, এটা বাস্তবতা নয়। স্বপ্নে দিনক্ষণের ঠিক থাকে না।

বাচ্চাটা ঘুমিয়ে পড়েছে। লানারও কেন যেন ঘুমে জড়িয়ে যাচ্ছে চোখ। লোকটা তো বলল সে ব্রেকফাস্ট বানাচ্ছে। লানাকে যেতে হবে নিচে।

লানা মুনকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে নিজেও শুয়ে পড়ল পাশে। যেন গভীর স্রোতে ভেসে যাচ্ছে তার শরীর। ডুবে যাচ্ছে তার সমস্ত চেতনা। ভীষণ ক্লান্ত লাগছে, প্রচণ্ড ঘুমে আচ্ছন্ন হল সে।

তীব্র একটা ব্রেক কষল নীল। পেছনে ইমাদ লাফিয়ে উঠে আঘাত পেল মাথায়। সামনে একটা মালবাহী ট্রাক হঠাৎ স্পিড কমানোয় পেছনের গাড়িগুলো হুমড়ি খেয়ে পড়ল। দু একটা গাড়ি অল্পের জন্য মারাত্মক দুর্ঘটনা থেকে বেঁচে গেল। নীল নেমে গেল পেছনের ক্ষতি কি হল দেখতে। তন্দ্রা ভেঙেছে লানারও। প্রথমে সে তাকিয়ে থাকল কিছুক্ষণ ফ্যালফ্যাল করে। তারপর নিজের অবস্থানটা বুঝে নিয়ে তাকাল চারপাশে। ইমাদ জানালার কাচ নামিয়ে নিজের মনে বকে যাচ্ছে কাকে যেন। সে মাথায় হাত ঘষছে। সবচেয়ে আশ্চর্যজনক কথা হল, লানা এখন বসেছে ইমাদের সাথে, পেছনের আসনে।
লানাকে জেগে থাকতে দেখে ইমাদ বলল
– ওহ, তুমি জেগে গেছো? আ’ম সো সরি লানা…
এতক্ষণ নীল ছিল, তাই তোমাকে সরি বলতে পারিনি। তারপর আবার দেখলাম কথা বলতে বলতে তুমি ঢুলছ, তাই আর বলা হয়নি। ভাবলাম একটু ঘুমিয়ে উঠলে বলব

লানা কপাল কুচকালো। যদিও তার মনে অসংখ্য প্রশ্ন
– কেন?
– আমার বোকামীর জন্য তোমাকে আজ অনেক কথা শুনতে হল। কি করব বল, তোমাকে না পেয়ে নীল কাল পাগলের মত হয়ে গিয়েছিল। একে ধরে, ওকে জিজ্ঞেস করে। শেষমেশ তো পুলিশ কল করার কথাও ভাবছিল। অগত্যা আমি বলেই ফেললাম।
– কি বললে?
– বলেছি, তুমি সামান্য ড্রিংক করেছ, আমার সাথে। তারপর একটু সিক ফিল করায় রেস্ট নিচ্ছ।
– নীল কী বলেছিল?
– নীলতো প্রথমে আমার সাথে রাগারাগি। আমি বলি, আরে জলে নেমে চুল ভেজাবো না, তাকি হয়? পার্টিতে এসে একটু আধটু গলা তো ভেজাতেই হবে। তাছাড়া নীল রাগ দেখাবে কেন, যেখানে আমি ছিলাম তোমার সাথে।
– তারপর?
– তারপর আর কি, সে গিয়ে নক করল তোমার ঘরে। তুমি তো বেহুঁশ। নীল পারলে দরজা ভেঙে ফেলে। চাবি দিয়ে লক খোলার চেষ্টা করে। কিন্তু তুমি তো বুঝি ভেতরে ছিটকিনি তুলে দিয়েছিলে। তারপর আমি অনেক করে বোঝালাম যে, তুমি ভালো আছ, ঘুমাচ্ছ। আমরা ছিলাম একসাথে। সারারাত দুশ্চিন্তায় ছটফট করেছে নীল ।
– তারপর?
– তারপর আর কি? সকালে আমিইতো তোমাকে দেখে অবাক। সত্যিই তোমাকে এত উৎফুল্ল, এত হাসিখুশি এর আগে আমি কোনদিনও দেখিনি। এমনকি নীলও অবাক। যদিও বকাঝকা করেছে অনেক…আর সে কারণেই আমি তোমার কাছে সরি..

লানা চিন্তিত মুখে ঘুরে বসল সামনে। মনে করার চেষ্টা করল খুব। আজ সকালে ঘুম থেকে উঠে তার রিসর্টের সেই রুমেই নিজেকে দেখার কথা। গতকাল রাতে সে ঘুমিয়ে পড়ল, স্বপ্ন দেখল, আর তারপর সরাসরি সে গাড়িতে জেগে উঠল। ব্যাপারটায় অনেক কিছু মিসিং। সকালে জেগে উঠে সে কি করেছে, কি বলেছে এবং এতদূর গাড়িতে আসতে আসতে কি হয়েছে কিছুইতো মনে নেই। তার মেমরি কি এতটাই ডাম্ব হয়ে গেছে। এটা ওই ড্রাগের জন্য হচ্ছে নাতো?

নীল উঠে এসে গাড়ি স্টার্ট করল। সামনে অনেকটা পথ এখন ক্লিয়ার। লানা চোখ বন্ধ করে থাকল সারাটা পথ। ইমাদকে বেশ বিগলিত লাগল । মনে হল, কাল লানাকে একটু সহযোগিতা করে বেশ সহজ হয়ে গেছে। আর আজ সকালে লানা নিজে কি বলেছে, কেমন আচরণ করেছে, কেনইবা যেচে ইমাদের সাথে গাড়ির পেছনে বসেছে তাতো অজানাই রয়ে গেল।

এমনিতে শুধু ইমাদ কেন, লানা কোন ছেলেকেই ঘেষতে দেয় না ধারে কাছে। কলেজ জীবনের একটা ছোট্ট ঘটনা কষ্টের দাগ এঁকে দিয়েছিল তার মনে। প্রথম ভালোবাসার নরম পলিতে বিষবৃক্ষের চারা রোপণ করেছিল সে নিজ হাতে। কালে কালে সে চারা বিশাল বৃক্ষে পরিণত হয়েছিল। কিন্তু প্রতারণা করেছিল প্রিয় মানুষটি। অন্য কাউকে ভালোবেসে পারি জমিয়েছিল বিদেশে। লানা তীব্র কষ্ট, যন্ত্রণা পেয়েছিল যতটুকু, তার চাইতে অনেক বেশী অপমানিত হয়েছিল। নিজেকে শেষ করে দেওয়াটাও ছিল বিশাল পরাজয়। তাই সব ভুলে থাকতেই বেছে নিয়েছিল নেশাকে।

গাড়িটা থামল বাগান পেরিয়ে, বাড়ির ভেতরে। লানা নামল। ইমাদ কাছে এসে সহজ হাসল। বলল,
– আজ তাহলে বিদায়। খুব শীঘ্রই আমাদের দেখা হচ্ছে তাহলে..?

লানার কপালে ভাজ পড়ল। শেষের কথাটা বলে ইমাদ কেমন লাজুক হাসছে। এসবের মানে কি?
লানা কি ইমাদকে কোন প্রশ্রয় দিয়ে ফেলেছে? কিংবা বলেছে, আবার খুব শীঘ্রই তাদের দেখা হবে? উফ, একটুও মনে পড়ছে না কেন…?

লানা কোন জবাব না দিয়ে অপ্রস্তুত হাসল। তারপর সোজা বাড়ির ভেতরে ঢুকে গেল। নীল আর ইমাদ কতক্ষণ দাঁড়িয়ে কথা বলেছে জানে না সে।

নিজের ঘরে এসে ফ্রেশ হল লানা। জেসিকে কফি দিতে বলে চিৎ হয়ে শুয়ে পড়ল বিছানায়।ছোট্ট ডোনা এসে ঝাঁপিয়ে পড়ল বুকে। লানা ডোনাকে বুকে চেপে আদর করল খানিক। তারপর পাশে জড়িয়ে ধরে চোখ বন্ধ করতেই ভেসে উঠল ছোট্ট একটা মেয়ের মুখ… মুন!

কি অদ্ভূত ছিল স্বপ্নটা। কিন্তু প্রতিটা অনুভূতি ছিল প্রখর।
লানার হঠাৎ মনে পড়ল, সে মুনকে আগেও স্বপ্নে দেখেছে। ওই যে ভয়ঙ্কর স্বপ্নটা, বাথটাবে দুটো হাত…বাচ্চাটাকে চেপে ধরছে পানির মধ্যে। ফর্সা, সুন্দর দুটি হাত…
লানা লাফ দিয়ে উঠে বসল বিছানায়। বড় বড় চোখে পর্যবেক্ষণ করল নিজের হাতদুটো। কই, এতো তেমন দেখতে নয়। স্বপ্নে মনে হয়েছিল, লানা নিজেই চেপে ধরেছে বাচ্চাটিকে। অথচ লানার হাতদুটি শুকনো, শ্যামবর্ণের।

লানা কি স্বপ্ন নিয়ে একটু বেশিই ঘাটাঘাটি করছে? লানাকে ব্যস্ত হতে হবে। ভার্সিটির নতুন প্রজেক্ট নিয়ে কাজ করা যেতে পারে। বন্ধু বান্ধবের সাথে ফোনকল করে সবাইকে একত্র করে একদিন বসে আলোচনা করা যেতে পারে। একটা চমৎকার আড্ডাও হবে। সমস্যা হল আজকাল নীলকে তার সমস্ত কাজের জবাবদিহি করতে হয়।
লানা যখন রিহ্যাবে, তখন ফিরে এসেছিল নীল। একমাত্র বোনের দুঃস্বময়ে থাকতে পারেনি দূরে। নীলকে নিয়ে শৈশবে লানার স্মৃতি বড্ড কম। তবে নীলের অনেক স্মৃতি আছে। নীল চৌদ্দ বছরের, যখন লানার সাত। মম্, ড্যাড তেমন সময় দিতে পারত না তাদের। মম্ আর ড্যাড তখন তাদের পৈত্রিক ব্যবসার পুরোদস্তুর ব্যবসায়ী। ঘটনাক্রমে, ব্যবসায় তাদের দুজনার সমান শেয়ার থাকায় দুজনেই চেয়েছিল দখলদারিত্ব কায়েম করতে । আর সেটা করতে গিয়ে একটা বিশাল ফাটল দেখা দিয়েছিল সম্পর্কে। তবে শেষ পর্যন্ত ওই বিজনেসটাই অবশ্য তাদের মধ্যকার অনিবার্য ডিভোর্সটা আটকে দিয়েছিল। সম্পর্ক ভাঙলে বিশাল বিজনেস ইন্ডাস্ট্রির ভাঙনটাও ছিল অবশ্যম্ভাবী। সুতরাং বিজনেসের স্বর্থে তাদের সম্পর্কটা টিকে গিয়েছিল।
লানা শুনেছিল, ইদানিং মমের কোন একটা সিদ্ধান্তে কোম্পানীর একটা বিশাল লোকসান হয়ে গেছে। মম্ মেন্টালি অনেক আপসেট। তবে লানা জানে, ভেঙে পড়বে না সে। এই যে মম্ আর ড্যাডের মধ্যে কাল ঝগড়া হল, ড্যাড রাতের ফ্লাইটেই চলে গেলেন ব্যাংকক। মম্ কে না বলে তারা চলে গেল পার্টিতে। আজ ফিরে এসেও খোঁজ নেয়া হল না। তার কী একটু দেখা করা উচিৎ ছিল মমের সাথে? একটু সমবেদনা জানানো..? তবে তার মমইতো তাকে শিখিয়েছে যে, যেকোন পরিস্থিতিতে মনটা শক্ত রাখতে হয়।

লানা যখন সাত বছরের। তার ভীষণ জ্বর আর গলা ব্যাথা হল। মমের একটা ফ্যাশন ফেয়ার ছিল সিঙ্গাপুরে। লানা মমের হাত ধরে ছিল শক্ত করে। মমের ফ্লাইটের সময় হয়ে যাচ্ছিল। তার পরিচারিকা জোর করে লানার হাতটা ছাড়িয়ে নিয়েছিল। মম যেতে যেতে দূরে দাঁড়িয়ে মিষ্টি হেসে বলেছিল

– ডোন্ট ওরি সুইটহার্ট… ইউ’ল গেট ওয়েল সুন। বিপদে মনটাকে শক্ত করতে হবে বুঝলে….? লক্ষী মেয়ে একটা…

মমের সাথে পরিচারিকার চোখে চোখে কথা হল কিছু। তারপর মম্ বেরিয়ে গেল। সে রাতে লানাকে নার্সিংহোমে ভর্তি করতে হয়েছিল।
লানার খুব ইচ্ছে করেছিল মমের হাতটা ধরে শুয়ে থাকতে। খুব মিস করেছিল সে মম্ কে। কিন্তু সে রাতে সারাক্ষণ নীল ছিল বোনের পাশে। নিজের শৈশবের একাকীত্ব দিয়ে নীল হয়তো বুঝে নিয়েছিল লানার কষ্টটা। তার ড্যাড আর মম্ অফিস, বিজনেস, বিদেশ ট্যুর এসবের মধ্যে হারিয়ে গিয়ে এভাবেই লানাকে শক্ত মনের, লক্ষী মেয়ে হতে সাহায্য করেছিল।

লানা কখন ঘুমিয়ে পড়েছে মনে নেই। তার ঘুম ভাঙল কারো তুড়ির আওয়াজে। চোখ খুলে দেখল, সে শুয়ে আছে একটা লম্বা ডিভানে। তার শিয়রে সুদর্শন এক ভদ্রলোক। পাশে চেয়ারে বসা ষাটোর্ধ এক ভারিক্কি চেহারার লোক। তার মুখটা হাসিহাসি। চশমার কাচের ওপর দিয়ে তিনি তাকিয়ে বললেন
– আর ইউ ফিলিং ওকে ডিয়ার..?

লানা বিস্ময়ে উঠে বসতে বসতে তাকাল চারিদিকে। চারিদিকে বিশাল বিশাল বুকসেল্ফ। আর মাঝখানে খোলা জায়গা। এক দিকে এই লম্বা ডিভানটা আর ঘরের মাঝখানে একটা গোল টেবিল।
লানা পায়ের দিকে দাড়াঁনো লোকটাকে ভালো করে তাকিয়ে দেখল, এতো মুনের বাবা, সেই ভদ্রলোক।
– আজ তাহলে আমি চলি জোহার। শি ইজ নাউ মাচ বেটার দ্যান বিফোর..
ডক্টর পার্থ উঠে দাঁড়িয়ে জোহারের সাথে হ্যান্ডশেক করল। জোহার সম্ভবত এগিয়ে দিতে গেল তাকে।

লানা নিজেকে দেখল খুটিয়ে খুটিয়ে। একটা ঢোলা প্যান্টের ওপর সাদা টপস্ পরনে তার। সেকি তবে আবার চলে এসেছে স্বপ্নদৃশ্যে? আচ্ছা, একই স্বপ্ন কি মানুষ বার বার দেখতে পারে? আবার স্বপ্নের মধ্যে থেকেও কি সে বুঝতে পারে যে, সে স্বপ্ন দেখছে?

ভদ্রলোকের নাম জোহার আর ইনিই কী সেই ডক্টর পার্থ? যার কথা সকালে বলেছিল মুনের বাবা অর্থাৎ জোহার? আজ আঠারই মার্চ, ডক্টরের সাথে কি যেন একটা সেশন…?

লানার চোখ আটকে গেল দেয়ালের ডিজিটাল ক্লকটাতে। ঘড়ির নিচে আজকের ডেট দেখা যাচ্ছে। এখন বাজে বেলা দু’টা বেজে দশ মিনিট এবং থার্ড মে, দুই হাজার উনিশ।

লানা তারিখটার দিকে বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকল। এতটা স্পষ্ট চিন্তা ও দেখা বিষয়বস্তু। এতটা গোছানো সবকিছু, অথচ স্বপ্ন। লানা মনে করতে পারছে ভার্সিটিতে তাদের একটা প্রোজেক্ট জমা দিতে হবে আগামী সপ্তাহে। ক্লাসে স্যার বোর্ডে বড় বড় করে লিখে দিয়েছিল প্রজেক্ট জমা দেয়ার লাস্ট ডেট, উনিশ, আট, দু’ হাজার বাইশ তারিখ। তারমানে স্বপ্ন দৃশ্যে সে পিছিয়ে আছে দু’ হাজার উনিশে। সবচেয়ে বড় কথা লানা সকালে শুনেছিল আজ আঠারই মার্চ, ডক্টর পার্থর সাথে কাউন্সিলিং। অথচ একই দিনে আবার দেখছে আজ থার্ড মে, লারার কেমন হাসি পাচ্ছে।

দরজা খোলার শব্দ এলো। জোহার ঢুকলো ভেতরে। লানা তাকিয়ে আছে তার দিকে। অপূর্ব সুদর্শন এক পুরুষ। জোহার নিঃশ্বব্দে এগিয়ে এসে দাঁড়াল সামনে, গভীর চোখে তাকাল লানার দিকে তারপর লানাকে কিছু বুঝতে না দিয়েই আচমকা জড়িয়ে ধরল তাকে। বলল

– আজ কি যে ভালো লাগছে আমার, সোহা। ডক্টর পার্থ বলেছেন, তুমি এখন আগের চেয়ে অনেকটা বেটার।

লানা কেমন দিশেহারা বোধ করছে। সে দু’ হাতে জোর করে ছাড়িয়ে নেয়ার চেষ্টা করল নিজেকে। জোহার আলগা করল হাতের বাঁধন, কিন্তু ছাড়ল না। লানার কোমর জড়িয়ে, গাঢ় গলায় বলল

– কতদিন তোমাকে কাছে পাইনি বলতো?

লানা বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল জোহারের চোখের দিকে। কি অদ্ভুত চোরাবালির মত দুটি চোখ। লানা কিছুতেই চোখ ফেরাতে পারছে না নিজের।

জোহারের চোখ দুটো নিবিষ্ট হল যেন লানার মুখাবয়বে। ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে অনিবার্য চুম্বনে। পাশের ঘর থেকে বাচ্চার কান্না ভেসে এলো ঠিক এমন সময়ে। লানা ছিটকে গেল। জোহারও অপ্রস্তত, ছেড়ে দিল তাকে। থরথর করে কাঁপছে লানা। জোহার হেসে ফেলল, বলল

– বেবি উঠে গেছে। তুমি গিয়ে ওকে ঘুম পাড়িয়ে দাও। আমি এখানে, স্টাডিতেই অপেক্ষা করছি তোমার জন্য।
কি নিবিড় আকুতি ঝরে পরছে জোহারের চোখে মুখে। লানা যেন বিদ্যুৎস্পৃষ্ট। তার গলাটা শুকিয়ে কাঠ। বুকের ভেতর তীব্র আতঙ্ক আর ভয়ের কাঁপুনি। কিসের ভয় জানে না লানা। সে দ্রুত বের হতে চাইলো। থামিয়ে দিল জোহার, বলল
– ওদিকে কোথায় যাচ্ছ? বেবির ঘরতো এইদিকে।
হাত ইশারায় জোহার বা দিকে ইঙ্গিত করল। লানা দেখল বা’দিকেও একটা বন্ধ দরজা। সে এক মুহূর্ত দেরী না করে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে।

বাচ্চার কান্নার স্বর অনুসরণ করে লানা আরেকটা ঘরে গিয়ে পৌঁছল। এই ঘরটা আগের দিনের মত নয়। এটা বেশ প্রশস্ত একটা সাজানো গোছানো বেডরুম। বেবি মানে মুন নামের বাচ্চাটা তাকে দেখে কাঁদতে কাঁদতেই হাসছে এখন। লানা এগোচ্ছে ধীর পায়ে। পাশেই জানালার কাচে লানা দেখতে পেল নিজেকে। বাদামী চোখের, ছোট চুলের সেই মেয়েটি। যার নাম সোহা। মুন মাম….ম্মাম….মাম…শব্দে হাত বাড়িয়ে আছে বিছানায়। লানা কাছে গেল তার। তাকে কি এখন বেবি ফিডিং করাতে হবে?
তা হোক। লানা দ্রুত মুনের পাশে গিয়ে শুয়ে পড়ল। তাকে যে করেই হোক ঘুমিয়ে পড়তে হবে। এই অসহ্য স্বপ্ন থেকে জেগে উঠতে হবে তাকে, দ্রুত।

পাশের একটা ঘরে একজন স্বামী অপেক্ষা করছে তার স্ত্রীর জন্য। লানা তার স্ত্রী নয়। যে করে হোক লানাকে বাস্তবে ফিরতে হবে। তার শরীরে এখনও ঝিমঝিম অস্বস্তি, একজন অজানা পুরুষের স্পর্শে। লানা যে করেই হোক ফিরতে চায়।
চোখ জড়িয়ে আসছে লানার। তীব্র ঘুম আচ্ছন্ন করছে তাকে। সে ঘুমাতে চায়। তার কেন যেন মনে হচ্ছে, একমাত্র ঘুমই তাকে এই দুঃস্বপ্ন থেকে জাগিয়ে তুলতে পারে।

ঘুম ভাঙল জেসির ডাকে।
লানা নিজেকে আবিষ্কার করল তার বেডরুম লাগোয়া খোলা বারান্দায়, রকিং চেয়ারে। কোলের ওপর ডোনা ঘুমাচ্ছে। জেসি ট্রে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বলল
– ম্যাম নিচে আপনার দুজন বন্ধু এসেছে। তাদেরকে বসতে দেয়া হয়েছে।
লানা কোল থেকে ডোনাকে নামিয়ে দিল নিচে। জেসির হাতে ট্রে। লানার মনে পড়ল সে জেসির কাছে কফি চেয়েছিল। জেসি জিজ্ঞেস করল
– ম্যাম আপনার কফিতো এখনও শেষ হয়নি। মগটা কি নিয়ে যাব?
লানা বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখল, পাশে একটা টুলের ওপর অসমাপ্ত কফির মগ।
জেসি কখন কফি দিয়ে গেল? লানা কি কফি খেয়েছে? কফির মগে অর্ধেক কফি। আচ্ছা, লানা তো শুয়েছিল বিছানায়, বারান্দার রকিং চেয়ারে কখন এলো?

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here