চোরাবালি পর্ব ১৯

0
149

#চোরাবালি_১৯
রেশমা আক্তার

মনে হচ্ছে সুদীর্ঘ একটা টানেলে ফেলে দেয়া হয়েছে লানাকে। কিচ্ছু দেখা যাচ্ছে না কোথাও। লানা কেবল বয়ে যাচ্ছে ধাবমান সময়ের মত ক্ষিপ্রগতিতে। কতকাল, কতপথ পাড়ি দিয়েছে জানেনা সে। শরীর আর মনে তীব্র অস্বস্তি আর ব্যথা। কানফাটা একটা চিকন শব্দ যেন প্রবাহিত হয়ে যাচ্ছে সমস্ত শরীরের মধ্য দিয়ে।

তীব্র ঝাঁকুনি খেয়ে ঘুম থেকে জেগে উঠল লানা। বুকে অক্সিজেনের তীব্র ঘাটতি। বিছানায় ধড়মড় করে উঠে বসে জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিল সে। ধাতস্থ হয়ে আতঙ্কিত চোখে চারিদিকে তাকাল। এই তো সেই ঘর, বিশাল বেডরুম, দেয়ালে সাঁটা হলিউড তারকাদের পোস্টার। নরম শ্বেতশুভ্র বিছানা।

লানা কি তবে স্বপ্ন দেখছিল? না না, তা কি করে হয়? তাদের পিকনিকে যাওয়া, জোহারের হাই স্পিডে গাড়ি চালানো, ব্রেক ফেল হয়ে যাওয়া, তার গাড়ি থেকে লাফিয়ে পড়া আর তারপর সেই ভয়ঙ্কর দুর্ঘটনা। আগুনের লেলিহান শিখায় অন্ধকার হয়ে যাওয়া তার দুটি চোখ…

কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই বিছানা থেকে নামল লানা। আর তখনই দরজা খুলে ভেতরে ঢুকল জোহার। বলল
– তুমি উঠে গেছ? বেশ, শোন আমি মুনকে নিয়ে একটু শপিং এ যাচ্ছি, কাছেই। দু’একটা দরকারি জিনিস আনতে হবে। গতকালকের প্ল্যান মনে আছে তো?

লানা জোহারকে দেখেল অবিশ্বাস্য চোখে। জোহারকে আবার দেখতে পাচ্ছে সে, ভাবাই যায় না। লানা দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরল জোহারকে। চোখ বন্ধ করে বলল
– তুমি ঠিক আছ জোহার? মুন, মুন ঠিক আছে?

জোহার বিস্মিত, বলল
– হঠাৎ আমাদের আবার কি হবে? কি হল তোমার বলতো? কোন দুঃস্বপ্ন দেখেছ বুঝি?

লানা আরও শক্ত ও নিবিড়ভাবে জড়িয়ে থাকল জোহারকে। কোন কথা বলতে পারল না সে। জোহারও এবার একান্তে জড়িয়ে নিল লানাকে। মাথায় হাত বুলিয়ে চুমু খেল চুলে। বলল

– হঠাৎ হঠাৎ তোমার যে কি হয় সোহা, একদম চিনতে পারি না। এ যেন অন্য কেউ। যে আমাকে, মুনকে তীব্রভাবে চায়, ভালোবাসে। আসলে সারাক্ষণ তোমার বিরক্তি, অবজ্ঞা আর নিতে পারছিলাম না। কেন অমন কর বলতো?

লানা ছেড়ে দিল জোহারকে। জোহার হাসল। নিজেও আলগা হয়ে দাঁড়াল। বলল
– মুন অপেক্ষা করছে গাড়িতে। আমি যাব আর আসব। তুমি এদিকটা গুছিয়ে নিয়ে রেডি হয়ে থেক। তোমার হাতে মাত্র দু’ঘন্টা। সব রেডি আছে। আমি এসে শুধু তুলে নেব তোমাকে।

টনক নড়ল লানার। এসব ঘটনা কি আগেও ঘটেছে তার সাথে? তার মানে সে স্বপ্ন দেখেনি। স্বপ্ন কখনও হুবহু পুনরাবৃত্তি হয় না।

লানা জিজ্ঞেস করল
– কোথায় যাচ্ছি আমরা?
অবাক গলায় জোহার বলল
– কেন, কালকের প্ল্যান ভূলে গেলে? আজ আমরা পিকনিকে যাচ্ছি। এখান থেকে ঘন্টা দুই ড্রাইভ করলে দারুন একটা সাইট আছে। আমি, তুমি আর মুন যাচ্ছি। মুন তো খুব এক্সাইটেড। পিকনিকের জিনিসপত্র কিনতেই আমরা বের হচ্ছি। তুমি আর দেরী কর না। নইলে ফিরতে কিন্তু রাত হয়ে যাবে।

জোহার তার ওভারকোট টা গায়ে জড়িয়ে নিল। যাবার সময় আবার লানেকে টেনে নিয়ে চুমু খেল ঠোঁটে । এবারও শিহরিত হল লানা। কিন্তু আচ্ছন্ন হল ভয়ে। কিছু বলতে চাইল তীব্রভাবে। কিন্তু কোন ভাষা জোগাল না মনে।

জোহার আর দাঁড়াল না। লানাকে কিছু বলার সুয়োগ না দিয়েই বেরিয়ে গেল দরজা ভেজিয়ে। লানা যেন পাথর হয়ে গিয়েছিল। সম্বতি ফিরলে গিয়ে বসল বিছানায়। কি হচ্ছে এসব? একইরকম একটা দিনের শুরু? তারা আজ পিকনিকে যাচ্ছে। আচ্ছা ব্যাপারটা কি এমন যে, সে কাল রাতে একটা দুঃস্বপ্ন দেখেছে আজকের পিকনিকটা নিয়ে? কিন্তু আজ যাই ঘটুক না কেন, লানা আজ কিছুতেই এই পিকনিকে যাচ্ছে না।

লানা ওয়াশরুমে ঢুকে একটু ফ্রেশ হল, তারপর বেড়িয়ে এলো বাইরে। কি অদ্ভূত। কালকের মত একই দৃশ্য সামনে। একটু এগিয়ে আসতেই ডাইনিং টেবিলে বসে থাকতে দেখা গেল রিজভিকে। লানা দেখেই চিনল এবার, ইনিই রিজভি। এমনকি কাল তারসাথে কি কি কথা হয়েছিল তাও মনে আছে। লানাকে দেখে গুড মর্নি বলল রিজভি। লানাও অভিবাদন ফিরিয়ে দিল। একজন উর্দিপড়া লোক টেবিলে খাবারের প্লেট রেখে গিয়েছিল। লানা সেখানেই চেয়ার টেনে বসল। তার প্রচণ্ড ক্ষুধাবোধ হচ্ছে, তাকে আগে কিছু খেতে হবে। দেয়ালে বিশাল পেন্ডুলামের ঘড়িটায় প্রায় এগারোটা বাজে।
লানা খাবার খেল। তাকে দ্রুত শেষ করে রিজভিকে কিছু কথা বলতে হবে। তবে কোত্থেকে শুরু করবে বুঝতে পারছে না সে। কালকে যেভাবে শুরু করেছিল সেভাবেই বলবে নাকি অন্যভাবে?

– ড্যাড…?
রিজভি মুখের সামনের কাগজ না নামিয়েই উত্তর দিল
– বলো..
– ড্যাড তোমার সাথে কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা আছে আমার।
– বলো, শুনছি
– কাগজটা নামাও
রিজভি কাগজটা নামিয়ে তাকাল
– ড্যাড, মুন আর জোহারের সামনে ভয়ঙ্কর বিপদ।
ভাজ পড়ল রিজভির কপালে, তার চোখে প্রশ্ন।
লানা বলল
– ড্যাড, আমি সোহা নই। মানে আমার শরীরটা সোহার হলেও ভেতরের আমিটা ভিন্ন কেউ। এই যে আমি তোমার সাথে কথা বলছি, আমার নাম আসলে লানা। ব্যাপারটা অদ্ভূত, কিন্তু সত্যি। আমি আর সোহা কোন এক অদ্ভুত উপায়ে একে অপরের শরীরে স্থানান্তরিত হতে পারি। সোহা যখন চিটাগং বাংলোয়, আর আমি ঢাকায়, তখন প্রথম এটা ঘটে। আমি ঘুম থেকে জেগে দেখলাম, আমি বাংলোয়, সোহার শরীরে। ড্যাড তুমি কি আমাকে বিশ্বাস করছ?

রিজভি হতাশ গলায় বলল

– সোহা, প্লিজ তুমি নতুন করে কোন নাটক তৈরি কর না। এমনিতেই তোমাকে নিয়ে সারাক্ষণ যা হচ্ছে। এর চাইতে বেশী কিছু আর নিতে পারব না।

– ড্যাড, প্লিজ বিলিভ মি। আমি লানা। আমি বাংলাদেশে ‘হায়দার গ্রুপ অফ ইন্ডাষ্ট্রিজ’ এর মালিকের একমাত্র মেয়ে। আমি যা বললাম সব সত্যি। যেহেতু সোহা তোমাকে ড্যাড সম্বোধন করে, তাই আমিও করছি। কিন্তু বিলিভ মি, আমি এসেছি কিছুটা সামনের সময় থেকে এবং আমি জানি, জোহার আর মুন আজ একটা ভয়ঙ্কর বিপদে পড়তে চলেছে। প্লিজ তুমি কিছু একটা কর।

– সেই বিপদটা নিশ্চই তোমার কারণে হতে চলেছে, তাই না সোহা? তুমি আর কি চাও বলতো? তোমাকে তো আমি সব দিয়েছি। আর কি এমন আছে যার জন্য তোমাকে এসব ছলনা বা মিথ্যার আশ্রয় নিতে হবে?

– ড্যাড, প্লিজ একটু বিশ্বাস রাখ আমার ওপর। তোমাকে বুঝতে হবে আমি সোহা নই আর এই মুহূর্তে আমি এসেছি সোহার হাত থেকে মুন জোহার এমনকি তোমাদের সবাইকে রক্ষা করতে। প্লিজ, যে করে হোক আজকের পিকনিকটা তুমি বন্ধ কর।

– এ গল্পটা তোমার নতুন। ইন্টারেস্টিংও বটে। তবে তোমার এসব বাজে কথায় আমি মুনের আনন্দটা মাটি করতে পারব না।

লানা নিরুপায় বোধ করল। ঘোর লাগা গলায় বলল
– সোহা, মুন আর জোহারকে মেরে ফেলবে ড্যাড, প্লিজ তুমি সোহাকে থামাও। কেবল তুমিই পার ওকে থামাতে। তুমিই হয়ত জানো কিভাবে থামাতে হবে সোহাকে

রিজভি গম্ভীর মুখে নিউজ পেপারটা ভাজ করে রাখলেন। সোহার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি হেনে বললেন

– নতুন করে কি মতলব আঁটছ বলতো? তোমার জীবনে জোহারই তোমার রক্ষা কবচ। এমন একটা মানুষ সারা পৃথিবী খুঁজলেও পাবে না তুমি। ওর কোন ক্ষতি করলে তোমার পায়ের তলায় আর মাটি পাবে না সোহা। আর মুন? সে তোমার সন্তান। একটা বাচ্চা হারিয়েছ তুমি। আমি সতর্ক করছি তোমায়, যদি মুনের কিছু হয় তাহলে আমি কিন্তু তোমাকে ছেড়ে দেব না সোহা…

লানা কিছুক্ষন তাকিয়ে বলল

– এগজ্যাক্টলি ড্যাড। আমিওতো সেটা বলতে চাচ্ছি। সোহা এখন মুন আর জোহারকে শেষ করবে। আজ, আজই হয়ত সেই ভয়ঙ্কর এক্সিডেন্টটা ঘটতে চলেছে। তুমি জোহারকে থামাও। নইলে সোহা কি যে করবে….

রিজভি রাগত মুখে উঠে দাঁড়ালেন। বললেন
– এসব বাজে চিন্তা যেন আর তোমার মাথায় না আসে সোহা। আমি অনেক ক্ষতি মেনে নিয়েছি, অনেক যন্ত্রণা সয়েছি, অনেক প্রিয়জন হারিয়েছি। আজও শুধু আটকে আছি তোমার ড্যাডি ডাকটার মায়াজালে। নিজের ভালো চাইলে বাজে চিন্তা ছাড়ো। নিজের পরিবার নিয়ে সুখে থাকার চেষ্টা কর। মুন পিকনিকে যাবে বলে খুশিতে লাফাচ্ছে। আর তুমি এই সকালবেলা কি শুরু করলে?

রিজভি রাগত মুখে উঠে চলে যাচ্ছিলেন। লানা দ্রুত উঠে এসে তার পথ রোধ করল। বলল
– ড্যাড, সোহাকে বিশ্বাস না কর, লানাকে তোমাকে বিশ্বাস করতেই হবে। আর বিশ্বাস না করলে প্রমান কর। আমি যে লানা, সেটার প্রমান আমি দিতে পারব তোমায়। তাহলে বিশ্বাস করবেতো?

রিজভি গম্ভীর মুখে সোহাকে পাশ কাটিয়ে যেতে যেতে বলল
– আগে পিকনিক থেকে ফিরে এসো তারপর সব শুনব

লানা ঘড়ির দিকে তাকাল। সবকিছু ঠিক সময়মত ঘটছে। ইস আরেকটু যদি রিজভিকে বোঝানো যেত। লানার মনে হল, সেতো চাইলে রিজভির ঘরে গিয়ে তাকে আরও বোঝাতে পারে। কিন্তু মন চাইলেও লানা যেতে পারল না। খুব অদ্ভুতভাবে সে লক্ষ্য করল অনিচ্ছা থাকা সত্বেও সে নিজের ঘরে গেল, তৈরি হল আর তখনই সেই উর্দিপরা লোকটি এসে জানাল, জোহার চলে এসেছে, তাকে ডাকছে।

লানা ভূতগ্রস্তের মত চলে এলো বাইরে।
বাইরে এসে দেখল সেই আগের দৃশ্য। দু’তিনজন উর্দি পরিহিত নারী পুরুষ হাত বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে।
একটা ঝা চকচকে নতুন গাড়ি সামনে দাঁড়িয়ে। উপরটা খোলা। মুন বসে আছে পেছনে। জোহার সামনে। দুজনেই হাসছে।
জোহার কে সত্যিই আজ ভীষণ হ্যান্ডসাম লাগছে। মুনকেও কি মিষ্টি লাগছে। লানার চোখদুটো ছলছল করছে। তার চোখে ভেসে উঠছে প্রচণ্ড শব্দে আগুনের গোলায় গাড়ি উড়ে যাওয়ার দৃশ্যটা।
জোহার এসে হাত ধরে ঝাঁকুনি দিল লানার। লানার চোখের পানিটা গড়িয়ে পড়ল এ সময়। জোহার খেয়াল করল না সেটা। বলল

– সারপ্রাইজ..! ড্যাডের তরফ থেকে এই গাড়িটা মুনের জন্য উপহার। মুন আজ এটাতে চড়ে পিকনিকে যাবে।

লানা জোহারের হাত চেপে ধরল। ফিসফিস করে বলল
-জোহার, এই গাড়িটাতে আজ যাচ্ছি না আমরা

– মানে?
– মানে আজকের পিকনিকটা ক্যানসেল।
– কিন্তু কেন?
– কারণ আজ একটা ভয়ঙ্কর দুর্ঘটনা ঘটতে যাচ্ছে। আজ আমাদের গাড়িটার একটা এ্যাকসিডেন্ট হবে।
লানা রীতিমত কাঁদছে। খুবই অবাক ও বিরক্তবোধ করছে জোহার। সে কাতর স্বরে বলল
– সোহা প্লিজ আজ এমন কিছু করনা যাতে পিকনিকটা ক্যানসেল হয়ে যায়। মুন খুব কষ্ট পাবে। সবচেয়ে বড় কথা, ড্যাড ভয়ঙ্কর রেগে যাবেন।

লানা চোখ মুছল। তার মনে হল, একই ঘটনা ঘটছে। যদিও কিছু পরিবর্তন আনতে পারছে সে নিজে। কাল যা ঘটেছিল আজও তার পুনরাবৃত্তি হবে। কাল এ্যাকসিডেন্ট হওয়ার পর যখন সব শেষ হয়ে গিয়েছিল, আজ লানা আবার সেই দিনটা শুরু থেকে পেল। নাকি সময় আবার পিছিয়ে তাকে কালকের দিনে নিয়ে গেল?
এখন পর্যন্ত সবকিছু একই গতিতে চলছে। কিছু ব্যাপারে তার নিয়ন্ত্রণ থাকছে কিছু ব্যাপারে থাকছে না। কিন্তু পরিবর্তনটা কোথায় আনতে হবে বুঝতে পারছে না সে। তবু প্রতিক্ষণেই চালিয়ে যেতে হবে চেষ্টা। কি জানি হয়ত এটাই শেষ সুযোগ।
লানা বলল
– জোহার পিকনিকটা এখানে বড় ব্যাপার নয়। তুমি বোঝার চেষ্টা কর, আচ্ছা তোমরা কেউ আমার কথা মন দিয়ে শুনছ না কেন বলতো?

জোহার বলল
– আচ্ছা, আমি তোমার সব কথা শুনব এক শর্তে। তুমি পিকনিকে যেতে রাজি হও, আমি গাড়িতে বসে সব শুনব।
লানা যেন তাও কিছুটা ভরসা পেল। সে বলল
– এই গাড়িতে আমি যাব না।
কথাটা কেন বলল নিজেও বুঝল না। লানা তো জানে, এই গাড়িটা কোন প্রবলেম ছিল না।

জোহার হাত ধরে টানল লানাকে। লানা যে যেকোন শর্তে যেতে রাজি হয়েছে সেই ঢের। গাড়ি একটা হলেই হল। জোহার লানাকে টেনে নিয়ে গেল গ্যারেজে। সেখানে তিনটা গাড়ি দাঁড়িয়ে। জোহার দেখিয়ে বলল
– কোনটা তোমার পছন্দ বল, সেটাতেই যাব।

লানা ভাবছে, কিন্তু সিধ্বান্ত নেবার আগেই তার আঙুল নির্দেশ করল কালো গাড়িটার দিকে। জোহার দ্রুত গাড়িটায় গিয়ে বসল। লানা বলল
– জোহার গাড়িটা একবার চেক করে নাও। অনেক দূরে যাবে। সব ঠিকঠাক আছে কিনা দেখ।

জোহার কিছুটা বিস্ময় আর বিরক্তি নিয়ে বলল,
– লানা, তোমার কি জানা নেই যে, ড্যাডির এই গাড়িগুলো ড্রাইভ করা আর দেখাশোনার জন্য ঠিক কতজন লোক আছে? আমরা আজ পিকনিকে যাব বলে নয়, গাড়িগুলোতো এমনিতেইতো সারাক্ষণ মনিটরিং এ থাকে।

সেটা জানে লানাও। সত্যিইতো তাই

মুন বসেছে সামনে জোহারের পাশে। লানা একাই পেছনে। গাড়ি চলছে শাঁ শাঁ করে। মুন নিজের মনে বকবক করছে। মিউজিক সিস্টেমে বাজছে দারুন একটা লাউড টোন। জোহার মিউজিকের সাথে মাথা দোলাচ্ছে, গাইছেও সাথে মাঝেমাঝে। মুন খুব মজা পাচ্ছে। সেও চেষ্টা করছে বাবার সাথে। লানার বুকটা টিপটিপ করছে। সে শক্ত দু’হাতে আঁকড়ে আছে সিট। জোহারকে ডেকে বলল
– জোহার মিউজিক বন্ধ কর। আমার মাথা ব্যাথা করছে। আর আমার কথা শোন, তুমি বলেছিলে গাড়িতে আমার কথাগুলো শুনবে।

জোহার মিউজিক বন্ধ করল। বলল
– বল, কি বলতে চাও
লানা খুশি হল, এইতো কিছুটা পরিবর্তন আনা গেছে। সে যেটুকু বুঝেছে, আজকের ঘটনাটা ইচ্ছে করলেই পরিবর্তনযোগ্য নয়। শুধু সুযোগের অপেক্ষায় চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। লানাকে জায়গাগুলো খুঁজে নিতে হবে।

– জোহার, তোমাকে গাড়িটা খুব সাবধানে চালাতে হবে। মনে রেখ, এই গাড়িটা একবার হাই স্পিডে তুললে তুমি আর ডাউন করতে পারবে না।
– কেন? তুমি কি গতরাতে এটা নিয়ে স্বপ্নে দেখেছ? নাকি আজকাল তুমি জ্যোতিষী হয়ে গেছ?

জোহারের মুখভঙ্গিতে ছিল দুষ্টুমি, মুন তার ড্যাডের এমন ভাঁড়ামোতে মজা পেয়ে হাসছে খিলখিল করে।
লানা গুরুত্ব দিল না। তবে গম্ভীর স্বরে আবার বলল
– হ্যা আমি ভবিষ্যত দেখেছি। তুমি আস্তে চালাও। আর শোন, মুনকে পেছনে আমার কাছে দাও।
জোহার রাজি হল। বলল
– দাঁড়াও থামুক গাড়িটা
গাড়িটা ইতিমধ্যে লোকালয়ে ছেড়ে, খোলা প্রান্তরে ছুটছে। একটু পর তাদের গাড়িটা সেই পাম্পে এসে দাঁড়াল। জোহার মুনকে বলল
– আইসক্রিম…?
মুন উল্লাসে চিৎকার করে উঠল।
তারা গাড়ি থেকে নামল। কিন্তু নামল না লানা।

লানা ঠিক করল সে মুনকে আর সামনে বসতে দেবে না। মুনকে নিয়ে সে পেছনে বসবে আর শক্ত করে হাত ধরে থাকবে মুনের।

লানা গাড়ির একটা গ্লাস নামিয়ে দিল। কোন লোকজন দেখা যাচ্ছে না কোথাও। চারিদিকটা কেমন যেন শুনশান। হঠাৎ আচমকা জানালায়
একজন বয়স্ক লোক এসে চমকে দিল লানাকে। লম্বা তামাটে চুলগুলো ময়লা, অবিন্যস্ত ঢেকে আছে আংশিক মুখ। কোটরাগত দুটি চোখ। ভীষণ নোংরা পোশাক আর দাঁতগুলো। রহস্যময় হেসে হাত বাড়িয়ে দিয়েছে লানার দিকে।
– হেই সুইটি, গিভ মি সাম ডলারস, আই’ল গিভ ইউ সামথিং

লানা অত্যাশ্চর্য। কারণ এই লোকটা যে এখন আসবে সেটা তো জানত সে, অথচ একটুও মনে পড়েনি। তার তো জানালার কাঁচ নামানোই উচিৎ হয়নি।
লোকটা একটা হাত ঢুকিয়ে রেখেছে ভেতরে। সে এবার নরম গলায় বলল

– হেই, গিভ মি ডলারস, আই’ল গিভ ইউ সামথিং….মাই ডার্লিং , সুইটহার্ট….
লানার মনে পড়ল, এই কথোপকথন কালকেও হয়েছিল। লেকটা ইতিমধ্যে অন্য হাতে পকেট থেকে একটা মাদুলি টাইপ, সুতোয় বাঁধা নোংরা কাপড়ের পুটলি বের করে দেখাল। বলল

– আই’ল গিভ ইউ দিস…, গিভ মি ডলারস। আই’ম হাংগ্রি…

লানা ঘটনাটা বারতে দিতে চাইলনা। একহাতে নিজের গলায় ঝোলানো ছোট্ট ব্যাগটা হাতড়াল, যা পেল ছুড়ে মারল বাইরে। লোকটা হাত বের করে ছুটে গেল মাটিতে পড়া ডলার আর কয়েনগুলোর দিকে।

দূরে জোহার আর মনুকেও আসতে দেখা গেল। লানা ইতিমধ্যে গ্লাস তুলে দিয়েছে।
জোহার আর মুন একটু পরে ফিরে এলো বেশ কিছু খাবারের প্যাকেট হাতে। লানা ঘামছে ঠান্ডাতেও। জোহার বলল
– আর ইউ অল রাইট?
লানা সামান্য হাসল, বোঝাতে চাইল সব ঠিক আছে।

গাড়ি স্টার্ট দিল। জোহার একটা খাবারের প্যাকেট এগিয়ে দিল সোহার দিকে। লানা হাত বাড়িয়ে নিল সেটা। তবে এবার সে মুনের আপত্তি থাকা সত্তেও জোর করে টেনে মুনকে নিজের পাশে বসাল।

গাড়ি আবার ছুটছে। নিঃশ্বব্দে খাচ্ছে তারা।
গাড়ি ঢুকে গেছে পার্ক এরিয়ায়। সেই একই দৃশ্যপট। নিবিড় অরণ্য, পাহাড়, ঝর্ণা, পশুপাখি। একটু দূরে দূরে মাইলফলকের মত নানান ধরনের সতর্কবাণী। কেউ যেন প্রকৃতির কোন জিনিস ক্ষতি না করে। জোহারের গাড়ি চলছে একটা জঙ্গলাকীর্ণ জায়গার মধ্যদিয়ে একটা সরু, সর্পিল রাস্তায়। গাড়ির স্পিড মাত্রাতিরিক্ত। লানা সতর্ক করল জোহারকে।

– জোহার, আস্তে চালাও। তুমি তাড়াহুড়ো করছ। এখানে অনেক বন্য প্রাণী আছে। তাছাড়া এখানে এত স্পীডে গাড়ি চালানোর নিয়ম নেই। হাইওয়ে পুলিশ যেকোন সময় ট্র্যাক করে ফেলবে তোমাকে
জোহার আস্বস্ত করল, বলল
– আরে সোহা, এমন ফাঁকা জায়গায় ড্রাইভ করার থ্রিলটাই যদি না নিতে পারি তাহলে পিকনিকের মজা কোথায় বল? তুমি চোখ বন্ধ করে বসে থাক। আমি আর মুন এনজয় করি… হুর.. রে…..!
হাসছে জোহার। মুন উৎসাহ দিচ্ছে তার ড্যাডকে আরও জোরে চালাতে। মুনের মজা দেখার লোভেই হয়ত জোহার আরও সামান্য স্পিড বাড়াল।

লানা ধমকের সুরে বলল
– জোহার বি কেয়ারফুল। আস্তে চালাও, আমার ভয় লাগছে। শোন, তুমি সিট বেল্ট খুলে ফেল। কোন অসুবিধা বোধ করলে গাড়ি থেকে লাফিয়ে পড়বে কেমন?

হো হো করে হাসছে জোহার। লানার অবান্তর কথাগুলোতে মজা পেয়েই সে স্পিড বাড়ালো আরও।
মুনও আনন্দে চিৎকার করছে। লানা শংকিত। এ্যাক্সিডেন্টের সমস্ত আলামত প্রকাশ পাচ্ছে একটু একটু করে। জোহারকে কি ভূতে পেয়েছে? কেন মরনখেলায় মেতেছে ও?

লানা এবার তীব্র ও রাগত গলায় বলল
– জোহার, আমি বলছি আস্তে চালাও, স্লো কর গাড়ি।
জোহার এবার গম্ভীর হল, বলল
– সোহা, আমি কেন যেন স্পিড কমাতে পারছি না
– হোয়াট?
– হ্যা, চেষ্টা করছি।

লানা স্থবির হয়ে তাকিয়ে আছে সামনে। জোহার এবার কিঞ্চিৎ জোরে বলল
– সোহা, মুনের সিটবেল্ট খুলে দাও। গাড়ি কন্ট্রোল হচ্ছে না।

মুন ভয় পেয়েছে। সে এবার কাঁদছে শব্দ করে।
লানা মুনের দিকে হাত বাড়াবার বদলে দরজার হাতলে হাত রাখল।
হঠাৎ ধুম করে গাড়ীর সামনে কিছু একটা দৌড়ে এলো। সেই হরিণটা নিশ্চই। গাড়ির চাকা চলে গেল হরিণটার ওপর দিয়ে। গাড়িটা প্রচন্ড একটা বাঁক খেয়ে এবার ছুটছে এলোমেলো।
লানা চিৎকার করল
– জোহার, তুমি লাফিয়ে পড়। আমিও মুনকে নিয়ে চেষ্টা করছি।
জোহার প্রাণপণ গাড়িটা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করতে করতে বলল
– আমাদের ভয়ঙ্কর বিপদ সোহা। তুমি মুনকে বাঁচাও। ওকে নিয়ে লাফিয়ে পড়। লানা অদ্ভুত চোখে তাকিয়ে আছে ক্রন্দনরত মুনের দিকে। তার এখন মুনের সিটবেল্ট খুলে ওকে নিয়ে লাফিয়ে পড়ার কথা কিন্তু তা করছে না। একটা বিশ্রী অনুভূতি আসছে মনে। লানা নিজের দিকের দরজাটা ধরে ঝাঁকাচ্ছে এখন।

জোহার যেন সামনে নিজের মৃত্যু দেখতে পাচ্ছিল। বনভূমি ছাড়িয়ে গাড়ি এখন উঁচুনিচু পাথুরে পাহাড়ের মধ্য দিয়ে এঁকেবেঁকে হোঁচট খাচ্ছে। জোহারের হাতের স্টেয়ারিং ঢলঢল করছে। জোহার অবিশ্বাস্য চোখে দেখছে সেটা। এটা হবার কথা নয়। গাড়িতে কী কোন যান্ত্রিক ত্রুটি ছিল আগে থেকেই? সোহা এতক্ষণ কিসব বলছিল, সবই তো ঘটছে। জোহার চিৎকার করে বলল
– সোহা, তুমি মুনকে বাঁচাও। গাড়িটা আমি বাঁচাতে পারব না

সামনে একটা বড় পাথরের দিকে ছুটছে গাড়ি। নিশ্চিত ভবিতব্য, চৌঁচির হয়ে যাবে গাড়িটা। লানা চিৎকার করে বলল
– জোহার আই’ম সরি… আমি কিছুই পারছি না করতে…আই’ম সরি জোহার……

লানা দরজা খুলে নিজেই ঝাপ দিল বাইরে। কয়েকটা উল্টি খেয়ে পাথরে ধাক্কা লেগে স্থির হল সে। আর তার কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই গাড়িটা তীব্র বেগে গিয়ে ধাক্কা খেল বিশাল পাথরটার সাথে। প্রথমে উল্টি খেল দুইবার , তারপর স্থির হল। গাড়ির ভাঙা অংশগুলো বিচ্ছিন্ন ছড়িয়ে পড়েছে চারিদিকে। লানার চোখের সামনে অদূরেই বিধ্বস্ত গাড়িটা।

লানা চিৎকার করে জোহার কে ডাকছে। ডাকছে মুনকেও। কারও সাড়া নেই।
লানা হামাগুড়ি দিয়ে উঠতে গিয়েও পড়ে গেল ধপাস করে। তার মাথায় তীব্র যন্ত্রণা। লানা প্রাণপণ উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করল। দূরে কোথাও পুলিশের গাড়ির হুইসেল শোনা যাচ্ছে।
লানা ভয়ার্ত চোখে দেখছে বিধ্বস্ত গাড়িটা। এখনই ঘটবে সেই ভয়ঙ্কর ঘটনাটা। লানা হাত জোড় করল, মনে মনে বলল, ” ও গড, হেল্প মি”, এক পা টেনে সামনে এগোলো লানা। আর তখনই প্রচন্ড বিস্ফোরণে, আগুনের গোলায় উড়ে গেল গাড়িটা। প্রচন্ড ধাক্কায় পেছনে বহু দূরে এসে ছিটকে পড়ল লানা। মুহূর্তে অন্ধকার হয়ে গেল তার দুনিয়া।

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here